বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৯

বিমূর্ত প্রেম


বোরিস পাস্তেরনাক

অনুবাদ : মোবারক হোসেন খান



সেপ্টেম্বর মাসের এক সìধ্যাবেলা। পিসার হেলানো টাওয়ারের তির্যক আলো সারা পিসার পার্শ্বদেশ আলোকিত করে তুলেছে। সারা টাসকেনি রাতের বাতাসে রুষ্ট হয়ে উঠেছে। শুকনো লরেল পাতার গìধ বইছে। এমনি এক সìধ্যার কথা। তারিখটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। তেইশে আগস্ট। সেদিন সìধ্যায় হাইনের খোঁজে হোটেলে এলেন এমিলিও রেলিনকুইমিনি। কিন্তু হাইনকে হোটেলে পাওয়া গেল না। তিনি হোটেলের বেয়ারার কাছে কাগজ ও আলো চাইলেন। বেয়ারা কাগজ ও আলোর সঙ্গে একটি কালির দোয়াত, কলমদানি, সিলমোহর ও মোমের গালা নিয়ে এল। রেলিনকুইমিনি বেয়ারাকে চলে যেতে বললেন। তিনি টাই থেকে পিনটা খুলে মোমের আগুনের ওপর ধরলেন। আগুনে পুড়ে লাল হলে তিনি পিনটা আঙুলে ফোটালেন। তারপর হোটেলের কার্ডের স্তূপ থেকে একটা কার্ড তুলে রক্তঝরা আঙুলে জড়ালেন। তিনি বেয়ারাকে ডেকে তার হাতে কার্ডটা নিয়ে বললেন, ‘হের হাইনেকে এই ভিজিটিং কার্ডটা দেবে। কাল ঠিক এই সময়ে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে আসব।’
হেলানো পিসা টাওয়ারের ছায়া আস্তে আস্তে দীর্ঘতর হচ্ছে। সেতুর ওপর দাঁড়ানো দর্শকের সংখ্যাও প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। আকাশের লাল আলো সাড়া প্রাঙ্গণে হামাগুড়ি দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। রাস্তাগুলো ছায়ায় আচ্ছাদিত হয়ে গেছে। অলিগলিও ঢোকার চেষ্টা করছে। পিসা টাওয়ার এগিয়ে চলেছে। একটা বিরাট আকৃতির ছায়া শেষ পর্যন্ত সূর্যটাকে ঢেকে ফেলল। দিনটা খান খান হয়ে ভেঙে গেল। হাইনে হোটেলে ফিরে এলেন। বেয়ারা আগন্তুকের খামটি তার হাতে দিল আর তার বলে যাওয়া কথাগুলো জানাল।
‘কী চমৎকার! দেখলেই মনে হয় একেবারে মৌলিক।’ হাইনের কিন্তু আগন্তুকের পরিচয় বুঝতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হলো না। আগন্তুকের নামও জানেন তিনি। ‘ইল সাঙ্গু’ শীর্ষক বিখ্যাত কবিতার রচয়িতা। একই দিনে তিনি ওয়েস্টফালিয়া আর আগন্তুক কবি ফেরারা থেকে পিসায় এসে পৌঁছেছেন। দুজনের একই দিনে উপস্খিত হওয়ার ব্যাপারটা হাইনের কাছে স্বাভাবিক বলেই মনে হলো। এ ধরনের ঘটনা তো ঘটতেই পারে। তার কয়েক দিন আগের কথা মনে পড়ল। এক অজ্ঞাত ব্যক্তির লেখা একটা চিঠি। চিঠির ভাষা অবজ্ঞাপূর্ণ এবং অবহেলার সঙ্গে লেখা। সেই নাম না জানা লোকটির চিঠিতে উল্লিখিত দাবি তার কাছে সৌজন্যের সীমা লঙ্ঘন করেছে বলে তার মনে হয়েছে। তার চিঠির বক্তব্যও বেশ অস্পষ্ট। হাইনের কাছে সেই ব্যক্তি অ্যাপেলসের মতো এক টুকরো পরিচয় চিহ্ন চেয়েছে। প্রেম (অজানা লোকটি লিখেছে), মেঘবিহীন রক্তে রঞ্জিত। অ্যাপেলেসের স্বাক্ষরের মতো এ কথা আপনার লেখা উচিত। মনে রাখবেন, অভিজাত মাথা ও রক্তের মধ্যে আপনার জন্ম (কারণ এ দুটোকে পৃথক করা যায় না)। আর ডিউথিসও এ বিষয়টি সম্পর্কেই শুধু কৌতূহলী ছিলেন।
পুনশ্চ আপনি পিসায় থাকায় আমার লাভ হয়েছে। এ খবরটা আমার প্রকাশক কন্টি আমাকে জানিয়েছে। খবরটা শুনে আমার বিবেকের দংশন থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্তি লাভ করেছি। তিন দিনের মধ্যে আমি অ্যাপেলেসের স্বাক্ষর দেয়ার জন্য আপনার কাছে আসব।
হাইনে বেয়ারাকে ডেকে বললেন, আমি দশটার ট্রেনে ফেরারা যাচ্ছি। গতকাল তোমার কাছে যে লোকটা কার্ড দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। তুমি এই পার্সেলখানা নিজের হাতে তাকে দিও। এখন যাও বিল নিয়ে আসো, আর পোর্টারকে ডেকে দাও।
অদ্ভুত পার্সেলটি খুবই হালকা। মনে হচ্ছিল যেন ভেতরে কিছু নেই। আসল কারণ পার্সেলের ভেতর ছিল খুবই পাতলা কাগজ লেখা একটা পাণ্ডুলিপি থেকে ছেঁড়া কিছু পাতা। সেই পাতাগুলোতে বাক্যের কিছু অংশ লেখা, যার কোনো শুরু আর শেষ নেই। তাতে লেখা রয়েছে : কিন্তু রনডলফিনা ও এনরিকো তাদের পুরনো নাম বদলে যে নতুন নাম নিয়েছে তা কেউ জানে না। লোকটা উদ্ভ্রান্তের মতো ডেকে উঠল, ‘রনডলফিনা’ আর মেয়েটি উত্তর দিল ‘এনরিকো’...।
ফুটপাথের পাথরে, বাজারের কাঁকড়ে আস্তীর্ণ পথে, পিসার ব্যালকনিতে, খার্গো নদীর বেড়িবাঁধের শহরবাসীরা টাসকানে রাতের সুগìধ জ্বালিয়ে দিল। অìধকার রাতের আলো সেই সুগìেধ দম আটকানো গলিতে ধুলো-উড়া পাইন গাছের তলায়, আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত তারার আলোর সঙ্গে মিশে এক রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। পিসার শহরবাসীদের মনে রাতের এই রূপ যেন ধৈর্যের এক মূর্ত প্রতীক।
জানালার পাশে একটি আসন। ট্রেনে করে ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন হাইনে। পথ-ঘাট-মাঠ পেরিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। হাইনে ট্রেনে বসে ভাবছেন। না, তার মনের ভেতর কোনো ভাবনা নেই। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে চোখে ঢুলুনি নেমে আসছে। হাইনে চোখ বুজলেন। তারপরও কিন্তু ভাবনার ফানুস মনের ভেতর ডানা মেলে উড়ে চলল :
‘কিছু একটা হবেই। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভেবে কাজ নেই। ভবিষ্যতের সমস্যার সমাধানের কথা ভেবে লাভ নেই। ভবিষ্যৎ তো সবসময়ই একটা পরম আনন্দকর রহস্য।’
রাতের সুরভিত মৃদু বাতাসে ভেসে আসা ফুলের গìেধ যাত্রীরা চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ে।
এটা একটা আত্মরক্ষার খেলা। কিছু না কিছু একটা এই খেলা থেকে বের হয়ে আসবেই। এ খেলা অর্থহীন হতে পারে না। হাইনে হাই তুললেন। রেলিনকুইমিনির প্রণয়াকুল কবিতাগুলোতে একটা অপরিবর্তনীয় টীকা রয়েছে যার নাম : ফেরারা।
পাথর, পাহাড়ের খাড়াই, হাইনের নিদ্রাচ্ছন্ন সহযাত্রী, কামরার দুর্গìধ আর গ্যাস লাইটের আলো সবকিছুই যেন রাতের ট্রেনটিকে চারদিক থেকে বেষ্টন করে রয়েছে।
অ্যাপেলেসের স্বাক্ষর... রনডনফিলা...। হয়তো একদিনে সবকিছু সারতে পারব না। আমার হাতে আর সময়ও নেই। আমাকে কোনো চিহ্ন না রেখেই লুকোতে হবে এবং আগামীকালের মধ্যেই। হোটেলের বেয়ারার কাছ থেকে আমার যাত্রার খবর পেয়ে নিশ্চয় স্টেশনে ছুটে আসবে আগন্তুক সেই বিখ্যাত কবি।
কৃষäনীল প্রভাত আর শীত ভেজা সুরভিত কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল আমার ছেড়ে আসা ফেরারা শহরটিকে কী চমৎকার মনোরম করে রেখেছে!
‘‘অসম্ভব, ‘ডোস’-এর ছাপার কাজ শুরু হয়েছে।’’
‘জানি। কিন্তু আমার আবিষ্কার আমি অন্য কারোর হাতে তুলে দিতে পারব না। এমনকি অর্থের বিনিময়েও নয়। আর ফেরারা শহরেও আমি একদিনের বেশি থাকতে পারব না।’
‘আপনি বলছেন যে, নোটটা ট্রেনের কামরায় আসনের নিচে পড়েছিল?’
‘নিশ্চয়ই। এমিলিও রেলিনকুইমিনির নোট বই, পাণ্ডুলিপির পাতা, তার অসংখ্য অপ্রকাশিত কবিতা, খসড়া কপি, প্রবচন দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, তিনি ফেরারা শহরে বসেই সারা বছর ধরে এগুলো লিখেছেন। লেখার নিচে তারিখ থেকেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়।’
‘নোট বইটা কোথায়? আপনার সঙ্গে আছে?’
‘না, আমার জিনিসপত্র স্টেশনে রেখে এসেছি। নোট বইটা আমার ট্রাভেল-ব্যাগে আছে।’
‘বড়ই দু:খের কথা। ওটা নিয়ে এনে তার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারতাম। প্রকাশক রেলিনকুইমিনির ফেরারা শহরের ঠিকানা জানেন, অবশ্য তিনি গত এক মাস ধরে বাইরে।’
‘আর রেলিনকুইমিনি যদি ফেরারা শহরে না থাকেন, তবে?’
‘সেটাই তো সমস্যা। সত্যি, আপনার এই হারানো-প্রাপ্তির কথা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে কী লাভ হবে আমি বুঝতে পারছি না।’
‘আমি বুঝিয়ে বলছি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলে আমি এই নোট বইয়ের মালিকের সাথে যোগাযোগ করতে পারব। আর রেলিনকুইমিনিও নিশ্চয় ‘ভোস’ পত্রিকার এই উপকারের জন্যে উপকৃত হতো।’
‘আপনার সঙ্গে আর পারা গেল না। বসুন, বিজ্ঞাপনে কী লিখতে হবে বলুন।’
‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দু:খিত। আচ্ছা, আপনার টেলিফোনটি ব্যবহার করতে পারি কি?’
‘আপনার যা খুশি করুন।’
‘হোটেল টরকোয়াটো টাগো? আপনার ওখানে কোনো রুম খালি আছে কি? আছে, কোন তলায়? চমৎকার : আমার জন্য আট নম্বর রুমটা রিজার্ভ করে রাখবেন।’
‘একটা কাজ হলো। এবার বিজ্ঞপ্তিখানা লিখে দিচ্ছি।’
‘এমিলিও রেলিনকুইমিনির প্রকাশিতব্য একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে। হোটেল টাসোর আট নম্বর রুমে অবস্খানরত ব্যক্তির সঙ্গে আজ সকাল থেকে রাত এগারোটার মধ্যে যোগাযোগ করে পাণ্ডুলিপির মালিক বা তার প্রতিনিধি পাণ্ডুলিপিখানা ফেরত নিতে পারেন। পরের দিন থেকে যিনি পাণ্ডুলিপি পেয়েছেন তিনি সময় সময় ‘ডোস’ পত্রিকার প্রকাশক এবং হোটেলের পরিচালকদের কাছে তার ঠিকানা পরিবর্তনের বিষয় অবগত রাখবেন।’
ভ্রমণের দরুন হাইনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। গভীর নিদ্রায় তিনি আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। ঘরের খড়খড়িগুলো সকালের আলোতে উত্তপ্ত হয়ে উঠল। ছোট্ট জানালা গলে এক রাশ আলো এসে মেঝেতে পড়েছে। রাস্তায় মানুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এক ঘন্টা পার হয়ে গেল। হাইনে ঘুমিয়ে আছেন। আলো জাল ছড়াতে লাগল। এক সময় আলোর উত্তাপ কমে আসতে শুরু করল। হাইনে তখনও ঘুমাচ্ছেন। রাস্তায় কথাবার্তা চলছে। আস্তে আস্তে আলো নিভে আসতে লাগল। কিন্তু হাইনে তখনো নিদ্রামগ্ন।
যেকোনো মুহূর্তে হাইনে জেগে উঠতে পারেন। বিছানা ছেড়ে নেমে আসতে পারেন। আমার কথা যে সত্য তার প্রমাণ পাবেন। তবে তিনি এখনো ঘুমিয়ে আছেন। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখছেন। স্বপ্নের শেষ পরিচ্ছেদটা তাকে দেখে নিতে দিন।

একটা হাতগাড়িতে করে খবরের কাগজের ছেলেটা রাস্তা দিযে চলছিল। প্রখর রোদে হঠাৎ গাড়ির চাকা ফেটে গেল। কাত হয়ে গাড়িটা ধপ করে পড়ে গেল। খবরের কাগজের বান্ডিলগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ল। রাস্তার লোকজন আহত ছেলেটাকে কাছের একটা ওষুধের দোকানে শুশ্রূষার জন্য নিয়ে গেল।
ঠিক! আমি বলেছিলাম না? হাইনে হঠাৎ লাফিয়ে অধৈর্যভরে ধাক্কা দিচ্ছে। হাইনের ঘুম তখনো পুরোপুরি ভাঙেনি। চুলগুলো এলোমেলো। হাতে চায়ের পেয়ালা। তিনি ড্রেসিং গাউনটার জন্য হাত বাড়ালেন। ‘একটু দাঁড়ান, আসছি।’ কথা শেষ করে হাইনে ধপ করে ডান পা’টা মেঝের ওপর ফেললেন। আবার বললেন, ‘এক্ষুণি আসছি।’ তিনি দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন।
‘কে?’ দরজার এপাশ থেকে জিজ্ঞাসা করলেন।
দরজার ওপাশ থেকে বেয়ারার জবাব ভেসে এল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, পাণ্ডুলিপিটা আমার কাছে আছে। মহিলাকে আমার অ্যাপলজি জানিও। ওকে ড্রইংরুমে বসিয়েছো তো?’
দরজার ওপাশ থেকে আবার বেয়ারার কণ্ঠ শোনা গেল।
‘সিনিওরাকে দশ মিনিট অপেক্ষা করতে বলো। দশ মিনিটের মধ্যে আমি তার সান্নিধ্যে ঠিক হাজির হব। শুনতে পাচ্ছো?’
বেয়ারার গলা আবার শোনা গেল।
‘শোনো!’
বেয়ারার কণ্ঠস্বর।
‘সাদমোয়াজেলকে আমি এই মুহূর্তে তার কাছে যেতে পারছি না বলে আমার দু:খ প্রকাশের কথা বলো। তবে আমি যদ্দুর সম্ভব তাড়াতাড়ি আসতে চেষ্টা করছি... শুনতে পাচ্ছো?’
বেয়ারা উত্তর দিল।
‘...আর মাত্র দশ মিনিট। আমার এই বিলম্বের জন্য আমি দু:খিত... ওকে বিনয়ের সঙ্গে কথাগুলো বলো। হ্যাঁ, শোনো বেয়ারা, ওকে বলো যে, আমি ফেরারা শহরের লোক নই।’
বেয়ারার জবাব শোনা গেল।
‘বেশ, বেশ, মহিলা কি ড্রইংরুমে?’
‘জি!’
‘তিনি কি একা?’
‘একা, সিনিওর।’
হাইনে বেরিয়ে এলেন। বেয়ারা তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ‘বাঁয়ে, বাঁয়ে চলুন সিনিওর।’ বেয়ারা বলল।

ড্রইংরুমে পৌঁছে ভদ্রমহিলাকে হাইনে বললেন, ‘সুপ্রভাত, আপনার জন্য কি করতে পারি বলুন?’
‘কিছু যদি মনে না করেন, আপনি কি আট নম্বর রুমে উঠেছেন?’
‘হ্যাঁ, আমি সে রুমেই উঠেছি।’
‘আমি রেলিনকুইমিনির নোট বইটার জন্য এসেছি।’
‘আমার পরিচয়টা দিচ্ছি... আমার নাম হাইনরিখ হাইনে।’
‘আচ্ছা, তার সঙ্গে আপনার কি আত্মীয়তা...?’
‘মোটেই না। আকস্মিক যোগাযোগ। এমনকি যোগাযোগটাও বেশ অস্বস্তিকর। তবে আমিও...।’
‘আপনি কবিতা লেখেন?’
‘আমি কোনোদিন কিছু লিখিনি।’
‘আমি ভালো জার্মান ভাষা জানি। আমার অবসর সময় আমি কবিতা পড়েই কাটাই। কিন্তু...।’
‘কবির জীবৎকালে অপ্রকাশিত কবিতাগুলোর সঙ্গে কি আপনার পরিচয় আছে?’
‘নিশ্চয়ই। এবার আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কে।’
‘কিছু মনে করবেন না, আপনার নামটা জানতে খুব ইচ্ছে করছে।’
‘ক্যামিলা আর্দেনজে।’
‘খুব খুশি হলাম। আচ্ছা, সিনিওর। আর্দেনজে, আপনি কি ‘ভোস’ পত্রিকায় প্রকাশিত আমার বিজ্ঞপ্তি দেখেছেন?’
‘নিশ্চয়ই। নোটবই সম্বìেধ যা লেখা হয়েছে সব পড়েছি। নোট বইটা কোথায়? ওটা আমাকে দিন।’
‘সিনিওরা! সিনিওরা। ক্যামিলা আপনি­ হয়তো আপনার সর্বান্ত:করণ দিয়ে­ অতুলনীয় রেমিনকইমিনিকে শ্রদ্ধা...।’
‘আসুন। এটা নাটকের মঞ্চ নয়।’
‘ভুল করছেন সিনিওরা। আমাদের সারা জীবনই আমরা মঞ্চে কাটাই। কেউ কেউ অনেক কষ্টে স্বাভাবিক হতে পারে। তারা জন্মের দিন থেকেই অভিনেতা হওয়ার সেই গুণ অর্জন করে থাকে।
‘সিনিওরা ক্যামিলা আপনি আপনার জন্মের শহরকে ভালোবাসেন। আপনি ফেরারা শহরকে ভালোবাসেন, কিন্তু (আমাকে বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে) আমি যত শহর দেখেছি তার মধ্যে এই শহরটি আমার কাছে মোটেই আকর্ষণীয় মনে হয়নি। আপনি খুবই সুন্দরী সিনিওরা ক্যামিলা। কিন্তু আপনি আর আপনার এই ঘৃণ্য শহর যখন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় আমার অন্তর দারুণভাবে কেঁপে ওঠে।’
‘আপনাকে বোঝা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।’
‘আমাকে বাধা দেবেন না, সিনিওরা। এই শহর, যে শহরটির কথা বলছিলাম, সে শহরটি আমাকে ঘুম পাড়িয়েছে গল্পের সেই বিষদায়ীর মতো যে নাকি ভাগ্যের ঘন্টা বাজায় সময় হলে তার প্রিয় বìধুকে বিষ প্রয়োগ করেছিল, সেই লোকটি কি না তার ভাগ্যের প্রতি অবজ্ঞার আগুন-ফুলকি ফোটাবার জন্য সরাইখানায় ঢুকেছিল। অথচ যে ভাগ্য তাকে লালন করেছে সেই ভাগ্যই শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। হে নারী, সেই বিষদায়ী এবার সেই মহিলার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শায়িত লোকটার দিকে তাকিয়ে দেখুন, ও তো তোমারই প্রেমিক। তোমার গল্প করেই ও অপেক্ষার সময়টুকু ভরে রেখেছিল। আমার কল্পনাকে সে গল্পগুলো তীক্ষî তীরের মতোই বিদ্ধ করছে। তুমি কি সেই কল্পনার ঘোড়ায় চড়ে এখানে আসনি। কেন তুমি হৃদয়হীনার মতো সেই উর্ণনাভ চাবুক দিয়ে আমাকে মারছো। সেই চাবুক যে ঘামে ফেনিল হয়ে গেছে।
‘ও: সেই গল্পগুলোর কথা আর কি বলব। আমাকে দয়া করে তোমার দিকে তাকাতে দাও। হে নারী, তোমার সম্বìেধ লেখা গল্পগুলোই তার কাছে ঘুমপাড়ানি গান হয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। তোমার বিরহ-ব্যথাই তাকে নিদ্রাতুর করে তুলেছে। তবে আমরা তাকে জাগাতে পারি। কিন্তু তার দরকার নেই। না, তাকে জাগিয়ে শঙ্কিত করে লাভ নেই। তাকে সুখে ঘুমাতে দাও। ঘুমের মাঝে হয়তো আমাকে স্বপ্নও দেখতে পারে। আমাকে বরং এক গ্লাস পানীয় এনে দাও। রাস্তায় খুব শীত। আমিও অবশ। দয়া করে আমার হাতগুলো ঘষে দাও।’
‘আপনি এক অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ, হের হাইনে। কিন্তু থামবেন না। আপনার কথাগুলো শুনে আমি খুব আনন্দ বোধ করছি।’
‘কিছু মনে করবেন না, আমি বোধহয় রেলিনকুইমিনির নোট বইয়ের কথা ভুলে গেছি। আমি ঘর থেকে এখুনি এনে...।’
‘অতো ব্যস্ত হবেন না। ওটার কথা আমি ভুলব না। বরং আপনার কথা বলুন। কী মজার লোক আপনি! আপনি বলছিলেন, ‘আমার হাতগুলো ঘষে দাও, তাই না?
‘হ্যাঁ সিনিওরা। আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য ধন্যবাদ।’
‘তারপর?’
‘বেশ বলছি শুনুন, এই শহর বিষদায়ীর প্রাণের বìধুর বিষ দেয়ার মতোই আমার সঙ্গে ব্যবহার করছে। আর আপনি, সুন্দরী ক্যামিলা, এই শহরের পক্ষে কথা বলছেন। এই শহর হয়তো আমার স্বপ্নের চিন্তাগুলোর কথা শুনে ফেলেছিল। কিন্তু আপনি নিশ্চয় আমার নিদ্রাভঙ্গ কামনা করেননি।’
‘আমি আবার এই গল্পের ভেতর এলাম কেমন করে? হোটেলের বেয়ারা গিয়ে আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিল আশা করি।’
‘আহ্, আপনি তাহলে মনে করেন রাত আসছে, ঝড় আসতে পারে। সময় পার হয়ে যাচ্ছে, আর দেরি করা যায় না, ওকে ঘুম থেকে জাগিও না।’
‘হুঁ, সিনিওরা হাইনে, আপনি মোহাচ্ছন্ন হয়ে আছেন। আমি বলি, ঠিক, ঠিক, ফেরারা, সে যদি এখনো ঘুমিয়ে থাকে তো তার চুল এলোমেলো করে দাও। আমার হাতে সময় নেই, ওকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দাও, যত লোক আছে সবাইকে জড়ো করো, যতক্ষণ তার ঘুম না ভাঙে চিৎকার করতে থাক, সময় বড় কম।’

‘আহ্, কিন্তু নোটবইটা...।’
‘ও ব্যাপারে পরে কথা বলব।’
‘হে সিনিওরা, ফেরারার হিসেবে গোলমাল হয়ে গেছে। ফেরারাকে ঠকানো হয়েছে, বিষদায়ী পালিয়ে গেছে, আমাকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে, আমি জেগে আছি­ হে আমার প্রিয়া, আমি তোমার সামনে নতজানু হচ্ছি।’
ক্যামিলা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
‘ঢের হয়েছে! যথেষ্ট হয়েছে! এ সবকিছু আপনাকে মানায়­ এমনকি এসব গতানুগতিক­ হ্যাঁ ঠিক, এ সবকিছুই গতানুগতিক। কিন্তু এরকম চলতে পারে না। আপনি বিদূষকের মতো আচরণ করছেন! আমরা তো একজন আরেকজনকে বলতে গেলে চিনিই না। মাত্র আধঘন্টা আগে­ এ নিয়ে তর্ক করাও হাস্যকর। অথচ, দেখুন না আমি আপনার সঙ্গে কেমন তর্ক করছি। আমার জীবনে এমন নির্বোধের মতো কাজ করিনি।
‘বলুন, বলুন, আমি আপনার কথা শুনছি, সিনিওরা।’
‘সিনিওরা, আমি হয়তো আরো আগ্রহ নিয়ে আপনার কথা শুনতাম। সত্যি, আপনার খুব বুদ্ধি আছে। আপনার কথায় শ্লেষও আছে। তা সত্ত্বেও গতানুগতিকতার প্রতি আপনার অবজ্ঞা নেই। সেটা অদ্ভুত ঠেকলেও অস্বাভাবিক নয়। আপনার নাটকীয় তারুণ্যও অদ্ভুত!’
‘মাফ করবেন, সিনিওরা, তারুণ্য গ্রিকদের কাছে আবেগ। কিন্তু ইতালীয়র কাছে সেটা ফাঁকা চুম্বন। আর চুম্বন তো বাধ্যতামূলক­।’
‘আবার! আর কষ্ট করবেন না। অসহ্য। আপনি আমার কাছ থেকে কিছু গোপন করছেন নিশ্চয়, ঠিক কি না পরিষ্কার করে বলুন : আর শুনুন, আমার ওপর রাগ করবেন না প্রিয় সিনিওর হাইনে। আপনি কেমন যেন ছোট্ট মানুষ­ না, ঠিক বলা হলো না­ আপনি একজন কবি। আমি আগে বুঝতে পারিনি কেন? অথচ আপনাকে দেখলেই তো বোঝা যায়। বিধাতা যাকে অলস করে তৈরি করেছেন, ভাগ্য তাকে নষ্ট করে দিয়েছে।’
‘চমৎকার!’ হাইনে জানালার চৌকাঠে লাফিয়ে বাইরের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালেন।
‘সাবধান, সিনিওর হাইনে! ক্যামিলা বললেন, ‘সাবধান, আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন।’
‘চিন্তা করবেন না, সিনিওরা।’
‘আমি বুঝতে পেরেছি।’ ক্যামিলা হাইনের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘না, না, আমি এখন আর সেই তরুণী নই। সবারই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন। কী আকর্ষণীয় মানুষ!’
‘সিনিওরা!’ ক্যামিলার পায়ের কাছে বসে পড়ে হাইনে বললেন, ‘সিনিওরা!’ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বললেন, ‘আপনি কি রেখাটা টেনেছেন?
‘কী ভয়ঙ্কর!’ মুখের ওপর থেকে হাত নামিয়ে ফিসফিস করে হাইনে বললেন। তার মুখটা হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে... বিব্রত সিনিওরিরার আর্দেনজের চোখের দিকে তাকিয়ে অবর্ণনীয় বিস্ময় লক্ষ্য করে তার মনে হলো যে...

ভোরবেলা গির্জার ঘন্টা তখনো বাজেনি। হোটেলের একটিমাত্র রুমে আলো জ্বলছে। টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে পোর্টারের ঘুম ভেঙে গেল। টেলিফোনের রিসিভার কানে তুলে আগন্তুকের প্রশ্নের উত্তরে বলল,
‘হ্যাঁ, সিনিওর আজ সকালে চলে যাবেন। আধ ঘন্টার মধ্যে আপনাকে টেলিফোন করতে বলব। আপনার নামটা বলুন আর টেলিফোন নম্বরটা দিন।’
আট নম্বর থেকে বের হয়ে হাইনে বারান্দা পার হয়ে টেলিফোন করার জন্য পোর্টারের ওখানে গেলেন। পোর্টারের সঙ্গে কথা বলার পর তাকে বেশ উত্তেজিত মনে হলো। ‘ভোস’ পত্রিকার সম্পাদককে টেলিফোন করলেন।
‘হ্যাঁ, আমি একদিন বেশি থেকে গেছি। পোর্টার ঠিক কথাই বলেছে, আমি বাড়ির ঠিকানা তাদের দিইনি এবং দেয়ার ইচ্ছেও নেই। আপনাকে দিতে বলেছেন? মোটেই না। আমি খবরের কাগজেও ঠিকানা ছাপাতে চাইনি। আর যদি মনে করে থাকেন, আজকে ছাপাব, তা-ও নয়। কারণ আর ছাপাবার দরকার নেই। না, না। রাগ করবেন না, সম্পাদক সাহেব। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন।’
‘রেলিনকুইমিনি আপনার সঙ্গে মধ্যস্খতা করবেন না।’
‘কারণ তার আর মধ্যস্খতা করার দরকার নেই। আপনি একটু শান্ত হোন, আমার কথা শুনুন। রেলিনকুইমিনি কোনোদিন কোনো নোটবই হারাননি। আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমাকে আজকেই চলে যেতে হচ্ছে। স্টেশনে আসুন, এক সঙ্গে কিছু সময় কাটানো যাবে। সাড়ে ন’টায় আসুন। কিংবা যেকোনো সময়ে। না, থাক, বরং না আসাই ভালো। না হয় হোটেলে আসুন। দিনের বেলা। সেটাই ভালো হবে।’
‘সìধ্যাবেলা আমার ফ্ল্যাটে আসুন। আসার সময় একগুচ্ছ ফুল নিয়ে আসবেন।’
‘চমৎকার বলেছেন সম্পাদক সাহেব, একগুচ্ছ ফুল, সìধ্যাবেলা। আপনি দেখছি বেশ ভালো ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। আমিও এ কথাই ভাবছিলাম।’
‘কিংবা আগামীকালও আসতে পারেন। শহরের বাইরে ডুয়েলিং স্কোয়ারে।’
‘জানি না। দেখি।’
‘আপনার ব্যস্ততা বেশি থাকলে আগামী পরশু কোমপোস্যান্টোতে আসুন।
‘তাই?’
‘হ্যাঁ, তাই।’
‘অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলেই না আজকের দিনটা শুরু হলো। দেখুন,্ আমি ক্লান্ত। ঘরে যেতে চাই।’
‘কী বলছেন? আমি শুনতে পাচ্ছি না। আট নম্বর?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আট নম্বর। চমৎকার রুম, সিনিওর এডিটর। পরিবেশটা খুবই ঘরোয়া। গত পাঁচ ঘন্টা ধরে ওখানে অনন্ত বসন্ত বিরাজ করছে। গুড বাই, সিনিওর এডিটর।’
হাইনে যন্ত্রচালিতের মতো টেলিফোন নামিয়ে রেখে বাতির সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিলেন।
‘আলো নিভিও না এনরিকো।’ অìধকার বারান্দা থেকে নারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
‘ক্যামিলা।’ হ
লেখক পরিচিতি : বোরিস পাস্তেরনাকের পুরো নাম বোরিস লিওনিদোভিচ পাস্তেরনাক। ১৮৯০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মস্কোতে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব সঙ্গীতপ্রিয় ছিলেন। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরে তিনি জার্মানির মারবুর্গ শহরে দর্শনশাস্ত্রে অধ্যয়ন শেষ করে মস্কোতে ফিরে এসে সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯২২ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত তিনি বহু কবিতা লেখেন। সঙ্গীত, দর্শন, সমাজতত্ত্ব ও সাহিত্যের এক অসাধারণ প্রতিভাধর লেখক, বোরিস পাস্তেরনাক বিংশ শতাব্দীর এক বিরল প্রতিভা। তিনি গ্যেটে, ক্লাইস্ত, হেরভেগ, বেন জনসন, সুইনবার্গ ও শেলীর কবিতা এবং শেকস পিয়ারের বহু গ্রন্থ রুশ ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৬০ সালে ক্যান্সার রোগে তার মৃত্যু হয়। ‘ইল ত্রাতো দ্য অ্যাপেলে’ গল্পের অনুবাদ ‘বিমূর্ত প্রেম’।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন