বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৯

যে-কবিতা এক পাঠে ফুরিয়ে যায় না : সিকদার আমিনুল হকের কবিতা

যে-কবিতা এক পাঠে ফুরিয়ে যায় না
আ সা দ মা ন্না ন

জীবনানন্দ দাশকে পাঠকের রক্তে-মাংসে-মেধায় প্রবেশ করতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল মৃত্যু পর্যন্ত। এ কথার মর্ম কী? মর্ম হল : কবির মৃত্যুর পর কবিতার প্রকৃতজীবন শুরু হয়। প্রজন্তরে নতুন পাঠকের চিত্তে কবিতার পুনর্জন্ম হয় বার বার। যদি তা প্রকৃত কবিতা হয়। প্রশ্ন আসে : একটি কবিতা কী করে প্রকৃত কবিতা হয়ে ওঠে? একটি কবিতার মধ্যে কী সৌন্দর্য বা রস সঞ্চিত থাকলে তা যুগ-যুগান্তরের পাঠকচিত্তে সঞ্চারিত হয়? কী করেই বা একটি কবিতা কালের শ্রেষ্ঠ কবিতা হয়ে ওঠে? প্রকৃত কবিতাকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে হয়তো আলঙ্কারিকের সহায়তা নেওয়া যাবে; কিন্তু একজন কবির শ্রেষ্ঠ কবিতাকে বাছাই করার যন্ত্র বা মন্ত্র কী? একজন কবি কী করে তার নিজভাষার শ্রেষ্ঠ কবি হয়ে ওঠেন, যদি একে শুধু কথার কথা বলে মেনে না-নেওয়া হয়? কবিতার গুণবিচারের স্থির কোনও মানদণ্ড আছে কি? নেই। আমরাও মনে করি, যেমন জীবিতকালে মনে করতেন বহুমাত্রিক প্রতিবাধর অন্তরঙ্গ প্রিয় কবি হুমায়ুন আজাদ মেপে, হিশেব করে, ওজন করে কোনও কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণয় করা যায় না; তবে বার বার পড়ে ও বিবেচনা করে, কবিতার বিষয়, বাণী, প্রকাশ ও আরও বহু বিষয় অনুভব, উপলব্ধি ও বিচার করে কোনও কবির উৎকৃষ্ট কবিতাগুলো শনাক্ত করা যায়।
হ্যাঁ, চিরকালই দ্বিমত থাকতে পারে কিছু কবিতা নিয়ে; কবির ব্যক্তিগত আবেগের কারণে নিজের কোনও কোনও কবিতা তার কাছে উৎকৃষ্ট বলে মনে হতে পারে; কিন্তু তা উৎকৃষ্ট কবিতা দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রজ্ঞা ও মেধাসম্পন্ন পাঠক বা সমালোচকের কাছে ততটা উৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত না-ও হতে পারে। একটি কবিতার উৎকর্ষ নিয়ে সমালোচক বা পাঠকভেদে মতভেদ থাকতে পারে, একটি উৎকৃষ্টমানের কবিতার ক্ষেত্রে যা থাকাটাই স্বাভাবিক; একটি ভালো বা উৎকৃষ্টমানের কবিতা এক পাঠে ফুরিয়ে যায় না। একজন পাঠকের পাঠাভিজ্ঞতার বিবেচনায় যে-কবিতা এক পাঠে ফুরিয়ে যায় না, তাকেই ঐ কবির শ্রেষ্ঠ বা উৎকৃষ্ট কবিতা হিশেবে গণ্য করা যায়, যে-কবিতায় বিষয়, বাণী ও ভাষার চূড়ান্ত সমন্বয় ঘটে এবং যা পাঠকের আবেগ, উপলব্ধি বা চেতনাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। এ কবিতা শুধু ওই কবির রচনাবলির মধ্যেই উৎকৃষ্ট নয়, ওই ভাষার উৎকৃষ্ট কবিতার সারিতে বসারও উপযুক্ত। বাঙালি পাঠক অবশ্যই মনে করেন যে, কোনও কবির শ্রেষ্ঠ বা উৎকৃষ্ট কবিতা শুধু তার ভালো বা মানসম্পন্ন কবিতা হলে চলবে না, ওই কবিতাকে বাঙলা ভাষার আবহমানকালের সমস্ত ভালো বা উৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠমানের কবিতার সমতুল্য হতে হবে; সমতুল্য না হলেও অন্তত কাছাকাছি গুণসম্পন্ন হতে হবে।

২.
কবি সিকদার আমিনুলের হকের মতো বাঙলা ভাষার একজন শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ কবির কবিতা পড়তে-পড়তে ভূমিকায় উচ্চারিত কথাগুলো অনিবার্যভাবে আমাকে ভাবায়। সিকদার আমিনুল হক-এরই শুধু নয়, যে কারও কবিতা পাঠ করার সময় প্রকৃত কবি ও কবিতার কথা প্রত্যেক পাঠককে বিবেচনায় রাখতে হবে। ‘কবরের গল্প’ কবিতায় সিকদার আমিনুল হক তার প্রিয় দু’জন কবি পাস্তারনাক ও কিট্স-এর কবরের চিত্র আঁকতে গিয়ে অবচেতনে নিজের কবরের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে : পাতাগুলো ঝরে পড়লো;মার্বেলের চৌকো কবরের ওপর। কবরখানার ডানদিকে তিনতলা বাড়িতে এখন ম ম করছে অর্গ্যান। একটা মেয়ে তার প্রেমিককে চুম্বনের অধিকার দিচ্ছে। ঝাউগাছ থেকে শব্দ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে কবরের ভেতরে অনন্ত নির্জনতার মতো চৌবাচ্চার মধ্যে।

ব্যক্তি সিকদার আমিনুল হক প্রয়াত হন ১৭মে ২০০৩। সাত বছর পার হয়ে গেছে। নতুন প্রজšে§র কবিদের প্রিয় কবির তালিকায় উঠে এসেছেন তিনি। সিকদার মনে করতেন যে, তার কবিতা তরুণদের কাছে এক মনস্থির করা সার্থকতা; সে-তরুণ, যে তার অহঙ্কার ও খুব উষ্ণ এক বিছানার জন্য বিবেকের দংশন ছাড়াই এক দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য লালায়িত। জানি, মানুষ যদিও মরে; কবির মৃত্যু নেই; কাজেই মানুষ হিসেবে গতায়ু হলেও কবি হিশেবে সিকদার আমিনুল হক সতত জীবিত: উত্তর প্রজšে§র কবি ও মননমনস্ক পাঠকের কাছে ক্রমশ তিনি নন্দিত হয়ে উঠছেন: তার পরিণত পর্বের কবিতার রূপ ও আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে যায় সময়কে উপলদ্ধি করতে পারার ক্ষমতাসম্পন্ন তরুণ কবি ও মেধাবী পাঠকের মন।
সিকদারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ দূরের কার্নিশ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, কবির জীবিতকালে ২০০৩ সালে। একুশের বইমেলায় সর্বশেষ কবিতার বই আমরা যারা পাহাড়ে উঠেছি বের হয়। মৃত্যুর পর ফারুক মাহমুদের সম্পাদনায় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে অন্যপ্রকাশ থেকে বের হয়েছে ১টি কবিতার বই। এটি নিয়ে কবির মোট কাব্যগ্রন্থ ১৯টি। ২টি প্রবন্ধের বই মৃত্যু চিন্তা : এবার হলো না গান’ ও শব্দ থেকে ভাবনায়। প্রথম প্রবন্ধের বই কবি আবিদ আজাদ-এর ‘শিল্পতরু’ এবং অন্যপ্রবন্ধের বই লতা হোসেন-এর ‘সানন্দপ্রকাশ’ থেকে বের হয়েছিল।
বিশ শতক বাঙলা, বাঙালি ও বাঙলা কবিতার মুক্তির শতক। এ শতক অবিভক্ত ভারতের মানুষের কাছে, বিশেষ করে বাঙালির কাছে সংগ্রাম, আন্দোলন, স্বাধীনতা ও মুক্তির শতক হিশেবে রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; অনুরূপ সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিশ শতক। এ শতকে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যে যে-কালজয়ী বিকাশ ও সম্ভাবনা তৈরি হয়, সেই বিকাশ ও সম্ভাবনার হাত ধরে রবীন্দ পরবতী কবিদের অনুসারী তার সমসাময়িক কবিদের বহুলচর্চিত ভাষা ও প্রকরণ ছেড়ে সিকদার আমিনুল হক ধীরে-ধীরে সম্পূর্ণ নিজস্ব স্বর ও ভাষা আবিষ্কার করেন। শুধু পরিণত পর্বে নয়, প্রথম কাব্যগ্রন্থ দূরের কার্নিশ এর ‘জলের দাগ’, ‘উৎসব’, ‘এই হাত দস্তানার মধ্যে’ ইত্যাদি কবিতার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছিল তার পরবর্তী কালের সেরা কবিতার অসংখ্য বীজ। সিকদার আমিনুল হকের প্রথমদিকের কোনও-কোনও কবিতায় তার প্রিয় তিরিশের কবি বিষ্ণু দে এবং পঞ্চাশের শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ কোনও-কোনও পূর্বসাধকের ছায়াপাত লক্ষ করা যায়। এটা দোষের কিছু নয়। প্রায় সব কবির ক্ষেত্রেই এটা ঘটে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য কবি অগ্রজ বা জমজদের প্রভাববলয় থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছেন কিনা। প্রকৃত শক্তিমান কবির বেলায় এ প্রভাব খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় না, যেমন স্থায়ী হয়নি সিকদার আমিনুল হকের বেলায়ও। আধুনিক মনন, বিশ্বজনীনতা, ছন্দকুশলতা, অপূর্ব চিত্রকল্পের অসাধারণ উপস্থাপনশৈলী, অজস্র শব্দের প্রতীকি বিস্তার এবং চিত্তহারী সব উপমা-উৎপ্রেক্ষার সমন্বয়ে তিনি কবিতায় যে-জগৎ নির্মাণ করেছেন, সে-জগতে সাধারণ পাঠকের সহজ প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু পাঠক একবার যদি তার শব্দের মায়াপুরীতে ঢুকতে পারেন, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, সেখান থেকে কবিতাসুন্দরীকে একা রেখে বেরিয়ে আসা কঠিন।
সিকদার আমিনুল হকের ১৯টি কাব্যগ্রন্থের প্রায় সব কটিতে রয়েছে অনেক উৎকৃষ্টমানের কবিতা। এসব কবিতা থেকে স্মরণযোগ্য বহু পঙ্ক্তি উদ্ধার করা যায়। পরিসরের বিষয়টি মাথায় রেখে আপাতত এ লোভ সংবরণ করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। বর্তমান আলোচনাকে আমি সিকদারের বহুলআলোচিত ও পাঠকনন্দিতগ্রন্থ সতত ডানার মানুষ ও বাতাসের সঙ্গে আলাপ-এর পাঠাভিজ্ঞতার মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চাই।
কবিতারসিক পাঠক ও সমালোচকদের মতে সিকদার আমিনুল হকের সতত ডানার মানুষ কোনও সাধারণ মানের কাব্যগ্রন্থ নয়। গ্রন্থটি তিনটি পর্বে বিভক্ত (১. শৈশব নিজের জন্যে কিনেছিলো প্রেমের দস্তানা; ২. মৃত্যু অন্য এক শীতল শৈশব; এবং ৩. প্রতিভা এক বিশাল বৃত্ত)। এ গ্রন্থের কবিতাগুলো বিশ্বমানের। ১৯৯১ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে এটি প্রথম প্রকাশ করেন সৌখিন প্রকাশনা সংস্থা ‘মূলধারা’র পক্ষে সাবের হোসেন চৌধুরী ( সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান সাংসদ)। প্রকাশের পর ১৯৯১ সালে উত্তর প্রজন্মের এক কবি গ্রন্থটি সংগ্রহ ও পাঠ সম্পর্কে তার যে-অভিজ্ঞতা ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তা এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য : “একটি কাব্যগ্রন্থ পড়ে অকস্মাৎ জেগে উঠেছি। ওপার বাংলার কেউ-কেউ মাঝেমধ্যে নিদ্রাভঙ্গের উপক্রম ঘটিয়েছিল। তা ঐ পর্যন্তই। এই জেগে ওঠার ব্যাপারটিও বড়ো অদ্ভুতভাবে ঘটেছে। গ্রন্থটির বাঁধাইকর্ম চলার সময় ঘটনাচক্রে আমি সেই মুদ্রণালয়ে উপস্থিত হই। নিছক কৌতূহলবশে দু-একটি কবিতার ওপর চোখ বোলাতে গিয়ে ধরা পড়ে যাই কবিতার কোমল অথচ প্রবলভাবে সংক্রামক বাহুবন্ধনে। পরদিনই ছুটে যাই বাংলা একাডেমিতে। কিন্তু গ্রন্থটির সাক্ষাৎ মেলে না। পরদিন আবারও। তার পরদিন আমি যখন মেলাচত্বরে উপস্থিত হই তখন ‘গীতশেষে বীণা’র মতো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বাংলা একাডেমির শূন্য মাঠ। এরপর বইপাড়ায় ছুটোছুটি শুরু করি। মুখোমুখি হই আরেক অভিজ্ঞতার। অনেকে আমার প্রার্থীত কবির নামও শোনেননি। কেউ-কেউ দার্শনিক নির্লিপ্ততার সাথে জানালেন যে, তার পারতপক্ষে কবিতার বই রাখেন না কিংবা বিক্রি করেন না। দু-একজন অবশ্য বললেন যে, তারা কবিতার বই রাখেন, তবে সকলের নয়। ভালো কবিদের। কারা ভালো কবি? আমার হতভম্ব চোখের সামনে যে নমুনাসমূহ তারা হাজির করলেন তাতে আমার ঐ মুহূর্তের মুর্খতা ও অজ্ঞতার তুলনায় পৃথিবীটাকে বড় ছোট মনে হল। না, শামসুর রাহমান নয়, এমনকী নির্মলেন্দু গূণও নয়, আমি শুধু দেখলাম চার রঙে মুদ্রিত একজন তরুণীর চতুষ্কোণ একটি ছবি আমার অজ্ঞতাকে পরিহাস করছে। অতঃপর প্রেসকপি সীলাঙ্কিত একমাত্র কপিটিই আমি আÍসাৎ করি মুদ্রকের কাছ থেকে। এবং পরদিন যথাসময়ে অফিসে হাজিরা দেওয়ার আতঙ্ক ও আনন্দের সঙ্গে ঐ রাতেই বইটি প্রথম দফা পড়ে শেষ করি। এবং যুগপৎ আনন্দ ও বেদনার সঙ্গে আবিষ্কার করি এই সময়ের একজন প্রকৃত কবিকে। আনন্দ অনাঘ্রাতা কবিতার এবং পৌরুষদীপ্ত একজন কবির সঙ্গে সাক্ষাতের আর বেদনা তার ইতঃপূর্বে প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের সঙ্গে পরিচয়হীনতার।”
ওপরের কথাগুলো মিনার মনুসরের। প্রায় তিরিশ বছর ধরে আমি মিনারকে অন্তরঙ্গভাবে জানি। তার কাব্যবোধ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা খুব উঁচুমানের, পঠনপাঠনের পরিধিও কম নয়। কাজেই একজন প্রকৃত কবির সন্ধান পেয়ে মিনার মনসুর যে প্রবলভাবে আলোড়িত হবেনন, তাতে বিস্মিত হইনি, বরং পুলকিত বোধ করি। পুলকিত বোধ করছি এ জন্যে যে, মিনারই প্রথম এ কাব্যের রূপ ও সৌন্দর্য আবিষ্কারের মতো একটি দুঃসাহসিক কাজ করেছিলেন, যার শুরুটা এরকম: “মোট কবিতার সংখ্যা কতো-তা গুণে দেখার ইচ্ছে বা প্রয়োজন কোনোটাই অনুভূত হয়নি। কারণ পুরো গ্রন্থটিকে গদ্যছন্দে লেখা, একই স্বরের, একই বিষয়ের একটিই কবিতা মনে হয়েছে। এমনকী প্রথম থেকে শেষাবধি প্রতিটি পঙ্ক্তির ধ্বনিস্পন্দন পর্যন্ত অভিন্ন। পড়তে-পড়তে বিঠোফেনের সিম্ফনির কথা মনে আসে কিংবা কোনো পাকা হাতের বাঁধা সেতারের ঝঙ্কার শোনা যায়। যেন একটি নির্দিষ্ট অথচ বিপজ্জনক কার্নিশ ছুঁয়ে তা অবলীলায় ওঠানামা করছে। প্রতিক্ষণেই আশঙ্কা জাগে, এই বুঝি সব শেষ হয়ে গেল। এবং ঠিক তখনি কবি পরিপূর্ণ আতœবিশ্বাসের সঙ্গে জানিয়ে দেন যে পুরো বিষয়টিই তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। তিনি কেবল খেলা করছিলেন পাঠকের সঙ্গে। না, ঠিক পাঠকের সঙ্গেও নয়; ওদের সঙ্গে তার দেনদরবার তেমন একটা আছে বলে মনে হয় না; যদিও তাদের অস্তিত্ব স¤পর্কে পুরোপুরি বিস্মৃত তিনি কখনোই নন। আসলে তিনি খেলা করেন তার নিজের সঙ্গে।” আমার বিশ্বাস, মিনারের পাঠপ্র্রতিক্রয়া নতুন পাঠককেও সিকদার আমিনুল হকের এই অসামান্য কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করতে প্রেরণা জোগাবে।
সকলেই কবি নয়,কেউ কেউ কবি Ñ এ উক্তি এখন আর জীবনানন্দ দাশের একার উক্তি নয়, কবিতার ভুবনে চিরকালীন এক ঐশীবাণী। সিকদার আমিনুল হক ষাটের দশকে আবির্ভূত কবি। যদিও কালের বিবেচনায় তিনি আর দশকের জালে বন্দি নেই। তার সতত ডানার মানুষ আর বাতাসের সঙ্গে আলাপ যারা পড়েছেন বা পড়বেন এবং তারা যদি উৎকৃষ্টমানের কবিতার প্রকৃত পাঠক হয়ে থাকেন, অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করতেই হবে যে, সিকদার আমিনুল হক বাঙলা ভাষার একজন চিরকালীন উৎকৃষ্টমানের ধ্র“পদী কবি, মর্মে মর্মে যিনি আবার চির রোমান্টিকও।
জীবিতকালে এ কবির কবিতাকে সমকালের বন্ধু কবিরা আড়ালে-আড়ালে উপহাস করেছেন, যেমন করা হয়েছিল জীবনানন্দ দাশকে। এ নিয়ে কবির নীরব আক্ষেপ ছিল, কিন্তু কারও প্রতি অভিযোগ ছিল না, যেমনটি ছিল না জীবনানন্দের। স্বভাবেও এ দুই মহৎ কবির মধ্যে কিছুটা মিল লক্ষ করা যায়। উভয়েই ছিলেন লাজুক ও ঘরকুনো প্রকৃতির । ফলে প্রকাশভঙ্গি ও বিষয়ের ভিন্নতা সত্ত্বেও এক ধরনের নির্জন অসুখ বিষণœতার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে উভয়ের কবিতায়। এ অসুখ রসের ভাণ্ডার, যা ফুরিয়ে যাবার নয়। এই রস পান করে পাঠক সহজে সংক্রামিত হয়ে থাকেন। এ রসের এমন গুণ, যিনি যতবেশি পান করবেন, তত বেশি অমরত্বে আক্রান্ত হবেন।
নিজের পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যে, সিকদার আমিনুল হকের কবিতা এক পাঠে ফুরিয়ে যায় না। বার বার পড়তে হয়। প্রতিটি পাঠেই তার কবিতায় আলাদা রস আবিস্কৃত হয়। সকল ইন্দি য়কে জাগ্রত না-করে তার কবিতার মর্মে পৌঁছুনো সম্ভব নয়। সকল ইন্দি য় জাগিয়ে কবিতা পড়ার মতো কজন পাঠক আছেন? খুব বেশি নয়। কাজেই বলা যায়, সিকদার আমিনুল হক আমপাঠকের কবি নন। তার কবিতার রসাস্বাদন করতে হলে পাঠকেরও কিছু প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া তার কবিতার মর্মে যাওয়া নৈব নৈবচ। এ বিবেচনা থেকেই অনেকেই তাকে কবিদের কবি বলে থাকেন। স্বীকার করি, তিনি কবিদের কবি; তবে তিনি কবিতা লিখেছেন পাঠকের জন্যে,যে পাঠক মুলত কবি। ‘প্রত্যেক পাঠকই এক হিসেবে কবি’ ডিউই-র এই নির্দেশ জীবনানন্দের মতো তিনিও গ্রহণ করেছিলেন। জীবনানন্দের মতো তাকেও ‘নির্জনতম কবি’ অভিধায় ভূষিত করা যায়Ñ উভয়ে শান্ত, øিগ্ধ, নির্জনতম, সৃষ্টিশীল অসুখে আক্রান্ত কবি। আবার এও ঠিক জীবনানন্দের নির্জনতা আর সিকদারের নির্জনতা এক নয়। একটি নিসর্গের নীল নির্জনতা, অন্যটি নগরের খাঁ খাঁ নির্জনতা। নিসর্গের নির্জনতার একটা গন্ধ আছে, যা নেই নগরের নির্জনতায়। নিসর্গেয় নির্জনতার মধ্যে একটি প্রলম্বিত প্রশান্তির আবহ তৈরি হয়, যা পাঠককে আচ্ছন্ন করে। অন্যদিকে নগরের নির্জনতায় এক ধরনের আতঙ্ক আছে, যা পাঠকের প্রতিটি ইন্দি য়কে আক্রান্ত করে। এ-আক্রান্তির মধ্যে সুখ আছে, রস আছে, যা পাঠকচিত্তকে প্রবলভাবে আলোড়িতও করে। ভাষা ও ভঙ্গিতে উভয়ের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ থাকলেও সিকদার আমিনুল হক তার কবিসত্তার গভীর প্রদেশে জীবনানন্দের নির্জনতম অস্তিত্বকে আমৃত্যু লালন করেছেন। এ সম্পর্কে সিকদারের ‘জীবনানন্দের সঙ্গে’ কবিতার শেষ কয়েকটি চরণ স্মর্তব্য:-
‘কবিতা লিখতে হয়,লিখি! কষ্ট? Ñ তাও আছে! দেহে
কত তছনছ আর রক্তচাপ, জিভে বাসি অ¤
সারা রাত্রি জেগেÑ
তথাপি
আমার কবিতাগুলি আপনার নিদ্রিত সন্তান।’

কেউ কেউ তাকে বলে থাকেন বাঙলা ভাষার ইউরোপীয় কবি। যারা তাকে এ অভিধায় চিহ্নিত করেছেন তারা কি বাড়িযে বলেছেন? না, বাড়িয়ে বলেননি। তিনি পাশ্চাত্যের, বিশেষ করে, ফরাসি প্রতীকবাদী (ঝুসনড়ষরংস) কবিদের মতো কবিতার অবয়ব থেকে সাহিত্য-অতিরিক্ত বিষয়সমূহ বর্জন করার পক্ষপাতী। মূলত এ বিশ্বাস থেকেই তিনি সমসাময়িক কবিবন্ধুদের প্রচলিত পথে পা রাখেননি। তার কালখণ্ডের সম্পূর্ণ এক নতুন ঘরানার স্রষ্টা এই কবি; সস্তা হাততালি বা জনপ্রিয়তার জন্য কখনও কবিতাকে উচ্চ গ্রামে নিয়ে যাননি। প্রথম কাব্য দূরের কার্নিশ বের হলে তার কবিতার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে বিষ্ণু দে ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। সতত ডানার মানুষ পড়ার পর শিবনারায়ণ রায় বাঙলা কবিতায় এক নতুন বাঁকের স্রষ্টা বলে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সমকালের একজন শ্রেষ্ঠ শুদ্ধতম কবি হিশেবে তিনি একান্ত নিজস্ব নারীয় মতো কবিতাকে অন্তরঙ্গে লালন করেছেন; যেমন-
আমার আছে কবিতার নীল-বাক্স । তারা অপরিচিত, কিন্তু আছে খ্যাতির শীর্ষে। আমার তালিকাগুলি দ্যাখো। রাত্রি।নারী। ঘোড়া। চিত্রকলা আর সবুজ মাছ। কথা দিচ্ছি,আমাকে বিশ্বাস করো,এইসব একদিন তোমাদের গৌরব এনে দেবে।
(আমার আছে কবিতার নীল-বাক্স/বাতাসের সঙ্গে আলাপ)

বলার অপেক্ষা রাখে না; কবি তার প্রতিশ্র“তি রক্ষা করেছেনÑ প্রতিনিয়ত তার কবিতা আমাদের, আমাদের ভাষাকে গৌরব এনে দিচ্ছে; বাঙলা ভাষার শক্তি ও সম্ভাবনাকে সম্প্রসারিত করেছেন। জীবনানন্দের কবিতার মতো সিকদার আমিনুল হকের কবিতাও চিত্রময়। অজস্র চিত্রের সমাবেশ লক্ষ করা যায় তার কবিতায়। আছে অপূর্ব সব চিত্রকল্প । চমৎকার কিছু চিত্রকল্পের নমুনা এরকম:
ক. সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমি ছিলাম ঘাসের মধ্যে।ঃআমার শরীর থেকে ঘাম নয়,ঘাসের গন্ধ বুনো ভালুকের মতো বেরুচ্ছে। আমি টেনে বের করবো সেইশাদা পরীর মতো মেয়েটিকে। তার ছলনার কোরাস থেকে। ( উৎসবের অভিজ্ঞতা / বাতাসের সঙ্গে আলাপ)।
খ. পশ্চিমের লোকেরা ভয়ানক বরফ খায়। সরবত হয় কত কিছুর। পেস্তা থাকে,বাদাম থাকে।তোমার শরীরের গন্ধ কোন কোনদিন এরকম পেস্তা হয়,বাদাম হয়। ( কবিতা প্রসঙ্গ/ বাসআ)।
গ. মধ্যরাতের স্বপ্নে উড়ে এলো সবুজ কমোডের ওপর বসা ধবল নগ্নিকার এক স্বচ্ছ গোপনীয়তা! যে রাস্তা দিয়ে আমি যাবো, তার পথে পথে নিভৃত সরাইখানায় গচ্ছিত থাকবে আমার সব স্বপ্ন। বৃদ্ধ বয়সের জন্যে যা একপাত্র পানীয়ের মতো ঠাণ্ডা ও আরামদায়ক! (চিত্রশালা থেকে ফিরে / (বাসআ)।
ঘ. মেয়েরা যখন তাদের বাসি পোশাকগুলি শরীর থেকে একে একে খুলে ফেলে দ্যায়,হ্যাঁ,তখুনি ভোর। ( সতত ডানার মানুষ)।
ঙ. কিন্তু কবির কল্পনা,যা কামনার মতো ঘর্মাক্ত;রূপসী মেয়েরা সেলাই করবে সেই জামা সারাদিন। তাদের ঘুম বনেদী বাড়ির বেড়ালের মতো চিত্রিত ও মূল্যবানÑ সময় লাগে না, ঘুমের বড়ি আর পায়চারি ছাড়াই ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্তর্বাস খোলার পর পরই। (সডামা)
চ. আমি যদি কবিতা না লিখতাম ,তবে আমাকে হ’তে হতো সমকামী। শুয়োর-নারীর নিতান্ত রাত্রির পাহারাদার অথবা খুব নিম্নস্তরের খুনীর বিনিদ্র মদ্য পরিবেশক। হতে পারতাম পর্যটক কেন্দে র ডোরাকাটা ট্রাউজার পরা নিম্নস্তরের এক কর্মচারী,যে সঙ্গমরতা নারীর অন্তর্বাস প্রহরীর কাছে বকশিস গোনে রাত্রির শেষ প্রহরে।

বহুদিন পর সিকদার আমিনুল হকের কবিতা,বিশেষ করে সতত ডানার মানুষ ও বাতাসের সঙ্গে আলাপ পুনর্বার পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে তিনি প্রেমের চেয়ে কামের প্রসঙ্গে বেশি উজ্জীবিত, বেশি আলোকিত। একজন প্রকৃত প্রেমিককবি তার আরাধ্য প্রেমিকার প্রতি যতখানি নিবেদিত, কবিতায় এ কবি কল্পিত প্রেমিকার প্রতি ততখানি নিবেদিত নন। কিছু-কিছ কবিতায় প্রিয় অনুষঙ্গ হিশেবে কাম এসেছে, কামনা আসেনি; এবং কামনা আসেনি বলে এসব কবিতার øিগ্ধতা পাঠককে মুগ্ধ করে। গদ্যছন্দে দীর্ঘকবিতা লেখার পাশাপাশি সিকদার অনেকগুলো লিরিক্যাল ক্ষুদ্র কবিতা লিখেছেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি ঈর্ষনীয় দক্ষতা দেখিয়েছেন; যেমন, তার একটি বহুল পঠিত ও উচ্চারিত জনপ্রিয় কবিতা এরকম:
সুলতা জানে,সুলতা জানে ভালো,
আকাশে মেঘ-দিঘিতে কেন হাঁস,
সুলতা জানে,সুলতা জানে ভালো
কবিরা কেন নারীর ক্রীতদাস!
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো
প্রেমিক কেন থাকে না চিরকাল;
সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো
সহজ সুখ থাকে না মহাকাল।

উপসংহারে শুধু এটুকু নিবেদন করতে চাই য়ে, সিকদার আমিনুল হক-এর কবিতা যারা এখনও পাঠ করেননি, বিশেষ করে তার সতত ডানার মানুষ, কাফকার জামা, বাতাসের সঙ্গে আলাপ, আমরা যারা পাহাড়ে উঠেছি’ ইত্যাদি গ্রন্থ যারা এখনও পাঠ করে উঠতে পারেননি, আমি গভীর উপলব্ধি থেকে বলতে চাই যে, তারা বাঙলা ভাষার অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত কবিতার স্বাদ থেকে এখনও বঞ্চিত রয়েছেন। আর একবার যারা পড়েছেন, তাদের উদ্দেশে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই যে, সিকদার আমিনুল হকের কবিতা এক পাঠে ফুরিয়ে যায় না; বার বার পড়তে হয়। যে কবির কবিতা এক পাঠে ফুরিয়ে যায় না তিনিই তো সেরা কবি, শ্রেষ্ঠ কবি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন