সোমবার, ২৪ আগস্ট, ২০০৯

বিনয় মজুমদার গণিত-প্রভাবিত দার্শনিক কবি


মানসিক অসুস্থতার কারণে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিনয় মজুমদার ‘এক পঙ্ক্তির কবিতা’ শিরোনামে ২০১ পঙ্ক্তির কবিতা রচনা করেন। বিনয়ের এ কবিতাগুলো এক ভিন্নতর দর্শনের দর্পণ। কল্পনার কোনো স্থান দেননি তিনি এ পঙ্ক্তিগুলোতে। কবিতার পঙ্ক্তি জুড়েই রয়েছে নিখুঁত বৈজ্ঞানিক ইতিকথা। শুধু কবিতা নয়, তিনি তার গদ্যসাহিত্যেও ধারণ করেছেন গণিত-প্রভাবিত দার্শনিকতা। তার মনোজগতে কবিতা ও বিশুদ্ধ গণিত একই ধারায় বহমান থেকেছে। ‘সাহিত্যের গতি গণিতে-বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে সাহিত্য নয়, গণিতকে বাদ দিয়েও সাহিত্য নয়’Ñ বিনয় মজুমদারের এ প্রমিতির ভাস্বর রূপ তার সাহিত্যের ক্যানভাস আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
বীরেন মুখার্জী

‘প্রতিভা’ এবং ‘মেধা’র সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা আমার জানা নেই। কোনো লেখক বা কবিকে ওই অভিধায় ভূষিত করা যায় কি নাÑ তা নিয়েও হয়তো অনেক বিতর্ক থাকতে পারে। তবে কোনো প্রতিভাবান বা মেধাবী কবি-লেখককে কোনো গ-িতে আটকে রাখা সম্ভব নয়। অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, চেষ্টা, ভালোলাগা, বিজ্ঞানমনোস্কতাÑ এসব চিরায়ত অনুষজ্ঞ একজন মানুষের মস্তিষ্কে সক্রিয় থাকে সবসময়। এসব ভাবাবেগ ওই কবি বা লেখককে যে কোনো দিকে নিয়ে যায়, তা বলা সহজসাধ্য নয় মোটেও। একজন সৃষ্টিশীল মানুষের অপার বোধ-বুদ্ধি, মনন-চেতনা, শিল্পের প্রতি অনুরাগ, দর্শন, সর্বোপরি সৃষ্টির প্রতি আন্তরিকতা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। দৃশ্যত এমনই এক অতিবাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবিতা নির্মাণ করেছেন কবি বিনয় মজুমদার। নানান শব্দ, ব্যঞ্জনা, উপমায় উপমিত করেছেন কবিতার ঘর-গৃহস্থালি। ‘নিজস্ব দিনপঞ্জী’ আকারে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আঙ্গিকে কবিতা নির্মাণ করে হয়ে উঠেছেন কবিতার প্রবাদপুরুষ। আগে ‘নক্ষত্রের আলো’ (১৯৫৮) ও ‘গায়ত্রীকে’ (১৯৬১), কবিতাগ্রন্থ দুটি প্রকাশিত হলেও তার প্রেমের কবিতা ‘ফিরে এসো, চাকা’ (১৯৬২) প্রকাশিত হওয়ার পর মূলত কবি হিসেবে আলোচনা-সমালোচনায় ভাস্বর হয়ে উঠতে থাকেন কবি বিনয় মজুমদার।
তিনি মানুষ হয়েও, এ সমাজে বসবাস করেও আত্মদহনের মন্ত্রে দীক্ষিত থেকেছেন সারাজীবন। জীবনকে প্রেমের কাছে সমর্পণ করে কবিতায় বসবাস করেছেন আমৃত্যু। পার্থিব জগতের আনন্দ-আয়োজন থেকে নিজেকে দূরে রেখে সযতেœ নিজ গৃহে নির্বাসিত দিন কাটিয়েছেন। একাকী নির্ভৃত বসবাসে মানব রসায়নের সঙ্গে গণিতের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন এবং তা অবলম্বন করে কবিতা বিনির্মাণ করেছেন আপন নিয়মে, স্বতন্ত্র ভঙ্গিমায়। তিনি জীবনের প্রতিটি প্রবহমান শব্দে, ভাষায় গণিতের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে কবিতাকে উদ্দীপিত করেন। ধীরে ধীরে ওই কবিতা পৌঁছে যায় পূর্ণ জীবনের তপস্যায়। তিনি তার ‘যৌবন’ কবিতায় ধারণ করেন ওইসব অভিজ্ঞতালব্ধ প্রাসঙ্গিকতাÑ
‘সহসা তাকিয়ে দেখি যৌবন নিকটে আছে আমার সমান লম্বা প্রায়।
আমি যৌবনের রূপে মুগ্ধ বহুকাল আগে থেকে।
যৌবনের চুলগুলি খুব ভালো, যৌবনের মুখখানি অত্যন্ত সুন্দরী।
আমি তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে এলাম আজকে।
অনেক যৌবন আছে পৃথিবীতে এই ভরসায় আমি এই যৌবনের
সহিত আলাপ করা এখনো সংগত নয় বলে মনে করি।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ছুঁয়ে বাংলা কবিতা বিশ্বজনীনতার স্বীকৃতি পেয়েছে। এরপর মাইকেল মধুসূদন দত্ত হয়ে বাংলা কবিতার অনেক বাঁক বদল হয়েছে। সূচিত হয়েছে আধুনিকতার নানান ধারা। ত্রিশের অন্যতম প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশের পর যে কয়জন কবি আধুনিক বাংলা কবিতাকে আরো সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের মধ্যে ‘আমাদের শিক্ষক’-খ্যাত কবি বিনয় মজুমদার অন্যতম। জীবনকে তিনি দেখেছেন নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে। পারিপার্শ্বিককে দেখেছেন সরল চোখে। যাপিত জীবনের সমীকরণ খুঁজেছেন গাণিতিক ফর্মে। কখনো যৌগিক আবার কখনো সরল অন্তঃকরণে। তিনি একাকী দীর্ঘবাস এবং দীর্ঘশ্বাসের নির্যাস থেকে তুলে এনেছেন কবিতার গভীর উপমা। তাই তাকে বোদ্ধামহল উপমার কবি হিসেবেও আলোচনায় তুলে এনেছেন। তিনি নির্মাণ করেন, ‘অক্ষত চর্মের আড়ালে আহত মাংসের মতো গোপন বা গোপনীয় হয়ে’, ‘প্রথম মিলনকালে ছেঁড়া ত্বকের জ্বালার মত গোপন, মধুর এ বেদনা’, ‘করুণ চিলের মত সারা দিন, সারাদিন ঘুরি’, ‘চতুর্দিকে সরল পাতার মাঝে থাকা শিরিষের বিশুষ্ক ফলের মতো আমি জীবনযাপন করি’ ইত্যাদি উপমাসিদ্ধ পঙ্ক্তি। তার ভাষায়, ‘উপমা ভাল হলে পাঠকের মনে আনন্দ হয়।’
কবি বিনয় মজুমদার অন্ধকারে বসে আলোর তপস্যায় মগ্ন থেকেছেন। সরল গ্রাম্যজীবনের লোকবিশ্বাস বুকে লালন করে নিরন্তর হেঁটেছেন সত্যানুসন্ধানে। আশার জটিলতায় সামিল না হয়ে বুকের ভেতর গড়ে তুলেছেন মসৃণ শিল্পগৃহ। লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে তিনি শিল্প সুষমার নিখুঁত তুলিতে এঁকেছেন কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি। মার্কিন কবি জিন গ্যারেজ বলেছেন, ‘একটি কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তিই হলো এক আত্মজীবনী।’ এ মহান উক্তির সঙ্গেই জীবনের গাঁটছড়া বেঁধেছেন কবি বিনয় মজুমদার। তার শাব্দিক কথামালা ও হার্দিক বর্ণমালা জুড়ে রয়েছে ধ্রুপদী সদগুণের সমন্বয়। তাই তার কবিবন্ধু উৎপল কুমার বসুর চূড়ান্ত উচ্চারণ ‘বিনয়ের অনেক কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, আমরা বুঝি তেমন এক অন্তিম অবস্থায় পৌঁছে গেছি যেন এরপর আর কোন কবিতা হয় না।’
মানসিক অসুস্থতার কারণে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিনয় মজুমদার ‘এক পঙ্ক্তির কবিতা’ শিরোনামে ২০১ পঙ্ক্তির কবিতা রচনা করেন। বিনয়ের এ কবিতাগুলো এক ভিন্নতর দর্শনের দর্পণ। কল্পনার কোনো স্থান দেননি তিনি এ পঙ্ক্তিগুলোতে। কবিতার পঙ্ক্তি জুড়েই রয়েছে নিখুঁত বৈজ্ঞানিক ইতিকথা। শুধু কবিতা নয়, তিনি তার গদ্যসাহিত্যেও ধারণ করেছেন গণিত-প্রভাবিত দার্শনিকতা। তার মনোজগতে কবিতা ও বিশুদ্ধ গণিত একই ধারায় বহমান থেকেছে। ‘সাহিত্যের গতি গণিতে-বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে সাহিত্য নয়, গণিতকে বাদ দিয়েও সাহিত্য নয়’Ñ বিনয় মজুমদারের এ প্রমিতির ভাস্বর রূপ তার সাহিত্যের ক্যানভাস আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তিনি নির্মাণ করেনÑ
‘আমি গণিতাবিষ্কর্তা আমার নিজের আবিষ্কৃত
ঘনমূল নির্ণয়ের পদ্ধতিটি বিদ্যালয়ে ঐচ্ছিক গণিতে পাঠ্য হয়ে গেছে, যেটি
ক্রমে ক্রমে পৃথিবীর সব বিদ্যালয়ে পাঠ্য হবে। এর ফলে কুড়ি কোটি ছাত্র-ছাত্রী আমার গণিত
পড়ে যাবে যতদিন পৃথিবীতে মানুষ ও দেবদেবী রবে।’
সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা চলে, ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত বিনয় মজুমদারের ‘আমিই গণিতের শূন্য’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে এক আলোকিত সংযোজন। ‘মনা আজ এসেছিল আমার কাছে’ শিরোনামে একটি কবিতায় তিনি ‘মোনা লিসা’ খ্যাত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সঙ্গে নিজেকে তুলনা করেছেন। কারণ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং বিনয় মজুমদার দু’জনেই কৃতী ইঞ্জিনিয়ার এবং গণিত আবিষ্কর্তা। কবি বিনয় মজুমদার ১৬টি মৌলিক উপপাদ্য রচনা করেছেন।
পরিমাণগত দিক থেকে বিবেচনা করলে বিনয় মজুমদারের সাহিত্য খুব একটা বেশি নয়, তবে তিনি শুধু কবিতা বিনির্মাণ করেননি। কবিতার পাশাপাশি রচনা করেছেন ছোটগল্প, লিখেছেন সমালোচনা, অনুবাদ করেছেন কবিতা, গল্প ও চিঠি। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে লেখাপড়ার সময় তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য রাশিয়ায় যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন। এ সময় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রুশ ভাষা বিভাগের প্রধান অধ্যাপিকা মাদাম ওলগা গুসেভার কাছে রুশ ভাষা শিখেছিলেন। মার্কসীয় মতবাদে প্রত্যয়শীল বিনয় মজুমদারের অনুবাদের তালিকায় রয়েছে পুশকিন, লেরমন্তেভ, এলভব ও ইয়েসিন মায়কোভস্কির মতো শক্তিমান রুশ লেখকদের রচনা। ঞযবড়ৎু ড়ভ জবষধঃরারঃু গ্রন্থটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে তিনি রাতারাতি কলকাতায় লেখক হিসেবে পরিচিতিও পান। তার অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যা ছয়। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ একুশ। গদ্য রচনা ছয়। এ ছাড়াও রয়েছে অপ্রকাশিত অনেক রচনা।
আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে বাংলাদেশের নব্বই দশকের খ্যাতিমান কবিদের মধ্যে স্বতন্ত্র ধারার কবি সমর চক্রবর্তী, কবি বিনয় মজুমদারের সান্নিধ্যে আসেন। তিনি কলকাতার ঠাকুরনগরের শিমুলপুর গ্রামে লোকচক্ষুর অন্তরালে বসে সাহিত্য চর্চারত এ গণিতবেত্তা কবি বিনয় মজুমদারকে তুলে এনে অধুনালুপ্ত পত্রিকা ‘দৈনিক আজকের কাগজ’ ও ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ পত্রিকায় পরপর কয়েকটি প্রবন্ধ লিখলে বাংলাদেশের লেখক, বুদ্ধিজীবীদের নজরে আসেন কবি বিনয় মজুমদার। এরপর এ দেশের কবি, লেখক, প্রাবন্ধিকরা তার খোঁজ-খবর নেয়া শুরু করেন। অনেকেই তাকে নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখেন এবং কবি বিনয় মজুমদারও বাংলাদেশে পঠিত হতে
থাকেন।
২০০৫ সালের মে মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার কবি বিনয় মজুমদারকে ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ প্রদান করেন। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে ভারত সরকারের ‘সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার’ অর্জন করেন তিনি। এছাড়া কবিতীর্থ পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পুরস্কার, যামিনীভূষণ স্মৃতি যমুনা-মতি পুরস্কার, পোয়েট্রি ফাউন্ডেশন পুরস্কারসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন কবি বিনয় মজুমদার। এসবের আগে ডড়ৎষফ চড়বঃৎু নামক টঘঊঝঈঙ প্রকাশিত কবিতা সঙ্কলনে তার কবিতা প্রকাশিত হয়। এ সঙ্কলনে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবিদের সেরা লেখা ছাপা হয়ে থাকে। ভারতের প্রথম তামিল মহিলা কবি বিদ্যা, বিদ্যাপতি, চ-ীদাস, ভারত চন্দ্র, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ প্রমুখ মহাকবির সঙ্গে বিনয় মজুমদারও সঙ্কলনভুক্ত হয়েছেন।
বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত একমাত্র গণিত-প্রভাবিত দার্শনিক কবি বিনয় মজুমদার। তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন ১১ ডিসেম্বর, ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে। প্রয়াণের পর থেকেই তিনি সাহিত্য বোদ্ধামহলে ব্যাপক আলোচিত, সমালোচিত, আদ্রিত ও আশ্রিত হয়েছেন এবং এ ধারা ক্রমবহমান।
কৃতজ্ঞতা: ‘গণিতবেত্তা বৈজ্ঞানিক কবি বিনয় মজুমদার’Ñ প্রবন্ধ, চিত্তরঞ্জন বাইন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন