সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০০৯

জলমগ্ন পাঠশালা






জলমগ্ন পাঠশালা : কাজল শাহনেওয়াজ

সূচিপত্র
জলমগ্ন পাঠশালা/ অবান্তব/ কেমন করে বলবো/ একদা অজস্র স্বপ্ন তুমি ও দৃশ্যপট/ থাকতো যদি দীর্ঘকায় পাইন/ পদ্যের বই/ সাইবারনেটিক্স/ হাইড্রলিক/ পরিস্থিতি/ রহস্যখোলার রেঞ্চ/ বায়োলজী ক্লাশে/ হাকুড়দিয়া/ কেওয়াটখালি লোকোশেড/ একরামপুরের দুপুর/ গারো ও ইহুদীরা/ ব্রেনড্রেন/ টেরর ছেলেটি যেভাবে বলেছিল/ হ্রস্বতম জেব্রার রূপকথা/ হেরোইন/ জংশন/ ভালোবাসার দানো/ একটি বিকল্প কবিতা/ দাঁত/ আমরা ক’জন শীত ও বর্ষাকালীন শাকসব্জী/ নিশার ভাষা/ অতনু/ দুই/ কন্যাকে/ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সিরিজ/ লিরিকগুচ্ছ/ মৃত্যু আজ লম্বা হয়ে শুয়ে আছে মৃতদেহ ছেড়ে



জলমগ্ন পাঠশালা
.............
ডাল ঝুঁকে বর্ষার প্লাবিত মগ্নতাকে
ছুঁয়ে ছিলো অলস, মন্থর গতিতে
দুপুরের কৃষ্ণ আঙ্গিনায় পার হলো উদাস শামুক
আমাদের জ্যৈষ্ঠ মাস গোড়ালীর ঘাসে
এক পা দুই পা করে জলমগ্নতায় অদৃশ্য হলো।

পুকুরের থৈ থৈ কৃষ্ণ কথায় চাঁদের ছায়া হলো থৈ থৈ থালা
হিঙ্গুল পাতার আঠালো থাবায় মগ্ন গ্রাম, মগ্ন দুপুরের পাঠশালা।

যেন অর্ধেক আঁধারে ভরা সরু খালের অন্তর,
প্রাকৃতিক বেঞ্চির তক্তা ভেসে গেছে অন্তপ্লাবনে
মৃত এক টুনটুনির অনুপম দেহ ভেসে যায় স্রোতের সমতলে
আধপাকা হিজল নামে মাছের সন্ধানে।

ওরা মাছ, ওরা দেশান্তরিত একদল মানুষের মতো
টিনের আধডোবা মোরগের পাশে বসবাস করে
ভাঙা বর্ষাকে জোড়া লাগালো-
কি যে দূর আত্মীয়তা মানুষ ও মাছে।

মৎস শিকারীরা এলো, নৌকার ছইএ ছিন্ন হার
ওরা পরিহার করেনি, ওরা তবু মৎস বিনাশী;
মাছের সবজে নীল চোখ ওরা ভালোবাসে,
ওরা জলের ভেতর রূপালী মাছের ঝাঁক ভালবেসে হৃদয়ের জালে তুলে নেয়।

ধান খেতে বাদামী পালকঅলা বক
কালো নৌকা এলে উড়ে যায়
দলছুট মাছ ও পালক পাশাপাশি অনন্তকাল ডুবে যেতে যেতে
নেমে যায়, চলে যায়, যেন হৃদয়ের কাছে ফিরে আসে।

মুঠোবন্দী নিশিন্দা পরীর গল্প, কারা এলো?
পানির ঘূর্ণিতে শ্যাওলার সবুজ চোখ, কারা এলো?
জলমগ্ন ঝিঁঝিঁদের সংসারে কারা এলো -
পেছনে হাটে আর ঝরা শিশিরের গল্পে
চোখ খুলে বর্ষা দেখে!


অবাস্তব
......
কে গেলো? কে? রেলোয়ে স্লীপার ধরে জড়োসড়ো?
আকাশের পথভ্রষ্ট পাখী কোন? ঝরা পাতা সমাজের?
পার্কে রাত্রিতে বহুদূরের আকাশ দেখিয়ে নিজেকেই বলেছিলাম
ঐ দেখো পাহাড় দেখা যায়
ঐ দেখো দূরে বিরাজ করে কেমন শূন্যতা
অবাস্তব দু’ফোঁটা পানিতে চোখ ভরে উঠেছিলো
পায়ের চটির মাঝখানে নখ ঘষে ঘষে
বলেছিলাম - ঐ দেখো নদী, ঐ দেখো
কি এক বিশাল চোখ তাকিয়ে এদিকে
দুটি কৃত্রিম হাতে শরীর জড়িয়ে বিড়বিড় করে এইসব বলেছিলাম।

কে গেলো, কে?
মাননীয় বৃক্ষের আড়ালে, কে গেলো জড়োসড়ো হয়ে
পথহারা পাখী? ঝরা পাতা সমাজের? তুমি?


কেমন করে বলবো
..............
কেমন করে বলবো
আমার হাতে বীজগণিত আর পাটীগণিত, তোমার হাতে ইতিহাসের নোট
আমার গায়ে ধুসর বর্ণের সার্ট আর কীটনাশকের রঙের চোঙা প্যান্ট
তোমার গায়ে আগুন না প্রজাপতির মরা রক্ত, মেরুন রঙের?

‘আমরা খুব আজ ব্যক্তিগত চিনাবাদাম খাবো
বাঁক ছাড়িয়ে যেতে যেতে কুড়োবো খুব
মাশরুমের টুপি, খুঁজে নেবো এমন কিছু ফুল
যারা নিজেরাই অদ্ভুত এবং বলবে সকল কথা!’

‘যেমন?’

‘যেমন কদম, কদম!
বুকের মধ্যে গোল, নিরেট, অনুর্বর
বর্ষাকালে খুলতে থাকে প্রাকৃতিক বন্ধন
নিজে এতো সুন্দর তবু ভেসে ভেসে জীবন কাটায়-’

‘যেমন কদম
একটি বৃত্ত নিজের ভেতর, একটি গণিত সমস্ত গাছের
অনুভবের নিজস্ব গোলক, পুরো জ্যামিতিক;
জটিল গতির সন্ধানে সে নিজেই অনুপস্থিত
দ্রুত ঝরে পড়ে আত্মস্মৃতির ভেতর-’



একদা অজস্র স্বপ্ন তুমি ও দৃশ্যপট
....................
তুমি বললে বনতুলশী, আমি বললাম ভুল
মাঠের মাঝে ফুটলো আমার নন্দনেরই ফুল।

মাঠ কুমড়ো নদী ঘেঁষে অবাক করা চোখ
আকাশ থেকে পড়লো বুঝি অপূর্ব আলোক।
সরু ফিতে কার যে চুলের নিরব অসহায়
আমার বুকের রাস্তা দিয়ে অল্প ঘেঁষে যায়।
পথের পাশে এগিয়ে গেলে অশ্বত্থের পাশে
ঈশ্বরেরই নাকে মতো মঠ এগিয়ে হাসে।
সবুজ জলাভূমি হেঁটে বাঁক ফেরালেই দেখি
বনতুলশী ঝোপে তুমি নিরবতার পাখি।

নিজেই বলি বনতুলশী, আবার ভাবি ভুল
মাঠের মাঠে এ যে আমার নন্দনেরই ফুল।


পদ্যের বই
..........
গুমটি ঘরে লুকিয়ে ছিলাম বেশ কয়েকটি রাত
বুটের লাথির ভয়ে
শালিখ আর চড়ুই এসে ব্যঙ্গ করতো প্রতিটি সকাল
ওরা আজকাল ভয়ই পায় না
মেনে নিয়েছে ফেরারী লোকজন।

বাইরে ঝুলছে তালার গহ্বর
ব্রোঞ্জযুগের নিদর্শনের মতো
দরোজা থেকে এঁকেবেঁকে ঠিক ভেতরের দিকে
একটি গোপন তক্তপোষ।

সঙ্গে ঝোলার মধ্যে রোগা কাব্যগ্রন্থ, হলুদ মলাট
প্রথম পাতা ছেঁড়া
দেশ এখন উপচে পড়ছে আর্তনাদের ফেনায়
বদ্ধ ঘরে টিনের চালে সেই শব্দের কাঁপন লাগে।

নিশানা নেই পথের
বসে আছেন যারা বসে থাকার, হাত তুলছেন, পা তুলছেন
খুলে দেবেন ঈশ্বরের তালা?
কারা, তারা কারা?

হলুদ পাতা থেকে
ক্ষণকালের বিশ্রামের ফাঁকে
ঊর্ধ্বে ওঠে ক্লান্ত চিলের ডানা
গুমোট ঘরে লতিয়ে ওঠে বুনো ধুন্দুল লতা
মেঝেয় ধানী ইঁদুর

আমার রোগা পদ্যের বই
কোথায় তুমি কই
আড়াই হাতের তক্তপোষে চুপচাপ আজকাল
আমি পেতে আমার জাল
শুধুই ভাঙি দিনের কাঠি, রাতের কংকাল।


সাইবারনেটিক্স
..........
তুমি এলে ট্রাক্টরের কলকব্জা নড়ে ওঠে
নি:শ্বাসে কাঁপে ঘাম
তুমি এলে সাইলেন্সার থেকে ভকভক ছোটে

তুমি থাকো যদি চুপচাপ
ধুলো ও কার্বন জমে ইনজেক্টরে
বুঁজে যায় থার্মোষ্ট্যাট ভাল্ব

তুমি না এলে
নড়ে চড়ে ওঠে হিসেবের গভর্নর, বিনা তাড়ায়
ধানখেতে কালো ফড়িং পেশী টানটান করে দাঁড়ায়।


হাইড্রলিক
.......
আমার হাত স্মৃতির পথ চলা থেকে নেমে এসে
কণ্ঠরোধ করছে আমাকেই বিশাল
একজোড়া হাইড্রলিক হাত

ভারী হয়ে উঠছে পা যেন বহুদিন
রোপা আমনের খেতে দাঁড়িয়ে ছিলাম
হতবিমূঢ় একজোড়া কাদামোজা পরে

আজ আমার চোখে কুয়াশা অবিকল
অঘ্রাণের খামার বাড়িতে একজোড়া
পুকুরেরই মতো


পরিস্থিতি
........
আসবে যদি ভাব নিতে তবে পিপা নিয়ে এসো
কালো ওয়েল্ডিং গ্লাস চোখে পরে এসো
সীসার জ্যাকেট পরে এসো
মিলিটারি বুট পায়ে এসো
গ্লাভস নিয়ে এসো

বলাতো যায় না কখন কি ঘটে যায়!


রহস্য খোলার রেঞ্চ
.............
হাত থেকে পড়ে গেলো ইস্পাতের রেঞ্চ ঝনঝন শব্দ করে
মেঝে মেঘলাতে
এমন সময় সোনা গাভী এসে মুখ দিলো হীরের ঘাসে
ওয়ার্কশপে যন্ত্রপাতির কাছে
আমি ঘষে যাই লোহার কবিতা
একা একা

কবে থেকে
টুকটাক ধাতুখন্ডদের সাথে কথা বলি
গল্প বলি নেবুলার বড়ো হয়ে ওঠা
মহাকাশযানের আজীবন একা থাকা
চতুর্মাত্রায় অনন্ত জীবন
কোয়ার্ক নাম ধরে ডাকি, ওগো দরোজা খোলো, জানালা খোলো
আমার কথা শোনো
কিউব, ট্যাপার আর গিয়ারের ফুলেরা

আজ কি যে হলো আমার
হাত থেকে কেন যে পড়ে গেলো ঝনন করে
রহস্য খোলার রেঞ্চ
সোনার গাভী এসে মুখ দিলো আমার
বাগানের হীরের ঘাসে
অচেনা ধাতুর এক গাভী এসে।


বায়োলজী ক্লাশে
.............
প্যারাফিন ট্রে’র গায়ে পিন দিয়ে গেঁথেছি
হাত
পা
এইবার যিশুর সাথে আমি ও এই সোনাব্যাঙ
পরস্পরের জীবন বদলাবো।


কেওয়াটখালি লোকোশেড
...............
রোদের জিহ্বা বেরিয়ে পড়েছে। কেওয়াটখালি লোকোশেডে
নীল মোচা রঙের রেল।
একটি ডিজেল বাবুইঞ্জিন টিনের টুপির নিচে
আরাম করছে। ঠেলে ঠুলে ঘাম ঝরাতে ঝরাতে
বয়লার ফেঁটে যাওয়া কয়লা ইঞ্জিনকে
আনা হলো। ঘি রঙের টুপি পরা ঠিকাদারের
লোক ভুড়ি ফুটিয়ে ছাতা মাথায় গোঁফ
নাড়িয়ে হুকুম দিলো ‘ভাঙো’।

অক্সিজেন শিখা জ্বললো। কালো রঙের আগুণ
ফোঁপালো।
টন টন ইস্পাত।
মিটার মিটার পাইপ।
তামা। দস্তা।
বিকেল হতে হতে লাইনের উপর রইলো শুধু চাকা।
চারটি।
একটি বাছুর সন্ধ্যের দিকে
হাওয়া খেতে চাকার উপর উঠলো।


একরামপুরের দুপুর
............
নদী ও রেললাইনের মাঝামাঝি মহকুমাজেলায়
একসার ওয়ার্কশপের কাছে
খালি পিপার পাহাড়।
ঘড়ঘড় শব্দে ধুলো ওড়ে শীতের মধ্যাহ্নে।
এক ঝলক কান্না কাতর নীল আলো
গভীর নলকুপের পাইপে ফিল্টার বদলানো সময়কার ঝালাই থেকে
মাশরুম লিঙ্গের মতো উঠে আসে।
আশেপাশেই এক প্রস্ত শিরিষ সবুজ, এক প্রস্ত জমানো নি:শ্বাস।

মালা বদল লেনায় দেনায়
দেশী কারখানায় শুরুর সাথে হাত ধরাধরি
এক পা ছায়ায় ধরে চৌকো বুনো পাতা
এক পা অগ্রগতির রুরাল জনসভায়
তানানা নানানা তানা নানা নানা
মাছের বুকের কাছে লেদের বিছানা
উবু হয়ে পা ছোঁড়ে ক্লান্ত ওয়াগন
আত্মনিবেদিত আধো নাগরিক মন
আমার এ সাম্প্রতিকের কান্না - ক্রমবিস্ফারিত গতি
একরামপুরের দুপুর একদিন পাবে পরিনতি।


গারো ও ইহুদীরা
............
ভারী যন্ত্র আমি ইহুদীদের পরম কল্যাণে ভারী
সাদাসিধে উচ্চমার্গীয় এক ইন্দ্রিয় যন্ত্র।

মহিলা এবং নিষ্ঠুর আর্তনাদ পছন্দ করি
আর আবিষ্কার করি যে রাস্তয় ভ্রমণে যাই
তা ব্যবহৃত হয়েছে বহুবার।

একমাত্র রাসায়নিক ভাবে অনুভব করে
মহিলার কৌমার্য বিষয়ে দ্বিধাহীন হওয়া যায়
গারোদের সে সুযোগ নেই বলে ওদের পুরুষেরা গুম্ফহীন।

ভারী শিল্প বাঁচে তূলনারহিত ইহুদীদের হাতে
একেকটি দীর্ঘ অপেক্ষা মহাযুদ্ধ শেষে
উচ্ছৃঙ্খল হয়ে স্বীকার করা ভালো
পুরুষ ও মহিলার মিলনেই ভারীশিল্প বেঁচে থাকে।


হেরোইন
.......
তাবুর ভেতর মরা রোদের ঘোর লাগা বিষন্ন ছেঁড়া পর্দা
টগবগে চৌবাচ্চা, উপচে পড়ে যাচ্ছে সবুজ খেলার মাঠে ট্রেন
একা একা চলেছি আলোর স্টেশন থেকে
বৃষ্টির ভেতরে, সবুজ ট্রেনে আজ কামরায় দুলুনি - ঝিরঝির ঝিরঝির

একটা হাত নদীর উপর পড়ে আছে, আরেকটি হাতে
নক্ষত্রের বাঁশী কোলের ওপর টেনে এনেছি
বরফের ঘরবাড়ি, মাছের ধনুকের প্যারাবোলা
হঠাৎ জায়গা বদল জুতোর সাথে হাঁস,
চোখের সামনে নিশিন্দা গাছে মোরগের দীর্ঘশ্বাস
কামরার সাথে কোনো এক আয়ুর্বেদিক ওষুধের আলমারি
লতাগুল্ম, ঢেকিশাক, ফার্নেসে উত্তাপ,
শব্দগুলো রঙিন সুতো, রক্ত ঝরছে, উজ্জ্বল আলোর নিচে ওপেন হার্ট সার্জারী।
দু’হাটুতে মাথা, আত্মদর্শনের গোলার ভেতর গোলা
ধরে আছি শক্ত করে হলুদ রোদেলা
পাখির নখ দিয়ে পড়ো-পড়ো অমৃতের ডাল
সাদা দেয়াল, শাদা দেয়াল - কিছুটা বেখেয়াল
ছবির সারি, ছবি থেকে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম - যেন সবুজ ঘাস
সোজা মানুষগুলোর চোখ ভরা কালো সন্দেহ, নির্মম অবিশ্বাস
তুল্যমূল্য, তুল্যমূল্য হিসাব, কালো পিঁপড়ের সারি
ঘাস, শুধু ঘাস আজ বিকেলের আততায়ী বাড়ি
থেকে রাতের ক্ষয়ে যাওয়া নখের নেবুলা।


ভালোবাসার দানো
.............
তোমার নাক, মুখ, চোখ, ঠোঁট - তোমার স্তন, যোনী, নাভী, নখ
সব ভালোবাসার সেবা করার জন্য
সব ভালোবাসার ডাক টিকিট, ভালোবাসার লোমকুপ, ভালোবাসার মুদ্রা।

প্রাকৃতিক আর সব ভোগ্যপণ্যের মতো তুমি;
তোমার জিহ্বার লালায় ক্লোরোফিল, স্তনে ডায়াজিপাম
নাভীতে চালতা ফুলের সৌরভ
সমুদ্রের সূর্যাস্তের মহিমা ঐ তোমার স্লিপারের ঝলকানি।

তুমি মাদী ঘোড়ার উজ্জ্বল কোমলতায় বর্ণিত
তরুণ মোষের নম্রতায়
বাষ্পরুদ্ধ বয়লারের মতো ছটফটে তোমার তরল চোখ
কোয়েলার মতো দুষ্প্রাপ্য, বিভারের মতো দামী
তুমি জানো সারস ও ষাঁড়ের হত্যারহস্য
শিকার ও শিকারীর মনস্তত্ব,
শুধু ভাঙচুরের কারসাজি।

সন্ধ্যার শ্যাওড়া কাঁপিয়ে চলাচল তোমার
তুমি ভালোবাসার দানো।

মহারাণীর বেতের চেয়ারে রাজসম্রাজ্ঞীর শিরদাঁড়া টান করে বসে থাকো
আনবিক ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে থাকি সেই দৃশ্য নিয়ে
আমিও যে বড়লোকের স্নানের দৃশ্য লুকিয়ে দেখেছি।


দাঁত
......
কবরের ভিতর চেনা বলতে শেষ পর্যন্ত রইলো দু’পাটি হাড়ের দাঁত।

এই দাঁতগুলো ছিলো উৎসবে চিবানোর জন্য
ভোঁজে ছেঁড়ার জন্য আর লৌকিকতায় মধুর হাসির জন্য
ছিলো ঘুম থেকে উঠে দিনের খোলা হা-এর ভিতর লাফিয়ে পড়ার আগে
সকালের পানি ও পেষ্টে ধুয়ে ফেলবার জন্য
কথা বলতে গিয়ে ভুল হয়ে গেলে জিভ কামড়ানো জন্য
চুমুতে সাহায্য করবার জন্য।

আজ বুকের লাল তিল, বুড়ো আঙ্গুলের ডগায় ছোট্ট পোড়াদাগ
এমনকি শরতের মসৃন নীলের সদৃশ চার আঙ্গুল কপাল
সবই মাটি ও উদ্ভিদের ভালোবাসার বিষয়।

চেনা বলতে রয়ে গেলো অবশেষ দু’পাটি দাঁত।

সাজানো, এলোমেলো, কোণা ভাঙা, একটির ওপর আরেকটি ওঠানো
শাদা বা ঘোলা
হৈ চৈ করা অথবা নি:শব্দ।


আমরা ক’জন শীত ও বর্ষাকালীন শাকসব্জী
..........................
আমরা ক’জন শীত ও বর্ষাকালীন শাকসব্জী, বাংলাভাষা, বামরাজনীতি,
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা ভালোবাসি
তাই আজ বেছে নিতে হয় এলোমেলো জীবনযাপন, লম্বাচুল, অনিশ্চয়তা
হাতে তুলে নিই হেরোয়িন গুড়া, সুঁই ও সিরিঞ্জ, নাজু ওয়ার্ক্সের সিস্টেম,
পাতিরাম, বয়রার চরশ

আমরা ক’জন ইটের রাস্তার উপর পিচ দিতে ভালোবাসি তাই মরাখোলা যাই
খুঁজে বের করি দাগীলোক
সূর্যাস্তের দৃশ্য ছেড়ে বেড়ার ঘরে বসে থাকি

আমাদের কাছে কৃষক শব্দের মূল অর্থ ‘কৃশ’,
মাস্তান ‘বিদ্রোহী অসহায়তা’
তরুণীরা ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলে ভুল করে, বলি, বিছানায় যাও
তোমাদের অন্ধকার খুব ভালো আছে, শুকতারা ভালো আছে,
ছাদ আজো ভালোবাসে শিউ-চন্দ্রিমা হাত
যাও, আর দেরী করো না, শুতে যাও খুকু।

আমার কখনো পালকিবাহক, ঝিকঝিক লা লা করে পুরনো গ্রামের আলপথে
বাউল রমা-পারুলের সংসারে যেতে ভালোবাসি
চিলে কোঠা ছেড়ে মাটি-কোঠা খুঁজি, ভালোবাসি কবিতা
তাই সমস্ত কুৎসিতের উপর প্রবল ঘৃণা উগরে দিয়ে
হা হা করে হাসতে হাসতে অপ্রকৃতস্ত হয়ে যাই।



কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সিরিজ
..............

শরৎকাল
.....
থিরথির করে কাঁপছে শরৎযন্ত্র শিশিরের আঘাতে
সারারাত চলেছে, তাই হিমায়িত নলে কুয়াশা
গাছপালার নাক-মুখ থেকে গলগল করে বেরোচ্ছে।
বিশাল থার্মোফ্লাক্স থেকে গলা বের করে
বেরিয়ে আসছে নদীর ঐ পাড়ের সূর্য হঠাৎ দাঁড়ি কামাতে কামাতে।


অনেকগুলি লেক
.........
কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের পাশ দিয়ে গেলে বর্ষাকালে
ষাঁড়ের গোবরের গন্ধ এসে ঝাপটা দেয়
কিছুদুরে শহীদ মিনার এর ওভারহেড পানির ট্যাংক
দুটি ভাই ওরা কিছুকাল হাত ধরে আছে
ঐ দিকে তাকালে আকাশ দেখা হয়ে যায়
লেকের পাশে চুপচাপ বসে থাকলে
পাশাপাশি কোথাকার অনেকগুলি লেকের কথা মনে হয়।


কর্মশালার পাশে রেললাইন
..............
আমাদের এখানে কর্মশালার পাশ দিয়ে
দিগন্তের মাফলার হয়ে রেললাইন চলে গেছে বহুদূর
আসামের নুড়িখন্ড আর গর্জন কাঠের স্লিপারের উপর দিয়ে।
দীর্ঘজীবী দিনের হাতে এইটুকু অবকাশ আমাদের
কর্মমুখর গবেষণা খামারের ভেতর।


জরিপ
.....
নারকেল গাছগুলো সাক্ষী সেই সব দুপুরে
কি করেছি আমি একরাশ অবিন্যস্ত ভাবনার
উড়োখুড়ো চুল উড়িয়ে মুখশুকনো সঙ্গীদের সাথে
পুরনো ব্রহ্মপুত্রের সীসারঙ পানির উপর থেকে
উঠে আসা রোদ নিয়ে
টি.এস.সি’র দোতলায়, বোটানিকেল গার্ডেনে
বৃষ্টিভেজা অন্তরীণ অবস্থাগুলোকে কি সব ভেবে
লুকিয়ে ফেলেছি বর্তমান থেকে
শাদা কাগজের স্তুপ তা জানে
জানে লেকব্রীজের তারাগুলো, গভীর রাতের কাছে
আমার আকুল অন্বেষণ, কি খুঁজেছিলাম
ধুলোর সাথে মিশে যেতে চেয়ে ঐ সব
নির্জন মুহূর্তগুলোয় -


লেকব্রীজ
.......
বাস্তবে লেকব্রীজ নিচে তার পানিছায়া
সামান্য বাতাসের রাতে ঝাউয়ের পাতায়
পুরনো দিনের জন্য সে কি শো শো উচ্ছ্বাস মায়া!
খেজুরে অশ্বত্থে যুগল জোড়াঞ্জলী
কান্নার নির্জন রাতে গাছগুলো পঙ্গু ঘোড়ার পিঠে বিপন্ন অশ্বারোহী।


বাহাদুর
.......
প্রতি সন্ধ্যায় দেখি তাকে হেঁটে হেঁটে হারিয়ে যেতে, চলে যায় কোথায় যেন
লাল টানেলের করিডোর ঠেলে প্রেমিক প্রেমিকার মাঝ দিয়ে
লাইব্রেরীর কাঁচ ভেদ করে এলামন্ডার উজ্জ্বল হলুদ পাপ ছুঁয়ে
সে যেন কোনো এক অসীম বলবান শক্তিশরীর হয়ে
অদৃশ্য হয়ে যায় খোঁড়াতে খোঁড়াতে।
এইতো ছিলো সে এই অন্ধকারে, খুঁটে খাচ্ছিল
ভিটামিন, শর্করা, সেলুলোজ, খনিজ কিছু কিছু
পরক্ষণেই সিমেন্টের ঢেউ ভেদ করে অন্যদিকে রাজপথে
খুট খুট করে হাঁটছে একাকী একা একা
সারারাত মাঠময় ঘুরে ঘুরে হাঁটে, দু’এক কদম
থমকে দাঁড়ায় লেভেল ক্রসিংয়ে, দূর থেকে দেখে
নতুন স্টেডিয়ামের হংশবলাকা ছাদ, ধীরে ধীরে হাঁটে
হাঁটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের হাতে আহত করা
অপারেশন শেখার গিনিপিগ ঘোড়া
রাত শেষে পেরিয়ে যায় তুঁত গাছ, আকাশের তারাদের দিকে।

আরো একবার ফিরে আসে
যেন ভালোবাসার লোভ হয় অপারেশন ঘরে...


লিরিকগুচ্ছ
..........

ছেলেটি ও মেয়েটি
...........
ছেলেটি পড়েছে তারপুলিন
শ্লোগানে বসে গেছে গলা -
ছেলেটি কি চায় আজ নিজের কাছে?
মেয়েটি যে নিস্ফলা!


ভালোবাসার ক্ষুধা
............
আসলে ভালো করে তোমাকে খাওয়াই হয়নি
তাই ভালোবাসার চোঁয়া ঢেকুর উঠছে
তোমাকে বলেছিলাম, আরেকটু ঠোঁটের ভাত আর ঘাড়ের ব্যঞ্জন দাও
অম্নি দেখালে জোড়া কবুতর উড়ে যাওয়া
মুঠো মুঠো গম দানা বরাদ্দ ওদের জন্য, আমার জন্য নয়
আমার যে রয়েছে ভালোবাসার ক্ষুধা, আর্তনাদ, ঈর্ষা ও পরাজয়।


ফাঁকি
......
যা দিয়েছো সব কি তোমার ভালোবাসার দান
এসব ভেবে দিনরাত হয়রান
হয়তো কিছু ফাঁকিও আছে বন বাদাড়ের মতো
ওরা যতো ঘন জমাট
শুন্য কি নয় ততো?


শংকা
........
দিন দিন কেবল শংকা বাড়ে তোমাকে নিয়ে
আছো কি নেই
তুমি কি ঠিক আগের মতোই
চুলে আটকে গেলে সরু চিরুনী
আমার কথা ভেবে খামাখাই শংকায় ভরে ওঠো?
----------------------------------------------

জলমগ্ন পাঠশালা : কাজল শাহনেওয়াজ। প্রচ্ছদ: কাজল শাহনেওয়াজ। স্বত্ব: সুরাইয়া সিদ্দিক। প্রকাশক: শিল্পতরু প্রকাশনী, ২৯০ সোনারগাঁও রোড, ঢাকা-১২০৫। প্রকাশকাল: ফাল্গুন, ১৩৯৫/ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯।
মূল্য: বিশ টাকা মাত্র। উৎসর্গ: আবিদ আজাদ করকমলেষু

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন