বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৯

সবারই সেখানে আমন্ত্রণ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম


দুটি লক্ষ্য থেকে সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে-সাধারণত হয়ে থাকে-এক· সংস্কৃতি, ইতিহাস, সংজ্ঞা ও বিবর্তন এবং এর নানা প্রকাশের একটা খতিয়ান নির্ণয় করা এবং দুই· সংস্কৃতির সঙ্গে আপাত-বিযুক্ত অথচ নিগূঢ়ভাবে সম্পর্কিত নানা বিষয়; যেমন-ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন এবং সংস্কৃতির পণ্যায়নসহ এর বিভিন্ন শর্ত নির্ধারণের একটি ব্যাখ্যা তৈরি করা। এ দুই লক্ষ্য বিপরীতমুখী নয়, বরং পরস্পর সম্পূরক। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, প্রথম লক্ষ্যটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়; ভাবা হয় এর পদ্ধতিটি ধ্রুপদী শ্রেণীর। দ্বিতীয় লক্ষ্যটিকে ধরে নেওয়া হয় তাত্ত্বিক অথবা আদর্শিক; অর্থাৎ এর পেছনে কার্যকর সমাজতাত্ত্বিক কোনো চিন্তা অথবা কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তত্ত্ব, যথা মার্ক্সবাদ, অথবা নারীবাদ; অথবা এর প্রেরণা জনসংস্কৃতিমূলক। কিন্তু দ্বিতীয় লক্ষ্যটিকে পাশ কাটিয়ে গেলে সংস্কৃতির গতি-প্রকৃতি, এর শত্রু-মিত্র, এর ভেতরের দ্বন্দ্বমান শক্তিগুলো এবং এর সংগ্রামের ক্ষেত্রটি সঠিকভাবে চিহ্নিত করা যাবে না। বাংলাদেশের সংস্কৃতির দিকে চোখ ফেরালে এই দ্বিতীয় লক্ষ্য বা পদ্ধতির কার্যকারিতার গুরুত্ব সহজেই বোঝা যায়। যেমন-আমরা যে আকাশ ও সংস্কৃতির কথা বলি, যার বিরুদ্ধে আমাদের অনেক ক্ষোভ ও অভিযোগ, অথচ একই সঙ্গে যাকে আমরা জীবনে সানন্দে গ্রহণ করেছি, এর প্রভাবের সম্পূর্ণ তাৎপর্যটি প্রথম লক্ষ্য বা পদ্ধতির প্রয়োগ থেকে সহজে প্রতীয়মান হবে না। সংস্কৃতির যেকোনো সামূহিক সংজ্ঞায় এ বিষয়টি শুধু একটি উপাদান হিসেবে চিহ্নিত হবে, কিন্তু কী কারণে সংস্কৃতির দৃশ্যমানতা দিনে দিনে অন্য প্রকাশগুলোকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে, এর পর্যাপ্ত কোনো ব্যাখ্যা তাতে পাওয়া যাবে না। আকাশ সংস্কৃতির সঙ্গে দৃশ্যমানতার সম্পর্কটি নিবিড়-এমনই নিবিড়ি যে একে পর্দা-সংস্কৃতি বলতেও বাধা নেই। একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর চোখ এখন মুদ্রিত পৃষ্ঠার চেয়ে নানা ধরনের পর্দায় (সিনেমা, টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন) আটকে থাকে দিনের একটা অংশজুড়ে এবং এই পর্দা-পড়ার চর্চাটাই তাদের জন্য সংস্কৃতির প্রধান উপাদান হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অথচ এই ক্ষুদ্র এবং প্রধানত নগরভিত্তিক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি কেন দেশের বৃহত্তর এবং গ্রামভিত্তিক মানুষের সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এই প্রশ্নের উত্তর সংস্কৃতির স্বার্থেই খোঁজা জরুরি। আর দৃশ্যমান বা পর্দা-সংস্কৃতির প্রকোপ এখন গ্রাম পর্যন্তও বিস্তৃত হচ্ছে এবং বিদ্যুতের সংযোগ যত গ্রামে গ্রামে পৌঁছে যাবে, তত তা বিস্তৃততর হবে। এতে লোকজ সংস্কৃতির ক্ষেত্রটি সংকুচিত হচ্ছে, এই সংস্কৃতির অনেক প্রকাশ হারিয়েও যাচ্ছে। ৫০ বছর আগেও এই বিপদটি কারও মনে আসেনি, তার মোকাবিলা করার প্রশ্ন তো দূরের কথা। অথচ এখন এটি বড় এক বাস্তব। সংস্কৃতি পাঠে ও আলোচনায় এই বিপদকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
সংস্কৃতির সহজ পাঠে একটি সংজ্ঞা বেশ কার্যকর, যেহেতু এ সংজ্ঞা থেকে বিভিন্ন দিকে অগ্রসর হওয়া যায়ঃ এটি দিয়েছেন উত্তর ঔপনিবেশিক তত্ত্বের অন্যতম চর্চাকারী রবার্ট ইয়াং। তাঁর কলোনিয়াল ডিজায়ার (১৯৯৫) গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘সংস্কৃতি বা সভ্যতা হচ্ছে, এথনোগ্রাফি বা বিজ্ঞানভিত্তিক মানবচিত্রের ব্যাপকতম অর্থে সেই জটিল সমগ্র, যাতে অন্তভুêক্ত জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্প, নৈতিকতা, আইন, আচার এবং সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষের অর্জিত অন্য যেকোনো সক্ষমতা এবং আচরণ।’ (৪৫) এই ‘জটিল সমগ্র’ থেকে যদি আমরা বিভিন্ন মুখে যাত্রা করি, তাহলে আর সংস্কৃতির সহজ পাঠ সহজ থাকবে না। তখন দেখা যাবে, সংস্কৃতি কোনো জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসগত সম্মিলিত অর্জন শুধু নয়, বরং এর ভেতরে রয়েছে অনেক বৈপরীত্য, বৈষম্য, দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং উদ্‌গিরণ-অবদমনের বিষয়। ইয়াং তাঁর বইয়ে সংস্কৃতিকে ঔপনিবেশিক ক্ষমতার প্রয়োজনে নির্মাণ ও ব্যবহারের বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর ‘জটিল সমগ্রের’ তালাশে এ রকম নানা পথে বেরোলে আমরা আরও দেখতে পাব, সংস্কৃতি হচ্ছে আধিপত্যবাদী শ্রেণীর অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে অধিগত বা নি্নবর্গীয় শ্রেণীর প্রতিরোধের নিরন্তর দ্বন্দ্বের একটা জায়গা। আন্তোনিওগ্রামসি যে ‘হেজেমনি’ বা শক্তি প্রয়োগ ও সম্মতির মাধ্যমে আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছিলেন, এই দ্বন্দ্বটি তারই একটি প্রকাশ। আরও দেখা যাবে, সংস্কৃতির সঙ্গে ক্ষমতার (এবং ওই ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের) সম্পর্কটি অবিচ্ছেদ্য। এবং আরেকটু এগিয়ে যদি আমরা মিশেল ফুকোকে আলোচনায় নিয়ে আসি, তাহলে দেখতে পাব, যে জ্ঞানের কথা ইয়াং লিখেছেন, তা ক্ষমতা তার নিজের স্বার্থে নানাভাবে তৈরি করছে, উৎপাদন ও বণ্টন করছে, শ্রেণীবদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করছে। এই নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, যাদের ক্ষমতা নেই, সেই অন্তর্বর্তী ব্যক্তিদের নিজেদের অভিলাষ অনুযায়ী তৈরি করা। ফুকো তাঁর বিশ্লেষণে দেখান, ক্ষমতা বিভিন্ন উপায়ে জ্ঞানকে এই অন্তর্বর্তী মানুষ তৈরিতে এবং তাকে সোজা পথে রাখতে সচেষ্ট। জ্ঞানের এই পদ্ধতিগত প্রকাশকে ফুকো বর্ণনা করেছেন ডিসকোর্স বা আখ্যান হিসেবে। এই ডিসকোর্সের এক প্রান্তে ক্ষমতা, অন্য প্রান্তে ওই নির্মিত ব্যক্তি। সমাজ সোজা পথের আদর্শকে ওপরে তুলে ধরে, অথচ ক্ষমতা কখনো সোজা পথে আসে না, অথবা চলে না; যা ক্ষমতার জন্য প্রযোজ্য নয়, তা সাধারণ ও অনুবর্তী ব্যক্তির জন্য অবশ্যপ্রযোজ্য। ফুকো তাঁর একাধিক আলোচনায় দেখিয়েছেন, কীভাবে ধর্ম, অর্থনীতি, আইন, মনোবিজ্ঞান বা চিকিৎসাশাস্ত্রের মতো ডিসকোর্স আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রগুলো তৈরি করে এবং সেগুলো সুরক্ষিত রাখে।
ক্ষমতার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ডিসকোর্সসমূহ কখনো নিরীহ বা নিষ্পাপ নয়; এদের বিভিন্নমুখী উদ্দেশ্য থাকে। একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পরিচিতি নির্মাণ; আরেকটি হচ্ছে এই পরিচিতির মাধ্যমে তাকে বা তাদের প্রকাশ করানো। অন্য একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তির সক্রিয়তার ক্ষেত্রটি নির্দিষ্ট করে দেওয়া। যেমন, নারীর সত্তাগত যত স্বাতন্ত্র্য অথবা নিজস্বতা থাকুক, তার পরিচিতি নির্মাণ করে পিতৃতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্র। এবং নারীর পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই তাতে সহযোগিতা করা ছাড়া উপায় থাকে না। কৃষক ও শ্রমিকের পরিচিতি নির্মাণ করে পুঁজিপতি ও পুঁজিবাজার। শিল্প-সাহিত্যে তাদের যেভাবে তুলে ধরা হয়, তাতেও এই নির্মিত পরিচিতির অনুবর্তন মুখ্য। সংস্কৃতির ভেতরে সূক্ষ্ম একটি প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার ইচ্ছা ও অভিলাষসমূহ, তার নানাবিধ পরিচিতি নির্মাণ ও তার প্রকাশের বিষয়টি ঢুকে পড়ে। সংস্কৃতির উচ্চ-নিচ বিভাজনে ধ্রুপদ ও ভদ্রজনের সংস্কৃতি ও গণসংস্কৃতির (অথবা লোকজ সংস্কৃতির) পৃথক্‌করণে ক্ষমতার এসব উদ্দেশ্য প্রকাশিত। দেশের শতকরা এক বা দুই ভাগ মানুষ যে সংস্কৃতির সেবক বা বোদ্ধা তা উচ্চ এবং বাকিদের সংস্কৃতি নি্ন সংস্কৃতি হওয়ার পেছনে রুচি, চর্চা ও শুদ্ধতার একটা কৈফিয়ত খাড়া করা হয় বটে, কিন্তু গণসংস্কৃতি অরুচিকর বা অচর্চিত অথবা অশুদ্ধ-এ রকম বলাও তো যুক্তিযুক্ত নয়। অথচ এ বিভাজনের আড়ালে এলিট শ্রেণী তাদের ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রয়োগ করে গেছে। গণসংস্কৃতির একজন তাত্ত্বিক, স্টুয়ার্ট হল, বলেছেন, এলিট সংস্কৃতি পিতৃতান্ত্রিক, তাই এর পৃষ্ঠপোষকতার অভাব হয় না। গণসংস্কৃতি গণতান্ত্রিক-নারীরও সেখানে অংশগ্রহণ রয়েছে। আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি প্রায় সম্পূর্ণ মাতৃতান্ত্রিক। সেগুলো কখনো এলিট সংস্কৃতির মর্যাদা পায়নি। অথচ জীবনের উত্তাপ ধরে রাখতে, এর প্রকাশ ঘটাতে এ সংস্কৃতির তুলনীয় কিছু নেই।
সংস্কৃতির যেকোনো পাঠ এর ভেতরের বিভিন্ন অর্থ উদ্ধারের একটি প্রয়াসও বটে। নিহিতার্থ বা গূঢ়ার্থ ছাড়াও রূপক বা প্রতীকী অর্থ, বিভিন্ন ডিসকোর্সের সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থও এ উদ্ধার-প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে দাঁড়ায়। সংস্কৃতির অথবা জীবনের কোনো অভিজ্ঞতার কোনো অর্থই অবশ্য স্থির-নির্দিষ্ট নয়; নিয়ত এর পরিবর্তন ঘটে, এবং নতুন নতুন অর্থের সমাহার ঘটে। লোকজ জীবনে বিচ্ছেদের ঘটনাগুলোর আপাত রূপ এক হলেও ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে, সময় থেকে সময়ে এর অর্থ পাল্টায়। বারোমাস্যা গানে যে বিরহ, তার অর্থ এখন ৫০ বছর আগের জায়গায় নেই। সামাজিক আচারের অর্থও পাল্টায়। সংস্কৃতির এই অর্থ পড়ার প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যন্ত এদের পেছনের বিন্যাসটি ধরা পড়ে। এ বিন্যাসটি বা বিন্যাসগুলো সংস্কৃতির ভেতরের কাঠামোকে জানতে সাহায্য করে। এই ভেতর-কাঠামোটিও পরিবর্তনশীল, কিন্তু তা বোঝা গেলে সংস্কৃতির শক্তি ও দুর্বলতার জায়গাগুলো জানা আমাদের সম্ভব হয়।
সংস্কৃতিপাঠের আরও সমস্যা আছে। সংস্কৃতি বলতে একবচনীয় যে চিন্তা উঠে আসে, তা কতটা সঠিক? বাংলাদেশে কি একটিই সংস্কৃতি? এবং সেই সংস্কৃতি সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর? বাঙালি মুসলমানের? নাকি তাতে অমুসলমানদের সমান অংশগ্রহণ রয়েছে? তাহলে এই সংস্কৃতি কি বাঙালির? তাহলে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর সংস্কৃতি কি এই একক সংস্কৃতির বাইরের? যদি সব জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে, তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে একটি শব্দে প্রকাশ করতে হয়, তাহলে কি সংস্কৃতি না বলে তাকে সংস্কৃতিসমূহ বলা উচিত নয়? এখন সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের যুগ। এখন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে ঊন ভাবার এবং তাকে মূলধারার সংস্কৃতির বাইরে রাখার কোনো যুক্তি নেই। সংস্কৃতি তো সংখ্যার কোনো বিবেচনা নয়, পরিমাণেরও নয়, তাহলে সংস্কৃতিসমূহ বলতে দোষ কোথায়? বিশেষ করে বর্ণনামূলক বা ব্যাখ্যামূলক পরিচিতিতে? ধারণাগত চিন্তা থেকে সংস্কৃতি একবচনীয় হতে পারে, যেমন এ লেখায় সংস্কৃতি বলতে বাঙালি-পাহাড়ি ও অন্য আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে বোঝানো হয়েছে।
আর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতিও কি একবচনীয়? সেখানেও তো বহুত্ববাদের প্রসঙ্গটি আসে!

২·
সংস্কৃতির একটি পরিচিতি হচ্ছে, এটি নিয়ত পরিবর্তনশীল। এবং পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়ায় সংস্কৃতির নতুন নতুন প্রকাশ ঘটে। অনেক সময় এ রকম অনেক প্রকাশ নিয়ে একই সঙ্গে উচ্ছ্বাস, হতাশা, ক্রোধ বা বিরক্তি অথবা নির্লিপ্ততা দেখা যায় মানুষের মধ্যে-তবে একই মানুষের মধ্যে নয়, বিভিন্ন বয়স, পেশা ও সামাজিক অবস্থানের মানুষের মধ্যে। পশ্চিম থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পাংক রক ও পাংকশিল্পের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পাংকস্টার নামে এ শিল্পের চর্চাকারীরা তাদের পোশাক-আশাক, আচরণ, প্রকাশের শৈলী ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ শিল্পীদের চুল কমলা বা সবুজ রঙে রাঙানো থাকত, পুরুষেরা কানে দুল ও শরীরে গয়না পরত, গান গাওয়ার সময় তাদের অঙ্গভঙ্গি অনেক সময় অশ্লীলতার পর্যায়ে পড়ে যেত। তাদের গান ও বাজনায় ধুমধাড়াক্কাই ছিল বেশি। দেখা গেল, বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী পাংকশিল্পের অনুরক্ত ও ভক্ত হয়ে গেল। রক্ষণশীলদের জন্য যারা ছিল চক্ষুশূল, তরুণদের জন্য তারা হয়ে দাঁড়াল আদর্শ। এর কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় নানা নীতি, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে পাংকশিল্পীরা কঠোর অবস্থান নিয়ে তাদের গানে ও অন্যান্য শিল্পে তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। পাংকশিল্পের সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তরুণদের নানা ক্ষোভ ও দ্রোহকেই এই শিল্প উপজীব্য করেছিল। মূলধারার শিল্পের প্রতিষ্ঠিত নন্দনতত্ত্বের বিপরীতে পাংকশিল্প এক প্রতিনন্দনতত্ত্ব তৈরি করেছিল। বেশ কিছুদিন এর স্থায়িত্ব ছিল। তারপর নতুন অন্যান্য সাংস্কৃতিক উৎসারণ এর ইতি টেনেছে।
বাংলাদেশেও তরুণেরা তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক প্রকাশ ঘটাচ্ছে। ব্যান্ড ও ফিউশন নামের নতুন কিছু সংগীতধারা বহু তরুণের আনুগত্য অর্জন করেছে। রক্ষণশীলেরা এ নিয়ে বিচলিত। তারা বিচলিত আকাশ-সংস্কৃতি নিয়েও। কিন্তু এসব নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। সংস্কৃতির কোনো একক প্রকাশ নেই, একক সেবকশ্রেণীও নেই। সংস্কৃতির ভেতরের জায়গাটি কোনো জমিদারের বাগানবাড়ি নয় যে শুধু আমন্ত্রিতদের সেখানে প্রবেশাধিকার। বরং এটি নদীর তীরে বিশাল একটা খোলা মাঠের মতো। সবারই সেখানে আমন্ত্রণ। সেই মাঠে বসে কেউ গুনগুন করে রবীন্দ্রসংগীত গাইবে, কেউ শামসুর রাহমানের কবিতা পড়বে, একজন কিবরিয়া অথবা একজন শম্ভু আচার্য সেখানে ছবি আঁকবেন, একজন সত্যজিৎ রায় ছবি বানাবেন, একটু দূরেই আরেকজন বানাবেন কোটি টাকার বুয়া। এই খোলা মাঠে তরুণেরা বাজনা-বাদ্য বাজিয়ে ধুমধাড়াক্কা গান গাইবে, আবার লালনের গানও শোনা যাবে অন্য একটি প্রান্তে। এই সহাবস্থানে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ সংস্কৃতির ভেতর এমন অনেক উপাদান আছে যা মানুষ তার চিরদিনের সঞ্চয়ে রেখে দেয়। যেমন রবীন্দ্রনাথ। যেমন সত্যজিৎ রায়। এই সঞ্চয়ের পরিচয়টি উচ্চ বা শুদ্ধ বা ধ্রুপদী যা-ই দেওয়া হোক, এটি সংস্কৃতির অন্য প্রকাশের সঙ্গে বিরোধে যায় না; আমরাই বরং সেই বিরোধটি তৈরি করি, ক্ষমতা তৈরি করে এই বিরোধ। সংস্কৃতির যে প্রকাশগুলো পরিবর্তনের হাওয়ায় হারিয়ে যায়, সেসবও হয়তো নতুন রূপে ফিরে আসে। এই তথাকথিত ‘পপুলার’, ‘গণ’ অথবা ঊনজনের সংস্কৃতিকে খাটো করে দেখার কোনো কারণ নেই। বরং তাদের ভেতরের উত্তেজনা, আবেগ, স্বপ্ন অথবা ক্ষোভ ইত্যাদি বুঝতে পারলে তা সংস্কৃতির জন্যই ভালো।
বিচলিত হওয়ার বরং অন্য একটি কারণ রয়েছে। এবং সেটি হচ্ছে, আমাদের শিশুদের সুপ্ত সংস্কৃতি-চেতনাকে জাগিয়ে তোলে-সে রকম শক্তি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় না থাকা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিচলিত হওয়া উচিত এবং এই বিচলন থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজা উচিত।
[&ৗ৬৫৫৩৩;][&ৗ৬৫৫৩৩;] সৈয়দ মনজুরুল ইসলামঃ কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন