রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০০৯

বাংলা কবিতার একটা মোড় ফেরা উচিত :: আল মাহমুদ

সাক্ষাৎকার গ্রহণে : পলাশ দত্ত

এটি আল মাহমুদের সঙ্গে বাংলা কবিতা নিয়ে একটা আলাপ। আলাপটি দৈনিক সমকালের সাহিত্য সাময়িকী কালের খেয়ার চলতি সংখ্যায় ছাপা এই শিরোনামে। আলাপটা আমার সঙ্গেই হইছে। এই কারণে এটা সচলায়তনে দিলাম।

=================================
আপনার উড়ালকাব্য বইটায় আপনি বলছেন পৃথিবীতে ঈগল থাকবে না ইতিহাস থাকবে। তো আগামী পৃথিবীর ইতিহাস তো হবে প্রযুক্তিতে আত্মবিস্মৃত মানুষের ইতিহাস। সেই ইতিহাসে কবিতাকে কতোখানি জায়গা দেবে মানুষ?

আল মাহমুদ : মানুষের শ্রেষ্ঠ কাজ হলো কবিতার সৃষ্টি। অর্থাৎ স্বপ্ন সৃষ্টি। মানুষ এই পৃথিবীতে কঠোর-কিঠন বাস্তবতার মধ্যে বাস করতে পারে না। তারা কিছুটা বাস্তবে কিছুটা স্বপ্নে বাস করে। এই যে স্বপ্ন সৃষ্টি করতে পারে মানুষ এটার নামই হলো কবিতা। মানুষ যে স্বপ্ন সৃষ্টি করে স্বপ্নের মধ্যে চলাফেরা করে এটা সম্ভব হয়েছে কবিতার জন্যে।

নতুন ধরনের কবিতা লিখতে না পারলে কোনো কবি কবিতার ইতিহাসে জায়গা পান না। আপনি যখন লেখা শুরু করলেন তখন এই চ্যালেঞ্জটা কিভাবে মোকাবেল করলেন?

আল মাহমুদ : আমি যখনই কবিতা লিখেছি তখনই নতুন কথা বলতে চেয়েছি। কবিতার আঙ্গিক বদলে দিয়েছি। কথা নতুন হলে আপনাতেই আঙ্গিক বদলে যায়। বক্তব্য থাকতে হবে। বক্তব্য থাকলে আঙ্গিক বক্তব্যের সাথে বদলে যায়।

আপনার ‘লোক লোকান্তর’ বেরুলো ১৯৬৩তে। ‘কালের কলস’ বেরুলো ১৯৬৬তে। এই দুই বইয়েল জন্য আপনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেলেন। পাঠক আপনাকে চেনে ‘সোনালি কাবিন’-এর জন্য। ওই বইয়ের প্রথম কবিতাটা ‘প্রকৃতি’- “কতোদূর এগোলো মানুষ!/আমি আজো ঘোর লাগা বর্ষণের মাঝে/উবু হয়ে বসে আছি।” এটা কি আসলে গ্রামের কথা?

আল মাহমুদ : হ্যাঁ এটা তত্কালীন আমার যে পরিবেশ ছিলো গ্রামের কথা।

সোনালি কাবিন বেরুলো ১৯৭৩-এ। কবিতাটা তারও কিছু আগে লেখা। প্রায় ৩৬ বছর পার হয়ে গেছে। এখন কি আপনার মনে হয় যে বাংলাদেশে/পৃথিবীতে গ্রাম থাকবে আদৌ?

আল মাহমুদ : দেখো আমরা হলাম এশিয়ান মানুষ। আমাদের তো চতুর্দিকে গ্রামই। যেটাকে তোমরা বলো যে urbanity, আমার কি সত্যি সত্যি খুব urban? আমরা তো অতোটা urban না। আমরা তো গ্রাম প্রকৃতি আধা শহর আধা গ্রাম- এর মধ্যে বাস করি। তোমার প্রশ্নটা কী?

আমার প্রশ্নটা হচ্ছে আধা শহরের ধাক্কায় তো আধা গ্রাম নাই হয়ে যাচ্ছে। ইওরোপীয় শহরের চরিত্র বাদ দিন। বাংলাদেশের শহরের যে চরিত্র ঢাকা শহরের যে চরিত্র চিটাগাংয়ের যে চরিত্র এই শহরের চরিত্র কি গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে না? গ্রাম কি শহরের চরিত্র ধারণ করতেছে না আস্তে আস্তে? এভাবে পুরো বাংলাদেশটাই কি শহরের আধা শহরের চরিত্র নিয়ে নেবে নাকি আস্তে আস্তে?

আল মাহমুদ : আমারও তাই মনে হয় যে,

নিরঙ্কুশ গ্রাম বলতে যেটা বুঝতাম সেই গ্রাম কি থাকবে? নাকি এই আধা শহুরে চরিত্রের গ্রাম হবে?

আল মাহমুদ : এটা তো এই মুহূর্তে বলতে পারছি না..

কবি তো দ্রষ্টা। আপনার তো অন্তর্দৃষ্টি আছে...

আল মাহমুদ : আমার মনে হয় যে হ্যাঁ, নানান আধুনিক সুবিধাপ্রাপ্ত একটা গ্রাম থাকবে।

আচ্ছা মাহমুদ ভাই বাংলা কবিতায় আপনার কাব্যভাষাটা তো নতুন?

আল মাহমুদ : তখন ছিলো নতুন।

হ্যাঁ। ৩০-এর দশকের কবিদের হাত দিয়ে যে-ভাষাটা তৈরি হলো বাংলাতে, সেই ভাষার মধ্যেই পরবর্তি সময়ে আপনারা পরে আরো কেউ কেউ সেই ভাষার কাঠামোর মধ্যেই নতুন নতুন কিছু জুড়ে দিয়ে নিজস্ব একটা করে ভাষা তৈরি করছেন। কিন্তু ৩০-এর পর এখন ২০০৯ সাল, এই এতো বছরেও ভাষার কাঠামোতে কোনো পবির্তন ঘটে নাই।

আল মাহমুদ : কথাটা ঠিক সর্বাংশে সত্য নয়। কিছু পরিবর্তন হয়েছে। জীবনানন্দ দাশের যে-ভাষা সেই ভাষার একেবারেই নিকটবর্তী কবি হলাম আমার ৫০ দশকের কবিরা। তো জীবনানন্দ দাশের ভাষা কি অবিমিশ্র থেকেছে? আমার মনে হয় যে ভাষা অনেকটা নদীর স্রোতের মতো। বদলে যাচ্ছে কিন্তু ধরা পড়ে না সহজে।

না, ধরেন যে রবীন্দ্রনাথের পর ৩০-এ ভাষাটা যেভাবে বদলালো একবারে, যেভাবে চোখে পড়ে

আল মাহমুদ : ৩০-এর কবিদের প্রকৃতপক্ষে কোনো দেশ ছিলো না। তারা ইউরোপীয় সাহিত্য পড়েছেন। সবগুলো লোকই ইংরেজি ভাষার অত্যন্ত ভালো ছাত্র ছিলেন। যখন তারা মনে করলেন যে একজন কবির তো দেশ না হলে চলে না, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তো কোথায় ফিরবে? বুদ্ধদেব বসু দেশে ফিরতে চাইলেণ, কিন্তু দেশ কই? তার তো কোনো দেশ ছিলো না। তিনি মহাভারতে ফিরলেন। এইরকমই বিষ্ণু দে : আমার খুঁজেছি হরেক বইয়েতে আপন দেশ/ দেশের মানুষ ঘুরিয়েছে শুধু ডাইনে বাঁয়ে/এখন আমি হয়রান হয়ে খুঁজছি শেষ/ফিরবো ফিরবো আমি বলো সে কোন গাঁয়ে। এদের সবারই ফেরার চেষ্টা ছিলো। কিন্তু ফিরতে গিয়ে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমার ৫০ দশকের কবিরা আমি শামসুর রাহমান বা আমাতের প্রথমেই দরকরা ছিলো একটা দেশ। আমার দেশের ভেতরেই ছিলাম। একটা দেশ আমাদের ছিলো সেটার নাম বাংলাদেশ।

ঠিক আছে। কিন্তু ৩০-এর কবিরা যে ভাষাটা আপনাদের দিছেন সেটা না দিলে কি আপনারা যতো সহজে শুরু করতে পারছেন সেটা পারতেন?

আল মাহমুদ : ঠিক আছে। তারা যে ভাষাটা দিয়েছিলেন, ৩০-এর কবিরা, আমার সে ভাষায় কাঠামোটা রেখেছি; কিন্তু আমরা অনেক আঞ্চলিক-গ্রাম্য শব্দ মিশিয়ে একটা ভাষা তৈরি করেছি।

কবিতাকে কি আপনি শিল্প মানেন? কবিতা কি একটা শিল্প?

আল মাহমুদ : কবিতা হলো স্বপ্ন। স্বপ্নটা যখন কাব্যে রূপ নেয়, ভাষায়- তখন কিন্তু এটাকে শিল্পই বলা উচিত। অতিশয় অনুভূতিপ্রবণ সূক্ষ্ম শিল্প।

শিল্প বললে কিছু আবার পরিকল্পিত ব্যাপার আসে না? মানে যে ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষের আবেগকে স্পর্শ করার জন্য জাগ্রত করার জন্য আলোড়িত করার জন্য কবির ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু শব্দ সাজিয়ে লেখাÑ এই অর্থ কি আমার শিল্প বলবো এটাকে?

আল মাহমুদ : না। ভাষার অর্থে। ভাষাকে যদি শিল্প বলা হয় তাহলে এটা বলা যায়। কারণ কবিতা কী? ভাষা ছাড়া কিছু না।

আমার যারা এখন লেখালেখি করি তারা তো লেখালেখি শুরু করছি আপনার ৫০ বছর পরে। এই কারণে আপনার সাথে একটু ভাবনা বিনিময়। আমাদের সময়ে প্রায় সবাই কবিতা লেখেন হচ্ছে যে ধরেন কোনো একটা কোনো একটা ঘটান দেখলো অথবা কোনো একটা দৃশ্য দেখে আলোড়িত হলো যে কোনো একটা অনুভূতি নিয়ে তার কেমন লাগলো সেইটা লেখে। আমার প্রশ্নটা হচ্ছে কবি কি কোনো দৃশ্য দেখে তার কেমন লাগলো সেইটা লিখবেন, নাকি কী দেখলেন সেইটা লিখবেন?

আল মাহমুদ : কবির কাজ হলো অন্যকে স্বপ্ন দেখানো। অন্যকে স্বপ্ন দেখাতে হলে ভাষার যে-উপাদানগুলো প্রয়োজন এটা কবিকে আয়ত্ব করতে হবে নিজে। কেউ সাহায্য করতে পারে না। তো আমার ধারণা যে বাংলা কবিতা আধুনিক বাংলা কবিতা এখন এমন একটা অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে এখান থেকে তার একটা মোড় ফেরা উচিত। কোথাও চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু মোড়টা ফিরছে না। যদি মোড় ফেরে তাহলে একটা ওলোটপালোট হয়ে যাবে।

এই যে মোড়টা যে ফেরা উচিত বলে মনে হচ্ছে আপনার এটা কেন মনে হচ্ছে?

আল মাহমুদ : এটার কারণ হলো প্রত্যেক ভাষারই একটা গতি আছে, একটা পিরিয়ড আছে। আধুনিক কবিতারও একটা পিরিয়ড আছে। আমার বলি আধুনিক কবিতা। আধুনিক কবিতা কতোকাল আধুনিক থাকে? একশ বছর? আমার এখনো তো আধুনিক কবিতাই বলি। এই যে একশ বছর পরেও কবিতা এখন যেটা লেখা হচ্ছে এটা আধুনিক? এটার অন্য নাম হওয়া উচিত।

অন্য নাম হতে হলে তো লেখাটাও অন্যরকম হওয়া উচিত, নাকি?

আল মাহমুদ : সেটাই তো। অন্য নাম যখন হবে তখন লেখাটাও অন্যরকম হবে।

বাংলা কবিতায় আপনারাও লিখছেন, আমরাও লিখি- আমরা সবাই উত্তম পুরুষে কবিতা লিখি। সব আমি দিয়ে লেখা হয় কেন আমাদের কবিতা?

আল মাহমুদ : এই প্রশ্নের জবাবটা তো আমাকে না করে নিজকে করাই উচিত। কারণ আমি, এটা ঠিক কথা যে আমি-আমি, এখন আমি না থাকলে কী হয়? আমি না থাকলে দেশ আছে জনগণ আছে।

কিন্তু কবিতা হয়ে ওঠার প্রথম শর্ত যেটা যে আমার অনুভূতিটাকেই সর্বজনীন করে তুলতে হবে লেখার মধ্যে, শুদু আমি দিয়ে লিখলে আমার অভিজ্ঞতাকে সর্বজনীন করে তোলার ক্ষেত্রে কি একটু সমস্যা হয় না? এটা কি আমাদের একটা টেকনিক্যাল প্রবলেম হয়ে যাচ্ছে না কবিতার?

আল মাহমুদ : আমার মনে হয় যে... একটা যুগ ছিলো যখন... বাংলা কবিতা চর্যার দল থেকে উঠে এসছিলো। আগে তো কবিতা গান করা হতো। এবং এটা যারা করেছিলেন তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একজন। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মধ্যবিত্ত সমাজকে নিয়েই কাজ করেছেন। উনি মধ্যবিত্ত সমাজকে ভাবতেন উটপাখি- উড়তে পারে না, কিন্তু সে পাখি। আবার পশুদের সাথেও মিশতে পারে না। কারণ সে ভাবে যে তার পাখা আছে। এই যে দোদুল্যমান মধ্যবিত্ত সমাজ, এই যে বেদনা এটা আধুনিক কবিতায় উচ্চকিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। সেখান থেকে আর অগ্রসর হতে পারেনি। আমার ধারনা এখনকার যুগের যে কবিরা- আমি অবশ্য জানি না, অতো খোঁজখবর রাখতে পারি না তো, চোখেও দেখি না- হয়তো তারা ভালোই লিখছে। কিন্তু কী? একটা কিছু দাঁড়াবে তো? সেটা আমি তো দেখি না। হয়তো আছে তোমাদের মধ্যে, কিন্তু... আমার কথা হলো আধুনিক কবিতা কতোদিন আধুনিক? এই হিসাবটা করতে হবে।

একটা সময় ছিলো যখন কবিতাকে আধুনিক কবিতা বলা হতো। এখন তো আর কবিতাকে আধুনিক কবিতা বলা উচিত না। অন্য কোনো নাম দেয়া উচিত। চিন্তার বদল না হলে আঙ্গিক বদলায় না। এমন কিছু বিষয় আসতে হবে যাতে আঙ্গিকটা ফেটে যাবে। এটা তো ঘটছে না। ঘটবে না এটা বলছি না। হয়তো এই সময়ের মধ্যেই এমন বহু কবি আসতে পারেন যারা ভাষার খোলনলচে পাল্টে দেবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত দেখছি না।

কিন্তু আপনার বক্তব্য হচ্ছে বদলানোর সময় হইছে?

আল মাহমুদ : হ্যাঁ, পুরোপুরি।

এই বদল কি সচেতনভাবে করা সম্ভব?

আল মাহমুদ : সচেতনভাবে করা সম্ভব। সচেতনভাবেই তো করতে হবে। কিন্তু কবিতা তো হতে হবে। এমন একটা কিছু হতে হবে যেটা দারুণ একটা প্রভাব বিস্তার করে মানুষের ওপরে।

কবিতায় কল্পনা জিনিসটা কী বলেন একটু।

আল মাহমুদ : কবিতায় তুমি কী কী চাও? কবিতায় কল্পনা চাও না। কী চাও।

বাস্তব জগতকে দেখে সেখান থেকে তাড়িত হয়ে যে কল্পনার সৃষ্টি সেটা একটা। আর একটা হচ্ছে যে শুধুই কল্পনার জগত তৈরি করে লেখা।

আল মাহমুদ : শোনো কল্পনাটা সবসময়, আমার ধারণা আর কি, বস্তুনির্ভর। তুমি কল্পনা করছো কিন্তু অন্তঃসার কিছু নাই- এটা তো কল্পনা হয় না। কল্পনাকে অবশ্যই একটা বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন