বুধবার, ২৬ আগস্ট, ২০০৯

সেলিম আল দীনঃ কিছু স্মৃতি কিছু প্রশ্ন

সেজান মাহমুদ

গত সোমবার (জানুয়ারি ১৫, ২০০৮) আধুনিক বাংলা নাটকের অন্যতম পুরোধা, বাংলা নাটককে বিশ্বমানে উন্নীত করার অগ্রগণ্য সৈনিক সেলিম আল দীন মৃত্যুর সংগে লড়াই করতে করতে অবশেষে চিরদিনের মতো চলে গেলেন। চলে গেলেন বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, ভক্ত, অনুরাগী, প্রিয়জন, সর্বোপরী বাংলা সাহিত্যের এই শক্তিশালী ধারাকে কিছুকালের জন্যে হলেও কান্ডারীবিহীন করে দিয়ে।


এ্যাংলো-আইরিশ নাট্যকার, লেখক অস্কার ওয়াইলড একবার বলেছিলেন, ’এই পৃথিবী এক নাট্যশালা, কিন্তু এর পাত্রপাত্রি নির্বাচন করা হয়েছে একদম বাজে ভাবে ’। নাটকান্তপ্রাণ সেলিম আল দীন একথা খুব ভালোভাবে জানতেন বলেই বোধহয় কখনও রাজনীতি বা ক্ষমতা নিয়ে কোন ধরনের টানাহেচরাতে যেতেন না। বরং নিভৃতে, নিরালায়ে গবেষক, ধ্যানীর একাগ্রতা নিয়ে কাজ করে গেছেন আপন মনে। আর তারই ফলশ্রুতিতে ’কেরামত মঙ্গল’, ’চাকা’, ’হাত হদাই’, ’যৈবতী কন্যার মন’, ’বনপাংশুল’, ’প্রাচ্য’, ’নিমজ্জন’ বা ’স্বর্ণবোয়াল’ -এর মতো আধুনিক, বিশ্বমানের নাটকের জন্ম।
সেলিম আল দীনের সংগে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় সেই আশির দশকের শেষদিকে তাঁরই এক ছাত্র ’রাজু’র মাধ্যমে। আমরা তখন ’ডকুমেন্টারি ড্রামা’ বা ’কমিউনিটি থিয়েটার’ এর ধারণাগুলোকে ব্যবহার করে স্বাস্থ্য-শিক্ষাকে একেবার সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেয়া যায় কিনা, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে চায়ের কাপে ঝড় তুলি। রাজুই একদিন বললো, ’আমি সেলিম স্যারের কাছে তোমাদের গল্প করেছি, তিনি জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটির বাসায় নেমন্তন্ন করেছেন।’ তখন তৃষ্ণা আর আমি নিমগ্ন প্রেমিক-প্রেমিকা, এমনিতেই পুরনো ঢাকার মেডিক্যাল কলেজের গন্ডি পার হয়ে যাওয়ার জন্য উন্মুখ। সেদিন জাহাঙ্গীর নগরে সেলিম ভাইয়ের বাসায় সারাদিন কাটিয়েছিলাম। প্রথম পরিচয়ে মানুষ যে এতোটা কাছে টেনে নিয়ে পারেন আমার ধারণা ছিলো না। গল্প, নাটক নিয়ে আলোচনা চললো; তখন আমিও টগবগে তাজা তরুন, তড়িৎ গতিতে কথায় চলে আসে ইস্কিলাস, মলিয়ের, কাম্যু, আরও কত কি! খুব গর্বের সংগেই বলি, সেলিম ভাই ভীষণ পছন্দ করেছিলেন সেই একদিনেই। নিজের হাতে নিজের রোপা গাছ থেকে পেয়ারা এনে খাওয়ালেন। সেলিম ভাই এবং ভাবীর গাছ লাগানোর শখ ছিল খুব।তারপর থেকে শুধু যোগাযোগ একটা সম্পর্কে দাড়িয়ে গিয়েছিল খুব কম সময়েই। তাঁর সংগে সম্পর্কের একটি ঘটনা না বললেই নয়, তার কারণ এটি আমার জীবনে অনেক স্মরণীয় ঘটনার একটি। তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে সেলিম ভাইয়ের ধারাবাহিক নাটক হচ্ছে, ’ছায়াশিকারী’। তৃষ্ণা তাতে একটি চরিত্রে অভিনয় করছে। নাটকের রিহার্সেল হবে বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি রুমে। ফোনে কথা বলার সময় সেলিম ভাই বললেন তুমিও চলে আসবে রিহার্সেলে। আমি বললাম, আমি কেন? আমি হয়তো তৃষ্ণাকে নামিয়ে দিয়ে আসবো। সেলিম ভাই বললেন, না, তুমি থাকবে এই রিহার্সেলে, তোমার কাজ হবে ক্যারেক্টারগুলো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যাখ্যা করে দেয়া। এ আবার কেমন কথা? কোন নাট্যকার কি এটা করেন? এই নাটকে অভিনয় করেছিলেন সেই সময়ের সব প্রতিশ্রুতিশীল, এখনকার স্বনামখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রী, শহীদুজ্জামান সেলিম, আফসানা মিমি, নাদের চৌধুরীসহ আরও অনেকে। নাটকের কোন চরিত্র কেমন হবে না হবে এগুলো নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে আমি বললাম, ‘এই নাটকটিকে গুন্টার গ্রাসের টিনড্রামের সংগে তুলনা করলে কেমন হয়? সেখানে যেমন প্রধান চরিত্রটি প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ঘোষণা করে সে আর বড় হবে না, অর্থাৎ প্রতিবন্ধী থেকে যাবে, এখানেও নাটকের প্রত্যেকটা চরিত্র কোন না কোনভাবে প্রতিবন্ধী, একধরনের সীমাবদ্ধতায় বন্দী, এটাও একধরনের প্রতিবাদ। তারপর যার যার অবস্থান থেকে চরিত্রায়ন করা যায়।’সেলিম ভাই আমার মনতব্য ভীষণ পছন্দ করেছিলেন। বলেছিলেন তুমি ঠিক আমার মনের কথাটি ধরে ফেলেছো। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে একটা ঘোষণা দিয়ে ফেললেন। এই নাটকে একটি চরিত্র ছিল অন্ধ একজন শিল্পীর। সেলিম ভাই বললেন, এই চরিত্রে সেজান অভিনয় করো। আমি জানি যারা এটা শুনেছিলেন ঐ সময়ে তারা নিশ্চয়ই অবাক ও ঈর্ষান্নিত হয়েছিলেন। আমি নিজেও জানি না তিনি কেন এটা বলেছিলেন, এবং এটা যে কথার কথা ছিল না তাও প্রমানিত যখন তিনি রিহার্সেলের পরেও কয়েকবার বলেছিলেন তার মধ্য দিয়ে। আমি বলেছিলাম, ’সেলিম ভাই, আমি পর্দার আড়ালে থাকার মানুষ। তাছাড়া আমি নাটকে আভিনয় করলে আমি একবারেই শেষ, আর না করলে আমি সারা জীবন বলতে পারবো বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান নাট্যকার আমাকে তাঁর নাটকে আভিনয় করতে বলেছিলেন। এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’ সেই চরিত্রটি পরে খ্যাতিমান অভিনেতা বুলবুল আহমেদ চরিত্রায়ন করেছিলেন।এরপর বিদেশে চলে এলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে যোগাযোগ হতো টেলিফোনে। একবার তাঁর পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী পালন হলো ঘটা করে। আমরা আমেরিকা থেকে ফোন করি তাঁর বাসায়। এতোদিন পরেও ’সেলিম ভাই, শুভ জন্মদিন, হ্যাপী বার্থ ডে’ এটুকু বলার সংগে সংগেই বলেন, সেজান কেমন আছো? তৃষ্ণার কি খবর? আমাদের আরও আবাক হবার পালা!
তাঁর মতো মহান শিল্পী প্রত্যেককে নানাভাবে অবাক করবেন, এতে অবাক হবার কিছু নেই। বাংলাভাষার নাটকে তাঁর অবস্থান যথার্থই কোথায় তা নির্ধারণ করা হলে আরও অবাক হতে হবে আমাদের। তিনি নাটকের আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরিক্ষা করেছেন, ধ্রুপদীধারার সঙ্গে আধুনিক অনুসঙ্গ বিনির্মানে কখনও আশ্রয় নিয়েছেন প্রাচীন উপকথার, কখনও জীবনকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দর্শনের তত্ত্বজ্ঞানের ভান্ডারকে রুপকাশ্রয়ী করে গেঁথেছেন গল্পের বুনন। তাঁর প্রথমদিকের নাটকে কালমুখীনতা লক্ষ্যনীয় থাকলেও, শেষেরদিকের কাজে কালবিরোধীতার লক্ষন দেখা যায়। এর থেকে অনুমান করি যে তিনি তাঁর নিজের সৃজনশীলতার নিরিক্ষাতেও নাটকের মতই ক্লাইমেক্সের বা চূড়ান্ত পর্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। হা হতস্যি, সেই কাজ শেষ হবার আগেই থমকে গেল তাঁর জীবনের ’চাকা’।
আমরা জানি সেলিম আল দীন এক সংগে অনেকগুলো রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ক্রনিক রোগগুলো এরকমই, একটা বাসা বাঁধলে অন্যগুলোও মেহমানের মতো আসে, জুড়ে বসে। তাছাড়া তাঁর মতো নিয়ম-মাফিক-চলা মানুষের মধ্যেও অনেক অনিয়ম জীবনের অনিবার্য সংগী হয়ে ছিল। সৃজনশীল কাজের নিত্য সংগী ’স্ট্রেস’, যা উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্য হূদরোগের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর। তাঁর জন্য সেটাই স্বাভাবিক। এও জানি তাঁকে চিকিৎসার জন্য ব্যাংককে নিয়ে যাওয়ার সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন জাগে কেন এই প্রস্তুতি নিতে হয় জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে? কেন বন্ধু-বান্ধব, শিল্পীদেরই প্রিয়জন হারানোরোধে শেষ মুহূর্তে এসে তড়িঘড়ি করে সব জোগার করতে হয়, যখন আর কিছুই করার থাকে না? আমরা কি জাতীয় পর্যায়ে কোন দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা নিতে পারি না? প্রতিষ্ঠা করতে পারি না কোন ফাউন্ডেশন যা জাতীয় সম্পদের মতো প্রতিভাবানদের অসুস্থতার দূঃসময়ে অর্থ জোগান দেবে? অন্তত পক্ষে ততদিন যতদিন আমাদের নিজের দেশে সুচিকিৎসার সব ব্যবস্থা পর্যাপ্তভাবে থাকছে না। এক্ষেত্রে বড় বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলো এগিয়ে আসতে পারে। নাকি তারাও ঢাকা থাকবে মাত্রাহীন মুনাফার ঘেরাটোপে?
সেলিম আল দীন চিরকালের মতো চলে গেছেন। সংগে নিয়ে গেছেন বাংলা ভাষায় আরেকটি নোবেল পুরস্কার পাবার সম্ভাবনা। কিম্বা কে জানে তাঁর ওপর গবেষণায় হয়তো দেখা যাবে সে সম্ভাবনার বীজ এখানেই নিহিত আছে। এ আমার আতিশয্য নয়, নির্মোহ ব্যক্তিগত মূল্যায়ন। শুধু দেখার পালা তাঁর বিশ্বজনীন আবেদনকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার প্রতিভা কোথায়! ফরাসি-আলজেরিয়ান লেখক, দার্শনিক, নাট্যকার আলবিয়ার কাম্যু’র একবার বলেছিলেন,

"Accept Life, take it as it is? Stupid. The means of doing otherwise? Far from our having to take it, it is life that possesses us, and on occasion shuts our mouths."

জীবনের কাছে আত্নসমর্পন করে জীবনকে মেনে নেয়াই ভালো, নাকি জীবনকে খুঁড়ে নিতে হবে জীবনেরই নির্যাস?, একথার উত্তরও দেবে সেলিম আল দীনের নাটক, এখানেই তাঁর মহৎ কালজয়ীতা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন