রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০০৯

কবি সুনীল সাইফুল্লাহর আটটি কবিতা ও দু'টি এলিজি









২৫.
মধ্যরাতে দরোজায় কড়া নাড়ে
কবরের মাটি সরিয়ে উদ্ধত উঠে আসা আমার কঙ্কাল।
তড়িঘড়ি শয্যায় উঠে বসে আমি দেখি
বুকের মাংস যোনির আকারে ফেটে গিয়ে
তৈমুরের তলোয়ারের মতো ঝকঝক করছে
আর তার ভেতর থেকে বিচ্ছুরিত
আমার চোখে দু’ হাজার রমণীমুখ
ঠান্ডা কঙ্কালফুল হয়ে ফুটে উঠলো।
পুতুলের মুখের মসৃণতায় হাত রেখে
একদিন তাকে মনে হয়েছিলো মানুষের অধিক মানুষ
আজ সে মিথ্যে মাটির প্রলেপ মুখে নিয়ে
ছুঁয়ে যায় ভূমধ্যসাগরে ভাসা নাবিকের লাশ।
আমি বুকে হাত রেখে অনুভব করি
অংকুরিত সবুজের লাবণ্যের লজ্জাবতী ধরিত্রীর
প্রথম মাতৃত্ব অতিক্রম করে
চাঁদের সঙ্গমে আন্দোলিত দু’ফাঁক কোমলতায় জন্ম নিচ্ছে
অন্তরীশে প্রবাহিত অগ্নিগিরি, নিহত ভ্রুণের চোখ

আমার বুকে একি যোনি নাকি অর্জুনের ধনুক ?
যমজ ছিলায় উৎক্ষিপ্ত তীরের ঘর্ষণে
মহাকাশে অগ্নিরমণীর কপাল ফাটিয়ে বেরিয়ে আসা
সবুজ পায়রার হৃৎপিন্ড চিবিয়ে খেয়ে
ঠিক তিন বছর পর আমি আত্মহত্যা করে যাবো।


৪০.
তুমি হেসেছিলে-
অমন প্রলয় জরায়ু-ছেঁড়া মৃত্যুর রাত্রে
আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি মৃত্যু
অজস্র পদ্মগোখরো উদ্ধত ফণায় ফণায়
নিয়ে এসেছে এক একটি জ্যোতির্ময় দেবশিশু

তুমি হেসেছিলে-
আমার সমস্ত বাতাস জুড়ে শিশুর মুখের গন্ধ
জন্ম যন্ত্রণায় থরোথরো ভূমিকম্প

তুমি হেসেছিলে- তুমি সহোদরা
একটি রাত শুরু মনে হয়েছিলো
আমারও বংশধর রেখে যাওয়া প্রয়োজন।



৪১.
কী যেন কী ফেলেছি আমি
আমার করতল ফেটে গন্ধ বেরিয়ে আসছে তার

লোহিত রমণীর পেলব গলায়
তপ্ত কড়াইতে ধানের মতো ফুটে ওঠে
জন্মেরর প্রথম পদতলে সবুজ মৃত্তিকা
তার ভেতরের অকস্মাৎ ভেসে ওঠে
পশমহীন মসৃন মটরশুটীর খোলার মতো চেরা
বক টুকরো মাংস, তাপহীন উজ্জ্বল একটি দিনের আভাস
সবুজ মাটি, খড়কুটো স্তুপের আড়ালে লুকোনো
একজোড়া নগ্ন বালক বালিকা

আমার করতল ফেটে গন্ধ বেরিয়ে আসছে তার
বস্তুত: সাবানে হাত ধুয়ে ফেলি বারবার
আরও গাঢ় হয় সে গন্ধ
করতলে বসে আছে দেখি হায়
অপাপবিদ্ধ কৈশোরের ছন্নছাড়া ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়।


৮.
আত্মহত্যারর আগে শেষকথা কী লিখে যাবো এই প্রশ্ন
করে শেষ রাত শেষ আকাশ মাধুরী; শেষকথা কী বলে যাবো
সেই কর্কশ বিদ্যুৎ সবর্শরীর ঢেকে আছে, মেঘাচ্ছন্ন দিন-
কাঁদে বাসভূমি, ছিন্ন চালাঘর

সাম্রাজ্যশাসন কোনদিনই হবে না আমার
মাঝেমধ্যে যেটুকু দায়িত্ব পাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাই
অলস নিয়মকানন, ব্যভিচার, দিগন্ত ছোপানো ভঙ্গুর মায়াজাল;
আশৈশব অনিবার্য অনাচারে আনত শরীর ভাসে
শীতকালীন শীতলক্ষা- স্রোতে, সময়ে পঁচে, মেশে নিবির্কার
পবিত্র জলে- জন্ম কেন কথা বলে চোখে এই বিরোধ
তীরে তীরে কম্পমান হিম সংহারে, মর্তধারায়;

আত্মহত্যার আগে শেষ চিত্রলিপি কী দেখে যাবো
এই প্রশ্ন করে জন্মভূ, নগ্ন হয়ে দেখাই রুপান্তরিত জন্মরুপ
বিকলাঙ্গ- প্রবাহে শিথিল যৌনাঙ্গ- বিষ, শৈশবে অমল প্রাসাদে
দায়িত্বহীন রাজত্বসুখ, স্বপ্নসন্ধ্যায় বয়ে যায় সূর্যাস্ত সুষমা
বুকে হেঁটে শেষাবধি এই নদী তীরে, অনাদি মায়াকানন
এখানে নকটু বসি যাবার আগে শেষ দেখি রঙে রঙে কতোটুকু
কম্পমান স্বপ্নশরীর, ছোঁবো না কণামাত্র নপূংশক মাটি
ছোঁবো না পরাধীন সুষমা, , নগ্ন হয়ে দেখাই রুপান্তরিত জন্মরুপ
পরান্ন- প্রবাসে এই অধিকার।


১২.
আত্মহত্যার আগে আমার নিঃশ্বাসের আগুনে ক্ষয়িষ্ণু
একদিন উৎসব হবে আলোছায়া আমলকি বনে,
সমস্ত ক্রন্দনের বুৎসভূমি ছুঁয়ে প্রবহমান নীরব নদীর ফুঁসে উঠলে
দুকূল
যেখানেই থাকি ফিরে আসবো,
খরস্রোতে অন্ধকারেকারে টালমাটাল জীবন প্রতিবাদহীন ভেসে যাবে
বৈনাশিক নিথর প্রবাসে তার আগে সমস্তই ধুলোখেলা-

কিছুদিন কাঁধে নেবো রাজ্যভার, কী ভেবে আমাকেই যে
উত্তরাধিকারী
মনোনীত করলেন রাজা বুঝি না মাথা মুন্ডু তার
দিগ্বীজয়ী মহারাজের অস্ত্রাঘাতে জজর্রিত স্বদেশভূমি
পাথির্ব উপঢৌকনে তাকে তুষ্ট রাখার রীতিনীতি শিখিনি কিছুই
তবু কী এক ক্রন্দনে বাঁধা পড়ে আছি
হাহাকার শুনলেই ফিরে আসতে হবে-
রাত্রির মাই চুষে সৃষ্টির সবটুকু আঁধার পান করার নেশায়
একজন নির্বাক বসে আছে জন্মাবধি, সে যতো পান করে আধাঁর
জন্ম দেয় তারো কিছু বেশী,
বসন্তদিনেষ আদিগন্ত সাগরতীরে ঘনভার মেঘ ডেকে যায়
কার আকুল কান্নর ধ্বনি জেগে ওঠে অন্তরীক্ষে, চিড় খায়
অনন্ত আকাশ-
কী রাজমুকুট পরবো এ দেশে, ভুল অঙ্গীকারের মাজর্না চাই রাজা
জন্মে নিয়েছি দেহভার বসবাসে যদি অবধারিত রাজ্যভার
তবে পিষ্ট হবো পাথরে-
রাজা তোমার উত্তরাধিকার ফিরিয়ে নাও।


২০.
চন্দনকাঠের পালংকে ঘুমন্ত রাজকন্যার নিতম্ব ছুঁয়ে
ঊঠে আসে করাত বিদ্ধ যুবতী বৃক্ষেরর যন্ত্রণা-
তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি দেখি
জ্যৈষ্ঠের দূরন্ত ঝড়ে পিতামহের নিজের হাতে লাগানো
বকুল গাছের ডালপাতাফুল দুমরে মুচড়ে ভেঙে যাচ্ছে।

বৃষ্টির প্রার্থনায় আশৈশব চুমোয় চুমোয় রাঙিয়েছি মেঘমালা
আজ বুঝি বালি ঝরানো স্বভাব তার।
সারারাত টুপটাপ শিশিরের শব্দে তন্দ্রাচ্ছন্ন
অরণ্যভূমির ভেতর দিয়ে অসি হাতে হেঁটে যায় যুবরাজ
তার জুতোর নীচে শুকনো পাতার আর্তস্বরে
চুম্বনরত দুটো হলদে পাখির উষ্ণতা
ভেঙে ভেঙে বয়ে যায় জলাঙ্গীর ঢেউয়ের ধারায়।
বজ্রপাতের শব্দে নড়ে ওঠে কর্কশ দাম্পত্যমেত
ঘরের যাবতীয় আসবাব। আমি কোনোদিন
ওর মতো সুখী হতে পারবো না ভেবে
একদিন একটা টিকটিকি খুন করেছিলাম।
হিরণ্যবাহ রমণীর উৎসমুখে মুখ চেপে শুয়ে আছি
ভীষণ পরাজিত শিশু
হে চিত্রিতযোনি, তোমার গর্ভে আমাকে ফিরিয়ে নাও।



ক.
সকাল হলে
একটি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো
আজন্ম পরিচিত মানুষ ছেড়ে চলে যাবো
মৃত্যুদন্ডিত
মৃত্যুদন্ডিতের মতো,
অথচ নির্দিষ্ট কোন দুঃখ নেই
উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতি নেই
শুধু মনে পড়ে
চিলেকোঠায় একটা পায়রা রোজ দুপুরে
উড়ে এসে বসতো হাতে মাথায়
চুলে গুজে দিতো ঠোঁট
বুক-পকেটে আমার তার একটি পালক



খ.
সে মাঠে এখন ইতস্ততঃ ছড়ানো থাকে স্তুপাকার
মানুষ গবাদি পশু ফসলের কৃষ্ণ কঙ্কাল
রঙিন ঘুড়ির ধ্বংসাবশেষ, খরগোশের পশম-
শুভ্র জলের সঞ্চলণশীল সোনালী মাছেরা মরে গেছে
একে একে পৃথিবীর নিয়মে,
বালুকা-ছড়ানো চন্দ্রতাপে বাষ্পিত সে জল উড়ে গেছে
নীলে নীলে শুণ্যে
সারা মাঠ এক্ষুনি উঠবে ফুঁসে লেলিহান প্রচন্ড অগ্নুৎপাতে
মহাশূণ্যে মাংসময় যৌবনে প্রথমে একবার বহুবার
আমি মুখোমুখি সে মাঠের যেন যাযাবর
আজন্ম উদ্বাস্তু দুজন।


.....................................................................................................
কবি মোহাম্মদ রফিকের এলিজি,সুনীল সাইফুল্লাহর জন্য


‘পিতৃপরিচয় মুছবো বলে শেযাবধি মুছি নিজেকে।’

সমস্ত মৃত্যুই স্বাভাবিক। বিশেষত আমাদের এই পোড়া দেশে, এমন অকল্পনীয় বিতিকিচ্ছিরি আর্থ সামাজিক পরিবেশে, যেখানে বেঁচে থাকাই অস্বাভাবিক, বলা যায় প্রায় অসম্ভব, সেখানে মৃত্যুই একমাত্র নিদারুণ নিয়তি। মৃত্যু দ্রুত এসে পড়ে; কিন্তু বেচেঁ থাকার জন্য প্রয়োজন প্রায় অসাধ্য সাধনের মত, বিদ্রোহের অন্তঃশীল আবেগ। তাই মৃত্যুইচ্ছা যেমন অপ্রয়োজনীয় বিলাস-বাহুল্য, ঠিক তেমনি বাঁচার ইচ্ছা সৃষ্টির অদম্য অনুপ্রেরণা যা অবশেষে কুরে খায় সৃষ্টিকর্তাকে।
আর সৃষ্টির জন্যে এমনি অদম্য অনুপ্রেরণা ছিল সুনীল সাইফুল্লাহর অন্তর্গত রক্তধারায় নিরন্তর সক্রিয়। তার এই জেগে ওঠার প্রক্রিয়া, জীবন, জগৎ ও কর্মের সঙ্গে সংযোগ সেতু ছিল তার কবিতা। যে বয়সে সে মৃত্যুকে বেছে নিল, বলা যায় মৃত্যু তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, সে বয়সের তুলনায় তার কবিতার সংখ্যা খুব বেশী নয়, তবে একদম কমও নয়; নয় এড়িয়ে যাবার মতো সাধারণ, সাদামাটা শুকনো ঘাসের স্তূপ। তার কবিতা সম্পর্কে যে গূণবাচক শব্দটি অবশ্যই অনিবার্যভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা হলো, তার কবিতা একান্ত তার নিজস্ব, তার আপন রক্তগন্ধমাখা। কবিতা, তার সংগ্রামের অঙ্গীকার, বল্লমের ফলা যা তার নিজের দিকেই তাক করা।
তার কবিতা ছিল তার নিজস্ব একদম নিজস্ব, তার একান্ত নিজের বৃত্তে বেঁচে থাকা। এইসব কবিতা কর্মের মধ্যে অন্য কারো, অন্য অগ্রজ কোনো কবির বা কোনো সতীর্থের প্রভাব খুঁজে পাওয়া অসম্ভব যেমন অন্য কোন ব্যক্তিত্বের প্রভাব তার জীবন রচনায় ছিল অকল্পনীয়। এর একটি জঠিল কিন্তু সাধারণ কারণ হয়তো এই যে সে কোন আশ্রয় খুঁজে পায় নি, না কাব্যে না জীবনে। এবং এই কারণেই তার দূর যাত্রা হয়ে পড়েছিল এতো বন্ধুর, বিপদ সংকুল।
পাহাড়ের সরু ধার বেয়ে চলতে গিয়ে, খাদে গড়িয়ে পড়ার ঘটনা, প্রায় অবধারিত। আলো-হাওয়া, আকাশ সুর্যস্তি রক্তে মাংস-মস্তিষ্কে ভাঙনের টানে তোলপাড় ঘটাবেই। তারপরও রয়েছে কতো কানাগলি, রূপকথা, রাজারপুর, হারিয়ে যাওয়া সকাল, অন্তহীন দুপুর-রাত্রি; এমনি মায়াবী ধ্বংসের গহ্বর খুঁড়ে যাত্রাপথ তৈরী এতোই কী সহজ? সে জীবনেই হোক আর কাব্যেই হোক। সাইফুল্লাহ সেই যাত্রার খাদ কেটেছে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বুনোট গদ্যধর্মী কাব্যরচনায় যা তার নিজের চলার ও চলার সংগ্রামের মতো নিজস্ব।
‘চুমু নাও ক্ষমাশীল মৃত্তিকা মহাদেশ-/ সামনে ক্রন্দনশীলা পথ’’।
ভালবাসায় যেমন সামান্যতম ফাঁকির আশ্রয় নিয়ে পার পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনি ঘটে সৃষ্টি কর্মের ক্ষেত্রে ।সাইফুল্লাহ কখনো ফাঁকির দ্বারস্থ হয় নি যেমন কাব্যের, তেমনি জীবনে। আর কে না জানে, এই ধরনের সততা কতোটা হননকারী। আর্শিতে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবার শক্তি প্রতিনিয়ত কী পরিমান রক্তস্রাব ঘটায়। সাইফুল্লাহ, স্বাভাবিক আত্মশক্তির কারণেই, সততাকে বরণ করে নিয়েছিল অজানা পথের সঙ্গী, বন্ধু ও পথদর্শক হিসেবে; এবং সে জন্যেই তাকে বিনিময়ে দিয়ে যেতে হয়েছেও প্রচুর, শেষ পর্যন্ত নিজেকেই। সে একজন সচেতন কৃষক যে ভাঙনের বিরুদ্ধে লড়তে-লড়তে ভাঙনের জলেই ভেসে যায়, আর তার ফলনকে ঘরে তোলে বা ফলনের স্বাদ উপভোগ করে আমাদের মতোই অন্যেরা।
‘স্বপ্নশরীর, ছোঁবো না কণামাত্র নপুংসক মাটি/ছোঁবো না পরাধীন সুষমা, নগ্ন হয়ে দেখাই রূপান্তরিত জন্মরূপ-/পরান্ন প্রবাসে এই অধিকার’।
মাথার ওপরে চাঁদ বা মেঘ, পায়ের নীচে অনুর্বর তাবু, কর্ষিত ক্ষেত, শরীরে খরার সংবাদবাহী হাওয়া; এইসব স্বদেশের, স্বজাতির, স্বজনের নিজস্ব ইতিহাস নিয়ে
দীর্ঘ পথ পরিক্রমা কখনো আনে ক্লান্তি, পরাজয়ের বোধ বা গ্লানি; তবু চলার দুঃসাহস কিছুতে থামে না। কখনো নিজের চুল ছেঁড়ে নিজে, মাথা ঠোকে পাথরে, নিজের বিরুদ্ধে নিজে চীৎকার করে ওঠে ক্রোধে, আত্ম-উন্মোচনের অসহ্য ক্রন্দনে। সুনীল সাইফুল্লাহর কবিতা ধারণ করেছে, এমনি বিস্ময়কর, কখনো কখনো অনিবার্যভাবে পরস্পর বিরোধী জগৎ, শারীরিক পঙ্গুতায়, অসামর্থও লালিত্যে। সার্থকতা বড়ো কথা নয়; কতোটা সততা ধারণ করতে পেরেছে তার কবিতা, সেটাই বিচার্য, ভেবে দেখার। তার অকাল মৃত্যুর জন্যে দুঃখ নেই, কর্মের অপূর্ণতার কারণে।
‘শ্রেষ্ঠতম উন্মোচন হবে আজ’।
এই উন্মোচন, বেঁচে থাকার জন্যে যে সংগ্রামের প্রয়োজন, তার। আমাদের জন্যে রয়ে গেল, সাইফুল্লাহর কবিতা, মৃত্যুর বিরুদ্ধে তার রুখে দাঁড়াবার অদম্য অনুপ্রেরণা ও প্রয়াস। অনিবার্য কিন্তু স্বাভাবিক ও সাধারণ বলা যায় প্রায় গতানুগতিক ক্ষয় ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম যতো দীর্ঘজীবী হয় ততোই প্রসারিত হয় আমাদের উত্তরাধিকার। সাইফুল্লাহর মধ্যে এমন একটি সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও জাগরণের প্রত্যাশা ও প্রত্যাশার উদ্গম পেয়েও হারালাম। সেখানেই আমাদের দুঃখ ও দুঃখবিনাশী অনুরনণ।
‘ফুটপাতে গলিত সংসার অন্ততঃ স্থিতিহোক সামান্য চলায়/সঞ্চিত হোক কমলাগন্ধ, কচি লেবু পাতায় প্রভাতী সুর্যের সৌরভ।’
দীর্ঘায়ু হোক তারঁ বেঁচে থাকার আত্মধ্বংসী প্রয়াস, তার কবিতা। তার কর্মই বহন করুক তার পিতৃপরিচয়, শোধ করুক তার জন্মঋণ

......................................................................................................................
"ঠিক তিন বছর পর আত্মহত্যা করে যাবো আমি"
সুমন রহমান

এভাবেই লিখেছিলেন সুনীল সাইফুল্লাহ। ১৯৭৯ সালের একটা কবিতায়। সত্তর দশকী বাংলা কবিতায় এরকম ধুন্ধুমার বিবৃতি নতুন কিছু ছিল না। আবুল হাসান তখন সবেমাত্র ক্রেজ-এ রূপ নিচ্ছে এই বাংলাদেশে।
কিন্তু শুধু স্বপ্নভঙ্গের বিবৃতিই ছিল না সুনীল সাইফুল্লাহর ঐ পংক্তিমালা। ঠিক ১৯৮২ সালেই আত্মহত্যা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া এই কবি। বয়স তখন তার পঁচিশ, বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রের জন্য একটু বেশি বয়স বুঝি বা। তাঁর মৃত্যুর পরপর বন্ধুদের উদ্যোগে তাঁর একমাত্র কবিতাগ্রন্থটি বেরয়, পাণ্ডুলিপিটি পাওয়া গেছিল বালিশের নিচে। মৃত্যুর আগে দিনরাত খেটে খেটে পাণ্ডুলিপির কাজ শেষ করেছিলেন তিনি। বইটার ভূমিকা লিখেছিলেন তাঁরই শিক্ষক কবি মোহাম্মদ রফিক।
কেমন লিখতেন সুনীল সাইফুল্লাহ? মোহাম্মদ রফিকের ঐ সহমর্মী এবং দায়সারা ভূমিকা ছাড়া আর কোনো গদ্যপ্রচেষ্টা গত পঁচিশ বছরে তাঁকে নিয়ে হয়েছে বলে জানা নেই। সত্তরের কবিতা নিয়ে নানা জায়গায় দিস্তা দিস্তা আলোচনা দেখি, কিন্তু সেখানেও জায়গা হয় না সুনীল সাইফুল্লাহর। মনে করিয়ে দেয় তাঁরই কবিতাকে:

যেখানেই নামি
আমার গোটা শরীর ডোবে না জলে
ডুবলে সত্যি
মাছেদের ক্রীতদাস হয়ে কাটিয়ে দিতাম বাকী জীবন
ডোবে নি সত্যি। বাংলা কবিতার ইতিহাসে সুনীল সাইফুল্লাহ তার আত্মহত্যার পঁচিশ বছর পরও দ্রবীভূত হয়ে উঠেন নি। বনের গাছের আর্তি দ্রবীভূত হয় না কাঠের পালংকে:

চন্দন কাঠের পালংকে ঘুমন্ত রাজকন্যার নিতম্ব ছুঁয়ে
উঠে আসে করাতবিদ্ধ যুবতী বৃক্ষের যন্ত্রণা
মোহাম্মদ রফিককে জিজ্ঞেস করতাম সুনীল সাইফুল্লাহর কথা। কেমন ছিলেন তিনি, ইত্যাদি। মোহাম্মদ রফিক অবশ্য এসব প্রশ্নের খুব উত্তর করতেন না। সুনীল সাইফুল্লাহকে নিয়ে খুব বেশি স্মৃতি নেই তার, দুজনের নান্দনিক অবস্থানের ভিন্নতার কারণে হয়ত। একজন জীবনভর জীবনেরই চর্চা করেছেন, অন্যজন নিভৃতে বসে-বসে ধাওয়া করেছেন নিজের মৃত্যুকেই:

আমার বুকের উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে রাজ্যসফরে চলেছেন মহারাজ
তাঁর পদস্পর্শ পাবার আশায় আমি শরীর ছড়াচ্ছি প্রান্তরময়
এমন কত অজস্র পংক্তি,কত প্রেম, কত কত আয়নাভাঙা ভায়োলেন্স!
মানুষজন্মে এও কি সম্ভব সবিতা, সেই বুড়ি দত্যিটাকে সময়মত সিগ্রেট না-খাওয়ালে
তোমার আমার একদড়িতেই ফাঁসি হত তার আগে দীর্ঘকাল শিরাউপশিরা কর্তন প্রক্রিয়া
কিংবা:
আমার কপালে বুলেটের মত ঢুকে গিয়েছে তোমার মুখ
ক্ষতচিহ্নের রক্তপাত আঙুলে মুছে নিয়ে আমি নগরীর দেয়ালে দেয়ালে বৃক্ষের বাকলে লিখছি তোমার নাম
কিংবা:
যাবার পথে শরীর বিছিয়ে তুমি সারাদিন ডাকছো আমাকে
তোমার কথার ময়ুর সিংহাসন আসে একটি পদভারও সয় না আমার
আগুন ছাড়া আর কিছুতেই ভারহীন হয় না শরীর
বাংলা কবিতার "মূলধারায়" গত পঁচিশ বছর ধরে সুনীল সাইফুল্লাহ একটি আগন্তুকের নাম। অথচ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যারা নির্ভীক ভাম্পায়ারের মত নিশিযাপন করতাম, সুনীল সাইফুল্লাহ ছিলেন আমাদের কাউন্ট ড্রাকুলা। তার প্ররোচনাতেই সারারাত টুপটাপ মৌ ফুল ঝরতো, হেলেদুলে রাস্তা পেরুতো বিশালবপু গুঁইসাপ। আমি ক্যাম্পাসে পা রাখার সাত বছর আগে মৃত্যু হয় তাঁর, কিন্তু খুব কম দিনই আমি তাঁকে দেখি নি, এমনটা হয়েছে।
সুনীল সাইফুল্লাহর কবিতা পড়তে চান? শাহবাগ কিংবা নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানে পাবেন না তাকে। ওয়েবে তো নয়ই। সাভারগামী বাসে চেপে চলে যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। খোঁজ করুন তপু নামে এক পিয়নকে। বলুন আপনার মনোবাঞ্ছার কথা। হ্যাঁ, তিনিই আপনাকে দিতে পারেন সুনীল সাইফুল্লাহর এক কপি বই। ১৯৮২ সালে বের হওয়া বইটির বাকী সব কপিই তিনি পরম মমতায় নিজের বাড়িতে আগলে রেখেছেন আজ পঁচিশটি বছর ধরে।



**কবি সুনীল সাইফুল্লাহর দুঃখ ধারার ভরা স্রোতের লিংক-
এখানে কবির সব কবিতাই পাবেন।
http://www.sachalayatan.com/ebooks/Dukkha_Dhorar_Vora_srote_-_sunil_saifullah.pdf

কবি সুমন রহমানের লেখাটির লিংক-
http://www.sachalayatan.com/yeeshan/1304

1 টি মন্তব্য:

  1. বালিকা ভাবি
    -মোঃ আনোয়ার হোসেন

    ভাবি ভাবি চাম্পা
    ভারির সোনা লম্বা।
    আয় ভাবি দেখে যা
    দেবর নাচন খেয়ে যা।
    ভাবি গেল নাইতে
    কাপড় গেল খুলে।
    ভাবির ঠোঁটে চাপা হাসি
    কি সুন্দর টলমল চাহনি!
    বাঁকা চোখে টেরা চাহনি
    খুলে যায় বুকের কাঁচুলি।
    ভাবি গেল হাঁটু জলে
    দেবরা শুধু চেয়ে থাকে।
    চাম্পা ভাবি হেঁটে চলে
    দেবরা সব উকি মারে।
    ভাবি ভাবি চাম্প
    ভারি নিতম্ব মোটা।

    উত্তরমুছুন