সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০০৯

কবি কাজল শাহনেওয়াজের সাথে কথাবিনিময়


স্বাক্ষাতকার - 'কথা' লিটল ম্যাগাজিন অংশ১


প্রকাশিত হয়েছে: কথা, ৫ম সংখ্যা, চৈত্র ১৪১৪/এপ্রিল ২০০৮
সম্পাদক: কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, রেলওয়ে হাসপাতাল (অন্তর্বিভাগ), সিআরবি, চট্টগ্রাম-৪০০০
ই-মেইল: editorkatha@yahoo.com
..........................................................................

আমরা আমাদের আলোচনার শুরুতেই আপনার শৈশব-কৈশোর সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।
আসলে এ সম্পর্কে আামি খুব একটা বলতে চাই না। কারণ যতটুকু এ নিয়ে লেখা যায়, ততটুকু আসলে বলা যাবে না। আমার বাবা সরকারি চাকুরি করতেন - তিনি ছিলেন ভ্যাটেরেনারি সার্জন। তাঁর চাকুরিসূত্রে আমাকেও নানান জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। যার ফলে আমার দেশ বলতে সারা দেশটাই আমার দেশ। আর বন্ধু বলতে সব জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো আমার বন্ধুসকল। আমার শৈশব অনেকটা চরভাঙা মানুষের মতো।

আপনার গ্রামের বাড়ি তো বিক্রমপুর?
বিক্রমপুরে তো আমার দাদার বাড়ি - সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা ছাড়া আমি সেখানে থাকিনি।
আচ্ছা ঠিক আছে - কিন্তু কথা হচ্ছে একাত্তরের সেই যুদ্ধের সময়টা সেখানে তো ছিলেন। সেই সময়ের টোটাল ফিলিংসটা সম্পর্কে কিছু বলুন।
হ্যাঁ, এই বিষয়টা আমার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই সময়টা সম্পর্কে কোথাও কিছু বলি নাই। তবে এই সম্পর্কে আমি বিস্তারিত কিছু বলতে চাই - কারণ এটা আমার জন্য এত বেশি আলোড়িত করার জিনিস, তা নিয়ে কিন্তু মহাপরিকল্পনা নিয়ে বসে আছি। এটা আমার ভিতরে খুব কাজ করে। এ প্রসঙ্গে আমি একটা কথা বলি - কিছু আগেই আমি মাহমুদুল হকের মাটির জাহাজ পড়ছিলাম। তো, সেখানে বিক্রমপুর, একাত্তর/বাহাত্তর আছে- যাই হোক। সেই বইটা পড়েই আমি আমার একাত্তর পুনরায় বোঝার চেষ্টা করলাম। তখন আমার বয়স কত হবে? এই ধরুন, ১০ বছর। আমি কিন্তু তখন অনেক কিছুই বুঝি। ওই জায়গাটা তো তখন ছিল দুর্ভেদ্য এলাকা। চারদিকে নদী - যার ফলে যোগাযোগ ছিল পানি পথে। আমি বাবার সাথে যেখানে ছিলাম সেটা কিন্তু এপ্রিলেই আক্রান্ত হয়ে গেছে। তখন আমরা ছিলাম ফরিদপুরে, সেই সময় আমরা পোটলাপুটলিসহ বিক্রমপুরে চলে আসি। বাবা তখন ফরিদপুর-বিক্রমপুর আসা-যাওয়া করতেন। আর আমি তার আগেই ৬৯-এর মিছিল দেখে ফেলেছি আর-কি। এই মিছিলে যাওয়াটা কিন্তু তখন সবার মধ্যে। আবার বাবা তো সরকারি চাকুরে, যার ফলে যারা মিছিল করত তারা কিন্তু আমাদের বাসার দিকে ঢিল মারত। এটা কিন্তু একধরনের মজার ব্যাপার ছিল - একই সাথে আমরা দুইটা দিকই দেখছি। আর সেই মিছিল, মানুষজন, শ্লোগান - এসব তো এখনও আমার মনে জ্বলজ্বল করছে। হ্যাঁ যা বলছিলাম, একাত্তরের সেই সময় হঠাৎ একদিন গুলির শব্দ শুনলাম, মানুষজন দলে দলে পালাচ্ছে। তখন বয়সের কারণেই হোক, আর যে জন্যই হোক, এইসব ব্যাপারে আমার ছিল দারুণ কৌতুহল। আপনাকে একটা সকালের কথা বলি। সেই সকালে পাকিস্তানি মিলিটারিরা একটা বাজারে এসে আগুন দিল। ফরিদপুরের সেই জায়গাটা ছিল হিন্দু অধ্যুসিত। যার ফলে আর্মিদের আগ্রহটাও ছিল। ওরা পুরা প্যানিক তৈরি করতে যাচ্ছিলো তো। আমি কিন্তু বালকের নির্ভয়ে ১২টার দিকে পুড়ে যাওয়া বাজার দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি আমি তখন যে পাগলটাকে চিনতাম, সে সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে আছে। এটা একটা সাংঘাতিক দৃশ্য ছিল আমার জন্য। আমার এখনও মনে হয়, একটা দারুন বিভতসতা তখনই আমি দেখে ফেলছি।
আমরা যেহেতু সরকারি বাসায় ছিলাম, যার ফলে আর্মিদের সাথেও ইশারায় আমাদের কথা হইতো। কিন্তু ওদের মানুষ বলে মনে হতো না। আরেকটা ঘটনার কথা বলি, তখন মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। তারা সেইখানকার থানা এ্যাটাক করল। সারারাত চারদিকে গুলির শব্দ। সকালে যুদ্ধ থেমে গেলে আমরা গুলির খোসা কুড়াতে গেলাম। তাতে আমরা সেই যুদ্ধের জায়গাটাও দেখলাম। তখন কিন্তু আমার কাছে এটা পরিষ্কার যে একটা বড় যুদ্ধ হচ্ছে এবং তাতে আমরাও একটা পক্ষ। প্রথম দিকে এটা ছিল একটা খেলা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর সবদিকেই সাজসাজ রব শুরু হয়ে গেল। আমাদের স্কুলের মাঠে কে একজন লোক যার যা আছে তাই দিয়ে প্রতিরোধ ট্রেনিং দিতে লাগল। আমরা বালকেরাও ট্রেনিংয়ের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে যেতাম। তখন এসব আমাদের খেরার অংশ। কিন্তু আর্মিরা যখন অনেক মানুষ মেরে ফেলল, তখন কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গেল।
তো, যা বলছিলাম, মুক্তিযোদ্ধারা যখন থানা আক্রমণ করল, তখন দেখলাম আমাদের চেনাজানা ওসি আহত হয়ে কাতরাচ্ছে। তখন কিন্তু আমার খারাপ লাগল। কারণ সে তো চেনাজানা একজন মানুষ। সেই পাগলটা দেখে খারাপ লেগেছিল, আবার এই ওসিকে দেখেও খুব খারাপ লাগল। আমরা সবাই খুব কাঁদ কাঁদ হয়ে গেলাম। মায়েরা তাকে সেবা-শুশ্রূষা করলো একজন মানুষ হিসাবে। এইভাবেই আমার মনে হয় কি, যুদ্ধটাকে অনেকভাবে দেখার আছে।

তা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের একটা কমিটমেন্টের ব্যাপার তো আছে?
আমি ঘটনাসমূহই বলি, তাতেই আমার দৃষ্টিভঙ্গিটাও ক্লিয়ার হবে। আমরা কিন্তু বেশী দিন ওভাবে থাকতে পারলাম না। কারণ কেউ ভরসা পাচ্ছিল না পাকিস্তানিদের নানামুখী অত্যাচারের কথা শুনে। আমাদেরকে দাদার বাড়ি বিক্রমপুরে চলে আসতে হলো। আমরা কার্যত সেখানে স্থবির হয়ে গেলাম। স্কুল নাই, বাইরে যাওয়া নাই। গেরিলা যুদ্ধ ক্রমশ: বাড়তে থাকল। আরেকটা বিষয় হলো, ঐ এলাকাটা সিরাজ শিকদার বাহিনীর জায়গা হওয়াতে সেখানে মুক্তিযুদ্ধের টাইপটাও ছিল অন্যরকম। মুক্তিযোদ্ধারা লৌহজং থানা দখল করেছে এবং সেটা পুড়ায়ে ফেলছে। আমার মনে আছে, আমাদের চাচারা সেখানে গেছে এবং পোড়া কয়লা নিয়ে এসে বলছে, আমরা এই কয়লা নিয়ে দাঁত মাজবো। তাহলে বোঝেন সবার কত খুশি। যুদ্ধের ভিতর কিন্তু বলতে গেলে সব পরিবারই পড়েছে। পলিটিকাল প্রসেস যাই হোক, এতে কিন্তু সব মানুষ ইনভলভ হয়ে গেছিলো, সবাই স্বপ্ন দেখছিল। যুদ্ধ করছিল। জয় পরাজয় নিয়ে ভাবছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছিল। বিশাল আলোড়ন ঘটে যাচ্ছিল। এটা ছোটোখাটো কিছু ছিল না। এটা পুরো জাতির অস্তিত্বের বিষয় ছিল, ছিল একটা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।

হ্যাঁ, একটা পরিবর্তনের বিষয় নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মানুষের জাগরণের সাথে সাথে বিভিন্ন বামদল ও গ্রুপের যে উত্থানটা হলো তাতে রাষ্ট্রীয় নীতির ধরনে কি আপনাকে আশান্বিত বা হতচকিত করেছে?
দেখুন, এর পরে-টরে কিছু নাই; তখন আমার বয়স ১০ বছর ছিল, এখন আমি ৩৫ বছর ধরে দেখছি - আমার অবজার্ভেশনটা হলো এরকম, যারা ক্ষমতা নিয়ে প্লে করছে, মানে যারা পাওয়ার উইনার, তারা প্রতিটি জিনিসকে কিন্তু একটা যুদ্ধ অবস্থার মইধ্যেই রাখতে চাচ্ছে। সবাইকে সর্বদাই সন্ত্রস্ত হয়েই থাকতে হচ্ছে। ক্ষমতার মূল বিষয় মনে হচ্ছে, মানুষজনকে ক্রমাগত সংকটের মইধ্যে রাখতে হবে। যেন সন্ত্রস্ত করে রাখলেই মেজোরিটি মানুষ ক্ষমতাকে ভয় পাবে, কাছে আসতে পারবে না। নিজেকে সেইফ করতে-করতেই তার সময় চইলা যাবে। বড় কিছু করার দিকে সে আসতেই পারবে না। পুরা পৃথিবীর ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার এটা একটা চাল ও বটে। আসল কথা হচ্ছে, কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধ তৈরি করে রাখা। সেটা আমেরিকার ইরাকে গিয়েও হইতে পারে কিংবা বাংলাদেশে উইনি গেম খেলে ও হতে পারে। এটাই এখন পাওয়ারের প্রিয় পদ্ধতি।



স্বাক্ষাতকার - 'কথা' লিটল ম্যাগাজিন। অংশ১ এর পর...

হ্যাঁ, তা হা নয় মানলাম, কিন্তু কথা হচ্ছে তখন প্রগতিশীল রাজনীতির ধারার কিন্তু বিকাশ ঘটল। আমরা তাদের ডেডিকেশনটাও দেখলাম। কিন্তু আপনার এধরনের লেখা বিশেষত রোকনের মৃত্যু বা বাবা নুরদীন-এ কিন্তু এর কিছুই দেখিনি।

লেখার কাজ কিন্তু ঐটা না। আমি সবসময় যেটা বলি, তা হচ্ছে, লেখা আমার সময়টাকে বুঝাইতে পারে, তা কিন্তু কোনো কিছুকে তৈরী করে না। সে সামাজিক বাস্তবতার পিছনে পিছনে যায় আর-কি। যে কথাগুলি আপনি দেখতে চাইলেন, ওইগুলি আসলে স্বপ্ন কথা হচ্ছে, ধরুন, একটা শক্তি অর্গানাইজড হওয়ার আগে অনেক মালমশলা লাগে তো? প্রণোদনা, ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি লাগে। দ্বান্দ্বিকতার অনেক লেয়ার আছে। শিল্প যা করে তা হচ্ছে, যদি মানুষের মনে তা থাকে, তা সে বের করে নিয়ে আসতে পারে। সে মানুষের মনে সেটা ঢুকাতে পারে। ক্ষমতা বদলানোর কাজটা কিন্তু নেতৃত্বের। একজন রাজনৈতিক নেতা স্বপ্নকে নেতৃত্ব দিতে পারে, আর শিল্প-সাহিত্য সেটা জাগাইয়া দিতে পারে। মানুষগুলি আগায়ে গেলে শিল্প-সাহিত্য তা রূপায়িত করতে পারে। কিন্তু তা জোর করে করার বিষয় না।

আমার কথাটাকে আরেকটু পরিষ্কার করতে চাই, স্বাধীনতারপর পর কিন্তু জনমনের ব্যাপক জাগরণ হলো, সর্বহারা পার্টি, আব্দুল হক বা তোয়াহার পার্টি, জাসদ ইত্যাদি হুহু করে বাড়তে থাকল। তার মানে মানুষের ভিতর তখন মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ষ্পষ্ট হচ্ছিল। আমার কথা হচ্ছে, ওইধরনের পটভূমিতে আপনার গল্প আছে ঠিকই কিন্তু মানুষের সেই স্বত:স্ফূর্ত আকাঙ্ক্ষাকে আপনি ধরতে চাননি।
কথা হচ্ছে, আমিও কিন্তু সেই ধরনের বিপ্লবী ক্যারেক্টারদের ভিতরই বড় হইছি। আপনি তো বাজিতপুরের সশস্ত্র বিপ্লবের কথা জানেনই। আবার কিশোরগঞ্জে কিন্তু নগেন সরকারসহ আরও মারাত্মক বিপ্লবীরা ছিলেন। এদের ব্যাপারগুলি কিন্তু আমি ভালো করেই জানি। আমি কিন্তু লেখাপড়ার পাশাপাশি এইধরনের লোকগুলি ধারেকাছেই বড় হইছি। আমার সিনিয়র বন্ধুরা আঙ্গুল কেটে রক্তে নিজের নাম লিখে ওই পার্টি করত। এরা কিন্তু পুরাজীবনটাই ওইসবের পিছনে ব্যয় করছে। কিন্তু ব্যাপার সেটা না, এর এক-একটা সময়ের এক-একটা ভাষা থাকে তো। এখন ধরেন, আমাদের যদি ১৯২০ সালের দিকে জন্ম হতো তাহলে কাজী নজরুলের ভাষায় সবকিছু ভাবতাম। আমি বলতে চাচ্ছি, ১৯২০ সাল আর ১৯৮০ সাল তো আর এক না। কথা হচ্ছে, স্বপ্নের বহুরকম রং তৈরি হয়। যাই হোক, আমাদের আলোচনাটা বোধ হয় অন্যদিকে চলে যাচ্ছে, অবস্টাকল তৈরি হচ্ছে।

তার মানে আমরা কি এটা ধরে নেবো যে রাজনীতির এইধরনের আলাপ আপনার ভাল্লাগছে না?
না না তা নয়, এখানে দুইটা জিনিস আর-কি, রাজনৈতিক চেতনাকে দুইভাবে দেখা যায়। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের কথাই ধরেন, শেখ মুজিব যেদিন নিহত হলেন, আমাদের পরিবারের সবাই কিন্তু ভীষণভাবে আহত হয়েছিল, আমরা সবাই কিন্তু স্তম্ভিত হয়ে গেছিলাম। আবার যখন আমি বিকালে বাইরে গেলাম, তখন যারা গোপন-বামপন্থি রাজনীতি করত তাদের সাথে দেখা হলো। সেখানে নগেন সরকারের সাম্যবাদী দল, অন্য গ্রুপ ছিল, জাসদ ছিল - তখন তাদের ইন্টারপ্রিটেশন ছিল একদম ভিন্ন। তখন আমি হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। তখন মনে হল, আমি তাহলে কোনটা গ্রহণ করব! আমি তখন এত গভীরভাবে জানি না যে কোনটা ঠিক। তখন কিন্তু বলা যায়, ওদের দ্বারা আমি এক বেলার জন্য নিষ্ঠুর হয়ে গেলাম, মনে হল, ব্যাপারটা তাহলে হয়ত অন্যরকম কিছু। তার মানে ব্যক্তিগত অনুভূতি আর পলিটিকাল এনালাইসিস এক হয় না। এতে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গেল, এরা যারা পলিটিকাল ফ্রেমওয়ার্কে থেকে পার্টিজান হয়ে আছে তাদের ভিতর একধরনের যান্ত্রিকতাও আছে। আমি অনেক কিছুই পাঠ করছি, অনেক কিছুই অনেক ভাবে দেখেছি। আমার তখন মনে হলো - না, এই ভাবে আমার যাওয়া সম্ভব না। তখন আমি অনেক আলোচনায় অংশ নিয়েছি। ওই বয়সেই খুব পাকা ছিলাম তো (হা হা হা)। আমার কাছে অনেকে আসত, আমিও অনেকের কাছে গেছি। এমনকি ময়মনসিংহে এগ্রিভার্সিটিতে পড়ার সময়য়েও আমার রুমে অনেক দলের আগাগোনা ছিল। তবে কখনই আমি কিন্তু ওই ফ্রেমের ভিতর ঢুকে যেতে পারিনি। আমি একটা বিষয় বুঝি, যখন বড় জোয়ার আসে, তখন কিন্তু ছোট ছোট বাঁধ আর থাকে না, ভেঙে যায়। ওই যে বড় জোয়ার, তা কিন্তু এখানে আর আসছে না। ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টি হওয়ার পর থেকেও অনেক দিনেও কিন্তু শ্রেণীসংগ্রামের বড় জোয়ারও তৈরি হয় নাই। সেই জোয়ার তৈরি হয়নাই বলেই হয়ত আমি সক্রিয়ভাবে সেসবের সাথে যাইনাই। তবে এটা সত্যি যে, কায়েদে আজমের জীবনী পড়ার সাথে একেবারে সস্তা কাগজে ছাপানো চারু মজুমদারের জীবনী পড়ে আলোড়িত হই। কারণ, এইখানে আমি দেখি - এক. চারু মজুমদারের ফাইটিং স্পিরিট। দুই. তার মানুষকে বাঁচাতে চাওয়া। তার কাছে যে যায় তাকেই সে বদলে ফেলতে পারছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সে কাজটা করেছিল সম্পূর্ণ লোভশূন্য হয়ে।

আপনি লেখালেখির বিষয়টাতে যখন এভাবে নিজেকে রাখতে চাচ্ছেন, আমি একটা বিষয় জানি, আপনি কবিতাও লিখে থাকেন। তো, গল্প আর কবিতার পার্থক্যটা আপনি কিভাবে করেন? আপনার লেখালেখির প্রাথমিক পর্যায় সম্পর্কেও বলুন।
এই সম্পর্কে বলতে গেলে আমার কিছু বাল্যকাল বলতে হয়, আমার বয়স তখন ১৪, তখন আমি প্রথম কিশোরগঞ্জ যাই। তো, সেই বয়সে একজায়গায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া খুব সহজ নয়। ওইখানে একটা লাইব্রেরি ছিল, সেইখানেই আমি যেতাম। তখন ভাবিনি যে আমি লিখব। আমি তখন প্রচুর পড়তাম। তখন পারভেজ নামের এক বন্ধু জুটে যায়। সে লিখত - শুধু লিখত না, প্রেমে পড়ে লিখত। প্রতিদিন একটা করে গল্প লেখে। ও খুবই রোমান্টিক। আর আমি ওর লেখার এনালাইসিস করতাম। এরকম অনেককেই আমি প্রেম-বিরহ-আসা-যাওয়া এসব নিয়ে বৈদগ্ধতা দিতাম। মানে এইদিক থেকে আমি হলাম ওদের তাত্ত্বিক। তবে খুব মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই বন্ধু আমার এখন খুবই ম্যাটারিয়ালিস্ট। এখন সে ইহজাগতিকতার ভিতর ডুবে আছে। যা বলছিলাম, তখন বুঝলাম যে, হ্যাঁ লেখাটা তো এরকম না, লেখাটা তো ওইরকম হওয়া দরকার ছিল। ওরা কিন্তু সেইটা বুঝতেই পারে না। তখন আমি ওদেরকে দেখানোর জন্য কঠিন কঠিন কবিতা লিখতে শুরু করি। কারণ আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ার আগেই, ধরেন, ওই সুধীন্দ্রনাথ পড়তে শুরু করছি। তখন পারভেজকে দেখানোর জন্য গল্পও লিখে ফেললাম। এইভাবে গল্প-কবিতা লিখে ফেললাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা একটা লিটল ম্যাগাজিন বের করবো। ওই সবার সাথে যোগাযোগ করল। সবকিছুর আয়োজন হল। কিন্তু যখন প্রিন্টার্স লাইনে নাম দেয়ার সময় হল তখন আমরা কেউই সেইভাবে জানি না যে কোন পদের কি অর্থ। তবে পারভেজ যেহেতু সবকিছু করছে, ওকে আমরা বানালাম নির্বাহী সম্পাদক। আর যেহেতু আমি প্রুফ দেখছি, কার কার লেখা যাবে না-যাবে ইত্যাদি করেছি, সম্পাদকীয় লিখেছি - সেই জন্য আমি হয়ে গেলাম সম্পাদক। হা হা হা।


ওই ছোটকাগজটার কি নাম নাম ছিল?
মনুমেন্ট।

তখন ওইটাকে কি শুধু কিশোরগঞ্জে অবস্থানকারী সব লেখক ছিল।
না না, ওইটাতে আবিদ আজাদ বা অন্যান্যদের লেখাও ছিল। কাগজটি বের করার পর দেখা গেল লোকজন আমার বন্ধুকে আর খোঁজে না, খোঁজে আমাকে। এই একটা মাত্র ভুলে আমি সম্পাদক হয়ে গেলাম। আমি আসলে কিন্তু তখন একজন বিজ্ঞানী । তখন বন্ধুদের নিয়ে বিজ্ঞান প্রজেক্ট করি। তবে ফরিদপুরে আমার একবন্ধু ছিল, ও ছিল কবি। ওর কথা খুব মনে পড়ে। ওর নাম ছিল খোসবু। ও প্রতিদিন কবিতা লিখত। ওর জীবনটা ছিল নজরুলের মতো। ও এক আত্মীয়ের বাসায় থাকত। তবে ওর কবিতা লেখা সেখানে পাত্তা পেত না। একসময় বাসায় জায়গা নেই বলে ওকে মসজিদে থাকতে হতো। মসজিদের ভিতর লুকায়ে লুকায়ে সে তার বইগুলো পড়ত। আমি তখন বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাপার-স্যাপার, এডভেঞ্চার ইত্যাদি পড়তাম। আমাদের বন্ধু ছিল একজন বৃদ্ধ দরজী। তো ক্লাশ ফাইভে পড়ার সময় একবন্ধুকে পেয়েছিলাম যে কবিতা লিখত আর ৯ ক্লাশে থাকতে পেলাম আর এক বন্ধুকে, যে গল্প লিখত। যখন আমার মনে হত, এইসব আর এমনকি, আমি তো বিজ্ঞানী, অন্য লাইনের লোক। ওরা আসলে না পড়েই লিখত, ওদের ইমোশনটাই ছিল মুখ্য। তবে এখন মনে হয় ওরাই আমাকে কবিতা আর গদ্যের প্রথম পাঠ দিয়েছে।
আচ্ছা, আমাদের তো কথা হচ্ছিলো কবিতা আর গল্পের পার্থক্য নিয়ে। আমি আমার প্রথম কাব্যসাধনার কথা বলি, তখন একটা কবিতা লেখা আমার কাছে রীতিমতো প্রজেক্ট টাইপের ব্যাপার ছিল। তবে গল্পটাকে মনে করতাম কবিতার ফাঁকে-ফাঁকে একটা কিছু। আমি গল্পলেখার শুরুতে অন্যদের নিয়ে গল্প লিখলাম। কিন্তু ৮৫ তে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ কাছিমগালার প্রথম গল্প প্রথম কবিতা লিখতে গিয়ে আমি রীতিমতো অন্যরকম হয়ে গেলাম। আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। আমাদের গ্রুপটা ছিল যারা এত দিন ভালো ছাত্রত্বের মধ্যে থাকতে থাকতে নিজেকে সরিয়ে ফেলতে চায় অন্যত্র তাদের নিয়ে। ওইখানকার একাডেমিকরা আমাদের খুব বেশি ইমেপ্রস করতে পারে নাই। আর তখন দেশে ঘনঘন সামরিক থাবা সব কিছুকে গোলমেলে করে দিচ্ছিল। তখন জীবনকে ডেঞ্জারাস করার দিকেই ঝুঁকে পড়লাম। ওইসময় আমি সত্যিকারের কিছু বিপর্যয়ের মুখোমুখি হই। এর ভিতর সম্পর্কের একটা জটিলতা ছিল। আমি তখন বিভিন্ন জায়গায় আড্ডা-টাড্ডা দিতাম। ফকির-বাউলদের বৈঠকে যেতাম - কখনও দলবদ্ধভাবে, কখনও-বা একা। তখন ঐ আড্ডায় বসে বসে টুকরা টুকরা গদ্য লিখতাম। হয়ত জার্নাল লিখতে চেয়েছিলাম। তো একদিন চয়ন খায়রুল হাবিব বললো (১৯৮৫) ও একটা কাগজ করতে চায়, গদ্যের। আমিও ভাবলাম ছাপবো নাকি এই গদ্যটা? জলপ্রপাত এ ছাপা হল - প্রথম কবিতা। ছাপা হবার পর বুঝতে পারলাম হ্যাঁ আমার মন মতো হয়েছে এটা।

এবার নিজের সাইকোলজি সম্পর্কে কিছু বলুন।
একটা ব্যাপার হচ্ছে, কোনো কিছু থেকে আমি নিজেকে সরায়ে নিতে পারি। যেমন, ধরেন আবৃত্তি/পেন্টিং করলাম কিছুদিন, আবার এসব থেকে আমি নিজেকে হঠাৎ সরায়েও নিলাম। আমার ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এমনও হয়েছে যে, নিজেকে নিরাপদ অবস্থান থেকে সরায়ে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। বারবার নিচ্ছি। এটা ঠিক কেন, তা হয়ত পরে বিস্তারিত বোঝা যাবে। এবার মনস্তত্বের দিকে যাচ্ছি না। শুধু বলতে চাই আমি নিজেকে আসলে বদলাইতে থাকার মধ্যেই রাখতে চাই।

সেটা শিল্পসাহিত্যের জন্যও দরকার?
হ্যাঁ। সরায়ে ফেলতে হয়, তা না হলে এত বিষয় নিয়ে কিভাবে আপনি লিখবেন। একটা বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলে আপনি তো আত্মপ্রেমী হয়ে গেলেন।

ঠিক আছে, আপনার পুর্বের কথা রেশ ধরেই বলছি, সত্যিকারের বিপর্যয়টা সম্পর্কে বিস্তারিত বলা যাবে কি?
না সবকিছু বলা যাবে না, পরে বলব আর-কি হাহাহা। সেভেন্টি সেভেন থেকে আমার ডায়েরিগুলো আছে। তাতে একদম খোলামেলা সব লেখা আছে। তবে এটা স্বীকার করতে হবে আমার খুব নিঃসঙ্গতা ছিল। আর আমি মনে করি, এটা আমাদের ভিতর খুবই কমন বিষয়। আসলে যাদের সিক্সটি বা সেভেন্টিতে জন্ম এবং এইটিজে যারা তাদের কৈশোর গেল, যারা অফুরন্ত স্বপ্নের কথা, সম্ভাবনার কথা শুনল, তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুদ্ধের বেদনা তাদের বেশি কষ্ট দিল। তখন আমি মনে করতাম আমিই সবচেয়ে দুঃখী। কিন্তু পরে বুঝলাম যে এটা আমার সময়ের একটা দুঃখ। আমি খুঁজে খুঁজে সেরকম পাঠ করে ফেললাম যাদের এই ব্যাপারগুলোর সমর্থন আছে। এটাকে সবাই তো আর ক্রিয়েটিভিটির দিকে ট্রান্সফার করতে পারে না। সামগ্রিক কষ্ট যে খুব ফেলনা জিনিস না, সেটাই আমি তখন অনুভব করি। এর তো পজেটিভ সম্ভাবনা থাকে। এখন আমাদের যদি কোনো পজেটিভ বলার জায়গা থাকে তাহলে সেটাই - মানে বলা যায় যে, দেখো, আমরা কিন্তু প্রচুর কষ্ট করছি। এত কষ্ট করছি যে, আমাদের এখন সেই কষ্টের অবসান হওয়া উচিৎ। এই যে আপনি ঘুরেফিরে পলেটিকাল কন্সাসনেসের কথা বলেন, দেখেন, আমাদেরকে বিন্দুমাত্র সময় কি গেছে যেখানে পাকিস্তানের প্রব্লেমের সাথে সাথে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের বিষয় নিয়ে কষ্ট পাই নাই, কি পারিবারিক ভাবে, কি ব্যক্তিগত ভাবে!

সেটা তো আছেই, মানুষ তার বেসিক রাইট নিয়ে ভাববেই।
হ্যাঁ, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বড়ো আকর্ষণ কিন্তু ছিল অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সমাধান।

এবার আপনার গল্পলেখার ধরন সম্পর্কে কিছু কথা জানার বাসনা রাখি। আচ্ছা, আপনার গল্পে একধরনের কথনভঙ্গি কিন্তু আছে। তা কি স্বত:স্ফূর্তভাবে করেন নাকি এটা আপনার একটা সচেতন স্টাইল?
এটা কিন্তু একটা মজার ব্যাপার, আর আমি এটা নিয়েও ভাবছি। আমি যেটা ইতিমধ্যে বলেছি, নিজেকে ভাঙবার আগ পর্যন্ত নিজেকে আমি একজন পাঠক হিসাবে তৈরি করি আর দেখি যে আসলে আমি কারও সাথে ভাবের লেনদেন করতে পারছি না। আমার স্বাভাবিক মুখচোরা স্বভাব ছিল, অচেনা লোকতো বটেই অতিচেনা লোকের সাথেও কথাসূত্রে কমিউনিকেট করতে পারতাম না। এটা কিন্তু সামাজিক অবস্থারই একটা কারণ। আমি বলি কি, দীর্ঘঅবদমন কিন্তু আমাদের এই জাতির উপর দিয়ে গেছে। আমার কাছে মনে হয় কি, গত কয়েকশ বছরের ইতিহাস হলো আমাদের অবদমনের ইতিহাস। যৌথচৈতন্যের ভিতর ধারাবাহিক অবদমন ঘটছে, এসবের চিহ্ণ সংস্কৃতির বিভিন্ন পকেটে এখনও দেখা যায়। আপনি যে পলিটিকাল যৌথউত্থানের কথা বলেন, তা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। ব্যক্তিগতভাবে আমি যোগাযোগের বিষয়গুলো ভাঙ্গি। আমি এর জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠী বা গ্রুপের শরণাপন্ন হই। বাউল-সন্ন্যাসী বা খামখেয়ালিতে ভরপুর মানুষজনের কাছে আমি যাই। আনঅর্থোডক্স যে জিনিসগুলো আছে, সেসবই কিন্তু অবদমন কাটানোর একটা পথ। আমি কিন্তু প্রচুর সময়, বিভিন্ন রকম করে ওদের সাথে কাটাইছি। আমি জানি, আমি শহুরে জীবনে ওইরকম না, তবু জোর করে আমি ওইখানে গেছি। এইভাবে ভাঙাটাই আমার ক্ষেত্রে কাজে দিয়েছে। এটা নিজের ক্ষমতাকে বোঝার জন্যও দরকার। যাই হোক এইসব করতে গিয়ে হয়ত আমার একটা কথন তৈরী হয়েছে, তবে এ বিষয়ে আপনারাই ভাল বলতে পারবেন!
কমিউনিকেট করার সমস্যাটা এখনকার ছেলেমেয়েদের কিন্তু কম হয়। এখন ওরা যে কোনো সমস্যাকে ট্যাকল করতে শেখে। এখন দেখবেন, অবসাদ, নিঃসঙ্গতা এইসব শব্দ বাজারে কম চালু।

কমিউনিকেট করার সমস্যাটা এখনকার ছেলেমেয়েদের কিন্তু কম হয়। এখন ওরা যে কোনো সমস্যাকে ট্যাকল করতে শেখে। এখন দেখবেন, অবসাদ, নিঃসঙ্গতা এইসব শব্দ বাজারে কম চালু।

এসব কেন হচ্ছে? ইন্টারনেট, সেলফোন, ইনফর্মেশন টেকনোলজির উন্নয়ন...
হ্যাঁ, অনেককিছুই এখন তাদের হাতের কাছে আছে। আমাদের স্বপ্নগুলি না-পাওয়ার যে অবসাদ, সেটা তাদের ভিতর সেইভাবে কাজ করছে না।

তার মানে এখন শিল্পের একটা সহজাত উৎকর্ষ বেশি হবে?
না সেরকমও বলা যাচ্ছে না। ওদের অন্তর্গত কষ্টগুলো কম থাকবে।

ওদের কিন্তু নির্জনতা-নিঃসঙ্গতাও নষ্ট হচ্ছে।
এটার কিন্তু দরকার ছিল। কারণ আমরা দীর্ঘসময়ব্যাপী একই রকম নি:সঙ্গ ছিলাম। ওরা নিশ্চয়ই এতো জনসংখ্যার ভিতর নির্জন হবার আনন্দটুকু সহজে ছাড়বে না।

আচ্ছা, তাহলে এই প্রসঙ্গে এটা কথা বলে নিই, আপনি কি নির্জনতা বা একাকীত্বের যে অনুসঙ্গগুলো বললেন তা আপনার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ গতকাল লাল-এ সেইভাবে বদলাতে পেরেছেন?
আমি এই ক্ষেত্রে শুধু এইটুকু বলতে পারি, নিজেকে যে বদলাতে পারে তাকে আর আলাদাভাবে সচেতন হওয়ার দরকার হয় না। ভাঙচুরের এই প্রক্রিয়ার ভিতরই তার সব হয়ে যায়।

আসুন আমরা আপনার শিল্পসত্তার অদ্ভুত এক বিস্তারের গল্প করি। আপনার কাছিমগালায় জীবনের যে বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়, তাই কিন্তু আপনার সদ্যছাপা কবিতা দাদাকাছিম ও দুটি গাছে আমরা লক্ষ করি। এটা তো শিল্পসত্তার একধরনের রূপান্তর বা এক্সটেনশন - নাকি?
সেটাও হতে পারে। পৃথিবী কিন্তু একটা জিনিসে তৈরি হয় না। এর জন্য সমুদ্র লাগে, পাহাড় লাগে। মরুভূমি বা অন্য অনেককিছু লাগে। কাজেই সবকিছু পরিপূর্ণ করতে গেলে অনেককিছুই দিতে হয়। আপনার জীবন যদি শুধু বিষাদের ভিতর দিয়েই যায়, তাহলে কোথাও না কোথাও তার ছায়া কিন্তু থেকেই যাবে।

তাহলে যাপিত জীবনের ভিতর যা-ই উপলব্ধি করেন তা-ই গল্পে আনতে চান।
তাই, মানে যা কিছু আমি তাই আমি। যেমন ধরেন, আমার খুব ঘনিষ্ঠ বয়জেষ্ঠ্য বা সমবয়সি বন্ধুদের মৃত্যু আমি দেখে ফেলছি। যতকিছুই আমরা বলি না কেন, যেই মুহূর্তে ও মারা যাচ্ছে, সেই মুহূর্ত থেকে সে কিন্তু আর একটা লেখাও লিখতে পারছে না। তার মানে এইয়ে এইভাবে বদলানোর কথা বলছি, সেটাও কিন্তু আমার জীবন। আমি যখনই আরেকটা গল্প বা কবিতা লিখতে পারছি না, তখনই কিন্তু আমি কিছুদিনের জন্য মারা যাচ্ছি। শৈল্পিক মৃত্যু যাদের হইছে তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একের ভিতর অনেকগুলো চোখ স্থাপন করা এটাই হলো বদলানো।

এবার আমি চাঁদের ব্লেড গল্পের উদয় ভানু নামের পুলিশ কর্তাব্যক্তিটির কথা বলি, সে কিন্তু আর লিখতে পারছে না। কারণ আমার মনে হয়েছে, সে তার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের সীমাবদ্ধতার বাইরে আসতে পারছে না।
এটা শুধু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নয়, আসলে সে নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। আমি বলতে চাচ্ছি যে, আমরা যদি নিজেদেরকে কোনো রেজিমেন্টেশান আটকাইয়ে ফেলি, তা খাকি বা শাদাকালো বা লাল যে পোশাকই হোক বা পার্টির ফ্রেমই হোক, তাহলে কিন্তু তার পক্ষে ফৃ শিল্পচর্চা করা মুশকিল।

আমি আপনার বিষয়গুলো ক্লিয়ার করে ধরতে পারছি না। তাহলে যৌথচৈতন্যের বিকাশটা কিভাবে হবে?
ওই যে বলছিলাম, যৌথঅবদমন থেকে যখন আমরা বেরিয়ে আসতে পারব, তখনই ওই চৈতন্যেরও বিকাশ ঘটবে।

আচ্ছা, তাহলে রাষ্ট্র সম্পর্কে আপনি কেমন আকাঙ্ক্ষা লালন করেন? সেখানকার মানুষজন, প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, মিলিটারি কেমন হবে?
এখানে দুইটা জিনিস আছে, এই সময়ে বসে রাষ্ট্রহীন পৃথিবী কল্পনা করা মুশকিল। আর হচ্ছে, ইহজাগতিকতার ভিতর অমরত্বের বিষয়টা সার্বিকভাবে এভাবে জাগিয়ে রাখতে হয়। মানুষ কখনই সমস্ত কিছু পাওয়ার পরও সন্তুষ্ট হবে না। মানুষের আল্টিমেট আনন্দের কোনো জায়গা নাই। মানুষ আনন্দের ভিতরও দুঃখ বা অবসাদের জায়গাগুলি থাকবে। এটা বোধ হয় মানুষের জিনের একটা ব্যাপার।

আচ্ছা, তাহলে আপনি বলুন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যেমন, ধর্ম বা ঈশ্বরের সাথে আপনার বোঝাপড়াটা কেমন?
ধর্মের কিন্তু এক চেহারা নেই, টাইম টু টাইম এর চেহারার বদল হয়। যেমন ধরুন, একপক্ষ বলছে, এর কোনো কার্যকারিতা নেই। অন্যপক্ষ বলছে, এটাই বারবার কার্যকর হয়ে আসছে। ধর্ম নানান সময়ে নানান কাজ কিন্তু করছে। একই সময় সে দর্শনের প্রভুত্ব দেয়, আবার মনস্তাত্বিক বা সামাজিক শৃঙ্খলার নির্দেশনা দেয়। সে একটা কর্পোরেট এমবিএ’র মতো সবকিছু জোড়া দিয়ে দিয়ে করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কিন্তু বিভিন্ন যায়গা থেকে ভাল ভাল জিনিস নিয়ে একটা কিছু করে। অর্থাৎ বিজ্ঞান যে জিনিসগুলো খুঁজে বের করে, অর্থনীতি যার রহস্য জেনে যায়, মনস্তত্ব যে কৌশলের কথা বলে, চলমান ধর্ম কিন্তু তা ধার করেই তার নির্দেশনা গুলি তৈরী করছে। তারপর সে তার ব্র্যাণ্ড লাগাচ্ছে। সমস্যা এই ব্যাণ্ডিং এর। আমি যদি চাই লাল রঙের কাগজ তো সাদা রঙের ফেরিঅলা এসে আমাকে জোর করে তা কেনাচ্ছে। আমার কাগজ না লাগলেও তা কিনতে হবে। এখানেই ঝামেলা হচ্ছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যখন পাওয়ার পলিটিক্সের সাথে পাল্লা দিচ্ছে, তখন সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে ক্ষমতাহীন মানুষদের। লোকাচারের জিনিসগুলো ধর্ম কখনও কখনও নিয়ে নিচ্ছে। এবং সে তা প্যাকেটজাত করছে। আমাদের লালন নিজের মতো করে ব্যক্তিগত অর্জন, ব্যর্থতা, বিশ্বাস নিয়ে মানুষের মনের মধ্যে যাচ্ছে, কি দরকারীই না হয়ে উঠেছে। তার জন্য তো কোন ব্র্যাণ্ডিং দরকার হয় নাই। কি হবে আর বলে, এই দেখো লালন কিন্তু মুসলিম বা অন্যরা যদি বলে, লালন মুসলিম হলেও হতে পারে, কিন্তু তার জন্ম তো হিন্দুঘরে বা কেউ যদি বলে, না, সে ছিল সুফিবাদী। আসলে সে কিন্তু নিজের জীবনযাপন, নিজের অনুসন্ধিৎসা ইত্যাদি দিয়ে তার নিজস্ব জিনিস তৈরি করছে। যা নিজস্ব আবার সবার। কারণ মানুষ তো সমবেত ভাবেই যায়। সে কিন্তু নিজে একা কিছু করার কোনো ব্যাপার না। দেয়া-নেয়ার ব্যাপারটা আসলে ওই জায়গাটাই, কথা হচ্ছে, দেয়া-নেয়ার এই ব্যাপারটা আমার ক্লিয়ার থাকা দরকার। একজন ধর্মের লোক যখন মানববোমা হচ্ছে, তখন কিন্তু সে নিজেকে তার প্রভুর কাছে উৎসর্গ করছে না, সে একটা রাজনৈতিক শক্তিকেই তা উৎসর্গ করছে। কারন প্রভুর কাছে উৎসর্গ করতে বোমা নয়, একটু ধ্যানই যথেষ্ট। এই জিনিসটা আমাদের বুঝতে হবে। এই জিনিসটা যদি বুঝি তাহলে নেয়া-দেয়ার ব্যাপারটাও পরিষ্কার হবে।

ঠিক আছে, এবার আপনার গল্প নিয়েই ফের কথা বলি। আপনার গল্পগুলির ভিতর বাসেত হিরনচি অত্যন্ত প্রিয় এবং সমকালের ভয়াবহ বাস্তবতার এক নিগূঢ় চ্ছবি। আপনি এর বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলুন।
একটা বিষয় তো সত্যি যে, আমি আনঅর্থোডক্স প্রসেস খুব পছন্দ করি। আমি নিজে কিন্তু বৈচিত্রময় জীবনযাপন করে থাকি।

এখনও আপনি তাই করেন?
তা বলতে পারেন। এই গল্পটি যখন লিখি তখন কিন্তু হিরনচিদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। দিনটা শুরু হয়তো পাঁচতারা হোটেলে অফিস করে, আবার রাতটা ওদের সাথে। যেমন, ইদানীং একটা বিষয় খেয়াল করছি, রাস্তা দিয়ে চলার সময় অনেকেই দেখবেন চরম উদাসীন, কে আসলো কে গেল কোনোই খেয়াল নাই। আমি কিন্তু লোকজনের মুখের দিকে তাকাই। আমি ভাবি, আচ্ছা, আমি এই কাজটা কেন করি! আমি কি কাউকে খুঁজি? এই তো গতবছর আমার ঘনিষ্ট একটা বন্ধু মারা গেছে। তার সাথে একেবারে বালককাল থেকে দীর্ঘসময় একসাথে আমার কাটছে। তার জীবন ছিল খুবই বর্ণাঢ্য, সে সামরিক অফিসার ছিল, নিজেও একটা আনঅর্থোডক্স লোক আর-কি। যখন যেটা করা দরকার সেটাও করত, আবার উল্টাটাও করত। তো হয়েছে কি, ও মারা যাওয়ার পরে একদিন দেখি কি ও আমার সামনের রিক্সায় করে যাচ্ছে, দেখতে দেখতে ওর রিক্সাটার কাছে যাবার আগে আমি জ্যামে আটকাইয়া গেলাম। ও কোথায় যেন চলে গেল। আবারও ওকে আমি বিভিন্ন জায়গায় দেখতেছি। আমার মনে হচ্ছে, মৃত্যুটা কি বাসা বদল। মানে ও হয়ত মোহাম্মদপুর থেকে উত্তরায় গিয়ে থাকতেছে। বাসেত-কে আমি চিনতাম। ওর ঘরে গেছি। ওর অনেক কথাই বলা বাকি আছে। যদিও ওর প্রথম বউ এখন খুব ভাল আছে, কিন্তু কবরে নিশ্চই ওর হাড়গোড়গুলিও আর আগের জায়গায় নাই।


আপনার 'কাছিমগালা' খুবই দরকারি এক গল্প মনে হয়। এর পটভূমি সম্পর্কে বলুন।
এখানে কিন্তু দুইটা জিনিস ছিল, আমরা যখন এগ্রিভার্সিটিতে পড়তাম, তখন ক্যাম্পাসটা আমাদের কাছে পুরা একটা সাম্রাজ্যের মত ছিল। আমরা যারা যা যা করার দরকার না তাই করতাম। সেখানকার স্টুডেন্টদের লাইফটা হচ্ছে, ওরা ক্লাশ করবে, পড়বে, সন্ধ্যায় রাস্তা দিয়ে একটু হাঁটবে; পাকারাস্তায় হাটবে, হলে ঘুমাবে এই আর-কি। আমরা পাকা রাস্তাকে অগ্রাহ্য করতাম। সবাই হয়ত ডাইনিং হলের দিকে যাচ্ছে, আমরা চায়ের দোকানে চইলা গেলাম। গল্পটা নিয়া যখন সেইসময়কার বন্ধুদের সাথে বলি তারা বলে যে, ওরা মনে করে এই গল্পটা লিখেছে ওরাই। মানে কাছিমগালা একটা সবার গল্প। ওইসময় আমি নিজেও ভাবতাম যে আমি বলে কিছু নেই। এটা যৌথমনের একটা ব্যাপার বলেই ধরে নিতাম। কারণ মানুষ তো একলা জীবনযাপন করে না। এইভাবে যুক্ততার ভিতরই কিছু হয়। আর তার নিজের জিনিসগুলি তো তার ভিতরে থাকেই, আবার অন্যের জিনিসগুলিও তার ভিতরে থাকে।
আমি ময়মনসিংহের পাঠ চুকাইয়া যখন জব লাইনে আসি, তখন আমার জবটাও ছিল এইরকম যে আমি অনেক জায়গায় ঘুরতাম। গল্পটাতে বিভিন্ন এলাকার বিষয় আছে। ময়মনসিংহের ভাষা তো আছেই, আবার মূল ক্যারেক্টারটা চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসলেও, সে কিন্তু রংপুর থাকত । যার ফলে সে কোন নির্দিষ্ট জায়গারও না।

সেখানে আপনার নিজস্ব উপস্থিতিও কিন্তু আমি টের পাই।
সটা তো আছেই, আমি যতগুলি গল্প লিখছি, তার কোনোটাই আমার অচেনা নয়। তো, যা বলছিলাম, আমি দেখতাম, ওই লোকটা নদী দিয়ে কাছিম শিকার করতে আসত। আবার সবাই মিলে শ্মশান-টশানে আড্ডা দিতাম যখন, তখন আমার শ্মশান বন্ধুরা রূপকথার গল্পের মত করে তাদের বাস্তবজীবনের গল্প শোনাত। এইসবের একটা যৌথ ব্যাপার ছিল। এটা কিন্তু আমার বিবাহপূর্ব জীবনের গল্প। তখন আমি ভাবতাম যে আমি বিয়ে-টিয়ে করব না। এটা নিয়া খুবই ইতরামি করতাম। ওইটাকে এস্টাব্লিস্ট করার তাগিদে ছোট্ট ইউনিটের একটা ফ্যামিলি আনলাম। এইসব ভাবতে-ভাবতেই বোধ হয় গল্পটটা তৈরি হইছে। এটা কিন্তু একটা অবাস্তব কন্ট্রাস্ট।

আপনার গল্পে দেখা গেল, মানুষ হয়ত বৃক্ষ হয়ে যাচ্ছে, মানুষের পেটে তিনশ বছর জীবনপ্রাপ্ত একটা কাছিমের বাচ্চা পয়দা হচ্ছে, তাহলে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা আপনাকে তৃপ্ত করে না? আপনি কি মানুষের ভিতর প্রাণীর রূপান্তর নিয়ে কিছু ভাবেন?
না, তা না, আমি আসলে জীবনকে খুবই ক্রুড জায়গা থেকে ভাবি। কাছিমগালা গল্পটার কথাই ভাবেন - এখন কিন্তু ইউনিট ফ্যামিলি আরও আলগা হয়ে গেছে। এখন আর শতপুত্রের জননী না, এখন সন্তানহীনতাই যেন গৌরবের বিষয়। স্বাধীনতা শুধু নয়, দায়িত্বমুক্তি, স্বার্থপরতা ইত্যাদি বেড়ে যাচ্ছে। ওই টেক্সচারের ভিতর ক্লান্তিও চলে আসছে। শহর বলেন, আরবানাইজড ভিলেজ বলেন, সেইসব জায়গা ইনফর্মেশন বা ইলেকট্রিসিটির জন্যই হোক, মানুষর ক্ষুদ্র জগৎও অনেক বদলে যাচ্ছে। আর্বানাইজেশন, জিনিসপত্রের দাম বাইড়ে যাওয়া, রিসোর্স কমে যাওয়া - এসবের ফলেই একটা পরিবর্তন কিন্তু স্পষ্ট হয়ে গেছে। আর এইসব মানুষের চিন্তাজগতে ক্ষয় করে দিচ্ছে। একটা ছোট্ট ফ্যামিলির একই চেয়ার-টেবিল, সংসারের ২/৩ টি ফিক্সড চেহারাও তাকে ক্লান্ত করছে। অন্যত্র সরে যাওয়ার জন্য তাকে প্রণোদিত করছে। মানুষের ভিতর ইহলৌকিক অমরত্ব পাওয়ার বিষয়টা কিন্তু ইনহেরেন্ট। সে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেই পারে। বিকল্প অমরত্বের বিষয়টাও সে ভাবে।

'একটা অত্যন্ত সাধারণ বিকাল' আমার কাছে একটা খুবই ভয়াবহতম গল্প মনে হয়। আপন ভাইয়ের সামনে বোনটার সেক্সুয়েল হেরাজমেন্ট একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার মনে হয়েছে। সেই সময়কার সামাজিক বাস্তবতা কি ওইরকম ছিল?
এটা আসলে পুরা ফ্যান্টাসি ধরনের গল্প। গল্পের স্টোরিলাইনটা কিন্তু বেশি না। এই গল্পের মূল টার্গেট হলো একটা সিচুয়েশনকে প্রকাশ করা। একটা ডেস্ট্রাকশনকে যদি চিহ্নিত করতে চাই তাহলে কী করা যেতে পারে। গল্পটা হচ্ছে, ফ্যান্টাসি নিয়ে কথকতা হচ্ছে - চলো ভাবি এই রকম। এটা হচ্ছে সেইধরনের গল্প। এটা তাই রিয়েলিটির চেয়েও হার্স। কিন্তু রিয়েলিটি কি এর চেয়ে ক্রুয়েল নয়?

আচ্ছা, গল্পের আলাপসালাপের একটা সাধারণ জায়গা থেকেই আপনাকে প্রশ্নটি করা যাক, এমন কোনো গল্প কি আছে যেখানে সরাসরি আপনাকে চিহ্নিত করা যায়?
আসলে সব গল্পের ভিতরই কিন্তু আমার নিজের জিনিস আছে। আমি নিজে লিপ্ত হওয়া ছাড়া কোনো গল্পই লিখতে পারি না। কোনো না কোনোভাবে আমার একটা জায়গা তো অবশ্যই আছে।

এইখানে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই, বিষয়টা হচ্ছে গল্পের মালিকানা বলতে যে বিষয়টাকে আমরা এস্টাব্লিস্ট করি, তা কি শুধুই একজন গল্পকারের? কারণ এটা পরিষ্কার যে, আমরা এটা প্রত্যক্ষ করি - গল্পের চরিত্র, বিষয়, ভাষা, গল্পের ইতিবৃত্ত প্রকাশনা মাধ্যম, মুদ্রণযন্ত্রের প্রিভিলেজ ইত্যাদি অলরেডি আমাদের সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আছে। আমি যখন একজন লেখক হিসাবেও নিজের নামটি যুক্ত করি, তখনও খানিক বিহ্বলতায় ভোগি - নিজেকে কখনও কখনও স্রেফ সংগ্রহকারী বা গল্পের সংযুক্তকারী মনে হয়।
এটা কিন্তু খুবই চমৎকার একটা প্রশ্ন। এই বিষয়টা নিয়ে আমিও খুব ভাবি। তা-ই একটা একটা করে বলি। এই ব্যাপারে আমি একদম মনে করি যে, এইগুলির মালিকানা বলতে কিছু নাই। গল্পগুলির পাঠ নিয়েই আমার বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হইছে। একজন এসে বলতেছে, আমি কাছিমগালা গল্পটা তো দেড়শ বার পড়ছি। তাতে গল্পে তার একধরনের ইনভলভমেন্ট হয়ে গেল। আরও নানান জন নানান কথা বলছে। গল্পটার ব্যাপারে সেইসময়কার বন্ধুদের কথাতো আমি বলেইছি। গল্পের সাথে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার কথাও বলা হয়েছে। তো ওই পাঠকদের ব্যাপারে বলা যায়, ওরা যখন কোনো গল্পপাঠ করে, তখন আমি ব্যক্তি হিসাবে তো থাকি না। আমারও তাই হয়, আমি যখন কারও লেখা পড়ি, তখন লেখক তো আমার কাছে থাকে না। লেখক তো নিজে বলে দেয় না যে এটা এই জিনিস। আমি কিন্তু আমার বোধ দিয়ে একটা অল্টারনেট জিনিস তৈরি করছি। কথা হচ্ছে, একটা গল্পের লেখক শুধু একজন না, লেখক তো পাঠকসহই লেখক। পাঠকও এটাকে তৈরি করতেছে। ভালো লেখাগুলোর বোধ হয় এটা একটা গুণ। আরেকটা কথা হলো স্টোরিলাইনের কথা যেটা বলছেন, ঠিক আছে, সেটা ফাইন - কিন্তু একটা জিনিস আপনার একটু মনে করতে হবে, সাহিত্যের কিন্তু নিজের কিছু জিনিস আছে যেটা লেখক হিসাবে টাইম টু টাইম করতে হয়। যেমন দেখুন ভারতচন্দ্র যখন কবিতা লিখতেছে, সেগুলি কিন্তু কবিতায় উপন্যাস। তখন কিন্তু তাকে অনেকগুলো দায়িত্ব পালন করতে হইছে। একই সাথে তাকে রাজসভা মনোনয়ন করতে হইছে। তাকে ইনফর্মেশন দিতে হইছে। তাকে বিভিন্ন ক্যারেক্টার তৈরি করতে হইছে। তাকে তার এভ্‌রিডে লাইফের স্কেচ করতে হইছে। তাকে সেসব আবার বর্ণনা করতে হইছে। একেকটা সময়ে একেকজন লেখক একেকটা দায়িত্ব পালন করেন। আমাদের এই সময়ে এসে সে অনেকগুলো মিডিয়া পাচ্ছে যার জন্য তাকে সিনেমার নাচ গান, পত্রিকার খবর, ক্যাবল টিভির ব্রেকিং নিউজ দেবার দায়িত্ব নিতে হয় না। তাহলে একটা পাঠযোগ্য গল্পের দায়িত্ব কি হতে পারে? সে এখন অনেক কিছুতে মগ্ন হতে পারে। তার জন্য এখন আরও বেশি মুক্ততা অনুভব করার সময়। তার মানে হচ্ছে, আপনি যে স্টোরিলাইনের কথা বলতেছেন, কথকতার কথা বলেন, এর সব কিছুতেই আপনি অপ্রচলিত অনেক কিছুর প্রয়োগ করতে পারেন। নতুন কিছু আনতে পারেন। এটাকে আমি ব্যবহার করতেছি, কারণ আমি তো একটা গল্প বলতে গিয়ে একটা গল্পই বলতেছি না, অনেকগুলো গল্পই বলতেছি। বলার কায়দাটাও খুজতেছি।
এটা কিন্তু অন্য সবার ক্ষেত্রেই হওয়ার কথা।
তা তো নিশ্চয়ই। আমি তো শুধু আমার কথা বলতেছি না। অন্যদের কথাও বলতেছি। সে কিন্তু জিনিস বোঝানোর কায়দা বের করছে, বৈচিত্র আনছে, এই যে সে এত জিনিস দিচ্ছে, এটা কিন্তু একটা কাজ। সে এই কাজগুলো করছে বলে গল্পকার হিসাবে তার নামটি যেতে পারে। আবার ওই কথাও ঠিক যে, পাঠক যখন গল্পটি পড়ছে তখন কিন্তু সে কিছু আবিষ্কার করছে। কারণ গল্পকার তো সেখানে নাই, সেখানে শুধু তার স্টেটমেন্টটা আছে। একজন লেখক তার সৃজনীশক্তি দিয়ে গল্পটি তৈরি করে, ডিটেইলে যায়। আবার একজন গুড-রিডারও তা করতে পারে। এখানে সময়টাও একটা ব্যাপার।

আচ্ছা, আপনার গল্প পড়ে কখনও কখনও আমার মনে হয় যে, মাহমুদুল হকের ভাষা, উপমা, শব্দের দ্যুতিময়তা আপনাকে খুবই আকর্ষণ করে। তাঁর ভিতরে যে বিষয়গুলি একটু সহজভাবে বলে দেয়া, একটু হেয়ালিপনা, অপ্রচলিত উপমা ব্যবহার - এসব কিন্তু আপনার লেখায় পাই।
শুধু মাহমুদুল হক নয়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক বা অন্য লেখকদের লেখাও আমি ভালোভাবে পাঠ করেছি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বলেন, দীপেন্দ্রনাথ বলেন, বুদ্ধদেব বসু, সতীনাথ ভাদুড়ি, কমল কুমার... তারাশংকর, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ এঁদের যে কথা বলার ভঙ্গি তা আমার ভীষন পছন্দের। আমার কথকতায় এঁদের প্রভাব থাকবে না তো কার থাকবে? এটা আমি ভাবতেও পারি না যে তা কিভাবে হয়। তা হয়ত গদ্যের নিজস্ব পদ্ধতির কারণে হতে পারে। আমি কিন্তু অনেক লেখকের মতো নিষ্ঠুর বা মোলায়েম দুইধরনের গল্পই লিখতে চাই। পৃথিবীর অনেক লেখকের ভিতরই এই জেনেরিক কোয়ালিটির মিল আছে ।

গল্পকারের লেখার বিষয় তো এল, এখন আপনার সময়ের মানে ৮০-এর কোন লেখকের নাম কি বলবেন যাদেরকে আপনার উল্লেখযোগ্য মনে হয়।
একটা লেখাকে মুগ্ধতার চোখে দেখা একজিনিস আবার ক্লিনিক্যালি দেখাটা ভিন্ন জিনিস। আমরা যেহেতু সমসাময়িক লেখক, আমাদের অনেকেরই জেনেরিক মিল আছে, তবে অমিলটাও কম না। আমার সময়ের গল্পকারের লেখা অবশ্যই পড়ি। তবে সেখানে লেখাটির ট্রিটমেন্ট, ভাষার ধরন, একটা চরিত্রের কয়েকটা মুহূর্ত এই সবই আমাকে ভীষন আনন্দ দেয়, আবার গভীর বিষাদে থরে দেয় ওদের কোন কোন চ্যুতি তে। আমার সমকালীনদের ভিতর অনেকেই ভালো লিখেছেন এবং ভবিষ্যতেও ভালো লিখবে।

এবার ভাষা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক, এইক্ষেত্রে এও বলতে হয়, আপনি কিন্তু ভাষার বেশ জোর দেন। এর ভাঙচুর করেন। ভাষায় আঞ্চলিক আবহ দেন, লৌকিক ক্রিয়াও অনায়াসে ব্যবহার করেন। তো ভাষার এই যে ধরন তা কি মানভাষার মান রাখার ব্যাপারে কোনো সমস্যা করে না।
জীবনযাপনের একটা ব্যাপার। ভাষাও সেইভাবে আমার লেখার ধরনে বদলায়। এমন কথা চালু আছে যে, ইলিয়াস পুরানো ঢাকার বদ্ধভাষা নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। আচ্ছা, ইলিয়াস যদি এখন একটা লেখা লিখতেন, তাহলে ঢাকার চতুর্প্রান্তে যে নতুন ঢাকা তৈরি হচ্ছে, সেখানে কি একটা মিক্সড ভাষার সন্ধান তিনি করতেন?। একজন হয়ত কৃষিজীবীর আবহ থেকে শ্রমিকের আবহতে মিক্সিং হচ্ছে। ভাষাও কিন্তু ওইখানে নতুনভাবে তৈরি হয়। আসলে প্রাণময় ভাষা তো ওইটাই। আমার ধারণা, ইলিয়াস এই সময়ে লিখলে কিন্তু ওইরকম ভাষাতেই লিখতেন। জীবনের প্রয়োজনে যে ভাষার উদ্ভব সেটাই তো আসল ভাষা। মানে হচ্ছে, ইহলৌকিকতা, পারলৌকিকতা, ভালোবাসা, যৌনতা ইত্যাদির প্রয়োজনেই নতুন ভাষাভঙ্গি পাওয়া যায়। মাহমুদুল হকের ভাষায় দেখবেন কলকাতার একটা স্টাইল আছে। এটা ঠিক পুর্ববঙ্গীয় নয়। পরে জানা গেল, ওঁর মা ওইভাবে অলঙ্কার দিয়ে কথা বলতেন। আপনার কথকতার জন্য একটা স্টাইল তো আপনাকে খুঁজে নিতেই হবে। স্টাইলই ভাষাকে কাছে টেনে নেয়। সৃজনশীলতা, বলার বিষয়, শিল্পতা এসবকিছু মুক্ত ভাষাকে নতুন মাত্রা দেয়। মুক্ত ভাষা ছাড়া সাহিত্য হয় না এবং এসবই মাননীয় ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখে। এমন কোনো কিছু সাহিত্যের ভাষা হতে পারে না যা সৃজনশীলতার গভীরতা দিবে না। আঞ্চলিকতা কিন্তু একটা বিশেষ জিনিস, এটা এক ধরনের আদিগোষ্ঠির এক্সপ্রেসন। আমার অত্যন্ত প্রিয় একটা বই হচ্ছে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর আঞ্চলিক ভাষার অভিধান। এর সব শব্দ দিয়ে সাহিত্য হবে না, কিন্তু এ ভিতর যে সৌন্দর্যটা আছে, উদাহরণে যে কথা বলার ভঙ্গিটা দেয়া আছে, তা জরুরী। আপনার কান-এর রেওয়াজ করার জন্য। আঞ্চলিক ভাষার টেকনিকটা আত্মস্থ করার চেষ্টা করি। মানুষের কথাভঙ্গিই হয়তো চিন্তা।

আচ্ছা, আপনাদের ফৃ স্ট্রিট স্কুল নামের লিটল ম্যাগাজিন-এর পরবর্তী পরিকল্পনা কি?
আমি এটা চালিয়ে যেতে চাই। একেক সময় একেক ফর্মে হয়ত। যেমন গতবছর চারটি কাব্য গ্রন্থিকা বেরিয়েছে: খায়রুল হাবিব-এর 'গরম কাদার ক্যান্টো', আহমেদ মুজিব-এর 'শুধু টের পাই আমি', আবু আহসান-এর 'সেলিমের চোখ' আর আমার নিজের 'আমার শ্বাসমূল'। এবছর বের হচ্ছে চয়ন খায়রুল হাবিব-এর চতুর্দশ পংক্তির কবিতা বই ‘রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ’ ও আমার কবিতার ইংরেজি রূপান্তর 'Hullabaloo or Tacit’

আমরা দেখেছি, একসময় আপনি শুধু লিটল ম্যাগাজিনেই লিখতেন, কিন্তু পরবর্তীতে আপনার লেখা প্রথম আলোতেও দেখলাম। এটা কি একধরনের বিচ্চুতি নাকি বড় কাগজে লেখাটা দরকারি কাজ মনে করছেন?
এইক্ষেত্রে আমি আমার মূল ট্রেইন্ডটা কি তাই বলি। আমার মূল এটিচিউড কিন্তু আনঅর্থোডক্সকে প্রাধান্য দেয়া। আমি যখন শুধুমাত্র লিটল ম্যাগাজিনেই লিখছি, তখনও কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনপনার ভিতর ছিলাম না।

এই পনাটা কি?!
পনাটা হলো প্রিটেনশন, আপনি যদি চোখ বন্ধ করে দশটা লিটল ম্যাগাজিন নেন, তাতে এর লেখক নির্বাচন, সম্পাদকীয়, ছাপার পদ্ধতি, টাইপ সেটিং, এই-সেই সব একই। আমি মনে করি, লিটল ম্যাগাজিনচর্চা হবে একটা গ্রুপের ব্যাপার - তা বিশেষভাবে একসাথে হওয়া, কাজ করা। এই গ্রুপে পাঁচজন যদি থাকে তারা পাঁচরকম লিখবে। তাদের বিশ্বাসও একরকম না। ওরা সবাই মিলে একটা বিশেষধরণের বিশ্বাসকে ধারণ করে। তাদের কাছে ক্রিয়েটিভিটিটাই মুখ্য। আমার কাছে মনে হয়, লিটল ম্যাগাজিন শব্দটাই এই পারপাস সার্ভ করে না এখন। আর প্রাতিষ্ঠানিকতা বলেন? সেটা কী? আমরা যেটাকে রেজিমেন্টেশন বললাম তা শুধু পোষাকেই নয়, অন্য অনেক কিছুতেই প্রকাশ পায়। সাহিত্যের শত্রু হচ্ছে এই রেজিমেন্টেশন, আপনি কি কোন ফ্রেমের ভিতর আটকে বসছেন কিনা। লিটল ম্যাগাজিনের সাথে যখন কেউ তার ক্যারিয়ার, পেশা, স্বার্থের ব্যাপার যুক্ত করে ফেলে, তখন কিন্তু তার এখান থেকে প্রস্থানের সময় হয়ে এসেছে। আমি মনে করি এটা হল বিজ্ঞাপন বিরোধী লাভবিহীন একটা চেষ্টা যার উদ্দেশ্য সাহিত্য প্রকাশ আর লক্ষ নতুন মাত্রা। কম বয়স হলেই যেমন লিটল ম্যাগাজিনের ফৃ ভিসা পাওয়া যাবেনা, তেমনি আজীবন পাসপোর্টও কেউ এর কাছ থেকে পায়না। আমার দৈনিকে লেখালেখির কোন স্পষ্ট কোন কারন বা উদ্দেশ্য নাই। কারণ এর থেকে কোন ফায়দা-ই আমার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। আপনি করেন? তাহলে বলেন তো শুনি। আগেই বলেছি সব ধরণের প্রিটেনশান থেকে মুক্ত থাকাই আমার চেষ্টা। জগতে নেই কোন বিশুদ্ধ পত্রিকা।

এটাও কিন্তু রাজনীতির ব্যাপার, সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা, প্রতিষ্ঠানের ঝামেলা ইত্যাদির জন্য ক্রিয়েটিভিটির একটা যথার্থতার ব্যাপার তো আছেই।
এখানে প্রত্যেকটা জিনিসই লেখকের প্রতিপক্ষ। যে প্রকৃত ক্রিয়েটিভ, সে তো যেটা নাই সেটা সে করতাছে। আপনি যে একটা ক্যারেক্টার নিলেন, ধরেন সে দেশের ল এন্ড অর্ডারএ সন্তুষ্ট না। সাহিত্য যদি সত্য প্রকাশের জিনিস হয়, তাহলে তো অটোমেটিকেলি আপনি এর বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছেন। রােষ্ট্রর প্রতি অসন্তুষ্টি আপনার লেখায় চলে আসবে। একটা এরোগেন্ট মানুষ চলে আসবে। বাই ডিফল্ট, আপনি বাউন্ড টু ডু দিস। কেউ যদি সেটা না করে তাহলে তো সে লেখকই না। আমি এই ব্যাপারে খুবই চরমপন্থি আর-কি। এটা যদি সেই লেখককে বুঝাতে হয়, তাহলে তাকে বলা দরকার, এখানে তোমার দরকার নাই, তুমি চলে যাও। আর যদি তুমি বুইঝাই থাকো তাহলে তুমি বুইঝাই এই কাজটা করো। আসলে লেখককে লিখেই দেখানো উচিৎ, অন্য কোনোভাবে দেখানির কিছু নাই।

লেখালেখির সাথে প্রতিষ্ঠানের একটা বিরোধিতা কিন্তু আছেই।
তাই নাকি? তাহলে কি বলবেন গাণ্ডীব-এর সাজ্জাদ শরিফ লিখছে না কারণ সে একটা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব পূর্ণ ব্যক্তি হয়ে গেছে বলে?

সেই হিসাবে গাণ্ডীব সম্পাদক তপন বড়ুয়ার ডেডিকেশনটাকে কিন্তু আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়। আচ্ছা, তাঁর মৌলিক কাজ কি?
তাঁর ডেডিকেশনের ব্যাপারটা তো আছেই। তপন বড়ুয়া গল্প লেখেন, কিন্তু তিনি নিজেও জানেন যে, অনেকদিন তার লেখা নেই। নিশ্চয়ই তার খারাপ লাগে।

আপনি খুব প্রাঞ্জলভাবেই বললেন যে আপনি লেখালেখিরই ভিতরই শুধু থাকতে চান। গল্পের কথিত দুর্দিনে আপনার এই মানসিক তাড়নাটা বজায় থাকার কারণ কি?
এখন বহুকিছুর সাথে যুক্ত হওয়ার ব্যাপার আছে। ইনফর্মেশন টেকনোলজির এই যুগে বহু কিছু নিয়ে কাজ করার সুযোগ বেড়ে গেছে। তবে সব কিছুকে একসাথে নিয়ে কাজ করাটা জটিল। গডস আর মেনি বাট আই এম এলোন। যার ফলে বহুকিছুর জরুরী চাপ থেকে বাঁচার জন্যই লেখালেখিটা বেশি দরকার। সহজের সহজ আর জটিলের জটিলকে প্রকাশ করার জন্য লেখা ছাড়া আর কোন উপায় নাই।

গল্প নিয়ে কিন্তু একটা কথা চালু আছে যে গল্প নাকি মরে যাচ্ছে! গল্পলিখনের ভাবসাব সম্পর্কেও কিছু বলুন।
এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার। মরে যাওয়ার বিষয়টা কিন্তু অনেক দিন থেকেই চালু। কবিতা মরে যাচ্ছে, গল্প মরে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের পরে তো সবকিছুই মরে গেছিল! ঘূর্ণিঝড়ের পর কি সুন্দরবন মরে যায়? তবে হ্যা, পুরানো মরে যায়, নতুন জন্ম নেয়। আসলে ভালো লেখার সাথে ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্টই বড়ো কথা। সে লিখতে পারে কিনা সেটাই হলো কথা। লেখক কিন্তু ওয়ার্কশপ করে বানানো যায় না, ভাল লেখাও। তবে সাহিত্যের একটা প্রিটেনশান হচ্ছে, আমরা এটা বলতেই আগ্রহী যে কিছুই হচ্ছে না। কিছু হলে সেটা বলতে আমরা অনাগ্রহী। আমি গত পনের বছরেও ট্যালেন্টেড ক্রিটিক দেখি নাই। আপনি কথার শুরুতেই গল্পের ওরাল হিস্ট্রির কথা বললেন তো - আসলে আমাদের যা কিছু তার সবই অরাল। এখানে কেউ কাগজে-কলমে কিছু করতে চায় না। এই যে এত আগ্রহ নিয়ে আমরা আজকে বসেছি, এই যে আমার আগ্রহটা আপনি ডকুমেন্টেড করতেছেন, এটাই কিন্তু আমাদের রক্তের মধ্যে নাই। কেউ দায়িত্ব নিয়ে কিছু বলে না। খালি পুস্তক পরিচিতি। যে ক্রিটিক, সে দুইদিন পরে ফুকো-দেরিদা-ড্যেলুজ ইত্যাদিতে ঘুরপাক খাইতে-খাইতে তার আসল কাজ করা হইয়া ওঠে না। সে আর বোঝেই না যে আমাদের নিজস্ব পৃথিবীটাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করব। সে খালি মার্কসের ইশতেহারের আওড়ায়, দুনিয়াকে বদলানোর আগে নিজেকে বদলাও। খালি বলে বদলাইতে, খালি বদলানোর কথা বইলা গেলাম - কি বদলাইতে হবে তা আর বললাম না। ঠিক আছে, এরা ফুকো-দেরিদার কথা বলুক, কিন্তু এটাকে দিয়ে তো নিজের বদলানোর জায়গাটা এক্সপ্লেইন করতে হবে। সেইদিন একটা ছেলের সাথে কথা হলো, সে বলছে, আমাদের এখানে পোস্টকলোনিয়াল লেখক নাই কেন? আমি বললাম, এটা তো ভাই এরকম প্রশ্ন হলো যে ঢাকা শহরে একটা সুন্দর পাহাড় নাই কেন। যেটা নাই সেটা নিয়া আপনি কেন মাথাখারাপ করছেন! যেটা আছে সেটা নিয়া কথা বলেন। জ্ঞানের একটা বিষয় হচেছ, এইটা সর্বত্র একরকম থাকে না। প্রয়োজন একে লোকালাইজ করা। এটা করতে না-পারলে এর প্র্যাকটিক্যাল ইউজটা হয় না।
লালনের অনুসারীরা কিন্তু গুরুবাদে খুব বিশ্বাসী। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি তা হচেছ, নিজেকে আনন্দ দেয়ার জন্য, আনন্দের সাথে নিজেকে বদলানোর জন্য যেখানে যার কাছে যাওয়া দরকার তাই যাওয়া উচিৎ। আমি আমার লালনবান্ধবদের কাছে কোনো এক জলসায় ‘টেসিট’ শব্দটি বলেছিলাম। মানে হৈচৈ-এর ভিতর থেকে যে নিরবতা গড়ে ওঠে তার কথা তুলেছিলাম। ওরা বিষয়টাকে খুব সায় দিয়েছিল।
আমরা কিন্তু পাওয়ার স্ট্রাকচার, রিএকশান ইত্যাদি দিয়ে কিছু বুঝতে চেষ্টা করি। এখন দেশটা যেভাবে বদলে যাচ্ছে, এর ভিতরে থেকে এর বিশৃংখলা থেকে সমাজের শৃংখলাটা বুঝতে হবে। হৈ চৈ থেকে নিরবতাকে বুঝতে হবে।

আপনার সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগল, আপনাকে বেশ কালারফুল মানুষই মনে হচ্ছে।
কালারের কী আর দেখলেনরে ভাই, সেই দিন তো আর নাই। হা...হা...হা...

২৫-০১-০৮/সকাল ১১-দুপুর ২টা
ধানমণ্ডি/ঢাকা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন