রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০০৯
কবি সাঈদ জুবেরীর কবিতা
নৈঃশব্দ্যের সেতু
.........
তোমাকে সেতুর উপর দাঁড়ানো দেখে মনে হলো
প্রতিটা মানুষই সন্ধ্যাভাষায় নির্মিত একেকটা সেতু
যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে দারুণমুখরব্যাকুল দরিয়া
আর সেতুটি নৈঃশব্দ্যের শব্দার্থে চলে যাচ্ছে...
আমিও যেইমাত্র একটা সেতুর উপর উঠে পড়েছি, তক্ষুণি
আবহাওয়া অফিস থেকে বিপদসংকেত পাঠাচ্ছে
সেতু নড়ে উঠছে, আমি তাতে চড়ে উঠছি; উঠতে উঠতে
জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া একটা সেতুর নিস্তব্ধতা টের পাচ্ছি
তুমি কি এখনও দাঁড়িয়েই আছ-
সন্ধ্যাভাষায় নির্মিত একটা নৈঃশব্দ্যের সেতুর উপর।
বর্ণপরিচয়
.........
সারাদিন বসে বসে কাটিয়েছি দিন
দিন কাটে নাই, শুধু
আমি রক্তপাতহীন কেটে দু’ভাগ হয়ে গেছি
আর আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে-
বিগতদিন, দিনের আলোক সম্ভাবনা নিয়ে
রাতের দিকে ক্রমাগত হেঁটে যাওয়া
রাতের গভীর থেকে একটা ব্লেড এসে
জড়িয়ে ধরত আমার শরীর
আমি তাকে ঠোঁটে নিয়ে দৌড়ে গিয়েছি সকাল বরাবর
প্রতিটি সকাল আমার দিকে রক্তচক্ষু তাকিয়ে থাকতো
যেন হেডমাস্টারের নালিশ শুনে বাড়ি ফিরে
আমার অপেক্ষায় বসে আছেন বাবা
আমি থমকে যেতাম আমার মার্বেল নিয়ে বাবার সামনে
আমি মুখের মধ্যে রক্ত লুকিয়ে দুপুরের দিকে চলে যেতাম
আমি সারাটা দুপুর পুকুরে ডুব দিয়ে থাকতাম
গোধূলিতে জেলখানার দেয়ালে কান পেতে শুনতাম
এই পৃথিবীর কয়েদীদের গান
পরে বুঝেছি তা ছিল কান্না
রেললাইন
..........
উড়তে উড়তে আমারই দরজায়
লটকে গেছে ঘুড়ি, পাশে নগ্নিকা
আছেন জন্মাবধি শবাসনে
যখন যীশুর হাত দুটো কেটে নেয়া হলো
এ গাঁয়ে কখনো রেলগাড়ি আসে না
কিন্তু বালকেরা রেললাইন চেনে
বৃদ্ধরা কোনদিন না দেখেও শিশুদের রেল স্টেশনের গল্প শোনায়
আর মৃতদের দেশে রেল যোগাযোগই নাই
শীতকালে কেন প্রলম্বিত হয়ে যায় রাতের প্রহর
ডায়ালে ঘূর্ণায়মান কাঁটা বন্ধ রেখেই সময় মেপে নেই
ভয়, পাছে রাতের বড়ত্ব যদি টুকরো টুকরো হয়ে যায়
অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে শেকড়ের প্রকৌশলে
চলে যাবো- হে মৃত্তিকা হে ব-দ্বীপ তোমার গভীরে।।
দ্য ট্রেন
.......
পথের মধ্যে বিরাম চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা
কয়েকটা বিকাল আমার দেখা হয়ে গেছে
বিরতিহীন রাত্রির ট্রেন ধরব বলে বসে আছি সম্পর্কের জংশনে
ট্রেন এসে গেলে পর; আমি তার একমাত্র অপেক্ষাতুর যাত্রী
ব্যাগ ভর্তি ঘৃণার সরঞ্জাম, পায়ে নিঃসঙ্গতার জুতা...
ঘুম ভাঙতেই দেখি, চাদরে ট্রেনের চাকার দাগ
বিছানা থেকে নেমে সেই ট্রেন খুঁজে বেড়াই
বউকে জিজ্ঞেস করি; রাতে কোন হুইসেল শুনেছে কিনা
সে বলে, তার প্রতি সকালে ট্রেন ধরতে হয় তাই সে রাত্রি জাগে না।
কনফেশন-১
(উৎসর্গ : জীবনানন্দ দাশ)
...............
সব কিছু জানা হলে পর- ক্লান্তির নিরলস প্রান্তরে
সব কিছু অজানা মনে হয়, এমনই অসহায় আজ মনুষ্য মজলিস
তেমন উচ্ছ্বাস নেই আর শুধু হৃদয়ের অন্ধকার
বের হয়ে পড়ছে ক্রমশ- আমি তারে আলোকিত উদ্ভাস ভেবে
সঙ্গে নিয়ে শুয়ে থাকি চাদরের উপর
অনেক অনেক দিন শুয়ে শুয়ে থাকি- যদি কোনদিন
সময়ের আঘাতে একটি ছিদ্র খুঁজে পায়
আলো আসবার আমার নিষ্পলক চোখের দরজায়, তবে
স্বপ্নের পাতা দিয়ে মুদিতাম চোখ
অযুত স্বপ্ন দেখে জেগেছি নিযুত দুঃস্বপ্নের ঘোরে, এ যেন
সেই অব্যর্থ নার্সিসাস নিয়তি তুমি যাকে পার না এড়াতে
বরং এড়াতে গিয়ে জড়িয়ে ফেলার মত ভুল
আমি সাথে নিয়ে বাঁচি সাথে নিয়ে মরি
জীবনের সুতীব্র অনুশোচনায়-
তোমাদের চেনা হয়ে গেলে কেমন যেন অচেনা মনে হয়।
জীবনানন্দ দা, তোমাকেই চুপিসারে বলি
শীতনিদ্রা রহিত এ প্রলয় বিক্ষুব্ধ নিঃসঙ্গতায়
আমিও হাজার বছর হেঁটে, গিঁটে গিঁটে ব্যথা আর
বিতৃষ্ণা নিয়ে পথের চলার কত ধুলোবালি মেখে
দেখি সমান্তরাল আরো এক পথ- যে পথে ঢের হাঁটা হয় নাই।
আজ তবে দৃশ্য বদলের মত করে অদৃশ্য হয়ে যাই
যেখানে কেউ নাই- কেউ নাই ফাঁকা- তবু তো ভারি কোন
ঘড়ির কাঁটা এসে নিস্তরঙ্গ ভাবে
বৃদ্ধের সঙ্গী হয়ে ফুটে ওঠে মুখের বলিরেখায়।
এরকম কোন কোন দিন কোন কোন রাত
চুপচাপ শিশিরের সাথে ঝরে পড়ে অথবা একটি বৃক্ষ ছেড়ে
আরো কোন সঠিক বৃক্ষের দিকে রাতজাগা পাখিদের ডানা
ঝাপটিয়ে ওড়ে- সেই সব মুহূর্তগুলোয় খুব বেশি মনে হয়
এখন অনেক রাত পৃথিবীর বুকে।
একোন বিনিদ্র নেশায় মগ্ন থেকে
ঘুমের প্রশান্তি মনে করে জেগে আছো ‘দীর্ঘদিবস-দীর্ঘরজনী’
হৃদয়ের গিটারের সুর চিরদিন বেজে ওঠে বেদনা বিধুর
কেউ তার নোট খুঁজে আঙুলে বাজাবে না
এরচেয়ে দেখ শুকতারা জ্বলে আছে ঐ
জ্বলনে এমন সুখ কেউ বোঝে নাই।
বিগত রাতে আমি শীতের নিকটে নগ্ন হয়ে
সকালের রোদে বুঝতে চেয়েছি শীতলতা
বিলোড়িত কামুক চেতনায় দারুণ অবদমনের জাল ছিঁড়ে
বারংবার দৌড়ে গিয়েছি বাঈজীবাড়ি
তবু পৃথিবীর সেই সব নারীর রূপ ঢের দেখা হয়ে গেলে
আরো একবার দেখার সাধ সুপক্ব ফলের মতো
আমার নির্ঘুম দোসর হয়ে থাকে।
হাসপাতাল
.........
এই পৃথিবী এক গোপন হাসপাতাল
আমি তার রোগী ডাক্তার ও নার্স!
মানুষের দিকে তাকালে শুধু হাসপাতাল দেখি-
রোগী, ডাক্তার ও নার্স সমেত একেকটা
গভীর হাসপাতাল জামাপ্যান্ট পরে গোপনে চলাচলরত।
অনেকদিন পর জানলাম, এটাই
আমার একমাত্র পরিত্রাণহীন রোগ;
তবু গোঁয়ারের মত-
শরীরে রোদের ইনজেকশান নেই
যখন চেতনা আমার অস্ফুট সেবিকা।
রোদকে বলি- তুমি আরো তীব্র হও
চেতনাকে বলি- তুমি হয়ে ওঠো ধারালো
আলোক-ছটায় ছুরিটাই চমকালো
ছুরি দিয়ে কাটি বুক কাটি পা কাটি হাত
যখন আমিই আমার রোগী ডাক্তার ও নার্স।
একটা গাছের কনফেশন
..............
মরা গাছ, অপেক্ষায় আছি কুঠারের।
সবুজ ছিলাম, জীবিত ছিলাম
ডালে ডালে পত্র পল্লব আর শোভিত কুসুম ছিল
ছিল পাখিদের নিত্য আনাগোনা
আমারই কোটর হতে শীতঘুম ভেঙে
এক সাপ নেমে যেত জনপদে
আমার কাণ্ডের এক পাশে
প্রেমিক চলে যেত প্রেমিকার দেশে
তাদের শীৎকারে
ওপাশের নিঃসঙ্গ যুবকের চোখে
জ্বলে উঠত তারা, স্খলনের ঘুম।
মরা গাছ, অপেক্ষায় আছি কুঠারের।
শুনেছি সেই নিঃসঙ্গ যুবকটি এখন জ্বালানি কাঠ বিক্রেতা
শহর বন্দর হতে মৃত গাছ খুঁজে নিয়ে যায়
শুনেছি সেই প্রেমিক যুগল এখন
দাম্পত্য কলহ সেরে প্রতিদিন
পাশ ফিরে শুয়ে থাকে সারারাত, সঙ্গমরহিত।
এখন মরা গাছ, অপেক্ষায় আছি তোমাদের
হে যুবক তোমার নিঃসঙ্গতার কুঠার নিয়ে এসো শেষবারের মতো
আমাকে কাটো, ব্যবচ্ছেদ করো, করে তোল সার্থক জ্বালানি
অবশেষে পৌঁছে দাও সঙ্গম রহিত সেই দাম্পত্য উনুনে...।
সিনেমার ঘোড়া
..........
এক ছুটন্ত তেজী ঘোড়া শুধু দাপিয়ে বেড়ায়
তার তেজস্ক্রিয় নিঃশ্বাসের লু এসে লাগে নাকে মুখে
তার খুরধ্বনি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি
দারুণ ঘোড়দৌড়ের অভিঘাতে ঘুম ভাঙে
অথচ সওয়ারতো দূরের কথা
তার নাগালই পাই না কখনও, তবু
বেশ টের পাই চোখ থেকে কচলে ঘুম ওঠাতে ওঠাতে
খুরধ্বনি আমাকে কেন্দ্র রেখেই পরিধি বাড়ায়...
সব কিছু ম্রিয়মাণ হয়ে গেলে-
সিনেমার ঘোড়াগুলোর কথা মনে হয়
-ওরা রেলগাড়ি ধাওয়া করে
নায়ককে পৌঁছে দেয় নায়িকার কামরায়...
আমার ঘোড়াটি কি তবে সিনেমায় চলে গেলো!
কিন্তু তা কি করে হয়, আমার মাথায় তো এখনো
ছুটন- খুরের আঘাতে ধুলার ঝড় বইছে....
তবে কি খুলির ভেতর শ্যুটিং ইউনিট
তবে কি খুলির ভেতর গান পাউডার মারমার কাটকাট
তবে কি খুলির ভেতর রেলগাড়ি ধাওয়া করে ফেরা
তবে কি খুলির ভেতর নায়ক নায়িকা ক্রন্দন
তবে কি খুলির ভেতর ভিলেনের অট্টহাসি
তবে কি খুলির ভেতর একটা ঘোড়দৌড়ের মাঠ।
প্রতিবেশী
........
নতুন গোরস্থানের প্রথম কবরটি
পায়ে চলা রাস্তার পাশে হয় কেন!
মৃত লোকটি তবে কি পদশব্দে বুঝে নিতে চায়-
যে সকল পায়েরা তাকে অতিক্রম করে যায়
আসলে তারা বহুদূর ঘুরে তার কাছে আসে...
জীবন কি এরকমই বটে... “আমাদের এতুটুকু সান্ত্বনা...”
মাঝে মাঝে অনেক রাতে নিসঃঙ্গ কবরটির পাশে গিয়ে বসি
ভাবি কে হবে তোমার প্রথম প্রতিবেশী
আর মনে হয়
এ পৃথিবী মৃতদের আবহমান সৎকারখানা
রক্তবৃত্ত
......
এক ফোঁটা রক্তের ভেতরে দেখি
রীতিমতো এক নদীর আস্ফালন
যা খুশি লেখার মতোই তার স্রোত
মোহনার দিকে যায় না কখনই
এক ফোঁটা রক্ত জমাট বেঁধে আছে টেবিলে
আমি তার মালিকানা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ
আঙুলের কাটা দাগ ভেঙচিয়ে শরীরে শুধু
ব্যথার স্মারক উপহার দিয়ে যায়
আমার রক্তের নাশকতাময় একটা প্রবাহ
ফোঁটায় ফোঁটায় নদী বইয়ে দিতে চায়
আমি বাধ্যগত, ছুরি চালাই- ব্লেড চালাই
দেখতে দেখতে টেবিলময় রক্ত ফোঁটা ফোঁটা
দেখতে দেখতে রক্তবৃত্তে নদীর দাপাদাপি
হুলস্থুল টেবিলটাতে উল্টে পড়ে থাকি।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন