সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০০৯

কবি কাজল শাহনেওয়াজের কবিতা







বেসামরিক দর্জিঘর

বেসামরিক দর্জিঘরের সামনে দাঁড়ায়ে বলি
খলিফা সাহেব কই, খোলেন ভাই দর্জাটা তাড়াতাড়ি
কাশেমের টুকরাগুলি কুড়ায়ে কুড়ায়ে আনছি
কাশেমকে জোড়া দিয়া দেন

ওহাব খলিফার গুহা জংগলের। গুহা হলেও একটা গাছের গুড়ির গুহা।
কাঠের গুহায় কাঠের মেঝে
তাতে কাঠের চেয়ার কাঠের চোকি
একটা কাঠের সেলাই মেশিন
আমরা ঢুকতেই সে কাঠের সালাম ঠুকল

আমরা বললাম ভাই সাহেব
মরা রোমিও জুলিয়েটকে সিলাই করে বাঁচান
আপনার হাতে কত কেরামতি!


ধোপাভাই

আমার সার্টগুলি ধুতে হবে
গাছের বাকল এবার বদলাতে হবেই হবে
এই নতুন ঋতুতে

আমি একটা সত্যিকারের ধোপার কাছে যাব
আমি একটা জ্যান্ত ধোপার কাছে যাব
আমি আমার ময়লা সার্টটাকে খাঁটি পানিতে ধুতে চাই

ধোপাভাই তোমার আগুনে পোড়া শক্ত হাত দিয়া
আমারে একটু কেঁচে দাও
তোমার ঘামে আমাকে একটু চুবিয়ে নাও
তোর নিরিবিলি কথার লালার মাড় দিয়া
আমার সার্টটাকে একটু ইস্ত্রি করে দিবি না?

নাপিত ভায়া

নাপিত ভায়া তোমার নাই একটাও টিকটিকি
তোমার ক্ষুর ভোতা হয়ে গেছে
চতুর্দিকে কবিতার হাতছানি
তুমি শুধু কাটো চুল
তোমার চোখের নিচে কালো বাকরখানি

কত কবির ভোকাট্টা চুল
তোমার কেচির কিচির মিচিরে উড়ে যায় সুদূর আকাশে
যে কবি তুমি তাকে বানাও বর

হে নরসুন্দর, বুঝিনা তোমার সুন্দরতা
পেখম ধরা গাল থেকে কি মনে করে
তুমি তরুণ শিল্পীর দাড়িগুলি চেছে ফেলো


মদিগ্লিয়ানি

মদিগ্লিয়ানি কশাইখানা থেকে বের হয়ে
পাল বাড়িতে গেল
পোড়ামাটির গায়ে রক্তারক্তির কান্ড দেখবে
কার মুখ যেন নীল রঙের চাদরটা দিয়ে ঢাকা
চোখ থেকে গলে গলে কোকিল বর্ণের কান্নার ফোঁটা ঝড়ছে

মদিগ্লিয়ানির ঘামগুলি কত তাজা
মদির শ্বাসগুলি কত জোড়ালো
তুলির রেখাগুলি কত মোটা

মদিগ্লিয়ানি মদিগ্লিয়ানি
জগতের পিকাশোকে দেখে হাসো
আর খালি বোতলটা ছুঁড়ে দাও ওর ছবি বিক্রি করা টাকার ওপর

আর চল ভুলে যাই প্রদর্শনীর আলো,
নিজেকে নিয়ে যাই গভীর বেদনার কাছে
যার কাছ থেকে মুক্তি নাই, ক্ষমা নাই কোন মানুষের

রাষ্ট্র আমাদের রাস্তার মৃত্যু থেকে বাঁচাতে পারবে না
সংঘ আমার শুন্যতা ভরে দেবে আর কবে
মধ্যরাতগুলি তার স্নেহ চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে
ফিরবার পথগুলি দেয়াল দিয়ে আটকানো

একটা চোখ থেকে কোকিল বর্ণের কাজল ধারা
একটা গর্ভবতীর অপেক্ষা মরা নদীর কালোপাড়ের শহরে
চোখটাকে একটু ব্যাকা করে তাকাই
আর ঠোটের কোনায় ঝুলিয়ে দেই অপেক্ষা।


যা হবার তাই হয়েছে

আবার আমরা একত্রিত হচ্ছি
সাইক্লোনগুলির পর সুন্দরবন যেভাবে জেগে উঠছে
সধবার বেদনা থেকে
পরিত্রান পায়না দিনগুলি

গালফোলা মেয়েটা কোথায় যায়
তা নিয়ে চিন্তা করি না

একটা আম গাছের ঝুঁকে থাকা দেখে
মনে পড়ে চোরের তালা খোলার কথা

নতুন নতুন রাস্তায় হাটছে দেখি
কবরে শুয়ে থাকা আমার বন্ধু নাসিম

মোচড় দিয়ে ওঠে প্রাতঃরাশ
জনতার মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়

মায়ের কোল জুড়ে আকাশ নয় নক্ষত্র নয়
বাবার পথ থেকেও চলে গেছে চাঁদ

ছেলেটার সাথে মেয়েটার সতের ঘন্টা কথা হবার পর
জিজ্ঞেস করে কে তুমি বলতো এবার, মুঠোপরী!

যা হবার তাই হচ্ছে
আবার আমরা মিলিত হচ্ছি
বহুদিন পর!

একটা তাল গাছের কথা

আমি একটা উঁচু তাল গাছ। আমার মাথা একেবারে সব গাছ ছাড়িয়ে বাবুই পাখির বাসার কাছাকাছি। বাবুই পাখিরা আমার প্রতিবেশী।

উঁচু থেকে আরো উঁচুতে ওঠার আকাঙ্খাই আমাকে এতো উঁচুতে নিয়ে এসেছে। ভালই আছি এই উঁচুতে। অনেক দূরের অনেক কিছু দেখতে পাই। খোলা মাঠের জন্য আমাকে হা হা করতে হয়না। সকাল বা বিকাল দেখার জন্য কোথাও যেতে হয় না।

সত্যি বলতে কি একটা সময় আমার এত উপরে ওঠার কোন ইচ্ছাও ছিল না, ভালও লাগত না। সবার সাথে মিলে মিশে ছিলাম। অন্যরা যখন হু হু করে বড় হতে থাকত, আমি থাকতাম আমার পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা টুনটুনিদের সাথে। মাটির পোকামাকড়দের গরমের দিনে বাতাস করতাম। বৃষ্টির দিনে ছাতি ধরতাম শিয়ালের বউয়ের মাথায়।

একদিন দেখলাম সবার চেয়ে আমার বেশ খানিকটা বাড় হয়েছে। কবে যে উচ্চাকাঙ্খার ডাক এসেছিল মনে নাই, তবে উড়ে যাওয়া কাকের আত্মার নীল একটা ঢেউ আমাকে ছুঁয়ে ছিল

আজ আমি ভালবাসার উর্ধ্বে একটা উঁচু তাল গাছ
ভীষন ফাঁকা উঁচু আর এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকি
আর ছোট ছোট বাবুই পাখিরা আমার প্রতিবেশী
অনেক উঁচু থেকে আর অনেক দূর থেকে
মিষ্টি ধোঁয়া ওঠা ঘাস আর পোকা মাকড় কে দেখি
সারাদিন ধরে ভাবি ওদের, শিয়ালের বাচ্চাটাকে ভাবি
কিন্তু ওরা আমাকে ভুলে গেছে
ওরা আমাকে একটা লম্বা গর্বিত একা তাল গাছ ছাড়া কিছুই ভাবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন