বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৯

জয়নাব

হাসনাত আবদুল হাই


জয়নাব আত্মহত্যা করেছে, এ বিষয়ে প্রথমেই সন্দেহ দেখা দেয়নি, কেননা নিজের হাতেই চিঠি লিখে সে একথা জানিয়েছে। কিন্তু মাত্র উনিশ বছর বয়সের দেখতে-শুনতে একটা সুশ্রী মেয়ে বলে কথা না, যে মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ফোর পেয়ে পলিটেকনিকে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে ভর্তি হয়েছে এবং যার সামনে সুন্দর এক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে সে কেন আত্মহত্যা করতে যাবে, এই প্রশ্ন অনেকের মনেই দেখা দেবে। সে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে যা বলেছে তা সহজেই, তার লেখা চিঠি পড়া মাত্রই খুঁজে পাওয়া যাবে না। যারা তার খুব অন্তরঙ্গ তাদের পক্ষেও কারণ খুঁজে পেতে সময় নেবে এবং তারপরও তাদের ভাবতে হবে ঘটনা যেমন মনে হচ্ছে সত্যিই তা কিনা, নাকি এর আরো নিগূঢ় অর্থ লুকোনো রয়েছে।

জয়নাব সোজা-সাপ্টা ‘আমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী’ এ ধরনের চিঠি লেখেনি, যদিও সে যে আত্মহত্যা করেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ রাখেনি। যখন কেউ মনের দুঃখে প্রিয় এই পৃথিবী ও পরিচিত জীবন ছেড়ে চলে যায় তখন বুঝতে হবে যে তার দুঃখের পেছনে সে একা নয়, আরো কেউ বা অনেকে আছে। আত্মহত্যা করে যেসব মেয়ে, তাদের আত্মমর্যাদাবোধ খুব প্রখর এবং তারা সাধারণ মানুষের মত কাউকে দোষ দিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় না। যাদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ, যে বা যারা তাদের দুঃখের কারণ তাদের নাম তারা সরাসরি উল্লেখ করে না, কেননা করা হলে নিজেকে ছোট করতে হয়। তারা এমনভাবে কারণ ব্যাখ্যা করে যে, যারা তাকে ভালভাবে চেনে তাদেরকেও বুঝে নিতে হয়। আভাস-ইঙ্গিত দিয়েই তারা বুঝিয়ে দিতে চায় কেন তাদের পক্ষে আর বেঁচে থাকা সম্ভব হলো না।

জয়নাব তার মাকে উদ্দেশ্য করে চিঠিটা লিখেছে, কেননা তার বাবা বেঁচে থেকেও নেই। তার বাবার এই অনুপস্থিতি পরোক্ষে থেকে একটা কারণ হিসেবে কাজ করেছে, এই অনুমান করা যেতে পারে। যে অভিমান নিয়ে সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল সেটা তার বাবার কারণে কিছুটা হলেও জমেছে। বলা যায় তার বাবাকে দিয়েই তার জীবনের দুঃখ শুরু। তার বাবা তার জীবন থেকে অনুপস্থিত না থাকলে যে অনুভূতি নিয়ে সে শেষ চিঠিটা লিখেছে তার জন্ম হতো না। শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়ায় যে, পুরুষ জাতির বিরুদ্ধেই ক্ষুব্ধ এবং বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে তাদেরকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সে শাস্তি দেবার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন করেছে। এই বিচার এবং শাস্তি প্রদান মানুষের তৈরি আইন-কানুনের বাইরে নৈতিকতার যে অমোঘ বিধি-বিধান তার ভিত্তিতে তৈরি। এক নজরে এই বিচার ও শান্তির সূক্ষ্ম কিন্তু তীব্র অভিঘাত চোখে পড়ে না কিন্তু যতই দিন যায় যারা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিল, বিচার ও শাস্তির পেছনে যে অভিযোগ তা তাদের মর্মে প্রবেশ করে এমন অশান্তির সৃষ্টি করতে পারে যা শারীরিক যাতনার চেয়েও বেশি। জয়নাব যেভাবে তার চিঠি লিখেছে তাতে যে বা যাদের উল্লেখ করে তার অভিযোগ তারা ঠিকই বুঝতে পারবে জয়নাবের ক্ষোভ এবং ঘৃণা কাদের বিরুদ্ধে।

জয়নাব তার মাকে লিখেছে ‘তুমি প্রথম স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে পুত্র-কন্যা নিয়ে যেভাবে দ্বিতীয় স্বামীর ঘর এবং তারপর নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে গলগ্রহের মত জীবন-যাপন করে দুঃখে-অপমানে দিনাতিপাত করেছো আমাকেও যেন সেই রকম অভিশপ্ত জীবন-যাপন করতে না হয় এবং আমাকে দুঃখের জীবন-যাপন করতে দেখে তোমারও যেন মনোকষ্ট না হয় সেই জন্য আত্মহত্যার এই পথ বেছে নিলাম। তফাৎটা এই তুমি পুত্র-কন্যা নিয়ে হতভাগিনীর জীবন-যাপন করেছো এবং ভাগ্যকে দোষারোপ করেছো, আমি পুত্র-কন্যার মা হবার আগেই ভাগ্যকে তাচ্ছিল্য করে বিদায় নিচ্ছি। তোমার বহু বছরের পুঞ্জীভূত দুঃখ আমি কয়েকদিনের দুঃখের ভেতর সঙ্কুচিত করে তাকে অতিক্রম করে চলে যাচ্ছি। দুঃখ তো তখনই অসহনীয় হয় যখন তা নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে দীর্ঘকাল পাশে পাশে থাকে। দুঃখকে আমি ক্ষণকালের সময় দিয়েছি যখন সে আমার নিত্যদিনের সঙ্গী হতে চেয়েছে এবং তারপর তাকে জীবনের প্রদীপ নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে বিদায় দিয়েছি। এইভাবে আমি দুঃখ জয় করেছি, যা তুমি পুত্র-কন্যার মুখের দিকে তাকিয়ে পারোনি। পুত্র-কন্যা তোমাকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে দেয়নি, তাদের প্রতি কর্তব্যবোধ থেকে তুমি ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও বাবার বাড়ির আশ্রয়ে থেকে সৎমার কটু-কাটব্যের গ্লানি সহ্য করে দিনাতিপাত করেছো। তুমি ভেবেছো তোমার ছেলে কিংবা মেয়ে বড় হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলে তোমার জীবনের দুঃখ-কষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা সবকিছু সার্থক হবে। তুমি ভাবতেও পারোনি যে, তোমার মেয়ের জীবন ঠিক তোমার মত না হলেও সেই জীবনে একই শ্রেণীর অবমাননা এবং দুঃখ নেমে আসবে, যা তার সঙ্গে তোমাকেও আমৃত্যু দহন করবে। আমার জীবনে ভিন্নভাবে হলেও তোমার জীবনের ছায়া দেখতে পাও, এটা আমি চাইনি বলেই আমাকে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হলো।’

চিঠিতে ওপরের কথাগুলো জয়নাবের অশিক্ষিত মা যতটুকু বুঝতে পারবে অন্যেরা সঙ্গে সঙ্গে ততটুকুই বুঝতে পারবে। তাদেরকে জল্পনা-কল্পনার সাহায্য নিতে হবে, নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনায় লিপ্ত হতে হবে। কেউ তার চিঠির অর্থ বুঝবে, কেউ বুঝবে না। যারা বুঝবে না তারা বলবে মেয়েটা বড় আবেগপ্রবণ ছিল। কেউ বলবে, বয়সের কারণে জয়নাবের চরিত্রে বা ব্যক্তিত্বে পরিপক্বতা আসেনি। অথচ তারা উপেক্ষা করবে এই বিষয়টি যে, আত্মহত্যা এমন এক সিদ্ধান্ত যা কেবল দৃঢ়-চেতনাসম্পন্ন মানুষই নিতে পারে। আবার একজন মানুষ যখন আত্মহত্যার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েও করে না সেখানেও চরিত্রের দৃঢ়তা থাকে। আত্মহত্যার সব প্রস্তুুতি নিয়েও কেউ যখন নিজেকে শেষ মুহূর্তে বিরত রাখে তখনও সেখানে দৃঢ় মনোভাব কাজ করে। আত্মহত্যার প্রস্তুুতি শেষ করেও জীবন ত্যাগ না করার মধ্যে কাপুরুষতা বা ভয়ের আভাস থাকে না। বেঁচে থাকতে না চেয়েও বেঁচে থাকার জন্য যখন সিদ্ধান্ত কেউ নেয় তখন একই সাহসের প্রয়োজন হয়।

জয়নাব মাত্র উনিশ বছরের গ্রামের এক মেয়ে, তার বাঁচা-মরা এই সংসারের জন্য এমন কিছু বড় বিষয় না- যা নিয়ে মানুষ মাথা খাটাবে। সে যদি সংবাদপত্রে মফস্বলের সংবাদ হিসেবেও স্থান পায় তাহলেও তার গুরুত্ব বাড়ে না, সে সাধারণ এমন এক মেয়ে যাকে নিয়ে বিশদ আলোচনা সময়ের অপচয় বলেই মনে করবে অনেকে। পনেরো কোটি অধ্যুষিত এই দেশে একটি মানুষ থাকলো কী থাকলো না অথবা থাকলেও কীভাবে জীবনযাপন করবে, সেই বিষয় কোনো জাতীয় ইস্যু নয়। তবু ফুটনোট হলেও জয়নাবের মত মেয়েরা আশেপাশের এবং হয়তো দূরের মানুষকে জীবনযাপনের বিচিত্র ও জটিল স্রোতের প্রতি দৃষ্টিপাতে উদ্বুদ্ধ করবে, কেননা এখনো সব মানুষই অনুভূতিহীন এবং বিবেকবর্জিত হয়ে যায়নি। তারা হয়তো জয়নাবের মত মেয়েদের জন্য কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু তাদের মনে যদি সহানুভূতি জাগে তাহলেও জয়নাবদের জীবনের দুঃখ-কষ্ট সার্থক হবে। কেননা এটা তো মানতেই হবে যে, তাদের মত মেয়েরা সহজেই সংবাদ হতে পারে না, সুতরাং যখন তা হয় বেশ আত্মত্যাগের মাধ্যমেই সেটা সম্ভব হয়। জয়নাবের জীবন সম্পর্কে জানতে চাওয়ার কৌতূহলকে ব্যাখ্যা করতে হলে এ ছাড়া আর কোনো যুক্তি দিয়ে বলা যায় না।



২.

জয়নাব যখন পাঁচ বছরের এবং তার ছোট ভাই তিন বছরের সেই সময় তার বাবা এক সকালে মাকে তালাক দেয়। মায়ের কী দোষ ছিল জয়নাব কিংবা তার ভাই সুরুজ তা জানতে পারে না। যে বাড়িতে সে পাঁচ বছর পর্যন্ত বড় হয়েছে সে বাড়ি ছাড়ার আগে সে বাবার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়েছিল কিন্তু বাবার ক্রুদ্ধ চেহারা দেখে নীরবে কান্না ছাড়া আর কিছু করার কথা চিন্তা করতে পারেনি। সে এবং তার ভাই মায়ের হাত ধরে অন্য হাতে পুটুলি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল।

জয়নাবের নানা মোটামুটি সচ্ছল ছিলেন। তিন মেয়ের মধ্যে জয়নাবের মা বড়। বাকী দুই মেয়ের মধ্যে একজনের সদ্য বিয়ে হয়েছে। অন্যজন বিয়ের অপেক্ষায়। তার নাম আমেনা। সবার বড় হলো ভাই সুলতান। তার এক ছেলে আছে। ছেলের নাম মনতাজ, সে জয়নাবের বয়সী।

জয়নাবের মা রাহেলাকে ছেলেমেয়েসহ বাড়ি আসতে দেখে তার বাবা মুন্সী হাফিজুদ্দিন বললেন, বেড়াইতে আইছো? জামাই কই? শুনে রাহেলা কাঁদতে থাকে। আঁচল দিয়ে চোখ চাপা দেয়। তার পাশে এসে দাঁড়ায় সৎ বোন আমেনা, বড় ভাই-এর বউ কুলসুম।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলেন, কী হইছে? কান্দো ক্যান? জামাই মার-ধোর করছে?

না।

তয় হইছে কী? খুইলা কও। হাফিজুদ্দিন হুক্কা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করেন।

তালাক দিছে। কান্না জড়ানো গলায় বলে রাহেলা, বলে জয়নাবের মা।

শুনে চুপ করে থাকেন মুন্সী হাফিজুদ্দিন। তারপর বলেন, ক্যান? তালাক দিতে চাইলো ক্যান? কি হইছে? ট্যাহা-পয়সা চায়?

না। আর একটা বিয়া করবো।

শুনে হাফিজুদ্দিন বলে, তা করলে কী করবা? মুসলমানে চারটে বিয়া করতে পারে। দুইটা এমুন কিছু বেশি না।

রাহেলা কাঁদতে কাঁদতে বলে, সতীনের সঙ্গে সংসার করতে পারুম না। কইয়া দিছি। হুইনা রাগ হইছে। তারপর তালাক দিছে।

শুনে গম্ভীর হয়ে যান মুন্সী হাফিজুদ্দিন। হুক্কায় কয়েকটা টান দিয়ে বলেন, কামডা ভালা করলা না। আমারে কইয়া তারপর জামাইরে জানাইতা। তারপর একটু চিন্তা করে বললেন, এ্যাহনো সময় আছে। হ্যাতো কাগজপত্রে সই করে নাই। তোমারে শুধু মুখের কথা কইছে। আমি তারে ডাইকা একটা মিটমাট করতাম পারি।

কেমুন মিটমাট আব্বা? রাহেলা তাকায় তার দিকে।

তিনি বলেন, এই প্রথমে কমু, কী দরকার আর একটা শাদি করার। মাইয়া আমার এ্যাহনো জোয়ান। অথর্ব হয় নাই, দেখতেও খারাপ মনে হয় না। আরেকডা বউ আইনা সংসারে ঝামেলা বাঁধায়া কাম কী?

রাহেলা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে বলে, আমি অনেক কইছি বুঝাইছি। হ্যা হোনে না। তার এক কথা। আপনে কইলেও হুনবো না। বড় জেদী মানুষ।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলেন, দেখি না চেষ্টা কইরা। না হইলেঃ। তিনি কথা শেষ করেন না।

রাহেলা বলে, না হইলে?

মুন্সী হাফিজুদ্দিন একটা অস্বস্তির সঙ্গে বলেন, তা হইলে সতীনরে মাইনা নাও। একলগে সংসার করো। অনেকেই করতাছে না?

আমি সতীনের লগে সংসার করুম না। রাহেলার দৃঢ় কণ্ঠস্বর।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলে, জেদ কইরা লাভ আছে? মাইয়াদের ঠাঁই হইলো স্বামীর ঘর। বাপের বাড়ি আছো যতদিন আমি আছি। তারপর কী হইবো? কই যাইবা?

রাহেলা বড় ভাই সুলতানের দিকে তাকায়। সে আর তার বউ মুন্সী হাফিজুদ্দিনের কথায় সায় দেয় না। তার ছোট বোন আমেনা বাবার কথায় মাথা নাড়ে। সে বাবাকে সমর্থন করে।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বললেন, আইছো বাপের বাড়ি। থাহো, যাইতে কইতে পারি না। তয় চেষ্টা কইরা দেহি জামাইয়ের মত বদলাইতে পারি কিনা। তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, সুলতান বড় জামাইরে খবর দে দেহি।

সুলতান পরের দিন মুন্সী হাফিজুদ্দিনকে বলে, বাজান হে আইবো না। আরেকডা বিয়ার এনতেজাম করতাছে।

শুনে মুন্সী হাফিজুদ্দিন বললেন, হু। তারপর রাহেলাকে ডেকে বললেন, তোর জামাই হুনলো না। আরেকডা বিয়া করবোই সে। এ্যাহনে তুই ঠিক কর সতীনের লগে থাকবি কিনা। আমি তো কই যা। বড় বউ হিসেবে তোর একটা দাম থাকবো সংসারে।

রাহেলা বলে, না, আব্বা। থাকুম না। তুমি আমারে এইহানে থাকতে দাও। দাসীর মত পইড়া থাকুম।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন হুকার টিকাটা নেড়েচেড়ে বলেন, দাসীর লাহন থাকবি ক্যান? যতদিন বাইচা আছি এ বাড়ির মাইয়া হিসেবেই থাকবি। কিন্তু আমি ভাবতেছি আমার পরে কী হইবো। পেছন থেকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী বলেন, তোমার বাপে ঠিকই কইতাছেন রাহেলা। ভবিষ্যতের কথা ভাইবা সোয়ামীর বাড়ী যাও।

রাহেলা বলে, দরকার হইলে অন্যের বাডিতে দাসীগিরি করুম কিন্তু সতীন নিয়া ঘর করুম না।

এ কথায় তার দ্বিতীয় মা অসন্তুষ্ট হন। কেননা তিনি এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছেন মুন্সী হাফিজুদ্দিনের প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর। তার গর্ভে জন্ম নিয়েছে রাহেলার ছোট দুই বোন আমেনা আর রহিমা। সুলতান আর রাহেলা হাফিজুদ্দিনের প্রথম স্ত্রীর সন্তান। রাহেলা বাড়ীতে এসে থাকবে প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়ের দল ভারী হয়ে যাবে।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন মুখে হাসি এনে জয়নাবকে বলেন, কই থাকবি তোরা? নানা বাড়ি না বাবার বাড়ি। জয়নাবের বয়স তখন সাত বছর। সে সব কথাবার্তা শুনেছে। মায়ের আঁচল ধরে সে বলে, নানার বাড়ি।

তার ছোট ভাই সুরুজকে জিজ্ঞাসা করার পর সেও বলে, নানা বাড়ি। তাদের দুজনকেই বেশ বিষণœ দেখায়। মুন্সী হাফিজুদ্দিন তাদেরকে কাছে টেনে বলেন, আহো নানাবাড়ি। কোনো অসুবিধা নাই। বাগানে ফল পাড়বা। পুকুরে গোসল করবা।

শুনে তার স্ত্রী আড়াল থেকে মুখ বিকৃত করেন।

রাহেলা বলে, হ্যাদের স্কুলে পাঠামু। লেখাপড়া শিখামু।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলেন, বেশ। স্কুলে যাইবো হ্যারা।

রাহেলার বড় ভাই সুলতানের ছেলে মনতাজ গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। সে বললো, হ জয়নাব আমার সঙ্গে স্কুলে যাইবো। মনতাজের মা কুলসুম হেসে বললো, হ যাইবো। জয়নাবের ছোট ভাই সুরুজের স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। তাকে নিয়ে তাই আলোচনা হলো না।

স্কুলের আগে বাড়ীতে থাকার ব্যবস্থা। সেটা নিয়ে গোল বাঁধলো। গোল বাঁধালো সৎ মা আর সৎ বোন আমেনা। পুবের বড় ঘরে থাকেন রাহেলার বাবা ও সৎ মা। দক্ষিণের ঘরে থাকে ভাই সুলতান আর তার বউ কুলসুম, আর উত্তরের ঘরে থাকে আমেনা আর সুলতানের ছেলে মনতাজ। পশ্চিমের ঘরটা পাট রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া মৌসুমওয়ারী অন্যান্য শস্যের বস্তা থাকে সেখানে। মালামালে ঘরটা প্রায় ভর্তি। সেই ঘরে থাকতে হলে মালামাল সরাতে হবে, কিন্তু সরানোর জায়গা নেই। মুন্সী হাফিজুদ্দিন বললেন, রাহেলা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকুক পুবের ঘরে আমেনার সঙ্গে। একটা চৌকি আনাইয়া দিই। শুনে আমেনা বেঁকে বসে। বলে, এত লোকে এক ঘরে হুইলে ঘুমান যাইবো না। তার মা সে কথায় সায় দেয়।

তখন সুলতান বলে, কয়েকদিন থাহো সবাই কষ্টেসৃষ্টে। তারপর কাজের মানুষের ঘর বানাইয়া দিমু। হ্যারা আইয়া গেলে হেই ঘরেই থাকবো পাট আর অন্যান্য মালামাল। তহন পশ্চিমের ঘর খালি হইবো। হেই ঘরে থাকবো রাহেলা আর তার ছেলেমেয়ে।

তার প্রস্তাবে বাবা রাজী হয়। সৎ মা ক্ষোভের সঙ্গে আড়ালে বলেন, হুদাহুদি বাড়তি খরচ। গুদাম ঘরেই একটা চৌকি ফালায়া দিলে হ্যারা থাকতে পারে। অত নওয়াবীর কী দরকার?

রাহেলা সৎ মায়ের কথা শুনতে পায়। সে বলে, বাপজান পাট রাখার ঘরেই থাকতে পারুম আমরা। অসুবিধা হইবো না।

শুনে মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলে, পাটের গন্ধ বড় কড়া। ঘুমাইতে পারবি?

রাহেলা বলে, অভ্যাস হয়া যাইবো।

শুনে বাপ বলে, দ্যাগ পারোস্ কিনা এখনকার মত। পরে একটা ব্যবস্থা করন যাইবো।

বললে বটে কিন্তু পাট রাখার ঘরে থাকতে গিয়ে রাহেলা দেখলো সে বেশ কঠিন ব্যাপার। ঘুমানো দূরের কথা শুয়ে বিশ্রামই নেয়া যায় না। পাটের কড়া গন্ধ পেটে গিয়ে ধাক্কা দেয়। সেই সঙ্গে আছে পিঁয়াজ, মরিচের গন্ধ। মরিচের শুধু গন্ধ না বাতাসে তার গুঁড়া ঘুরে বেড়ানোর ফলে চোখও জ্বালা করে। রাহেলা ছেলেমেয়েদের বলে, চোখ বন্ধ কইরা ঘরে ঢুকবি। বন্ধ কইরা রাখবি। ঘর তো খালি ঘুমানের লাইগা।

ঘরে বসে পড়া হয় না জয়নাবের। দিনের আলোতে উঠোনে বসেই তাকে পড়তে হয়। তাছাড়া একটানা পড়ার সময় পায় না সে। নানী প্রায়ই একাজে সেকাজে ডাকেন। সেই কাজ করতে করতে সময় চলে যায়।

একদিন মনতাজ স্কুলে যেতে যেতে বলে, জয়নাব তুই আমাদের ঘরে সন্ধ্যার সময় আমার লগে পড়তে পারোস্। আমেনা খালা সন্ধ্যায় ঘুমাইতে আসে না। আসে খাওনের পর। ততক্ষণে তোর পড়া শেষ হইয়া যাইবো।

শুনে জয়নাব তার মাকে বলে। মা শুনে বলে, ভাল কথা কইছে। একলগে স্কুলে যায়। একলগে দুইজনে পড়াশুনা কর। ঠিক আছে।

আমেনা সেটা দেখে টিপ্পনি কাটে। বলে, বুবুর মাইয়ার মনে হয় ঘরখানা পছন্দ হয় নাই। অন্যের ঘরে গিয়া পড়াশুনা করে। নাক এত উঁচা হইলে বাপের বাড়ি ছাইড়া না আইলেই হইতো। তার কথা শুনে মা হাসে। সেই হাসিতে বিদ্রƒপ আর খোঁচা দেওয়ার স্বর মেশানো।

রাহেলার ছোট বোন রহিমা পোয়াতি হয়ে মায়ের বাড়ি এসে আমেনার ঘরে থাকা শুরু করলো। পোয়াতির প্রসবের জন্য তৈরি হবে নতুন ঘর। প্রসবের পর সেখানে থাকবে নবজাতক নিয়ে রহিমা।

মনতাজ তার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করলো। জয়নাবের পড়াশুনা আবার উঠানেই।

রহিমা এসেই মা আর ছোট বোন আমেনার সঙ্গে একজোট হয়ে রাহেলার বিরুদ্ধে লেগে গেল। সে কাজকর্ম করে না, বসে বসে খায়। নিজের ছেলে-মেয়েকে বেশি করে খাওয়ায়, সংসারে জিনিসপত্র নষ্ট হচ্ছে, কিছুই দেখে না। এইসব কথা প্রায়ই বলতে থাকে দুই বোন। রাহেলা সব শোনে। সে মুখ বুঁজে থাকে। মেয়েকে সাবধান করে দেয় খালাদের সামনে না যেতে।

বাবা মুন্সী হাফিজুদ্দিন টের পান সংসারে কী হচ্ছে কিন্তু যে কারণেই হোক কিছু বলেন না। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আর হুক্কা খান। দিনের বেলা সুলতানকে নিয়ে জমিতে কাজ দেখতে যান। দুপুরে বাড়ি ফিরে খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম নেন। বিকেলে বার হন প্রতিবেশিদের সঙ্গে কথা-বার্তা বলতে। প্রতিবেশিরাও মাঝে মাঝে তার বাড়ি আসে। তারা রাহেলার ভাগ্য নিয়ে আলাপ করে এবং আফশোস করে। কেউ কেউ বলে, তার স্বামীটা খারাপ মানুষ। তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়াটাই ঠিক হয়নি। রহিমা আসার পর কয়েকদিন দুই মেয়েকে নিয়ে রাহেলার সৎ মা খুব শলা-পরামর্শ করে। তারপর একদিন দুপুর বেলা যখন মুন্সী বিশ্রাম নিচ্ছেন সেই সময় তার দ্বিতীয় স্ত্রী বলেন, রাহেলার স্বাস্থ্য, গতর মাশাল্লাহ ভালই আছে।

মুন্সী তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বলেন, হু।

তার স্ত্রী বলেন, হ্যারে আর একটা বিয়া দেওন যায়। পাত্র আছে।

হ্যা? কি কইলা? বলে মুন্সী হাফিজুদ্দিন এবার পাশ ফিরে শোনে।

কইলাম, রাহেলার নিকাহ্ দিবার কথা। তার স্ত্রী পান চিবুতে চিবুতে বলেন।

নিকাহ্? হ্যা, কে নিকাহ করবো? আর নিকার ঝামেলা আছে না? আরো একটা বিয়া, তালাক এইসব আছে মাঝখান। এইসব হইবো কেমনে?

তার স্ত্রী বলেন, রাজী হইবো না ক্যান? বাপের বাড়ি পইড়া আছে, এইভাবে থাকন কী তার ভালা লাগে? নিজের সংসার কোন মাইয়া না চায়। আর ঝামেলার কথা কইতাছেন? কোন ঝামেলা নাই। রহিমার জামাই সব ঠিক কইরা দিবো কইছে।

মুন্সী পাশ ফিরে বলেন, কইয়া দ্যাহো রাহেলারে। রাজী হয় কিনা।

তার স্ত্রী এবার রেগে যান। বলেন, রাজী হয় কিনা মানে? কিতা কও তুমি? মাইয়ার ঘর হইলো জামাই বাড়ি। বাপের বাড়ি আইয়া থাকলে হইলো? কয়ডা মাইয়া বিয়ার পর বাপের বাড়ি থাহে? হ্যার শরম করে না? করে, করে। হে রাজী হইবো। তুমি শক্ত কইরা কইলেই হইবো।

বাধ্য হয়ে মুন্সী হাফিজুদ্দিন রাহেলাকে কথাটা বলেন। শুনে হতভম্ভের মত তাকিয়ে থাকে রাহেলা। তার শরীর থরথর করে কাঁপে। চোখ ভিজে আসে। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, বাপজান আমি কী বোঝা হইয়া গিছি আপনার সংসারে? তয় আমাদের তিনজনকে কাইটা নদীর পানিতে ভাসাইয়া দ্যান। আর স্বামীর ঘর করুম না। তারপর বলে, নতুন স্বামী কী আমার জয়নাব আর কুতুবরে নিজের বইলা মাইনা নিবো? নিবো না। দেখা যাইবো তার অন্য ঘর ছিল, হেই ঘরে পোলাপান আছে। এমন সংসারে সুখ নাই। ঝগড়া-ঝাটি লাইগাই থাকবো। আমার একবার সর্ব¦নাশ হইছে, দ্বিতীয়বার সর্ব¦নাশ কইরেন না।

শুনে মুন্সী হাফিজুদ্দিন চুপ করে থাকেন। পরদিন ছেলে সুলতান জমি দেখার সময় বলে, রাহেলারে কাঁদতে দেখলাম। কিছু হইছে নাকি বাপজান? হে আমারে কিছু কইলো না। হুদু চোখ মোছে। আমার কথা হুইনা।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলেন, হ্যারে নিকাহ্র কথা কইছিলাম। তোর মায়ের পরামর্শে। আমার মাথায় আসে নাই।

শুনে সুলতান বলে, রাহেলা তোমার বড় মাইয়া। এই বাড়িতে তারও একটা হক্ আছে। তারে তাড়ায়া দিয়েন না।

সকালে স্কুলে যাবার সময় মুড়ি-গুড় কখনো চিড়া-গুড় খেয়ে যায় জয়নাব। তাকে খাবার দেন নানী, এক মুঠা দিয়েই বলেন, যা, হইছে। তখন তার মা রান্না ঘরে ব্যস্ত। তার মাকে সংসারের সব কাজই করতে হয়, রান্না থেকে শুরু করে। আমেনা কোনো কাজই করে না। পাড়া বেড়িয়ে বেড়ায় আর পুকুরের ঘাটলায় বসে গল্প করে সখিদের সঙ্গে।

স্কুলে যাওয়ার পথে মনতাজ জয়নাবকে দেখে বলে, তোর মুখ শুকনা দেখায়। সকালে নাস্তা করছ নাই?

করছি। জয়নাব মুখ নামিয়ে উত্তর দেয়।

মনতাজ বলে, দেইখা মনে হয় খাস্ নাই। দাদী মনে হয় ঠিক মতন দেয় নাই তোরে। দাদীটা হিংসুইট্টা। তার মাইয়াগুলাও তাই। তারপর একটু থেমে বলে, টিফিনের সময় তোরে পিয়ারা, জামরুল পাইড়া দিমু। সফেদা থাকলে সফেদাও দিমু। খাইস্।

জয়নাব হেসে বলে, আমার ক্ষুধা নাই।

মনতাজ বলে, এহন ক্ষুধা নাই। কিন্তু স্কুলে পড়ার পর ক্ষুধা লাগবো। বাইত আইতে আইতে দুপুর।

দুপুরে পেট ভইরা খামুনে। জয়নাব বলে।

হ। পেট ভইরা খাওয়াইবো তোরে। দাদীর হাতেই তো খাইবি। মনতাজ বলে।

জয়নাব মনতাজের হাত ধরে বলে, ক্যামনে জানস্ তুই? দেখছস্ আমারে খাইতে?

মনতাজ গম্ভীর হয়ে বলে, দেখন লাগে না। আমি কী বুঝি না মনে করস? আমারে যত ছোট দেহায় আদতে অত ছোট না। দাদীর কারবার আমার জানা হইয়া গ্যাছে।

দুজন তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। মনতাজ একটা কঞ্চি দিয়ে রাস্তার পাশে গাছ-গাছড়ায় মারতে মারতে বলে, দাদীটা খুব পাজী। মনে হুদা হিংসা ভরা। দাদা ভালা মানুষ।

দাদী হিংসা করে ক্যান? জয়নাব বলে।

অন্যেরে খাইতে দেখলে তার জান পোড়ায়। তোরা যে আইছস,্ এহানে থাকস্ এইডা তার পছন্দ না। মনে করে উইড়া আইয়া বইছস্। খাইয়া-দাইয়া শেষ কইরা ফালাইবি।

জয়নাব বলে, আমার ক্ষুধা পায় না কিন্তু ছোট ভাইডা বড় ক্ষুধায় কাতরায়।

মনতাজ বলে, কে সুরুজ?

জয়নাব বলে, হ্যা। ছোট মানুষ তো ক্ষুধা চাপতে পারে না। বিছানায় যেমুন পেশাব চাপতে পারে না।

শুনে মনতাজ বলে, আমিও বিছানায় মুইতা দিই। স্বপ্নে দেহি সামনে পেশাবখানা।

শুনে জয়নাব হি হি করে হাসে।

জয়নাবকে এত প্রাণ খুলে হাসতে দেখেনি সুরুজ। সে বলে, হাসো ক্যান।

জয়নাব হাসি থামিয়ে বলে, তোর কথা হুইনা।

মনতাজ বলে, ক্যান, তুমি বিছানায় পেশাব করো না?

শুনে জয়নাবের মুখ লাল হয়ে যায়। গম্ভীর হয়ে বলে, কমু না। এসব কথা কওন ঠিক না।

ও। আর মামার ব্যাপারে বুঝি এই কথা কইতে বাধা নাই? কওন যায় পেশাবের কথা। মনতাজ বলে।

হ হ। যায়। তোরা হইলি পুরুষ। তোদের কথা কওন যায়। জয়নাব দৃঢ় স্বরে বলে।

মনতাজ বলে, ও, মাইয়াদের বুঝি পেশাবের কথা কওন যায় না?

শুনে জয়নাব জিভে কামড় দেয়। গম্ভীর হয়ে বলে, কীযে কস্। তোর মুহে কোনো লাগাম নাই। দেহস্ না আমি একটা মাইয়া। আমার সামনে ঐ সব কথা কইতে নাই।

মনতাজ তাচ্ছিল্লের ভঙ্গীতে বলে, হু। ভারী একখান মাইয়া হইছে। পিয়ারা গাছে উঠতে পারোস্? নারকেল গাছে?

না। পারি না। হ্যার লগে এই কথার কী সম্পর্ক? জয়নাব অবাক হয়ে তাকায়।

মনতাজ বলে, পোলারা যা পারে মাইয়ারা তা পারে না।

না পারে না। জয়নাব গম্ভীর হয়ে বলে।

তা হইলে এত দেমাগ ক্যান? চুপচাপ থাকলেই হয়। মনতাজ তার দিকে তাকায়।

জয়নাব মুখ নিচু করে আস্তে বলে, দেমাগ দেহাই নাই। আমার দেমাগ দেখানের কী আছে?

তার স্বরে এমন কিছু ছিল যা মনতাজকে ধাক্কা দেয়। সে জয়নাবের দিকে তাকিয়ে বলে, মন খারাপ করিস্ না। আমি তোর মন খারাপের লাগি কিছু কই নাই। বলে সে জয়নাবের হাত ধরে।

জয়নাব বলে, হাত ধরলি ক্যান?

মনতাজ বলে, আমি তোর ভাই। হাত ধরুম না? তারপর গাঢ় স্বরে বলে, আমি তোর লগে কহনো ঝগড়া করুম না।

জয়নাব হেসে বলে, হাচা?

মনতাজ বলে, হাচা। তারপর বলে, এট্টুতেই তোর ভিতরে কান্দোন ভাব আইসা যায়। ক্যানরে?

জয়নাব বলে, তাই নাহি? টের পাই না তো।

মনতাজ বলে, তুই পাইস্ না। কিন্তু আমি পাই।

জয়নাব বলে, তুই বড় ভালারে মনতাজ। তোরে আমার খুব ভালা লাগে।

মনতাজ বলে, তোরেও ভালা লাগে। তারপর বলে, আর কারে ভালা লাগে তোর?

মামুরে, মামীরে। নানারে। জয়নাব হঠাৎ সামনে তাকিয়ে বলে, ঐ যে ইস্কুল আইয়া পড়ছে। কথা কইতে কইতে খেয়াল নাই আমাদের। চল তাড়াতাড়ি। হগলে মাঠে জড়ো হইছে। এহনে জাতীয় সঙ্গীত হইবো।

মনতাজ বলে, হ। তুই তো আবার ফাষ্ট। তোরে সামনে না দেইখা মাস্টারে হৈ চৈ করবো।

ফাষ্ট হই বইলা তুই কী আমারে হিংসা করস্? জয়নাব দৌড়ে হেটে যেতে যেতে তাকায় মনতাজের দিকে।

মনতাজও জোরে হাঁটতে থাকে। সে বলে, হিংসা করুম ক্যান? আমার বোইনে ফাষ্ট হয় এতে আমার বুকডা বড় হইয়া যায়। যহন মাস্টারে তোর সম্পর্কে ভালা কথা কয় তহন মনে হয় আমারেও কইতাছে। আমি তোর ভাই লাগি না? সে হাফাতে থাকে।

স্কুলে দুজনে এসে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে জাতীয় সঙ্গীত শুরু হয় মাঠে। প্রতি ক্লাসের ছেলেমেয়েরা এক একটা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। জয়নাব তাড়াতাড়ি গিয়ে লাইনের মাথায় দাঁড়ায়। ঐ জায়গাটা তার জন্য ঠিক করে রাখা। সে ক্লাসের ফাস্ট হওয়া ছাত্রী।

স্কুলে ক্লাস শিক্ষক প্রতিদিনই কাউকে মারেন, অথবা বকেন। কিন্তু তিনি জয়নাবকে কখনো কিছু বলেন না। বরং তাকে দেখিয়ে অন্যদের বলেন, ওর মত হইতে পারো না? কত লক্ষ্মী আর পড়াশুনা করে মনোযোগ দিয়া। তোমরা খালি দুষ্টুমি করো, পড়ায় ফাঁকি দাও।

একদিন শিক্ষক মনতাজকে বেতের বাড়ি দিতে যাচ্ছিলেন, জয়নাব হঠাৎ চেঁচিয়ে বললো, স্যার, ওকে মাইরেন না। শুনে শিক্ষক অবাক হয়ে তার দিকে তাকান। তারপর গম্ভীর হয়ে বলেন, ক্যান ওকে মারবো না ক্যান? দুষ্টুমি করেছে সে।

জয়নাব বলে, না। মারবেন না। সে আমার ভাই।

তার কথা শুনে শিক্ষক হেসে দিয়েছেন। তার সঙ্গে ক্লাসের ছেলে-মেয়েরাও।

ফেরার পথে মনতাজ গম্ভীর স্বরে বলে, তুই অমন কইরা কইলি ক্যান? হগলে হাস্লো। এ্যাহনে আমারে ভেঙ্গাইবো। কইবো, ’হে আমার ভাই।’

জয়নাব হেসে বলে, বলুক গা। তুই কানে নিবি না। বুঝছোস্, মাথা মোটা।

মনতাজ আরো ক্ষেপে যায় শুনে। বলে, নিজের মাথাডা চিকন বইলা আমারে মাথা মোডা কও, না?

হ্যা। কই। তুই কিছুই বুঝছ না। বোন হইলে ভাইরে দেখাশুনা করতে হয়। এইডা তুই বুঝছ না। তাই কই তোর মাথা মোডা।

মনতাজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর বলে, আর বোনরে? তাকে দেইখা-শুইনা রাহন লাগে না?

হেইডা আমি কী কমু? যে ভাই, হেইই জানে। এ কথা সে যখন বলে তাকে বেশ ভারিক্কী মনে হয়। যেন মনতাজের চেয়ে বয়সে বড়।

মনতাজ কঞ্চি দিয়ে কচুগাছের পাতা থেকে বৃষ্টির পানি ফেলতে ফেলতে বলে, তুই বেশি বুঝছ্। তোর মাথা অনেক পরিস্কার। এর লাগি ক্লাসে ফাষ্ট হস্।

জয়নাব হেসে বলে, তুইও পারবি ফাস্ট হইতে। মনোযোগ দিয়া পড়াশুনা কর।

আমি ফাস্ট হইলে তুই কী হইবি? দুইজনে ফাস্ট হওন যায়?

যায়? ক্যান যাইবো না? একই নম্বর পাইলে হওন যায়। না হইলে আমি সেকেন্ড হমু। তুই ফাস্ট।

তৃতীয় শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণীতে জয়নাব ক্লাসে পঁচিশজন ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রথম হলো। সে বাড়িতে গিয়ে রাহেলাকে বললো, মা আমি ফাস্ট হয়েছি।

রাহেলা তার কপালে চুমু খেয়ে বললো, তোর নানা আর নানীকে সালাম করবি চল।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন খবর শুনে হাসিমুখে বললেন, মাসাল্লাহ্। খুব বুদ্ধিমান মাইয়া তুমি। আল্লাহ তোমার হায়াত দরাজ করুক। বালা-মুসিবতের হাত হইতে দূরে রাখুক।

তার দোয়া শুনে রাহেলার সৎ মা মুখ কুঞ্চিত করলেন। বিড়বিড় করে কিছু বললেন নিজেকে।

জয়নাব তার মামা সুলতান আর মামী কুলসুমকে পা ধরে সালাম করতেই তারা তার মাথা নিচ থেকে তুলে বললেন, মনতাজ ভালা খবর দিছো। খুব খুশি হইছি। এই বাড়ির মুখ উজালা করছো।

পাশে মনতাজ দাঁড়িয়েছিল। ফাঁকা পেয়ে বললো, চল্ ফড়িং ধরি গিয়া। ডালিম গাছের তলে অনেক ফড়িং উড়তাছে দেইখা আইলাম।

তার মামী বললেন, মনতাজ, দেখছো অত অন্ধকার ঘরে থাইকা তোমার বোনটা ক্যামুন ভাল ফল করছে। তুমিও ভালা করতা পারবা। একটু মন দিয়া পড়াশুনা করো।

জয়নাব বলে, বুঝলেন মামী, আমি হ্যারে কইছি একলগে পড় ুম। হ্যা পড়তে চায় না।

মনতাজের মা তাকে বলে, কিরে একলগে পড়স্ না ক্যান?

মনতাজ বলে, একলগে পড়লে হ্যারে মাস্টার, মাস্টার মনে হইবো। জয়নাব মনে হইবো না।

তার কথা শুনে সবাই হাসে। তারা ফড়িং ধরতে চলে যায়।



৩.

রহিমার প্রসবের দিন এগিয়ে আসে। দাই এসে দেখে যায়। সব দেখে বলে, সময় হইয়া আসিছে। আর দেরি নাই। অমাবস্যার এক রাতে ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি, সেই সময় রহিমার প্রসব বেদনা উঠলো। সারা রাত চললো তার প্রসব বেদনার চিৎকার। বাড়ির সবাই অস্থির আর শঙ্কিত। এ বাড়িতে আরো ছেলে-মেয়ে জন্ম নিয়েছে কিন্তু এমন অবস্থা দেখা যায়নি। সবাই জেগেই কাটালো রাত। আকাশে বাজ পড়লো একটু পর পর। বিজলী চমকালো আকাশের একপাশ থেকে অন্য পাশে। মৌলভী সাহেবকে ডেকে দোয়া-দরুদ পড়ানো হলো। কিন্তু রহিমা সন্তান প্রসব করে না।

শেষ রাতের দিকে মৃত সন্তান প্রসব করলো রহিমা। প্রসব করেই সে অজ্ঞান হয়ে গেল। প্রথমে মন হলো সেও বুঝি মরে গেল। পরে দেখা গেল তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস চলছে। বুক ওঠা-নামা করছে।

সকালে জ্ঞান ফিরলো রহিমার। চোখ খুলেই বললো, ছেলে কই আমার? ছেলে কই? দেখাও।

তার মা বললো, হইবো, হইবো। একটু সুস্থ হইয়া নে। বড় ঝড় গেছে শরীরের ওপর দিয়া। আল্লাগো।

আঁতুর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাহেলার সৎ মা স্বামীকে শুনিয়ে বললেন, মরা পোলা হইবো না? ঘরে এক অলক্ষ্মীরে জাগা দিছো। তালাক নিয়া আইছে যে তার ছায়া মাড়াইতে নাই। আমার মাইয়া হেই অলক্ষুণে মাইয়া মানুষডার ছায়ায় কী একবার পড়ছে? গত তিন মাস ধইরাই তারে দেখতাছে। তার হাতের রান্ধন খাইতাছে। এমন হইবো না?

মুন্সী হাফিজুদ্দিন তামাক খাওয়া বন্ধ রেখে বলেন, কী যাতা কইতাছো। রাহেলা অলক্ষুণে হইতে যাইবো ক্যান? তার মাইয়া ক্লাসে ফাস্ট হইতাছে না?

তার স্ত্রী মুখ ঝামটা দিয়ে বলেন, অলক্ষুণে না হইলে স্বামী তালাক দিল ক্যান? স্বামীর ঘর থেইকা তাড়ায়া দিল ক্যান? এমুন মাইয়ারে ঘরে জাগা দেওন ঠিক হয় নাই। হতীনের ঘর করলে কী ক্ষতি আছিল? মাইনষে হতীনের ঘর করে না?

জয়নাব মাকে জড়িয়ে ধরে রাখে রান্না ঘরে। সে সব শুনতে পায় আর তার শরীর হিম হয়ে আসে। সে মায়ের শরীর জড়িয়ে ধরে বলে, মাগো, লও যাইগা এই হান থিকা।

শুনে তার মা কাঁদে নিঃশব্দে।

সুলতান রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে বলে, কান্দোস ক্যান? এইটা তোরও বাড়ি। আমরা আছি না? কারো একার সম্পত্তি না। শেষের কথাটা সে বেশ চেঁচিয়েই বলে। তার সৎ মা শুনতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলেন, হুনছেন? আপনার পোলা কী কয়? বইনের লাইগা দরদ উথলাইয়া পড়তাছে। তারে বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেছে। সম্পত্তির কথা কয়। আপনি বাইচা আছেন, এ্যাহনই হ্যারা সম্পত্তি ভাগাভাগি করতাছে। আপনি কী কিছু হুনেন না? দেখেন না? তারপর বিলাপের স্বরে বলেন, ওরে আল্লারে কার ঘর করতাছি? কেমুন মানুষ এইডা?



৪.

রহিমা মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তার স্বামী মোখসেদ শ্বশুর বাড়ি এলো। যতটা মন খারাপ হওয়ার কথা তাকে দেখে তেমন মনে হলো না। বরং সে বেশ স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করলো ঘটনাটা। অনেককে বললো, এমুন হয়ই। সব প্রসবই কী ঠিকমত হয়? আল্লার ইচ্ছা। আহ! তা কীসের? সময় আছে পোলাপান হওনের। বলে সে হাসলো। মুন্সী হাফিজুদ্দি জামাইয়ের কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় একটু বিব্রত হলেন। মোখসেদ জামাই বেশ ঠোঁটকাটা, যখন যা বলার না তাই বলে ফেলে।

দেখা গেল মোখসেদ বেশ মিশুকও বটে। লোক পেলেই তার সঙ্গে গল্প করে। নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় করে আলাপ জমিয়ে বসতে তার সময় নেয় না। গল্প করতে থাকলে সে এ কথা থেকে সে কথায় চলে যায়, সময়ের জ্ঞান থাকে না। তার অজস্র গল্প মনে আছে, কিছু শোনা, কিছু নিজের বানানো। এ সব গল্প সে সবাইকে শোনায়। আরো দেখা গেল মেয়েদের সঙ্গে গল্প করার প্রবণতা তার একটু বেশি। সুযোগ পেলেই মেয়েদের পাশে বসে পড়ে গল্প শুরু করে দেয়। এ নিয়ে মেয়েরা হাসাহাসি করে। কিন্তু মোখসেদের সেদিকে হুশ থাকে না।

সে রান্নাঘরে ঢুকে রাহেলার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয় তার রান্নার মধ্যেই। একটু পর পর বলে, এক কাপ চা দ্যান। আপনার হাতের চায়ের সোয়াচই অন্য রকমের। আহা কী মিষ্টি যে লাগে।

চা খেতে খেতে সে বলে, আপনারে মোটেও দুই ছেলে-মেয়ের মা মনে হয় না। মনে হয় বিয়া-শাদিই হয়নি।

শুনে রাহেলার হাসি পায়। সে আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে হাসে। হাসি থামিয়ে বলে, কি যে কন? কত বয়স হইছে আমার। মাইয়া ডাগর হইছে।

তা হউক। আপনার বয়স বাড়ে নাই। ক্যাডা কইবো মা হইছেন। শরীরখানা দেহেন না? মোখসেদের এই কথা শুনে লজ্জা পায় রাহেলা। সে পরনের শাড়ি টেনে-টুনে ঢেকে দেয় শরীরে।

দেখে মোখসেদ বলে, শরম পাইলেন নাহি? পান, পান। শরম পাইলে আপনারে সোন্দর দেখায়।

রাহেলা ভাতের হাড়ি নামাতে নামাতে বলে, আপনি অহন যান। আমার অনেক কাম। এসব কথা হুননের সময় নাই।

মোখসেদ উঠতে উঠতে বলে, কহন হুনবেন? অনেক গল্প জানি আমি। হুনাইতাম পারি। কহন ফুরসৎ আপনের?

রাহেলা মাথায় ঘোমটা টেনে বলে, আমার ফুরসৎ নাই। সকাল-সন্ধ্যা এই রান্না ঘরে থাহি। কত কাম! যান আপনে অহনে।

মোখসেদ অনিচ্ছা মনে উঠতে উঠতে বলে, হ যাই। এত কাম কইরেন না। অমন সোন্দর শরীরডারে নষ্ট কইরেন না।

তার কথা শুনে রাহেলার আবার হাসি পায়। লোকটাকে তার অদ্ভুত মনে হয়। বেশ সাদা-সিধা, খুব খারাপ না, এমন।

যাবার আগে মোখসেদ বলে, বিকালে আবার আমু চা খাইতে। এইখানে বইয়া বইয়া চা খাইতে খুব ভালা লাগে। আপনারে দেহন যায়, কথা কওন যায়।

রাহেলা বলে, বউয়ের কাছে যান্। তার মন খারাপ। ভালা কথা কইয়া মনডা ঠিক কইরা দ্যান।

মোখসেদ গম্ভীর স্বরে বলে, আপনা-আপনিই ঠিক হইয়া যাইবো। তারপর বলে, ছোড আঁতুর ঘরে আমার হামাইতে ভালা লাগে না। বাজে গন্ধ। হেইখানে আমারে ঘুমাইতেও দ্যায় না। কয় মায়ের নিষেধ আছে। কন্ তো, কাণ্ডটা কী?

শুনে রাহেলা হাসে। বলে, হ্। হেইটাই নিয়ম। সবাইরে মাইনা চলতে হয় প্রসবের পর।

শুনে মুখ গোমড়া করে মোখসেদ চলে যায়।

তার দিকে তাকিয়ে রাহেলা হাসে। আস্তে করে বলে, পাগল একটা।

জয়নাব স্কুল থেকে এসে খাতাপত্র থুয়ে রান্না ঘরে গেল। সে আর সুরুজ সেখানেই খাওয়া-দাওয়া করে। সে রান্নাঘরে ঢোকার সময় সেখান থেকে বেরিয়ে এল মোখসেদ। তার সামনে দাঁড়িয়ে লোকটা বললো, কী স্কুল থেইকা আইতাছো বুঝি? ভালা, ভালা। মন দিয়া পড়াশুনা করো সোন্দর জামাই পাইবা। বলে সে জয়নাবের দুই গাল টিপে দেয়। অস্বস্তিতে সরে দাঁড়ায় জয়নাব। তার শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে লোকটার স্পর্শে। সে রান্নাঘরে ঢুকে তার মাকে বলে, ব্যাডাটা কেডা মা?

কার কথা কস্? রাহেলা মেয়ের দিকে তাকায়। জয়নাব চলে যেতে থাকা মোখসেদকে দেখিয়ে বলে, ঐ যে যায়।

রাহেলা হেসে বলে, ক্যান তোর খালু। রহিমা খালার জামাই। আগে দেহস নাই? কয়দিন হইলো আইছে।

জয়নাব বলে, দেখছি। বলে সে মুখ কালো করে বসে থাকে।

রাহেলা তখন বলে, মুখ অমন করতাছিস ক্যান? মেজাজ ভালা নাই মনে হয়।

জয়নাব বলে, লোকডা ভালা না। বলে সে মুখ নিচু করে রাখে।

ক্যাডা? তোর মোখসেদ খালু?

হ, ঐ ব্যাডা। বলে জয়নাব আবার মোখসেদকে দেখায়। সে তখন অন্দরমহলের বাঁশের তর্জার বেড়া পার হয়ে বাইরে যাচ্ছে।

রাহেলা বলে, ভালা না, মানে হারাপ? না, তা হইবো ক্যান। ভালা মানুষ। হাসির কথা কয়। মুখে লাগাম নাই।

জয়নাব বলে, লোকডা খারাপ। সে মাটির মেঝেতে কাঠি দিয়ে আঁকি বুকি আঁকে।

খারাপ কস্ ক্যান? কী হইছে? কইছে কিছু তোরে? রাহেলা মেয়ের দিকে তাকায়।

জয়নাব মুখ নিচু রেখেই বলে, কোলে বহাইতে চায়। বহাইয়া গল্প শুনাইতে চায়।

রাহেলা হেসে বলে, ভালই তো। আদর কইরা কোলে বহাইতে চায়।

জয়নাব জোর দিয়ে বলে, না ঐ ব্যাডার কোলে বইতাম চাই না। খারাব লাগে। লোকডা খারাপ।

রাহেলা কিছুক্ষণ চুপ করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, বেশ তো। মনে না চাইলে বইবি না কোলে।

জয়নাব বলে, জোর কইরা বহায়। লোকডা খারাব।

রাহেলা কপালে ভাঁজ ফেলে বলে, তুই বইবি না। কইয়া দিবি বইতে পারুম না। বলে সে উনুনের দিকে তাকায়। গনগনে আগুনে তার মুখ লাল দেখায়। কপালে গলায় ঘাম জমে। তাকে এখন একটু চিন্তিত দেখায়।

কয়েকদিন পর এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে রাহেলা পশ্চিমের ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। সে বন্ধ করে আর ঝড়ো বাতাস এসে এক হ্যাচকায় খুলে দিয়ে যায়। সে দরজায় খিল ধরে বসে থাকে। বাইরে বাতাসের মাতামাতি। টিনের ছাদের ওপর নারকেল গাছের ডগার ঝাপটানির শব্দ। ঝড় বন্ধ হয় একটু পর কিন্তু বৃষ্টি থাকে। রাহেলা নিশ্চিন্তে চৌকিতে শুয়ে পড়ে। তার চোখে ঘুম এসেছে এমন সময় ঘরের দরজা নড়ে ওঠে। আবার ঝড় এলো মনে করে সে উঠে বসলো। হ্যা, ঝড়ই হবে। দরজাটা নড়ছে, বেশ শব্দ হচ্ছে।

রাহেলা দরজা খুলে দেখে বাইরে আবছা অন্ধকারে কে যেন দাঁড়িয়ে। দেখে সে ভয়ে আঁতকে ওঠে। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করতে যায়। লোকটা ততক্ষণে ঘরে ঢুকে পড়েছে। লোকটাকে কাছে থেকে চিনতে পারে রাহেলা। মোখসেদ। সে আতঙ্কিত হয়ে উদ্বেগের স্বরে ব্যস্ত হয়ে বলে, আপনি আইছেন ক্যান? এই সময়?

মোখসেদ তার মুখে হাত রেখে চাপা দিয়ে ফিস্ফিস্ করে বলে, আস্তে কথা কও। পোলা-মাইয়া জাইগা উঠবো।

রাহেলা আরো ভয় পেয়ে বলে, আপনে আইছেন ক্যান এই ঘরে? যান গিয়া। তাড়াতাড়ি যান।

মোখসেদ বাইরের দরজা একহাতে বন্ধ করতে করতে বলে, ঝড়-বাদলে ক্যামুন আছো দেখতে আইলাম। ঘরটা ভাঙ্গা। ছাদ উইড়া গ্যালো, না বেড়া ছিটকাইয়া পড়লো দেখতে আইলাম।

রাহেলা বলে, না কিছু হয় নাই। সব ঠিক আছে। আপনি যান।

মোখসেদ আরো ঘন হয়ে দাঁড়ায়। তার বুক রাহেলার বুক স্পর্শ করে। সে আবার রাহেলার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে, চুপ করো। একা একা থাহো খারাপ লাগে না? জোয়ান বেডির শরীর জ্বালা ধরে না? এমন শরীর এইভাবে ফালাইয়া রাহো রাইতের পর রাইত।

রাহেলা মুখ থেকে মোখসেদের হাত সরাবার চেষ্টা করে প্রাণপণে। ততক্ষণে মোখসেদ তাকে জাপ্টে ধরেছে। এক হাতে টানদিয়ে শাড়িটা খুলে বুকে মুখ দিয়েছে। অন্য হাতে জাপ্টে ধরেছে তার পাছা। সে চিৎকার শুরু করে দেয়। গোলমালের শব্দে জয়নাব আর সুরুজ জেগে উঠে অন্ধকারে তাকিয়ে প্রথমে কিছু দেখতে পায় না। তারপর শোনে মেঝেতে ধপাস করে ভারী কিছু পড়ার শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে রাহেলার স্বর শোনা যায়, মারে, মাইরা ফ্যালাইলো।

রাহেলার আর্তস্বর আর ধ্বস্তা-ধ্বস্তির শব্দ শুনে জয়নাব আর সুরুজ চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। এক সময় তারা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে চিৎকার করতে থাকে। ঘরের ভেতর থেকে রাহেলা তখনো আর্তচিৎকার করে মোখসেদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে।

চিৎকার শুনে সুলতান, মুন্সি হাফিজুদ্দিন এবং তার স্ত্রী উঠোনে বেরিয়ে আসেন হারিকেন নিয়ে। তাদের কথা শুনে পশ্চিম ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে পালায় মোখসেদ। সে তার বউ রহিমার ঘরে গিয়ে ঢোকে। মুন্সী হাফিজুদ্দিন আর সুলতান পশ্চিমের ঘরের দরজার সামনে এসে বলে, রাহেলা, কী হইছে?

রাহেলা কোনো উত্তর দিতে পারে না। সে শব্দ করে কাঁদতে থাকে।

জয়নাব কাঁদতে কাঁদতে বলে, খারাপ লোকডা ঘরে ঢুকছিল। ঢুইকা মারে মারতাছিল।

তার নানী ধমক দিয়ে বলে, চুপ কর হারামজাদি। কারে খারাপ লোক কস্? তোর মায়ে খারাপ এইডা কস্ না ক্যান? কতবড় সাহস আমার জামাইরে খারাপ কয় দুধের মাইয়া। তারপর হিংস্র হয়ে বলে, এ বাড়িতে থাকবি, এ বাড়ির খাইবি আর এ বাড়ির জামাইয়ের বদনাম করবি। এইডা হইবো না। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, নিজ কানে হুনলা, নিজ চোখে দেখলা। বদমাইশ মায়াডার কাণ্ড এইডা! হেইই ডাইকা আনছে ছলছুতা দিয়া। মাইয়া আর পোলার জাইগা থাহনে সুবিধা করতে পারে নাই। এহনে ভালা মানুষ সাজছে। দোষ দিতাছে আমার জামাই-এর ওপর। কত বুদ্ধি এই খানকি মাগির।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলেন, নিজের মেয়েকে অমন করে গালি দিয়ো না। মাথা ঠাণ্ডা করো।

তার কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন তার স্ত্রী। চিৎকার দিয়ে বলেন, আমার মাইয়া? অমন কলঙ্কিনী মাইয়া আমার গর্ভে কখনো জন্ম ন্যায় নাই। হে একটা শয়তান, ফন্দিবাজ মাইয়া। আমার সাদা-সিধা জামাইডারে পটাইবার তালে আছে। ভাতারখানা মাগি।

সুলতান রেগে গিয়ে বলে, মা, চুপ করেন। পাড়া প্রতিবেশি হুনবো। এত রাতে হৈ চৈ হুইনা আইসাও পড়তে পারে।

তার সৎ মা শুনে বলে, আহুক। আইয়া দেহুক বজ্জাত মাইয়া লোকডার কাণ্ড। আশ্রয় দিছি দয়া কইরা, তার বদলে এই কাম?

সুলতান বলে, আশ্রয় দিবেন ক্যান? এটা রাহেলার বাপের বাড়ি। তার হক্ আছে এহানে।

হক আছে? বিয়ার পর মাইয়াদের বাপের বাড়ির ওপর হক থাহে নাহি? কেমুন কথা কও তুমি? বোনের লাইগা পরান পুড়তাছে? তয় তারে নিজের সংসার তৈরি কইরা জাগা দেও না কেন?

দিমু। যহন সময় হইবো তহন দিমু। সুলতান উত্তেজিত হয়ে বলে তার ঘরে চলে যায়।

মুন্সী হাফিজুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে তার স্ত্রী বলেন, হুনলা পোলাডার কথা? সৎ মা বইলা আমারে একটু সম্মান করবো না? ঠাস্ ঠাস্ কতগুলা মিছা কথা কইয়া গেল? অপমান কইরা গেল। তুমি খাড়ায়া আছো খুঁটির লাহান। কেমুন মানুষ তুমি? বউয়ের সম্মান রাখবা, না আমি বাপের বাড়ি যামু গা? এর বিচার চাই। না হইলে বাপের বাড়ি কালই যামু গা। মোল্লাবাড়ির মাইয়া আমি। খানদানের নাম আছে। বাপে হুনলে কালই আইয়া লইয়া যাইবো। দেহি তার আগে তুমি কি কর।

সকালে রান্না ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল রাহেলা, তার সৎ মা দরজা আগলে রেখে বললেন, ঢুকতে পারবা না। তোমার লাহান বজ্জাত মাইয়া এই পরিবারের রান্নাঘরে ঢুইকলে সব অপবিত্র কইরা ফালাইবো। এইডা নিজ চোখে দেখতে পারুম না।

শুনে রাহেলা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার সৎ বোন আমেনা সামনে এসে বলে, এতবড় সাহস তোমার, দুলাভাইয়ের বদনাম করো। নিজে অসৎ চরিত্র আর ধরা পইড়া এ্যাহন সব দোষ দিতে চাও আর একজনের ঘাড়ে। মা যে বলেন তুমি বজ্জাত মাইয়া, হেইডা দেখতাছি ঠিকই।

হৈ চৈ শুনে মুন্সী হাফিজুদ্দিন রান্না ঘরের কাছে এসে বলেন, এত চিৎকার কেন? হইছে কী। কারো মাথায় বাজ পড়ছে? আস্তে আস্তে কথা কইয়া বিষয়টা ফায়সলা করণ যায় না? সবচেয়ে ভালা হয় ঘটনাটা ভুইলা গ্যালে।

ভুইলা গ্যালে? সাপের মত হিস্ হিস্ করে ওঠেন তার স্ত্রী। চিৎকার করে বলেন, হয় ঐ মাইয়ারে রাহো, না হয় আমারে। দুইজনের এই বাড়িত জায়গা হইবো না।

হাফিজুদ্দিন হকচকিয়ে গিয়ে বলেন, আহা। তুমি এত মেজাজ খারাপ করো ক্যান? তুমি এদের মা। তোমার একটা দায়িত্ব আছে না?

শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠার মত হয় তার স্ত্রীর। তিনি আরো চেঁচিয়ে বলেন, আমি বজ্জাত মাইয়াদের মা না। খানকী মাইয়াদের মা না।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন হতাশ হয়ে রাহেলাকে বলে, যারে, তোর ঘরে যা। এ্যাহন সামলাইয়া থাক।

রাহেলা ঘরে গিয়ে দেখে জয়নাব আর সুরুজ কাঁদছে। সে দু’জনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর চোখ মুছে বলে, জয়নাব তুই এহনো স্কুলে গেলি না?

না। যামুনা আইজ। কান্নাভেজা গলায় জয়নাব বলে।

রাহেলা তার মুখে চোখে হাত রেখে আদর করে বলে, যারে স্কুলে যা। এইহানে থাইকা তোর মন খারাপ হইবো। তুই স্কুলে যা। মনতাজরে দেখলাম খাঁড়ায়া আছে।

দুপুর বেলায় খেয়ে-দেয়ে মুন্সী হাফিজুদ্দিন বিশ্রাম নিতে যাবেন এই সময় মৌলভী কেফাতুল্লাহ এলেন। গলা খাঁকারি দিয়ে বাইরে থেকে তিনি তার উপস্থিতি জানিয়ে দিলেন। অগত্যা মুন্সী হাফিজুদ্দিনকে বিছানা থেকে উঠতে হলো। বাইরে এসে মৌলভী কেফাতুল্লাহকে দেখে তিনি বললেন, কী ব্যাপার? এই দুপুরে আইছেন যে?

মৌলভী কেফাতুল্লাহ বললেন, একটা ঘটনার কথা হুনলাম। পাড়ায় অনেকেই হুনছে। তাই আলাপ করতে আইলাম।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, কী ঘটনার কথা হুনছেন?

এই যে কাইল রাতে আপনার বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটলো।

কোন ঘটনা?

আরে ঐ যে আপনার তালাক পাওয়া মাইয়াডা আর মেয়ের জামাই। একঘরে দেখা গিছে। ঘটনাটা তো ভালা না। গ্রাম দেশের মানুষ। নানা কথা কইতাছে।

কী কইতাছে?

যা কইতাছে তা আমি মুখ দিয়া আনলে ওজু নষ্ট হইবো।

কী কইতে চান আপনি? মুন্সী স্থির চোখে তাকান মৌলভী কেফাতুল্লাহর দিকে।

আমি কই কী মাইয়াডারে এইভাবে রাখলে এমুন কথা-বার্তা মাঝে-মধ্যেই হইবো। অহনো জোয়ান শরীর, বুঝলেন না। কহন কী কইরা বসে গরমের চোটে। তহন আপনার মুখে কালি পড়বো।

তা কী করতে বলেন? তাড়াইয়া দিমু নিজের মাইয়ারে?

না, না তাড়াইবেন ক্যান। আস্তাগফেরুল্লাহ। অন্য রাস্তা আছে।

কী রাস্তা? বলেন দেখি কী রাস্তা।

মৌলভী কেফাতুল্লাহ গলা খাঁকারি দেন পরিষ্কার করার জন্য। তারপর বলেন, একটা বিয়া দিয়া দ্যান। অমন বিয়া আকছার হইতাছে। সেও একটা ঘর পাইলো, আপনেও ঝামেলার হাত থিকা বাঁচলেন।

বিয়া? কোথায় বিয়া দিমু? মুন্সী হাফিজুদ্দিন তাকান জিজ্ঞাসু চোখে।

আরে মানুষের অভাব আছে নাহি? তবে দোজবর হইবো। তালাক পাওয়া মাইয়া, তার ওপর সঙ্গে দুই সন্তান। নতুন জামাই এইসব দেইখাইতো রাজী হইবো। জামাইও তেমুন হইতে হইবো। মনে একটু বয়স্ক, আর প্রথম কী, দ্বিতীয় স্ত্রী বাইচা আছে, সেই ঘরের ছেলে-মেয়েও থাকবো। এই যা হয় আর কি। বলে তিনি প্রসন্ন মুখে তাকিয়ে থাকেন।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলেন, আনেন, প্রস্তাব আনেন। তারপর দেহি কী করা যায়। হ্যা, এইডা একটা রাস্তা বটে। মাইয়াডার সারাজীবন পইড়া রইছে সামনে। এইভাবে কতদিন কাটাইবো?

তার কথা শুনে খুশি হন মৌলভী কেফাতুল্লাহ। তিনি বলেন, এই তো সব বুঝছেন আপনে। তা হইলে আমি জামাই দেহন শুরু করি। কী কন?

মুন্সি হাফিজুদ্দিনকে মৌলভী কেফাতুল্লাহ আরো আগেই বিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলেন। রাহেলা তালাক পেয়ে বাবার বাড়ি আসার পর হঠাৎ একদিন পুকুর ঘটে মেসওয়াক করার সময় তাকে দেখে মৌলভী কেফাতুল্লাহ বলেছিলেন, তোমারে চেনা চেনা লাগে। কে গো তুমি বেটি?

রাহেলাকে কয়েকবার পরিচয় জিজ্ঞাসা করার পর সে নিজের নাম বলেছে। তাতে সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনতে পারেন নি মৌলভী কেফাতুল্লাহ। তাকে তাই আরো স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করতে হয়েছে, তুমি কার বউ?

বাড়ন্ত বয়সে মেয়েদের পরিচয় দিতে হলে স্বামীর নামই দিতে হয়। স্বামী বেহেস্তের দরজা শুধু নয়, ইহজগতেও ভরসার স্থান। তার পরিচয়েই মেয়েদের পরিচয়। একথা গভীরভাবে বিশ্বাস করেন মৌলভী কেফাতুল্লাহ। যখন তার প্রশ্নের পর রাহেলা কেবল তার নিজের নাম বলে তখন তার পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। তাই সে স্বামীর নাম জানার জন্য চাপ দেয়।

রাহেলা তখন বলে, আমি মুন্সী হাফিজুদ্দিনের মাইয়া।

ও। তাই কও। এই লাইগাই চেনা চেনা লাগে। তা বাপের বাড়ি বেড়াতে আইছো বুঝি? ভালা ভালা। বেড়াও। বাপ যতদিন আছে বেড়াইতে আইবা। বাপের বাড়ির আদরের তুলনা নাই। এহানে আইলে দেখবা বয়স এক লাফে কম হইয়া যাইতাছে। মনে মনে ছেলেবেলায় পিছায়া যাইবা।

পরে রাহেলার তালাক পাওয়ার খবর পেয়ে তিনি একদিন মুন্সী হাফিজুদ্দিনকে রাহেলার আর একটি বিয়ের কথা বলেছিলেন। স্বামীর সংসার ছাড়া মেয়েদের ভরসা নাই। এ কথার ওপর জোর দিয়েছিলেন তিনি। তার স্বর নিচু করে বলেছিলেন, একলা জোয়ান মাইয়া দেখলে শয়তান আইসা ভর করে। নানা কুমতলব দ্যায়। তাই বেশিদিন জোয়ান মেয়েকে পুরুষ ছাড়া একা থাকতে দিতে নাই।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন তখন তার কথায় কান দেন নি। রাহেলা আরেকটা বিয়ে করতে রাজী হবে না একথা তিনি জানেন। তাই এই প্রসঙ্গ তোলার প্রয়োজন বোধ করেন নি। তিনি খুব ধনী নন; কিন্তু তার অবস্থা এমন নয় যে, একটা মেয়ে দুই বাচ্চা নিয়ে তার বাড়ি আশ্রয় নিলে তার হাঁড়িতে টান পড়বে।

কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে। ঝড়ের রাতে রাহেলার ঘর থেকে রহিমার জামাই বেরিয়ে আসার পর ঘটনাটা মুখে মুখে ছড়াচ্ছে। দেখা যাচ্ছে পাড়ার অনেকেই জানে। তিনি সন্দেহ করেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী এই বিষয়ে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে। সে প্রথম থেকেই রাহেলার তার বাড়িতে আসা এবং থাকা সুনজরে দেখতে পারেনি। তার মধ্যে সৎ মায়ের সব চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যই রয়েছে, এটা তিনি লক্ষ্য করেছেন; কিন্তু কপালের লিখন বলে মেনে নিতে হয়েছে। প্রৌঢ় বয়সে তিনি স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে সংসারে অশান্তি আনতে চান না।

এখন মৌলভী কেফাতুল্লাহ রাহেলার দ্বিতীয় বিয়ে দেবার যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেটা তিনি ফেলে দিতে পারছেন না। অন্য সময় হলে কানে নিতেন না; কিন্তু ঘরে-বাইরে যে কানাঘুষা আর রটনা চলছে তার ফলে মান-ইজ্জত রাখার জন্য রাহেলার একটা বিয়ে দেয়া ফরজ বলে মনে হলো তার কাছে। কিন্তু তার আগে রাহেলাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। সে মানবে না প্রথমে; কিন্তু মানাতে হবে।

রাহেলাকে বিয়ের কথা বলতেই সে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। বার বার বললো, আমারে কাইটা নদীর পানিতে, বিলের মধ্যে ভাসাইয়া দ্যান। আমি আর বিয়া করুম না। আমারে বিয়া দিবেন না আব্বাজান।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলেন, আমি যতদিন বাইচা আছি তুই না হয় এহানে থাকলি। আমি গেলে গা? থাকতে পারবি এই বাড়িতে? পারবি না। তাই আমি বাঁইচা থাকতেই তোর একটা গতি কইরা দিয়া যাই। বিয়া ছাড়া তোর আর গতি নাই।

শুনে রাহেলা জবাই করা মুরগীর মত ছটফট করে দাপাতে থাকে বাড়ির উঠোনে। ঘরের ভেতর থেকে দৃশ্যটা দেখে একটার পর একটা পান মুখে দেন মুন্সী হাফিজুদিনের দ্বিতীয় স্ত্রী। তার মুখে কুটিল হাসি। তার সঙ্গে যোগ দেয় ছোট মেয়ে আমেনা।

স্কুল থেকে এসে জয়নাব মাকে ঘরে শুয়ে কাঁদতে দেখে তাকে জড়িয়ে বলে, মা, কান্দো ক্যান? কী হইছে?

তার কথা শুনে রাহেলা আরো জোরে কেঁদে ওঠে। তার দেখা-দেখি জয়নাবেরও কান্না পায়। সে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।

কিছুপর বড় ভাইয়ের বউ কুলসুম এসে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে বলে, ও জয়নাব। বাইরে আইয়ো। খাইবা না? কহন স্কুল থেইকা আইছো। টের পাই নাই। তোমার লাগি মনতাজ খায় নাই। বইয়া আছে। আহো উইঠা।

রাহেলা চোখ মুছে কান্না থামিয়ে জয়নাবকে বলে, যারে জয়নাব। খাইতে যা। মনতাজ বইয়া রইছে।

জয়নাব বলে, তোমারে নিয়া খামু আইজ। তুমি চলো মা।

রাহেলা জয়নাবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, আমি গোসল করি নাই। আমার দেরী হইবো। তুই যা।

জয়নাব অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিছানা থেকে ওঠে। বইপত্র গুছিয়ে রেখে সে ঘরের বাইরে যায়।

কুলসুম তখন ঘরে ঢুকে বলে, তোমার কী হইছে রাহেলা? শরীর ভালা নাই? না মনডা?

তার কথা শুনে রাহেলা আবার কাঁদতে শুরু করে।

কুলসুম চৌকিতে উঠে তার পাশে বসে পিঠে হাত রেখে বলে, কী হইছে তোমার? কইবা না?

রাহেলা কান্না ভেজা গলায় বলে, আমি বিয়া করুম না। বিয়া করুম না।



৫.

জমির শেখ বলেছেন, বিয়া কী আমি করতাম চাই? হক্কলে কইতাছে। তাই।

বড় ছেলে বলে, আমরা আপনার নিজের ছেলে-মেয়ে। আমরা তো কই না। পরের কথা হুনবেন ক্যান, বয়স দেখবেন না? এই বয়সে আবার বিয়া করবেন ক্যান?

বয়সের কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে যান জমির শেখ। একটু রেগেই বলেন, বয়স? আমি কী থুরথুরা বুড়া হইয়া গেছি? কী কস্ তোরা? এই বয়সে দুইটা ক্যান, লোকে চারটা বিয়া করে।

তার কথা শুনে বড় মেয়ে বলেছে, সে আগের কালে হইতো। এ্যাহনে হয় না।

জমির শেখ জেদের সঙ্গে বলেছেন, হয় না? করলেই হয়? ঐ সব কথা শহরে মানায়। গ্রামে-গঞ্জে চলে না। এহানে আগের নিয়মই চালু আছে। যা তোরা। বেয়াদবি করিস্ না। যা ঠিক করছি তাই হইবো। হৈ চৈ করিস না।

জমির শেখ বেশ ঘটা করেই বিয়ে করলেন। অনেক লোকজন দাওয়াত করা হলো খাওয়ার জন্য। জোতদার হিসেবে তার নামডাক আছে ইউনিয়নে। এখন বয়স হয়েছে; কিন্তু এক সময় খুব দাপটের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতেন তিনি। জনশ্রুতি আছে, জোয়ান বয়সে খুন-খারাপি, অন্যের বাড়ির মেয়েলোক ধরে আনা, এইসবও করেছেন। এখন বয়স পঞ্চাশের ওপর হয়েছে, বাতেও বেশ কষ্ট পান তাই আগের রমরমা অবস্থা নেই। তবু রেগে গেলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না তার। বিয়ে করা নিয়ে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে ঝগড়ার পর তিনি ঠিক করলেন সবাইকে ত্যাজ্যপুত্র আর কন্যা করবেন। কাউকে সম্পত্তির ভাগ দেবেন না। তার স্ত্রী শুনে বললেন, একটা কথা রাখো তুমি। বিয়া করতেছো তাতে আমার মত নাই। ছেলে-মেয়েরও নাই। এইডা স্বাভাবিক। এমন বিয়াতে কেউ মত দিবো না। কিন্তু ঃ

তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জমির শেখ বলেন, আমি কী ফুর্তির লাইগা বিয়া করতাছি? সংসারের লাইগা। তুমি তো বিছানা নিছো ছয় মাস হইলো। সংসারডা চালায় কে? সংসার চালানের লাগি বউ আনতাছি।

তার স্ত্রী বলে, হ্যার কাম কী। পোলারা বড় হইছে, হ্যাদের বিয়া দাও। পোলার বউরাই সংসার দেখবো।

শুনে তাচ্ছিল্লের সঙ্গে হাসেন জমির শেখ। তারপর বলেন, বিয়া কইরাই পোলারা কী করবো জানো? কী?

কইবো জমি-জমা লিখা আলাদা কইরা দাও। আলাদা সংসার করুম।

তা কইবো ক্যান?

কইবো, কইবো। বউরাই শলা-পরামর্শ দিবো। বুঝছো।

বিয়া করবাই তুমি। তোমারে নিষেধ করলেও হুনবানা; কিন্তু পোলা মাইয়াডিরে ত্যাজ্য কইরো না। এই কথাডা রাখো।

জমির শেখ বলে, হ্যাদের মুখ সামলাইয়া চলতে কও।

সমস্যা দেখা দিল জয়নাব আর সুরুজকে নিয়ে। জমির শেখ চায় তারা নানার বাড়িতে থাকুক। মুন্সী হাফিজুদ্দিনেরও তাই ইচ্ছা। তিনি মানুষ করবেন এদের। জয়নাবকে বললেন, জনু, তুই এইহানে থাক।

জয়নাব বলে, না মায়ের লগে থাকুম।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলেন, হেইখানে যদি স্কুল না থাহে।

না থাকলে, পড় ুম না। মায়ের লগে থাকুম। মারে ছাইড়া থাকতে পারতাম না।

সুলতান বলে, তোর নানা ভালো কথা বলতিছে। নতুন জাগায় গেলি তোর পড়াশুনা বন্ধ হইয়া যাইতে পারে।

জয়নাব জেদী স্বরে বলে, যাইলে যাইবো। আমি মার লগে থাকুম।

সুরুজেরও এক কথা, ’মার লগে থাকুম।’ তার এখনো স্কুলে যাবার বয়স হয়নি। তার জন্য মুন্সী হাফিজুদ্দিনের অত চিন্তা নেই। জয়নাবের জন্য তার চিন্তা হয়। মেয়েটা পড়া-শুনায় ভালো। জমির শেখের বাড়ি গিয়ে পড়তে পারবে কিনা ঠিক নেই। তবু কিছু করতে পারেন না তিনি। ভাই-বোন যাবে তো যাবেই। তাদের একরোখা গো।

জমির শেখ তার বাড়িতে জয়নাবকে দেখে প্রথম দিন বলেন, এতবড় মাইয়া স্কুলে যাইয়া কাম নাই। এ বাড়ির মাইয়ারা বড় হইয়া স্কুলে যায় নাই কখনো। বাড়িতে থাইকাই আমপাড়া, ছিপারা পড়ো। আরবী শিহো। মৌলভী রাইখা দিমু। তবে মৌলভীর সামনে খালি শরীরে যাইবা না। বোরকা পিইন্দা যাইবা, বোরকা বানাইয়া দিমু।

শুনে তাজ্জব হয় রাহেলা। স্বামীকে বলে, জয়নাব ছোট। হ্যার আবার বোরকা ক্যান? তাও নিজের বাড়িতে?

জমির শেখ হুকায় টান দিয়ে বলেন, আমার মর্জি। এ বাড়িতে আমি যা কই তাই হয়।

রাহেলা বলে, তা হইলে বোরকা পইরা স্কুলেও যাইতে পারে।

না। পারে না। এ বাড়ির মাইয়ারা স্কুলে যায় না। বাড়িতেই পড়ে।

শুনে চুপ হয়ে যায় রাহেলা। জমির শেখকে একটা অত্যাচারী, নিষ্ঠুর মানুষ বলে মনে হয় তার। এই পরিচয় আরো স্পষ্ট হয় রাতের বেলা। সমস্ত সংসারের কাজ করে জমির শেখের প্রথম স্ত্রীকে খাওয়ানোর পর সে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে যায়। জয়নাব আর সুরুজকে শোওয়ায় ছোট এক ঘরে। পাশেই গোয়াল। গন্ধে টেকা দায়। সেই ঘরটাই দেয়া হয়েছে তার ব্যবহারের জন্য। রাতের বেলা কাটাতে হয় জমির শেখের ঘরে। তার হাত পা মালিশ আর শরীর টিপে দিতে হয়। যখন জমির শেখ উত্তেজিত হয় মাঝে মাঝে রাহেলাকে উপুর করে শুইয়ে ওপরে ওঠেন। বাতের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠে হাত-পা ছড়িয়ে দেন ওপরেই। এইভাবে লুঙ্গি নষ্ট হয় প্রতি রাতে। তাতে তার রাগ আরো বেড়ে যায়। রাহেলাকে আরো জোরে জোরে গা টিপতে বলেন। টিপতে টিপতে ঘুম আসে রাহেলার। হাতের মালিশ শিথিল হয়ে আসলেই ধমক দেন জমির শেখ। দাঁতে দাঁত চেপে বলেন, ঘুমাও ক্যান? ভালা কইরা টিইপা দাও। খালি খাওনের শরীর। এই সংসারে পোলা-মাইয়া নিয়া আইছো খাইয়া শেষ করনের লাইগা। কইলাম পোলা-মাইয়ারে রাইখা আইয়ো, হুনলা না। অহনে খালি আরাম-আয়েশ করবার চাও। তা হইবো না। জমির শেখ কাউরে বহাইয়া বহাইয়া খাওয়াইবো না। টিপো। জোরে জোরে টিপো।

রাহেলা ঘুমে ঢুলে পড়তে পড়তে জমির শেখের শক্ত হাত-পা টিপতে থাকে। তার বেশ কান্না পায়। নিজের কপালকে দোষ দেয় সে। ভোর বেলার দিকে ঘুমায় জমির শেখ। তার নাক ডাকে জোরে জোরে, তখন পা টিপে টিপে রাহেলা ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে ঢোকে। জয়নাব আর সুরুজ তখন অঘোর ঘুমে। তারা জাগে না। রাহেলা তাদেরকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে। ক্লান্তিতে ঘুম আসে দেখতে না দেখতে। বেশিক্ষণ ঘুমুবার সময় পায় না সে। মোরগের ডাক শুনে জেগে উঠতে হয়। সংসারের কাজ বেশির ভাগ তাকেই করতে হয়। সেই কাজে জয়নাবও সাহায্য করে। কখনো সুরুজ।

কাজ করতে করতে রাহেলা বলে, জয়নাব, তোর নানা বাড়ী যা গিয়া। পড়াশুনা কর। এহানে থাইকা কিছু হইবো না।

জয়নাব বলে, তোমারে ছাইড়া কোথাও যামু না আমি।

রাহেলা বলে, আমারে মাঝে মাঝে আইসা দেইখা যাবি। এত কী আর দূর?

জয়নাব বলে, না। আমি যামু না। আমার পড়াশুনার কাম নাই।

শেষে রাহেলাই বুদ্ধি করে পাড়ার পড় ুয়া ছেলেদের কাছ থেকে পুরানো বই এনে পড়তে দেয় জয়নাবকে। বলে, এইগুলা পড়। মনে করবি য্যান স্কুলে যাইতাছোস্। পরীক্ষা হইবো।

জয়নাব বলে, পরীক্ষা হইবো। প্রশ্ন পত্র কই?

তার মা বলে, প্রশ্ন পত্র কিরে মা?

জয়নাব বলে, যেই কাগজ দেইখা পরীক্ষা দিতে হয়।

রাহেলা বলে, পোলাপানরে জিগায় দেহি। তাদের পুরানা প্রশ্নপত্র থাকলে নিয়া আসুম। তুই দেইখা দেইখা পরীক্ষা দে।

জয়নাব বলে, আমার খাতা দেখবো কে? নম্বর দিবো কে? স্যার তো নাই।

রাহেলা কিছুক্ষণ ভেবে বলে, তোর সৎ ভাই হেরে কমু হ্যাদের কেউ না কেউ তোর খাতা দেইখা দিতে পারবো।

জমির শেখের মেয়ে দু’জন তাদের মায়ের পক্ষ নিয়ে রাহেলার সঙ্গে ভালো করে কথা বলেনি। দেখলে মুখ গম্ভীর হয়ে থেকেছে। বিয়ের রাতে বাড়ীতে আসার পর তারা তার কদমবুছিও করেনি। ছেলেদের মধ্যে ছোটজন মোটামুটি তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছে। অন্য দুই ভাই, বোনদের মতই তাকে উপেক্ষা করেছে এবং এড়িয়ে থেকেছে।

ছোট ছেলে কাসেম তাকে একদিন একা পেয়ে বলেছে, মা আমাদের ভুল বুইঝেন না। আমরা বড় বিপদে পড়ছি।

কী বিপদ বাবা?

এই যে আপনারে মাইনা নিতে পারতাছি না আমরা, আবার আপনার হাতের রান্না তিন বেলা খাইতাছি। স্বার্থপর মনে হয় আমাদের।

নাহ্্। স্বার্থপরের কী আছে? তোমাদের নিজেদের বাড়ি। যেই রান্না-বান্না করুক তোমাদের হক আছে খাওয়ার ওপর। আমি তো বাবার বাড়ি থেইকা কিছু আনি নাই। বলতে বলতে তার চোখ ভিজে যায় আর গলা ভারি হয়ে আসে।

কাসেম বলে, আমরা জানি আপনি ইচ্ছা কইরা এই বিয়া করেন নাই। আপনার আপত্তি ছিল। আপনার মনের বিরুদ্ধেই জোর কইরা এই বিয়া দেয়া হইছে।

শুনে রাহেলা চুলার মধ্যে কাঠ-খড়ি দেয়। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলে তার মুখ লাল হয়ে ওঠে। সে কিছু বলতে পারে না।

কাসেম বলে, আপনি আমাদের দিকটা ভাবেন। মা মারা যায় নাই এই অবস্থায় আরেকজনরে মা ডাকা কত কষ্টের।

রাহেলা বলে, তোমাদের মা ডাকতে হইবো না। মনে কইরো এ বাড়ির অন্য দাস-দাসীর মত আমিও একজন।

কাসেম তাড়াতাড়ি বলে, ছি ছি। কি কথা কন আপনি। দাস-দাসী হইতে যাইবেন ক্যান? আপনি এ বাড়ির বউ হইয়া আইছেন।

রাহেলা বলে, কপাল খারাপ হইলে দাসী ক্যান আরো নীচে নামন লাগে। সবই কপালের দোষ।

কাসেম বলে, আপনার মনের দুঃখ আমরা বুঝি। কিন্তু কী করতাম। মনডারে শক্ত করতাম পারি না।

রাহেলা একটু পর বলে, অমার মাইয়াডার পড়াশুনায় বড় সখ। টান। এহানে আইয়া তো স্কুলে যাইতে পারে না। বাড়িতে খালি আরবি পড়ে মৌলভীর কাছে। তুমি কী হ্যার পড়ালেখা একটু দেখাইয়া দিতে পারবা?

কাসেম বলে, পারুম না ক্যান? পারুম। আজ থেইকাই পড়ামু হ্যারে আমি।

কাসেমকে পড়াতে দেখে তার বড় ভাইরা টিপ্পনী কাটে। বলে, কীরে কত বেতন পাস?

কাসেম হেসে বলে, মাইয়াডা পড়া-শুনায় খুব ভালা। আব্বা তো স্কুলে যাইতে দেয় না। তাই একটু দেখাইয়া দিই। ছোট মানুষ। হ্যার কী দোষ?

তার বড় ভাই বলে, মারে কইছস্? কইয়া নিস্। না হইলে গোস্স্া হইবো।

কাসেম বলে, এইডা ভালা হইতাছে না। হ্যারা তো ইচ্ছা কইরা এহানে আসে নাই। জোর কইরাই পাঠান হইছে। একটা বুড়ারে কে বিয়া করতে চায়?

তার বড় ভাই হেসে বলে, খালি বয়সটাই দেখলি। বুড়ার যে জমি-জমা, টাকা-পয়সা আছে। হেইডা দেখলি না।

কাসেম বলে, এই সব দেইখা বিয়া করছে বলে মনে হয় না। এরা ভালা মানুষ।

তার মেজভাই বলে, ও। তুমি তা হইলে পইটা গ্যাছো গা।

হু। আম্মারে কইতে হয়। বড় ভাই বলে।

কাসেম বলে, কইতে চাইলে কও। তারপর বলে, না জাইনা, শুইনা মাইনষের গিবৎ গাওয়া ঠিক না।

তার বড় ভাই রেগে বলে, কী বললি তুই? আমরা গিবৎ গাই? খুব বাড় বাড়ছে দেহি। মাইয়া লোকডাতো সুবিধার না। তোর মগজ ধোলাই কইরা ফালাইছে এরি মধ্যে। আব্বার বেলায় তা হইলে তো কথাই নাই। জাদু জানে মাগি।

কাসেম বলে, ছি। ঐ কথা কইও না। সম্পর্কে মা লাগে, আমরা মানি আর না মানি।

তার মেজ ভাই বলে, মা না ছাই। উইড়া আইসা জুইড়া বইছে। হে আবার মা!

কাসেম তার ভাইদের সামনে থেকে চলে যায়। জয়নাবকে পড়ানোর সময় এখন। সে তার জন্য পুকুর পাড়ে খাতা-পত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে। কাঁঠাল গাছের নিচে দু’তিনটা গাছের গুঁড়ি ফেলানো। ওরা সেখানে বসেই পড়াশুনার কাজ করে। কাসেম শিক্ষক আর জয়নাব ছাত্রী। সুরুজ চুপচাপ বসে থাকে।

একদিন রান্না ঘরে ঢুকে কাসেম বলে, আম্মা। জয়নাব পড়া-শুনায় সত্যিই ভালো।

রাহেলা কাসেমের ’আম্মা’ ডাক শুনে গলে যায়। তার বুকের ভেতরটায় দক্ষিণের বাতাস বয়ে যায় যেন। সে হাসি মুখে বলে, বসো। বাপজান। বলে সে একটা পিঁড়ি এগিয়ে দ্যায়।

বসতে বসতে কাসেম বলে, জয়নাব স্কুলে পড়া-শুনা করলে খুব ভালো করতো। আব্বায় যে ক্যান মাইয়াদের পড়তে দ্যান না। বুঝি না।

রাহেলা বলে, তুমি যে কষ্ট কইরা পড়া দেখাইয়া দিতাছো এটাই যথেষ্ট। এতেই স্কুলের কাম হইয়া যাইবো।

কাসেম বলে, স্কুলে গিয়া তাদের পাঠ্যবই, পাঠ্যসূচী এইসব নিয়া আসুম আমি। তারপর সেই সব দেইখা পড়ামু। জয়নাবের পড়াশুনা স্কুলের সমান য্যান হয় হেইডা দেখমু।

রাহেলা হেসে বলে, তা হইলে তো খুবই ভালা হয়।

কাসেমের বড় আর মেজভাই গিয়ে তাদের মায়ের কাছে কাসেমের বিরুদ্ধে নালিশ দেয়। সব শুনে তাদের মা বলেন, কাসেমডা সব সময়ই বোকা। পরের মাইয়ারে পড়াইবার বেগার খাটতাছে ক্যান? তার কী লাভ?

বড় ছেলে বলে, আব্বার নতুন বউ নিশ্চয়ই তার মগজ ধোলাই করছে।

তাদের মা বলে, হ্যার মগজ ধোলাই করা লাগে না। হে সব সময়ই সাধা-সিদা।

মেজ ছেলে বলে, কিন্তু হে আমাদের মতের বিরুদ্ধে গেল গিয়া। এর লাগি কিছু কইবা না?

তাদের মা বলেন, তোরা কইয়া দ্যাখ।

বড় ছেলে বলে, আমরা কইছি। কোনো কাম হই নাই। রোজ পড়াইতাছে পুকুর পাড়ে বইয়া।

ছয় মাস পর তৃতীয় শ্রেণীর পরীক্ষার শেষে স্কুল থেকে প্রশ্নপত্র এনে কাসেম জয়নাবের পরীক্ষা নিল। খাতাগুলো পরীক্ষা করে দেখলো জয়নাব শুধু পাশ করেনি বেশ ভালো নম্বর পেয়েছে। সে রাহেলাকে খবরটা দিল।

রাহেলা খুশি হয়ে বললো, এইটা বাবা তোমার লাইগাই হইছে। তুমি হেরে পড়াইছো বইলাই হে ভালো করছে।

কাসেম বলে, না আম্মা। জয়নাব নিজের গুনেই ভাল করেছে। আমি আর কতটুক পারি। দিনে এক ঘন্টাও পড়াতে পারি না। ওর পড়াশুনায় ঝোঁক আছে। আব্বাকে বলে দেখি তিনি ওকে স্কুলে পাঠাতে রাজী হন কিনা।

এক সকালে বলতেই জমির শেখ কাসেমের দিকে তীক্ষè চোখে তাকালেন। তারপর অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, তুমি এই বাড়ির নিয়ম-কানুন ভাল করেই জানো। এইডা আমি বাইচা থাকতে ওলোট-পালট হইবো না। স্কুলে গিয়া মাইয়াদের পড়াশুনা হইবো না। বাড়িতে থাইকা যত পারুক পড় ুক। আমার আপত্তি নাই।

কাসেম বলে, কিন্তু আব্বা, বাড়িতে নিজে নিজে পড়ার একটা সীমা আছে তার উপরে উঠতে হইলে তাকে স্কুলে যাইতে হইবো। না হইলে ভালা শিক্ষক রাখতে হইবো। আমারে দিয়া হইবো না।

ভালা মানে? জমির শেখ তাকায় ছেলের দিকে।

ভালা মানে স্কুলে পড়ায়, এমুন একজন। কাসেম বলে।

বাইরের এক ব্যাটারে অন্দর মহলে ঢুকাইতে চাও তুমি? বড় বেআক্কল দেখি। পর্দা-পুশিদা থাকবো বাইরের লোক পড়াইতে আইলে?

কাসেম বলে, মৌলভী সাহেব আইলে পর জয়নাব যেমুন বোরকা পরে তেমুন না হয় বোরখা পড়বো।

জমির শেখ এবার রেগে গিয়ে বলে, তর্ক কইরো না। মৌলভি আরবি পড়াইতে আসেন, আর স্কুলের শিক্ষক আইবো ইংরাজি, বাংলা, অঙ্ক পড়াইতে। দুইডা কী এক হইলো? বাজে কথা কইয়ো না তুমি। এ বিষয় নিয়া তুমি আর কুনো কথা কইবা না আমার লগে। বাজারে আড়তের কাম দ্যাহা-শুনা করো। পড়া-শুনা নিয়া মাথা ঘামাইয়ো না। যাও।



৬.

দুপুরে জমির শেখ খেতে বসেছে। খালি পা, লুঙ্গি পরা। পেছনে একজন দাসী বড় পাখা দিয়ে বাতাস দিচ্ছে। জমির শেখ শিতল পাটিতে হাঁটু মুড়ে বসেছে, সামনের দিকে একটু ঝুঁকে। রাহেলা মাথায় ঘোমটা দিয়ে হাতে বড় চামচ নিয়ে বসে। সে কখনো কই মাছ, কখনো পাবদা মাছ তুলে দিচ্ছে। জমির শেখ মাছের টুকরো পুরো খাচ্ছে না, একটু খেয়ে পাশের থালায় ফেলে দিচ্ছে। এইভাবে ফেলে দেওয়া অবশিষ্টাংশের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ভাত তৈরি হয়েছে তিন রকমের চাল দিয়ে, বালাম চল, কালিজিরা, রাজভোগ। তরকারি অনুযায়ী জমির শেখের পাতে ভাত তুলে দিচ্ছে রাহেলা। খেতে খেতে ঘামছে জমির শেখ। ঘাম মুছছে পাশে রাখা তোয়ালে দিয়ে। লুঙ্গিটা ঘামে ভিজে যাচ্ছে। খেতে খেতে হাফিয়ে পড়ছে সে। তখন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। কোরাল মাছের বড় পেটের টুকরোটা পাতে নিয়ে চর্বিআলা অংশটা সে একবারে মুখের ভেতর পুরে দিলো। রুই মাছের মুড়ো দিয়ে ডালের ঘন্ট তৈরি হয়েছে। মস্ত বড় মুড়োটা পাতে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো জমির শেখ যেন ঠিক করছে কোন দিকে থেকে খাবে। হঠাৎ বিরক্ত হয়ে পেছনের দাসীর উদ্দেশ্যে বললো, এই করস কী? জোরে জোরে বাতাস দে। গরমে খাইতাম পারতাছি না।

দাসী জোরে জোরে বাতাস দেয়। রাহেলা রুই মাছের দ্বিতীয় মাথাটা দেবে কিনা জিজ্ঞাসা করে। জমির শেখ বলে, জিগাও ক্যান? পাতে দাও। জানই তো মুড়া আমার পছন্দের।

ডিমের দো-পেয়াজাও জমির শেখের পছন্দের। চারটা ডিম খেলো সে। সব শেষে দই আর সন্দেশ। আম কেটে রাখা হয়েছে কয়েক ধরনের। সে আম খেলো একটা একটা করে। হাই তুলে বললো, এবারে ভালো আম আসে নাই মনে হয়।

পেছনের দাসী বললো, বাজারে আমের ব্যাপারীরা ডরাইতাছে কইলো সলিমুদ্দিন।

ক্যান ডরায় ক্যান?

পুলিশ আইয়া ভেজাল আম সব ফালাইয়া দিতাছে।

হু। আমেও ভেজাল ঢুকছে। হালার কী একখান দেশ। কিছুই ভালা রাখবো না। মাছেও হুনি এই রকম করতাছে। আমাদের মাছ পুকুরের তো?

রাহেলা বলে, জ্বি। সবই পুকুরের আর বিলের। বাজারের মাছ নাই।

একটা মস্ত বড় ঢেঁকুর তুলে জমির শেখ বললো, হুনো ছোট বউ। তোমারে শেষবারের মত কথাডা কই। বলে সে একটু বিরতি দেয়। রাহেলার বুক ঠক্ ঠক করে। তখন জমির শেখ বলে, তোমার মাইয়াডা। তারে অত লেহাপড়া শেখানের কাম নাই। আগেই কইছি তোমারে, এই বাড়ির মাইয়ারা স্কুলে যায় না। বাড়িতে আরবী, ফার্সি পড়ে। এইতেই হইয়া যায়। শেখ বাড়ির মাইয়াদের বিয়ের লাগি লোকে পাগল। তাদের পড়াশুনা লাগে না।

রাহেলা বলে, হ্যা তো স্কুলে যায় না।

স্কুলে যায় না, কিন্তু স্কুলের পাঠ্যবই পড়ে। কাসেমডা তার শিক্ষক হইছে। নিজের কাম ফালাইয়া হে স্কুল শিক্ষক হইছে। এসব হইবো না। বন্ধ করো। মাইয়াডারে সাবধান কইরা দাও। এই বাড়ির নিয়ম-কনুন মাইনা চলতে হইবো। এই শেষ বারের মত কইলাম। আর যেন উল্টা-পাল্টা না শুনি। খেয়াল রাইখো।

জমির শেখ বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত ধোয়, মুখ কুলকুলি করে তারপর তোয়ালে দিয়ে হাত মুছে সে রাহেলের হাত থেকে পান নেয়, পানের বোঁটায় লাগানো চুন মুখে দ্যায়। তারপর একটা বড় হাই তুলে রাহেলাকে ধমকের স্বরে বলে, যা যা কইলাম মন থাকে য্যান। মাইয়াডারে মাথায় উঠাইও না। পরে পস্তাইবা।

জমির শেখ দুপুরে খাবার পর ঘুমাতে যায়। যে পর্যন্ত না ঘুমায় রাহেলাকে তার পা, উরু টিপে দিতে হয়। ঘুমুনোর পর তার ছুটি। তখন সে রান্না ঘরে গিয়ে খেতে বসে। জয়নাব প্রায়ই তার সঙ্গে খায়। তার একা খেতে ভালা লাগে না। খেতে খেতে সে কাসেমের কথা বলে, পড়াশুনার কথা বলে। কাসেমের প্রশংসা করে। আজও তাই করছিল। রাহেলা হঠাৎ বললো, কাসেম তোরে আর পড়াইতে পারবো না।

ক্যান? পড়াইতে পারবো না ক্যান? জয়নাব তাকায় মা’র দিকে।

তার কাম বাইড়া গিছে। বাজারে গুদাম দেখতে হইবো, চালের কল, আটাকল দেখতে হইবো। বাড়িতে থাকনের সময় পাইবো না। তোরে পড়াইবো কহন?

শুনে জয়নাবের চেহারা ম্লান হয়ে যায়। তার চোখে পানি আসে। তার মা বলে, নিজে নিজে পড়বি, পারবি না?

জয়নাব অস্ফুটে বলে, পারমু।

দুপুরে কাসেম জয়নাবকে ডেকে বলে, আমি বাজারে যাই। আড়তের কাজ দেখতে হইবো। এ্যাহন থাইকা রোজই দেখতে হইবো। চালের কলেও গিয়া বসতে হইবো। তোরে আর পড়াইতে পারুম না।

জয়নাব বলে, হুনছি।

কাসেম অবাক হয়ে বলে, ক্যাডা কইছে? কার হান থে হুনছো?

জয়নাব বলে, মা কইছে।

শুনে কাসেম ঠোঁট কামড়ায়, একটা কিছু ভাবে। তারপর বলে, তোর বইখাতা-পত্র জোগাড় কইরা দিমু। তুহ একা পড়তে পারবি। তাছাড়া মাঝে মাঝে কী আর পড়াইতে পারুম না? শেষের দিকে তাকে বেশ স্বাভাবিক মনে হয়।

জয়নাব বলে, হ। তুমি বই-পত্র আইনা দিও। আমি একাই পড় ুম।

বর্ষার শেষে আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসে। বেশ নীল রঙ ঝকঝকিয়ে লেপে দেয় আকাশের বুক। সাদা মেঘ কাশ ফুলের মত নড়ে-চড়ে ওঠে আকাশে। চিলগুলো অনেক ওপরে ঘুরে ঘুরে ওঠে। উঠোনে ধান শুকোতে দিয়ে ওপরে তাকায় রাহেলা। ঘর-সংসারের কাজ করতে করতে তার বাইরের দিকে তাকানো হয় না। বেড়ার মধ্যে আটকে আছে সে। একইভাবে দিনের পর দিন যায়, রাত আসে, সেই রাতও শেষ হয় দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে। মনে হলো অনেক দিন সে আকাশ দেখে না।

একদিন সকালে জমির শেখ বিছানা থেকে আর ওঠে না। এত বেলা পর্যন্ত ঘুমুতে দেখে রাহেলা ভেতরে গিয়ে ডাক দেয় কয়েকবার। প্রথমে আস্তে, তারপর জোরে। কিন্তু জমির শেখ নড়ে না। সে লম্বা হয়ে যেমন শুয়েছিল তেমনভাবেই থাকে। রাহেলা শঙ্কিত হয়ে তার কাঁধ ধরে নাড়া দিতে গিয়ে দেখে সেটা কাঠের মত শক্ত। সে চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকারে দাস-দাসী ঘরে ঢোকে। তারাও একটু পর চিৎকার দিতে থাকে। কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করে।

কাসেম ঘরে ঢুকলে রাহেলা বলে, তোমার বাপজান। নড়ে না, কথা কয় না।

তার কথা শুনে কাসেম বাবার শরীর স্পর্শ করে। ঠান্ডা আর শক্ত শরীর দেখে সেও কাঁদতে শুরু করে।

একটু পর জমির শেখের সব ছেলে ঘরে ঢোকে। তার মেয়েদের খবর দেওয়া হয়।

জমির শেখের প্রথম স্ত্রী খবর পেয়ে বলে, অমঙ্গল। ঐ দ্বিতীয় বউটা একটা অমঙ্গল। তারে বিয়া কইরাই লোকটার আয়ু ফুরাইলো। রোজ রাতে তার শরীর দলাই-মলাই করে, পা টিইপা দ্যায় বইলা হুনছি। একটা পুরুষ মানষের শরীর বুড়া বয়সে অত হুজ্জত সহ্য করতে পারবো? মাইরা ফেলাইছে ঐ মাগী। শনির আছর আছে হ্যার ওপর। ঐটারে তাড়া বাড়ী থাইকা, না হইলে আরো বিপদ হইবো।

জমির শেখের কুলখানির পরই রাহেলাকে ছেলে-মেয়েসহ বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাকে দেখে সৎ মা কুটিল হাসি মুখে নিয়ে বলেন, ফিরা আইছো? হ। তোমার কোনো ঘরই টিকবো না। তোমার কপালে স্বামী নাই। নিজের সংসার নাই।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন দুঃখের সঙ্গে বলে, হ্যারা আর কটা দিন অপেক্ষা করতে পারলো না? চল্লিশার পরই না হয় আইতে কইতো। ক্যামুন মানুষ? একটা বছর মাইয়াডা আমার দাসীর মত হেই বাড়িতে খাটা-খাটনি করলো। হ্যারে কিনা ফকিরনীর মত তাড়াইয়া দিলো।

জয়নাব নানার বাড়িতে এসে খুব খুশী হলো। তার ভাই সুরুজও। মনতাজ তাদের নিয়ে আগের মত ফলের বাগানে ঘোরাঘুরি করে সময় কাটায়। তাদের কথা আর হাসি শুনে মনের দুঃখ ভুললো রাহেলা। সে আবার পশ্চিমের ঘরে পাট, চাল-ডালের বস্তার পাশে তাদের বিছানা পেতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সৎ মা আর সৎ বোনগুলো বিদ্রƒপ করে, গাল শোনায়। কিন্তু তার ভাই সুলতান আর ভাবী কুলসুম তাকে আগের মতই আদর করে। আর মনতাজ তো জয়নাবকে কাছে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা।

জয়নাব সবচেয়ে খুশী হয় স্কুলে যেতে পেরে। সে তৃতীয় শ্রেণীর পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হয়েই চলে গিয়েছিল। এখন এক বছর পর আসার কারণে তাকে নিয়মমত চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হতে হবে। কিন্তু তাহলে সে তার আগের সহপাঠীদের তুলনায় পেছন পড়ে যাবে। মনতাজ বললো, স্যারকে কইয়া দেখ্। তোরে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি করতে পারে কিনা।

শুনে স্যার বলেন, এইডা তো নিয়ম নাই। তুই চতুর্থ শ্রেণীর পরীক্ষা দ্যাস নাই। তোরে পঞ্চম শ্রেণীতে ক্যামনে ভর্তি করি। তারপর কী ভেবে তিনি বলেন, তুই পরীক্ষা দিতে পারবি?

জয়নাব বলে, জ্বি, পারুম।

তার শিক্ষক বলেন, যদি পরীক্ষায় পাস করতে পারিস তা হইলে পঞ্চম শ্রেণীতেই ভর্তি করুম তোরে।

জয়নাব পরীক্ষায় ভালভাবেই পাস করে। কাসেম ভাই তাকে যেভাবে পড়িয়েছে তার জন্য পরীক্ষা দিতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তার শিক্ষক খুশী হয়ে বলেন, ভালা হইছে। না হইলে আমার মনডাও খারাপ হইতো। তুই এতো ভালা ছাত্রী। তোরে ক্যামনে নিচের ক্লাসে ভর্তি করি।

মনতাজ বাড়িতে গিয়ে তার মাকে বলে, মা, জয়নাব আমার ক্লাসে ভর্তি হইছে। নিচে ভর্তি হইতে হয় নাই। তার মা জয়নাবকে ডেকে আদর করে বলে, তুই আরো ভাল কর মা।

রাহেলা শুনে খুশী হয়। রান্না ঘরে উনোনের পাশে বসে অগ্রহায়ণ মাসেও সে ঘামছিল। ঘাম মুছে জয়নাবকে কাছে এনে কপালে চুমু দিয়ে বললো, বাইচা থাক। যেমুন কইরা পারিস বাইচা থাক মা। তরো উন্নতি হইবো। কোন অর্থে কেন এই কথা বলে তার মা জয়নাব তা বোঝে না। কিন্তু কথাটা তার মনে দাগ কাটে। ’বাইচা থাক। যেমুন কইরা পারিস্ বাইচা থাক্।’ সে তো বাইচাই আছে তা হইলে একথা কওনের মানে কী? তার মা কী এমন কিছু জানে বা দেখতে পায় যা সে জানে না কিংবা দেখতে পায় না? জয়নাবের মনটা খচখচ করে।

রাহেলা বাপের বাড়ী আসার কয়েকদিন পর মৌলভী কেফাতুল্লাহ এসে হাজির। দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে তিনি রান্না ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রাহেলাকে বলেন, তুমি আইসা পড়ছো?

রাহেলা তার কথার উত্তর দেয় না। মৌলভী কেফাতুল্লাহ চারিদিক দেখে রান্না ঘরের প্রবেশ পথে মোড়া নিয়ে বসে বলেন, আহা, তোমার কপালটাই খারাপ। এত ভাল ঘর দেইখা নিকাহ্ দিলাম। হেইটাও টিকলো না। জমির শেখ যে এত তাড়াতাড়ি মইরা যাইবো ভাবতে পারি নাই। তা ভালা করছো বাপের বাড়ি আইসা। ভাই-বোন হগলে একলগে থাকবা। আর আমি তো আছিই।

রাহেলা তবু কোনো কথা বলে না। বরং তার থেকে একটু দূরে সরে বসে এবং মাথায় লম্বা ঘোমটা দেয়। দেখে মৌলভী কেফাতুল্লাহ বলে, আমারে দেইখা অত শরমাও ক্যান? হোক না হিল্লা বিয়া, আমি তোমার সোয়ামী আছিলাম। লজ্জার কী আছে?

রাহেলা বিরক্ত হয়ে বলে, আমি এ্যাহন ব্যস্ত। তাছাড়া ধারেকাছে কেউ নাই। আপনি যান এহন থে।

হে হে হে। কি যে কও। কতদিন পর দেখলাম। ভালা আছোনি, শরীরডা ক্যামুন এইসব না জিগাইয়া যাই ক্যামনে? আমার একটা দায়িত্ব আছে না? তারপর রাহেলার শরীর জরিপ করে বলে, শরীরডা মাশাল্লাহ খাসা রাখছো। কী শক্ত বাঁধুনি। য্যান মনে হয় সিমেন্টের ঘাটলা। চক্চক্ করতাছে।

রাহেলা ক্রুদ্ধ স্বরে বলে, আপনি যাইবেন? না চিক্কার দিমু?

মৌলভী কেফাতুল্লাহ একটু থতমত খেয়ে বলে, অমন করতাছো ক্যান। আমি কী পর? অল্প কয়দিন হইলেও স্বামী আছিলাম। ঐ শরীরডাঃ। তার কথা শেষ হবার আগেই রাহেলা চূলা থেকে জ্বলন্ত কাঠের টুকরো বার করে বলে, অক্ষণে যান। না হইলে আগুন লাগাইয়া দিমু। শয়তান কোথাকার?

মৌলভী কেফাতুল্লাহ লাফ দিয়ে উঠোনে নেমে রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে বলেন, আরে বাপরে। অক্করে সাপের লাহান। ছোবল দিতে চাও দেহি। কাণ্ডটা কী? আমি তোমার কী ক্ষতিটা করছি? এ্যা?

চলে আসার সময় জয়নাব আর মনতাজের সঙ্গে দেখা মৌলভী কেফাতুল্লার। সে জয়নাবকে দেখে বলে, স্কুল থেইকা আইতাছো বুঝি? ভালা, খুব ভালা। তোমার চেহারাডা দেহি মায়ের মতন হইছে। খুব সুন্দরি হইবা তুমি। হে হে হে।

জয়নাব বিরক্তি আর রাগের সঙ্গে মৌলভী কেফাতুল্লাহকে দেখে পশ্চিমের ঘরের দিকে যায়। সেখানে বই-খাতাপত্র রেখে সে খেতে যাবে রান্নাঘরে। মনতাজও তার সঙ্গে যাবে। জয়নাব রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো মা একটু রেগে আছে। মুখ বেশ ভার। সে বুঝলো মৌলভী কেফাতুল্লাহ তাকে বিরক্ত করে গিয়েছে। কথাটা না তুলে সে শুধু বললো, মা খাইতে দাও। ক্ষিধা পাইছে। মনতাজও খাইবো। সুরুজরে দেহি না? সে কই?

রাহেলা উনোনে জ্বালানি কাঠ ঠেলে দিতে দিতে বলে, বাগানে ঘুরতাছে। এ্যাহনো খাইতে আহে নাই। সারাদিন দুষ্টামি করে। তারে ডাক দেহি।

জয়নাব বলে, সামনের বছর হ্যারে স্কুলে দিবা। স্কুলের বয়স হইবো তহন। স্কুলে গেলে আর দুষ্টামি করবো না। তারপর বলে, তারে ডাইকা নিয়া আহি। তিনজনে একলগে খামু।

রাহেলা মুখ তুলে বলে, তোর না ক্ষিধা পাইছে? আগে খাইয়া নিবি?

পাইছে। তুমি ভাত বাইড়া দিতে দিতে আইয়া পড় ুম। সে মনতাজকে নিয়ে সুরুজের সন্ধানে বের হয়।

রাহেলা তাকিয়ে দেখে জয়নাব যেন হঠাৎ লম্বা হয়ে গিয়েছে। মনতাজের মাথা ছাড়িয়ে গিয়েছে। বার বছর বয়স তার। নাকি তের? হিসাব করে রাহেলা।

মৌলভী কেফাতুল্লা মুন্সী হাফিজুদ্দিনকে বলে, মাইয়াটার কপাল খারাপ। স্বামীটা মারা গেল।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলেন, হ্যা। কী আর করা।

মৌলভী কেফাতুল্লাহ সুযোগ বুঝে বলে, মশাল্লা শরীর স্বাস্থ্য ভাল আছে। আর একটা বিয়া দেওন যায়। যদি কনঃ?

শুনে রেগে যান মুন্সী হাফিজুদ্দিন। রাগের স্বরে বলেন, মাইয়াটারে কী খাজুর গাছ পাইছেন? প্রতি বছর আগা চাইছা রস বার করতে অইবো? আমার মাইয়ার আর বিয়া দিমু না। আমার বাড়িতেই থাকবো। অনেক হইছে।

মৌলভী কেফাতুল্লা হকচকিয়ে গিয়ে বলেন, আমি ভালা মনে কইরাই কইলাম। আপনি অন্যভাবে নিয়েন না।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলেন, ভালার দরকার নাই। এমনিতেই চলবো। আপনি আর তার বিয়ার কথা কইবেন না। তারপর হুক্কায় টান দিয়ে বলেন, লোকে হাসবো না? একটা তামাশা মনে করবো সবাই। আমি তামাশা হতে দিমু না।

মৌলভী কেফাতুল্লাহ বলে, লোকে কী মনে করলো হেইডা চিন্তা করবেন ক্যান? আপনি আপনার ভালা দেখবেন। মাইয়ার ভালা কীসে হেইডা দেখবেন।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন হুক্কা নামিয়ে রেখে বলেন, হ্যা। সব চিন্তা কইরাই কইতাছি। আপনি আর বিষয়টা আমার সামনে তুলবেন না।

মৌলভী কেফাতুল্লাহ হাল ছাড়তে চায় না। সে বলে, হায়াৎ-মওত আছে। কহন কী হয়? এ্যাহন না হ আপনি আছেনঃ।

তার কথা শেষ হবার আগেই মুন্সী হাফিজুদ্দিন রেগে বলেন, আপনি যাইবেন? আমার মেজাজটা আইজ ভালা নাই। জমিতে পোকা পড়ছে। আপনি আইয়া এ্যাহন জ্বালান শুরু করছেন। ভালা লাগতিছে না। আপনি বাইত যান।

কয়েকদিন পর জয়নাব এসে তার পা ছুঁয়ে সালাম করে বললো, নানা আমি বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি পাইছি।

মুন্সি হাফিজুদ্দিন তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, হ্যা নানা, আমি জানি তুমি বৃত্তি পাইবা। জীবনে আরো বৃত্তি পাইবা। মন দিয়ে পড়াশুনা করো।

রাহেলা জয়নাবকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুইই আমার ভরসা। তোর লাইগাই বাইচা আছি। তুই বড় হইলে, নাম করলে আমার সব দুঃখ যাইবো গিয়া।

জয়নাব মায়ের বুকের সঙ্গে লেপ্টে থেকে বলে, মা, তুমি দোয়া করো।

মনতাজের মা কুলসুম এসে বলে, কীরে জয়নাব, মামীরে সালাম দিবি না? খালি মারে করলেই হইবো। এতো ভালা খবর।

রাহেলা মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে বলে, যা মামীরে সালাম কর। মামা আইলে মামারেও করবি। তারপর কী ভেবে বলে, নানীরেও করিস্। ক্যান করবি না? তোর কাম তুই করবি। হের কাম হে করবো।

কুলসুম জয়নাবের কপালে চুমু খেয়ে বলে, খুব ভাগ্যবতী হও। সুখি হও। এই দোয়া করি।

তার কথা শুনে রাহেলার চোখ ভিজে আসে। সে চুলায় কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালায়।



৭.

জয়নাব যখন এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৪ পায় এবং বৃত্তি লাভ করে মুন্সী হাফিজুদ্দিন তখন রোগ-শয্যায়। অনেকদিন থেকে রোগে ভুগছে। শীতকাল এলে তার এ্যাজমার অসুখটা বাড়ে প্রতি বছর। জয়নাব এসে তাকে সালাম করে খবরটা দিতেই তিনি উঠে বসবার চেষ্টা করলেন। তারপর শুয়ে থেকেই বললেন, মাশাল্লাহ। খুব ভালো খবর। আমি জানতাম তুমি বৃত্তি পাইবা। আরো পাইবা। আমি দেইখা যাইতে পারুম কিনা জানি না। বলতে বলতে তার চোখ ভিজে আসে। রাহেলা পাশে বসে মাথায় হাত রেখে বুলিয়ে বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, আপনে দেখবেন। সব দেখতে পাইবেন আব্বা। জয়নাবের নাম-ডাক সব শুনতে পাইবেন।

মনতাজকে দেখে মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলেন, তোমার খবর কী মিয়া?

কুলসুম বলে, হে ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করছে।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলে, হ্যা। এইটাও ভালা খবর। তুমিও ভালা করেছো দাদা। বলে তিনি একহাত জয়নাব আর অন্য হাত মনতাজের মাথায় রাখেন।

বিকেলে উঠোনে বসে রাহেলার মাথার চুলে নারকেলের তেল মেখে দিচ্ছে কুলসুম। কয়েকটা মোরগ-মুরগী খুটে খুটে খাবার খাচ্ছে। শীতের উত্তরে হাওয়া এসে দুজনকেই একটু কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আকাশটা নীল আর ঘষা-মাজা। রাহেলা বললো, আইজ রাতে বেশি উষ পড়বো। ঠাণ্ডাও পড়বো।

কুলসুম গায়ের কাপড় টেনে জড়িয়ে নিয়ে বলে, হ। শীত বাড়তাছে। এবারের শীতের কামড় য্যান বেশি।

রাহেলা বলে, শীত না কমলে আব্বার কষ্টটা বাইড়া যাইবো। এমনিতে খুব কষ্ট পাইতাছে।

কুলসুম বলে, একটা ব্যাপার দেখছো রাহেলা?

রাহেলা বলে, কী?

মায়ে বাপের লাইগা একটুও চিন্তা-ভাবনা করে না। খাইলো কী খাইলো না এসব দ্যাহে না। য্যান কুনো মাথা-ব্যথা নাই।

রাহেলা ঠোঁট উল্টে বলে, কবে আছিলো?

কুলসুম তেল মাখাতে মাখাতে বলে, রাহেলা তোমারে একটা কথা অনেক দিন ধইরা কইতে চাই। আজ কইয়া ফালাই।

রাহেলা হেসে বলে, কন্। এত ভাবনের কী আছে?

কুলসুম বলে, মনতাজ আর জয়নাবের মধ্যে খুব মিল। একজন আরেকজনরে ছাড়া থাকে না। আমার খুব ইচ্ছা হ্যাদের দু’জনের বিয়া হোক। এ্যাহনে না, আরো বড় হইলে।

রাহেলা হাসি মুখে বলে, এতো খুব ভালো কথা। এইডা কইতে এত ভাবনের কী আছে? জয়নাব খুব খুশি হইবো। তারপর কী ভেবে বলে, ভাইজান? তারে কইছেন?

কুলসুম বলে, কই নাই। কিন্তু সেও রাজী হইবো। খুশি মনেই রাজী হইবো। তোমাদের খুব পছন্দ করে হে।

রাহেলা বলে, আব্বা আর আপনাদের জন্যই এ বাড়ির মাটি কামড়াইয়া বাইচা আছি ভাবী।

কুলসুম বলে, কী যে কও। এইডা তোমারও বাড়ি। এহানে থাকনের হক্ তোমারও আছে। জয়নাব, সুরুজ এ বাড়িরই পোলা-মাইয়া।

উত্তর দিক থেকে একটা ঝড়ো হাওয়া এসে তাদের প্রায় ফেলে দেয়ার উপক্রম করে।

ত্রস্তে উঠে কুলসুম বলে, ঝড় আইতাছে নাহি? বাতাসে কী জোর।

রাহেলা শাড়ি ঠিক করে পড়তে পড়তে বলে, জবর ঠাণ্ডা এই বাতাসে। য্যান দাঁত বসাইয়া দিলো। মাগো মা।

রাতের বেলা কুলসুম স্বামীকে বলে, রাহেলার আপত্তি নাই।

কিসে?

মনতাজের সঙ্গে জয়নাবের বিয়া দিতে। আজ তুলছিলাম কথাটা।

শুনে সুলতান হেসে বলে, এখনই বিয়া? ওরা দুইজনই ছোডো। আরো বড় হইতে দাও।

কুলসুম বলে, মনের ইচ্ছাডা কইয়া রাখলাম। দেখলাম তার কিছু কওয়ার আছে কিনা।

সুলতান বলে, ভাল করছো।



৮.

শীতের শেষেই গরমের মৌসুম এসে গেল এবার। তারপরই নামলো বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি অনেক দিন কেউ দেখেনি। আকাশ সেই যে মেঘে ঢাকা, তার আর শেষ নেই। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বৃষ্টি শুরু হয়। খাল-বিল-নালা-নর্দমা সব ভর্তি হতে থাকে। নদী ফুলে ফেঁপে ওঠে। স্রোত বেগবান হয়। উজান থেকে ভেসে আসে কাঠ, গাছপালা, নানা রকমের জঞ্জাল। লোকে বলাবলি করে, এবার বন্যা আসবে।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন সুলতানকে বলে, বাপ নৌকা ঠিক কইরা রাহো। বান আইলে বাড়ি-ঘর ডুববো। চাউল-পাট নিয়া উঁচা জায়গায় রাখতে হইবো। নিজেদেরও যাইতে হইবো আশ্রয়ে।

সুলতান বলে, হ, বাজান দেখতাছি। নতুন নৌকা দুইডা কিনন লাগবো। এবার মানুষ বেশি।

মুন্সী হাফিজুদ্দিন বলে, হ। রাহেলা আর তার পোলা-মাইয়া আছে।

বন্যার জন্য যখন সবাই তৈরি হচ্ছে সেই সময় একদিন মৌলভী কেফাতুল্লাহ বলেন, মুন্সী সাব, কিছু চিন্তা-ভাবনা করছেন? বলে সে দাঁড়ি চুলকায়।

কিসের? বানের লাগি? হ। নৌকা কিনতাছি।

বানের কথা কই না। কইতাছি আপনার নাতনী জয়নাবের কথা।

তার কী হইলো? স্কুল তো অহন বন্ধ। বাড়ীতেই থাহে। তার কিছু হইছে?

না হয় নাই। মানে হওন লাগে না? বলে কেফাতুল্লা মিষ্টি হাসেন।

কী হওন লাগে? বুঝতে না পেরে তাকায় হাফিজুদ্দিন।

বিয়া-শাদি। ডাগর হইছে। এ্যাহন একটা বিয়া দেওন লাগে। যদি কন্ জামাই দেহা শুরু করি। বলে কেফাতুল্লা দাড়িতে বিলি কাটে।

শুনে রাগে ফেটে পড়ার জোগাড় হয় মুন্সী হাফিজুদ্দিনের। তিনি অসন্তুষ্ট স্বরে বলেন, আপনার দেখি আক্কেল একটু কমই। এখন লোকে জান-মান বাঁচাইবার লাইগা ভাবতাছে আর আপনি আইছেন বিয়ার পয়গাম নিয়া। আপনের হইছে কী?

কেফাতুল্লাহ বলে, সারা জীবন মাইনষের খেদমত কইরা গেলাম। তাই বান হোক আর যাই হোক মাথার মধ্যে খেদমতের কথাটা ঘোরে। আইজ হোক, কাল হোক বিয়া তো দিবেন। ত্য এ্যান থেইকাই বিচরাইলে ভালা না?

মুন্সী বলেন, আপনি জয়নাবের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করবেন না। সেটা ঠিক হইয়া গিছে গা।

ঠিক হইয়া গ্যাছে? কোন হানে?

আমার পরিবারেই। সুলতানের পোলার লগে।

আরে, তোউবা। হ্যা তো অহনা পোলাপান। তাছাড়া মামাতো ভাই না? আত্মীয়ের মধ্যে বিয়া দিবেন?

মুন্সী বলেন, মনতাজ কী সারাজীবনই ছোট থাকবো? বড় হইবো না? আর বিয়া তো অহন হইবো না। বড় হইলে দিমু। মামাত ভাই? ক্যান শরিয়তে না করে? এমুন কত বিয়া হইতাছে।

কেফাতুল্লাহ একটু দমে যায়। দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, ভাইবা দেহেন। আরো জামাই আছে। জাগা-জমি, বড় পরিবার, খানদান। বিয়া মানেই তো পরিবার বড় করা। বাইরের পরিবারের সঙ্গে দিলে অনেক .......

২টি মন্তব্য:

  1. উফ! এত বড় পোস্ট?? সত্যি বলছি, আমি পড়িনি। দু:খিত।

    aR
    Bangla Hacks

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন