বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৯

নির্বাচিত কবিতা : রহমান হেনরী

অনুসিদ্ধান্ত
........
কষ্ট সহজ,
বুকের ভেতর কষ্ট পোষা, সহজ না ...
স্পর্শ সহজ,
হৃদয় দিয়ে হৃদয় ছোঁয়া, সহজ না ...

ইচ্ছে হলেই কাঁদাও তুমি, কান্না সহজ;
পাখির মতো ওড়াও দেখি! হাসাও দেখি!
সুখের স্রোতে মাতাল হৃদয় ভাসাও দেখি!
সহজ না

দুঃখ সহজ,
হত্যা সহজ,
জীবন সহজ ...
শুদ্ধতম জীবনযাপন, সহজ না ...

ভাবতে পারো অনেক সহজ, অ-নে-ক সহজ ...
বুক-ঝিনুকে মুক্তা হওয়া; সহজ না ...
ভালবেসে পাথর বুকে ফুল ফোটানো সহজ না ...



সংবিধিবদ্ধ অনুরোধ
............
এতটা স্বপ্নের আঁচে উষ্ণ কোরো না তার বরফআঙুল
স্বপ্ন মানে মৃত প্রজাপতি, প্রদর্শিত কাচজাদুঘরে;
ওড়ার বাসনা হলে খসে যায় ইকারুস-ডানা ...
ওখানে স্বপ্নের মধ্যে ঈশ্বরের বাস, বহুবিধ প্রলোভন আছে ...
শেয়ারবাজার আছে ... জলগন্ধ ... ফাঁদপাতা সর্বনাশ আছে!

এতটা স্বপ্নের বিষ দিয়ো না গভীর তার চুলের বিন্যাসে
বিন্দু বিন্দু স্বপ্নবাষ্প জমতে দিয়ো না তার চোখের আকাশে
ওখানে স্বপ্নের মধ্যে আয়ুহারা বুনোহাঁস ওড়ে
পাখিদের ডানায় আগুন, দিগন্ত রেখায় ধাঁধা,
বস্তুত স্বপ্নের নামে পাহাড়ের পাহারা বসেছে ..
গভীর খুঁটিয়ে দ্যাখো, মানুষের বাসনার প্রতিইঞ্চি মাটিতে পচন ...
এতটা দুঃখের জলে তাকে আর দিয়ো না ডুবিয়ে!
বন ও বোনের চোখে হলুদ জীবাণু;
টের পাই, হেমন্ত এসেছে ...
টের পাই, পাতা ঝরে যাবে ...
দুঃখের কুয়াশা নেমে, টের পাই,
পৃথিবীর শীত আরও দীর্ঘায়িত হবে ...
স্বপ্নের ওষুধে তাকে আরও বেশি অসুস্থ কোরো না!



আত্মকথনের মতো
...........
আমি তো নিজেরি সাথে পাপ করি নিজে
পাপে পাপে পূর্ণ হয়ে অপূর্ণতা পাই

যে আমি একাকী জেদে
শস্যনাশে গেছি, গেছি স্বপ্ননাশে
বিনাশের বিন্যাসে
আত্মনাশে গেছি, গেছি সর্বনাশে

পতনের দিকে দ্রুত হেঁটে যেতে যেতে
সহসাই মনে হলো—
নাম ধরে কে যেন পেছন থেকে ডাকে!

আসলে ডাকেনি কেউ
কখনও ডাকে না
ডাকবে না ...


সমীকরণ
.......
প্রতিবেশী মেয়েটি তাকে ফোন করে, তোমাকে দেখে আমার চাঞ্চল্য হয়।
সে বলে আমারও ... কাজেই একটা সমীকরণ হয়। কিন্তু প্রাক্তন কাজের
মেয়েটি অসংকোচে জানায়, সাহেবের চরিত্র ভালো না। দেহলোকে
দৃষ্টিপাত করে। মেয়েটি হাসে। বলে, চরিত্র ভালো না হওয়া ভালো। তাতে
একটা সমীকরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং তৎক্ষণাৎ সে চরিত্র বিষয়ে
একটা রচনার সূত্রপাত করে—

চরিত্র বেশি ভালো হওয়া ভালো না। তাতে
বিড়ম্বনা হয়। বিপত্তি বাড়ে। চরিত্র ভালো হলে
অবিবাহিত পুরুষও এমনকী যুবতীকেও মনোযোগ
করে না। না-পাত্তা দেয়। চরিত্র খারাপ হলে
বিবাহিত পুরুষও যুবতী কিংবা অযুবতীরও দেহলোকে
দৃষ্টিপাত করে ...

দৃষ্টিপাতের শব্দানুষঙ্গে তার মস্তিষ্কে আরও আরও ‘পাত’ ধ্বনিত হয়।
সুতরাং এটুকু রচিয়া তার দেহলোকে পুনঃ চাঞ্চল্য হয় এবং সে বিক্রিয়া
ঘটাতে তৎপর থাকে। পরিশেষে পুলক লাভ করে। একদিন শোনা যায়,
সে জননী হইয়াছে। তাতে
অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়। কেননা উহা একটি অর্জন এবং উহাতে একটা
সমীকরণ হয় মর্মে জনশ্রুতি আছে ... জনশ্র“তি থাকা ভালো। তাতে
সমীকরণ ও অভেদের পার্থক্য স্পষ্টতর হয়।



পথচারণ
...........
পথচারণের এই আনন্দ সম্বল হে, হাঁটো ...

হেঁটে ... হেঁটে ... হেঁটে ...

হৃদিপর্যটনে হও হৃতোদ্যম! অবিরাম কাচ ভাঙো আর হও
আয়নার দিকে অবনত; আজকাল বিচূর্ণিত আয়নাতেও
পাখিকলা কী রকম উড়িতেছে দ্যাখো! ফলে কাচ ভাঙা
সমীচীন বোধ হওয়া ভালো ... ঐক্যের বিপরীতে হেঁটে যাওয়া
আমারও উচিত ছিল মর্মে যারা আমাকেই অপরাধী করে, আমি
তাদেরই জলসায় বসি অনুগত শ্রোতা ... আর
আমারও যে কতিপয় কথা ছিল, ও দয়ালু জ্ঞানের বিপণি!
আমি শুধু ন্যায্য দরে জ্ঞান কিনে যাবো?

... অতপর, ন্যায়পালবিদ্যাসভা দণ্ডাজ্ঞা দিলেন ... আর
ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলে আমারও কি মনে হলো— মৃত্যু খুব
আনন্দজনক, তাই চমৎকার সুন্দরও? মরে যেতে যেতে আজ
কামতৃষ্ণা কেন হে জাগিল?

পথচারণের এই আনন্দ সম্বল হে, হাঁটো ... আহা!
আমি হেঁটে হেঁটে মরি আর মরে মরে হাঁটি আর
ঝুঁকে পড়ি গুঁড়ো গুঁড়ো আয়নার দিকে; কেননা,

হাঁটার জন্য পায়ের মর্দামি নয়, চোখেরও প্রতিভা থাকা চাই ...
সুতরাং ওহে চোখ, হাঁটো!




কুশল
.....
পড়ে আছ নিহত-বিক্ষত যেন উপসর্গ মাঠের ওপারে ...
তোমার কুশল মনোবাঞ্ছা করি নিয়ত নিখিলে;
বহুস্থানে বৃষ্টি এলে প্রকৃত ব্যাঙেরা নেচে ওঠে, গৌরী উৎসবে, স্নানে,
প্রকাশ্য পাথারে তারা অথৈ বেদনা করে, আর
প্রকৃত সত্যটি এই— খসে যাওয়া পাখির পালক তুলে আজকাল
কেউ আর ঘরেই রাখে না; তাতে বুঝি অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়?
তবুও তো নীতি বলি তাকে, যে রকম জননীতি—
জনতার যাতে কোনও ভূমিকা থাকে না ...
ভন্তে গো, তোমাকেই বাঞ্ছা করি প্রথমোক্ত মাঠের ওপারে, অন্ধকারে,
ফলে, আমাদের অবসর ধর্মকর্ম হয় ... অবসাদে অবসর ভালো,
কেননা যে, ভালবাসা অপচয় অনেক হয়েছে,
দেশে দেশে, জগতে জগতে ...
এবার বিনত ডানা মেলে দেয়া ভালো প্রভৃতি-আকাশে;

একটাই মাঠ শুধু বৃত্তাকারে-চক্রাকারে ... আজীবন ঘুরি,
সরণ প্রকৃত অর্থে একে তো বলে না! তবু
তোমার কুশল আমি বাঞ্ছা করি, নব-নিরাকারে ...




যেমন ঝিনুকগুলি
.........
পার্শ¦দৃশ্যে সে ছিল শায়িতা ... আর আমি
এই সন্ধ্যা রচনা করেছি যেন জমাট রক্তের মধ্যে
ব্যক্তিগত ছায়া প্রক্ষেপণে; যেমন পাখির ঘুম।

দৃশ্য থেকে, রক্ত থেকে, পাখি থেকে ... অথচ দূরত্ব
বেড়ে যায়; কিন্তু আমার জননী ছিল মৃত্তিকার আদি সহোদরা,
ফলে, তাকে জন্মেরও অনেক আগে একবার
কোথায় যে দেখিয়াছি ... অচেনা জলের দেশে ...
সেই গল্প ক্ষীয়মাণ, নেপথ্যে বিলীন।

পার্শ্বস্বপ্নে সে ছিল জাগ্রত ... আর এত গান!
এ রকম একবার কখনও কি শোনা গিয়েছিল?
আমার জননী তো সেই স্মৃতি স্মরণে রাখেনি!
ফলে, এই স্মরণিকা রচনা করেছি যেন
অন্তত ঘুমের মধ্যে, বিস্মৃতির ধূসর ডানায় ...
যেমন নদীরা কোনও পূর্বস্মৃতি স্মরণে রাখে না।

তবে আজ কী কী কথা মনে পড়ে আর কী কী
মনেই পড়ে না ... সেই দুঃখ স্মরণবাহুল্য;
প্রাগুক্ত বিষয় নিয়ে আমার মায়ের সাথে
বহুকাল কথা তো হলো না! সে ছিল ভ্রমণশীলা, মেঘে

পার্শ্বদৃশ্যে সে ছিল শায়িতা ... আর আমি
এই দুঃখ রচনা করেছি যেন সংগুপ্ত প্রাণের মধ্যে
কাহাদের উপস্থিতি ভ্রমে; যেমন ঝিনুকগুলি।
ফলে আজ কান্নাও অধিক জানে ফলনের
কৃষিসংস্কৃতি; যেমন আমার মা, ফসলের প্রকৃত অগ্রজা।




ধারাপাত
........
প্রথমে শীতল হয় চুল;
তারপর রকমারি ভুল
জেগে ওঠে অন্তরে-বন্দরে ...

দ্বিতীয়ত সরিষার দানা,
অন্তরের পুরুষ বেগানা
লেপ্টে যায় তোমার ভেতরে,

প্রথম, দ্বিতীয় ...কথা নয়;
মূলকথা বস্তুত সময়
বেঁচে থাকে নির্মিত অক্ষরে ...

তুমি বাঁচো, তুমি মরে যাও;
মরে গিয়ে অমরত্ব চাও
উন্মাতাল বাণিজ্যের হাটে ...

আগুনের স্বভাব— লেহন;
আমি তাই কঙ্কাল-মেহন
ভালবাসি চন্দনের খাটে ...

তৃতীয়ত উষ্ণতা সম্বল;
একজোড়া নৃতাত্ত্বিক ফল
ফলিয়াছে আদমের হাতে ...

শেষ কথা জেনে গেছি বটে!
কৃষকের আহার্য সংকটে
সঙ্গী সেই আধোভেজা মাটি,

পরিশেষে পরিণাম এই—
আহার্যের স্বত্বভেদ নেই
ঠোঁটের নিকটে জল, জিহ্বার তৃষ্ণায় কাঁদে নারীযথা, লবণের বাটি ...



জ্বর
.......
এত দীর্ঘ আলপথ! বাসনাসম্ভব সত্যে সুদূর শৈশবে যাওয়া যেত ...
আর দ্যাখো, আমার গলায় আজ কী করুণ টাই জেঁকে আছে!
আল ভেঙে চারপাশে দেয়াল তুলেছি ... শুধু ওপরে ও দূরে আছে
চতুর্ভূজ মেঘলা আকাশ; ফলে, জীবনকেও তরলের স্মৃতি মনে হয়; আর
অনন্ত তুষারপাতে ঢেকে যাচ্ছে দিনের বর্ণনা ... তবু
এতটা বিপদ থেকে দু’চারটে দৃশ্যও কি তুলে রাখতে পারছি গোপনে?
ঘরে কিংবা মনে কিংবা ভোগে-উপভোগে ... নিরাপদ নিসর্গ-আশ্রমে?
বিচ্যুত স্বপ্নের থেকে কেন্দ্রাভিগ শব্দার্থের প্রাণে!

আজ এই এতটা বিমর্ষ গানে, এতটা আত্মীয়কণ্ঠে ডেকো না তো ছাই!
সর্বনাশের এখনও অনেক বাকি; এইদিন বর্ণনারও প্রচুর অতীত ...

তবু দেখ, জ্বর হলে কেমন সুন্দর লাগে!
জ্বর এলে, কতবার আকণ্ঠ চৈত্রেও আমি আপাদমস্তক কেঁপে উঠি!
কেঁপে কেঁপে উঠি শিহরণে ... অতএব জ্বর ভালো; শরীরে আগুন কিন্তু
মন ঠিকই পুড়ে যায় শীতে!

এমন তুষারপাত!
অফুরন্ত জ্বর এসে শুশ্রƒষাকুমারী যেন, আমাকেই মগ্ন ঘিরে রাখে ...
ঢুকে যায় রক্তে-মাংসে, অনুভবে, হাড়ে; বাৎস্যায়নঋদ্ধতায়
জ্বর এক আশ্চর্য প্রেমিকা! যোগে-ভোগে পর্যাপ্ত রমণী ...


সাকুল্যে আমিও আজ তিনশ’ পঁয়ষট্টি কোটি রাত জেগে আছি
আর জেগে জেগে গড়িতেছি প্রাণ ... আহা! এই প্রাণ আমি
এবার ছিটিয়ে দেবো অনার্য ভূগোলে ...



শাপমোচনকাল
.......
বহুদিন হাঁটি নাই মাছের শহরে। বাতাসের ভাড়াবাড়ি তালাবন্ধ অনেক বছর। এইমাত্র খোলা হচ্ছে ... অতএব শেষ হলো মরিচার দিন। ধন্যবাদ হে ভোরের পাখিরা, কেননা, এখনও বেঁচে আছি। বহুদিন হাঁটি নাই ... কোথায়? তা বলেছি নিশ্চয়ই! শহরের তালা খুলে দেখা গেলো, বনরাজ নেই। বরং বীভৎস কোলাহল। টিকটিকি-তেলাপোকা ... নিজেদের বনরাজ ভাবে। অতএব এইসব বাতিল পদ্যের দিন ... আমরা এসেছি দেবী। দেবী তবু শুয়ে আছে খাটে। এ রকম মৃত্যুখাট আমাদের স্মৃতিরও অতীত! এবার তোমাকে দেবো নবতর সাজ। চোখ খোলো দেবী, চক্ষু খুলিয়া দ্যাখো, এ তোমার নতুন যৌবন ... আমাদের শুভদৃষ্টি তোমার নতুন স্রষ্টা আজ; তাহাকে কুর্ণিশ করো!

এইবার আমরা এসেছি। মাছের শহরে তুমি মৎস্যদেবী। তাহাদের স্তব-স্তুতি তোমাকেই দিয়েছিল জন্মমাত্র মৃত্যু-অভিশাপ। মনে পড়ে? ফুল হাতে বহুদিন হাঁটি নাই আমিষনগরে। তুমি দেবী, সত্য আর আমৃত্যু-যৌবনা। কবি আজ তোমার চরণে রাখে ফুল। খোলো দেবী, চক্ষু দু’টি খোলো, শাপমোচনের কালে চেয়ে দ্যাখো, আমি সেই আদিহাঁস, প্রখ্যাত সন্তাপ ...

কেমন সাঁতার দ্যাখো, কাঁপিতেছে জল!



যে গল্প রূপকথা হবে
.....................
গোয়াল ছিল, গরু ছিল, রাখাল এবং গো-পতিও ছিল ...

তবে যাই? দিগন্তের কাছে গিয়ে বলে আসি সবিনয় বালকের কথা!
আহা! কাহাদের গোশালায় সেও ছিল অনুগত গভীর রাখাল? অথচ
কেমন দ্যাখো, বহুবর্ণ পাখি হলো শেষে; দার্শনিক বালকের কাছে বসে
এইসব গল্প বলা যেত, তাই কোনদিনও বলি নাই ... অতএব
অদ্য গড়ি এই শ্রবণিকা; আর আমাদের বাল্যকাল বয়সী জিহ্বায় চেটে দেখি,
মরিচ রোপণপর্ব কী প্রকার কষ্টকর ছিল ... সেইসব বাতাসের
দ্বিভাজিত রূপকথা ইতিহাসে গড়হাজির আজও;
মৌনতা প্রসঙ্গে তবু বলা হলো, এমন হয়েছে যে, কৃতঘœতা পায়ের প্রশ্রয় পেয়ে
উঠে গেছে ঠোঁটে ... অবদমনের ফলে হয় কী—
লবণ পর্যাপ্ত হলে জোঁকেরও সামর্থ্য খসে পড়ে; কাজেই সঙ্গত ছিল
নিবিড় লবণ চাষাবাদ ...

অদ্যকার জ্ঞানসভা রাখালেরই জন্য যদি সম্মাননা এনেছে প্রস্তাবে, সেই ফাঁকে
বলে রাখা ভালো, গো-পতিরও কথা কিন্তু লিখতে হবে, রাখালের উল্টোপিঠে
শাদা-কালো রিভার্স ফরমেটে!

অবশেষে আক্রান্ত রাখালই বটে আনুগত্য যথেষ্ট লভেছে!
এবং কাক্সিক্ষত আলো জ্বেলে দিচ্ছে প্রতি অন্ধকারে ... কিছুকাল
বিনয়বশত সেও তুচ্ছতায় বেড়ে উঠেছিল, নেপথ্যের গভীরে— গোপনে ...

ফলে কিন্তু দাসযুগ চিরস্থায়ী নয়!



পাখিকল্পবেলা
..........
দৃশ্যত প্রচুর পাখি ... অদৃশ্যত অগ্নিসত্যদিন ...

কারও ডানা সংগীতোন্মুখ ধু-ধূসর দিনের উপমা;
কারও কারও ঠোঁট থেকে রক্তঝরা দেখে
প্রধানত মনে হয়
রক্তদৃশ্যে পৃথিবীতে রঙেরই আনন্দ নেমে আসে ... আর
পাখিপ্রেমে সংরক্ষণবাদীরাও কী সুন্দর পারে!
পাখিদের মাংস ভেজে
বনভোজন ছড়াচ্ছে বাতাসে ... এত রুচিকর ঘ্রাণ!

দৃশ্যত প্রচুর পাখি ঝরেছিল ... অদৃশ্যত সত্যের কঙ্কাল ...
পাখি হে, ও নানাবর্ণ পাখি,
ডানার প্রতীক খুলে ব্যাখ্যাযোগ্য হও!

উঠলে উঠুক বেজে রাষ্ট্রসঙ্ঘে ব্যর্থ হাততালি ...


উপ-আনুষ্ঠানিক
........
অজস্র অনেক রাত জেগে থেকে জেনেছি যে, রাত্রি
বড় দীর্ঘদেহী হয়; ফলে সেই রাত্রিকেই বিজ্ঞাপন করি
এই বিহিত বর্ণনা ... কী প্রকারে ধানদুধ খেয়ে গেছে
কত না ফড়িং! সেইসব দুর্ভিক্ষের সূচক-বন্দনা;
কৃষি ছাড়া আমাদের আর কোনও আনন্দ ছিল না,
অতএব কৃষিসূত্রে জন্ম নিল বৃক্ষগণ দূর-উপকূলে ...
আমরা অধিক দুঃখ সানন্দে যাপনহেতু জেনেছি যে, দুঃখ
খুব সুপ্রসিদ্ধ হয়; ফলে ধ্র“ব-দুঃখকেই বিজ্ঞাপন করি
এই মর্মজ্ঞান, ঋদ্ধ-প্রভাষণা ... কেননা যে,
আমার কৃষকপিতা নিরক্ষর না ছিলেন বলে
ফসলের বর্ণশিক্ষা ছিল তার আদিপাঠশালা; ফলে
আমরা অনেক শস্য বপন-কর্তনহেতু জেনেছি যে, শস্য
বড় নিরপেক্ষ বিজ্ঞানী হয়; তাই আজ শস্যকেই বিজ্ঞাপন করি
এই সর্বশেষ শব্দচিন্তারাশি ... আমাদের আনন্দ-বিস্ময় ...



ভিত্তিপ্রস্তর যুগ
.........
দুপুরের চোখে কিছু স্বপ্ন থাকা সমীচীন হয়
তবে কিনা, বোশেখের জলস্বপ্ন এঁকেছিল চৈত্রবিকেল ...
ঘুঘু কথা কয়; আর
ভালবাসা ফোটাচ্ছে সংশয় ঘরের চাতালে—
এই তিন দুঃখ নিয়ে জেগে পড়ে গ্রাম
এবং ঘুমিয়ে ওঠে পদ্মাপাড়ে জেলেদের বউ
অতএব এসো,
ভালবেসে আমরা পৃথক জামা পরি আর
সন্নিহিত কোণ এঁকে দুইদিকে গতিশীল হই!
কেননা, বেঁচে থাকার আনন্দ ও সুবিধা এই—
আরও কিছু স্বপ্ন দেখা যায় ... আর তার প্রমাণস্বরূপ
ভিত্তিপ্রস্তর যুগ ঘনীভূত হতে থাকে ক্রমে ...



বিবিধ দহন
..........
ফেলে এসেছি লাল-নীল আলোর উৎসব, ছদ্মস্বপ্নপ্রণোদিত স্মৃতিদের বাড়ি ...
পশ্চাদ্ভূমিতে জাগা নিয়রের গান, হিমকান্না, কাঠের গুঁড়িতে লিপ্ত কুড়ালের মতো মেঘপৃষ্ঠে কোপমারা চাঁদ ... ঢেউঢালা কল্লে¬ালিত চন্দ্রাভাস নদী ... নদীগুলি মৃত ...
ফেলে এসেছি আনন্দের সাংকেতিক ঋতু ... প্রযতœ-খোদিত যত মুখস্থ ঠিকানা, হংসস্নাত দিঘির দরদ ... এইসব গান ... জোনাকির যাজক গৌরব ...

ও নিদ্রালু চাঁদবোন, সে বড় অদ্ভুতগাঁও! মৌনতাবিমুগ্ধ ভোরে জেগে দেখি,
আশ্চর্য পাখির দেশ; বিবর্ণ রঙের প্রগল্ভতা ... আর সেই লোভদীপ্র
বিষমাখা ছুরি রক্তদৃশ্যে ঝলসিত, চিকচিক করে ... আমাদের আরও আরও
অভিমান ছিল ... অন্ধবিদ্যালয়গুলো অতশত আনন্দ বোঝেনি ;
মিথ্যাবাদী রাখালের কথা কারও অজানা ছিল না, তারা তবু
আগুন! আগুন! বলে দেশময় ছিটিয়েছে জল। তারপর ...
অনেক বছর গেলে, একদিন আগুনেই পুড়েছে সংসার ... আহা!
তবু এই আমাদের আনন্দ ঘোঁচেনি; আর এই বর্ণ পাখির দেশে
বায়ান্নটি ডানা মেলে পাষাণের চোখজলে ভাসি ... এবং প্রচ্ছন্ন কথা ...
পাথরের দৃষ্টিসীমা বৃত্তায়িত করে যথারীতি মর্মান্তিক উড়ি ;

আমার গৌরব কীসে? সিঁড়িতে উঠেছি বটে! বরং
তাহাতে বাড়ে সিঁড়িরই গৌরব ... পৃথিবী সমাসে তৃপ্ত, আমি থাকি
ব্যাসবাক্যে মৃত ...

তা হলে বোনের কানে তথ্যপ্রপাতের ছলে বলা যায়, ওগো চাঁদবোন,
আজ এই হলুদচর্চিত রোদে, শুয়োরের মতো অন্ধকারে, ডানার যন্ত্রণা
ঢেলে বুঝে গেছি, বস্তুত ভাষার জন্য নীরবতা অধিক জরুরি!



সমুদ্র অভিযান
..........
স্টার ফিশ সুইমস্যুটে তোমাকে সমুদ্রমাতা মনে হয়, আমিষচিত্রিত সেই
শারীরিক উন্মাদনা ... ভালো লাগে। সমুদ্রোপমা নও, সমুদ্র তোমার উপমিত;
হয়তো কখনও আমি রিস্কি সাঁতার দিয়ে তোমার গহীনে চলে যাই
শুধু কাব্যিক কৌতূহলে। এ রকম জলপর্যটন, জেনেছি শোভন নয়—
সমুদ্রকাতর যত নাবিকেরা কী প্রকার ঝুঁকি নিয়ে
যাত্রাপথ, অভিপ্রায় হারিয়ে ফেলেছে!

তবু এই অভিযান ভালবেসে অনিশ্চিত স্বপ্নে জেগে আছি, অমিত সাহসে ...
আমি শুধু তোমার মধ্যমা ছুঁয়ে সলিলসমাধি চাই, আর ভাবি, চলে যাবো
অগোচর মৃত্যুর দখলে ... অসীম বাসনা নিয়ে এইভাবে একদিন স্থলভাগ
রোমাঞ্চিত হবে, সকল গন্তব্য হবে সমুদ্রজনিত; কেননা যে, সমুদ্রসভ্যতা
আজ আসন্ন ও ঘনীভূত বিজ্ঞানসমাজে। আমি সেই অভিযাত্রা সূচনা করেছি,
সীমাহীন পথ আর রাশি রাশি ভয় আর জল ... কোথায় রেখেছ তুমি
গুপ্ত ধনাগার? ওহো জলবালা, ভোগের প্রসঙ্গ এলে কেবল ছড়িয়ে রাখো
প্রলোভন স্থলের বাতাসে! আমি শুধু একবার তোমার লোভের উৎসমুখ,
তোমার গোপন সূত্র খুলে খুলে সম্ভাবনা দেখে যেতে চাই, জেনে নিতে চাই,
কত কোটি অক্টোপাস তোমার সম্পদকেন্দ্রে পাহারা বসেছে! পেছনের
যাত্রাচিহ্ন অপনীত; প্রতিজ্ঞ দু’হাত দেখ উপনীত তোমার সড়কে ...

আমি পরাজিত নই। আমার পূর্বজ কবি বলেছেন, পরাজিত হয় না কবিরা ...


রাষ্ট্রবিজ্ঞান
.......
কতিপয় লৌকিক কাতরধ্বনি ... নৈঃশব্দ্য, বেশ্যালয় থেকে ফিরে যাচ্ছেন
ছদ্মবেশী টুপি ... নগরসভ্যতার হাঁ-করা ম্যানহোলে টুপ করে ঢুকে যাচ্ছে
আদিজ্ঞান ... এই যেমন, তিনি ... তিনি কে? তিনি বস্তু।
প্রপিতামহদের লজ্জিত ফসিল ... ইন্টারনেটে কৃষি ফলাচ্ছেন কানসোনা ...
মানে, আমাদের দুঃখগণ, মোনাজাতউদ্দিন ... কী রকম ছিল অই আদিজ্ঞান?
দ্বাবিংশ শতাব্দির ঊষালগ্নে সুতরাং ক্লোরোফিল-তৃষ্ণা জাগিল ... অতএব
গ্রামায়ন ... হলো কী, ফলত সূচনাপর্ব, পুনরায় কৃষক সভ্যতা ... ঢাকাতে
ছনের অট্টালিকা; কে যেন বললেন, ওটা আধুনিক তস্করের গ্রাম!
জলপথে পৃথিবীর ভ্রমণ বেড়েছে ... তারা সব গেলেন কোথায়? সায়েন্সফিকশনগণ?

তারপর ... ও জননী, বালিকা বালিকা বলে কী প্রকার কাঙাল হয়েছি!
তাহারা সভ্যতা জানে, আগাম-নিগুম জানে ...
শিশ্ন আছে, তাই বলে বড়াই করি না ...
বরং বিনয় ... আর বলি, ও বালিকা, তোমার শরীর দিয়ে আমাকে গ্রহণ করো;
আমার শরীরে তুমি কাম দাও, আমার শরীরে তুমি মন জ্বেলে আলোকিত করো
এই রক্তের বন্যতা ...
তবু কেমন বীভৎস সেই শুয়ে থাকা! নারী না, পুরুষও নয়— শুয়ে আছে
সশব্দ শরীর; আমার তো ঘুম আসে! অথচ পুলিশ এসে নিয়ে যায়
ধর্ষিতা মেয়েকে.. চাবি নয়, তালা ... চাবি খুব ডাঁট মেরে ঘোরে,
কেননা অনেক চাবি এবং তাদেরই কাছে; অতএব তালা নিয়ে ফিরে যায়
গণপ্রজাতন্ত্রী দেশ এবং জিজ্ঞেস করে, চাবিটা কেমন ছিল? তালার প্রবেশপথ
ঠিক আছে কিনা ... তারপর ... তালার ডাক্তারও দ্যাখে, সার্টিফিকেট দ্যায় ...
ও তালা, ওখানে যাসনে বোন, তাহাদেরও একইরূপ চাবি ...

অতঃপর ... ও জননী, একখান সিল মেরে গণতন্ত্র লটারিতে ভাগ্যটা যাচাই করি ...
যদি লাইগ্যা যায়! ... লাগে না তো ... যে যায় লঙ্কায়, তিনি রাবণই বটেন!
জননী গো, অসমতা ... ঊনপঞ্চাশ একান্নর খেলা ... আহা গণতন্ত্র! দ’ুজন ওপরে
আর তাদের পায়ের নিচে ঊনপঞ্চাশ কাঁদে ... অতএব পুনরায় ক্রোধ ও কাতরধ্বনি ...

প্ল¬াতো মহাশয় কেন কাঁপিতেছে জ্বরে? ... ও রাষ্ট্র, তোর স্থাপত্যকৌশল দেখি
ভেন্না খুঁটির মতো বাতাসেই নড়ে!
তবে কিনা, ও জননী, লালগ্রন্থ পুনরায় আদিপাঠ্য করি আর
শিখি ফের রাষ্ট্রবিদ্যাখানি ...

মূর্খদের বিদ্যালয়ে পুনরায় পাঠ্য হোক— রা-ষ্ট্র-বি-জ্ঞা-ন ...



বৃষ্টিসম্ভাবনা
..........
জমাট বেঁধেছে মেঘ ...
না ... ওভাবে নেড়ো না! বর্ষণ আসন্ন হতে পারে—
ভিজে যেতে পারে সুখ,
ভিজে ভিজে ভেসে যেতে পারে, ও তোমার
আর্তভাষী ক্ষেত; এ প্রকার বৃষ্টিসম্ভাবনা
মুহূর্তে জাগিয়ে তুলে বিলম্বিত হতে দেয়া ভালো,
তাতে উত্তেজনা হয়, পরিণত হয় পরিণতি।

আমি বহুদিন উপভোগ করি এই শীর্ষবেদনা,
এই উত্তপ্ত প্রলয় ... এত বেশি অস্থিরতা ভালো নয়,
ভালো নয় বিদ্যুচ্চমক ... উষালগ্নে পেয়ে গেছি
গূঢ় প্রণোদনা, জেনে গেছি গুহ্য মন্ত্রগুলি—
উত্তুঙ্গ ক্ষুধার মুখে গো-গ্রাসে গ্রহণ অনুচিত, তাতে
ব্যর্থ হয় গ্রহণের প্রকৃত ব্যঞ্জনা;

জমাট বেঁধেছে মেঘ, ওভাবে নেড়ো না ...
সংযত-সংহত করো পালকের সেবা, অকস্মাৎ
পতনোন্মুখ বৃষ্টি— তাকে আরও পরিণত, ব্যাপ্ত হতে দাও!
অফুরন্ত কালব্যাপী বিস্তারিত হতে দাও প্রেমে,
সমগ্র ভূগোলে যেন শিহরণ অব্যাহত থাকে ...

এই যে সামান্য মেঘ, বৃষ্টিসম্ভাবনা—
ছন্দিত ঘর্ষণে তাকে নিয়ে যাও গভীর বর্ষণে
দীর্ঘক্ষণ সিক্ত হোক মরুর পিপাসা ...



জ্ঞান উপদ্রুত
..........
জ্ঞানপ্রবাহের মাঝে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। ভাসিতেছি ...
এতো জ্ঞান! যুক্তির প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হলে
বিজ্ঞান শিক্ষক এসে খালি খালি ধর্ম শেখাতে চায়; বিশ্বাসের
প্ররোচনা করে। অতএব
এ বছর অযৌক্তিক কথাবার্তা বলা হলো খুব। এইবার
আশ্চর্য যে, বুদ্ধিগণ আমাকেও জ্ঞান স্বীকার করলেন!

জ্ঞানপ্রবাহের মাঝে ডুবে আছি। ভাসিয়া গিয়াছি...
আর দ্যাখো, এ সমাজ কেমন খুঁড়িয়ে হাঁটে! ফলে তো
জ্ঞানগর্ভবতী হলো মানুষ সকল। আহা
কী প্রকার দৈবপ্রণোদনা! আমরা খালি হাবুডুবু খাইÑ

ও জ্ঞান, আপনাকে আমি তে কতো ‘জোনাব জোনাবন’ বলে ডাকি!



মতান্তর
.......
বাতাসের মতান্তরে জীর্ণ পাতাটি দ্যাখো কী প্রকার উড়ে উড়ে
মাটিই পাচ্ছে না! বেশ তো ভ্রমণদিন— চলো তবে
নিরুদ্দেশে উড়ে উঠে অগন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যাক!
ভেবে দ্যাখো, কারও বাবা বিপতœীক; কারও মা
পুনরায় বিবাহ করেছে ... ফলাফলে সম্পর্কও উড়ে যাচ্ছে,
মাটিই পাচ্ছে না— বেশ তো ভ্রমের দিন! সাংঘাতিক
শেকড়বিচ্যুতি ... নিরুদ্দেশে যেতে যেতে তারা খুব কথাই বলে না,
পক্ষান্তরে, এরা কোনও বেশি কথা বলে। অতএব চিন্তা করো,
তারা কিন্ত এরা-দের মতো নয়; সুতরাং এরা বটে
তারা-দেরই মতো। সম্পর্কের মতান্তরে
আত্মীয়তা কী প্রকার ঘুরে ঘুরে দূরে দূরে যায়!
পৃথিবীর অভিপ্রায়ে জীর্ণ পাতাটি যে রকম অনাত্মীয়বোধে
বৃক্ষ থেকে, মাটি থেকে, বাতাসের বিবেচনা থেকে,
অসীম দূরত্ববর্তী হলো, দৃশ্যান্তরে ডানা মেলে
লুপ্তিমান ছিন্নমাটি হলো ... আমাদেরই মতো!

আমরা কিন্তু মতান্তরে আমি জীর্ণ পাতার সার্বভৌম সুর
আমরা কিন্তু অনুদ্ধৃত কবি আধারবিহীন বায়ুসমুদ্দুর
আমরা কিন্তু তারা এবং এরা বিপরীতের ঐকবদ্ধ ভূমি
আমরা কিন্তু মেঘেই ভাসা পাখি অন্তরালে ব্যাপক গোঁয়ার্তুমি
আমরা কিন্তু আমাদেরই মতো মতান্তরে জীর্ণ পাতার স্রোতও ...



মুদ্রণার্ত
.....
মুদ্রিত হয়েছ চোখে চোখে
সম্প্রকাশিত তুমি ...
তুমি মানে তোমার দুু’চোখ
ছায়াশীল শোক
চোখ নয়
চোখ ও চিবুক
ভালবাসা
ঘুমিয়ে পড়ার মতো সুখ

যেন শীতলতা সঞ্চালিত হয়
মেরুরজ্জু থেকে
নিম্নক্রমে ...
ভালবেসে ভ্রমে
ঘুমিয়ে পড়েছি অবশেষে
তোমার বিরহ শুধু
আমাকে জাগিয়ে রাখে
ছবি ...

ফলে
স্রোতে ও কল্লোলে
কেউ কেউ জেনে যায়
কবিতা লেখারও আগে
আমি কবি

অন্ধকারে জোনাকিরা জ্বলে
অভিভূত যাজক-সন্ধ্যায়
ব্যাপক বিরহে জেগে আছি
মৌন
নির্জন নৌকায়

কিছু বিদ্যা সম্প্রচার হয়েছে বাতাসে
আমিও মুদ্রিত আজ
রাত্রির আঁচলে
ধূলিধামে, ঘাসে
বাঙলার অনার্য আকাশে ...
মুখপত্র
........
অনন্ত ঘুমের মধ্যে নেচে উঠছ একটি দোয়েল
সাংগীতিক, আজও যত প্রহরার রক্তচক্ষু চিরে
বিপণœ তাকিয়ে দেখি, আঙুলের চঞ্চলতাগুলি
কেমন বিষাদে কেঁপে ওঠে! পালকের পাঠশালা থেকে
জেগে উঠছে, ও তোমার মৃন্ময়নদী কম্পমান;
তিরতির বেলা বয়ে যায় ... প্রক্ষেপিত আলো সঞ্চালনহেতু
জ্বলে ওঠে বালু আর চঞ্চুর যন্ত্রণা থেকে ঝরে পড়া
বিহ্বল ঢেউ— তোমাকেই দৃশ্য করি এহেন প্রভাতে।
কবেকার নদীহীন জন্মপ্রদেশ থেকে ভেসে আসছে
আর্ত হাহাকার! কে এক বালক দুঃখ হেঁটে যাচ্ছ
চিনিডাঙ্গা বিলের দুপুরে, একা একা ... আর
ব-হু-দূ-রে, দিগন্তে ...অস্পষ্ট রেখার মতো
ফুটে উঠছে নদীর কল্পনা। সে কার উপেক্ষা মেখে
হায় পাখি, অনন্তের পাখি, নিস্তরঙ্গ জন্মক্ষেত্রে
বহুকাল নতমুখী গান হয়ে আছ? সংযত ধ্বনির মধ্যে,
বাক্য ব্যঞ্জনার মধ্যে বিপুল কবিতা হয়ে আছ?
মাটি-অভিমুখী এই গান থেকে নেচে উঠছে
একটি শৈশব, নিখিল বাঙলার পথে, এশিয়ার ধ্বস্ত নগরীতে ...
মৃন্ময় দোয়েল যেন বেজে উঠছ হৃদয়ের মহাশূন্যে
সংগীতের, কবিতার, মানুষের ... মুখপত্র হয়ে



প্রাচীন শ্যাওলার জন্য শোক
...............
পৃথিবীর কয়জোড়া হাঁস আজও দুর্গম জল কেটে
পাড়ি দিতে চায়, বৃদ্ধপৃথিবীর এই দীর্ঘজলপথ ...
তাদের পায়ের খাঁজে বরফের শ্যাওলা জমে আছে; আর
যারা ছাড়িয়ে যাবার লোভে
ডানায় বাতাস কেটে মহাশূন্যে উড়ে উঠেছিল—
তাহাদের রঙিন পালকগুলি
অস্পষ্ট পথের রেখা ... মাত্র কিছু রঙচটা প্রতœস্মারক!

কয়জোড়া হাঁস আজও পৃথিবীর মজাজলে ক্রিয়াশীল থেকে
অন্য কোনও প্রান্তে যেতে চায়;
তাদের সবুজ ডানা। জলসিক্ত ডানাগুলি সুপ্রাচীন রোদে ঝলসে ওঠে ...
পরিভ্রমণ শেষে মনে হতে পারে

দূরের রোদেরও কাছে মানুষের কিছু কিছু ঋণ থেকে গেছে



মাতৃবন্দনা
........
কেঁদে ওঠো। পাথরের মর্মমূলে সুপ্ত অভিমান। যে তোমার
কেউ নয় তার জন্য কাঁদো। সেই কান্না বৃষ্টিরও অধিক
হওয়া চাই। জলপাই বৃক্ষতলে দ্যাখো, অনেক সবুজপাতা
কী প্রকার লাল হয়ে আছে! অবিকল তোমার চোখের মতো।
লালরঙে চিরকাল ঝরার কাহিনী বিধৃত ... মাটির কৈষিক জলে
লুপ্ত স্বপ্নগুলি, জেগে ওঠো। যে তোমার বিপ্রতীপে কাঁপে
তার জন্য জাগো। সে তোমার কেউ নয়, তবু ডাকো।
ভালবেসে নাম ধরে ডাকো। সাড়া দেবে জগতের যন্ত্রণাসকল ...
অরণ্যধ্বনিতে উপ্ত অধুনা ত্রিভূজ, যুক্ত হও লম্ব-অভিক্ষেপে।
প্রসারিত হও। অন্তর্বিভাজনে হও প্রবর্ধিত স্পেস। যে তোমার
কিছুই ছিল না— তার জন্য উন্মুক্ত, প্রবেশযোগ্য হও ...
যে তুমি পাথর নও— অ্যামিবাজীবন; খণ্ডিত হবার নামে
বেড়ে যাচ্ছ জ্যামিতিক জেদে। যে তোমার চিরন্তন
আততায়ী— তার প্রেমে আকণ্ঠ ভিজেছ। অতএব
কাঁদো। সতৃষ্ণ চাতক, চোখেরও অধিক লালে পুঞ্জিভূত মেঘে
জলপাই বৃক্ষতলে কাঁদো। এই কান্না সৃজনের গুপ্ত ইতিহাস!
জয়তুন তলে বসে নিরালায় কেঁদেছিল ঈভ ... এভাবে নদীর জন্ম ; আর
স্রোতে যে জন ভেসে এসেছিল, তাকে আদিপিতা বলা হলো।
এত সব প্রতœকথা প্রণিধানযোগ্য ছিল পৃথিবীর প্রথম প্রহরে ...
জলপাই গাছে গাছে কেঁপে ওঠো, দুলে ওঠো প্রলুব্ধ গন্ধম।



প্রায়ান্ধকাল
...........
পৃথিবীর পৌরসমাজে
ঋতু ভেঙে রীতি বদলে গেলে
অধিক রটনামূলে নানারূপ কানাকানি হয়;
তোমাদের পুরসভা অঞ্চলেও বহুবার
এরকম হবে। যেমন শ্রাবণে এই শীতপিঠাগুলি
ক্যালেন্ডারে ভুল পৃষ্ঠা উল্টিয়ে রেখেছে!
জনান্তিকে বলা ভালো—
সকল সৃষ্টির মর্মে ধ্বংসবাসনা উপ্ত থাকে।

প্রতিদিন নতুন ধারণা আসে, কিন্তু তুমি
অভ্যাসের চিরকৃতদাস, পুরাতনপ্রেমী।
পৌরসমাজে তাই সকল ঋতুর নাম প্রাচীনত্ব
যে কোনও সংবাদ মানে শীত ও জড়তা
পথ মানে প্রতিদিন হেঁটে যাওয়া পরিচিত ক্লান্ত সড়ক ...
কেউ কেউ উজিয়ে যাবার নামে ফিরে যাচ্ছে
শতাব্দীপ্রাচীন গৃহে;

গৃহ তবু চিরকাল গৃহহীন করেছে তোমাকে
অন্ধকারও প্রমাণসাপেক্ষ হয়ে আছে



কৈ উৎসব
........
নৈঃশব্দ্য ঘোষণা করছি, নিশিভর বেজে ওঠো
মৌন ঝিঁঝিঁদল; পোয়াতি ধানের ক্ষেতে বহুদিন পর
আজ রাতে কৈ-উৎসব, তার উত্তেজনা নিয়ে
সম্মিলিত নেচে উঠছো কৈ-টোপাগুলি ... বহুকথা
রাত্রিতে বিদিত; ভ্রাতৃত্বের করতলে তীক্ষè হচ্ছ
সামাজিক ছুরি, ইনভিজিবল সেই সর্বনাশকথা
রাত্রির সকাশে বলি— তুমি জানো, কে কতটা
একাকিত্বভোগী। সভ্যতা-ইশকুল থেকে আত্মঘাতী জ্ঞান নিয়ে
আনন্দ ঘোষণা করছি, রাত্রিময় বেজে ওঠো
অন্ধ উইগুলি; এখনও যাইনি বলে কোনওদিন যাওয়াই হবে না
এমন সিদ্ধান্ত ভুল, হে আক্ষেপ, না থেকেও কতখানে আছ!
চিরহরিৎ অরণ্যের গাছে গাছে, রিফ্লেক্টেড অবজেক্টিভ
গুণীদের চোখের পাতায় ... ঈর্ষানৃত্যে বর্ষণের মতো তবু
অনায়াসে ঢুকে যাচ্ছ নগরীর অলিতে-গলিতে যেন স্রোত
বাঙলার ক্ষেতে-মাঠে; প্রসূতি ধানের ক্ষেত মেতে ওঠো
বহুদিন পর ... আজ রাতে কৈ-উৎসব। নৈঃশব্দ্য ঘোষণা করছি,
রাতজুড়ে নেচে ওঠো কৈ, কৈ-টোপা ... সমিতির অন্ধকারে
আর কোনও পূর্ণিমা হবে না, উৎসব হবে না।

আজকেই শতাব্দীর প্রথম ও শেষ উৎসব ...



দৃশ্যভঙ্গ, অর্ধযুগ পরে
..............
পরিবর্তনের মধ্যে বসে থেকে বহুদিন আনন্দিত হই
বাঁশপাতা যে রকম ভাবে নেচে ওঠে
তিরতির কাঁপে ধানশীষ ...
দ্যাখো না, বয়স হলে কলাপাতা কী রকম ফেটে ফেটে যায়!

মিহিন গন্তব্য জেনে, আর যারা ছুটে যাচ্ছ মসলিন সুতার ওপারে
সুতাই তো বহু আগে গন্তব্য ছুঁয়ে বসে থাকে!
পরিবর্তনের মধ্যে বহুবার সংস্থাপিত হই
সুপক্ক ডালিমগুলি যে রকম ভাবে ফেটে ওঠে
ঝাউডালে নিখুঁত ক্বীরাত পড়ে প্রচ্ছন্ন বাতাস
আর ঝিলে ঢেউগুলি ভেঙে ভেঙে নাচে ...
ওয়াপদা কলোনি থেকে, যে-তুমি গোপন পায়ে ছুটে যাচ্ছ
ডালিয়া-বিকেলে; নিকটেই জলসত্র আছে (তুমি জানো?)

পরিবর্তনের মধ্যে বহুকাল প্রবর্তিত হই
বাঁশপাতা কী রকম অকারণ নেচে নেচে ওঠে!
ধানশীষ তিরতির কাঁপে, কেঁপে কেঁপে স্থির হয়;
নিপুণ পিপাসা নিয়ে একাকী দুপুর কেন
দৌড়ে যাচ্ছ ক্যানেলের দিকে ... এই ভেবে
কতদিন দৃশ্যভঙ্গ হল! আহা তুরীয় প্রকাশ ...
ওহো সাইবার সিটিজেন, তুমি জানো?
একপশলা ধানক্ষেত, একটি সামান্য বিলও
নিখিল এশিয়া হয়ে ওঠে!



এই ক্রিয়াপদগুলি আর যে যে ধারণার জন্ম দেয়
............................
বলা

সে তাকে সামান্য ভালবাসে। এক চিলতে তিলের মতো ছোট।
এরই মধ্যে নাক গলিয়ে কেউ, বলল, এবার লজ্জা হয়ে ফোটো!
এই ঘটনা দেখছি নাকি ঘটছি নিজের ভেতর, স্মরণে নেই—
তোমাকে সামান্য ভালোবাসি। অতি রুগ্ন পাটশলাকার মতো ...
কাকে বলছি? সেও বলছে অবাক হয়ে, আমিও তোমাকে তো!
বলতে বলতেই উঠল ফুটে যেন নিজের দেহেই অসামান্য ক্ষত

দেখা

এই যে আপনাকে দেখছি! এই দেখা ধারণাসম্মত;
আপনি মানে অন্য কেউ, তিনি হয়তো আপনারই মতো।



গণতন্ত্র : ক্ষেপণযোগ্যতা, রপ্তানিযোগ্যতা
...........................
এটা বরং ভলোই হয়েছে যে, গণতন্ত্রের ক্ষেপণযোগ্যতা সম্পর্কে
আমাদের মনে আর কোনও সংশয় রইল না; আমরা জানলাম,
উপসাগরের রণতরী থেকেও গণতন্ত্র ছুঁড়ে দেয়া যায় মুক্তিকামী
বাগদাদের লোকালয়ে। নির্বোধ জগতবাসী খামোখাই তাকে
মিসাইল ভ্রম করছে, বলছে, এটা অমানবিক, যুদ্ধনীতির
ঘোরতর পরিপন্থী ... এই লাগামহীন আবেগ ঝেড়ে ফেললেই
বোঝা যাবে, মারণাস্ত্রের প্রতীকী তাৎপর্যগুলি। গণতন্ত্রের এবং
মুক্তিরও রপ্তানিযোগ্যতা সম্পর্কে যাদের একদম ধারণা নেই,
তারাই অমন আদেখলেপনা করবে, আবেগী সমাবেশ করবে
এ রকম ত্রাণ যুদ্ধের বিপক্ষে ... গণতন্ত্র, এমনকী, ছুঁড়ে দেয়া যেতে পারে
মার্কেট এরিয়াতেও; এক হাজার শিশু কিংবা শ’চারেক
গর্ভবতী মাতৃমৃত্যু তো বড় কথা নয়! নতুন শতাব্দীর
মূল দাবি হলো গণতন্ত্র আর মুক্তি; সেটা সামরিক এলাকা চাইলে
তারাও পাবে, আবাসিক এলাকা চাইলে, তারাও! কিন্তু ক্ষেপণ করা হবে
মিসাইলের প্রতীকে। ক্লাস্টার বোমার রূপকে হলে বেটার, তাতে
ক্রমিক বিস্ফোরণে গণতন্ত্র আরও বেশি দীর্ঘস্থায়ী হবে, মুক্তির
শেকড় যাবে ষোলো ফিট মাটির গভীরে, গণতন্ত্রে ছেয়ে যাবে
ধূলিওড়া ইরাকের সমস্ত আকাশ ...



চোখের দূরত্ব থেকে
................
লোনলিনেস থেকে চোখ দু’টি বহুকাল ভ্রমণে গিয়েছে, শ্রাবণের মেঘে মেঘে; প্রসঙ্গত
বলা ভালো, পর্যটনপ্রিয় অই শব্দশীল মেঘগুলি পত্রবন্ধু। ওরা খুব কবিতাপ্রবণ
যাযাবর। চেরাপুঞ্জি থেকে এসে কালে কালে আমাকেও ভাসিয়ে দিয়েছে কতবার!
শিশুকালে সাঁতাল পাড়ায় কান্নাকেই অধিক সংগীতময় মনে হয়েছিল। তাই আমি মেঘ
ভালবাসি। জানি, পেছনের পথ প্রিয়, ফেলে আসা যে-কোনও গন্ধম। ফলে ওরা, উড়ে
উড়ে দূরে যেতে যেতে মাটিকেই করেছে চুম্বন। আর এই পরকীয়-যৌনপ্রণালী
সামাজিক ইঙ্গিতময়তা থেকে গোপন রয়েছে।

লোনলিনেস থেকে জেনে ফেলি লিখনপদ্ধতি। ফলে অর্থের ডানায় বসে
মৌনবাক্যগুলি মেঘ, পাখি, উড্ডয়ন ... অভ্যাস করেছে। আর আমি শ্রাবণে শ্রাবণে
থাকি। শ্রাবণে শ্রাবণে জলপাখি। অতএব চোখ দু’টি বহুদিন নিরুদ্দিষ্ট আছে।

মনোটোনাস অন্ধকারে সুবিন্যস্ত মোমশিখাগুলি অযথাই জ্বলে, অর্থহীন। আমি দুঃখ
এবং আরও কিছু কথা বাষ্পীয় ডাকযোগে মেঘের প্রকাশ্যে তুলে ধরি। যেন এই
অন্ধপ্রভাষণা, এই রাত্রি আমারই প্রস্তাবমতে সৃজিত হয়েছে। তাই নিভিয়ে ফেলার
আগে বাতিগুলি কোলাহল করে।

ও মেঘ, ও নৈঃশব্দ্য পত্রবন্ধু, আমার দু’চোখ নিয়ে আরও দূর অধিবাসে যাও। ভালো
লাগে অন্ধ-অন্ধকার। প্রান্তরের ধূলিকণা, গোধূলির ত্যাজ্য পালক ... হায় লোনলি
বাতাস! মেঘের দূরত্ব থেকে, চোখের দূরত্ব থেকে একা একা বহুদূর যেতে ভালো
লাগে ...



কৃষিগাথা
..........
ইরিক্ষেতের মুগ্ধবাতাস বাঁধ ছাপিয়ে ওঠে
ঝাউপাতা গায় হারানো গান, শিস বাজিয়ে ঠোঁটে
সবুজ পাতার কোলাহলে অবিরাম এক ফুল
অন্তরালে বাঁধিয়ে ফেলে নীরব হুলস্থূল ...

ফাটা-বাঙ্গি নানা জাতীয় উপসর্গ নিয়ে সুচিকিৎসার জন্য ভুট্টাক্ষেতের
নিকটবর্তী হলে যে-সকল দৃশ্য, সুখ ও ধ্বনির অবতারণা হয় তার সাথে
উষ্মবর্ণ জড়িত রয়েছে; ফলে শিসের সাযুজ্যে অই ধ্বনিগুলি বেজে ওঠে
আর কেঁপে ওঠে দৃশ্যপট। এইভাবে বেজে বেজে, কেঁপে কেঁপে ওঠে বলে
বৃষ্টিমগ্ন ক্ষণেরও ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়

আমাদের শস্যক্ষেত এ প্রকারে ফলবতী হলো
মাছের পোনার গন্ধে সেই সাথে পুত্রবতী, জলও—
জলের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হলো মেঘের সংসারে
শেকড় পাতাল ছুঁলে ক্ষেতে-মাঠে জলতৃষ্ণা বাড়ে ...

আর যারা বেঁটে-খাটো, কাউন শীষের মতো নত হয়ে আছি— এবার
যবের মতো খাড়া ও সূঁচালো হতে চাই, দোয়া করবেন, ও মশাই,
আলাভোলা দেহের ভেতর ভুট্টার দৃঢ়তাগুণ চাই ... আর
বাঙ্গিঋতু শেষ হলে কত কত আক্ষেপ করি! কেননা যে,
ভোলাভালা হতে পারি, আমরা তো কৃষকেরই ভাই!

অবশেষে শস্যক্ষেত আমাদের দিকে হয় নত
মেঘেও মেরেছি খোঁচা; জল ঝরে বৃষ্টির মতো
জলের প্রসঙ্গ ওঠে ফিসফাস। মেঘবতী নারী
খাপের সান্নিধ্যে চায় ভুট্টা নয়, তীক্ষè তরবারি ...

বিষণœ বিলের মধ্যে বৃষ্টি, হাহাকার, শিষধ্বনি ও মুগ্ধবাতাস
সম্মিলিত সমগ্রকে কী প্রকার কৃষিগুণ পায়— আমরা তো
না ভেবেও আশ্চর্য হই! আর জিজ্ঞাসা ওঠে,
তলোয়ার কি উৎপাদন-হাতিয়ার হয়?

বাঙ্গি এবার অসুখ বুকে অস্ত্রোপচার চায়
রোদের মুখও লালচে হলো আসন্ন লজ্জায়
ইরিক্ষেতের মুগ্ধবাতাস দিগি¦দিকে ছোটে
ঝাউপাতা গায় অনন্য গান, শিস বাজিয়ে ঠোঁটে ...
বধূযুকাল
“তোমার প্রজননস্থানে পুরুষ ভ্রƒণ আসুক, বাণ যেমন তূণে।
তোমার পুত্রত্বে পরিণত গর্ভ দশমাসে সর্বাবয়ব বীর এখানে জন্ম নিক॥”
-অথর্ববেদঃ৩/২৩/২

মাঠান্তেই অভিপ্রাপ্ত; অর্থাৎ
সভাযোগ্য নই। তবু
গুহ্য নাম ধরি ... দ্যাখো,
এই যোনি সজ্জিত করেছি আজ
সুবসনা হও স্রজযোগে; বিলাসাঙ্গে
তিরীট বসাও ... অনন্তর
নীবি খুলে আবিষ্কার করো পিনোধর,
হসন্তী হে, শেগস্পর্শে বিদ্ধ হও,
সং¯পৃষ্টহেতু করো তনু সম্প্রদান।
সহশয়নের জন্য রোদসী হে, রথের চাকার মতো
ভূজবদ্ধা হও। আমাতে সঙ্গত হও
জলের সমীপে; যদিচ অশুচিকাল
মলবাস খোলো ... সুতসোমে উন্মাদিনী,
চর্যার হরিণী, সংতৃপ্তিহেতু
অন্তে প্রবেষ্টন করো যুগল বেষ্টনী;
দর্ভ একাগ্রযোগে পুংব্যঞ্জন উর্ধ্বাকার হলো
এথা প্রজননস্থলে হোক সংস্থাপিত ভ্রƒণ
বিশে¬ষণে বীজিপিতা, তথাপি জনিতা হই ...
হে সুভগে, এলো এ-বধুযুকাল, এসো
সহস্র শরৎব্যাপী সমবেশনায় লিপ্ত হই,
তুমি পুত্রবতী হবে।



প্রাচ্যের রূপকথা

একদিন
যখন ফুটেছে স্বপ্ন মঠে মঠে মঠে
নদীই বেড়াতে এলো আমাদের বাসের নিকটে

ফলে যাকে ভালবেসে আমরা পাষাণ
তাকে তো জননী বলা সমীচীন হলো!
কেননা নদীর মতো চোখে সেও হেসেছিল
ভেসেছিল, নেচেছিল বেহুলার বেশে
দুঃখের ঘুঙুর পরে আধুনিক ইন্দ্রের সভায়, অবিরত ...

একদিন
যখন আনন্দমুখী ফুটেছিল সন্ধ্যাতারা তটে
নদীই বেড়াতে এলো আমাদের সুখের নিকটে
ফলে আমরা নদীবংশ, দুঃখ কুলবাসী
জননী জননী ডেকে আমাদের আকাক্সক্ষা আকাশি

একদিন
যখন ফুটেছে দুঃখ কৃষকের আকাশে আকাশে
আমরা বেড়াতে গেছি স্মৃতিনাশা নদীর সকাশে
ফলে যাকে নদী বলি— সে তো শুধু জননীর চোখ
প্লাবনভূমির মতো অধিকৃত, সিক্ত হয়ে আছে

তারপর
যখন ফুটেছে নদী বাঙলার মাঠে মাঠে মাঠে
আমরা বিষণœ তিল জননীর করুণ ললাটে

অন্যদিন
যখন ফুটেছে ঘৃণা আরও ঘৃণা ... আরও ... আরও ফোটে
জননী বেড়াতে এলো নদীমেখলা দেশের নিকটে




জ্যামিতিবোধ
............
অনিবার্য ক্রীড়ামোহ
এক জোড়া পিংপঙ বল হাতে খেলা ...
দৃশ্যের একান্তে দেহ স্থির
শুধু চোখ নিয়ে দূরে এসে
আবার তাকালে
হাস্যকর মনে হতে পারে;
এই যে অদ্ভুত খেলা—
বল হাতের ও মধ্যে
কে কতটা আন্দোলিত-উত্তেজিত হয়
কোনওদিন জানাই হবে না
এইসব নিগূঢ় ব্যঞ্জনাসূত্র ...
এক জোড়া পিংপঙ বল তবু
দুলে ওঠে দৃশ্যের বিস্তারে
আর সময় জমাট হলে
বল ও নিপুণ হাত
উভয়ে গরম হতে হতে
লাল হয়ে ওঠে; উপরন্তু
এই যে ডিমের কথা বলা হলো—
সেই সূত্রে বাবুইয়ের যাপনপ্রণালী এথা উদ্ধৃত্য।

দৃশ্যকেন্দ্রে এভাবে নিজেকে গেঁথে
চোখ দু’টি পরিধিতে এলে
দেখারও ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয় ...
বৃত্তের পরিধিবর্তী হায় চোখ
ঝুলে আছ, থাকো
পাপে ও প্রজ্ঞায় সমন্বিত—

এই দৃশ্যে, বলা যায়,
ফলত— জ্যামিতি সৃষ্টি হলো।




ঢোলসম্প্রদায়
...........
একবার আমাদের আলাভোলা শান্ত মফস্বলে
বাদ্যযন্ত্র হাতে এক অদ্ভুত আগন্তুক এলে
আমরা সেই যন্ত্রটির নামে আর ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়েছি
এবং জেনেছি যে, ইহা হয় ঢোল বা ঢোলক ...
যাহা শব্দমান, তালে ও বেতালে বাজে; এর সাথে
মালিকানা প্রচারের, ঘোষণা বা নিলামের সম্পর্ক রয়েছে;

তার আগে আমরা কোনও বাদ্যযন্ত্রে অভ্যস্ত থাকিনি—
ফলে, বাদ্যক্রিয়া আমাদের নতুন বিস্ময়;
আমরা আনন্দিত।

আজকাল আমাদের ঘরে ঘরে, কাঁধে কাঁধে ঢোলক রয়েছে;
এর ফলে আমরা কিন্তু সুদক্ষ বাদক!
ঢোল-সহরতযোগে আমাদের স্বপ্নগুলি, স্বাধীনতাগুলি
নিলামে তুলেছি ... এই ক্রিয়া পর্যাপ্ত নতুন ও আনন্দদায়ক বলে
ঢোলগুলি খালি খালি স্বল্পায়ু হয়, খালি খালি
ফেটে যায় ...পরিণামে কারখানা, পরিণামে ঢোলসম্প্রদায়; তবু

আগন্তুক বাদকের কাছে আমরা তো কৃতজ্ঞতাবোধে নত
এবং বিমুগ্ধ হয়ে আছি।



বিষয় : নূরুন্নবী
..........
পোড়াবাড়ি বনে গেলে নূরুন্নবীর সাথে কথা হয়, সমতট অঞ্চলের রামগঞ্জ থানা থেকে দীর্ঘ হালট ভেঙে একাই এসেছে সে পৃথিবীর শস্যনগরে, যাকে আমরা বন মর্মে বিভাগ করেছি; আর তার জন্য মন্ত্রণালয়ও আছে ... এই যে শস্যের জন্য ধ্যানমগ্ন প্রকৃত কৃষক ফলবান— নূরুন্নবী, বনের মুনিষ তুমি, কী তোমার মন্ত্রণালয় আমি তো জানি না! তোমার সন্তানগুলো খেলা করে সমতটে প্রতœবাঙলায়; প্রতীক্ষাপ্রবণ বউ কী কী সব স্বপ্ন নিয়ে জেগে থাকে কুয়াশা ও ফাল্গুনের রাতে— অনির্ণীত অইসব বঞ্চনার কথা রেখে আমি শুধু তোমার কবিতা পাঠে মুগ্ধ থাকি তরতাজা মাটির কাগজে। তুমি তো মাটির কানে বহু কথা বলতে চেয়েছ, মৃৎকবি, বাঙলার নমস্য যন্ত্রণা ... যথাকালে ওলশিশু পনের-সতের কেজি হবে— এটুকু বলেই তুমি আনন্দিত হয়ে উঠেছিলে বায়ুর কল্লোলে, আমি সেই যথাকালে চোখ রাখি, দেখি, বৃত্তাকারে শরীরবিদ্যুৎ দুলে ওঠে স্মৃতির ভেতরে ... ফসলের দোলা দেখে স্বপ্নগ্রস্ত একজন কৃষকের হাসি, কী রকম পবিত্র ও স্নিগ্ধতম সত্য মনে হয়— যেন প্রমুগ্ধ শিশুর মুখ, মুক্তাদ্যুতি ছলকে ওঠে দৃশ্যের বিস্তারে। আমি সেই কবিতার পাঠ আর ঘ্রাণ নিতে নিতে সুদীর্ঘ হালট ভেঙে মাটির অন্তর হেঁটে আসি, একা ... সমতট থেকে আরও বহুদূর বরেন্দ্র ও পুণ্ড্র ঘুরে হরপ্পার সুবর্ণ যৌবনে; আর নূরুন্নবীর সাথে কথা হয় সবখানে মাটিবর্তী কবিতাজীবনে ... তারপর ... অনেক অনেক দিন কেটে গেলে আপাত ও প্রকৃত সময় ছেনে নগরের খণ্ডিত মাটিতে, টবে ... বারবার মনে হলো নূরুন্নবীর সাথে কথা হয়, হলে, ভালো লাগে ... আমাদের একই পেশা— কৃষিজ কবিতা।



রাষ্ট্রসঙ্ঘ
.......
এহেন মুহূর্তে তুমি হায় রাষ্ট্রসঙ্ঘের মনীষা, রাজহাঁসের উঁচু-লম্বা গলার মতন আগ্রহ বাড়িয়ে তোলো আনবিক যুদ্ধদগ্ধ পৃথিবীর সুকোমল স্তনে! লুণ্ঠিত মাটিতে শুয়ে অুনভব করি সেই দৃষ্টির আরাম। যে তোমাতে বিচার প্রার্থনা করে, কুমারী নিষেক, তার প্রতি রাষ্ট্র, ধর্ম, গোত্রাচার ... অসীম আগ্রহে জেগে ওঠে। হায় রাষ্ট্রসঙ্ঘ তুমি, তুমি সেই আদিম লালসা, অভিভাবকত্ব নিয়ে আদরের ছলে করো শিশুযৌনাচার! লাঞ্ছিতা পৃথিবী নিয়ে আমি তবু তোমার দুয়ারে যাই, আধুনিক কাজীর দরবারে। গিয়ে দেখি, শ্যাম্পেন-স্নানের পর রতিক্লান্ত বিচারক অচেতন, ঘুমে। দুয়ারে, প্রবেশপথে, আণবিক অস্ত্রগুলি অতন্দ্রপ্রহরী সেজে আছে ...

ডানায় ভ্রমণক্লান্তি, ফিরে যাচ্ছি পরাজিত পাখি। এহেন মুহূর্তে তুমি হায় রাষ্ট্র, হায় সঙ্ঘনীতি, গণতন্ত্রে খুঁজে পাচ্ছ মানবতা; মানুষের মুক্তি ও সমতা!



আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
.............
বজ্রাহতের মতো থমকে আছ বিস্মিত হরিণী। হাঁসছানাদের জন্য
ভালবাসা নিয়ে গৃহস্থের মেয়েগুলি শামুকসন্ধানে গেছে বিলে।

এইখানে কী করে মাটির মধ্যে এত স্বপ্ন ঘুমায়ে রয়েছে— সেইকথা
ভেবে তুমি বিস্ময়পূর্বক ভেসে যাচ্ছ ধরলার ঢলে সীমাহীন; আর
মেয়েগুলি বিল থেকে ফিরেই এলো না! হাঁসছানাদের জন্য শৃগালেরও
অপত্য দরদ উথলে ওঠে, ইন্টারনেটে ভাসে তার পর্যাপ্ত নমুনা ... কী ভাবে
বিলের মধ্যে মেয়েগুলি নিরুদ্দিষ্ট হলো— সেই গল্প অবহিত হও;

স্বপ্নাহতের মতো দেখেছিল তারা, বিলের শামুক সব আচানক
হাঙরের হা হয়ে জেগে উঠল অপার যমুনা! ধরলার ঢেউয়ে ঢেউয়ে
ভেসে যাচ্ছ বেদনাপূর্বক; এইখানে কী করে বিলের থেকে মেয়েগুলি
ফিরেই এলো না ... হাঁসছানাদের জন্য শৃগালমাতৃত্ব থেকে বুঝে নিয়ো
অইসব রাজনীতিপনা ... এশিয়ার দুঃখ নিয়ে য়্যুরোপে সভা হলে
অর্থনীতি কার পক্ষে হাঁটে? জেনে নাও, ও হাঁসের ছানা!



সমাজতান্ত্রিক বিপর্যয় এবং একটি কাঁথার গল্প
.................................
একটি সমান্য কক্ষে অসামান্য উপস্থিতি আজ। বারো কোটি মানুষের মুক্তিস্বপ্নে বোনা
কাঁথাটিকে টুকরো টুকরো করা হবে— তার আলোচনা।

বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে, সমতট থেকে, বোদা ও নাচোল থেকে, টেকনাফ থেকে মতামত উদ্বিগ্ন আছেন। আদমজী এসেছে, কৃষি আছে, ক্ষেতমজুরিও পাশে বসে আছে ভয় আর উত্তেজনা নিয়ে। বহুগুলি বিশ্ববিদ্যালয় এসে সামান্য কক্ষের মধ্যে উপবিষ্ট আছে। একটি অনুরোধ উঠে কর্তাদের পা ছুঁয়ে কেঁদে ফেলেছিল; সে চায় সামান্য কিছু। কাঁথাটির অখণ্ডতা চায়। নাটকের পঞ্চমাঙ্কে একটানে ছিন্নভিন্ন কাঁথা। অ্যাম্ফিথিয়েটার থেকে ফিরে এসে আগোচরে একটি উদিত স্বপ্ন দীর্ঘ ঝুলে আছে সিলিং ফ্যানের সাথে, নিখিলের খিলবন্ধ পল্টনের প্রীতম হোটেলে।

আমি জানি, ঝুলে থাকা দীর্ঘ হতে হতে এই কাঁথা ঢেকে দেবে এশিয়ার অন্ধকারশীত। একটি সামান্য কক্ষে অসামান্য উপস্থিতি একদিন অন্য অর্থ পাবে।

লক্ষ করো, পৃথিবীর সকল সিলিং ফ্যানে ঝুলে আছে দীর্ঘ সম্ভাবনা।



দ্বিরুক্তিকা
.........
আমিও কিছুটা খুলি, আর তুমি বাদবাকি খোলো
ভেতরে গুঁমরে কাঁদা প্রশ্নগুলি তোলো!
খোলাখুলি হোক আলোচনা ...
খানিক তুমিও ওঠো, আমিও ক্ষণেক উঠে থাকি
এইভাবে লিঙ্গভেদ করি ঢাকাঢাকি!
আমি অন্ধ আর তুমি পদ্মলোচনা;

বুধে কী ফাল্গুনে ফের
রামধনু হেসে ওঠে আকাশপাড়ায়
তারও আগে বৃষ্টি নামে ভিন্ন দ্যোতনায়;
কামধেনু কৃষকের দ্ব্যর্থ প্ররোচনা ...

‘মুষল পূর্ণিমা’ নেই—
অজগরঅন্ধকারে লিপ্ত গাঁওখানি
রাত্রি বলে, আমি ক্বচ, তুমি দেবযানি;
পরিণতি এক বটে— পৃথক শোচনা ...



পুনোরুৎসব
.........
আমি যখন তোমার কথা ভাবি স্বপ্ন ফোটে বনের গাছে গাছে
সফলতম শব্দলোকের চাবি তুমিশ্লিষ্ট ভাবনামালায় আছে
তুমি যখন আমার কথা ভাবো স্বপ্নগুলো শিল্পিত সন্ত্রাসে
উস্কে দিয়ে অনঙ্গ স্বভাবও জ্বরের মতো শরীর বেয়ে আসে
তুমি তখন বাঙলাভাষার নদী আমি শব্দ অন্যরকম ঢেউ
ছিন্নভিন্ন আর্যভাষার গদি সর্বনাশ তো রুখতে পারেনি কেউ

এভাবে এনেছি কাক্সিক্ষত জয় প্রতিস্বপ্নের বেলা
তুমি আর আমি এ নিখিলময় নন্দিত অবহেলা

আবার যখন পৃথিবী উঠেছে জেগে খুঁজে খুঁজে তার শেকড়ের সন্ধান
আমরা এনেছি চিরায়ত উদ্বেগে ভেজা মাটি আর নয়া পৃথিবীর গান
উস্কে দিয়েছি সবগুলো নদী-নালা ভাসিয়ে নিয়েছি মেকি স্বপ্নের বেদী
শব্দের মাঠে অনুসন্ধানমালা সচল করেছি তুমি আর আমি জেদি
দ্যাখো, বাঙলার গাছে গাছে আর মাঠে আলোকিত ফুল আলোকিত সবপাখি
এসো আজ এই সুষুপ্ত তল্লাটে অনার্যদের পুনোরুৎসব ডাকি




ডিমের সম্ভাবনা
............
ডিমেভরা কৈ-এর মতো কথা
উপ্ত ছিল বুকের ভেতর, মনে
গোপন করে স্নিগ্ধকোমল ব্যথা
ঘুরছিল সে অচিন বনে বনে
বনে বনে মানুষ ছিল; ভাষা
ভিনদেশীদের মতোই অন্যতর
স্থগিত রেখে ব্যক্ত করার আশা
কাছিমখোল-এ কষ্ট হলো দড়
মুক্তাফলা ঝিনুকরীতির মতো
বিসর্জনে রাখল দ্যুতিদানা
কবি হলো শামুক, আত্মরত
রইল পড়ে ডিমের কাব্যখানা

গ্রস্ত আশায় প্রতীক্ষা, দিনগোণা ...
খুঁজবে কে সেই ডিমের সম্ভাবনা?




প্রণয়ঘটিত
.........
তোমার আনন্দ, তৃপ্তি ... শনাক্ত করেছি
এসো আজ আমাকে শনাক্ত করো, মৃত ...
ভালোবাসা দাগী চোর বিধানে, বিধৃত;
তাকে গ্রেফতার-ছলে তোমাকে ধরেছি।
দোঁহেই দোঁহার কাছে প্রার্থী দোনো পাণি
অথচ না-জানি কোন ধূর্ত-অজগর
এমতো পেঁচিয়ে ধরে প্রকাশের স্বর ...
পাণিপ্রার্থী, এই নাও চক্ষুভরা পানি!

আপন নাভিটা কেটে রক্ত কিছু দাও!
আপাদমস্তক সুখ চাকু ঠেঁসে চিরি
ভালোবাসা জন্ম আর মৃত্যুর সংজ্ঞাও
দোঁহার আনন্দে দোঁহে যাঁচি হারিকিরি;
নিরীহ স্তনাগ্র খোলো, ছিঁড়ি বিষদাঁতে ...
দুনিয়া দেখুক প্রেম বিস্মিত প্রভাতে!




বিষতৃষ্ণা
.......
কী সুন্দর শিল্পসম্মত এই উপেক্ষার ভাষা!
আমাকে দেখেই তুমি উঁচিয়েছ ফণা
কেবল কবিতা এই শিল্পের তুলনা;
অথচ নির্বোধ আমি, তোমাকেই করেছি দুরাশা ...
যে রূপে গর্ভিনী তুমি, যে রূপে জননী
যে রূপে কামিনী তুমি যে রূপে নাগিনী
সর্বরূপে সর্বজ্ঞানে অকল্যাণে এবং কল্যাণে
যে করে তোমার ধ্যান অনুপল বিপন্ন বিজ্ঞানে
আমি তার সর্বৈব প্রতিভূ। অনন্তর
দেহের অধিক অর্থে বেঁধে দেহঘর
উপশম যাকে বলি সেও বটে প্রকৃষ্ট প্রদাহ ...
যেমন মৃত্যুই হলো নিরন্তর জীবনপ্রবাহ ...

তোমাকে চেয়েছি বলে আমি মূর্খ, আমি হতজ্ঞান
তোমাকে চেয়েই তবু শিল্প আমি, আমিই প্রজ্ঞান ...



এলিজি
............
মাছসব ছাড়ে নাই জল, মানুষ ফিরেছে লোকালয়ে,
যথেষ্ট সংসারী হলে পর্যাপ্ত সন্ন্যাস এসে ডাকে ...
চাঁদ খুব দূরে বলে অধিক নিকট মনে হয়;
এত জ্যোৎস্না শরীরে-দুয়ারে-মনে সমাদর মাখে।
প্রচুর সকালবেলা রোদ যদি সম্ভাবনাময়—
তবে কোন অপার বিশ্বাসে ডাকো অন্যায্য বিকেল?
ভেঙে ফেলে হৃদয়ের স্বপ্নভাণ্ড, আনন্দবলয়;
বিবর্ণ হলো যে এত প্রশুদ্ধ নিকেল!

লোকসব ছাড়ে নাই ঘর, মাছেরা গিয়েছে আরও জলে,
প্রভূত আনন্দভূমি অগ্নিশীল, তিক্ত মরুময় ...
ভুলেছি প্রতীজ্ঞাগুলি, ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির ফলে
মুঠোতে ধরেছি এক মোহমায়া, নকল বিস্ময়।
আজ এই এতটা হলুদ গান— তবু কোন ফাঁকে
যথেষ্ট বিফল বলে— তোমার প্রতীজ্ঞা এসে ডাকে ...



অন্ধকার : পরোক্ষ গোধূলি
........................
বাইরে প্রচণ্ড চাঁদ, মাঠ ডাকে— আয়!
নগ্ন-প্রকাণ্ড রাত স্নানরত তীব্র জ্যোৎস্নায় ...
ভেতরে প্রচুর মৃত্যু, মুগ্ধ যন্ত্রণায়
ভেতরে জোনাকিস্বপ্ন, শিশিরশীতল ঘুম,

অন্ধকারও আছে; অপেক্ষায়


আশ্চর্য প্রেমিকা তুমি, পাখির ডানার স্বপ্নে নামো প্রতিদিনই।
সময়ের কাঁটায় কাঁটায়, কী ভাবে যে আসো!
তথাপি প্রতীক্ষাগীতে কাটে দিন, বিরহব্যাকুল শীতমাসও ...
সংগোপন সঙ্গদানে করেছ তো অতিশয় ঋণী—

তোমার নামার শব্দে নামে ঘ্রাণ, স্মৃতিরাজহাঁসও ...

তবে কি আমারই মতো নীরবে এসেই ফিরে যেতে
ভালবাসো? অলখে আঘাত পেতে পেতে
তোমারই গজল শুনি— নৈঃশব্দ্যের সহজ-সম্ভবে;
প্রশ্নপ্রধান গানে ভিজে ওঠা মাঠে, ফিরে কেন আসা তবে
মনোটোনাস প্রার্থনায় মেতে?


নাচের মুদ্রায় উড়ে যাও.. আহা! আমারও ডানার লোভ হয়,
ফাল্গুনের এত অন্ধকারে কেন যে শরীরে জাগে জ্বর
কী সুন্দর অক্টোপাস রাত্রি এলে, আমাকে কেবল ডাকে ভয়;
কেন ভয় শিখিয়েছ? তেড়ে আসছে ভয়ের হাঙর ...

রাত্রির কাছে রেখেছ কেন ফেলে? রাত্রি তো আমার বউ নয়!

একাকী আঁধার শুয়ে আছে নিঃসাড়
জীবনের সাথে মৃত্যুর অভিসার ...
এ রকম রাতে একটি কল্পবেলা
ভালবাসা ছিল বাকি সব অবহেলা
কালো পিপীলিকা ঘিরেছে অস্থি, হাড় ...

রাত্রি, তুমি জেগে ওঠো যার গানে—
আমি বাঁচি সেই বৃষ্টির কল্যাণে;
বৃষ্টি আসেনি, বৃষ্টি আসে না, ধুলো ...
বিমূর্ত আজ অবাক সন্ধ্যাগুলো!

পথে পথে ঘুরি বৃষ্টির সন্ধানে


ফুটেছে গুঞ্জার লাল, সংকুচিত তৃষ্ণা জেগে ওঠে;
বিভিন্ন অগ্নিতে দগ্ধ রাত্রিগুলি কুঁচবর্ণে ফোটে ...
বিপুল বিশাল রাত্রি ফুলে ওঠে, দুলে ওঠে ক্ষোভে;

এহেন গুঞ্জারকাল উঠে যাচ্ছে গণ্ডারের ঠোঁটে!
অফুরন্ত অন্ধকারবেলা নামে লোভে ও প্রলোভে ...


গতকাল তাকে স্মরণ করিনি, গতকাল ছিল ঘোর,
গতকাল ছিল মৃত-বুধবার, জন্মের অগোচর;
মৃত বুধবার মৃত্যুরই মতো অচেতন শুয়ে থাকা—
মেঘের ওপরে বজ্র সাজিয়ে শূন্যবৃত্ত আঁকা ...
জন্ম অবধি আঁকছি তো ছবি, গতকাল ছিল ছাড়
গতকাল ছিল খুব বাড়াবাড়ি ধূমায়িত সন্ধ্যার;
প্রতিসন্ধ্যার অজস্র স্মৃতি নিউরনে জমা রাখি
গতকাল ছিল শূন্যবৃত্তে শূন্যেরই আঁকাআঁকি

গতকাল ছিল রক্তগোধূলি, আলুথালু শঙ্কার—
এই ‘বার’ শুধু একবারই আসে, আসবে না ঘুরে আর ...


বৃষ্টির মতো ঝমঝম সুরে রাত নেমেছিল, নামে ...
সেই রাত্রিকে স্বাগত জানাই সেজদা ও প্রণামে;
রাত নেমে এসে হাত পেতেছিল, করেছিল প্রার্থনা।

উপাস্য যদি উপাসনারত, ডাকি তাকে কোন নামে?
পত্রের ছলে তোমাকেই সেই রাত্রি দিয়েছি, খামে ...



১০
রাত্রি আমার স্বপ্ন খামার রাত্রি আমার বউ
রাত্রি এলেই উথলে ওঠে নির্জনতার মৌ
রাত্রি আমার হা-হাহাকার রাত্রি আমার সুখ
অবিনশ্বর প্রাণ খুঁজে হই রাত্রিতে উন্মুখ
রাত্রি খুঁড়েই দেখছি নিজের ছিন্নভিন্ন বুক




অন্ধকার : রাত্রির প্রত্যক্ষে এই গান
..........................
অনুকার ধ্বনিলিপ্ত রাত্রিনদীতে ভেসে যাই
আর অই শিশুবেলা কেঁদেছিল স্মৃতির উঠানে;
স্মৃতি তো আমারই বোন! সাঁওতালবোধের সানাই—
বিহারে কী হারে ওর সন্তানেরা হাহাকার বোনে!
অথবা রাত্রির সাথে, বলা চলে, অদৃষ্ট বদলাই ...


কিংবা এমন হয়, দিনপঞ্জি লিখি আজ রাত্রির মর্মরে ...
আয়না থাকেনি; ফলে— আমারই রাত্রিতে জর্জর
থেকেছি অনেক কাল, শত্র“দিনে, বন্ধুত্বের হাহাকার-জ্বরে।
কিন্তু এই এত চুল ... জীবনেরও অধিক ধূসর!
কৃষ্ণত্বপ্রাপ্তির লোভে ছুটে গেছে বালুপর্ণ জলের শহরে ...


রাত্রিরই প্রাতিস্বিকে লিখি এই রাত্রিকথাগুলি ...
আঁধারপ্রবাহে ওড়ে হৃদয়ের ধূলি;
মাসিকচক্রের ত্যানা উড়িতেছে রাতের আকাশে,
ভুবনের মেয়েগুলি খিলখিল হাসে ...

গলায় টাঙানো কত বিভিন্ন মাদুলি!

সমুদ্রবাহন নাই, তবু কত প্রবাহিত হয়েছি যে জলে!
যাকে এত জল বলি, সেও বুঝি পেয়েছিল ডানা
রাত্রির নিগূঢ় চোখে ... চিত্রিত আকাশ নিয়ে এসেছি জঙ্গলে;
এতটা নিপুণ কারা টাঙিয়েছে কালো সামিয়ানা?

মলিন জোনাকিগুলি মৃত; তবু জ্বলে ওঠে সমসত্ত জলে ...


আমাকে অশুচি করে এই রাত্রি পবিত্র হয়েছে;
পবিত্র হয়েছে ভেবে, বেঁচে-বর্তে গেছে ...
আমিও ঘরের ছেলে ফিরে যাবো ঘরে,
কষ্ট পাবো না ... আছে প্রতিজ্ঞা অন্তরে।

মফস্বলে ফিরে গেলে, রাত্রি একা, কাঁদবে নগরে ...


জলবাহিকার কাঁখের মতোই মজবুত এই রাতও;
ভালবাসা যেতো, গড়ে তোলা যেতো সীমাহীন সংঘাতও ...
পালিয়ে গিয়েছি; নূপুরের মতো পায়ে পায়ে তবু বাজে
নাছোড় সর্বনাশ ... রাত্রিরই কাছে নতজানু তাই লাজে

আমি মনে রাখি, মনে রেখে ভাবি, তোমরা ভুলবে না তো!


স্মৃতিতে আক্রান্ত হই, কেন না তা রাত্রির সমান;
রাত্রিতে আক্রান্ত হই, রাত্রিই প্রকৃতপক্ষে গান ...
গানে তো আক্রান্ত হওয়া আরও সমীচীন!

গানের ভেতর থেকে উদিত যে দিন
যেহেতু আমার লক্ষ্য সেই আদিপ্রাণ ...


কালো শাড়ি সুসজ্জিত সিঁদুররাঙানো মুগ্ধরাত ...
ভেতরে ও ভাঁজে ভাঁজে ইতিহাস, রক্তপ্রপাত!
ভুবনের মেয়েগুলি উড়িতেছে রাতের আকাশে;
এত ক্ষুধা ... উৎপীড়ন মাখামাখি এই রাত্রিবাসে!

ছড়ানো ছিটানো দাগ স্পষ্টতই জঙ্গলে ও ঘাসে


তবে একে ধ্বংস বলি, এই ধ্বংস সন্তানসম্ভবা
উত্তরের হিমশৈল, দক্ষিণে অতল পুনর্ভবা;
তবে একে দুঃখ বলি, এই দুঃখ সুখের অধিক
পশ্চিমে ডুবেছে গান, তৈরি থেকো পুবের পথিক!
নষ্ট করো না বীজ, এই মাটি যথেষ্ট সম্ভবা ...


১০
ভূমিপুত্র, মাটির নিরীহ ঘুম পোড়াও উল্লাসে!
রাত্রির চৈতন্যে ছোঁড়ো অভিতীর একলব্যবোধে;
মুত্যু তো অনেক হলো! এইবার পূর্ণপ্রতিশোধে
জাগো ও জাগাও ধ্বনি অনার্যের আকাশে বাতাসে

যেন দেখি, মনসাই গাঙুরের জলে জলে ভাসে ...



স্মৃতিসম্মেলন
........
তোমাকে দেখতে যাবো সাধু যোশেফের সমাবেশে
উনিশ শ’ একাশি খ্রিস্টাব্দের সোনালি উৎসবে;

তখন আমার দুঃখ মাধ্যমিক, আর তুমি নিম্নমাধ্যমিকে—
এ রকম উৎসব পুনরায় স্মৃতিতে সম্ভব। তোমাকে দেখতে
যাবো অনুতপ্ত স্মৃতিসম্মেলনে। যে রকম প্রাথমিক
গণিতের দিনে দেখতে গিয়েছি সেই জোয়াড়ির
বিশীদের বাড়ি; বাড়িতে মানুষ নেই— বাড়িটিও নেই—
তবু আমি ঘুরে ঘুরে কেন দেখি সারাটি দুপুর?

তুমি নেই, কখনও ছিলে না— অস্তিত্ব বিষয়ে এই
চিরায়ত অনুজ্ঞাও অস্বীকার করছি বিনয়ে; আমার যে কোনও পণ
সবিনয় জেদ। অতএব যাবো, তোমাকে দেখতে যাবো স্থাপনদিঘিতে;

রাণীভবানীর ছাদে যে রকম সারারাত তোমাকে দেখেছি—
শিশিরের ছলে শুধু রক্ত ঝরেছে সারারাত— রাতভর
নক্ষত্রের বীভৎস শরীর থেকে সহিংসার অগ্নি ঝরেছে ...
ঝলসে যাওয়া দেহে তবু পালিয়ে আসিনি; সাহসী ইচ্ছায়
দৃঢ় ভষ্মে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থেকেছি আর দেখেছি তোমার নৃত্য
ভয়ঙ্কর অগ্নিদিঘিতে ...

তোমাকে দেখতে যাবো, চন্দ্রাবতী কবিতা আশ্রমে—

গীতিকা উৎসব যদি ব্যর্থ হয়— অসম্ভব স্বপ্ন হয়ে যায়—
তবু যাবো; রোদ ভেঙে, শিশির মাড়িয়ে, বাসে-ট্রেনে,
পায়ে হেঁটে, ঘুমের ভেতরে ... অবিকল্প, নিশ্চয় যাবো!

একবার, তোমাকে দেখতে যাবো, অ স ম্ভ বে




রাত্রিযাপন
........
অন্ধকারে— ধূপখোলা মাঠ থেকে ভেসে আসে থোকা থোকা মেঘ;
তবু দেখ, বিড়ালের চারণশৈলীতে
দূর ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাত্রির অবসন্ন চাঁদ
তাকে বিবাহিতা কিন্নরীর দাম্পত্য যন্ত্রণাক্লিষ্ট
চোখের মর্যাদা মনে হলো। সময়কে জলের মতো ছেনে-ছেঁকে
পাওয়া যাচ্ছে দুইটি আশ্চর্য ফলাফল— নৈঃসঙ্গ্য ও মৃত্যুসম্ভাবনা;
অথচ এ-চাঁদ সেই ব্যর্থ প্রেমিক— যে কিনা
অনন্তকাল ছুটে যাচ্ছে মুহূর্তে হারানো তার
প্রেমিকার দিকে; অসফল সঙ্গমের ক্ষোভে
সে এখন অভিশপ্ত, মৃত ... আর দ্যাখো, অকস্মাৎ
আমাদের স্মরণে আসে যে, এই চাঁদ একা একা
দয়াগঞ্জ মোড় থেকে হেঁটেই এসেছে কিংবা
এখনও আসেনি; একবার আসবার কথামাত্র আছে ...

ঝুলবান্দার দিকে দৃষ্টি রেখে রাতের মন্দিরে আজ
তার কথা ভাবি কিংবা কিছুই ভাবি না, শুধু
ভাবার বাসনামন্ত্রে জেগে থাকি রাত্রির অদূর ভবিষ্যতে; আর
পদ্মনিধি লেন থেকে ভেসে আসে কার যেন
কান্নার মিহিন আওয়াজ, মনে হয়— আকুল জননী কাঁদে;

বিফল রাত্রির সেই অবসন্ন চাঁদটির কথা ভেবে
তবু আজ আমাদের নিদ্রাভঙ্গ হলো—

গৌড়ীয় মঠের পাশে, নারিন্দার অন্ধকার-বিপন্ন গলিতে




অকৃতজ্ঞতা
........
মানুষই অকৃতজ্ঞ; এই উপলব্ধির জন্য আমার তো অন্য কারও প্রয়োজন নেই!

পঁয়ত্রিশ বছরে আমার তৃষ্ণা নিবারণের জলপাত্র লেগেছে
একশটিরও অধিক কি নয়? আর পুকুর, নদী, সমুদ্র কিংবা নলকূপের
কথা না হয় ছেড়েই দিলাম; এ ছাড়াও থাকছে— পুষ্প, শিশু, নারী,
বাগান ও বৃক্ষদের কথা। এমনকী, নিঃসঙ্গ দুপুরে মাছরাঙার
ধ্যানস্ত-শিকার এবং তার ডানার যাদুময় ভঙ্গিমা— এ সবের
কতটুকুই বা স্মরণে রেখেছি? অথচ তারাই কি তৃপ্ত করেনি আমাকে?

ক’জন হলফ করে বলতে পারবে যে মনে রেখেছে তারাও? আর অই
নগরীর রোদে ও উজ্জ্বল আলোর নিচে দুলে-ওঠা রূপসীর দল—
তাদের, এমনকী, অকৃতজ্ঞ বলতেও সাহস রাখি না; তারা তো
এইসব সূক্ষ্ম ভাবনা ও ক্ষুদ্রতর যন্ত্রণা থেকে বহুদূরে— নির্জনে—
গোপন সব রাজ-অন্তঃপুরে নূপুর নিক্কনে হাঁটে, হাসে,
খেলা করে; পৃথিবীর কোনও ধূলি, উ™£ান্ত বাতাস আর
নিরুদ্দিষ্ট ঝরাপাতার গুপ্তকান্না কোনদিনও ভেদ করতে পারেনি
যেসব পুরুষ্ট দেয়াল— তারা সেই সুরক্ষার প্রযতেœ সুন্দর; জেগে থাকে
বহুবর্ণ আলোর মধ্যে আর তাদের কোমল দামি ও রঙিন
অন্তর্বাস খুলে ফেলার আগে পর্যন্ত বেঁচে থাকে
টাটকা রক্তগোলাপের ঘ্রাণে মনোহর এবং সেইসব
নগ্ন-সৌন্দর্যের ওপর মৃত্যু ঝাঁপিয়ে পড়বার মুহূর্তে হয়তো বা

কারও কারও মনে পড়ে, অন্তর্বাসের সীমাহীন অকৃতজ্ঞতার কথা ...




ভেসে থাকার ঘটনা
.............
জলে ভেসে আছে— জুতা; আর
দুলে উঠছে, উত্তাল ঢেউয়ে ঢেউয়ে,
মনে হচ্ছে, আজ
স্বেচ্ছায় তাকে নৌকাভ্রম করি, কিন্তু

থাক সেই রূপকথা; যতক্ষণ না-জন্ম নিচ্ছে
অবাধ্য শিশুরা,
যারা হট্টগোল করে, আর ভালবাসে
শুধুই পুরানো গল্প— অবান্তর এবং
কল্পনামাখা সুখের দিন;

প্রশ্ন হতে পারে—
জুতা জলে ভাসে কিনা; কিংবা
কবে, কোথায়-বা ভেসেছিল?
সটান— আমি কিন্তু জাহাজ প্রসঙ্গে ফিরে যাবো,
তোমরা প্রশ্ন করো না; শুধু
শুনে যাও, ভাসাভাসা ভাসার ঘটনা ...

বরং মনে রেখো, অইসব শিশুদের কথা—

তাদের অবাধ্য খেলার দিনগুলি, কল্পগল্পে ঠাঁসা; তবু
তারা একদিন ভাষা পেলে, অকস্মাৎ
জুতার প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলবে,
বলবে যে, ভাসতে ভাসতে
দুলে উঠেছিল ...



অস্তিত্ব বিষয়ে
..........
তোমাদের ঘাটে ঘাটে স্নান করি, আর দেখ, শঙ্কিত শঙ্খের শব্দে কীরকম ভুলে যাই, বিশেষ মুহূর্ত এলে কোনও কোনও শরীরও মন্দির হয়ে যায়; আমি সেই মন্দিরের প্রকাশ্য আলোর নিচে পুড়ে যাই শৈশবের কাল্পনিক নদী ...আমি অই মন্দাকিনী স্রোতে যেন তোমাদেরও বহুকাল আগে কবে চিৎ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি! সহসা নিথর হয়ে স্রোতও ঘুমিয়ে পড়েছে সাথে সাথে; ধারণার ধূম্র-কুহকে শুধু অঙ্কিত হয়েছে সেই স্থিরচিত্রনদী, সীমাহীন সমুদ্রের অসীম দৃশ্যের দিকে চোখ রেখে দৃষ্টিকেও মিথ্যাবাদী ভাবা যেতে পারে। আমি তো মন্দিরে স্থির বসে আছি সফল যন্ত্রণা ... পাথরে প্রোথিত প্রাণ, প্রতœ-পুরোহিত; ফলে যাকে হেনরী ভাবো, সে তো শুধু ধারণাবিধৃত এক আমার কল্পনা! শৈশবের অবোধ মন্দিরে শুয়ে, আমি এক নদীস্পর্শে ধুয়ে-মুছে গেছি— স্লেটে লেখা অক্ষরের মতো; যাকে শুদ্ধ-দেবী ভেবে প্রণয়ের অধিক শ্রদ্ধায়— নৈবেদ্য দিয়েছি প্রেমে, পুজায়-প্রসাদে, সে আমার জননী ছিল না; তাই আজও মাতৃকাম হাহাকার করে ওঠে স্রোতের কল্লোলে ... প্রভু, আমি স্নান করি অদৃশ্যত কুসুমনদীতে; রাধিকার ঘাটে কোনও শ্যাম নয়— ধ্বনিমন্ত্রে শিহরিত বিনয়ে ও কামে, এই পোড়া শরীরও মন্দিরে হয়ে যায় ...




গরু চুরি
.......
একদিন আমাদের ভজহরি স্ট্রিটের বিকেলে
বদরগঞ্জ থেকে কয়েকজন লোক এসে বলে যে,
গরু কোনঠে? এ্যালায়, চুরি করিব্যান্নাগে যে!

আমরা বলি, বদরগঞ্জ কোথায়?

তারা আমাদের ভূগোলজ্ঞানে মুগ্ধ হাসে আর
বলে যে, সিড্যা তো হামাগেরে ওম্পুর বাহে!
এই কথায় আমরা লজ্জিত হই, বলি, দ্যাশের মানুষ;

তারা আমাদের ড্রয়িংরুমে বসে পড়ে, হাসে, আর
সেই হাসিতে আন্তরিক কুটুম্বভাব ঝরে পড়লে
আমাদের ড্রয়িংরুমটা বড় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে; দেখে
আমার বউ খুবই সংকোচ করে, বলে যে,
গরু তো নাই— চা করি?

তাদের সর্দারকে আমার এতটাই চেনা ঠেকে যে, মনে হয়,
অন-এয়ারে তাকে আমরা বহুবার দেখে থাকবো, বলে—
চা কী দরকার? এ্যালায় গোয়াল ঘরখান ঘুরি দেখান!

চুরির স্বার্থে অতিক্তি গরু কেনা তো দূরে থাক, আমরা
দুধের জন্য একটা গাই কেনারও সমর্থ হই না—
এই কথা কী ভাবে যে বলি! তারা সংকোচ-সংকেত বোঝে,
বলে যে, নাই— এই তো! এ্যালায়
ফির কবে আসিম ঝটপট কন কেইনে বাহে!

আমার বউ বলে যে, সামর্থ্য নাই; তারা আবারও হাসে, বলে—
সাহস করিলেই সামর্থ্য আইসে! তখন আশ্চর্য যে,
সত্যি সত্যিই আমাদেরও সাহস হয়, বলি—
দুই বচ্ছর পরে আইসেন কেইনে!

তারা আমাদের সাহস দেখে এতটাই আনন্দিত হয় যে,
বোঝাই যায়, গরু চুরির কথা আর মনেই রাখে না; ফলে
এই প্রথম আমাদের সন্দেহ হয়, তারা গবাদিপালন উদ্ধুদ্ধকরণে
এনজিও কর্মী কিনা; হয়তো বিশ্বব্যাংকের ফাইন্যান্সে
গরু চুরির এমন অযুহাত করে!
আরেকটি গোপন কথা

পোষা বিড়ালে ঘরে রাতভর চাপা কান্না কেন?
তুমি— এর একটা তদন্ত করো তো!

পাথরই তো আমাদের প্রথম সম্পদ;
তার সম্ভাবনা জ্বেলে জ্বেলে
এত দূর হেঁটে এসেছিলে,
উড়ে উঠেছিলে মহাশূন্য; চাঁদে— রেখে
এসেছিলে তোমার পায়ের চিহ্ন, পাপ;
তাকে আজ ব্যর্থ ভাবা কেন?

এখনও অনেক কথা, স্বপ্নোদগম, হয়তো কোথাও
চাপা পড়ে আছে; পাথর সরিয়ে দেখ—
পাথরেই সম্ভাবনা, পাথরে বিনাশ;
সেই পাথরের এত আধুনিক ঘর,
মার্বেল-মোজাইক মেঝে; সে ঘরে ক্রন্দন কেন?
সংগোপন তদন্ত করো তো!
আমার সন্দেহ হচ্ছে, রূপসী-বিড়াল কেন কাঁদে?
কাঁদে? না-কি ক্রন্দনের শ্র“তিভ্রম হয়?
এমন ক্রন্দন!
কেঁপে উঠছে বহুতল শপিং-কমপ্লেক্স,
অ্যাপার্টমেন্টগুলি,
ঝনঝন শব্দে ফেটে চৌচির কাচের ফিটিংস ...
কান্না থেকে ভূমিকম্প হয়?

তুমি— এর একটা তদন্ত করো তো!




বিজয় দিবসেও যখন আমাকে লিখতে হচ্ছে শহীদদের জন্য শোকগাথা
........................................
এসো, শহীদ দিবসে আজ
লালরঙ মদ্য পার করি; আর
আমাদের স্মরণে আসুক
রক্তের কথা ...

মানুষের বিস্মৃতিকে ইতিহাস পরোয়া করে না;
একদিন ঠিক ঠিক এই কথা রাষ্ট্র হয়ে যাবে—
আমাদের নদীগুলি প্রবাহিত রক্তের যন্ত্রণা;
তবু আজ আশীর্বাদ করি—

রাজার সুখেই থাক, দীর্ঘায়ু হোক,
তাদের মৃত্যুর পর
তাদেরই সন্ততিগণ
রাজ্য ফিরে পাক;
আমরা সেই অভিষেক-উৎসবেও যাবো,
গিয়ে— রাতভর, নেচে-গেয়ে, মদ খেয়ে
ফিরে আসবো আন্ধকার গুহার ভেতরে;
কোনও আলো, বর্ণবিভা, কোনও উচ্ছ্বলতা
আমাদের ঈর্ষা জাগাবো না—

শুধু সেই উৎসবের পাদপদ্মে কাতর মিনতি: তারা যেন
আমাদের নির্ভেজাল পানপাত্রে আইনের মাছি না-পাঠান!

আজ কেন? প্রতিদিনই আমদের শহীদ দিবস!
এসো, প্রতিদিনই লালরঙ মদ্য পান করি; আর
আমাদের স্মরণে আসুক
রক্তের কথা ... এই রক্ত আমাদেরই স্বজনের; বন্ধুদের
রঙিন-উৎসবের আলোর মতো-লাল!

এত লাল! আমাকে উন্মাদ করে তোলে




ভ্রম
....
সাপিনীর পিছু পিছু ছুটে গেছ, একা—
অতখানি জঙ্গলের পথ,
শুধু স্তন দেখবে বলে!

তুমি হয়তো জানো না যে, সাপিনীরা
স্তন খুলে রাখে
নদীর বক্ররেখার কাছে
গুপ্তঘুমের মতো যেখানে খোঁড়লগুলি থাকে;

তারপর? খুলে বলো, শুনি,
কিছু দেখতে কি পেয়েছিলে? মুগ্ধরঙ,
বিচ্ছুরিত আলোর মতন?

অন্ধকার তালের আকৃতি খুব ঘনবস্তু দেখে
ভয় পেয়ে ফিরে এসেছিলে?
তুমি একা? নাকি
অত ঘোর-অরণ্যের পথ
সাপিনীই এগিয়ে দিয়েছে?
তার ফণা থেকে
অপরূপ আলো, অবিরাম
ঝরে পড়ছে জঙ্গলে, জমাট-অন্ধকারে ...

চলো, রেখার গোপনসূত্র খুলে খুলে
আরেকবার দেখে আসি
আলোকিত স্তন
সাপিনীর, জঙ্গলের; নদীর খোঁড়লে




শান্তির জন্য নীলিমা কর্মসূচি
...............
সন্ত্রাসমুগ্ধ দেশে— নেচে-গেয়ে, হেসে হেসে
যেতে হবে ভেসে
শংসালিপ্সু এই হাওয়া যেদিকে ওড়ায়;
আত্মতৃপ্ত পাগলা ঘোড়ায়
চেপে— মৃত্যুরও প্রস্তুতি থাকা চাই—
যখন তোমার পালা, বলে যেও— বাই!
সন্ধ্যার নিঃস্ব তারাটিকে;

দুর্বোধ্য আলোর মতো ঝলসে ওঠা কান্নার্ত রাত্রিকে
পিছু ফেলে, একা—
চলে যেও, যেতে যেতে হঠাৎ না-লেখা
কবিতাটি রেখে দিও—
আঁকতে চাওয়া ছবিটিও
সন্তানের অংক-খাতায়;
যাতে ফের না হাতায়
ময়নাতদন্ত শেষে তোমার টেবিল,
চিনিডাঙা বিল
ছাড়া— লোকটির ছিল না কিছুই
যেন এই ভেবে, পৈতৃক ভূঁই
থেকে ফিরে যায়, গোয়েন্দার দল—
আর শুধু একটা আঁচল
রেখে যেও, যাতে যন্ত্রণার জল
কেউ গোপনেই মুছে নিতে পারে;

মৃত্যুর মর্যাদাদগ্ধ রাত্রির সংসারে
সেভাবেই ভেসে যেও, এই হাওয়া যেভাবে ভাসায়—
ভাসান নিহিত ছিল, আমাদের কাক্সক্ষাতে— আশায়—

মুগ্ধতা-ঝলসানো রাতে অবাক অসুখে
বিস্মায়াহত, তবু— যেও হাসি মুখে




কার্নিভাল
......
কার্নিভাল থেকে
ফিরে, মনে হলো—
রূপসীমুখোশ-পরা মৃত্যুর সুন্দর
রূপ, রাতভর
নাচলো, নাচালো;

উৎসব হয়তো সম্ভব ...
অনেক জীবন থেকে উৎসব মুছে
ফেলে, এরকম
উৎসব এখনও সম্ভব;
মনে হলো, মৃত্যুই সুন্দর; রঙিন বাল্বের রাতে
বহুবর্ণ ঝলমলে-অন্ধকার আনন্দের মতো
মৃত্যু খুব নৃত্যময়, উপভোগ্য, গাঢ়-চমৎকার!
মৃত্যু কোনও উৎসবমুখর দেশ; আর
ঐতিহ্যের মতো
কারও কারও প্রিয়, অহংকার
কার্নিভাল— মৃত্যুর মর্যাদাবাহী বিজ্ঞাপন সভা ...

আবার সময় এলে, তুমি—
একবার কার্নিভালে যেয়ো;
নাকি গিয়েছিলে? গুপ্ত-নাচের রাতে
অদৃশ্য রাজার কার্নিভালে;
একমাত্র আমন্ত্রিত অতিথির বেশে—
গিয়েছিলে নাকি?


অনুসন্ধান প্রকল্প
...........
সেই বৃক্ষটির খোঁজে আমরা বাগানে গিয়েছিলাম;
মাটির নিচে, শেকড়ে যে তার প্রতিবিম্ব তৈরি করেছে।

প্রতিবিম্বের ধারণা আর প্রজাতির নাম ছাড়া অন্য কিছুই
জানা ছিল না আমাদের; কাজেই যেতে হলো বাগানে।

মাটির নিচে অই প্রতিবিম্ব দেখতে পাবার জন্য কোনও
বীক্ষণই ছিল না আমাদের সাথে; আর এখন— এই ঝমঝম
বৃষ্টির মধ্যে দ্যাখো আপেলগুলিকে, ফোঁটা ফোঁটা জল
কী ভাবে চুঁইয়ে পড়ছে— যেন ভিজবারই নয় তারা!

বৃক্ষটি শনাক্ত না করেই আমরা ফিরে এলাম; আর
মনে হচ্ছিল, বৃষ্টি-আক্রান্ত এই আহ্লাদি বিকেলে
যে-গাছে একটি আপেলও ভেজেনি; হতে পারে,
সেটাই আমাদের উদ্দিষ্ট ছিল।

এ রকম অনুসন্ধান দুপুরেই ভালো, তবু জেনেশুনেই
কেন যে আমরা বিকেলে গেলাম! সেই রহস্য
অনুদ্ঘাটিত বৃক্ষটির চেয়েও আজ বড় বেশি ঘনীভূত হলো;

কিন্তু প্রেসনোট বলছে ভিন্নকথা— প্রকল্পের ব্যর্থতা বিষয়ে
সরকারি ধারণা হলো: আমরা যে-স্পটে গিয়েছিলাম,
সেটা আদৌ কোনও আপেল বাগান নয়; এমনকী,

বাগান তো দূরে থাক, কোনও বৃক্ষই ছিল না সেখানে



তোমাকে বলছি
..........
তোমাকে বলছি, যে-তুমি আমার
রক্তে রচিত ফুল
তোমাকে বলছি, যে-তুমি আমার
স্বেচ্ছাকৃত ভুল

মাঠ পেরোলেই দিগন্তে অই
আকাশ-ছোঁয়া নদী
আমন্ত্রণের হাতছানি তার
পাচ্ছি জন্মাবধি

যে-তুমি আমর সর্বনাশের
ষড়ঋতু, বারোমাস
যে-তুমি আমার প্রিয় তমসায়
সকরুণ উপহাস
প্রতিহিংসার অগ্নি জ্বালিয়ে
করতল করো ক্ষত

যে-তুমি আমার প্রসূনে প্রসূনে
গুপ্ত কীটের মতো
সাবধানে ফেল পা—

যে-তুমি আমার সন্তানখেকো
আর্থ্রোপোডা মা
তোমাকে বলছি না

তোমাকে বলছি, যে-তুমি আমার
ক্ষরণে ক্ষরণে নদী
তোমাকে বলছি, যে-তুমি আমার
অধিকার হতে যদি!
যে-তুমি আমার কাবেরী, গঙ্গা,
কপোতাক্ষের মতো
সীমাহীন বেগে ছুটে চল, তবু—
সহসাই সংযত

তোমাকে বলছি, তোমাকে বলছি,
তোমাকে বলছি, আজও—
যে-তুমি আমার সত্তায় বসে
এস্রাজ হয়ে বাজো ...

বলতে বলতে ভুলেও যাচ্ছি
বলছি তো কিছু ভুলও
শরীরে মাখছি পুষ্পরেণু

শরীরে মাখছি ধুলো

তোমাকে বলছি নীরধ্বনি
ভাষাহীন এক সুর
তোমাকে বলছি নেত্রক্ষেপে
অগম্য সুদূর

যে-তুমি আমার শিশিরশয্যা
তোমাকে বলছি না—
পদ্মফুলের ছদ্মবেশে
আগুন রঙের ঘা—
তোমাকে বলছি না

তোমাকে বলছি, যে-তুমি আমার
অপ্রেমের অজুহাত
যে-তুমি আমার ছোট ছোট ঢেউ
শিল্পিত সংঘাত

যে-তুমি আমার শাখে জল ঢালো
মূলে ছেড়ে দাও পোকা
যে-তুমি আমার হিসাব-নিকাশে
শুভঙ্করের ধোঁকা

তোমাকে বলছি বন্ধু, বন্ধু—
তোমাকে বলছি ভাই
যে-তুমি পুরো কুরুক্ষেত্রের
গদাধর একলাই
তোমাকে বলছি স্বরকল্পন
সোচ্চার নীরবতা
তোমাকে বলছি কখনও বলাই
হতো না যে-সব কথা
তোমাকে বলছি, যে-তুমি আমার
চিত্ত-দোলানো চাঁদ
তোমাকে বলছি, যে-তুমি আমার
সচেতন অপরাধ ...

তুমি যদি হও পুষ্পরেণু— তুমিই যদি-বা ধুলো—
তোমাকে বলছি উড়োমেঘ আর পাখিদের মতো তুলো

তোমাকে বলছি, যে-তুমি আমার
ঠিকানা, বিড়ম্বনা;
তোমাকে বলছি, তোমাকে বলছি
তোমাকে তো বলছি না!

যে-তুমি আছো মেঘের আড়ালে
রেবাটির ওই পাড়ে
যে-তুমি আছো শঙ্খের প্রাণে
সমুদ্র-শীৎকারে

তোমাকে বলছি গোপন বিলাপ
প্রকাশ্য যন্ত্রণা—
তোমাকে বলছি মৃত-স্বপ্নের
প্ররোচিত প্র-রচনা ...














প্রতীক্ষা : বৃষ্টির মতো

কবিতার মতো মিষ্টি হৃদয়ের মানুষ মুুকুল বিশ্বাস। নিজেও কবি। ওরা সাথে দেখা হয়েছিল, কোলকাতায়, রাজা রামমোহন হলে। বাংলাদেশে ফিরে ওর চমৎকার, আন্তরিক, কাব্যমাখা পত্রটি আমাকে মুগ্ধ-বিস্মিত করেছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, এক বিপর্যয়ের দিনে ঠিকানা-টেলিফোন নম্বরসহ ওর পত্রটি হারিয়ে আমি বিব্রত। সকল বিপর্যয় থেকে মানুষই তো ফেরে, জেগে-বেঁচে উঠতে চায় ... বর্তমান কবিতাটি, এক বৃষ্টির রাতে, ওকেই বহুরৈখিকভাবে স্মরণ করতে চেয়েছে ...

আমিও তোমার জন্যে প্রতীক্ষার একটি বিকেল আজ বৃষ্টিতে ভিজেছি
রবীন্দ্রসদনে; তোমার জন্যেই তবু শাহবাগে কেউ কেউ রৌদ্রে ঘেমেছে ...
প্যারিসে— উত্তর তীরে— কফি হাউসেও তুমি নেই; ফলে বিষণœ বৃষ্টিতে
কেউ কেউ হেঁটে গেল সীমনের কবরের দিকে ...

বাইরে ব্যাপক দিন ডেকে ডেকে ফিরে যাচ্ছে প্রান্তরের কাছে
বাইরে বিপুল জ্যোৎস্না একা একা ভেসে যাচ্ছে সমুদ্রের জলে

শুরুতেই যা যা ভেবেছি, আমরা তো তাই তাই ভেবে আর না ভেবেও
উঠে গেছি পর্বতের সুউচ্চ শিখরে, যেখানে মেঘের চুল শাদা শাদা,
যেখানে মেঘের মুখ কুয়াশার ছদ্ম নেকাবে ঢাকা, বিভ্রমের কুহক ছড়ানো ...
এ রকম পর্বতের নাম হোক বেথেল পাহাড়; যেখানে কুয়াশাভ্রমে
অনায়াসে মেঘ ছোঁয়া যায় ... তুমি কি মেঘের মতো দ্রুতগামী?
পলায়নপর? তুমি কি প্যারিসে, রোমে, শাহবাগে, কোলকাতার ট্রামে?

অথচ তোমার জন্যে প্রত্যাশার একটি কবিতাকাল থমকে আছে
ধর্মতলায়; তোমার জন্যেই শুধু অনবদ্য বেঁচে আছে এতিম-কবিতা
সিলভিয়া প্লাথের, ফলে এই ধর্মশাসিত দেশে কাকে আজ
ভগ্নি বলে ডাকি? আমার ভগ্নিটি সেই আশ্চর্য কবিতা, কোনদিনও
যে কবিতা লেখাই হবে না, যে কবিতা শব্দে-ছন্দে বাঁধাই পড়ে না, শুধু
অতৃপ্তির কাঁটা হয়ে চিরকাল বিঁধে থাকে শুদ্ধতম কবিদের বুকে ...

তবুও তোমার জন্যে স্বপ্নের সারাটা দুপুর আজও কেটে গেছে
ঠাকুর বাড়িতে; দক্ষিণের ত্যাজ্য বারান্দায়; দোয়েলের ঠোঁট থেকে
টুপটাপ খসে পড়া হিরন্ময় সংগীতের মতো ঝমঝম বৃষ্টি ঝরেছে
বিরাটী ও আশোক নগরে, বনগাঁয়ে ... দু’পাড়ের কাস্টমস অফিসে।
পাসপোর্ট নেই, তবু বৃষ্টি দ্যাখো কী রকম অনায়াসে দুই দেশে নাচে!

ওহো অরণ্যের মেয়ে, দ্যাখো, প্যাপিরাসে লেখা হচ্ছে সংগুপ্ত বাসনা,
তোমার চোখের মদে লিপিবদ্ধ সমুদ্রের মতো মোহময়!

যেমন পাহাড়পাখিরা ফিরে আসে সমতলে, শস্যের মায়ায়—
তুমিও কি ফিরবে না কোনদিনও, অরণ্যের সবুজ সবুজ গানে?
অগ্ন্যিভ চৈত্রের দিনে তুমি আর নাচবে না? গভীর সবুজ মেঘে
বৃষ্টি হবে না? আমাদের মরুময় হৃদয়ের দেশে একবার খঞ্জনার
নাচ হওয়া ভালো ... তুমি আর নাচবে না, শ্বাসাঘাত ছন্দের মতো?

কবির স্বপ্নের মধ্যে আসন্ন কবিতা হয়ে, গান হয়ে, শব্দের ঘ্রাণ হয়ে
উত্তপ্ত দুধের মতো তুমি আর বল্কে উঠবে না?

























দয়া

রাস্তাটা এখানে দ্বিখণ্ডিত;

আর পড়ে আছে— যুবকের লাশ—
তিনখণ্ডে একা; ধু-ধু

যে কোনও পথিক এখানে এসেই, দ্রুত
মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অন্যদিকে এবং
ছুটে যাচ্ছে শাঁই শাঁই ...

খুনিরা, বলতে গেলে, বড়ই দয়ালু—
হত্যাকালে ভাগ্যিস ওর চোখ দুটো
উপড়ে ফেলেছিল— না হলে,

পথচারীদের এমন উদাসীনতা দেখে—
কী কষ্টটাই না পেতো—
বেচারা যুবক!
















নৈঃশব্দ্য

সমুদ্র গর্জনের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আমি বহু বহু
দূর-স্বজনদের আর্তনাদ শুনলাম; তবে কী গাঙচিলেরাই
এতকাল ঠোঁটে ঠোঁটে বহন করে এসেছে মানুষের যন্ত্রণা
ও তার পরাজিত উত্তরাধিকার!

বালুতে আছড়ে-পড়া অগণন ঢেউয়ের স্ফূর্তি আর মডেলকন্যাদের
প্রিয় সাবানের ফেনার মতো বুদ্বুদ দেখেই একদিন জেনে ফেলেছি,
পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও রয়েছে বিপুল পর্বতমালা; পাহাড়
কাটতে কাটতে তুমি যতই সমতল বানাও— পালাতে চাও— সমুদ্র
ঠিকঠাক ধেয়ে আসছে তোমার দিকেই; আমি, সমুদ্রবর্তী এবং আবারও
নিমগ্ন হচ্ছি বিশ্র“ত সেই গানে— নির্বাধ ঢেউয়ের বিপুল
বিস্তারে যার সুরের সঞ্চালন; আর বাণী— এতই নিরুচ্চার যে,
মৌনতা— তার পক্ষে কোনও যোগ্য অভিধাই হতে পারে না;

আমি ফিরে যাচ্ছি আবারও সেই অভিধানে, যার বর্ণগুলি
স্বর ও ব্যঞ্জনে বিভক্ত নয়— শব্দগুলি নীল, সবুজ, পিঙ্গল,
কালো, লাল এবং আরও সব বিচিত্র রঙের; রঙই তো শব্দ!
আর বিশালাকৃতি বিষণœ অই গাছগুলিও কী সংগীতপ্রতিভা নয়?

অচেনা ক্ষুদে-পোকাদের অবিরাম অর্কেস্ট্রায় কী মহান সেই
বৃক্ষসংগীত; নৈঃশব্দ্য— কিন্তু সুর তার ভেসে যাচ্ছে দিকচক্রবালে—












বখতিয়ারের ঘোড়ার খুরের শব্দে

দীর্ঘ ঘুমের পর— ঘোড়ার খুরের শব্দে কেঁপে উঠছে
চল্লিশেই পরাজিত পুরনো কবর; কেঁপে উঠছে ঘুমন্ত শিশুরা

সকাল, দুপুর, রাত্রিকালে— ভেঙে যাচ্ছে পাখিদের
নিভৃত সংসার ... ঘুঘুদের, বুলবুলির, ডাহুকের গ্রামে
লেপ্টে যাচ্ছে খাঁখাঁ শূন্যতার মোম— ঘোড়ার খুরের শব্দে স্বপ্নবনে
অজন্মার গ্রাস; শব্দশাসিত ঢেউয়ে, রেশন-বাতাসে, এহেন শরতে—
শাপলা-ফোটার দিন নিখোঁজ সংবাদে সমাহিত; অথচ
আশ্চর্য কথা! দাপানো ঘোটকদৃশ্য শিশুদের প্রিয় অভিলাষ—
তারা অই বহুবর্ণ ঘোড়ার কেশর ছুঁয়ে বড় হতে চায়;
একদিন নিজেরাও বর্ণিল ঘোড়া হতে চায়— ফুটন্ত যৌবনে—

ঘোড়া এলো— পঞ্চম বারের মতো; আস্তাবল ফেলে—
এত ঘোড়া কোথা থেকে আসে? ঘোড়ার খুরের শব্দে
মৃতদের নিদ্রাভঙ্গ হলে— অনিচ্ছায়, আড়মোড়া ভেঙে—
চল্লিশের পুরনো কবর ভাবে— এই কথা; পাখিরাও ভাবে—

রাজাদের এত এত ঘোড়া? নাকি, অই ঘোড়ারাই রাজা?














প্রতিবিম্বেপ্সা

মৃত রূপসীর দেহে মুগ্ধ কাকাতুয়া

বসে আছে লাল ঠোঁটে; পালক কম্পিত, খাড়া—
অসামান্য উত্তেজনা নিয়ে এই দুলেওঠা অন্ধকাকাতুয়া
কী বাণী ছড়াতে চায় অবশিষ্ট জঙ্গলের কানে?

রূপসীর ঠোঁট মৃত, স্তন গলে কর্দমাক্ত টিলা;
চোখ জোড়া অরণ্যের স্থির সরোবর ...
বুকের প্রাচীন মঠ নিঃসঙ্গ প্রান্তর;

কাকাতুয়া জানে?

কাকাতুয়া অন্ধ; তবু
আয়নার ব্যবহার জানে?


















উপনিষদ
আমি যাকে গুরুত্ব দিই সে-ই আমার গুরু

হোয়াইট-বোর্ডের গায়ে খড়িমাটি টেনে
আঁকছি; অসম্ভব বর্ণবিন্যাস—
পড়ছেন গুরুদেব— মানে, রাজহাঁস;

যখন অসহ্য মানি, নিতে হয় গুরুর শরণ—
তরলে তরল ঢেলে পৃথকীকরণ
যে আমাকে শিক্ষা দিতে পারে;
আমি সেই গুরুর দুয়ারে
বর্ণবিভাজনসূত্রে যাই—
আর দেখি, গোটা দুনিয়াই
শাদায় শাদায় মাখামাখি;
হোয়াইট-বোর্ডের গায়ে খড়িমাটি আঁকি।

তারপর রেখা টানি— আঁকি শূন্য মুখ;
আমার গুরুও আজ কী সূত্রে উৎসুক
হয়ে বসে থাকে স্রোতের কিনারে!
আর বলে— ভেদবুদ্ধি তোমার হলো না—
পদার্থে পদার্থে শেখো স্বতন্ত্র ছলনা ...













অনুতাপ

ভালোবাসি দীর্ঘাঙ্গীকে; আভিজাত্যময়— কোনও এক সম্রাজ্ঞীর মতো তার
দাঁড়াবার শালীন ভঙ্গিমা, ডৌল মুখশ্রী; আমি কোনও সম্রাজ্ঞীকে
এতটা নিকট— মানে, স্পর্শের দূরত্ব থেকে কখনও দেখিনি; তবু
মনে হলো, সম্রাজ্ঞীরা এ রকম— দেহসিন্ধু মুক্তাদানার মতো
বৃষ্টিকণায় সুসজ্জিত আর দেহসন্ধি— ছায়ার বিজন রূপকথা; আমি
সেই নির্জনতা ছুঁয়ে দিতে কতবার ব্যাকুল হয়েছি! জাদুমুহূর্তের প্রিয়
সম্রাজ্ঞী আমার, ক্ষমা কোরো কম্পমান আঙুলের অনভিজ্ঞ ভীতি—
আমি কোনও সম্রাজ্ঞীকে এতটা উন্মুক্ত করে কখনও ভাবিনি;
তার দেহে বুঝি মাতৃগন্ধ থাকে? গলায় মাদুলি আর নাভির সামান্য
নিচে বিছা? নাকে তার নাকছাবি থাকে? থামের মতন দুই ঊরুর আড়ালে
অসম্ভব ক্রন্দনের ইচ্ছা চেপে— কতবার এইসব প্রশ্ন করেছি
মনে মনে! তুমুল বৃষ্টিতে তবু বারান্দায় সম্রাজ্ঞী অটল— আভিজাত্যময়
তার দৃপ্ত ভঙ্গিমা; ডাহুক পাখির ফুল্ল নৃত্যমগ্ন পায়ে
আমার সফল ঋতু শ্রাবণে পৌঁছেছে— এত ফর্সা, এতই
রূপসী সেই সুঠাম সুন্দর! তাকেই প্রসঙ্গ করে— দ্যাখো আমি
নাটাবনে কাঁটার ঈর্ষায় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছি;

সম্রাজ্ঞীকে ভালোবাসি; মাতৃগন্ধময়— কোনও এক যুবতীর মতো
তার গ্রহণের আকণ্ঠ-ভঙ্গিমা, আর তার সনৃত্য শরীর—
আমাকে শৈশবে ডেকে, একা একা ফেলে গেল— কঙ্কালাকীর্ণ
এক ভয়ানক মাঠের কিনারে ... কখনও সম্বিত ফিরে

আবার মন্দিরে গেলে, আমি কিন্তু প্রসাদ ছোঁব না!










গোত্রভূমিকাহীন

ধুলা উড়ছে— সবুজ-সবুজ— আর, দ্যাখো অই মানুষগুলোকে,
তারা সব শ্যাওলারঙ; যেন অযুত বছর পর এইমাত্র উঠে এলো
সমুদ্রের নির্বাসিত তলদেশ থেকে; যে রকম এই ভূমিদেশ, একবার
সত্যি সত্যি উঠে এসেছিল— সমুদ্রের হৃৎপিণ্ড থেকে, অকস্মাৎ—
আর ধুলায় ধুলায় তারা কী প্রকার সবুজ জারিত! তবু কী আশ্চর্য বিষয়—
তাদের পিঠে পিঠে নীলচিহ্ন; যেন সবুজের নীলশিটে মেখে আছে

নীলশিটে চিত্রিত মানুষ— এরও কোনও ইতিহাস আছে— নিশ্চয় আছে—
কোনও এক নিষ্ঠুর কাহিনী কিংবা কোনও দূরস্মৃতি, হতে পারে
পূর্বপুরুষের; শিশুরাও জন্ম নিচ্ছে অপত্য সবুজ জন্মদাগে
আর হামাগুঁড়ি দিচ্ছে সবুজ-জড়িত এক ভয়ানক কাদার উঠানে—
রোদে-জলে তৈরি হচ্ছে শ্যাওলারঙ জমাট সবুজ ...
কিন্তু নীলশিটে প্রত্যেকের পিঠে পিঠে;

সবুজ বাতাসে উড়ছে ধুলা—
সবুজ সবুজ ধুলা— আর, দ্যাখো সেই মানুষগুলোকে, তারা সব
আলকাতরা-বুড়ো হচ্ছে, বুড়ি হচ্ছে ... দুপুরের সন্নিহিত রোদে;

এরও কোনও নিশ্চিত কারণ রয়েছে— বলতে বলতেই সূর্য কিন্তু
ডুবে যাচ্ছে বিলের সবুজ ঢেউয়ে; পত্রহীন, অবসন্ন গাছের আড়ালে












সেই গল্প

তা হলে পড়ে থাক সেই গল্প— বৃটিশসূচিত পাথর আর
ইস্পাতের প্রতিবেশী অন্ধকারে; দ্রবীভূত গ্লুকোজ পাউডার
যেমন অদৃশ্য হয়ে যায় চা-চামচের ঘূর্ণায়মান নাড়ানির
অভ্যস্ত মুহূর্তে; সেই গল্প— যা নির্দেশিত দৃশ্যের প্রয়োজনে
চিত্রায়িত কোনও তরুণীর ত্রিশ সেকেন্ড স্থায়ী
হাসির জন্য নির্মিত নয়, নির্মিত নয় এমনকী তার
অবসাদগ্রস্ত বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা ও স্মৃতিরোমন্থনে
উদ্ভাসিত যন্ত্রণারাজির পাশে স্বর্ণপ্রভা সান্ত্বনার কোনও
অনাবিষ্কৃত সাফল্যের জন্যও; যারা উড়ে যাচ্ছিল বিস্তারিত
মাঠ ও বহুকাল আগে নারীর নিতম্বে বিছার মতো ছড়ানো
নদীগুলিকে পেছনে রেখে উদয়ের খুব কাছাকাছি— এ গল্প তাদের।

থাক সেই কথা; তারা গন্তব্যে পৌঁছার আগেই মাধুকর
তার দিনমান সংগৃহীত এক পোটলা অন্ধকার মেলে ধরে
রচনা করেছিল কিনা সেই প্রহর, যাকে আমরা রাত্রি
জেনে, কত যুগ বিশ্রামে গিয়েছি! সেকথা এমন কিছু
ধর্তব্য হতেই পারে না; কেননা, কে না জানে যে, মানুষেরা
আমৃত্যু মনে রাখে আর পরস্পর বলাবলি করে
সেই অভিযাত্রার কথা যা কোনদিনও গন্তব্যে পৌঁছেনি।

সাফল্য ও প্রাপ্তির সব গল্পই তো ততক্ষণই বেঁচে থাকে— যতক্ষণ
না তার জন্য সম্মিলিত হাততালির আওয়াজ বাতাসে মিলিয়ে যায়











চা-খানার গণতন্ত্র

আমাদেক আগে পজিশনে আসতে হবে—

তারা এই কথা বলে, আর
মুষ্টিবদ্ধ বামহাত শূন্যে তুলে, ফ্লাট
ডানহাত সঞ্চালনের এমন একটা ভঙ্গি করে, যেন
কচুকাটা ব্যাপারটা মর্মার্থসহ দৃশ্যায়িত হয়— এবং

সেই সাথে পূর্বকথার রেশ ধরে আরও বলে যে, তারপর
একটা একটা করে দেখে নেবো সব শালাদেক;

এ টুকুতেই আমরা বুঝে ফেলি, তারা
অপজিশনে আছেন— পজিশন ছাড়া দেখে নেওয়াটা
মুস্কিলই বটে! আমরা ‘দেখা’ শব্দটির অন্য আরেক মানে
খুঁজে পাই— সেটা বেশ কবিতা কবিতা লাগে;
অর্থাৎ বক্রোক্তি; খুবই ইঙ্গিতে ইঙ্গিতে ভাব ...

এই দেখে নেওয়াটা দেখবো বলে আমরাও
তক্কে তক্কে অপেক্ষা করি, কখন শুরু হয়
পালাবদলের খেলা— অমুক ভাইকে ভোট দিন—

তারপর একদিন অন্য কয়েকজন আসেন, জেলা শহরের
এই ভাঙা চা-খানায়, তারাও বলেন,
আমাদেক আগে পজিশনে আসতে হবে ...
আমরাও এই শালাদেক খুব ভালো করে দেখে নিই; কিন্তু
অনেক লক্ষ্য করেও কিছুতেই আলাদা করতে পারি না—
হুবহু একই চেহারা, একই ভাবসাব, একটাই গান
দেখে নেবো, দেখে নেবো ...
একই পুরনো রেকর্ড বেজে যাচ্ছে দেদারসে,
কখনও থামছে না; থামবে কেন? চা-খানা বলেই কী
তার কোনও গণতন্ত্র থাকবে না!





প্রেসনোট

এইরূপ উন্মাদনা ও রাজনৈতিক বিকেল চিরে
ছিপছিপে মেয়েটি সেদিন কোথাও যাচ্ছিল না;
বিশ্বাস করুন, সত্যি যাচ্ছিল না— এবং
তার হাঁটায় কোনও ভঙ্গিমাও ছিল না।

আর অই যে, বিশ্র“তপ্রায় লো-প্রোফাইল কবি
হাদিউলের মতো নিঃশব্দে বয়ে চলা নদীটা—
ওর নাম বংশী নয়; আসলে
ওখানে কোনও নদীই ছিল না; নদী
কোনদিনও থাকে না কোথাও; কল্পনা
এমন খালকাটা কুমির যে, আমরাই
চিরদিন যে-যার ইচ্ছেমতো বানিয়ে নিচ্ছি
নানারূপ নদী; আর শুনুন,

সন্ধ্যার পরপরই অই কাঁঠাল বাগান ও তার
গা-ছমছম অন্ধকারে সেদিন কোনও ঘটনাই ছিল না;
কেননা, কে বলে যে, সেটা হয় জঙ্গলপথ?
এইমতো না-বোধক দিনে, আমি তো বলছি—
কিছুই ছিল না; এমনকী, কোনও ঘটনাও নয়;
তা হলে? আপনারা কেন বলছেন যে, অইরকম
না-নদীর পাড়ে, না-জঙ্গল না-সন্ধ্যায়—
ছিপছিপে না-মেয়েটি, নিহত হবার আগে ধর্ষিতা হয়েছিল?











বিবাহ-ব্যাপার

তহবন্দ্ পরেছি রঙিন—
পাঞ্জাবির আয়োজন করো!
নদীতে সাজাও ভেলা-দিন
ভেলাতেই বিবাহ আসরও;

কারুসাজে রেখো নাগ-মনসার ফণা;
শঙ্খিনী না-পেলে কিন্তু বাসরে যাবো না!
বনগ্রাম রোডে শাড়ি উঠেছে রিকশায়
আমার বাসর কেন জলে ভেসে যায়?
আমি তো জলেই মগ্ন-বসবাস
করি! ঈর্ষান্বিত কে-তুমি বেহুলা?
পাঞ্জাবির কী হলো রে খাটাশ-খান্নাস,
খ্যাট্খ্যাট হাসে ক্যান বাইঞ্চোতগুলা?

তহবন্দ্ পরেছি রঙিন—
নদীপাত্রী আয়োজন করো!
নতুন নদীর যদি আজ জন্মদিন,
হতে চাই সে-নদীর বরও।















পাথরপ্রেমিক

মহিমান্বিত এক পাথরের গল্পে আমাদের বেলা কেটে গেল;

একটা পাথরচুম্বনের ইচ্ছায় আমরা বেড়ে উঠছি— এশিয়ায়—
শিখছি দূর মরুভাষা; ভাবো তো, কী প্রকার পাথরপ্রেমিক!

ছায়া-টইটম্বুর দিঘিজল, সাধুবৃক্ষ আর পাখিদের গ্রাম পিছু ফেলে
সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে— আমরা সেখানে যাবো—

এই গল্পে কেটে যাচ্ছে— আমাদের রোমাঞ্চিত সুরেলা শৈশব,
ঈদের ফিনফিনে শাদা পাঞ্জাবির মতো সভাঁজ-মার্জিত আমাদের
সাধিত যৌবন; মহিমান্বিত সেই পাথরের প্রেমে— অস্থির, ব্যাকুল!

আর দ্যাখো, চ্যানেল ঘুরাতেই— ন্যাশনাল জিওগ্রাফি—
দেখা যাচ্ছে— একটা কালোপাথর; সারিবদ্ধ আশেকান— তাকেই
চুমু খেতে খেতে ব্ল্যাকহোল বানিয়ে দিচ্ছে ... আর
ভিড় করে ঘুরছে তার চারপাশে;

ভাবো তো, কী প্রকার উপলগ্রাসী প্রেম!















গাঢ়, ব্যক্তিগত

রূপসীর নির্ধারিত বয়স থাকে না; শুধু তার ত্বকের লাবণ্য ফুঁড়ে
ছুটে আসে হীরকদ্যুতির বিচ্ছুরণ— আমাদের ব্যক্তিগত চোখে; আর থাকে
অসম্ভব নির্লিপ্ত ভঙ্গিমা তার চোখের জাদুতে— তাকে এক সহজাত
অহমিকা ভেবে, যন্ত্রণায়— নিরিবিলি বিষণœতা এসে— নষ্ট হলো অনেক
কবিতামগ্ন স্বপ্নপ্রহর; নষ্ট হলো কবিতার দিন। জীবিতের সাথে
বহু গল্প হলো মৃতদের নিয়ে— গামর ধানের ক্ষেতে কত কত
ব্যাঙডাকা ভোর— প্রাথমিক বিদ্যালয় পার হলে নিয়মিত আখবন,
তারপাশে সারি সারি অই তো কবর! কবরে কবরে জাগে ঘাস—

কবরে কবরে জাগে জীবনের স্মৃতি ... এইসব মিহিকথা, কোনদিনও
রূপসীর কানে কানে বলাই হলো না— শুধু তার ত্বকের লাবণ্য থেকে

ঠিকরে বাহিরে এলো বিদ্যুতের লোভবিচ্ছুরণ; আর আমাদের
শহরে স্থাপিত এই গ্রামময় চোখগুলি— হারালো সাবেক মসৃণতা—

রূপসীর বাস্তবিকই বয়স থাকে না; ফলে, বয়স ও গঠনশৈলীভেদ
নির্লিপ্ত মার্বেল চোখে হেঁটে গেল সারিবদ্ধ, কবরের পাশ দিয়ে
মুখরসন্ধ্যায়; জীবনের গল্প তাতে দীর্ঘ হলো, সমগ্রতা পেলো—

শুধু এক ব্যক্তিগত কবরের পাশে আজও শ্বেতকাঞ্চনের গাছ
ফুটে থাকা নৈঃশব্দ্যে— গাঢ় হলো অন্তর্গত অশ্র“র আওয়াজ—











বিদ্যালয়মুখী

পাহাড়িকা বিদ্যালয়ে যাই—
আর দেখি, আমরা খোদাই
হচ্ছি যে কালের পটে
টীকা-ভাষ্য-ব্যাখ্যা সংকটে
সেখানে যা কিছু ঘটে
তারও বেশি রটে ভিন্নকথা;

আমরা অযথা
বিদ্যালয়ে যাই, লিখি-পড়ি—
কিন্তু দ্যাখো, ক্ষণমাপা ঘড়ি
চিতশোয়া, জঙ্গলের পাশে;

অচেনা পাখির ঝাঁক আকাশে আকাশে
উড়ে উড়ে ঝরাচ্ছে পালক,
তবু যত বালিকা-বালক
মাঠের ভেতরে সংজ্ঞাহারা;
শুধু শুধু শিক্ষক-কর্তারা
ধারাপাত পড়ে সর্বস্বরে...

মেঘের তোশক-পাতা ঘরে
ভাঁজকরা সামান্য তালিকা,
পাহাড়িকা বিদ্যালয় থেকে
যত পথ ছোটে এঁকেবেঁকে
সেইসব পথে পথে আঁকা
ছোট-বড় বালক, বালিকা...

পাহাড়িকা বিদ্যালয়ে যাই—
যেতে যেতে পথেই হারাই।







মায়ের কবিতা
২৫ ডিসেম্বর ২০০৬ ; একটিই কবিতা তার...

কবিতা লেখেনি একটিও তার মা—
অথচ এমন অবাক জ্যোৎস্না!
ছলকে দিলো স্তব্ধ-সবুজ গ্রাম;
আমরা তখন কোথায় কে ছিলাম!

মধ্যরাতে রূপার থালা মেলে
পাষাণ চোখে ঘর-পালানো ছেলে
ভাবলো, এমন মিষ্টি করুণ গাঁ-টি!
মা কী তখন মাটির বুকে মাটি!

ভাবলো, দূরের পদ্মদিঘি-জলে
কোন ধারণায় জ্যোৎস্নাফসল ফলে?
শান্ত কেন জল-জ্যোৎস্নার ঢেউ?
সেও জানেনি; কেউ জানেনি, কেউ—

মাতবে পাড়া নতুনে, উৎসবে;
শাহীবাজার গমগমাবে ভিড়ে—
জ্যোৎস্নাভেজা বিষণœ রাত্তিরে
কাব্যময়ীর কবিতা পাঠ হবে?

কবিতা লেখেনি একটিও তার মা—
অথচ এমন শব্দদ্যোতনা!
কোপ মারলেই মাটির প্রাণে বাজে;
পঙ্ক্তি কি তার মাটির ভাঁজে ভাঁজে?







বাবার জন্য গান

একটি বিস্মৃত সুর স্মরণের লোভে
রচনা করেছি কত অন্তরাল গান!
অনেক আনন্দে, সুখে, কান্নায়-সংক্ষোভে
বাঁধাই করেছি শব্দ, ধ্বনির মাচান;

একটি প্রাচীন গল্পে সন্তপ্ত বাবার
দু’চোখ নদীর মতো আর্দ্রতম ছবি,
সে-গল্প গড়তে যেয়ে আমিও আবার
রক্তনদীতে যদি হতে চাই কবি—

এই প্রশ্নে বাবা ছিল বড় অসম্মত।
কেননা, গল্পটি তার, সুরটিও তারই;
যে-সুরে রাত্রির বুকে প্রতœ-আহাজারী—
নিটোল জলেরও ত্বকে দগদগে ক্ষত;

স্বপ্নশব্দে জুড়ে দিচ্ছি অসম্ভব সুর
শব্দের আত্মায় বাবা, স্বপ্ন বহুদূর ...















তোমার মুখের দিকে
তিরিশে সেপ্টেম্বর, ফিরে ফিরে আসে ...

তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছি যত সন্ধ্যার মৌন অন্ধকারে
জ্যোৎস্নার স্মিত ঘ্রাণে ভেসে গেছে শিহরিত ভুবন আমার—

নিখিল বাঙলার এই ধূলিগ্রস্ত পথে— কত মাঠ, নদী, বন,
পাহাড় ডিঙিয়ে— তবু সেই মুখখানি কল্পনায় আঁকি—
এই পৃথিবীতে যারা তোমার মতন মুখে আজও বেঁচে আছে—
তারা অত জ্যোৎস্নাময়ী নয়; তাই বুঝি ক্লান্তি নেমে আসে
আমার লোহিত চোখে— আমার ভুবনভরা নিবিড় কান্নায়—
আজও সেই সন্ধ্যাগুলি যূথবদ্ধ জোনাকির গান হয়ে বাজে
একটি স্ফটিক মুখ— একটি হীরকহাসি— এপ্রিলের মুগ্ধ সন্ধ্যাবেলা
জীবনের কত গল্প লিখে রেখে গেছে! অবশেষে
আমি তা জেনেছি— আমার মতই অই এপ্রিলের চাঁদও
সেপ্টেম্বরে এতিম হয়েছে; আজও তাই পূর্ণিমা ফ্যাকাশে—
ক্লান্ত, ম্লান। তবু এক রিনিঝিনি সান্ধ্যসংগীতে
আমি আর স্মৃতিজ চন্দ্রিমা— এক হয়ে হেঁটে গেছি,
হেঁটে যাবো— চন্দ্রহারা জ্যোৎস্নার অন্তহীন মাঠে—

তোমার বিভূতিমুখ, নক্ষত্রনেত্রের হাসি জ্বেলে জ্বেলে
তৃতীয় দুনিয়াব্যাপী; সার্বভৌম দুঃখ আর যন্ত্রণার দিকে দিকে
লবণাক্ত জীবনের প্লাবিত প্রান্তরে— হেঁটে হেঁটে ...
ক্লান্ত— ম্লান— বৃদ্ধ হয়ে যাবো—










দুধশাদা ঘোড়া

প্রত্যূষেই কার্য শুরু— কপাটে কপাল ঠুকে যাত্রা শুভ হলো!

চিরকাল ঝিঁঝিঁরাই উচ্চকিত ছিল, বিশেষ ঋতুতে ব্যাঙেরাও সংগীতমুখর;
আমি কোনও সন-ঋতু-মাসিকের পঞ্জিকা রাখি না— পঞ্জিকাই মানুষের
শ্রেষ্ঠতম ভুল; ঘরের দুয়ারে যদি দুধশাদা ঘোড়া—
চালন-দক্ষতা তুমি চটজলদি পরখ করো তো!
মিছেমিছি দিনক্ষণ, দিগি¦দিক, শুভাশুভ ভাবা; যদি চায়—
সে তোমাকে নিয়ে যাক সরাইখানায়; পেশাদার
জুয়ারির মতো তুমি ফেরেস্তাসমেত বসে জুয়া খেল! মদ খাও;
না হয় হারবে ক’টা দান— জুয়ায় হারলে কি হে রাজ্যপাট যায়?

কপর্দকশূন্য কবি; পানপাত্রে বড্ড সাবলীল— রাত্রি যদি
গাঢ় হয় নক্ষত্রের বিলাসী আড্ডায়— অপ্রতুল পানীয়ের
আসন্ন শঙ্কায় কেন সভাভঙ্গ করো? ভেবে দ্যাখো,

বল্গাহারা ঘোড়ার খুরের ছন্দে রাত্রি গেল অনিদ্রার পথে,
প্রত্যূষেই কার্য শুরু হলো; মনে রেখো, পাক্কা বাজিকর আমি,
তেমন ঘোড়ার জন্য আমার স্বপ্নকে ছাড়া সবকিছু বাজি ধরতে জানি;

আর আজ— জুয়ার বাজিতে হেরে, পানপাত্র ভেঙে, টলতে টলতে
হেঁটে যাচ্ছি সংকীর্ণ গলির সেই কাফন-মোড়ানো অন্ধকারে—
অথচ আশ্চর্য যে, তেমন ঘোড়ার জিন আমি কিন্তু বহুবার
স্বপ্নে নয়— বাস্তবে ছুঁয়েছি...










ঠাকুরঘর

প্রশ্ন তো ওঠেনি বেজে ঠাকুর ঘরে কে রে !
বজ্রধ্বনি সশস্ত্র গোঁফ শূন্যে উঠছে তেড়ে ;

কলাও নেই, ফলারও নেই, ছেলে ঘুর ঘুর করে ;

ঝড় ওঠেনি, বাতাসও নয় কেন্দ্রস্থলে নড়ে
কেন পাটের ক্ষেত ?

ভোলেনাথের কৃপায় কাঁপছে বাঁশবাগানে বেত !





















খেরোখাতার আসন্ন পৃষ্ঠাটি

বাউলিকাটা হাওয়ায় উড়ছে ধুলা
কুলায় উড়ছে ধান ও ধানের চিটা
ভিটায় উড়ছে ঘুঘুর নির্জনতা
জনতাও উড়ছে যে যার মতো ;

ক্ষতজুড়ে উড়ছে বিপুল মাছি ...


পৌঁছে গেলাম ঝড়ের কাছাকাছি !
























ভবঘুরে শিশু

ভবঘুরে শিশুটিকে দ্যাখো,
চোখে-মুখে-প্রাণে তার ফুটে আছে সরলমুগ্ধতা

অবাধ আকাশে এক স্বপ্নের সামিয়ানা স্বরচিত রেখে
তীব্র দুপুর হেঁটে ছায়ায় ছায়ায়, সে এখন
রৌদ্রে সটান ঝিমোচ্ছে গভীর।

ফুলের সুগন্ধী আর সংগুপ্ত কীটের পাখা ভালোবেসে
তীক্ষè কাঁটাকেও প্রিয় লক্ষব¯ত্ত ভেবে
নিজেকে নিয়েছে টেনে অসম্ভব নদীর কিনারে, আর
ভয়ঙ্কর বনকেন্দ্রে সূচনা করেছে কতো বিজনসুন্দর !

স্ফূর্ত-সুন্দর সেই ভবঘুরে শিশু
তুচ্ছকেও মহার্ঘে নিষিক্ত করে ছুটে যাচ্ছে
ভূ-প্রান্তবিস্তারী মাঠে ; গমনরেখায় তার বেজে ওঠে
অনিঃশেষ বর্ণবিভা, জীবনেরও চেয়ে দীর্ঘ সুর ...

বেজে বেজে আমাদের যৌবনের দোতারা বানায়

একদিন
সুরেলা বিকেল এসে সন্ধ্যার ঘাটে ভিড়ে গেলে
আচানক মনে হয় :

ভালোবাসা ভবঘুরে শিশু ;
মানুষের মনের অতলে তারও জন্ম-মৃত্যু আছে








ধৈর্য

এতোকাল আপনারাই বললেন

দ্যাখো মেনে নাও, মেনে নাও,
একটু মানিয়ে চলো !

মেনে নিতে নিতে
মানিয়ে চলতে চলতে

আমার দুচোখে এখন অগ্নুৎপাত
ভয়ানক দাবানলের দিন ;
তুঙ্গ-মুহূর্ত এসে ডেকে ডেকে ফিরে যাচ্ছে
মাঠান্তের দিকে ...

আমি বললাম
দেখুন, আ-র মেনে নেওয়া যা-য় না !

এবার আপনারাই বলুন,
আমাকেও কী আর মেনে নেওয়া সম্ভব
আপনাদের পক্ষে !














ত্রাণসুন্দরী

ব্রোঞ্জের যুদ্ধ জাহাজ এসে দাঁড়ালো বন্দরে ;

ফলাফলে উত্তাল সমুদ্র হলো আমাদের মন,
ঝড়ের স্বভাব সেই বৈদেশিক হাওয়া লেগে
দুলে-ওঠা নৌকার পালের মতো নেচে উঠলো ঢেউ
তরঙ্গের ফেনিল উচ্ছ্বাস আজ আমাদের প্রেমার্ত-হৃদয় ;

সমুদ্রেরও পঞ্জিকা রয়েছে
একাত্তরে বঙ্গোপসাগর আর দু’হাজার আট-এ
এরা কিন্তু এক নয় একইরূপ জল-ঢেউ-ঢেউয়ের বিস্তার
তবু নয় ; জলে-ঢেউয়ে অভিন্ন বিস্তার নয় এরা

গুপ্ত জাহাজ এসে দাঁড়ালো বন্দরে ;
এতো সশস্ত্র কোমল এতো কাব্যময়
আমরা এর ভক্তবৃন্দ, প্রেমিক হলাম আবেগ-অস্থির ;

আর দ্যাখো, দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছি ঝাঁক ঝাঁক মন
মিলিশিয়া গোলার আঘাতে ; নানাবর্ণ তেজ-এ
ক্ষেপণাস্ত্র গেঁথে যাচ্ছে রোমে, রোমকূপে ;

ভালোবাসা হৃদয়ের এতো সাংঘর্ষিক !











সামান্য কথা

“...নদীর গোপনে নদী কেঁদে ওঠে তৃষ্ণা-হাহাকারে
নদীর অন্তরে নদী কেঁপে ওঠে অকারণ-সৃষ্ট জলভারে
গ্রামের গহীনে গ্রাম প্রতিদিন চুরি হয়ে যায়
বৃক্ষের অন্দরে বৃক্ষ পরাজিত, অন্তরালে
নিহত, কাতরায় ...
তবু হায় !
মানুষের বুকের ভেতরে নাই মানুষের বাস। ”

ভয়ানক বদলে গেলে রঙের আকাশ
পৃথিবীর শেষ ডোডোপাখি এসে অদৃশ্য হবার ঠিক আগে
এইসব বলে গেল ইঁদুর-দৌড়ানো শাহবাগে,
কেন যে আমার কানে কানে !
বিনিদ্র বাতাস জানে,
উ™£ান্ত মেঘদল জানে ;

তার
ঠোঁট থেকে ঝরে-পড়া রক্তধারা ধরে আছি হাতে
সেই থেকে নির্ঘুম, বিবিধ শংকাতে
আর
ভয় সে তো বুকের গহনে এক বিহিত বাহিনী ;

বাংলার শেষতম শ্যামাঙ্গীও রাজার বজরায় !
এই যে সামান্য কথা গভীর কাহিনী
কার সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়া যায় ?









শর্ত

যদি চাও
স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিতে রাজি ;
মৃত্যুর উপায় তুমিই সরবরাহ দিও !

যদি চাকু হয়
মনে রেখো, চাকুর ধারালো দিক
আনন্দদায়ক হওয়া চাই ...



মৈত্রী ট্রেন

এশিয়ার জননেত্রীদের মতো এসে সম্ভ্রান্ত দাঁড়ালে,
জনাকীর্ণ প্ল্যাটফর্মে ; কাঁধ ঝাঁকিয়ে, হাত নেড়ে নেড়ে,
বেশ তো জানাচ্ছো বিদায় !
না-কি ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছো ট্রেন সেই নির্মম-বাহন
যা শুধু চিরকাল মানুষের বিরহ বাড়ায় !

এ রকম ট্রেন এসে কতোবার স্বজনের মুখগুলো নিয়ে গেছে
দৃশ্যের ওপারে ; অলীক-আলোর নামে
রাত্রির অন্ধকার-পর্দার গহনে আরও গাঢ়তর আঁধারের পেটে ;

কতোবার আমাদের দূরত্ব বাড়িয়ে দিলো ট্রেন ;
হুইসেল বাজিয়ে কতো হৃৎপিণ্ড থেঁৎলে দিতে দিতে
ছুটে গেল অদৃশ্যের দিকে !

এ রকম ট্রেনে সেও গিয়েছিলো আনন্দনগরে
আজও কতো অলীক দিগন্ত থেকে ট্রেন আসে,
অলীক দিগন্তে ফিরে যায় ...

সে তবু ফেরে না

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন