বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৯

বিশেষজ্ঞ জ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান, প্রচার ও ক্ষমতা বিষয়ক আমার ভাবনাঃ একটি আধা-কাল্পনিক কথোপকথন

বিশেষজ্ঞ জ্ঞান সম্পর্কে মিশেল ফুকো’র (Foucault) ‘Disciplne and Punish’ চিন্তার জগতে একটা আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই। ফুকো’র মূল কথাটা কি ছিলো?- ফুকো আধূনিক ইউরোপে বিচারব্যবস্থার মানবিকীকরণের (যেমন, মৃত্যুদন্ডের তুলনায় যাবজ্জীবন কারাদন্ড)প্রক্রিয়ায় জেলখানার ভিতরে এবং সেখান থেকে সমাজজীবনে ক্ষমতার রুপান্তরের বিশ্লেষণ মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের স্বরূপ উৎঘাটন করেছেন।

ফুকো’র আলোচনার শুরুটা ছিলো নিতান্তই নিরীহ একটা প্রশ্ন দিয়ে যে, জেলখানা যদি অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যেই করা হয়ে থাকে, তাহলে জেলখানার প্রকৃত কাজ হবে ক্রমাগতভাবে অপরাধ কমিয়ে ফেলা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ঘটে ঠিক এর উলটো, অর্থ্যাৎ জেলখানার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে অপরাধ আইন ও অপরাধীর সংখ্যা, কাজেই আরো বাড়ে জেলখানার সংখ্যা, আরো আইন, আরো জেলখানা।- এভাবে চক্রাকারে চলতে থাকে এই প্রক্রিয়া। এখানে থেকে ফুকো নতুন এক প্রশ্ন উত্থাপন করেন যে, অপরাধ দমনে জেলখানার এই অনন্ত ব্যর্থতার পরেও কেনো জেলখানার এই রূপ/কাঠামো না বদলিয়ে আরো বেশি বেশি করে একই রকম জেলখানা তৈরী করা হয়? জেলখানা বা শাস্তির প্রক্রিয়া ভালো না খারাপ সেদিকে না গিয়ে ফুকো জানতে চাইলেন জেলখানার এই ক্রমাগত ব্যর্থতার বাস্তব (empirical) ফলাফলটা কি? ফুকো তার এই বইটাতে ইউরোপের আধূনিক জেলখানা’র (panopticon) গঠনের সাথে Disciplinary control এর যোগসূত্র দেখেছেন।এই জেলখানার প্রধান গঠনগত বৈশিষ্ট্য হলো- এর কুঠুরিগুলো ধাপে ধাপে নিচ থেকে উপরে অবস্থান করে। আর সবার উপরে থাকে ওয়াচ-টাওয়ার, সেখান থেকে পাহাড়াদাররা কয়েদীদের উপর নজরদারি করে। কোনো কয়েদী সামান্য এদিক-সেদিক করলেই সে ধরা পড়ে, এবং অবধারিতভাবেই তার জন্য বরাদ্দ হয় কঠোর শাস্তি। কাজে কাজেই, সকল কয়েদীর মধ্যেই এই ধারণা জন্মে যে, তারা সর্বদা নজরদারিতে থাকে। কয়েদীদের মনে এই যে ধারণা, এর থেকেই উৎসারিত হয় ক্ষমতার নতুন এক রূপ। ওয়াচ-টাওয়ারে পাহাড়াদার থাকুক আর নাই থাকুক, কয়েদীরা নিজ দায়িত্বে নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রন করা শুরু করে। সম্ভাব্য শাস্তির ভয়ে কয়েদীদের এই যে আত্ম-নিয়ন্ত্রন, তা কোনো ব্যক্তি-বিশেষের ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পন নয়, তা’ হলো নতুন এক ধরণের ক্ষমতার কাছে যা’র নিয়ন্তা সমাজের একটা বিশেষ প্রতিষ্ঠান (জেলখানা)।

ক্ষমতাসীনরা দেখল যে, এ তো ভারী সুবিধাজনক। অল্প খরচে, স্বল্প লোকবলের সাহায্যে মোটামুটি নির্বিঘ্নে অনেক সংখ্যক মানুষকে নিয়ন্ত্রন করা যায় এই ‘ডিসিপ্লিনারী কন্ট্রোল’ সিস্টেমে। এখান থেকেই শুরু অপরাধ দমনের বদলে অপরাধী নিয়ন্ত্রনের কৌশলের। কিন্তু শুরুতে জেলখানার কাঠামো মূখ্য ভূমিকা রাখলেও এরপর প্রধান হয়ে দাড়ায় অপরাধ আইন, আইনী প্রক্রিয়া, আদালত, পুলিশ, ইত্যাদি। এসব কিছু মিলেই গড়ে ওঠে ‘পেনাল সিস্টেম’ যা সমাজের সমস্ত মানুষের মধ্যে নির্দিষ্ট আইনের আওতায় বিশেষ বিশেষ কাজকে অপরাধ বলে গণ্য+মান্য করতে বাধ্য করে। নতুন নতুন আইন ও এর প্রয়োগের প্রতি সাধারণ মানুষের এই যে বশ্যতা, তা আপাতঃদৃষ্টিতে সর্বসম্মতিক্রমে দেখা গেলেও আদতে তা জোরপূর্বক আদায় করা হয়। তবে এই জোর ব্যক্তির শারিরীক শক্তি থেকে আসে না, আসে বিশেষজ্ঞের মুখ থেকে উচ্চারিত ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ এর তকমা নিয়ে। বিশেষজ্ঞ জ্ঞানকে “বিশেষ” হয়ে ওঠার জন্য কিছু নীতি-পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে নেওয়া হয়; যেমন, জ্ঞান উৎপাদন (generate) ও মূল্যায়নের কিছু সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ, জ্ঞান উৎপাদনের পদ্ধতিসমূহের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, সুনির্দিষ্ট কিছু ব্যাক্তিকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকর্তিক আনুষ্ঠানিকভাবে বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি দান, এবং এই বিশেষ জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত কিছু নির্দিষ্ট চর্চা (practice) কে সমাজে বৈধ হিসেবে প্রচলন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ডাক্তারের কথা।

কিছু নির্দিষ্ট নিয়ন-কানূনের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তারি বিদ্যা উৎপাদন করা হয় যা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। মেডিক্যাল কলেজে নানা আনুষ্ঠানিকতার শেষে কিছু ব্যক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃতি নিয়ে আসে, এবং তারা রোগীর দেহে তাদের ইচ্ছেমতো কাটাছেঁড়া করতে পারে, এমনকি তা রোগী এবং অন্যদের কাছে আপাতঃদৃষ্টিতে অনর্থক মনে হলেও। তারপরেও আমরা এটা মেনে নেই, কারণ ডাক্তার সেই বিষয়টা’তে সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি জানেন বলে স্বীকৃত। পাশাপাশি এটাও ধরে নেই যে, ডাক্তার যা করছেন, তা রোগীর ভালোর জন্যই (কারণ, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান মানবিক!)। এভাবে ডাক্তার হয়ে ওঠেন রোগীদেহের উপর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এই ক্ষমতা আসছে ডাক্তারের বিশেষ জ্ঞান হতে। একারণে ফুকো এই একে বলেছেন “পাওয়ার/নলেজ”, যেখানে পাওয়ার ও নলেজ একে অপরকে signify করে।

জ্ঞান চর্চার এই আধূনিক প্রক্রিয়া প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবার মধ্যে দিয়ে সূত্রপাত হয় জ্ঞানের বিশেষায়নের, যা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের জন্ম দেয়, যেমন আইনবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, ইত্যাদি। একই সাথে এই প্রক্রিয়া আরেকটা কাজ করে, তা হলো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান চর্চার পরিধির বাইরে যাবতীয় জ্ঞান কে অবৈজ্ঞানিক, কাজে কাজেই পরিত্যাজ্য ঘোষণা করে। এখানেই শুরু হয় বিশেষজ্ঞ তথা বুদ্ধিজীবির আত্ম-পরিচয়ের রাজনীতি, যেখানে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ দল নিজ নিজ বয়ান (narrative) নিয়ে হাজির হয়+তা’র স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে তাদের বয়ানের যথার্থতা প্রমাণে ব্রতী হয়। নিজ নিজ দলের জ্ঞানের তাৎপর্য ছাড়াও এর উৎপাদন পদ্ধতি, প্রাতিষ্ঠনিক মর্যাদা, অন্যদের স্বীকৃতি, ইত্যাদি বিষয়ে নানান বিতর্ক শেষে কোন এক দলের বয়ান, তথা জ্ঞান গ্রহনযোগ্য বলে গৃহীত হয় (enters the Discourse), বাকিরা marginalized হয়ে সংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, মিথ ইত্যাদি নাম নিয়ে জ্ঞানের জগত থেকে বিতারিত হয়।

এই যে জ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি, তা কিন্তু শুধুই জ্ঞানের গভীরতার দ্বারা নির্ণীত নয়। এখানে অনিবার্য ভাবেই এসে যায় ক্ষমতা। এই ক্ষমতাও কোনো ব্যক্তি হতে নয়, আসে কিছু নৈর্ব্যক্তিক উৎস থেকে, যেমন, রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয়, চার্চ, প্রভাবশালীদের সংঘ, ইত্যাদি ত্থেকে। এইসব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির জ্ঞানকে স্বীকৃতি দেয়। বিনিময়ে এই বিশেষ জ্ঞান সেইসব প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বকে সমুন্নত করে। এভাবে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা হাতে হাত ধরে চলে। ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠান যেমন বিশেষজ্ঞের জ্ঞানকে ব্যবহার করে নিজ কর্তৃত্ব বজায় রাখে, তেমনি সেইসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার মাধ্যমে বিশেষজ্ঞও হয়ে ওঠে ক্ষমতাবান। এই ক্ষমতাও প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতার মতো নৈর্ব্যক্তিক। এটা আসে কতিপয় বিশেষজ্ঞের একটা নির্দিষ্ট দলের সমন্বিত প্রয়াসে। আর এই ক্ষমতার উৎস হল বিশেষজ্ঞের দিক থেকে a generalized will to pwoer, যা’ মূর্ত হয় সমন্বিতভাবে তাদের সকলের ‘ability and/or possibility of being able to speak the truth’-এই দাবিতে।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে, এই পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ তার মতামতকে আর জ্ঞান বলেন না, বলেন সত্য। কিছু নির্ধারিত রীতিনীতি+ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠানের আশ্রয় ও প্রশ্রয়+শাসনযন্ত্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় একটা বিশেষ দলের একটা বিশেষ সময় ও প্রেক্ষিতে কোন বিশেষ বিষয়ের “”বিশেষ জ্ঞান”” হয়ে ওঠে “সাধারন জ্ঞান”।

ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় তারা এই সাধারণ জ্ঞানকেই সত্য বলে চালিয়ে দেয়, চাপিয়ে দেয় সকলের উপর। পাঠশালা আর পাঠ্যক্রমের যাতাকলের মাঝ দিয়ে শুধু বের হয়ে আসে কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সনদধারি কতিপয় বিশেষজ্ঞ, যারা কোন ডিসিপ্লিনের একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ে স্পেশালাইজেশন করে আসলেও বনে যান সেই ডিসিপ্লিনের সামগ্রিক জ্ঞানের গ্রহনযোগ্য একমাত্র মুখপাত্র। অন্যদিকে সেই ডিসিপ্লিনেরই কোন কোন বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা সত্বেও শুধু প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের সনদ না থাকায় বাকিরা হয়ে থাকেন অশিক্ষিত, কাজে কাজেই অপাংক্তেয়।

২০০০ সালের দিকে বাউল করীম শাহের বক্তৃতা শুনেছিলাম ঢাবি’র এক ছোট্ট প্রোগ্রামে। এখনো মাঝে মাঝে মনে হয় জ্ঞানের
পথ ও পাথেয় নিয়ে তেমন গভীর আর কোন বক্তৃতা শোনা হয়নি। নানা জায়গায় নানা পাঠ্যক্রম আর আলোচনার মাঝে কবেই হারিয়ে গেছে করীম শাহের সেই সব কথা। কিন্তু অধ্যাপক আমিনুলের গাইডবই-গোত্রীয় পাশ্চাত্যের দর্শন বিষয়ক বইটা এখন জ্ঞানের আধারই বটে। লালন এবং অন্যান্য বাউলরা প্রতিনিয়ত দর্শনের মূল ধরে নাড়া দিয়ে গেলেও তা সনদের অভাবে জ্ঞান হয়ে উঠতে পারে না, লোকায়ত সংস্কৃতির পরিচয়ে আড়ালে থেকে যায়। বিশেষজ্ঞের জ্ঞানের সত্য হয়ে ওঠার প্রয়াস এক পর্যায়ে এতোটাই জোড়ালো হয়ে ওঠে যে, তা সাধারন মানুষের নিজেদের সম্পর্কে জানার থেকেও বেশি জ্ঞান দাবি করে বসে (as if the specialists know people better than the people themselves)। এই পর্যায়েই বিশেষ জ্ঞানের সাম্রাজ্যবাদ স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। যেমন, ডাক্তার দাবি করেন যে তিনি রোগীর অনুভব রোগীর থেকেও বেশি বোঝেন, সাইকিয়াট্রিস্ট মনোঃবৈকল্যের রোগীর সমস্যা তার থেকেও বেশি জানেন, বা সমাজ সংস্কারক সেমসেক্স বিষয়ে সেমসেক্স কাপলদের থেকেও বেশি জানেন।

এডওয়ার্ড সাঈদ তার ‘ওরিয়েন্টালিজম’ বইয়ে ফূকোর এই তত্ত্বের প্রয়োগ করে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন কিভাবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে একটা বিশেষ ধরণের জ্ঞান উৎপাদন করে যা অধিকৃত বিশ্বের উপর পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদকে স্বাভাবিক হিসেবে বৈধতা দেয়, ঠিক যেভাবে ডাক্তারী জ্ঞান রোগীর শরীরের উপর ডাক্তারের ক্ষমতার বৈধতা দেয়। ডাক্তারের মতোই ওরিয়েন্টালিজম জাস্টিফাই করে যে প্রাচ্যের ভালোর জন্যই পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদ! সাঈদ সুনির্দিষ্ট করে দেখিয়েছেন কি কি প্রাতিষ্ঠানিক রীতি, কোন কোন প্রতিষ্ঠান, কোন কোন বিশেষজ্ঞ, আর কি কি ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে “ওরিয়েন্টালিজম” জন্ম+বিকাশ লাভ করেছে। তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে একটা বিশেষ ধরনের সিস্টেমের মধ্য দিয়ে প্রাচ্য-বিষয়ে এখানকার লোকেদের থেকে পাশ্চাত্যের বিশেষজ্ঞ বেশি জানেন বলে দাবি প্রতিষ্ঠা করেন, কিভাবে আধূনিক শিক্ষা আর মনবতাবাদি খোলসের আড়ালে থেকে প্রাচ্য-বিশেষজ্ঞরা পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদকেই বৈধতা দিয়েই চলেছে।

যে জ্ঞান মানুষ বিনা বাক্যে/প্রশ্নে মেনে নেয়/গ্রহন করে/অনুসরণ করে (অর্থ্যাৎ,সাধারণ জ্ঞান) তা’কে তত্ত্বীয় পরিমন্ডলে বলা হয় “হেজেমনি”। গ্রামসি মার্ক্সের শ্রেণী-সংঘাতের তত্ত্ব থেকে এই কনসেপ্ট নির্মাণ করেছেন। এর দ্বারা গ্রামসি এমন জ্ঞানকে বুঝিয়েছেন, যা মানুষ বিনা প্রশ্নে সত্য/সঠিক/স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেয়। ফুকো যেখানে এই জ্ঞানকে ব্যক্তি+প্রতিষ্ঠানের একটা সামগ্রিক প্রেক্ষিতে দেখেছেন, গ্রামসি সেখানে এটি শ্রেনী-মতাদর্শের আলোকে বিচার করেছেন। বিশেষ কোন মতাদর্শকে এই পর্যায়ে আসতে হলে তা’কে অনিবার্য ভাবেই শ্রেণী-বিভাজিত সমাজের বিদ্যমান জ্ঞান-কাঠামো’র (Discourse) মধ্যে প্রচলিত অন্যান্য মতাদর্শের সাথে সংগ্রাম করে তবেই আসতে হয়। যেমন, ইউরোপে জাতীয়তাবাদকে প্রায় তিনশ বছরের নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ধর্মের আশ্রয়ে থাকা সামন্তবাদকে পরাজিত করে আসতে হয়েছে। আবার জাতীয়তাবাদের নানা ধারাও একে অপরকে পরাজিত করেই এগিয়ে চলে। যেমন, পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ থেকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। আর, যখন যে মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, সমাজের সকলে সেটাকে সাধারণ জ্ঞান হিসেবে বরণ করে নেয়। কিন্তু অন্য মতাদর্শের সাথে সংগ্রামে জয়ী হতে না পারলে তা আর সাধারন জ্ঞানের স্তরে আসতে পারেনা। যেমন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের জাতীয়তাবাদকে আমরা পাত্তা দেই না, কারণ তা’ পর্যাপ্ত ক্ষমতার অভাবে এখনো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মোকাবেলায় নিজের স্বকীয়তা প্রমান করতে পারেনি।

গ্রামসির মতে, ক্ষমতায় থাকা শ্রেণী তাদের মতাদর্শকে সাধারণ জ্ঞানের স্তরে নিয়ে আসার জন্য দুই ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার আশ্রয় নেয়; এক, রাজনৈতিক (Political) প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন আর্মি, পুলিস, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি যাদের লক্ষ্য সরাসরি দমন (Domination)। এইসব প্রতিষ্ঠান শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের বশ্যতা (compliance) আদায় করে এবং এই শক্তি প্রয়োগ ঘটে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে থেকেই (যদিও এরা বাস্তবে প্রায়শঃই সংবিধান লংঘন করে)। দুই, নাগরিক (Civil) প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন বিদ্যালয়, পরিবার, সংগঠন, ইত্যাদি যারা জনগণের সম্মতি (consent) আদায় করে ঘুর পথে, সাধারণ জ্ঞানকে একটা নির্দিষ্ট দিকে চালিত করার মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সরাসরি শক্তি প্রয়োগ না করে জনগণের চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে তাদের মতামতকে নির্দিষ্ট পথে চালিত করে। যেমন- আমাদের দেশে রাজনৈতিক মিছিল নিয়ন্ত্রণ পুলিশ-বিডিআর রাস্তায় সরাসরি শক্তি প্রয়োগ করে যা’কে নাগরিকদের দ্বিমত করার অধিকারকে ক্ষুন্ন করে, কিন্তু তা সত্বেও আমরা মেনে নিই কারণ তা আইনের মারপ্যাচের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ যথার্থ হিসেবে দেখাতে পারে। আবার সরকার শত শত নাগরিককে কর্মচ্যুত করে রাষ্ট্রীয় মালিকানার শিল্প প্রতিষ্ঠান বেচে দেওয়ায় অসংখ্য পরিবার পথে বসলেও আমরা তা মেনে নিই, কারণ নাগরিক প্রতিষ্ঠানগুলো (পাঠ্য-পুস্তক, মিডিয়া, ইত্যাদি) ‘সরকারী মালিকানা ক্ষতিকর’ এই ধারণাটা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সরাসরি কোন শক্তি প্রয়োগ করে না, শুধু আমাদের চিন্তাধারাকে একটা বিশেষ দিকে চালিত করে।

তৌফিক (১৯৯৬-২০০২)ঃ ক্ষুদ্রঋণ কিভাবে আমাদের সাধারণ জ্ঞানের অংশ হয়ে ওঠেছে? এখানে ক্ষমতার রূপটাই বা কি?

উত্তরঃ খুবই প্রাসঙ্গিক বিষয়। গ্রামীন ক্ষুদ্রঋণ এখন শুধু আমাদের দেশে নয়, বরং প্রায় সারা বিশ্বেই মানুষের সাধারণ জ্ঞানের অংশ হয়ে উঠেছে। অর্থ্যাৎ সকলেই বিশ্বাস করে যে ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র মানুষকে ‘বিনা জামানতে’ ছোট কিন্তু কার্যকরী ঋণ প্রদান করে যা’র মাধ্যমে তারা দারিদ্র্যমুক্ত হয়। এই জ্ঞান এতোটাই স্বাভাবিক হিসেবে গৃহীত যে কেউ জানতেও চায় না ক্ষুদ্রঋণের প্রকৃত শর্তগুলো কি কি, সুদের হার কতো, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতারা কি কি কাজে ঋণের অর্থ ব্যয় করে, কি উপায়ে ঋণের কিস্তি প্রদান করে, ঋণ পরিশোধের পর তাদের আর্থিক অবস্থা কেমন হয়, ইত্যাদি যা’র সবগুলোই ক্ষুদ্রঋণের ফলাফল অনুধাবনে অত্যাবশ্যক।

এখানে প্রশ্ন এসে যায় যে, কিভাবে ক্ষুদ্রঋণ আমাদের মনে এইরূপ সত্যজ্ঞান হিসেবে জায়গা করে নিল যে আমরা যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়াই তা’ বিশ্বাস করি? এটি সম্ভব হয়েছে মূলতঃ নাগরিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্রমাগত প্রচারে, সেই সাথে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রত্যক্ষ সমর্থনে। এই বিষয়টা বোঝার জন্য আমাদের লক্ষ্য করতে হবে কোন সময়ের প্রেক্ষিতে ক্ষুদ্রঋণের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে। ১৯৯০ এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের অবাধ প্রসার শুরু হয়। সেই সময় ১৯৯১/৯২ সালে মিডিয়াতে বাংলাদেশকে ‘ইমার্জিং টাইগার’ হিসেবে ব্যাপক প্রচার দেওয়া হয় এই বলে যে, বাংলাদেশ মুক্তবাজার ব্যবস্থা অনুসরণ করলে অচিরেই পূর্ব-এশিয়ায় দেশগুলোর মতো উন্নত হবে! ফ্রী-ফ্লোটিং মুদ্রানীতি, শেয়ার বাজার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারী মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া, শিক্ষা-স্বাস্থ সহ অন্যান্য সামাজিক খাতে রাষ্ট্রের সহযোগিতা হ্রাস, ইত্যাদি তথা আইএমএফ+বিশ্বব্যাংক+এডিবি’র অর্থনৈতিক কাঠামোগত সংস্কারের প্যাকেজ চাপিয়ে দেওয়া হয় উন্নয়নের আশ্বাসে। এই সময় আমাদের নাগরিক প্রতিষ্ঠানসমূহ তথা পরিবার, বিদ্যালয়, মিডিয়া, সংগঠন ইত্যাদিতেও উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন আসে। সেগুলোর কতগুলো নিম্নরূপঃ

১। যৌথ পরিবাবের স্থলে একক পরিবারের ব্যাপক বিস্তার এবং মহিলাদের আয় উপার্জনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি। একক পরিবারকে নারী-স্বাধীনতার জন্য সহায়ক এবং নারীর উপার্জনকে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য অপরিহার্য হিসেবে গ্রহন করা।

২। বিদ্যালয়ের সংগঠন, পাঠ্যক্রম, পরিচালনা, ইত্যাদিতে মৌলিক পরিবর্তন, যেমন- মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে নারী শিক্ষা, অভিভাবকদের ভোটের মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদ গঠন, ছাত্রছাত্রীদের উপর শিক্ষকদের আচরণে নিয়ন্ত্রন ইত্যাদি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে পাঠ্যক্রমে- সামষ্টিক মূল্যবোধের জায়গায় নিয়ে আসা হয় ব্যক্তি-অধিকার, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তি-মালিকানা ইত্যাদি। ফলে ‘একতাই বল’, ‘দশের লাঠি একের বোঝা’, ‘সোনার হরফে লেখা নাম’, ‘টাকার মেশিন’, ‘পন্ডিত মশাই’ ইত্যাদি গল্প পাঠ্যক্রম থেকে হারিয়ে যায়।

৩। মিডিয়াতে ব্যক্তিগত সাফল্যের সাড়ম্বর প্রচারের পাশাপাশি সরকারী প্রতিষ্ঠানের দূর্নীতি+অদক্ষতা, সরকারী প্রতিষ্ঠানের দূর্বলতাগুলো পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের সাফল্য+সম্ভাবনার দিকটা প্রচার করা।

৪। জাতীয় সমবায় আন্দোলনে ভাটা পড়ে, আর সেই শূন্যস্থানে গড়ে ওঠে শত শত এনজিও প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি বিনামূল্যে সমাজসেবার জায়গায় আসে স্বল্পমূল্যের এনজিও সেবা কর্মসূচী।

-এইরূপ সামাজিক প্রেক্ষিতে নাগরিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে আমাদের সাধারণ জ্ঞানকে এমন অবস্থানে নিয়ে আসা হয় যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারী শিক্ষা, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ইত্যাদি উন্নয়ন তথা আধূনিকতার সমার্থক হয়ে দেখে দেয়। আর এইসবের বিকাশে সরকারী বা সমবায়ভিত্তিক যৌথ উদ্যোগের স্থলে এনজিও পরিচালিত (Guided, not directed) ব্যক্তিগত উদ্যোগকে যথার্থ+অপরিহার্য হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি হল একটা সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যখন ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র মানুষের উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে সাধারণ জ্ঞানের অন্তর্ভূক্ত হয়। এই বিষয়টি আরো পরিস্কার হয় ক্ষুদ্রঋণের ইতিহাসের দিকে তাকালে।

ক্ষুদ্রঋণ আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের কাবুলিওয়ালাও ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসা করতো। তার আগে পরে আরো অনেকেই ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসা করেছে যাদেরকে বলা হয় ‘মহাজন’ আর তাদের এই ব্যবসাকে বলা হয় ‘দাদন’। তারা সেটা করেছে ব্যক্তি পর্যায়ে এবং সরকারের বিরোধীতার মুখে (দাদন ব্যবসা আইনত দন্ডনীয়)। কিন্তু এখন সেই একই ব্যবসা এনজিওদের জন্য আইনসিদ্ধ (গ্রামীন অধ্যাদেশ, ১৯৮৪)! উল্লেখ্য, এই আইন এসেছে স্বৈরশাসকের কাছ থেকে, কোন গণতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে নয়।

এই বিষয়টা আবারো পরিস্কার হয় ক্ষুদ্রঋণ এবং এই মডেলের প্রবক্তা ডঃ ইউনূসের প্রাপ্ত পুরস্কারসমূহের সময়কাল এবং পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থাগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে। ফিলিপাইনের ম্যানিলাভিত্তিক ম্যাগসেসে পুরস্কার থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকায় অবস্থিত জাতিসংঘের নানা সংস্থার পুরস্কারগুলো আসা শুরু হয়েছে ১৯৯০-এর কাছাকাছি (আগে+পরে) সময় থেকে। সবথেকে লক্ষ্যনীয় হল, সমাজতান্ত্রিক ব্লক থেকে ক্ষুদ্রঋণের স্বীকৃতি+পুরস্কারের ঘাটতি! অথচ পুঁজিবাদের তুলনায় গরীবের জন্য দরদ/সহানুভূতি সমাজতান্ত্রিকদেরই বেশি হওয়ার কথা।

কোন বিশেষ জ্ঞান সাধারণ জ্ঞানের অংশ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার ভূমিকা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয় পর্যায়েই লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তি পর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে প্রচার করা হয় ক্ষুদ্রঋণের ‘দারিদ্র্যনাশিনী’ ভূমিকার কথা। বিবিধ ডিগ্রীধারী (কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতাহীন) এইসব বিশেষজ্ঞের বক্তব্যের বিপরীতে ডিগ্রীহীন (কিন্তু ভূক্তভোগী) ঋণগ্রহীতার বক্তব্য স্বভাবতঃই বিজ্ঞানভিত্তিক তথা গ্রহনযোগ্য জ্ঞান হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। বিশেষজ্ঞের ডিগ্রী হতে আসে একধরণের ক্ষমতা যা’ তার বক্তব্যকে জ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে দেয়, আর ঐরূপ ডিগ্রীর অভাবে ঋণগ্রহীতাদের বক্তব্য পরিত্যক্ত হয়। আর প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে রাষ্ট্র ও বৈদেশিক পুঁজির সরাসরি সমর্থনে স্কুল+মিডিয়া+গবেষণা সংস্থাসহ নানা প্রতিষ্ঠান অবিরাম ক্ষুদ্রঋণের সুফল প্রচার করে, আর পাশাপাশি বিরূদ্ধ মতের কন্ঠরোধ করে। যেমন, এই গত মাসে সাপ্তাহিক ২০০০ ছেপেছিল গ্রামীনের হাড়ির খবরের খানিকটা। পরের কিস্তিতেই আবার সম্পাদক শর্তহীন ক্ষমা চেয়েছে গ্রামীনের কাছে। (ক্ষুদ্রঋণের গ্রামসিয়ান বিশ্লেষনের জন্য করীম (২০০৮) একটা দারুন আর্টিক্যাল)।

কামরুল (১৯৯৪-২০০০)ঃ কোন বিশেষ জ্ঞানের সাধারণ জ্ঞান হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ‘প্রচারের’ ভূমিকা কি? বিজ্ঞান প্রচার বিমুখ আমার কিন্তু মনে হয় না। বরং বিজ্ঞান প্রচার বিমুখ হলে নতুন নতুন প্রযুক্তি’র উদ্ভাবন ,প্রচার ও প্রসার ঘটছে কি করে?

উত্তরঃ উদ্ভাবন, প্রচার আর প্রসার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়া। বেশির ভাগ বৈজ্ঞানিক ‘উদ্ভাবন’ হয়েছে আকস্মিক, টার্গেট করে কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিস্কার হয়েছে কি? আর্কিমিডিসের চৌবাচ্চায় নামা, নিউটনের সামনে আপেলের পতন- এসবই দৈব ঘটনা। কিন্তু ‘প্রচার’ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখী; আর এই প্রচারকর্মের সাফল্যই হল ‘প্রসার’। কাজেই জ্ঞান উৎপাদনে প্রচারের ভূমিকা নেই, তবে জ্ঞান প্রসারে আছে। কোন বিশেষ জ্ঞান সাধারণ জ্ঞানের অংশ হয়ে উঠতে প্রচার কার্যের সাফল্য অবশ্যক। একারণেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের উদ্ভাবন তথা জ্ঞান উৎপাদনে প্রচারের কোন ভূমিকা নেই।

মুহাম্মদ (১৯৯৯-২০০৫)ঃ কিন্তু প্রচারের মাধ্যমে যারা জ্ঞান প্রচারে নিয়োজিত হয়, তাদের নিজেদের জ্ঞান কি ঝালাই করে নেওয়া হয় না?

উত্তরঃ না। জ্ঞান প্রচারের পর্যায়ে গেলে তা’ মতবাদ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ধারন করে। কারণ, প্রচারযজ্ঞে জ্ঞান উৎপাদনের পূর্বশত ‘পর্যালোচনামূলক উপলব্ধি’ (critical appreciation) অনুপস্থিত। ফলে প্রচার কার্যের মধ্যে নিজের জ্ঞান অন্যদের সাথে শেয়ার করার মাধ্যমে তা’ ঝালাই করে নেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আর শেয়ার করলেই জ্ঞান ঝালিয়ে নেওয়া যায় না। এর জন্য অপরপক্ষকেও যথেষ্ট (বেশি, সমান, বা কাছাকাছি, কিন্তু কম নয় একেবারেই) জ্ঞান রাখতে হয়। কিন্তু সব মানুষের যোগ্যতা তো এক রকম নয়, বিশেষ করে আমজনতার। আর জ্ঞান প্রচারের শুরু যে অনুমানের ভিত্তিতে তা হল, জনগণ বিষয়টা জানেনা। তাহলে জনগনের মাঝে প্রচারের মাধ্যমে নিজের জ্ঞানের শেয়ার, কাজে কাজেই ঝালিয়ে নেওয়া হবে কি করে? কিন্তু প্রচারে কিছু তো হয়ই, সেটা কি? সেটা হলো জন-সাধারনের কাছ থেকে এই স্বীকৃতি আদায় যে, “বিশেষজ্ঞ যা জানে তোমরা তা জানোনা”।- কিন্তু এটা প্রত্যক্ষে নয়, ঘটে পরোক্ষে। আর জনগণের মাঝে যখন প্রচার হয়ে যায় যে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি কোন নির্দিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, তখন তারা
সেই বিশেষজ্ঞের কথা বিনা বাক্যে সঠিক বলে ধরে নেয়, তা’ তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার বিপরীত হলেও। যেমন লালন শাহ সম্পর্কে ডঃ আহমদ শরীফের করা উক্তি যে, ‘লালন ফকির যদি শিক্ষিত হতেন, তাহলে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ কবি হতেন।’

- ডঃ আহমদ শরীফ বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত। আর তাই তার করা উক্তিও আমরা অনেকেই কোন প্রকার চিন্তাভাবনা ছাড়াই সঠিক বলে ধরে নিই। এটা ঘটে আমাদের এই ধারণা থেকে যে, ডঃ শরীফ আমাদের থেকে বেশি জ্ঞানী। কাজেই তার পর্যবেক্ষন সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা আমাদের পর্যবেক্ষণের চেয়ে বেশি। কিন্তু একটু ভালো করে ভেবে দেখলেই এই উক্তির অসারত্ব প্রতীয়মান হয়। যেমন, রবীন্দ্রনাথকে শিক্ষিত বলা হয়েছে। কিন্তু তার কি কোন ডিগ্রী ছিলো? যদি ডিগ্রী ছাড়াই রবীন্দ্রনাথ শিক্ষিত হিসেবে স্বীকৃত পেয়ে যান, তাহলে ডিগ্রীহীন লালনকে শিক্ষিত বলা হলো না কেন? রবীন্দ্রনাথ আর লালনের মধ্যে পার্থক্য আসলে তাদের ব্যক্তিগত জ্ঞানে নয়, পার্থক্য হচ্ছে ‘কারা+কোথায়’ তাদের ধ্যান-ধারণাগুলোর চর্চা করছে সেইখানে। রবীন্দ্রনাথের ধ্যান-ধারণা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল ধারার জ্ঞান হিসেবে ব্যাপকভাবে পঠিত, কিন্তু লালনের চর্চা সেই তুলনায় নগণ্য। পাঠ্যবই, সভা-সমিতি, আলোচনা অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্র-স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার বলয়ে সর্বদা উপস্থিত। আর তাই তার ধ্যান-জ্ঞান চর্চা করলে শিক্ষিত হিসেবে সার্টিফিকেট পাওয়া যায়। অন্যদিকে লালনের চর্চা হয় মাঠে-ঘাটে, গাছ তলায়, মুখ্য-সুখ্য মানুষের মাঝে। আর এসবের থেকে কোন সার্টিফিকেটও মিলে না, বড়জোর মিলে ‘বাউল’ উপাধী যা’র মানে সংসারত্যাগী বা অসামাজিক। ফলে লালনের ধ্যান-ধারণায় যথেষ্ট বুৎপত্তি লাভ করলেও কেউ শিক্ষিত হিসেবে স্বীকৃতি পায়না। ফলে অশিক্ষিতের মাঝে থেকে থেকে লালনের ধ্যান-ধারণা এবং লালন নিজেও ‘অশিক্ষিত’ই থেকে যান!

রবীন্দ্রনাথ ও লালনের মাঝে এবং সেই সাথে তাদের ধ্যন-ধারণা চর্চাকারীদের মাঝে এই যে শিক্ষিত/অশিক্ষিতের পার্থক্য, তা আলোচ্য ব্যক্তি বা তাদের থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানের কারণে ঘটেনা, ঘটে “প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা”র (Disciplinary Control System) মাধ্যমে যা’র ক্ষমতাই নির্ধারণ করে কোনটা স্বীকৃত জ্ঞান আর কোনটা নয়। এই পার্থক্যকারী ব্যবস্থায় একক ভাবে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয় বরং এই দুইয়ের অবিচ্ছেদ্যভাবে সমন্বিত ক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় একধরণের ক্ষমতা যা’কে ফুকো বলেছেন power/knowledge । জ্ঞান প্রচারের মাধ্যমে অনিবার্যভাবে এই power/knowledge এর ব্যাপ্তি+প্রসার ঘটে। ফলে প্রকৃত জ্ঞানচর্চার পথ সঙ্কুচিত হয়ে যা থাকে তা’ এক ধরণের বিশেষ জ্ঞানের আলোচনা যেখানে জ্ঞান উৎপাদনের থেকে অলরেডী উৎপাদিত জ্ঞানের প্রসারই মূল লক্ষ্য হয়ে পড়ে।

কামরুল (১৯৯৪-২০০০)ঃ “এহেন যে নড়বড়ে যে ভাষার গাঁথুনি, তার মাধ্যমে পাওয়া জ্ঞানের কথার আসল অর্থ কতোটা অবিকৃত ভাবে আমরা পাবার আশা করতে পারি? তা’ই নিয়ে কতোটা আত্মবিশ্বাসের সাথে বিতর্কে নামতে পারি?”- দর্শন , সমাজবিজ্ঞান বা সাহিত্যের বেলায় এটা হয়তো সত্যি (তাও আমি নিশ্চিত না), কিন্তু খাটি বিজ্ঞানের বেলায়ও কি? ধরুন নিউটনের তিনটা সুত্র , এ নিয়েও কি আমি আত্ম-বিশ্বাসের সাথে তর্ক করতে পারবো না? নাকি এটাও নড়বড়ে ভাষার গাঁথুনি’র মাধমে পাওয়া জ্ঞান বলে গন্য হবে?

উত্তরঃ খাঁটি বিজ্ঞান আর ভেজাল-বিজ্ঞান (দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্য) এর পার্থক্য বইয়ে লেখা থাকে না। কারণ, বইয়ের লেখার মধ্যে অর্থ থাকে না। অর্থ তৈরী হয় পাঠকের মনে/উপলব্ধিতে। এর কারণ, ভাষার সীমাবদ্ধতা। লেখার অক্ষর কেবলমাত্র তখনই অর্থময় হয়ে ওঠে যখন সেই অক্ষরগুলো কোন “মানুষ” পড়ে। ভাষার মাধ্যমে লেনদেনকৃত অর্থ/ভাব আসলে পাঠকেরই সৃষ্টি, ভাষার কোন অবদান নয়। ভাষা কেবলমাত্র মানুষের ভাবের বাহন, অর্থ-উৎপাদনে সক্ষম কোন সিষ্টেম নয়। এই কারণে ‘নিউটনের তিনটা সূত্র’ একই ভাষায় একই রকম অক্ষরে লিখে দেখানো হলেও যেব্যক্তি কোনদিন বিজ্ঞান পড়ে নাই তা’র কাছে সেগুলো অর্থহীন, আর বিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে সেগুলো অর্থময় বৈজ্ঞানিক সূত্র।

তবে হ্যাঁ, আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে আলোচনায় নামতেই পারি, কিন্তু তা’ ভিন্ন ভিন্ন বিষয়বস্তুর জন্য বিভিন্ন মাত্রায় হবে, খাঁটি-বিজ্ঞান/ভেজাল-বিজ্ঞান ভেদে নয় (আসলে বিজ্ঞানে এমন কোন পার্থক্য আমি মানিওনা, বিজ্ঞান শুধুই বিজ্ঞান, তা কাউকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাক বা না-যাক [বিজ্ঞানের সংগা দ্রষ্টব্য])। খুবই পরিচিত (familiar)+দ্ব্যার্থহীন (non-controvarsial) বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে আমরা বেশ উচ্চমাত্রায় আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বলতে পারি, যেমন- ‘কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র তৈরী হয়’। এই বাক্য সবার কাছেই অর্থপূর্ণ। কিন্তু যদি বলি যে, ‘হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মিলে পানি উৎপন্ন হয়’, তাহলে তা’ বেশিরভাগের কাছেই অর্থহীন, আজগুবি মনে হবে। এই বাক্যকে অর্থপূর্ণ করতে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক, ল্যাবরেটরীতে ল্যাব এসিষ্টেন্ট আর বাড়িতে প্রাইভেট টিউটরের ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় (যারা সকলেই মানুষ); বাক্য নিজে নিজেই অর্থময় হতে পারে না। তারমানে কি দাঁড়ালো?- ভাষার মাধ্যমে যে ভাবের লেনাদেনা, তা’তে ভাষা শুধুই একটা নির্জীব মাধ্যম, এর বেশি কিছু নয়; যা’ কিছু কর্মময়তা (Action) তা’র সবই মানুষের। এই কারণে শ্রোতা ভাষা বা বক্তব্যের বিষয়বস্তুর দিয়ে নয়, প্রভাবিত হয় বক্তা/ব্যাখ্যাকারীর মাধ্যমে। বিষয়বস্তু খাঁটি-বিজ্ঞান বা ভেজাল-বিজ্ঞান তা’তে কিছু যায়-আসে না। ভাষার মধ্যস্থিত গ্যাপের কারণে একই বাক্যের সম্ভাব্য নানা অর্থের মধ্য থেকে শ্রোতারা কোন অর্থটা গ্রহন করবে তা’ নির্ধারিত হয় শ্রোতাদের মাঝে বক্তার সাধারণ পরিচয়ে। এই কারণে উক্তির কিভাবে মূল্যায়ন হবে তা’র বিচারে অনিবার্যভাবেই এসে যায় কে/কারা সেই উক্তি করেছে, কাদের উদ্দেশ্যে করছে, আর বক্তা ও শ্রোতাদের মাঝে সম্পর্কের স্বরূপটাই বা কি। আলোচ্য উক্তির বিষয়বস্তু সেখানে গৌণ, বক্তার পরিচয় এবং শ্রোতার সাথে বক্তার/ব্যাখ্যাকারীর সম্পর্ক মূখ্য।

ব্লগ থেকেই উদাহরণ দেই। (কেউ মাইন্ড করবেন না, প্লিজ। এই নামগুলো উল্লেখ করে আমি ভাষার অক্ষমতাকে আরো স্পষ্ট করার চেষ্টা করছি মাত্র)।- মুহম্মদের সাথে প্রচার+ক্ষমতার আলোচনায় আমার মতের অমিল থেকেই আমি লিখেছিলাম ‘মুহম্মদের প্রশ্নের উত্তরে জ্ঞান, জনপ্রিয় জ্ঞান ও ক্ষমতা নিয়ে আমার ভাবনা’ এই লেখাটি। এখানে লক্ষ্যনীয় যে আমার লেখার মূল বিষয়টা ছিল মুহম্মদের ধারণা অনুযায়ী ‘জনপ্রিয় বিজ্ঞান’, সাধারণভাবে বিজ্ঞান আর সুনির্দিষ্ট ভাবে ডারউইনের বিবর্তনবাদ নয়। কিন্তু মুহম্মদ নিজে, সানাউল্লাহ ভাই, কামরুল আর সোহেল ভাই আমার লেখায় বিজ্ঞান (বা বিবর্তনবাদ) খুঁজলেন। কেন? আমার লেখায় কোথাও ত বিজ্ঞান বা বিবর্তনবাদ আসার কথা নয়। আর ‘জনপ্রিয় বিজ্ঞান’ মানে ত বিজ্ঞান বা বিবর্তনবাদ নয় যে ‘জনপ্রিয় বিজ্ঞান’ বিষয়ক যেকোন আলোচনা মানেই তা’কে বিজ্ঞানের বা বিবর্তনবাদের আলোচনা ধরে নিতে হবে। তাইলে?- এটা ঘটেছে এই কারণে যে, মুহম্মদ বিবর্তনবাদের একজন একনিষ্ট সমর্থক+আলোচক হিসেবে সিসিবি’তে (সচলায়তনেও) সবার মাঝে ‘বিজ্ঞানমনষ্ক’ বলে পরিচিত। কাজেই ওর ধারণার বিপরীতে যেকোন ধারণাই পাঠকের মধ্যে বিজ্ঞানবিরোধী হিসেবে ‘ধরে-নেওয়া’র প্রবণতা তৈরী হয়ে আছে যা’ অবস্থান ভাষার মধ্যে নয়, বরং ভাষার বাইরে আমাদের পারস্পারিক সম্পর্কের মধ্যে। আবার মুহম্মদকে কেউ কেউ সাধারণভাবে ধর্মের বিরুদ্ধে জিহাদে সক্রিয় হিসেবে জানেন, যেমন ফয়েজ ভাই। আর তাই তিনি (এবং সম্ভবতঃ তার মতো অন্যান্যরাও) মুহম্মদের সাথে আমার আলোচনার কেন্দ্রে ধর্মকে দেখতে চাইলেন। আবার হোসেন মন্তব্য শুরুই করেছে আমার সাথে দ্বিমতের ঘোষনা দিয়ে যে, ‘খাঁটি বিজ্ঞান’ ক্ষমতামুখী নয়! কিন্তু আমার আলোচনায় ত খাঁটি বিজ্ঞান নাই, ছিল ‘জনপ্রিয় বিজ্ঞান’। এহসান ভাই শেষ কমেন্টটায় পুরো বিষয়টা সুন্দরভাবে পরিস্কার করে বলেছেন যে, আমার পোষ্টের শিরোনামটাই ছিল ‘মিস লিডিং’!- তাই কি? আমি ত শিরোনামে যা লিখেছি, তারই আলোচনা করেছি। তাইলে?

আশা করি, ভাষার সাথে শব্দ/বাক্যের অর্থময়তার সম্পর্কে এখন এই দাবী করা যায় যে, শব্দ/বাক্যের অর্থের অবস্থান ভাষার মধ্যে নয়, ভাষায় বাইরে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের জালে (অর্থ্যাৎ, সমাজে)। এই কারণে বাক্যের অর্থ নির্ধারিত হয় আলোচনার বিষয়বস্তু দ্বারা যা আবার আলোচনায়রত ব্যক্তিবর্গের মাঝে বিদ্যমান সম্পর্ক অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

প্রশ্নঃ বিশেষজ্ঞ জ্ঞান আর ভাষার এই সীমাব্ধতার সাথে ক্ষমতার কি সম্পর্ক?

উত্তরঃ বিশেষজ্ঞ জ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সত্যিকার অর্থেই সুপিরিয়র জ্ঞান যা’র উপর নির্ভর করা যায়। কিন্তু বাস্তবতার কারণেই সকল মানুষের পক্ষে সকল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া সম্ভব নয়। অর্থ্যাৎ, আমাদেরকে নানা বিষয়ের বিশেষজ্ঞের উপর নির্ভর করতেই হয়। এই নির্ভরতা থেকে বিশেষজ্ঞের হাতে এই ধরণের ক্ষমতা চলে আসে যা’কে বলা যায় বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা। আর ভাষার সীমাবদ্ধতা এই বুদ্ধিজীবির এই ক্ষমতাকে তার অনুসারিদের মাঝেও ছড়িয়ে দেয়, অর্থ্যাৎ বিশেষজ্ঞ না হয়েও তা’র নামে অ-বিশেষজ্ঞরাও সেই জ্ঞান থেকে উৎসারিত ক্ষমতা চর্চা করতে পারে, যেমন কোন বৈজ্ঞানিকের বা দার্শনিকের মতের অনুসারিদের বিজ্ঞানমনস্কতার দাবী, এবং সেখান থেকে তাদের সামাজিক কর্মসূচীর বৈজ্ঞানিক ভিত্তির দাবী। আবার কোন কোন বিশেষজ্ঞ নিজের স্পেশালাইজেশনের বাইরে অন্য বিষয়েও পান্ডিত্যের দাবী, যেমন ডঃ জাফর ইকবালের ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ রচনা!

Karim, Lamia 2008 “Demystifying Micro Credit: The Grameen Bank, NGOs, and Neoliberalism in Bangladesh” in Cultural Dynamics 20(1):5-29.

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন