বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৯

বাংলাদেশে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে

ডঃ আবুল কাশেম ফজলুল হক

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা বা সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন । তাছাড়া টুপী দাঁড়িওয়ালা এবং হিজাবধারীদের নানাভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে এমন অভিযোগও উঠছে । এসব বিষয় নিয়ে সম্প্রতি রেডিও তেহরান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডঃ আবুল কাশেম ফজলুল হকের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহন করে। রেডিও তেহরানের সৌজন্যে সাক্ষাৎকারটি এখানে পুন:প্রকাশিত হলো:


প্রশ্ন: আচ্ছা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে, পিরোজপুরে বোরখা পরা তিন ছাত্রীকে কয়েকজন বখাটে ছেলে রাস্তায় উত্যক্ত করে। ছাত্রীরা প্রতিবাদ জানালে বখাটেরা জেএমবি, জেএমবি বলে চিৎকার করে । এক পর্যায়ে পুলিশ জেএমবি সন্দেহে নিরীহ ঐ তিন ছাত্রীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং জেল হাজতে পাঠায়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ এবং আলেম সমাজ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন । এ বিষয়টিকে অনেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে উত্যক্ত করার পরিকল্পিত কাজ বলে মনে করছেন । আপনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন ?

ডঃ আবুল কাশেম ফজলুল হক : দেখুন, বখাটে ছেলেরা অনেক সময় মেয়েদের উত্যক্ত করে । বোরখা পরা বা হিজাব পরা ছাড়াও অনেক সাধারণ মেয়েকেও উত্যক্ত করে বখাটে ছেলেরা । এরকম ঘটনা কিন্তু কম নয় । কোনো সমাজ ব্যবস্থা যখন ঢিলেঢালা হয়ে পড়ে বা অবক্ষয়ক্লিষ্ট হয় তখন এ ধরনের সমস্যা বৃদ্ধি পায় । বাংলাদেশে গত প্রায় ২৫ বছর ধরে ধর্ম নিয়ে তীব্র বিরোধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে । ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মধ্যে অনেকে অসহিষ্ণু আছেন । তারা ধর্মীয় যে কোনো কিছু দেখলে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন । আবার ধর্মীয় শক্তিগুলোর মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা অসহিষ্ণু । এই দুই ধারার অসহিষ্ণুদের নিয়ে বাংলাদেশের সমাজে একটা বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আর এর ফলে আমাদের জাতীয় জীবনের মূল সমস্যাগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে । আপনার প্রশ্নের মধ্যে যে বিষয়টিকে এনেছেন এবং কেউ কেউ এটাকে যে পরিকল্পিত প্রয়াস হিসেবে দাবী করছে সে সম্পর্কে আমি বলবো - হ্যাঁ এটাকে পরিকল্পিত প্রয়াসও বলা যায় যেতে পারে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বতস্ফূর্তভাবে অনেক বখাটে ছেলে এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে । এক্ষেত্রে দেশের আইন রক্ষাকারী সংস্থা যেমন পুলিশ - তাদের উচিত এ ধরনের বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখা এবং সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করা ।
এছাড়া যারা সমাজের অভিভাবকস্থানীয় চিন্তাশীল লোক - যাদেরকে আমাদের দেশে বা সমাজে বুদ্ধিজীবী বলা হয় - তাদের কর্তব্য হচ্ছে এসব বিষয়ে সমাজের মূল্যবোধকে ঠিক রাখা এবং সেই প্রেক্ষাপটে জনসাধারণ ও তরুণদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রকাশ করা । কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় দূর্ভাগ্য হচ্ছে - আমরা বড় ধরনের সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যে আছি । এই অবক্ষয়কালে আমরা দেখতে পাচ্ছি রাজনীতিবিদদের মধ্যেও দলাদলি রয়েছে একইসাথে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছে দলাদলি । আর এই দলাদলির মধ্যে যারা লিপ্ত রয়েছেন সাধারণভাবে তারা সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক চিন্তা করেন না । কিন্তু সামাজিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন নারী পুরুষ সম্পর্ক, ধর্ম এবং ধর্মনিরপেক্ষতা- এসব ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি বাঞ্চনীয় বলে আমি মনে করি ।

প্রশ্ন: সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অভিযোগ উঠেছে যে, ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি অনুগত ব্যক্তি বা পরিবারগুলোকে নানাভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে । যেমন- যারা নামাজ পড়েন এবং টুপি দাঁড়ি রাখেন তাদেরকে একটি দলের সমর্থক আখ্যা দিয়ে হয়রানী করা হচ্ছে । আবার মেয়েরা ইসলামী বিধান পালনের জন্য যদি বোরখা কিংবা মাথায় স্কার্ফ পরেন তাহলে তাদেরকে জেএমবি বলা হচ্ছে । এ বিষয়ে আমি আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি, বাংলাদেশ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ । ফলে এই পরিস্থিতি অদূর ভবিষ্যতে সমাজে কি ধরণের প্রভার ফেলবে বলে আপনি মনে করেন ?

ডঃ আবুল কাশেম ফজলুল হক : আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন করেছেন । আর আপনি যে বিষয়গুলোর কথা বল্লেন, এরকম পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে তাহলে তার ফল সমাজে খুবই খারাপ হবে । আমি মনে করি আমাদের রাষ্ট্রের উচিত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অবলম্বন করা । আর সেই নীতি বাস্তবায়িত করবেন সরকার । শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অর্থ হচ্ছে যারা ধর্মকে অবলম্বন করে ধর্মসম্মত জীবনযাপন করতে চান তাদের সেই অধিকার এবং সুযোগ সুবিধা পূর্ণ মাত্রায় থাকা । অন্যদিকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং গণতন্ত্রের আদর্শকে অবলম্বন করে যারা চলতে চান তারা ধর্মনিরপেক্ষনীতি নিয়ে চলবেন । একই সমাজে বিভিন্ন ধারার বিভিন্ন নীতির লোক থাকবে । আমি এ প্রসঙ্গে বলবো গণতন্ত্র সম্পর্কে তো নানা ধারণা আছে । সব গণতন্ত্রের আদর্শ কি এক রকমের ? এ সব ক্ষেত্রেও অনেক পার্থক্য রয়েছে । যারা ধর্ম অবলম্বন করেন তাদের মধ্যেও মতপার্থক্য আছে । তাছাড়া আমাদের দেশে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টান ও জৈন এসব ধর্মের লোক কমবেশী রয়েছে । তো একটি রাষ্ট্রের ভেতরে বা একটি জাতির মধ্যে নানা ধর্ম এবং নানা মতাদর্শের লোকদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি একান্ত দরকার । যারা গণতন্ত্রের আদর্শ নিয়ে লিখেছেন চিন্তা করেছেন বা গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছেন- তারা কোনো না কোনোভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানের কথা বলেছেন । ইসলাম ধর্মেও এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা খুবই গুরুত্বের সাথে বলা হয়েছে । অন্য কোনো ধর্ম বা মতাদর্শের মধ্যে এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলার আগে অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি সবার আগে এই সহাবস্থানের কথা ইসলাম বলেছে । ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে খুব সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলেছেন । কিন্তু গণতন্ত্রী বা সমাজতন্ত্রীদের দিকে তাকালে লক্ষ্য করি অসহিষ্ণুতা । আমরাই টিকবো অন্যদের টিকতে দেব না এরকম ইমমেটিয়্যুড বা অপরিপক্ক দৃষ্টিভঙ্গী । আর এগুলোর কারণে আমাদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে । যেকোনোভাবেই হোক না কেন আমাদের উচিত সব ধর্মের লোকদের মধ্যে সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গী বা সহাবস্থানের মধ্যে চলার নীতি গ্রহণ করা । বার বার আমি সহাবস্থানের কথা বলছি কারণ এটিই সামাজিক শান্তি বিধানের একমাত্র পথ ।

প্রশ্ন: ইতোমধ্যে অনেকে বলছেন, বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মহল ক্ষমতায় যাওয়ার কারণে এবং ইসলামী মূল্যবোধের ব্যাপারে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদীদের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উপর এক ধরণের চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে । এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন ?

ডঃ আবুল কাশেম ফজলুল হক : দেখুন , বাংলাদেশে বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে । আর তারা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের দাবীদার । কিন্তু আওয়ামী লীগ যে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে খুব ভালোভাবে বোঝেন সেটি আমার মনে হয় না । অনেকটা শোনা কথার মতো তারা ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিকে গ্রহণ করেছেন । আর যদি সত্যিই আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি বুঝতেন - তাহলে তারা উপলব্ধি করতেন গণতন্ত্রই তো একটা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মতবাদ । আর সেক্ষেত্রে আলাদাভাবে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ রাখার কি দরকার বা বলারই বা কি দরকার ! এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না নিয়ে বাইরের নানা শক্তির প্রভাবে এই কাজগুলো করা হয় ।
আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলছে -যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে তো ধর্মের প্রশ্ন , দাঁড়ি টুপি হিজাব বা বোরখার বিষয়টি একত্রিত করা উচিত না । কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সমাজের স্তরে স্তরে তাই করে ফেলা হচ্ছে । এছাড়া আরো একটি বিষয় রয়েছে আর তা হচ্ছে - যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কিভাবে তারা করবেন - সে জন্যে তারা আন্তর্জাতিক শক্তি বা সমাজের কথা বলছেন; জাতিসংঘের কথা বলছেন । কিন্তু যুদ্ধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়টি তো সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার । ঐ যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিল পাকিস্তান - তারা আমাদের বিপক্ষে ছিল । ঐ যুদ্ধে ভারতও সরাসরি যুক্ত ছিল । কাজেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটি বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যেই তো থাকা উচিত । এর মধ্যে জাতিসংঘকে ডেকে এনে কি সুফল হবে ? আমি তো দেখতে পাই জাতিসংঘ বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন করছে । ফলে যুদ্ধাপরধীদের বিচারের বিষয়টির সঙ্গে ধর্মকে একাকার করে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়াকে আমি অন্যায় বলে মনে করি । এ কাজটি কখনও আওয়ামী লীগ আবার কখনও বামপন্থীমহল করে থাকে । আর এর ফল আমাদের সমাজে খুবই খারাপ নজীর হয়ে থাকছে ।
আমি এ প্রসঙ্গে আরো বলবো- আমাদের দেশে তো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিকশিত করা হয়নি । আর এ কাজটি বুদ্ধিজীবীরা বা রাজনীতিবিদ কেউ করেননি । আমাদের দেশে গণতন্ত্র এখনও নিতান্তই একটা মুখের কথা হিসেবে আছে । গণতন্ত্র সম্পর্কে এখনও বৃহত্তর সংখ্যক শিক্ষিত লোকদের পড়ার মতো কোনো বই আমাদের দেশে প্রকাশিত হয়নি । গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের কোনো রাজনৈতিক নেতা বা দল স্পষ্টভাবে তাদের গণতান্ত্রিক দর্শন বা আদর্শের কথা ব্যক্ত করেননি । অন্তত আমরা দেখিনি । তো বাংলাদেশে কি করে শুধু শোনা কথা আর জনসভায় বক্তৃতা বা বিবৃতির ভিত্তিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত না হওয়ার কারণে - ধর্মীয় শক্তিকে নিয়ে একটা অসহিষ্ণুতা প্রদর্শনের বিষয় হয়ে আছে । গণতন্ত্রের ব্যাপারটি তারা যদি বুঝতে চেষ্টা করতেন, ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি যদি তারা বুঝতে চেষ্টা করতেন - তাহলে তারা অবশ্যই ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে বিরোধে যেতেন না । তারা সেটি বুঝতে সক্ষম হলে এ ধরণের বিরোধকে অতিক্রম করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ তারা খুঁজতেন।
আবার ধর্মীয় শক্তির দিক থেকেও বলবো ঠিক আন্তরিকভাবে রাজনীতিতে ধর্মকে অবলম্বন করার তেমন কোনো প্রায়াস দেখতে পাইনা । একটা সুবিধা নেয়ার জন্যেই ধর্মের কথা বলা হয় । এজন্যে ওদিক থেকেও সমস্যা আছে । রাজনীতির বিচারে দেখতে গেলে ধর্মপন্থী শক্তিগুলোর মধ্যেও আদর্শবোধের অপ্রতূলতা লক্ষ্য করি । আর গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে এই আদর্শবোধের ঘাটতি বা অপ্রতূলতা আরো বেশী । কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক গণতান্ত্রিক আদর্শের আকর্ষণ বাংলাদেশে অনেক বেশী লোকের মধ্যে রয়েছে । বেশীরভাগ মানুষ গণতন্ত্রকে পছন্দ করেন এবং ধর্ম বিষয়ে তারা নীরব থাকতে চান । যার ধর্ম তার কাছে - পরষ্পর স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবেন এটাই চান অনেকে । রাজনীতিতি ধর্ম নিয়ে সংঘাত বা সংঘর্ষ হোক এটা তারা চান না ।
আর এই বাস্তবতার মধ্যে আমাদের দেশে গত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে ধর্ম নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও ধর্মীয় শক্তির মধ্যে অসহিষ্ণুতা চলছে ।এমনকি রক্তপাত , খুনাখুনির মতো ঘটনাও কখনও কখনও ঘটছে । আর এ বিষয়টি সত্যিই খুব দুঃখজনক । এর নেপথ্যে বাইরের প্রচার মাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে । বিবিসি রেডিও একটি শক্তিশালী প্রচারমাধ্যম । বিবিসি রেডিও প্রতিদিন বাংলা ভাষায় যে অনুষ্ঠান প্রচার করে তাদের সেই অনুষ্ঠানের মধ্যে গত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে প্রতিদিন নানাভাবে উস্কানীমূলক বিষয় প্রচার করছে । সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের সাথে ধর্মীয় শক্তির একটা মারামারি, বিবাদ, সংঘাত এবং সংঘর্ষ জিইয়ে রাখতে বা একটা হিংসার সম্পর্ক অটুট রাখতে সচেষ্ট এই মাধ্যমটি । তার আগে এ মাধ্যমটি যে অবস্থা থাকুক না কেন গত ত্রিশ বছর ধরে বিবিসি রেডিও এই কাজটি ব্যাপকভাবে করেছে ।
আমরা যদি ভয়েস অব আমেরিকার দিকে তাকাই তারাও বাংলায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে । তারাও একইভাবে রামমন্দির বা বাবরী মসজিদ বিরোধকে তীব্রতর করার জন্যে উস্কানী দেয়ার ক্ষেত্রে ভয়ানক ভূমিকা পালন করেছে বলে আমি মনে করি । একইভাবে বাংলাদেশেও ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয় শক্তির মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি যাতে লঙ্ঘিত হয় এবং আমাদের রাষ্ট্র সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যাতে ভেতর থেকে দূর্বল হয়ে যায় ; দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ড দূর্বল হয় - সেজন্যে ভয়েস অব আমেরিকা, স্কাই নিউজ , বিবিসি রেডিও এবং টিভি সর্বাত্মক কাজ করছে । পাকিস্তান , ভারত এবং বাংলাদেশকে নিয়ে যে বিরাট উপমহাদেশ- সেখানে আধিপত্য বিস্তারের জন্যে ইঙ্গো মার্কিন শক্তি ভীষণভাবে তৎপর । আর সেই স্বার্থে এধরণের কাজ তারা করছে ।

প্রশ্ন: অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক - আামি সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইবো - দাঁড়ি টুপি পরার কারণে কিংবা মাথায় স্কার্ফ পরার কারণে যদি নাজেহাল হতে হয় কিংবা কটুক্তি শুনতে হয় তাহলে এটা কি ধরে নেয়া যায় না যে বাংলাদেশে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর এক ধরণের সীমাবদ্ধতা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয়েছে ?

ডঃ আবুল কাশেম ফজলুল হক : দেখুন , সবাইকে একটা জিনিস বুঝতে হবে - যখন পক্ষ- প্রতিপক্ষ দেখা দেয় - তখন প্রতিপক্ষ পক্ষকে নানানভাবে হয়রানি করা ও দূর্বল করার চেষ্টা করে । বাংলাদেশের সমাজে যারা উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী তারা ধর্মীয় শক্তিকে দমন করে রাখার চেষ্টা করছে । তাদেরকে দূর্বল করে পারলে নিঃশেষ করে দেয়ার চেষ্টা করছে । ফলে এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় ধর্মীয় শক্তির স্বাধীনতার উপর এক ধরণের সীমাবদ্ধতা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরী হচ্ছে । এই অবস্থায় ধর্মীয় ধারা যারা অবলম্বন করছেন তাদেরকে সতর্কতার সাথে চলতে হবে । অনেক বিরোধ এড়িয়ে চলতে হবে। ধর্মকে গভীরভাবে বুঝতে হবে এবং একইসাথে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানকে গভীরভাবে ধারণ করতে হবে। যদি এভাবে ধর্মীয় শক্তি অগ্রসর হয় তাহলে তারা একটি ভালো সমাধানের দিকে যেতে পারবেন এবং তারাও সফল হবেন । আপনি প্রশ্নের মধ্যে যে বিষয়টি এনেছেন যে ধর্মীয় শক্তি সাপ্রেসড ফিল করছে এবং তাদের উপর সাপ্রেশন চালানো হচ্ছে এতে অবশ্যই কিছু না কিছু সত্য আছে । কিন্তু সেই সাথে এটিও মনে রাখতে হবে গণতন্ত্রের নামে যারা জবরদস্তিমূলক নীতি নিয়ে কাজ করছে তারা গণতন্ত্রের চিন্তা চেতনাকেও বিকশিত হতে দিচ্ছে না- একরকম সাপ্রেশন গণতন্ত্রীদের উপর চালাচ্ছে । তাছাড়া সমাজতান্ত্রিক আদর্শেরও কিছু লোক আমাদের দেশে আছেন তাদের ক্ষেত্রেও যতোটা অধিকার নিয়ে কাজ করার সুযোগ একটা রাষ্ট্রে থাকা উচিত সেটা এখানে নেই । সবকিছু মিলিয়ে আমি একথা বলতে চাই খুব অস্বাভাবিক অবস্থা চলছে বাংলাদেশে । বিশেষ করে রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবং বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহের নিয়ন্ত্রণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় রয়েছে। স্বাধীনভাবে একটি রাষ্ট্র বা সরকার চললে সমস্যাগ্রস্ত এসব বিষয়ের মিমাংসা যেভাবে হয় বা হয়ে থাকে বিদেশী শক্তির প্রত্যক্ষ আধিপত্যের মধ্যে পড়ে গেলে সেভাবে মীমাংসা করা সম্ভব হয় না ; তখন সমস্যা আরো অনেক বেশী সৃষ্টি হয়।

(তথ্যসূত্র : রেডিও তেহরানের সৌজন্যে সংগৃহীত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন