বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৯

ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন


নিম্ন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ক্লাসে যোগ-বিয়োগ ও গুণনের পদ্ধতি শেখানোর পর নিজে নিজেই ভাগের নিয়ম আবিষ্কার করে শিক্ষককে অবাক করে দিল কাজী পরিবারের দুরন্ত বালক কাজী মোতাহার হোসেন ৷ পদ্মাপারের প্রকৃতির সাহচর্যে বেড়ে ওঠা এই দুরন্ত বালক যৌবনে এক সপ্তাহের অনুশীলন হিসেবে দেওয়া বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাত-আটটা প্রশ্নের সমাধান করে ফেলেছিলেন কয়েক ঘন্টার মধ্যেই৷ কাজী মোতাহার হোসেন নামের এই দূরন্ত বালক পরবর্তী জীবনে খ্যাতি লাভ করেন বাংলাদেশের প্রথম পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, দাবাড়ু, এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক হিসেবে৷ কাজী নজরুল ইসলাম তাঁকে ডাকতেন 'মোতিহার' বলে, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ভাষায় তিনি 'আপনভোলা নিরহংকার মানুষ, বিদ্বান ও গুণী'৷ আর গুণমুগ্ধ ভক্তদের কাছে তিনি শ্রদ্ধেয় 'কাজী সাহেব'৷ বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি সাহিত্য-সংস্কৃতি-সঙ্গীত-খেলাধুলা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে অনন্য সাধারণ প্রতিভার সমন্বয়ে যুক্তিবাদী, ধর্মপ্রাণ ও স্পষ্টবাদী কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ৷

তত্‍কালীন নদীয়া জেলার ভালুকা (বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী) থানার অন্তর্গত লক্ষ্মীপুর গ্রামে ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই (বাংলা ১৩০৪ সালের ১৪ শ্রাবণ) শুক্রবার ভোরবেলা নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন কাজী মোতাহার হোসেন৷ তাঁর পিতা কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ এবং মাতা তসিরুন্নেসা৷ পিতা-মাতার চার ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান৷ জনাব গওহরউদ্দীন আহমদের নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার অধীন বাগমারা গ্রামে৷ তাঁদের পূর্বপুরুষ মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে দিল্লী-দরবারে ধর্মীয় উপদেষ্টা ও কাজী (বিচারক) পদে নিযুক্ত ছিলেন৷ বংশগত 'কাজী' পদবী তাঁরা পেয়েছেন এই সূত্রেই৷ জনাব গওহরউদ্দীন এন্ট্রান্স পাস করেননি৷ পেশায় তিনি ছিলেন প্রথমে সেটেলমেন্টের আমিন, পরে হেড আমিন এবং আরও পরে আমিনদের ইন্সপেক্টর৷ পেশাগত জরিপকাজের সূত্রে বছরের ছয় মাস বিভিন্ন এলাকায় যেতে হতো তাঁকে৷ বাকি ছয় মাস বাড়িতে থাকার অবসরে তিনি বাড়ির পাঠশালায় শিক্ষকতা ও গ্রামের মসজিদে ইমামতি করতেন৷ দিল্লীর বাদশাহের দেওয়া অল্প কিছু জমিজমা থাকলেও সত্‍ ও ধর্মপ্রাণ কাজী গওহরউদ্দীনের সংসারে যথেষ্ট সচ্ছলতা কখনোই ছিল না৷ তবে বাগমারার মধ্যবিত্ত এ পরিবারটি শিক্ষা-সংস্কৃতি ও বংশ-গৌরবে ছিল বিশিষ্ট৷

ফরিদপুরের বাগমারা গ্রামে বাবার বাড়িতে শৈশবের দিনগুলিতে ঝড়ের সময় আম-জাম কুড়ানো, খেজুর গাছে উঠে খেজুর বা খেজুররস আহরণ, পদ্মায় ঝাঁপাঝাঁপি, বাঁশ বা কাঠের হাতার ব্যাট ও ন্যাকড়ার বল দিয়ে ব্যাটবল আর কাঁচা জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, কুস্তি ইত্যাদি ছিল মোতাহারের বাল্যকালের নিত্যলীলা৷ আট বছর বয়স পর্যন্ত স্কুলে না গিয়ে এসব স্বতঃস্ফুর্ত আনন্দলীলার মাধ্যমেই স্বাভাবিক বুদ্ধির বিকাশ ঘটেছিল দুরন্ত মোতাহারের৷ পিতার কাছে এবং পারিবারিক মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় তাঁর৷ নানার বাড়ীতে লক্ষ্মীপুরের কাছে যদুবয়রা নিম্ন প্রাইমারি স্কুলে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি৷ পরে ১৯০৭ সালে বাগমারা নিম্ন প্রাইমারি স্কুল পাস করেন এবং রাজবাড়ী কেন্দ্রে মৌখিক বৃত্তি পরীক্ষায় পুরো নম্বর পেয়ে মাসিক ২ টাকা হারে বৃত্তি লাভ করেন৷ ১৯০৯ সালে তিনি কুষ্টিয়া মহকুমার অন্তর্গত সেনগ্রাম মাইনর স্কুল থেকে উচ্চ প্রাইমারি (ষষ্ঠ শ্রেণী) পাস করেন৷ পরে কুষ্টিয়া গিয়ে উচ্চ প্রাইমারি ক্লাসের বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হয়ে মাসিক তিন টাকার এবং চুয়াডাঙা থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে মাসিক চার টাকার বৃত্তি লাভ করেন তিনি৷ ১৯১৫ সালে তিনি কুষ্টিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রবেশিকা (ম্যাট্রিকুলেশন) পরীক্ষায় পূর্ববঙ্গ ও আসামের ভিতরে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে পাস করেন এবং মাসিক পনেরো টাকা হারে প্রাদেশিক বৃত্তি লাভ করেন৷ ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে কাজী মোতাহার হোসেনই ছিলেন পরিবারের প্রথম ব্যক্তি৷

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে আইএসসি শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে কাজী মোতাহার হোসেন বেশ কয়েকজন গুণী শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করেন৷ কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়বার সময়ে একটি অপ্রীতিকর ঘটনার দরুন সব শিক্ষার্থীর দশ টাকা করে জরিমানা ধরা হয়৷ জরিমানা মওকুফের সুযোগ না পেয়ে সেখান থেকে চলে এসে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন তিনি৷ ১৯১৭ সালে এই কলেজের বিজ্ঞান শাখা থেকে তিনি প্রথম বিভাগে চতুর্দশ স্থান অধিকার করে আইএসসি পাস করেন এবং মাসিক কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন৷ ১৯১৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং এই পরীক্ষায়ও পূর্ববঙ্গ ও আসামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম হয়ে মাসিক ত্রিশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন৷ ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ডিগ্রি লাভ করেন৷

পিতার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে ছাত্রাবস্থায় দুঃসহ দারিদ্র্য ছিল কাজী মোতাহার হোসেনের নিত্যসঙ্গী৷ তৃতীয় শ্রেণীতে থাকতে স্নানের পরে একটিমাত্র কাপড় (ধুতি) ভেজা থাকায় স্কুলে যেতে তাঁর দেরি হয়েছে কোনো কোনো দিন৷ কুষ্টিয়া হাইস্কুলে পড়ার সময়ও তাঁকে প্রায় সময়ই এক কাপড়ে দিন কাটাতে হয়েছে৷ ঢাকা কলেজে এমএ শ্রেণীতে পড়বার সময়ে ত্রিশ টাকা বৃত্তির সবটাই তিনি পাঠিয়ে দিতেন অসুস্থ পিতার কাছে৷ আর ছাত্র পড়িয়ে পাওয়া ২০/২৫ টাকা দিয়েই তিনি চালাতেন নিজের খরচ৷ কলেজে গ্রীষ্মের ও পূজোর ছুটিতে কোনো না কোনো স্কুলে শিক্ষকতা করে বাড়িতে টাকা পাঠাতেন৷ এরকম ছুটিতেই ১৯১৯ সালে তিনি দৌলতপুরের মোহসীন স্কুলে স্বল্পকাল শিক্ষকতা করেন৷

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়৷ তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ ড. জেনকিন্সের সুপারিশে ঐ বিভাগে ডেমোনস্ট্রেটরের পদে নিযুক্ত হন এমএ শেষ পর্বের ছাত্র কাজী মোতাহার হোসেন৷ একই বছরে এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে তিনি উক্ত বিভাগে সহকারী লেকচারার নিযুক্ত হন৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রখ্যাত বিজ্ঞানসাধক ও কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের জনক বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং অনেক নৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষকের স্নেহ-ভালোবাসা লাভ করেন তিনি৷ কাজী মোতাহার হোসেনের মধ্যে গণিতের অসামান্য প্রতিভা লক্ষ্য করে তাঁকে স্ট্যাটিস্টিক্স পড়তে পরামর্শ দেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু৷ ১৯৩৮ সালের দিকে এক ছুটিতে তিনি কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে যান কলকাতার 'Indian Statistical Institute' -এর অধ্যাপক ড. প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের কাছে৷ উপমহাদেশের সংখ্যাতত্ত্ব (Statistics) বিষয়ে পঠন-পাঠনের জনক এই মনীষীর কাছে সংখ্যাতত্ত্বের পাঠ গ্রহণ করে ১৯৩৮ সালে ডিপ্লোমা অর্জন করেন কাজী মোতাহার হোসেন৷ পরের বছর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন৷

কলকাতা থেকে ফিরে এসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগের অন্তর্ভুক্ত পরিসংখ্যান বিষয় পড়ানো শুরু করেন৷ একইসঙ্গে পদার্থবিদ্যার ফলিত অংশ ছেড়ে দিয়ে অনার্স ক্লাসে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা পড়াতে শুরু করেন৷ ১৯৩৯ সালে তিনি ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার-এ স্ট্যাটিসটিক্স বিষয়ে পাঠদান করেন৷ ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগটি গণিত ও পরিসংখ্যান বিভাগে রূপান্তরিত হলে এ বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন তিনি৷ ১৯৫০ সালে তিনি Design of Experiments বিষয়ে Balanced Incomplete Block Design শিরোনামের গবেষণা-অভিসন্দর্ভ রচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংখ্যাতত্ত্ব তথা তথ্যগণিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময় সংখ্যাতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা পরিচালনার কোনো যোগ্য ব্যক্তি না থাকায় তত্ত্বাবধায়কের সাহায্য ছাড়াই অভিসন্দর্ভ রচনা করেন তিনি৷ তাঁর পিএইচডি অভিসন্দর্ভের পরীক্ষক ছিলেন প্রখ্যাত সংখ্যাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক স্যার রোনাল্ড ফিশার, অধ্যাপক রাজচন্দ্র বোস এবং ড. মোহাম্মদ জিয়াউদ্দীন৷ অধ্যাপক ফিশার এই গবেষণাপত্রটি মূল্যায়ন করতে গিয়ে অত্যন্ত উচ্চ প্রশংসামূলক মন্তব্য করেন৷ কাজী মোতাহার হোসেন উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি সংখ্যাতত্ত্বে পরবর্তীকালে 'হোসেন শৃঙ্খল' বা 'Husain's Chain Rule' নামে অভিহিত হয়েছে৷ শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর হিসেবে এবং ফজলুল হক মুসলিম হলসহ আরো কয়েকটি হলে প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন৷ ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথক পরিসংখ্যান বিভাগ সৃষ্টি হলে কাজী মোতাহার হোসেন এ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত হন৷ পরের বছর তিনি এ বিভাগের রিডার পদে উন্নীত হন৷ তিনি ১৯৫৪ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন এবং ১৯৬১ সালে নিয়মিত অধ্যাপকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন৷ ১৯৫৩ সালে গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডীন-এর দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৬১ থেকে '৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক (সুপারনিউমারারি প্রফেসর) হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন৷ ১৯৬৩ সালে তিনি কলেজ অব মিউজিক-এ বাংলা ও অ্যাকুস্টিক্স-এর অবৈতনিক শিক্ষক নিযুক্ত হন৷ ১৯৬৪ সালে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ISRT) -এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নিয়োগ করা হয়৷ ১৯৬৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'প্রফেসর ইমেরিটাস' পদে নিযুক্ত হন৷

স্কুলজীবনে অবসর সময়ে পিতার বইপুস্তক পাঠ করার মাধ্যমে সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয় কাজী মোতাহার হোসেনের৷ বাল্যকালে একই গ্রামের কাজী আবদুল ওদুদের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে এসে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী ও সত্যেন দত্ত'র লেখা এবং সবুজপত্র, প্রবাসী ও পরিচয় পত্রিকাসমূহ পাঠ করার সুযোগ লাভ করেন তিনি৷ কুষ্টিয়া হাইস্কুলে পড়ার সময়ই শিক্ষক জ্যোতিন্দ্রমোহন রায়ের উত্‍সাহ ও প্রেরণায় কাজী মোতাহার হোসেনের লেখালেখির হাতেখড়ি হয়৷ সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম রচনা 'গ্যালিলিও'৷ ১৯২৬ সালের ১৯ জানুয়ারি কাজী আবদুল ওদুদ, আবুল হুসেন এবং কাজী মোতাহার হোসেন ঢাকায় 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' নামে একটি প্রগতিশীল সাহিত্য-সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন৷ এই সংগঠনের বার্ষিক মুখপত্র 'শিখা'র দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ-সংখ্যা সম্পাদনা করেন কাজী মোতাহার হোসেন৷ পরবর্তী কালে নিজস্ব স্টাইলে মননশীল, প্রাঞ্জল ও বলিষ্ঠ প্রকাশভঙ্গির একজন দায়িত্বশীল প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন কাজী মোতাহার হোসেন৷ ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম মৌলিক প্রবন্ধসংকলন 'সঞ্চরণ' প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাজী মোতাহার হোসেনকে সাধুবাদ জানিয়ে বাংলা ১৩৪৪ সালের ২রা ভাদ্র প্রেরিত পত্রে লিখেছিলেন, "... বিচিত্র ভাবকে এবং আলোচনার বিষয়কে স্বচ্ছ প্রাঞ্জল ভাষায় রূপ দিয়ে যে প্রবন্ধগুলি আপনার 'সঞ্চরণ' গ্রন্থে প্রকাশ করেছেন তা পড়ে পরিতৃপ্ত হয়েছি৷ আপনার বলবার সাহস এবং চিন্তার স্বকীয়তা সাধুবাদের যোগ্য৷ ..." প্রমথ চৌধুরী, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখেরও বিশেষ প্রশংসা লাভ করে 'সঞ্চরণ'৷

কাজী মোতাহার হোসেনের প্রকাশিত মৌলিক গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে নজরুল কাব্যপরিচিতি, সেই পথ লক্ষ্য করে, নির্বাচিত প্রবন্ধ (১ম খণ্ড)৷ প্ল্লেটোর 'সিম্পোজিয়াম', ম্যাঙ্মি গোর্কির 'ঝড়ো বাজের গান' কবিতা এবং কাজী আশরাফ মাহমুদের বেশ কয়েকটি হিন্দি কাব্যগ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন তিনি৷ স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তাঁর রচিত পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে রয়েছে Intermediate Geometry, Beginner�s Translation, আধুনিক ভূগোল, সাহিত্যবিকাশ (১ম ভাগ), জ্যামিতি প্রবেশ, প্রবেশিকা বাংলা ব্যাকরণ, ইসলামের ইতিহাস, পাকিস্তান ও পৃথিবী, Elements of Statistics, সাহিত্যিকা (১ম ভাগ), তথ্যগণিত, গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস, আলোকবিজ্ঞান (১ম খণ্ড)৷ 'নবাব স্যার সলিমুল্লাহ' তাঁর রচিত একটি জীবনী পুস্তিকা৷ তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে অসীমের সন্ধানে, কবি ও বৈজ্ঞানিক, বৈজ্ঞানিকের জ্ঞানসাধনা, মানুষ মোহাম্মদ, ধর্ম ও সমাজ, নাস্তিকের ধর্ম, আনন্দ ও মুসলমান গৃহ, সঙ্গীতচর্চা ও মুসলমান, সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ, আমার বন্ধু নজরুল : তাঁর গান ইত্যাদি৷ পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও কাজী মোতাহার হোসেনের অন্তত বারোটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন জার্নালে৷ বাংলা পরিভাষা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন৷ স্ট্যটিসটিক্স-এর বাংলা পরিভাষা হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছিলেন 'তথ্যগণিত', যদিও অধ্যাপক মহলানবীশের 'পরিসংখ্যান' বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে৷ কাজী সাহেবের যে পরিভাষাগুলি এখন নির্দ্বিধায় ব্যবহৃত হয় সেগুলি scatter বিস্তার, dispersion বিক্ষেপ, standard deviation পরিমিতি বিস্তার, variance বিস্তৃতি, mean deviation গড় বিস্তৃতি, range পরিক্ষেপ, semi-interquartile range আন্তঃচতুর্থক অর্ধপরিক্ষেপ, test of significance পার্থক্যের যথার্থতা, value মান, variate বিভিন্নক, constant অভিন্নক ইত্যাদি৷

বিজ্ঞানগবেষণা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও কাজী মোতাহার হোসেন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছেন৷ ছাত্রজীবনেই তিনি ফুটবল, টেনিস, ব্যাডমিন্টন, দাবা ও সাঁতারে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন৷ পরবর্তী কালে তিনি নিজেকে উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন৷ তিনি ১৯২৫ সালে 'অল ইন্ডিয়া চেস্ ব্রিলিয়্যান্সি' প্রতিযোগিতায় মোট ১০৩ নম্বরের মধ্যে ১০১ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন৷ তিনি ১৯২১ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত একটানা চল্লিশ বছর অবিভক্ত বাংলা এবং পূর্ব পাকিস্তানে দাবা চ্যাম্পিয়ন ছিলেন৷ তিনি 'অল ইন্ডিয়া অ্যান্ড সাউথ আফ্রিকা করেসপণ্ডেন্স চেস্ কম্পিটিশন'-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন৷ 'বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশন'-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং আজীবন সভাপতি ছিলেন তিনি৷ বাংলাদেশের দাবার জগতে পরম সম্মানিত 'দাবাগুরু' হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন তিনি৷ দাবার জগতে তাঁর অবদানের স্মারকস্বরূপ ১৯৮০ সালের ২৫ এপ্রিল ঢাকায় 'কাজী মোতাহার হোসেন ইন্টারন্যাশনাল রেটিং চেস্ টুর্নামেন্ট' শুরু করা হয়৷ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় করাচিতে দাবা খেলবার জন্য নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে পুরো নয় মাস আটকা পড়েছিলেন সেখানে৷ তাঁর দাবাখেলার সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন কথাশিল্পী শরত্‍চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, সতীশচন্দ্র আড্ডী, কিষাণলাল প্রমুখ৷ দাবাখেলা ছাড়াও তিনি ১৯৫১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত লন্ টেনিস প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন৷

একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে ১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত সাহিত্যমেলায় আমন্ত্রিত হয়ে ভাষণ প্রদান করেন কাজী মোতাহার হোসেন৷ অনুষ্ঠান শেষে রাত্রিবেলায় বাড়ির ছাদে কফি পার্টির আয়োজন হয়৷ জ্যোত্‍স্নালোকিত পূর্ণিমার সেই রাতে উপস্থিত সবাইকে চমকে দিয়ে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান কাজী মোতাহার হোসেন৷ নীরস পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের কন্ঠে অপ্রত্যাশিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন সবাই৷ মূলত সঙ্গীতের প্রতি কাজী মোতাহার হোসেনের বিশেষ অনুরাগ ছিল কৈশোরকাল থেকেই৷ ১৯১৭-১৮ সালে তিনি বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ হেকিম মোহাম্মদ হোসেন সাহেবের কাছে দুই বছর রাগসংগীত তথা টপ্পা, ঠুম্রি ও খেয়াল শেখেন এবং বছর তিনেক সেতারের তালিম গ্রহণ করেন৷ তরুণ বয়সে নানাবিধ পুরানো বাংলা গান, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্তের গানের চর্চা করেন তিনি৷

কাজী মোতাহার হোসেন ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের 'সিতারা-ই-ইমতিয়াজ' পদক লাভ করেন৷ ১৯৬৭ সালে প্রবন্ধ-সাহিত্যের জন্য তিনি লাভ করেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার৷ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তন উত্‍সবে তাঁকে সম্মানসূচক 'ডক্টর অব সায়েন্স' (ডিএসসি) ডিগ্রি প্রদান করা হয়৷ ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁকে বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপকের মর্যাদা প্রদান করে৷ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে 'স্বাধীনতা পুরস্কার ১৯৭৯' প্রদান করে৷ তিনি বাংলা একাডেমীর সম্মানসূচক ফেলোশিপ, মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার, সওগাত সাহিত্য পরিষদের নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, ভাসানী পুরস্কার এবং শেরে বাংলা জাতীয় স্মৃতিসংসদ-এর শেরে বাংলা জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন৷ তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনের ষষ্ঠ অধিবেশনে কলকাতা মুসলিম ইন্সটিটিউট হলের সভাপতি, দুইবার পাকিস্তান সায়েন্স কনফারেন্স-এর সভাপতি এবং ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের বাংলাদেশি সদস্য নির্বাচিত হন৷ নজরুল একাডেমী এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সম্মানসূচক আজীবন সদস্য ছিলেন তিনি৷ এছাড়া কুমিল্লার একটি সংগঠন তাঁকে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি এবং সিরাজগঞ্জের যমুনা সাহিত্যগোষ্ঠী 'বিদ্যার্ণব' উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে৷ ১৯৮১ সালে তাঁকে ফরিদপুর জেলা সমিতি সংবর্ধনা দেয়৷ ১৯৮৫ সালে তিনি শেরে বাংলা জাতীয় স্মৃতিসংসদ স্বর্ণপদক এবং ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় ক্রীড়া স্বর্ণপদক লাভ করেন৷ তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনটির নামকরণ করা হয় 'কাজী মোতাহার হোসেন ভবন'৷

এমএ ক্লাসের ছাত্র অবস্থাতেই কাজী মোতাহার হোসেন ১৯২০ সালের ১০ অক্টোবর কলকাতার মোহাম্মদ ফয়েজুর রহমান ও মুসলিমা খাতুনের কন্যা সাজেদা খাতুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন৷ শিল্প-সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী সাজেদা খাতুন ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেনের যোগ্য জীবনসঙ্গী৷ বৈষয়িক সকল দায়িত্ব একা হাতে সামলে তিনি নির্বিঘ্নে জ্ঞানসাধনা করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন জগত্‍-সংসারের প্রতি উদাসীন কাজী সাহেবকে৷ সংস্কৃতিমনা এই দম্পতির চার পুত্র ও সাত কন্যার মধ্যে বর্তমানে এক পুত্র ও চার কন্যা জীবিত আছেন৷ সন্তানদের প্রায় সকলেই জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-ক্রীড়ার পারিবারিক ঐতিহ্যকে লালন করেছেন৷ প্রয়াত কন্যা যোবায়দা মির্যা অবসর গ্রহণের প্রাক্কালে সরকারি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, প্রয়াত ওবায়দা সা'দ ময়মনসিংহের মেয়েদের মডেল স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন, তৃতীয় কন্যা খোরশেদা খাতুন বিএ অনার্স পাঠকালে প্রয়াত হন৷ প্রয়াত তিন পুত্র কাজী মকবুল হোসেন, কাজী ইকবাল হোসেন এবং কাজী নূরুদ্দিন মাহবুব হোসেনের মধ্যে শেষোক্ত জন প্রতিশ্রুতিশীল দাবা ও টেবিল টেনিস খেলোয়াড় এবং সেই সঙ্গে লেখক ছিলেন৷ অপর পুত্র কাজী আনোয়ার হোসেন জনপ্রিয় গোয়েন্দা কাহিনী 'মাসুদ রানা' ও 'কুয়াশা' সিরিজের রচয়িতা ও সঙ্গীতশিল্পী৷ কন্যাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. সন্জীদা খাতুন, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ফাহমিদা খাতুন এবং চিত্রশিল্পী মাহমুদা খাতুন রবীন্দ্রসঙ্গীতের তিন খ্যাতিমান শিল্পী৷ পড়াশোনা ছাড়াও খেলাধুলা, গান-বাজনা ইত্যাদিতে কাজী মোতাহার হোসেনই ছিলেন সন্তানদের প্রথম ও প্রধান সহায়৷ ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে কাজী মোতাহার হোসেন ১৯৬৬ সালে সস্ত্রীক হজব্রত পালন করেন৷ ১৯৭৫ সালের ৭ জুন ৬৮ বছর বয়সে ঢাকার পিজি হাসপাতালে স্ত্রী সাজেদা খাতুনের পরলোকগমনের পর কাজী মোতাহার হোসেনের বাকি জীবন কেটেছে অনেকটা নিঃসঙ্গতা ও অসহায়ত্বের মধ্যে৷

সংস্কৃতিসচেতন একজন আদর্শ বাঙালি ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন৷ পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দেওয়াতে ১৯৪৭ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর প্রকাশিত 'রাষ্ট্রভাষা ও পূর্বপাকিস্তানের ভাষাসমস্যা' প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন "... ধূমায়িত অসন্তোষ বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না৷ শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে৷" ১৯৬১ সালে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও তিনি রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন৷ ১৯৬৭ সালে বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি৷ পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সভাপতি হিসেবে তিনিই প্রথম বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে পহেলা বৈশাখকে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণার দাবি জানিয়ে ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করেন৷ এই সংগঠনের উদ্যোগে এবং কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে ঢাকায় প্রথমবারের মতো ম্যাক্সিম গোর্কির মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপিত হয়৷ কলকাতায় শরত্‍চন্দ্রের সঙ্গে দাবাখেলার এক ফাঁকে তিনি মন্তব্য করেছিলেন 'শরত্‍ সাহিত্যে মুসলিম সমাজচিত্র একেবারেই অনুপস্থিত যদিও মুসলমানরা এ দেশের বিরাট একটা অংশ জুড়ে হিন্দুদের পাশাপাশি অবস্থান করে আসছে৷' এরপর শরত্‍চন্দ্র লিখলেন তাঁর একমাত্র মুসলিম সমাজচিত্র, বিখ্যাত ছোটগল্প 'মহেশ'৷ সাহিত্যকে হিন্দুকরণ বা ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে কাজী মোতাহার হোসেন বলেছিলেন, "...জলকে পানি বলে উল্লেখ করলে সাহিত্যের জাত যাবে না-জাত যাবে যদি জলচৌকিকে পানিচৌকি, পানিপথকে জলপথ, জলযোগকে পানিযোগ, জলপানিকে পানিপানি বা পাণিপ্রার্থীকে যদি জলপ্রার্থী করা হয়৷"

সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে কাজী মোতাহার হোসেন নিজের মধ্যে একজন দেশপ্রাণ বাঙালি, উদারমনা মুসলমান এবং সত্‍ ও আদর্শবান ব্যক্তিত্বকে লালন করেছেন৷ মৃত্যুর কিছুদিন আগে কাজী সাহেব বলেছিলেন, "জন্মদিন যেমন আনন্দের দিন মৃত্যুদিনও তেমনই আনন্দের দিন৷ সুতরাং শোক করা উচিত নয়৷" ৮৪ বছর বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে ১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর শুক্রবার পবিত্র ঈদ-উল-আযহার সকালে মৃত্যুবরণ করেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় মনীষী কাজী মোতাহার হোসেন৷ অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে সমাহিত করা হয় ঢাকার বনানী গোরস্থানে তাঁর স্ত্রীর কবরের পাশে৷

জীবনী সংক্ষেপ

পূর্ণনাম: কাজী মোতাহার হোসেন

জন্ম: ১৮৯৭ সালের ৩০ জুলাই (বাংলা ১৩০৪ সালের ১৪ শ্রাবণ) শুক্রবার ভোরবেলা তত্‍কালীন নদীয়া জেলার ভালুকা (বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী) থানার অন্তর্গত লক্ষ্মীপুর গ্রামে মাতুলালয়ে৷

পিতা-মাতা: কাজী গওহরউদ্দীন আহমদ এবং তসিরুন্নেসা৷ পিতা-মাতার চার ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান৷

শিক্ষা: নিম্ন প্রাইমারি স্কুল পাস করার পর মৌখিক বৃত্তি পরীক্ষায় পুরো নম্বর পেয়ে মাসিক ২ টাকা হারে, কুষ্টিয়ায় উচ্চ প্রাইমারি ক্লাসের বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে মাসিক তিন টাকার এবং চুয়াডাঙায় বৃত্তি পরীক্ষায় মাসিক চার টাকার বৃত্তি লাভ৷ প্রবেশিকা/ম্যাট্রিকুলেশন(মাধ্যমিক)- কুষ্টিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় (১৯১৫); প্রবেশিকা পরীক্ষায় পূর্ববঙ্গ ও আসামের ভিতরে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে পাস করেন এবং মাসিক পনেরো টাকা হারে প্রাদেশিক বৃত্তি লাভ করেন; আইএসসি (উচ্চ মাধ্যমিক)- রাজশাহী কলেজ (১৯১৭); স্নাতক (সম্মান)- বিএ, ঢাকা কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে (১৯১৯); এই পরীক্ষায়ও পূর্ববঙ্গ ও আসামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম হয়ে মাসিক ত্রিশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন; স্নাতকোত্তর - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ, পদার্থবিজ্ঞানে, ঢাকা কলেজ (১৯২১); গণিতে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৩৯); সংখ্যাতত্ত্বে ডিপ্লোমা - ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট (১৯৩৮); পিএইচডি্-সংখ্যাতত্ত্বে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, Design of Experiments বিষয়ে রচিত গবেষণা-অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল Balanced Incomplete Block Design (১৯৫০); কাজী মোতাহার হোসেন উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি সংখ্যাতত্ত্বে পরবর্তীকালে 'হোসেন শৃঙ্খল' বা 'Husain's Chain Rule' নামে অভিহিত হয়েছে৷

কর্মজীবন: ১৯১৯ সালে দৌলতপুরের মোহসীন স্কুলে স্বল্পকালীন শিক্ষকতা; ১৯২১ সালে এমএ শেষ পর্বের ছাত্র থাকতে নবপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ডেমোনস্ট্রেটর এবং ওই বছরেই এমএ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর একই বিভাগের সহকারী লেকচারার নিযুক্ত; ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন; ১৯৩৯ সালে ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার-এ স্ট্যাটিসটিক্স বিষয়ে পাঠদান৷ ১৯৪৯ সালে গণিত বিভাগটি গণিত ও পরিসংখ্যান বিভাগে রূপান্তরিত হলে এ বিভাগের প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা; ১৯৪০ সালে ফজলুল হক মুসলিম হলে আবাসিক শিক্ষকের এবং পরে ঢাকা হলসহ আরো কয়েকটি হলে প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন; ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত পৃথক পরিসংখ্যান বিভাগে বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত; ১৯৫১ সালে এই বিভাগের রিডার পদে এবং ১৯৫৪ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত; ১৯৬১ সালে নিয়মিত অধ্যাপকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ; ১৯৫৩ সালে গ্রীষ্মের ছুটিতে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন; ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডীন-এর দায়িত্ব পালন; ১৯৬১ থেকে '৬৪ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক (সুপারনিউমারারি প্রফেসর) হিসেবে নিযুক্ত; ১৯৬৩ সালে কলেজ অব মিউজিক-এ বাংলা ও অ্যাকুস্টিক্স-এর অবৈতনিক শিক্ষক; ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ওঝজঞ)-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নিযুক্ত এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের দায়িত্ব পালন; ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'প্রফেসর ইমেরিটাস' পদে নিযুক্ত৷

পরিবার: স্ত্রী -প্রয়াত সাজেদা খাতুন৷ সন্তান্তচার পুত্র ও সাত কন্যার মধ্যে বর্তমানে এক পুত্র ও চার কন্যা জীবিত আছেন৷ প্রয়াত কন্যা যোবায়দা মির্যা অবসর গ্রহণের প্রাক্কালে সরকারি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, প্রয়াত ওবায়দা সা'দ ময়মনসিংহের মেয়েদের মডেল স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন, তৃতীয় কন্যা খোরশেদা খাতুন বিএ অনার্স পাঠকালে প্রয়াত হন৷ প্রয়াত তিন পুত্র কাজী মকবুল হোসেন, কাজী ইকবাল হোসেন এবং কাজী নূরুদ্দিন মাহবুব হোসেনের মধ্যে শেষোক্ত জন প্রতিশ্রুতিশীল দাবা ও টেবিল টেনিস খেলোয়াড় এবং সেই সঙ্গে লেখক ছিলেন৷ অপর পুত্র কাজী আনোয়ার হোসেন জনপ্রিয় গোয়েন্দা কাহিনী 'কুয়াশা' ও 'মাসুদ রানা' সিরিজের রচয়িতা ও সঙ্গীতশিল্পী৷ কন্যাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. সন্জীদা খাতুন, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ফাহ্মিদা খাতুন এবং চিত্রশিল্পী মাহ্মুদা খাতুন রবীন্দ্রসঙ্গীতের তিন খ্যাতনাম্নী শিল্পী৷ স্ত্রী সাজেদা খাতুন ১৯৭৫ সালের ৭ জুন ৬৮ বছর বয়সে ঢাকার পিজি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পরে পরলোকগমন করেন৷

প্রকাশনা: মননশীল প্রাঞ্জল ও বলিষ্ঠ গদ্য রচয়িতা হিসেবে পরিচিত৷ প্রথম মৌলিক প্রবন্ধ সংকলন 'সঞ্চরণ' প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ সালে৷ অন্য মৌলিক গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে নজরুল কাব্যপরিচিতি (১৯৫৫), সেই পথ লক্ষ্য করে (১৯৫১), নির্বাচিত প্রবন্ধ ১ম খণ্ড (১৯৭৬)৷ প্রকাশিত অনুবাদগ্রন্থ প্লেটোর সিম্পোজিয়াম (১৯৬৫), এবং কাজী আশরাফ মাহমুদের হিন্দি কাব্যগ্রন্থ নিমন্ত্রণ, বিয়োগী, কুটজ, বিয়োগিনী যথাক্রমে নিবেদন (১৯৬৭), বিরহী (১৯৬৮), কুটজমালা (১৯৬৮) এবং বিরহিণী (১৯৬৯) নামে৷ রচিত পাঠ্যপুস্তক্ত : Intermediate Geometry (1949), Beginner's Translation, আধুনিক ভূগোল (২য় ভাগ: সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর সহযোগে; ১৯৫০), সাহিত্যবিকাশ (১ম ভাগ; ১৯৫০), জ্যামিতি প্রবেশ (১৯৫১), প্রবেশিকা বাংলা ব্যাকরণ (১৯৫২), ইসলামের ইতিহাস (১৯৫২), পাকিস্তান ও পৃথিবী (সুরেশচন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে যৌথভাবে; ১৯৫৩), Elements of Statistics (1955), সাহিত্যিকা (১ম ভাগ: অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ-র সঙ্গে যৌথভাবে; ১৯৫৭), তথ্যগণিত (১৯৬৯), গণিতশাস্ত্রের ইতিহাস (১৯৭০), আলোকবিজ্ঞান (১ম খণ্ড; ১৯৭৫)৷ 'নবাব স্যার সলিমুল্লাহ' (১৯৮০) তাঁর রচিত একটি জীবনী পুস্তিকা৷ বাংলা একাডেমী থেকে চার খণ্ডে 'কাজী মোতাহার হোসেন রচনাবলী', কাজী মোতাহার হোসেন ফাউণ্ডেশনের পক্ষে প্রজাপতি প্রকাশন থেকে 'নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন' এবং নবযুগ প্রকাশনী থেকে 'প্রবন্ধ সংগ্রহ' প্রকাশিত হয়েছে৷ অপ্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে দাবাশিক্ষা, ব্যবহারিক পদার্থবিদ্যা, কোরান-পরিচয়, পয়গম্বর-কাহিনী৷

সম্মাননা: সভাপতি, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনের ষষ্ঠ অধিবেশন, কলকাতা মুসলিম ইন্সটিটিউট হল (১৯৩৮); সভাপতি, কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন, কাগমারী, টাঙ্গাইল; সিতারা-ই-ইমতিয়াজ সম্মাননা, পাকিস্তান (১৯৬১); বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৭); সভাপতি, পাকিস্তান সায়েন্স কনফারেন্স, ঢাকা (১৯৬৮); মূল সভাপতি, পাকিস্তান সায়েন্স কনফারেন্স, রাজশাহী (১৯৭১); সম্মানসূচক ডক্টর অব সায়েন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৪); বিদ্যাসাগর উপাধি, কুমিল্লা (১৯৭৫); জাতীয় অধ্যাপক, বাংলাদেশ (১৯৭৫); নাসিরুদ্দীন স্বর্ণপদক, সওগাত সাহিত্য পরিষদ (১৯৭৭); সম্মানসূচক আজীবন সদস্যপদ, নজরুল একাডেমী, ঢাকা (১৯৭৭); সম্মানসূচক আজীবন সদস্যপদ, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন (১৯৭৮); স্বাধীনতা পুরস্কার ১৯৭৯, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা, বাংলাদেশ সরকার (১৯৭৯); সম্মানসূচক ফেলোশিপ, বাংলা একাডেমী (১৯৮০); মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০); বিদ্যার্ণব উপাধি, যমুনা সাহিত্যগোষ্ঠী, সিরাজগঞ্জ (১৯৮০); নির্বাচিত বাংলাদেশী সদস্য, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউট, কলকাতা (১৯৮১); শেরে বাংলা জাতীয় পুরস্কার, শেরে বাংলা জাতীয় স্মৃতিসংসদ, ঢাকা (১৯৮১); সংবর্ধনা, ফরিদপুর জেলা সমিতি (১৯৮১); ভাসানী পুরস্কার (১৯৮১); ১৯৮৫ সালে তিনি শেরে বাংলা জাতীয় স্মৃতিসংসদ স্বর্ণপদক এবং ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় ক্রীড়া স্বর্ণপদক লাভ করেন৷ তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনটির নামকরণ করা হয় 'কাজী মোতাহার হোসেন ভবন'৷

মৃত্যু: ৮৪ বছর বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে ১৯৮১ সালের ৯ অক্টোবর শুক্রবার পবিত্র ঈদ-উল-আযহার সকালে মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশের শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ক্রীড়া ও বিজ্ঞানচর্চার সর্বজনশ্রদ্ধেয় মনীষী কাজী মোতাহার হোসেন৷ অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী তাঁকে সমাহিত করা হয় ঢাকার বনানী গোরস্থানে তাঁর স্ত্রীর কবরের পাশে৷

তথ্যসূত্র:
১. আবুল আহসান চৌধুরী সম্পাদিত কাজী মোতাহার হোসেন : জীবন ও সৃষ্টি; নবযুগ প্রকাশনী; ঢাকা; ২০০৭৷ ২. এ. এম. হারুন অর রশীদ; বিজ্ঞানে আমাদের উত্তরাধিকার; সাহিত্য প্রকাশ; ঢাকা ২০০৮৷

গবেষক: মোঃ কুতুব উদ্দিন সজিব

৩টি মন্তব্য:

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. গবেষক জনাব মোঃ কুতুব উদ্দিন সজিব সম্ভবত কুষ্টিয়া জেলার অধিবাসি, যে কারনে খুব কৌশলে ডঃ কাজী মোতাহার হোসেনকে কুষ্টিয়া জেলার ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিতি পাইয়ে দিতে চান। এই লেখার বিভিন্ন জায়গায় তিনি ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন এর নিজ বাড়ী ‘রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রাম’ কে তিন উল্লেখ করেছেন বাবার বাড়ী হিসাবে। গবেষক জনাব কুতুব উদ্দিন সজিবসহ সকলেরই জানা আছে তবুও উল্লেখ করছি, বাংলাদেশের কালচার অনুসারে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিবাহিতা মহিলাদের পরিচয় প্রদানের সময় ‘বাবার বাড়ি’ শব্দটি উল্লেখ করা হয় কিন' ছেলেদের ক্ষেত্রে এধরনের শব্দের ব্যবহার অবশ্যই উদ্দেশ্যপূর্ণ। তিনি ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন এর নানা বাড়ীর ঠিকানা খুব যত্নের সাথে উল্লেখ করেছেন “তৎকালীন নদীয়া জেলার ভালুকা (বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী) থানার অন্তর্গত লক্ষীপুর গ্রামে” অথচ মোতাহার হোসেন এর নিজ বাড়ীর ঠিকানার ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন ‘বাবার বাড়ী ফরিদপুর জেলার পাংশা উপজেলার বাগমারা গ্রামে’। ফরিদপুর এর পূর্বে ‘তৎকালীন’ বা ফরিদপুররের পরে ‘বর্তমান রাজবাড়ী জেলা’ শব্দ দুইটির কোনটিই উল্লেখ করেননি।

    আমাদের দেশে মহিলারা গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসবের জন্য স্বামীর বাড়ী থেকে বাবার বাড়ীতেই যায়। সেকারনে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষেরই জন্ম তাদের নানার বাড়ীতে। বর্তমান যুগে শিশুদের জন্ম হয় হাসপাতালে, সেক্ষেত্রেও নানার বাড়ী জেলার হাসপাতালই অধিকাংশ সময়। গবেষক মোঃ কুতুব উদ্দিন সজিব সাহেবেরও জন্ম হয়তো নানার বাড়ীতে এ সম্ভাবনাই বেশি, এজন্য কি আপনি আপনার বাড়ীর পরিচয়ের ক্ষেত্রে নানার বাড়ীকে উল্লেখ করেন? পাঠক আপনারা কে কে নানার বাড়ীকে বাড়ীর পরিচয় হিসাবে প্রদান করেন? আমার ধারণা কেউই তা করেননা। ডঃ কাজী মোতাহার হোসেনের ক্ষেত্রটিও তাই।

    লেখায় যে যেমন কৌশলই অবলম্বন করুক না কেন, ডঃ মোতাহার হোসেন রাজবাড়ী জেলার সন্তান এটি কেউই অস্বীকার করতে পারেনি। জনাব কুতুব উদ্দিন সজিব সাহেব আপনিও পারবেন না।

    পরিচয়ের চাতুরতাটুকু যদি বাদ দেই তাহলে আপনার লেখার তুলনা হয় না। খুব কম লেখক বা গবেষকই আপনার মতো এতো সুন্দর তথ্য নির্ভর অথচ সাবলিল লেখা লিখতে পারে।

    আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই এই বিশাল গবেষণার জন্য। আপনার লেখা অসম্ভব সুন্দর ও সাবলিল। লেখক বা গবেষক হিসাবে আপনার আরও অনেক উন্নতি কামনা করি।

    এস, এম কারুল হাসান পলাশ
    এ্যাডভোকেট
    রাজবাড়ী জজ কোর্ট, রাজবাড়ী।
    মোবাইলঃ ০১৭১২-৭৯২৮৯৪

    উত্তরমুছুন