সোমবার, ৩১ আগস্ট, ২০০৯

আমার শ্বাসমূল

কাজল শাহনেওয়াজ


দুইটা প্রাচীন গাছ ও একটা দাদাকাছিম
........................
ঐ গ্রামে প্রাচীন দুইটা অক্ষয়গাছ আছে।
সেই গাছের ছায়ার নিচে বিশ্রাম নিতে নিতে
বহু বছরের পূরানো একটা কাছিম
আকাশের দিকে তাকায়ে তাকায়ে গাছ দুইটারে নিয়া অনেক ভাবিছে:
কিভাবে এতোদিন ধরে বাঁচি আছে এরা?
চারিদিকে এতো ছোট গাছের মধ্যে?

একশ বছর, দুইশ বচ্ছর? কে জানে কতদিন?

গ্রামের লোকেদের মধ্যে সবচে শাদা চুল যাদের তারা বলে:
আমরাই তো বাঁচায়ে রাখছি গাছ দুইটারে
নাহলে ধরেন যখন লোকজন কুড়াল নিয়ে আসছিল,
আমরা কি তাদের ফিরাই নাই?

ভাবতে ভাবতে শ খানেক বছর কাটি গেছে মহাপিতামহ গজকচ্ছপের,
কিন্তু এখনো তিনি কিছুতেই বুঝতে পারেন নাই,
গাছকে কে বাঁচায়ে রাখে - মাটি আর আকাশ?
কচ্ছপকে কে বাঁচায়? পানি আর শ্যাওলা?
তা হলে মানুষের এই কথার মানে কি?

ঐ গ্রামে মাঝে মাঝে আমি যাই,
ঘুরে ফিরে গাছ দুইটাকে সালাম জানায়ে আসি,
দিঘিটার পানিতে নেমে কাছিমদাদাকে কদমবুচি করি

ওঁরা আশির্বাদ করে: বেঁচে থাকো।

অতোদিনতো অসম্ভব,
আমার যে আর একটা দিনও বাঁচতে ইচ্ছা করেনা।


কবিতার জন্য
..........
নতুন কবিতার জন্য নিজেকে বদলায়ে বদলায়ে চলি
বহুদিন থাকি পাউরুটি খাই
কাঁটা চামচ পকেটে ঢুকাই
লাইবেরিয়া না গিয়া লাইব্রেরীতে ঘুমাই।

হো হো হো হা হা
কবিতাযে কতো রকম দেখি তাকাইয়া
দিনে দিনে কতোবার পাল্টায় কবিতার রকম সকম!

মানুষ বদলায়, কবিতাযে বদলায় আরো বেশি
মানুষ মরে, কবিতা হয় এলোকেশি।

নতুন কবিতার জন্য নিজের কান নিজেই পরিষ্কার রাখি,
পরিষ্কার করি নাক, জিহবা
লালন ফকির গেয়ে এক কলি পরীক্ষা করি ঠিক শুনতে পাচ্ছি কিনা,
একটা কামড় দেই অর্জুনের ছালে।

একটা কামড় বাংলাভাষার একহাজার বছরে,
চর্যায় এক কামড়, মঙ্গল কাব্যে একটা
পুঁথির আনন্দে কাটাই কিছুকাল
কিছুকাল উপনিবেশের ঝাপটা

ধান চাষের তিন হাজার বছর
শুঁকতে শুঁকতে আমার নাক হয়ে যায় বুনো শুয়োরের
সৌর বছরগুলি ঘুরতে ঘুরতে যেভাবে বাংলা বছর হয়ে যায়

রসের ইক্ষুদন্ড চিবাইলে জিহবার আর কোনো সমস্যা থাকে না!
কবিতার জন্য জিহবা পরিষ্কার করার কায়দাটাও
নতুন শিখছি ভারতচন্দ্রের কাছে
আর কে না জানে,
হরেক রকম কবিতার জন্য নতুন স্বাদ অতি প্রয়োজন!


তাকায়ে আছে
........
ঐ দেখো কাজের খোঁজে আসা মানুষেরা বসে আছে

ওদের কারো হাতে টুকরি ও কোদাল, কারো হাতে কর্ণি,
কিন্তু যার হাতিয়ার নাই সে নিজের হাত সামনে সাজিয়ে বসে আছে

রাস্তারার পাশে কাজের খোঁজে আসা কোদাল তাকিয়ে আছে টুকরির দিকে,
দা কাঁচির দিকে,
করাত বাটালির দিকে,
কর্ণি তাকিয়ে আছে যোগালির তাওয়ার দিকে
সবাই থাকতে থাকতে অসহ্য হয়ে গেছে
কাজের লোক এভাবে বইসা থাকতে কি আর পোষায়!

মধ্য প্রহরের সূর্য তাতায়ে উঠছে নাকি?
কেউ তাকায়ে দেখছেনা

হালায় একটা রাম টুকরি : হাতের কোদাল কয়
হালায় ভোদাই করাত : বাটালি টাটায়
হউরের পো’র বিচি নাই : যোগালি চেঁচায়

কাজের সন্ধানে আসা মানুষগুলি
কোদাল, করাত, কর্ণি, টুকরি লইয়া বসা
কেউ তাকাইয়া দেখে না


এই শরতে আমাদের নামাবাজার
...................
দু কদম গেলেই ট্রাকদের অফিস, একটা ছোট বট,
হুরহুর করে মানুষ আসা যাওয়া করছে

নামাবাজার পোকায় খাওয়া একটা হলুদ ফল
বাজার করে ভুখানাঙ্গা গরীব করণিক, টেম্পু, হলার, বেরী বাঁধ
নাস্তা খাওয়া ১২ নম্বর বাস

সবাই যখন ভোরের আজান ফাঁকি দিয়ে গভীর ঘুমে
নামাবাজার তখন জেগে ওঠে,
ভাদ্র মাসের তালের দোকানী ভোর না হতেই দুয়ারখোলে
স্বপ্ন দেখে পথের ব্যাপারী বাকী খাতায় সস্তা দেবে কে

দোকানগুলি পুরানদিনের ছোট্টছোট্ট টিনের হিন্দিছবি
সারা দিনের বাছাই করা স্বপ্ন ধার করে ঘরে ফেরার সময়
কাল্পনিক সুপার মলে রিজেক্ট ষ্টোরে ফ্যাশন হাতরায় খুচরা কাস্টোমার
সোনার কাচে রূপার ফিতা পঞ্জের হাইহিল, হাতে ধরে ছোট্ট বোনটাকে
দুচোখভরে রাপাপ্লাজার আধপাকা পেলাস্টিকের সখে
রাজ্যহারা স্বপ্ন থেকে ব্যস্ত হয়ে
ভাতের হোটেল পার হয়ে যায় ছিড়া ছাতির ঘর
সারি বাধা লুঙি সেলাই মেসিনে এখন ব্লাউজের মাপ

হঠাৎ ফুলকি এসে পড়ে কামারখানা থেকে উড়ে আসা আরিচার খিদার আগুনে
আলু ভর্তা ঢেঢ়শ ভাজি চিচিংগার ঝোল
কুঁচা চিংড়ি পুঁই শাক ডিম ভুনা জাটকা ইলিশের পেটি
আল্লাগো তোমার পেটে এতো খিদা, বানাইছো কত খাদ্যখাবার
গরুর ভুনা চাপিলার চচ্চরি পাঙ্গাসের বিরান
তোমার হাত কত মিঠা, বাবুর্চি তুমি এক পালোয়ান
তোমার ইশারায় কাচকির তরকারী কি সুন্দর ডাক দিয়া যায়
তোমার চোখ কত না সুন্দর,
কি সুন্দর তোমার দাঁতফুল
তোমার চুল মেঘের কাশফুল
সামান্য প্লাস্টিক তোমার হাতে পড়ে হয় যে নাক ফুল
তোমার জুলুসে পচা মাটি বানায় কাঁঠাল
তোমার জ্বসনে চাঙারি ভরা ভাঙা কাঁচ ফ্যাক্টরী আলো করে
তোমার আদরের ছোঁয়ায় মিষ্টি হয় কাউফল

সবই ঠিক আছে, যেখানে যা যা তুমি দিয়াছো নিজ হাতে
তবে কেন তুমি বানাইলে এ শহরে আমাদের জন্য নামাবাজার?
দুনিয়ার যত রং দেখি চোখে নিত্য পথে যাতায়াতে
আমাদের ফলপাকুর, মাছগোস, তরিতরকারী, পোলাপানের ভিডিও গেমে
পাই না তাতো
তোমার সবই তো সুন্দর, কিন্তু হাত দুইটা কেনো এতো ছোটো?


মাডস্কিপার
.......
কাদামাখা মাডটাকি তুমি কি জোয়ারের না ভাটার দলের?
কোটি কোটি বছর ধরে আন্ধারমানিক নদীতে তুমি কি আওয়ামি লীগ না বিএনপি করেছো
আমাকে বলবে কি?

তখন আমাকে একটা আশ্চর্য ঘটনা দেখালো:
আমি দেখলাম প্রতিটা মানুষই এক একটা মাডটাকি
আবার বললো, এবার দেখো:
দেখলাম আমাদের মানুষেরা না না প্রকার পশুপাখিদের মতো

মাডটাকির কাছে মানুষ কি ভিন গ্রহের প্রাণি
তারা কাদার বদলে কাপড় পড়ে থাকে
কোথাও যেতে লাগে ট্রেন বা উড়োজাহাজ

আমরা নিজেরাই আমাদের ভুলছি
তারপরও স্বীকার করি, সকল মাড চায় মানুষের মতো দুটি হাত
কানকো দিয়ে হাটতে চায় না কাদায় কাদায়
মাডস্কিপারীনি নাচতে চায়

তোমরা ভাই আমাদের ডাকো
আমাদের সাথে নাও
মাছকে ডাকো, কুমিরকে ডাকো, ডলফিনকে ডাকো
গ্রামের মানুষদের সাথে নাও

কুকুরকে যেমন পুলিস বাহিনীতে নিয়েছো
বানরকে নিয়েছো কেবল টিভিতে
তোমাদের জন্মদিনে যেমন রয়েছে
স্টারফিসের ভাগ
তোমাদের অংক করছে হাতি
টিকটিকি দিচ্ছে একলা দিনের সংগ
বক হচ্ছে ভাষা বিজ্ঞানী
টিয়া ইংরাজির শিক্ষক
তেমনি আমাদের মতো সাধারনকে দলে নাও
তোমাদের দলে

বকবক করা মাড রাজকুমার
হঠাৎ জোয়ারের আগে থামে

আমরা স্বপ্নের ভিতর থেকে বের হয়ে আসি
মাড টাকি ওখানেই ঘুরঘুর করে


আমাদের রউফ
...........
আমরা ধাঙ্গর বস্তিতে যেতাম শুধু মাত্র চোলাই চাখতেই নয়, কিঞ্চিত পানোন্মত্ততায় যার যা প্রাপ্য তা অকাতরে বিলিয়ে দেবার জন্যেও বটে: যে অর্জন করেছে ইতোমধ্যে তরুণ হৃদয়ের ভালোবাসা অর্থাৎ সংবেদনা ও শ্রদ্ধা যার রয়েছে আর কিছুটা স্বপ্নছুট তরমুজ লাল হয়েছে তারায় তারায় আমরা তাকে মাথায় নিয়ে ধেই ধেই করে নাচতাম যেন ওই ধাঙ্গর এখনো টিকে থাকা আমাদের প্র-প্র-প্র-পিতামহ

তখন রউফ আমাদের দলে সহজেই মিশে গেল : সেদিন পার্টির সদ্য লাল গ্লামারের সদস্যপদ মোড়ানো প্রাপ্তির আনন্দে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছিল ও

কেন মানুষ হেরে যায়?
হাসতে হাসতে এ ধরনের প্রশ্ন ও সহজেই করতো

কিন্তু ও ছিল নির্বিকার
তিরাশীর পহেলা বৈশাখের তপ্ত বেলা এগারোটায় যখন আমরা চুলা থেকে সদ্য নামানো উষ্ম দোচোয়ানি মগকে মগকে হল্লা করে করে গিলছিলাম তখন রউফ এক ফাজিল নেতার মতো উসকে দিচ্ছিল আমাদের প্রেম ও ক্রোধের বিষয়গুলি, আমরা আল মাহমুদ আর শহীদ কাদরীকে তাদের প্রাণনিষ্ঠা আর গ্রাম ও নগর বেদএর জন্য আমাদের সম্মিলিত কণ্ঠষাঁড়ের কুঁজে একটু হাত বোলাতে দিচ্ছিলাম আর আমরা পায়ের কাছ থেকে শুয়োরের বিষ্ঠা মাখান আঠাল মাটি তুলে লেপে দিচ্ছিলাম তাদের নাম ফলকে যারা প্রথম পুস্তকের সাথেই আমাদের প্রতারিত করেছে

আর আমাদের মনে হয়েছিল : কেন মানুষ হেরে যায়?
হাসতে হাসতে এ ধরনের প্রশ্ন ও সহজেই করত

আমরা সেরকম নেতাদের পাছায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাঁসের স্প্রিং-লিঙ্গ ঢোকাচ্ছিলাম, সেরকম সমরনায়কদের ঘিলু বের করে চুবিয়ে রাখছিলাম পোড়া মবিলের মধ্যে যাতে তা কিছুটা হলেও চালু হয়; আমরা সেরকম হতভাগ্য সরকারগুলিকে অভিষাপ দিচ্ছিলাম আর হাতের কাছে যে ঝাঁটাগুলি পড়েছিল দুহাতে শক্ত করে ধরে ইতিহাস থেকে বিদায় দিচ্ছিলাম তাদের ঝেঁটিয়ে

আমাদের উসকে দিচ্ছিলো রউফ, যে ওর মায়ের সম্মানে ছিলো বদ্ধপরিকর

আমরা সবাই ক্রোধে অন্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম; একে একে ধাঙ্গর পল্লীর সকল মহিলাকে মা বলে ডাকছিলাম, নাকি আমরা কেবলই এই মহিলাদের অপমান করছিলাম পহেলা বৈশাখের বাংলা গেরূয়া শাড়িকে? ওরা যে পড়েছে ভাটিখানার গরম চোলাই সে কথা না ভেবে রিফাত এক মহিলাকে ভগ্নিজ্ঞানে দ্রবীভূত হতে গিয়ে দ্রুত-চুম্বন চেয়েছিল বলে হঠাৎ পুরো ধাঙড় পাড়া ক্ষেপে গেল,
বুড়োরা হলুদ চোখ তুলে যুবকদের বললো : ওদের বলি দে!

বৈশাখ দুপুরের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলাম এইভাবে।
একপ্রকার শান্তি প্রক্রিয়ায় দেখলাম,
কবিকে চুম্বন প্রস্তাব করতে নাই, করা ঠিক না,
বিশেষত নিরাপত্তা নিরাপদ নয় যখন -


রঙের সন্তান
........
কোন স্বপ্ন সত্যি দেখি নাই রূপায়িত হতে
কি ভাবে বলবো যে তুই আমারই রঙের সন্তান

এই ভালো
তোর জন্মদাতা : হাওয়া
হাওয়া-ই তোকে মানুষ করবে

চল বাছা তোকে তোর প্রকৃত বংশ চেনাই :

এই যে বনস্পতি, এ তোর পিতা
এই যে মাটি, ইনি হলেন মাতা
আর তুই ঘাসফুল

সূর্যের দুধ খেয়েছিলি বলে
তুই চঞ্চল

নদীতে ঘুমিয়ে ছিলি
তাইতো একটু একটু করে মনে তোর বড়ো হবার ঢেউ জাগছে

আমার হাতে মিথ্যার দুধ
আর বিষের কলম
তুই তাকিয়ে থাকলে
পুড়ে যাবি
তাই লিখবো না তোকে।


চন্দ্রবিন্দু ও শ এর কবিতা
................
পটিয়া বাজারে সারি সারি পাঁঠা বাঁধা, আজ পাঁঠা বাজার, শুক্রবার, ২১ শে শ্রাবণ, ১৪০১ শাল, মহাশড়কের দুপাশে দলে দলে হো চি মিনের শশ্রুমণ্ডিত চিবুক, টান টান শিরদাঁড়া, গর্বে খানিক পরপর কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে কচি পাঁঠাগুলি

স্বত:স্ফুর্ত পাঁঠা গন্ধ মসৃন বিচিগুলি ঢেকে রেখেছে হালকাভাবে তবুও চোখ চলে যায় বারবার। পাঁঠার তো ওটাই গর্ব।
নিম পুরুষের হাত বারবার পকেটে যাচ্ছে আর ইর্ষায় পতপত করছে ওদের পতাকা।

বান্দরবানের আনাচে কানাচে ঘুরে বেরাবার সময় পাঁঠার তাকদ চাই
যেন পাহাড়ে চড়তে পারি, নামতে পারি পাহাড় থেকে।


কেন যে আমার জন্ম হলো চুপসে যাওয়া এই ছোটগ্রহে

কেন যে আমার জন্ম হলো চুপসে যাওয়া এই ছোটগ্রহে
কেন যে দেখতে হয়
মানুষের চোয়ালে রূপার লাগাম তাতে অফুরন্ত হাসি হাসি ভাব

বাকপটুতার অনাবিল যত্ন সাজ

কেন যে আজ সংখ্যালঘুরাই আন্তর্জাতিক।


শামুক মা
........
শামুক মা শামুক মা আমি যে তোর মুক ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকিস না
তোর সোয়েটার বোনার কাঁটা আমার চোখে ঢুকে রয়েছে
আজ আমি যে কিছুই দেখিনা।

কেঁচো মা কেঁচো মা স্বপ্ন কী তোর আজ
আজান শুনে তাকাস, আমি তো আর বিশ্বাসীটি নইরে পাগলি

ঘড়ির গোল মুখটা নাই আর যে তোকে দেখবো
আমার বোতামও আর ছিঁড়ে না, তোর ঐ সুঁই লাগবে কিসে?

আমি বাদুড় পুষি তার খাঁচা নাই কোন
বধির মন্ত্রে প্রহর কাটাই আটটাই
তুমি যাতে লজ্জা না পাও আমি আশ্রয় হারালে

মা তুমি দেখে নিও, ঠিকই খুঁজে পাবো আমি বিচার বসার আগে তোমার চরণ

তোর ছেলে যে ফোঁপায় ভোররাত্রি দিনের ভয়ে
আমার কালো ডেরায় ও মা তুই কই তোকে যে দেখতে পাই না।


সঙ্গীত পরিবারে সতীদাহ
..............
উচ্চারণে ত্রুটি ছিল, তবু শে গেয়েছিল ঠিক রবীন্দ্রনাথ।

পা টেনে টেনে ক্লান্ত সারাদিন শেষে
সামনে একটা শুকনা দেহের নদী
তারপর ইতিহাসের সর্বশেষ সতীদাহ মাঠ।
কলকাতায় ব্রিটিশদের আইন লেখা হলেও
গণ্ডগ্রামে খবর পৌঁছায় নাই বলে
দাউ দাউ করে চিতায় পুড়েছিল শে
জীবন্ত, শ দুয়েক বছর আগে।

নরসুন্দার পাড়ে বহু পুরানো গ্রাম
জংলা টংলা সরিয়ে এখনো ভ্যাপসা নৈ:শব্দে
কয়েক ঘরের লোকালয়
কেবলই বলে না না না না না।

পড়ো পড়ো বাড়ি, জাম্বুরা গাছ অবনত টকফলে
নিয়তির অনুরোধে দীঘি আজ মজা বিষপুকুর
বড় ভিটায় ছোট ছোট ঘর
দিনের বেলায়ই রাত দেখে যারা রোজ
মস্ত উঠান, লম্বা অন্ধকার
একটা বালিকা ঝাঁটায় রৌদ্র তুলে
এই বাড়িটার অসুখ সারাতে রত।

আমরা কোন খবর দিয়ে আসি নাই
তবু কাকাবাবু তার হুকাটা নামায়ে
কিছুক্ষণ বসে থাকেন, উঠানটার দিকে তাকায়ে বলেন :
গান শুনতে এসেছেন... মজা পুকুরে মাকড়শার বুদবুদি...
গান তো সব আপনাদের ঘরে... এ বাড়িতে গৌরিকে উঠান ঝাঁট দিতে হয়
... খোলের কিরন চটা, তাছাড়া হাঁপানি হার্মনিয়ামের...
বলে আবার জাম্বুরা গাছের দিকে তাকান।

কফিল যখন চর্যাপদে সুর বসায়ে গাইল,
মনে হল ও কেন আজ যুদ্ধ ডেকে আনছে?
গৌরি তখনো ব্যস্ত, অস্থির হাতে চা বানায়...
আর সেই ফাঁকে লুঙ্গি পড়া পাশের বাড়ির ছেলেটা গাইছিল
ঠিক যেমন করে গায় আর সকলে
অতুল রজনী কাজী নজরুল।

অবশেষে গৌরি গাইতে এল
খালি-পায়ে-হাটতে-হাটতে-ছড়িয়ে-যাওয়া পা দুটা
কোন রকম লুকিয়ে রেখে বসে
হার্মনিয়ামে শ্যামলা হাওয়া দিল।

উচ্চারণে ত্রুটি ছিল কিন্তু শে গাইল ঠিক-রবীন্দ্রনাথই
বর্ষাদিনে বিকালবেলা সংখ্যালঘু পরিবারের ক্ষয়ে যাওয়া মেয়ে
সোপেনহাওয়ার টোনে গাইলো শ্যামা নাট্টের সেই দুখানা গান...।

ফেরার সময় তখন প্রায় সন্ধ্যা
ঘন্টা বাজো বাজো। গৌরি বিদায় দেবে
আমাদের এক প্রবীণ কবি বললো:
তোমার সবই তো ভাল শুধু উচ্চারণটা ঠিক করা চাই।

অপমানটা ভাসল ওর চোখে
শক্ত হাতে বিদায় ভা-ররী হয়
কবি তো কী হয়েছে, এক্কেবারে মাথা কেটে নেবে?
থামরে কুলাঙ্গার, এক্ষুণি তুই আত্মহত্যা কর!
আমরা দাঁড়ায়ে যাই।
দাঁড়াও গৌড়ি! তোমাকে অপমানের ফল
ভুলের কবি চিত্ত থেকে কেমন করে প্রায়শ্চিত্ত করে, দেখো!

ঠিক হলো কেদো পুকুর পাড়ে ইঁটের উপর মাথা রাখবে বৃদ্ধ কবি
আমাদেরই কেউ আরেকটা ইটে যতক্ষণে পারে
গুড়াগুড়া করে উড়িয়ে দেবে ওর নিরেট মাথাটা।

গৌরি তখন বলে:
চাইনা যে একা যেতে দিতে কবিকে কোথাও, অপমানে
সাজাও চিতা, সাথে যাবো আমি!

ঘটনাটা ঘটেছিল ঠিক, অগাষ্টের প্রথম সপ্তাহে, ১৯৯৬ শালে
কিশোরগঞ্জের সাকিন করিমগঞ্জ।


কেওড়া গাছের বাড়ি
............
নোনা বাদাবন সৃজনে
মা বাবাদের রেখে ফরেস্টবিটে
নেচে নেচে তারা বেরোয়ে পড়েছে সুন্দরবন থেকে
ওরা কী নিৎসের মর্মবাণী নিজ কানে শোনে নাই?

নুনের পানিতে পলির ছড়াছড়ি
এখানে অতিকায় সবুজ পনিরে
কেওড়া গাছের বাড়ি
শাবাজপুর মোহনায়
নোনাগন্ধ তার শীতের পাখিরা টের পায়

ভোলা থেকে বাংলাবাজার, তারপর খায়েরহাট, বোরহানুদ্দি, উদয়পুর,
কুঞ্জেরহাট, ডাওরি, লালমোহন, কর্তারহাট, চরফ্যাসন

সব শেষে চর শশীভূষন
মোটরের শেষ চাকা লেতরা ঘাটে
আকাশ হাটুর কাছে আসতে শুরু করেছে
হাসির শব্দ মুছে গেছে বদন থেকে
কপাল থেকে চন্দ্রবিন্দু গড়াতে শুরু করেছে
হাত ভরা বেরী বাঁধ
অনন্ত সমুদ্রের বিপদে বুক গুরু গুরু
ঐ যে বিন্দু বিন্দু দ্বীপ দেখা যায়।

পড়ে ছিল বুঝি এলোচুল
কচ্ছপিয়াঘাটে বাংলা আকাশ
চওড়া কাকড়ার ডাকে
গলা ধরে অচেনা দুয়েন্দে
বুক ঝালে বসে থাকি
প্লেটে নিয়ে চুলেরডাটি ঝোল।

শ্যালো নৌকায় ছাতি ধরে কোথায় হে মন মাঝিরা
আমায় নিয়ে চল্লে কোন টেম্পোতে
টুস্ট্রোক শব্দে যে কিছু বোঝার উপায় নাই।

বনেরও লম্বা হাতছানি
সন্ধ্যায় বাচ্চা বাচ্চা দ্বীপের চি চি চেঁচামেচি কান্না
বড় দ্বীপগুলি কতদূরে
কার কোলে উরুখোলে গাঙুরি গুঙুরি
ঐ যে কারা যায়, ওটা সমুদ্র পরীর ঝাঁক না?

পকেটেতো ছিল মন চিনি, তাই এখানেতে আজ দিনমনি
পথ থেকে তুলে নিল পিছুটান
কপালেতে বিষ তিল তিষি নাই, চোখে নাই আর কোন উদ্বেগ
ইঞ্জিনের মনটা কি ফুরফুরে, নিৎসের নাই কোন ডালভাত।

হাবাগঙ্গারাম চর কুকরি
দিনভোর ডাক দেয় চিলদের
মহিষের সৎ বোন দুধ দেয়
পনিরের হাঁক ডাক তাই তোলে গোয়ালে
গতকাল যারা ছিল উজানে
আজ তারা ঝিঁকিমিকি তারাদের হাত পা রাত জেগে গুনেগুনে ক্লান্ত।

গোলপাতা গোল নয়, চ্যাপটাও নয়
দূর থেকে মনে হয় চিনি উহারে
বাদা বনে ছৈলা দাঁত তার সবজে
সে নাকি বুদ্ধের নাম শোনে নাই।

ছোট চর কুকরি মুকরি
জেগে উঠে চোখ মেলে ছয় ঘন্টা পর পর
ভাটা রেখে যায় পলি মাটি,
বাড়ছে বাংলার পরিসীমানা।

প্রথমে ধানশী, হারগোজা তারপর
পাখিরা বেড়ায় সকালে আর বিকালে
মাছেরা দেখেনা কি করে তার জেলে
খুব ভোর যদিও, কুয়াশা কার্তিকেয়
ঘুমন্ত বনের মন্দ ফাঁকে
হাঁসেরা ডাকছে কিয়ের্কেগার্দ কিয়ের্কেগার্দ।

কুয়াশাটা নুন ছিল না কিন্তু খালটা ভরা নুন
ফর্সা হতে দেখা গেল সবুজ আগুন
ছৈলাগাছের গোল মনোরম ফল গো
উদবিড়ালের সাঁতার দেখে শ্বাসমূল তার জাগলো।

খালের ঢালু পাড় না তো জীবনানন্দের বাড়ি
তোমাকে কী দরকার আজ জাঁ পল সার্ত্র।

নোনা আশ্বিনের ম্যানগ্রোভ আজ
মুচমুচে আর সকালবেলাডা ঝিকিমিকি
কুকড়ির ভোর ভাইয়া তুমি একাকীকির কিকি কিকি
আজ তা হলে চল যে চই নীল চখাদের চুচকি হাচাই
আয়তনে বাড়বো আর কান চিচুরাই আশনাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন