রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০০৯

কবি অভিজিৎ দাসের কবিতা










ইউনিফর্ম
......
নিজের জন্মের দুই যুগ পরে প্রসুতিসদনে গিয়ে দেখি
এক প্রবীন দর্জির কারখানা।জন্মকেন্দ্রের ইতিহাস নির্মাতা
মায়াদৃস্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন সুর্যের মাতৃগর্ভে আর
সেখানে বৃত্তাকার এক দোলনায় দোল খাচ্ছে আমার
আতুরঘর।এই দর্জিকে আমি শৈশবে দেখেছি
লালা ঝরবার কাপুড়ে ঝুড়ি বানাতে,আজ উল্কা
ঝড়ের এই রক্তবর্ণ রাতে,যখন চাঁদ ও সুর্য
একই প্রান্তরে গড়াতে গড়াতে একে অপরকে
করছে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া,আমারই জন্মের
দুই যুগ পুর্তিতে প্রসুতিসদনে জন্মচিন্হ খুজতে এসে
দেখি,সবুজ এপ্রনে ঢাকা সেবিকারা ঝোপের
ভেতর দাড়িয়ে গাছ সেজে দুলছে,তাদের মধ্যে
কেউ সেজেছে বকুল,কেউ সন্ধ্যা মালতি
আবার কেউ আমলকি,আর জন্মকেন্দ্রে বসে
একজন প্রবীন দর্জি সেলাই করছেন শবদেহের
পরিধেয় জীবাশ্ম দিয়ে তৈরী মৃত্যুর ইউনিফর্ম।


মহামায়া
........
এখনো শরতে আমি তোমার চাইতে প্রিয় কোনো
মুখ দেখি না তো-মন্ডপের ভিড় ঠেলে
সপ্তমী সন্ধ্যায় ওহে ভুবনেশ্বরী আজো খুঁজে যাই
বেগুনী রঙের মায়া-সম্মোহনী পূজোর পোষাক,
যে পথে গিয়েছ তুমি সেই পথ ছুঁতে গিয়ে
অবাক মেঘলা গিরিখাতে দেখো ভাসমান
এই আমি;নিঃসন্গতা আমাকে টানে না-
দেখি সফলতাকামী মানুষেরা অপরিচিতের
মত যাদুপথে যেতে গিয়ে শারীরিক হতে
ভালবাসে,আমাকে দেখলে তারা দু'একটি
বাদাম খেতে দেয় -
এবার পূজোয় তাই তোমার দেবীর মুখোমুখি
হয়ে বলে দেব সাফকথা,যে যাই বলুক
ওগো মহামায়া শোনো,উচ্চাশার চেয়ে
আদিগন্ত ভালবাসা নিয়ে যেন বিসর্জিত না হই-



ভাঙ্গা আয়নার প্রতিবিম্বগণ
...............
একটি ভাঙ্গা আয়না তোমাকে শিখিয়েছে কিভাবে প্রতিবিম্বগণ নিজেরই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে
প্রকাশ্য ময়দানে ইহলৌকিকতার দুর্নাম রটায় । যে সকল অপবাদকে তুমি প্রশংসা
পদবাচ্য মেনে গভীর রাতের পথে গেয়ে গেছ উন্মাদগীতি ,তাতে প্রশাখাবহুল নক্ষত্রও
মাথার ওপরে ফেলেছে তীর্যক রশ্মির ফলা আর নগরের সমাধিস্হ তন্দ্রাহীন প্রেতেরাও
তোমার বেসুরো কন্ঠের বৈতালিক লয়ে বিদ্রুপে ইঙ্গিত ছোড়ে ,তুমি কি এখনো তবে
গেয়ে যাবে পুরোনো সে শুকনো পাতার সুরে শীতের সংগীত ?

আহা! বসন্ত জাগ্রত দ্বারে .......

ভোরবেলা দেখো যদি পরিত্যক্ত প্রতিবিম্বগণ তোমারই শবাধার কাঁধে নিয়ে সবুজ
পাতায় ঢেকে রেখে গেছে তোমারই দুয়ারে, তবে গোপনতাকামী স্মৃতির পোকারা
যেন শতচ্ছিন্ন তোমার শরীর খোদাই করে লিখে রাখে "তিনি, কবি, নিজেরই প্রতিবিমম্বগণ
যার হন্তারক"।



গানের অবসানে
..........
সেই সুর বেজে ওঠে নাকো আর
পালাবদলের ক্ষণে পড়ে কি তাহারে মনে

ঘোরগ্রস্ত মুগ্ধতার কালে...
কদাচিৎ যেই গান বেজেছিল

পথের মানুষ হয়ে পথ ছেড়ে
কতদূরে আর যাওয়া যেতে পারে


নিকটে সমুদ্দুর মেলে রেখে
অপরাহ্ন মরুতে পোহালে !

দূরে সীমারেখা মুছে মরাকটালের ঢেউ
প্লাবিত করুক অশান্ত নীলিমা

এই দ্রাঘিমায় মেঘ সৌরচিত্র ঢেকে দিলে
আঁধারের সুরে ভেসে থাকি

স্রোতের বিরুদ্ধগামী জলপোকা তবু
কচুড়িপানার চেয়ে মহত্তর বোধ নিয়ে

প্রতিকূলে ভেসে রয়
জলজ গানের তানে...



শ্রুতি-প্রতি-বিশ্রুতি
...........
যা কিছু বিরহের চিহ্ন রয়ে যায়-অবয়ব হতে খসে পড়া একটি দুটি
ব্যথাতুর দৃশ্যরাগ-ধ্বনিময় পিপাসা সংবেদ !
তোমাতে সমর্পিত হল এসে ধমণির অসহ প্রবাহ,অনুরাগ
এই গতিময় চেতনযাত্রায় বেদনা তাড়াতে অপারগ আমার মজুদকৃত
আনন্দরাশি ব্যর্থতার ক্লেশে ঝিমোয় বসে আমাদের দূরবর্তী সম্পর্ক চৌকাঠে, সকল খুনসুটির মধ্যে একটি দণ্ডায়মান আলপিনের দৃঢ়তা আরোপ করে যতটা নিরাপদ হলে ঘুমোতে যাও-আমি পতঙ্গস্বভাবে
কেটে দেই তোমার শিথানে ছড়িয়ে থাকা অবিন্যস্ত স্বপ্নজাল!

নিয়মানুগ বিরহকাতরতা ছিলনা তাই তরল স্বপ্নেরা মাথার ভেতর যে প্রবাহে নেমে আসে তার গতিমুখ উর্ধ্বগামী তবু বাস্পীভূত বেদনার
মেঘে তোমারও আকাশ ঢেকে গেলে আমি ফের দখিন হাওয়ার বেশে
মেলে দেব হা-খোলা মেঘের দুয়ার!



তুমি ও তুমিহীন আমার গোয়েন্দা সত্তা
..........................
তোমার নিকট থেকে ফিরে এসে
পদ্য লিখব বলে বসি নিরালায়
ভবিষ্যতের ধারাবিবরণী ফনা তুলে ছুটে আসছে
দেখি, অতীত রোমন্থনও নিরাপদ নয়

আত্মহননের পূর্বে যে স্বীকারোক্তির দাবাছক
খুলে ধরে তোমার সম্মুখে বসে বারংবার পরাস্ত হয় হয়েছি
তুমিহীন তোমার সাক্ষাতে তবু গোয়েন্দা সেজেছি
অসাড় আতসকাঁচে অজ্ঞাত মেঘের ইউ টার্ন

আগামীকালের হাতে যখন নিথর হল
প্রত্যাখ্যাত বিগত ও আজ
হৃদয়ের প্রবেশদুয়ারে যুক্তির উল্লাসে কাঁদে
অনতিক্রমনীয় শূণ্যতা

অথচ সংলাপসম্মত বিরহের চিত্রনাট্যে
কোনো শর্ত, চুক্তিপত্র ছাড়া
আত্মঘাতী হতে সাধ হলে
কেন তুমি ফের হয়ে মুখোমুখি
লিখিয়ে নিচ্ছো
ভবিশ্যৎ শূণ্যতা ভরাট করতে
এই ব্যর্থ পদাবলী!



অস্হিরতা
........
সকল অস্থিরতাকে একটা বীজের মধ্যে পুরে দিয়ে
মাটিতে পুতে রাখলে কিছুকাল অপেক্ষার পরে
একটা বিতৃষ্নার চারাগাছ গজিয়ে উঠতে পারে
এমন একটা বিতৃষ্না বৃক্ষকে আমি পেলেপুষে বড় করে তুলতে চেয়ে
সবার অলক্ষে তার পরিচর্যা করে চলেছি বহুকাল

আমার অস্হিরতার বীজ যাতে ছদ্মবেশী কোনো প্রেমের হাতে
অংকুরেই বিনস্ট না হয়-তার জন্য প্রহরায় রেখেছি।
সদা সতর্ক সন্দেহ প্রবণতা
একটি সন্দেহ অপর সন্দেহের দিকে তাক করে আছে
ঈর্ষাকাতরতার বল্লম
কখন যে এ ওকে গেথে ফেলবে ধারালো মুগ্ধতায়!
আর নিরবতাহীন আমার অন্তর্গত অস্হিরতার বীজ
তার খন্ডিত অবয়ব নিয়ে আমাকেই ধাওয়া করবে....
হতে পারে বিতৃষ্নার বৃক্ষ নিধনের দায়ে অভিযুক্ত
আমাকে তখন আশ্রয়ন খুঁজে পেতে যেতে হবে বনভূমে

আমার অস্হিরতা বীজের গহীনে নৈরাশ্যে নামের
রিনরিনে কান্নার শীতল একটা জলপ্রপাত
বয়ে চলে অনর্গল।


কবিতা : পাখি বিষয়ে যৎসামান্য আরেকবার
০৩ রা এপ্রিল, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:১০
শেয়ার করুন: [Add to digg] [Add to FURL] [Add to blinklist] [Add to reddit] [Add to Technorati] [Add to YahooMyWeb] [Add to Co.mments] [Add to NewsVine] Facebook [new feature]

১.
সব পাখি ঘরে ফেরে
যে পাখির ঘর নেই তারও আছে ফিরবার তাড়া
খড়কুটো-বিচালি ছড়িয়ে রাখা উষ্ণতার ওমে
ঝড় এলে তারও বুক কাঁপে
কামার্ত ডানায় সেও ঠোঁট রাখে অন্য পাখির পালকে

আমাদের পাখিগ্রহে
যে পাখি জানে না গান-তারও প্রাণে
বেজে ওঠা বিস্ফারিত বেদনার ধ্বনি
আমরা শুনি না,
অথচ যে গৃহত্যাগী পাখি
গৃহ নির্মাণের কলাকৌশল সমূহ প্রনালীসহ
আমাকে শিখিয়ে আকস্মাৎ
ডানা মেলে জুড়ে দিল বাউলা উড়াল,
তাকে কি করে ফেরানো যাবে-
আকাশ সীমান্ত ভেঙে তার গান
ভিনদেশী পাখিদের কানে পৌছোবে
আর কি সর্বনেশে
কাণ্ডটাই না ঘটবে যখন
পাখির বাসার জানালা দিয়ে
তাকিয়ে এসব দেখব আমি !

২.
ঘুমোলে পর সেই পাখিটি এসে
আমার বুকের লোম ঠুকরে তোলে
(ওর শয্যা বানাতে নাকি এসবই চাই)

আমার যখন জেগে উঠবার সময়
পাখিটা তখন ঘুমোবার আয়োজন করে
(ওর শয্যাসামগ্রী বলতে গতরাতে আমার
বুক থেকে তুলে নেয়া লোমের স্তূপ)

জেগে দেখি আমার বুক থেকে রক্ত
ঝরে ভিজে গেছে স্লিপিং গাউন
( ওর তীক্ষ্ণ ঠোঁটের ধারে আমার
বুকে তৈরী হয়েছে ক্ষত )

এরপর আমি আমার বুক কাউকে দেখাইনি আর
(পোশাকের আবডালে সেই ক্ষত লুকিয়ে রেখেছি)

পাখিটি ঘুমোলে আমি ওর ডানাদুটো
খুলে নিয়ে দেখব ওড়া যায় কিনা
(চেষ্টা করে দেখা যাক, যদিও পাখির চেয়ে
মানুষের ওজন বহুগুণ)




যৌথপ্রয়াস(অভিজিৎ দাস ও মুয়ীয মাহফুজ বিরচিত)
...............................
যে পাখি অচিন হয়ে থেকে গেল দেহের খাঁচায় অন্তরীন
শুভ্রতর ডানা নিয়ে উড়ে যেতে বলো তাকে শান্তির স্ব-পথে
গতকাল যার চোখে সুপেয় অমৃত দেখে ঠোঁট নেড়েছিলে
আজ রাতে তার মুখ বিষাদে আবৃত হয়ে কাঁপায় তোমাকে

তুমি মানে আমাদের সে,তিনি বা তাহারা ক'জন
নিজ আয়ুরেখা নিয়ে বক্রতর বৃত্তের গোলক
জ্যামিতি না জেনে শুধু কেন্দ্রভূক বিন্দু গেঁথে রাখে
হৃদয়ে অমেয় ব্যাধি প্লাবনে যাপিত এই শোক!

যে পাতক অতি পরিচিত রুপ দেখিয়ে হয়ে গ্যালো বিমুর্তাক্ষর ছন্দে
শুভ্রভাব তার তবে তাপিত রুপ দেখে অন্ধের রঙে,বিজন!
অবিকল যন্ত্রের রুপে তবে তার দৈহিক রুপে কিংবা চোখে
নির্ভরতা অনুভব হয় কিন্তু অবশেষে রয়ে গ্যাছে পলায়ন!

"তথৈবচ" বলে বলে আরো কিছু দিন কাল কেটে যাক,
ওপারের সবুজ বলান্চলে বৃক্ষপতনের ডাক শোনা যাক।
মৃগনাভি তার ব্যাক্তিগত গন্ধে যে দিন কাটাচ্ছে তা ভালো কি মন্দে,
এইকথা কোনো এক উন্মাদ তার নিজ মনে কিন্তু জোর উচ্চারণে
তোমার কানে কানে এসে বলে যাক,
রক্তঋণ কিছুটা পূরণ হবে,কেউ জানবে বা কে খুণী এমন ভীষণ রণে।

তোমার অন্ধত্ব নিয়ে অরণ্য ঝড়ের খুব প্রিয় হলে বুঝি
দিব্যদৃস্টিরেখা ধরে খুঁজেছ সরল কোনো পথ!
এই বেলা আমি হতে আমার দূরত্বে তাই খুঁজি
মূর্তমান বাস্তবের অলীক বিমূর্ত অবয়ব

সেই ঘোর কেটে যাবে নাকি কাটবে নিজেই ঘোর
অপরের মলিনতা স্বরুপে ধারণ করে সুঘণ নিভৃতে
যেই ঘরে বসতি গড়েছ,নিজেই সেজেছ চোর!
যতটা আসক্তি নিয়ে ফিরে গেছো কামার্ত আবেশে।

তরিতাবেশ ঘিরে ধরে আততায়ীর আশীর্বাদ বা নির্দেশে
আততায়ীরা অতি পরিচিতই হয়,প্রাক্তন শুভাকাংখীর বেশে
তবুও আমাদের এই সুপরিচিতির অন্তরালের যে ঘোর
তা যেন আমারই দর্পনের প্রতিরুপ যা দেখে চলছি প্রতি প্রভাতে।

না চাইলেও হরিদ্রার হলুদে রুপায়িত হবার ঘটনাও ঘটে
আমাদের ঘোর যায় কেটে,গিলোটিনে কাটা পড়ে বোধ
শোক হয় না কোনো তবুও নির্বোধ কিছু অনূভূতিও চলে বটে,
মংগলের ক্যামোফ্লেজে সৈনিকের হয়ে জীবন কিছুটা করে শোধ।



*underline করা পংক্তিগুলো কবি মুয়ীয মাহফুজ এবং সাধারণ ফন্টে লেখা অংশগুলো কবি অভিজিৎ দাস কর্তৃক বিরচিত


............................................................................................
কবি অভিজিৎ দাসের কবিতার বই ' বই নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙা কেমন সবুজ' নিয়ে আলোচনা
বেদনার বহুবর্ণ ধ্বনিরাগ

অভিজিৎ দাসের প্রথম কবিতার বই নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙা কেমন সবুজ। এখানে উৎসর্গ পত্রে মাতৃ সংকীর্তন করতে গিয়ে অভিজিৎ লিখে যান ‘মাতৃগর্ভে ফিরে যাই/আর আকাশের ঐ মেঘপুঞ্জ/বিমর্ষতা ছাড়া কিই বা যোগাতে পারে/আমার হৃদয়ে!’ প্রথম থেকেই বিমর্ষতার বৃত্তান্ত, পরবর্তী পর্যায়ে অভিজিতের কাব্য-প্রদেশের অনেকাংশ জুড়েই এই বিমর্ষতার রঙ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তবে বিমর্ষতামণ্ডিত জগৎবাড়ির খেরোখাতাটি কোথাও ছকবন্দি নয়। কবির স্তবকের মতোই বিমর্ষ আবহের রং-গন্ধ-পালক যেন ‘স্বর্গ-নগকের মধ্যবর্তী অপেক্ষমাণ’ স্তরে দাঁড়িয়ে থাকে। আর এক ধরনের অস্থির সময়-পরিপার্শ্ব এবং পরিপার্শ্বজাত ব্যক্তিমানসের মনোগত বিপন্নতার বীজ মুখে করে কবিতার পাখিরা তৈরি করে কুটির। সেখানে স্বর্গ-নরক নেই কিন্তু যা আছে তা ‘জীবাশ্ম দিয়ে তৈরি মৃত্যুর ইউনিফর্ম’। আছে জ্নকেন্দ্রে বসে সেই শিকার যুগ থেকে অদ্যাবধি বেদনার নীল মাটি, খনিজ তামা, অভ্র, লোহা অবশেষে আয়নার সামনে নিজেরই জ্নচিহ্ন এবং শবদেহ দেখে ফেলা!
দেখাদেখি পর্বের মাঝপথে ভাবগত অনুভবের মাঝখানে আর কী কী ঘটে-‘নিজের জ্নের দুই যুগ পরে প্রসূতিসদনে গিয়ে দেখি/এক প্রবীণ দর্জির কারখানা। জ্নকেন্দ্রের ইতিহাস, নির্মাতা/মায়াদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন সূর্যের মাতৃগর্ভে আর/সেখানে বৃত্তাকার এক দোলনায় দোল খাচ্ছে আমার আঁতুড় ঘর। এই দর্জিকে আমি শৈশবে দেখেছি/লালা ঝরবার কাপুড়ে ঝুড়ি বানাতে, আজ উল্কা/ঝড়ের এই রক্তবর্ণ রাতে, যখন চাঁদ ও সূর্য/একই প্রান্তরে গড়াতে গড়াতে একে অপরকে/করছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, আমারই জ্নের/দুই যুগ পূর্তিতে প্রসূতিসদনে জ্নচিহ্ন খুঁজতে এসে/দেখি, সবুজ এ্যাপ্রনে ঢাকা সেবিকারা ঝোপের/ভেতর দাঁড়িয়ে গাছ সেজে দুলছে।’ (‘ইউনিফর্ম’)’
প্রান্তরে গড়াগড়ি খেতে খেতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া আর সংঘর্ষে চন্দ্র-সূর্য দুলছে। তার মধ্যে বসে অনুভূতির রঙধনু বাঁকিয়ে ছবি বানাচ্ছেন কবি। রূপান্তরের কৌশলে সবুজ অ্যাপ্রণে ঢাকা সেবিকারা হয়েছে উঠছে গাছ-বকুল, সন্ধ্যা মালতি! যেন এক বি্নয়বালকের খেলা, খেলতে খেলতে ছবির রঙে কথা বলা। সেই কথার পরম্পরায় বারবার ছুটে আসে কেবল কবিরই মুখচ্ছবি। তাঁর রক্তবর্ণ মা, মধুবালার মতো প্রেমিকারা। বোধ করি অভিজিৎ দাস নিপুণভাবেই চিত্রকল্প সাজাতে জানেন। তবে তাঁর চিত্রকল্পগুলো পাখা মেলে উল্টো দিক থেকে। নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙা কেমন সবুজ কাব্যগ্রন্থের ৫২টি কবিতার অধিকাংশ কবিতায় এই প্রমাণ মিলবে। এক প্রকার মর্মরিত ধ্বনিরাগে অভিজিৎ কথা বলছেন। কিন্তু যতক্ষণ পাঠক কবির ক্ষিপ্র ছবির সঙ্গে কথাকে মিলিয়ে না নিতে পারছেন, সেই অবধি কথা-বাক্যের অর্থও ধরা দিচ্ছে না তাঁর কাছে। অধিকন্তু ছবির সমান্তরালে কথা কিংবা কথার সঙ্গে দৃশ্যের ঐক্য যখন অদ্বৈত হয়ে উঠছে, তখনই পাঠকের কাছে পূর্ণাঙ্গরূপে ধরা পড়েন অভিজিৎ। সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্টতার বাইরে দাঁড়িয়ে, তাঁর চেয়ে অধিক স্পর্শ-গন্ধময় হয়ে ওঠে তাঁর জগৎ। সেখানে বেলে মাটি, বারুদ, আগ্নেয়গিরির স্পন্দন, তেজস্ক্রিয়তা, তামার ঠোঁট ও লোহার দাঁত জেগে থাকে। এরই পাশে কথার গুণ্ঠন খুলতে খুলতে একটি ব্যক্তিগত বেদনার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে কবি চলেন-
‘মহাকাশগামী এক এ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে/প্রায়শই আবর্তিত হয় আমাদের ঘিরে/গতরাতে দেখি/মুমূর্ষু স্বপ্নদের নিয়ে গানের ক্লাসে যাচ্ছে/মৃত্যুর স্বরলিপি শিখতে/বেসুরো কণ্ঠে যে কিছু ইস্পাতের/ধ্বনিরাগ ছুঁড়ে দিয়েই খালাস!/আমি আমার দেহের গ্যারেজে ওই ব্যক্তিগত বেদনার্ত নীল/অ্যাম্বুলেন্সটিকে রেখে পথে নেমেছি।/•••আমি আমার ব্যক্তিগত লাল এ্যাম্বুলেন্সের সাথে/একবার লিপ্ত হতে চাই সহবাসে।’ (‘এ্যাম্বুলেন্স’)
ব্যক্তিগত বেদনার লাল অ্যাম্বুলেন্স সঙ্গে করে বারবারই অভিজিৎ জানতে চান নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙা কেমন সবুজ। মজার বিষয় হলো, এই জিজ্ঞাসাবিন্দুতে স্থির কবি তাঁর কবিতার দৃশ্য আঁকেন বটে, কিন্তু দৃশ্যের যৌথ ছবি আঁকেন না। তাঁর ভাষায় ‘•••আমি এ দৃশ্যের কোনো যৌথ ছবি রাখিনি/অথবা রাখতে চাইনি।/অথচ যখন এক ভগ্নস্বাস্থ্য চোর এসে অভিপ্রায় জানাল, আমি একে একে/সিন্দুকের মধ্যে সাজিয়ে রাখা আমার পূর্বপুরুষের প্রেতগুলো/তার হাতে তুলে দিলাম।/সে তৃপ্তির চোখে একদলা আলো ছুঁড়ে দিয়ে পাতালের দিকে উড়ে গেল-যেখানে তার নিবাস।’ (‘মৃত্যুদিন’) ভগ্নস্বাস্থ্য চোর পাতালে ফিরে যায়। ক্লান্তির দীর্ঘ ্নারক হাতে কবি একটি সমগ্রতাকে ধরতে যান-ছবিগুলো টুকরো হয়ে পড়ে। আবার দৃশ্যের পাশে ছোট্ট একটি শব্দবন্ধ বেঁধেও দৃশ্যকল্পকে বিস্তারিত করে তোলেন তিনি-‘মৃত্যু গড়াতে গড়াতে/গড়ায়ে নেমেছে কৃষ্ণবেলা/অনুভবে কবে-ধীরগতি!’
মৃত্যুর বাস্তবিক অথচ বিমূর্ত বিষয়কে গড়িয়ে গড়িয়ে, অনুভবের ফুলবাগানে দুলিয়ে তার সঙ্গে যুক্ত করলেন ‘ধীরগতি’ শব্দটি। ফলে মুহূর্তের পাঠকের দৃষ্টিসীমায় উ্নোচিত হলো মৃত্যু, বস্তুগতরূপে যাকে ছোঁয়া যায় না কখনো, সে গড়িয়ে নামছে! কবিতা হয়ে উঠেই এ যেন এক সঘন ছবিময়তার দেশে পাঠককে ডুবিয়ে দেয়। ক্রমাগত ছুটিয়ে মারে। এভাবে কামরাঙা কেমন, কতটা সবুজ জানতে চাওয়া কবি অভিজিৎ দাসের কবিতায় ছবির পর ছবি, দৃশ্যের পর দৃশ্যের খণ্ডাংশ অথবা একটি ছবির মধ্যে আরও অনেক ছবির আভা উঁকি দেয়। আর ‘বহুবার জীবনের যন্ত্রণার বিষে/ঘিলুশব্দ শুনে’ প্রেত, মৃত্যু, কর্কশতার লৌহজগৎকে মেনে নিয়েই কবি ফেরার পথে তাকান-
‘ফেরার পথগুলো কেন এত ঢালময়/যাবার সময় এ কথা তো বলে দাওনি কেউ।
‘যাত্রাকালে যা কিছু দিয়েছ সাথে ঠিকঠাক সাজিয়ে গুছিয়ে/গড়িয়ে নেমেছে সে তো পথের ধুলোয়
‘এ কেমন খাড়া পথে আমাকে পাঠালে/পাহাড়ে ওঠাও সহজসাধ্য এর চেয়ে•••’। (‘ফেরার পথ’)
প্রথম কাব্যগ্রন্থে কবি অভিজিৎ দাস সজ্জিত, সুন্দরতম চারপাশকে পথের ধুলোয় লুটান। পরিবর্তে পূর্বপুরুষের প্রেত হাতে অবিরল ‘পতন সংলাপ’ বলতে বলতে বলেন, ‘ঝরা পাতা গো আমি তোমারি দলে’ আর নিজস্ব কথনভঙ্গিমা কণ্ঠে ধরে, ব্যক্তিক বেদনার সাইরেন বাজাতে বাজাতে যেন বলতে চান-কালো, নিগ্রো পরীর হাতে সবুজ কামরাঙাটি সবচেয়ে সুন্দর।
শেখর আহমদ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন