রবিবার, ৩০ আগস্ট, ২০০৯

কবি সুমন রহমানের কবিতা


ছোটখালার যাওয়া
.............
ছোটখালার মনে নেই, ওকে আমি পালিয়ে যেতে বলেছিলাম
বলেছিলাম, এসো, লুকিয়ে থাকি শূন্য ফুলদানির
অন্তহীন রহস্যের ভেতর,
মরণশীল দুটো মাছরাঙার সাথে জীবন বদলাই আর
হাওড়ের মধ্যে ডাকাতের মত তাড়া করি ঘূর্ণায়মান প্রপেলারকে

এ-কথা শুনে ওর সূঁচ-ধরা হাত গেল থেমে। ওর চোখ
হয়ে ওঠল মেঘাচ্ছন্ন দিনের জোড়াপুকুরের চেয়েও সন্ত্রস্ত
সূচিকর্ম ওর প্রিয়। মাছরাঙাদের সমাজে সেলাইয়ের প্রচলন নেই জেনে
কী হাসি তার!
যেন আমার প্রস্তাব বাতিল হয়ে গেছে
সুপারি গাছদের বিশেষ বর্ধিত সভায়

ওর ব্যস্ততা ছিল। ভিনদেশী এক রাজকুমারের ঘুমের জন্য
বালিশের ওয়াড়গুলোকে কথা বলতে শেখানোর কাজ, তাই সারাদিন
নিজ আঙুলের সৌন্দর্যে নিজেই সে মুগ্ধ হয়ে থাকত
আমার কথা শুনত কি শুনত না -- বৃষ্টি ধরে এলে
আমি শূন্য ফুলদানির ভেতর একা ঘুমিয়ে পড়তাম
ঘুমিয়ে ভাবতাম
প্রপেলার-পাখার অন্তহীন হিমেল নৈঃসঙ্গের কথা

সেই রাজকুমারের ওপর আমার ছিল অসামান্য ক্রোধ
তাকে আমি খুঁজে বেড়াতাম সত্যিকারের টিনের তলোয়ার নিয়ে
ধ্বসিয়ে দিতাম যাবতীয় উঁইয়ের ঢিবি, তার ঘোড়াটিকে
ধাওয়া করবার জন্য
ভাব রাখতাম দ্রুতগামী বাছুরদের সাথে

একদিন আমার আয়ত্বে এল রূপকের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা
অনুনয় করে বললাম, খালা, চল বোয়ালমারির বিলে
নিশুতি রাতে তুমি জেলেডিঙি হয়ে ঘুরে বেড়াবে, আর আমি
হ্যাজাক-হারিকেন
কিংবা চলো দূরে, যেখানে তুমি এক বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, আমি এক
উলুঝুলু কাকতাড়ুয়া
নয় আরো দূরে, তুমি পোড়োবাড়ি আর আমি টিনের সেপাই!

সূঁচের কাজ শেষ হলে ছোটখালার জন্য পালকি এল
এল অঘোর শ্রাবণ, আমার চোখ পোড়োবাড়ির জানালা
আমি কাকতাড়ুয়া, আমি টিনের সেপাই, আমি হ্যাজাক-হারিকেন
বর্ষণসিক্ত বাঁধে ওঠে অনেকক্ষণ ধরে হাত নাড়লাম
ছোটখালার যাওয়া তবু ফুরাল না, চলে যাচ্ছে সে
নিসর্গের সেলাই খুলে হারিয়ে যাওয়া জেলেডিঙির মত।


বোতলবন্দি
..........
আমায় বোতলবন্দি করে ঝাঁকায় সে, আর হাসে, শাদা পাজামার হাসি

আমি ওকে শোনাই পাঠ্যবইয়ের মলাটের কথা
যেসব কথা শুকনো পাতার মত ওড়ে অপসৃয়মান বাসের পেছন পেছন
তাহাদের পারলৌকিক উল্লাসে দ্রবীভূত আমার প্রতিভা

তবু ভাবি, একদিন নিশ্চয়ই আরব্য দৈত্যের মত ফুলে-ফেঁপে
বেরুবো বোতল থেকে
চমকে দেয়ার মত নানান উপমাসহ, আর
ওর আসন্ন প্রস্থান রপ্ত করবো ঠিক নিজের জীবনে

অথচ প্রথম যেদিন এল সে ঘরে – বসল চেয়ারে – নিশ্চিত হয়েছিলাম
ওর বসবার ভঙ্গি বাদ দিলে আমার চেয়ার
একটি নামপ্রত্যাশী জড়বস্তুমাত্র
ওর উপস্থিতি ছাড়া বারান্দা, বাড়তি শূন্যতা!


রেস্তোরাঁ: লালবাত্তি জ্বলিবার আগে-আগে
............................
নিচু গলায় ঝগড়া করছিল খিটখিটে চেয়ারগুলো
শেষে ঠোকাঠুকি একচোট – তন্দ্রা টুটে গেল টেবিলটির


অয়েল ক্লথের নিচে সে দেখছিল দারুণ ভয়ঙ্কর এক স্বপ্ন!
দেখছিল, ওকে কোপাচ্ছে আর খিস্তি করছে লাকড়ি-ওলা


ধ্যাৎ, কোন মানে হয়? যত আজগুবি, এখনও ঢের দেরি
ধাতস্থ হতে হতে ভাবল সে, পিঠ ভিজে গেছে ঘামে


রেস্তোরাঁর ঘড়িতে সকাল দশটা, এরমধ্যেই পাজি বয়টা
নাক ঝেড়ে সিকনি মুছে গেছে কোন এক ফাঁকে


নাহ্, কাউকে বলা যাবে না, সব্বাই ভাববে কাপুরুষ
সুযোগ পেয়ে যা তা একটা বলেও বসতে পারে
ইঁচড়েপাকা লবণদানিগুলো


তবে, একা পেলে, ফাটা গ্লাসটিকে, আরো বীভৎস করে
পুরো গল্পটি শোনাতে হবে, যাতে ওর দফারফা হয়


সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া
...............
উচ্ছল সান্ধ্য আড্ডার জন্য প্রায়-মাংসাশী হয়ে উঠে রেস্তোরাঁ
কুরুক্ষেত্র ছেড়ে শুনতে এসেছি সিরামিকের নিজস্ব ঝগড়া

শীতল অহিংসা ছড়াতে আসেন যুধিষ্ঠির, আসে কর্ণ
ধনুক বিক্রির পয়সায় খুব পুরিয়া জমছে আজকাল!

হঠাৎ অর্জুনস্রোত! ঝুঁটি-বাঁধা অর্জুন, ফ্রেঞ্চকাট অর্জুন
আসে চাকরিপ্রার্থী ভীম, ছাত্র পড়িয়ে ক্লান্ত নকুল-সহদেব

ওরা প্রত্যেকেই তিনঘণ্টার জন্য গোপনীয় হতে এসেছে
তাই কথার ফোয়ারা; নাহলে মরিচা ধরবে চোয়ালে

রেস্তোরাঁটি ওদের সবাইকে কিন্তু দারুণ ভালবাসে। আর বোঝে
প্রত্যেকের প্রয়োজন ভিন্ন ভিন্ন ওয়াটের আলো

দুইশ’ বিশের সামর্থে তবু চারশ’ চল্লিশ ভোল্টের কুরুক্ষেত্র, জয়
কাশীরাম! দ্রৌপদী নিশ্চয়ই পৃথিবীর প্রথম রেস্তোরাঁর নাম!


ছেলেকে না-বলা রূপকথা
Share
Wednesday, August 5, 2009 at 3:44am
তোর বার্থডে কেকের ’পরে
দাতাসংস্থার শাদা ছাতা
মা দূর অভিবাসী মন
বাবা এক রুগ্ন করদাতা

উহাদের সিভিল বিবেক
ভেদ-বিভেদের মনোগ্যামি
তুই তার মূর্ত মশকরা
তারা তোর হাসির আসামি

বাকি সব টেলি-রিয়েলিটি
প্রেম, দেনমোহরের ডিউ
লোন তুলে মাইক্রো ক্রেডিটে
তোর মাকে বলি, লাভ ইয়্যু!

বলি ভেঙ্গে, ইনস্টলমেন্টে
ডেডলাইনের আগে-আগে
কর্পোরেট প্রতিভাসমেত
সেও শোনে সহজ বিরাগে

ভোরে হাহাকার, দুপুরে বার্গার
রাতে ফিরে দেখি তোর জ্বর
ভাবি, এই চুপসানো গ্রহে
কেন যে জন্ম হল তোর!

থরথর থার্মোমিটারে
তার-ই পাঠ, পারদ-আলাপ
মাপছে মা ফারেনহাইটে
আর সেন্টিগ্রেডে কাঁপে বাপ!


বিলবোর্ড-নিবাসিনী
.............
চিরকাল দূরে থেকে-থেকে তুমি সুদূরের প্রণয়ভাগী হয়ে গেছো
চিত্রার্পিতা, বিলবোর্ড-নিবাসিনী, তোমার গমনোদ্যত পা
মুড়িয়ে দেয়ার জন্য আমি জমাচ্ছি আমার সকল অপরিণামদর্শিতা
সর্বব্যাপী প্রেমোক্র্যাসির ধোঁয়ায় তোমার যতোটুকু শ্বাসকষ্ট
আমি তার ততোধিক নীল নেবুলাইজার
তুমি আসছো মোরগের বিষ্ঠাভরা জংলা পার হয়ে
মিডিয়াগাছের ছায়াফাঁদ বাঁচিয়ে
আমার ডাকবাক্সের ধূলায়, আমার নিখিল বিজ্ঞাপনহীনতায়!

আমি তো তোমার অপলকময়তা দেখে-দেখে
কাঁথামুড়ি দিয়ে পাশ ফিরতাম
নয়তো তোমার গল্পঘরের বারান্দায় বসে দেখতাম
নৈশকোচগুলো গ্যারেজে ফিরছে একে-একে
ঠাণ্ডা চা আর পোঁতানো পপকর্ন গিলছে টহল পুলিশ—
একটা সিএনজি স্কুটার আরেকটাকে পেছনে-বেঁধে
চলে যাচ্ছে দূরে, কোনো সমকামী অভীপ্সার দিকে
এতসব দেখে-দেখে, তোমার নম্র উপেক্ষার ধ্যানে এ জীবন কাটিয়ে দিতাম
ফুটপাতে, শেষরাত্রির প্রিজনভ্যানে!

তোমার চুলে নিরুত্তাপ স্মরণসভার গন্ধ, যেন তুমি
কখনো মানুষ ছিলে, এখন কুঠুরি, দরজা-জানালা বন্ধ
কলতাবাজার কবরস্থান থেকে পালিয়ে আসা লম্বা-লম্বা সিপাহীদের ছায়া
তোমাকে পাহারা দেয়
তোমার বামচোখের ভেতর একটি ঘুরানো সিঁড়ি
উপরে উঠতে-উঠতে হারিয়ে গিয়েছে মহাশূন্যে
তোমার ডানচোখে অতীতকালের একটি চিৎকার জমে বরফ হয়ে আছে

আমি সেই রাত্রেই কসাইটুলি থেকে কুড়াল চুরি করে আনলাম
দেহপসারিনীদের ছেঁড়াখোঁড়া অভিলাষকে চিরদিনের মত বিদায় জানালাম
তখনো অনেক বাকি ভোর, মফস্বলগামী নিউজপেপার
স্তূপাকার হয়ে আছে জনশূন্য বাস টার্মিনালে
এদের ভাঁজে-ভাঁজে আমি বিছিয়ে দিলাম আমার না-লেখা প্রেমপত্রগুলোকে
ছোট আর একান্নবর্তী শহরগুলোর আলোবাতাসে ওরা
বড় হয়ে উঠবে একদিন!

এসে দেখি, তোমার গল্প থেকে এমন মোহময় সাবানের গন্ধ ছড়াচ্ছে
আর তা তন্ময় হয়ে গিলছে কয়েকটি নির্ঘুম কাক
তুমি কি ওদের সাথেই উড়বে নাকি, বিলবোর্ডবাসিনী!
ওরা কিন্তু সত্যি-সত্যি কাক নয়—কর্পোরেট মেটাফিজিক্স—
তোমাকে তোমারই স্মৃতির ভেতর কয়েদ করতে এসেছে, তারপর
বাসি মেট্রোপলিটনের পিঁপড়াগুলোকে ছেড়ে দেবে ওরা
তোমার সবুজ শাকসবজির আকাঙ্ক্ষার ভেতর

তবু, কোনোদিন ভোরবেলা জেগে আমি অবাক দেখবো শাদা বিলবোর্ড
অচেনা রূপসী, নতুন কমোডিটি—তোমার শ্রান্ত ডানাজোড়া আর
খুঁজেও পাবো না
যাদের আমি চোখের জলে এতকাল লুকিয়ে রেখেছিলাম!


পশুর নদী পেরিয়ে
.............
হরিণ দেখব বলে পশুর নদীতে ট্রলার নিয়ে বার হলাম
ছ’ঘণ্টার ভাটায় সুবোধ-হয়ে-যাওয়া কুমিররঙা নদী
আমাদের উপস্থিতি বিষয়ে যে কোন ভদ্রলোকের মতই অন্যমনস্ক
যেন ক্ষমা করে দিচ্ছে ট্রলারের
চার সিলিন্ডার ছোকরা ইঞ্জিনটির বেয়াদপি

পশুরের ভদ্রলোকী বোবাপনায় আমার মেজাজ বিগড়াল
ওর বখে যাওয়ার ধরনটি কিছু কিছু ক্রিটিকের মতো
হায় সমুদ্রসখী! কথা না বললেও তুমি জাজমেন্টাল
যাবতীয় ডুবোচরায় সাজানো তোমার উদাসীন ছন্দহীনতা!

বিশাল সুন্দরবনে আমার কল্পনাশক্তি ক্লান্ত হয়ে গেছে
ধাবমান বন্য বরাহের পেছনে হারিয়ে গেছে উপমার বোধ
তাই উড্ডয়নশীল মাছরাঙায় উৎসাহ নেই, জেনেছি ওদের
পশ্চাদ্গামিতার হেতু, ওরা ভালবাসে প্রপেলার

বরং নারীবর্জিত এক দ্বীপরাজ্যের কথা ভাবা যাক:
তরোয়াল মাছের শুকিয়ে-আসা হিংস্রতা ওখানকার
স্তিমিত যৌনচেতনার প্রতীক
জামতলীর নালায় উবু হয়ে থাকা কেওড়া গাছটির কানে কানে
চিরকাল পশুর-কথকতা, ছলাচ্ছল একই গল্পে স্থগিত হয়ে থাকা!

ধীরে পাক দিচ্ছে চিল, ওর লক্ষ্য ভাসমান বয়া
সুকানি নিশ্চিন্ত; তার কাছে বয়া তন্দ্রার সমার্থক
একটা নিঃসঙ্গ বয়াকে ঘিরে অনেকগুলো সম্ভাবনা
একই চোখের অসংখ্য তুলনার মত, একই হাসির
নানারকম অর্থের মত

ম্যানগ্রোভ ম্যানগ্রোভ উত্তেজনা চারদিকে, কোথায় অভয়ারণ্য
কোথায় ফরেস্ট বাংলো, বিপন্ন গাদা বন্দুক, বানর-ভরা গাছ


পশুর নদী পেরিয়ে আমার মনে কি পড়বে, আমি ছিলাম এক
মিঠাপানির মাছ!


স্কুলড্রেস
.....
বেড়াল যেভাবে হাঁটে, কিংবা ধরো, যার অভিলাষ নাই
নখ আছে গোলাপি থাবার নিচে, উদ্ভাস নাই
সেভাবেই আমি আমার প্রজ্ঞাকে
তোমার শ্রুতিসীমা থেকে লুকিয়ে রাখতে চাই

কিশোরী ঘূর্ণির কাছে হঠাৎ একটি উলুঝুলু নারকেল গাছ
যেভাবে নাকাল হয়, অথবা শুশুক
যখন রক্তাক্ত হয়
কালো মেঘ আর ভাসমান ট্রলারের পার্থক্য না বুঝে

আর মনে করো: পিপীলিকা যে নিয়মে তার
মৃত স্বজাতিকে
খাদ্য তালিকায় স্বতঃসিদ্ধ করে, যেভাবে একটি হাট
শ্রাবণের সামান্য হাসিতে
টুকরো টুকরো হয়ে পালায় চালাঘরে

নিজ বিকাশের প্রাত্যহিক বারান্দায় বসে
তুমি এদের ওপর হাসির হররা বইয়ে দাও
এদের জন্য তৈরি করো কার্যকারণের
শাদাকালো স্কুলড্রেস

আর আমি ভাবি, তোমার কৌতূহলের কথা
দূরাগত শান্ত জিজ্ঞাসার কথা
যখন জানবে তুমি কেন এরা চিরদিন পরস্পর-অভিযোগহীন
ততদিনে, নিরুত্তর ধোপাঘরে, তোমার স্কুলড্রেস তুমি হারিয়ে ফেলেছো!



আলাস্কা
........
"Here's to my life in a chosen country
Here's to Alaska and me"
- John Denver

তোমার হস্তলিপির চেয়ে স্বচ্ছ, শরতময় কোনো দিনে, শ্যালো ইঞ্জিনের নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টিধারায় আমাদের নদীসভ্যতার গভীরে আলাস্কা নামের কোনো গ্রাম। হয়ত আলাস্কা নামে কোনো গ্রাম নাই, হয়ত আলাস্কা নাই; আছে বিদ্যাকূট আর উরখুলিয়ার মাঝামাঝি এক রোদ-অবকাশ, তাকে তুমি আলাস্কা ডাকছ। কিন্তু, মাঠকর্মীদের উল্টো-করে-শুকাতে দেয়া ল্যাট্রিন প্যানগুলো যখন শরত-পরিস্থিতির ওপর চড়ে বসছিল -- যেমন আমি ভাবছিলাম সিমেন্টের শত শত সীল মাছ ওরা, অঘটনের নেশায় স্তব্ধ হয়ে আছে, যেন ওদের নৈপুণ্য আমাকে দেখাবার নয়, যেন ওদের উচ্ছ্বাস পাল্লা দেয় করলেংকোর নৈশঝড়ের সাথে!

আমার সম্পত্তি বলতে একটা কাঁটাঝোপ-গজানো রেললাইন, আর দু-তিনটা অকশনে-ওঠা রেলবগি। আমার স্বত্ব বলতে একটিমাত্র গল্পের ওপর, খুব বস্তাপচা ত্রিভূজ গল্প সেটা, ভরা যৌবনে এক আলাস্কা-কুমারী একটি ছন্নছাড়া ভালুকের প্রেমে পড়েছিল, আর ভালুকটি তখন হাবুডুবু খাচ্ছিল ওর হাত-ফসকে-যাওয়া একটি রূপালি ট্রাউটের নেশার ভেতর।

কোথায় আলাস্কা ? ফাঙ্গাস পড়া মনপর্বত, কোথায় সে ? যে হিমবাহটি গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে তাকে তোমার পছন্দের শাখানদীর ভেতর ঘুম পাড়িয়ে দাও। তারপর নিবিষ্ট হও: আলাস্কার মহান সাইলেন্সে একটি ঝরন্ত পাতার জীবনীর মধ্যে। দেখো ঈগল তার তীক্ষ্ম টর্চ তোমার পিঠে বুলিয়ে দিচ্ছে, আধামিনিটের জন্য উত্কর্ণ একপাল চিত্রাহরিণ, ঘণ্টি বাজছে ঘুমন্ত গ্রিজলির সদাজাগ্রত নাসাপথে। পাইনের পাতাঝরার বৃত্তান্তসহ এবার তুমি আলাস্কায় ঝরো।

হতে পারে আলাস্কা নেই। তাই তাকে নিয়ে লিখব বলে গোটা শরতকাল ধরে ভেবেছি, এই ভাবনা ছিল তোমার বয়সন্ধির নীল পতাকার চেয়ে সুন্দর। আলাস্কাহীন আমার কবিতা যাবতীয় বিরহের আলোকিত-অপর-পৃষ্ঠার মত, বহুযুগ ধরে কারো রক্তে দ্রবীভূত না-হতে পারা নাইট্রোজেনের ঘনশ্বাসের মত।

Tuesday, May 26, 2009 at 1:22pm
পাঠ্যপুস্তকের ভিতর শ্রাবণ অঝোরে ঘুমাচ্ছে
এই নৈশবেলায়। মেষদলটির কথা ভাবে নি সে।

কিংবা ভেবেছে, হয়ত মুষড়ে পড়েছে, কাল
টিউটোরিয়াল।

তাই তালাবদ্ধ দোকানঘরের বাড়তি চালার নিচে আধভেজা
পরম আরামে চোখ বুঁজে-বুঁজে বর্ষা দেখি। আমি আর মেষদল।

আমি ভাবি এই ক্ষুদে পর্যটকদের কথা
পেশাদার ভবঘুরে ওরা এই মফস্বলে, একেকটা ইবনে বতুতা
বিভিন্ন শৈশব থেকে হারিয়ে যাওয়া কিছু পশমের টুপি

ওরা ভাবে, আহা! কবি!


দড়ি-ছিঁড়া
.......
আমার জন্য ধারাচ্ছে যারা ছুরি
ঝুলিয়ে দিলাম তাহাদের কৃষিকাজ
টিলা ডিঙালেই পাবে খুঁটি, ছেঁড়া দড়ি
এই অসময়ে পালিয়ে এসেছি আজ

কোথায় ছিলাম? কাহার বৃন্দাবনে?
ভেবেছি জীবন শুধুই লীলার দাস
ঘাড়ে ক্ষত হলে পাঠাল নির্বাসনে
কেঁদেছি যতই, আটকে বসেছে ফাঁস

জোয়াল ছাড়িয়ে, শিঙে দিয়ে লাল টুপি
কান ধরে হাটে নিয়ে গেল গৃহস্বামী
কত যে ‘কানাই’ জপেছি গো চুপি চুপি
বাসি খড় গিলে হয়ে গেছে ভেদবমি

সন্ধ্যা অনেক আশ্বাস দিতে জানে
চকচকে ছুরি, ডাঁশমাছিদের ত্রাস
বসে ভাবতাম আত্মাহুতির মানে
নিরুপায় লেজ নড়ত এপাশোপাশ

দূরের গোপাটে তখনি দেখেছিলাম
উড়ছিলে তুমি ধারালো শরীর-প্রাণে
ওড়ার দাপটে ছিঁড়ে গেল দড়ি মোর
সন্ধ্যা অনেক উস্কানি দিতে জানে

এটুকই প্রেম -- সলাজে ভেবেছিলাম
বাদবাকি ‘আমি’ টানটান রূপকথা!
বিধাতা হাসেন! প্রিয় কুচকুচে পাখি
প্রেম নয়, ক্ষত ঠোকরানো তোর প্রথা?

পালিয়েছি তাই। আমি এক দড়ি-ছিঁড়া
সাধ হয় পায়ে বাটখারা বেঁধে ডুবি!
তেমন তটিনী কৈ, তেমন গম্ভীরা?
প্রাণপক্ষিনী, তুমি তো কেবলি ছবি!


মধ্যরাতের নদী
...........
খুব ক্যাজুয়াল, কোন জলদি নাই, যেন নিরবধি --
যেন কারো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাচ্ছে মধ্যরাতের নদী
পাঁচমিশালী ধারাস্রোতের দোটানা-সহ।

আলোকসজ্জার নৈশ অনুরোধ ঠেলে যেতে মন কি তার একদম সরছে না?
নাকি ভুলে গেছে,পাহাড়ের বেণী খুলবার দিনে সেও ক্রন্দনশীলা পথ --

আর জয়দ্রথ
কিংবা আমি
এসে বসলাম পা ডুবিয়ে -- ইউরিয়া ফ্যাক্টরির সবুজ বিষ্ঠা মিশছে
ঘুমন্ত ইলিশের ফুলকায়
তবু গুনগুনিয়ে যাচ্ছে নদী, যেন ওর গানের ভেতর ইলিশের
বোকা-বোকা শ্বাসকষ্ট আছে। সহজ মরণ আছে।

নদীকে বললাম আমার নানাবিধ পদ্যসম্ভাবনার কথা
এক বালিকার খেয়ালখুশির ভেতর তীব্র বেদনারাশিসমেত
লতিয়ে উঠত ওরা –
যাকে আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম ওর সহচরীদের কাছ থেকে
আগলে রেখেছিলাম পৃথিবীর সবাইকে তস্কর ভেবে --

বলতে ইচ্ছা করছে: তাকে হারিয়ে ফেলেছি, অথবা তাকে
কোনদিনই পাই নি
তাকে আমি একদম বুঝি নি, সেও আমাকে নয়
আমি হয়ত তাকে একদিন বুঝে উঠতে পারবো, কিন্তু সে আমাকে
কোনদিনও বুঝবে না

একটি নিঃসঙ্গ জেলেনৌকার আলোয় আমার চোখ
ঝাপসা হয়ে আসছে

নদী বইছে ধীরে, সপ্রতিভ উপেক্ষার অল্প-অল্প ঘূর্ণি ওর গায়ে
যেন আমি যে গল্পটি বলছি সেটি বহুবার তার বহুজন থেকে শোনা
যেন তার তীরে তীরে পুনরাবৃত্তি বোনা

যেন কোন উচ্চাভিলাষী শহরের পাশ দিয়ে
একবারও বয়ে না-গিয়ে
আমার বুঝবারই কথা নয় দাম্পত্য কাকে বলে
যেন আমার সম্ভাব্য কবিতা
ঐ উঠতি শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের মতই
একপেশে একটি বধির ব্যবস্থামাত্র!


সমবেত স্নান শেষে শ্রমিকদের হল্লা মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে
ছুটি চেয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলছে ঘাটগুলো, যেন আমি উঠে গেলেই
একযোগে নাইতে নামবে –
সারাদিনের ক্লান্তি আর লোহার অ্যাংকরের খামচিগুলোতে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে
ঘুমাতে যাবে তারা।


সবুজ বানর
...........
কেন যে ভাবতাম দূর অরণ্যের কথা, জানেন বিধাতা
জোড়া-বনস্পতি বৃষ্টিবিদ্যুতের উপহাসে সেখানে চোখামাথা
খোড়লভর্তি ওদের সবুজ বানর -- ঝিমাতে ঝিমাতে দেখছিল
আমাকে -- কেন যে আমাকেই দেখছিল? জানেন বিধাতা?

দমকা হাওয়া এল একদিন। পরিত্যক্ত গুদাম ঘরের
ছত্রিশ বছরের জং ধরা দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে সে কী
আক্রোশ তার! দোকানগুলোর শাটার নামল ঝপাং ঝপাৎ
একেবারে নিরাশ্রয় হল চারশ’ চল্লিশ ভোল্টের সব লাইটপোস্ট

আর ফাঁকা ময়দানে ওরা -- অসংখ্য সবুজ বানর,
বোধকরি চায়ের স্টলের নিভন্ত চুল্লী থেকে -- বেরুল
দলে দলে। আমার হঠাৎ পানাভর্তি পুকুরের কথা ভেবে খুব
হাসি পেল -- কেন যে ভাবতে গেলাম ওসব -- আর হাওয়া এল

শিলাবৃষ্টি সহ! গত দশকের স্থাপত্য টুকরা টুকরা হয়ে
ছড়িয়ে পড়ছিল আগামী শতকের খরার উপরে --
এই প্রলয়ের জন্য কাকে দায়ী করে স্বস্তি পাই বলো
বসুন্ধরা -- দ্বিতীয় বরফ যুগ আমাকে খামোখাই মাংসাশী বানাল!

কেন যে ভাবি নাই পরবর্তী বসন্তের কথা, শোকগ্রস্ত সে
ন্যাড়া ডালগুলো তার কুড়ি মেলছে সাধ্যমত -- এদিক ওদিক
মাইল-মাইল বরফে ও জলে ঝিকিয়ে উঠছে রোদ, নূহ নবী
শুকাতে দিয়েছে নৌকা, ক্লোনড পশুপাখি, হাইব্রিড ধান ও বারূদ!


এমন বাদল দিনে
............
তোমার চুল ও এথিকসে হামলে-পড়া উরাধুরা ভাইরাস
আমি, এইতো... বেশ শিখে ফেলছি বর্ষাবন্দনা -- রাগ মেঘমল্লার -- মন্দ না
ওগো অন্তর্যামী, দেখো দুইজন জবুথবু মনোগ্যামি --
হাঁটছি দুটি ভিন্ন ভিন্ন ছাতার প্রযত্নে
আমি হাঁসফাঁস, তুমি সমাহিত,
দু’জনেই সমান মীমাংসারহিত
রোড ও রেস্তোরাঁভিন্ন কোন যৌথগন্তব্য নাই, হায় আমাদের!


গল্প করতে করতে হাঁটি আমরা -- খুব নির্দোষ -- শিশু-শিশু
খুব একমত-একমত গন্ধ সেসব গল্পের গায়ে
তারপর আরও কিছু -- ধরো, খুব ধুরন্ধর -- সুঁইয়ের আগায় কারিকুলাম
বলছিলাম, ওরা তোমার চোখের চামড়ার নিচে নীল হয়ে জমতে থাকবে
তোমারই খাঁচার ভেতর পোষ্য হতে হতে
ওরাই তোমায় শেষে পোষ মানিয়ে ফেলবে!

তুমি তবু ভোঁতা তরবারিগুলোকেই ভয় পেতে পছন্দ করো
শক্তপোক্ত পাঁজরসমেত ওদের সামনে কম্পমান থাকাই তোমার পেশা
ফলে, তোমার বাদল দিনের মনমরা পৃষ্ঠাগুলোর কোনও ভাঁজে
এখন আমার হারিয়ে যাওয়া খুব সাজে
তোমাকে আমার আমাকে তোমার দেখবার সাধ লটকে যাচ্ছে যাক
আমাদের নিজ-নিজ পারিবারিক ফোটোগ্রাফের মাঝে


নেহাত ঘটনাচক্রে তোমার চুল ও এথিকস একসঙ্গে উড়ছিল
আর অবসর ছিল আমাদের। আমি বানিয়ে-বানিয়ে তোমায় বলছিলাম
নানান কৌশলের কথা -- যাদের ব্যর্থতা প্রমাণিত
সেগুলো শিখেছিলাম কোন এক কাঁঠালপাতা ও মাটির ঢেলার
প্রণয়কাহিনী পড়তে পড়তে:
আজ যখন বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া একজোট হয়ে এল -- আমাদেরও যৌথতায়
বোকা-বোকা মাধূর্য ছাড়া কিছুই রইল না
এমন বাদল দিনে, এমন উস্কানিভরা দিনে
একসঙ্গে হাঁটছি আমরা, বিদ্যাকুটের রাস্তা কোনোদিনও খুলবে না জেনে!


অমরতার চেয়ে সত্য
...........
তোমার অন্তর্ধান সকাল দশটার যাদুকরী রোদের ভেতর
অতএব মেনে নিই এই বিরহ মাত্র কয়েক ঘণ্টার

এটুকু সময়ের মধ্যে ঘুরে আসতে হবে অনেকগুলো উপদ্বীপ
অনেকগুলো পাহাড়ি খাড়ির তলদেশের মাটির নমুনা পাঠে
জেনে নিতে হবে কেন মহাদেশগুলো পরস্পরের কাছে ক্রমশই
অসহনীয় হয়ে উঠছে
জানতে হবে ঝাউয়ের একটিমাত্র প্রজাতিই কেন ক্রন্দনশীল!

এসব প্রশ্নের তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের অনেক নিচে, ফলত বাতাসমাত্রই শৈত্যপ্রবাহ, আমরা নৈকট্য বোধ করতাম। অর্থাৎ আমার মহিষের চামড়া-টানানো-আকাশের নিচে তোমার চকিত লাবণ্য! আমাকে জানতে হত যা কিছু ঘটেছে এবং যা কিছু ঘটে নি, তাই আমি জানতাম কার্যকারণ হচ্ছে যাবতীয় অভিজ্ঞতার প্রধান মুদ্রাদোষ। তবু যখন:

দেশান্তরী তুতসীদের দেখে তোমার কান্না পেত, আমি আশ্বাস দিতে গিয়ে
বলেছিলাম, দশ হাজার বছর আগে মহাসমুদ্রে ভেসে-বেড়ানো এক ছন্নছাড়া
মহাদেশের নাম আফ্রিকা।

বিচ্ছিন্নতাবাদ তোমার পছন্দ নয়, কিন্তু চাঁদের বিচ্ছেদ কি তোমাকে উপহার
দেয় নি একটি অতলান্তিক সমুদ্র!

তাছাড়া, অনেকবার বলেছি, তালব্য-শ’ লিখতে গিয়ে তুমি কতটা যত্নশীল,
এ থেকে বোঝা যায় তোমার যৌবন ঠিক কতখানি ফুটেছে!

আমি ভয় পাই সেসব কথা যা তোমাকে বলা হয় নি, এরা আমাকে দিয়েছে
অনিদ্রা আর আনন্দ, খুব সপ্রতিভ কোন আড্ডার মর্মমূলে এরা থেকে গেছে
পিত্তথলির পাথরের মত নীরব ও বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে...

যেমন, ধরা যাক, ভেড়াদের আমি ভালবাসি তাদের পর্যটকসুলভ পেশাদারি
নির্লিপ্তির জন্যে, এবং জেনেছি হস্তীছানার জলক্রীড়া নিজ-প্রতিবিম্ব-দর্শনে
অনীহা ছাড়া আর কিছু নয়।

এসব বিষয়ে নিশ্চিত হতে গেছি। সেখানে দেখেছি
গোলকধাঁধা তৈরি করেছে তোমার চক্ষুজোড়া
আহ্লাদী হয়ে উঠেছে তোমার স্তনবৃন্ত
তোমার কুন্তলরাশি ঝপাৎ বৃষ্টিপাতের মত
আমাকে লুকিয়ে ফেলেছে
যাবতীয় চিন্তাশীলতার কাছ থেকে


ভাবলাম, আমি বোধহয় সূর্যকলসের ফাঁদে-পড়া দার্শনিক পতঙ্গমাত্র
জানা নেই ভূবনচিলের পা কেন খুঁজে ফেরে গগনশিরীষ শাখা
মফস্বলী কাকের কেন চাই এলুমিনিয়ামের এণ্টেনা

অনিবার্য এবং অবোধ্য, স্বাভাবিক কিন্তু গাণিতিক নয়

বরং জরুরি বেলা একটায় তোমার ফিরে আসা
মিনিট-স্থায়ী পুনর্মিলন, সমগ্র জীবনের
যৌথতার চেয়ে সত্য
অমরতার চেয়ে সত্য অমরতার দিকে যাওয়া


মেঘশিশু
.....
ছোট, ধাবমান একখণ্ড মেঘ, দ্বিধাজড়িত, একা
নিচু হয়ে উড়ে চলে, এণ্টেনাগুলো কাকশূন্য, ফাঁকা

ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে হিমালয়চূড়ার চিরচঞ্চল হাওয়া
স্বেচ্ছাসেবকের শীতল ও পবিত্র উর্দি-পরা হাওয়া

ভঙ্গিটি ব্যক্তিগত, মনে হচ্ছে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, অকিঞ্চিৎকর
কখনো সে লুকিয়ে যাচ্ছে বয়লারের ধোঁয়ার ভেতর

আকাশে তখন জোর প্রস্তুতি, তুমুল গমগম
সমতটে শ্রাবণ আজ শুরু, মেয়েটিকে প্রথম কদম

উপহার কে দেবে, বাঁশি একাই ‘রাধা’‘রাধা’ বলে

হায় চঞ্চল হাওয়া! ওকে ডাক, ও যে মেঘশিশু
ডেকে আন মাতৃমেঘে, কচুক্ষেতে করতে দিও না হিশু


শীতকালীন বৃষ্টি
.........
বোবা-বোবা শীতকালীন বৃষ্টি ঝরছে পথে, লেইট রেইনফল
ডিয়ার রেইন, তুমি অনেক অনেক লেইট, তুমি আসাদ গেইট --
ম্রিয়মাণ এক আইল্যান্ড, কিন্তু স্ট্রেইট, মাঝবরাবর তৃণভূমি জাগে
আর সেখান থেকে ভেজা-হাওয়া আমার পৌরুষে এসে লাগে

চায়ের দোকানে হি হি কাঁপাকাঁপি, ভাবলাম পুস্তক পড়া যাক
এক বদমাইশ বই, মাল্টিলিঙ্গুয়াল, উরু খুলে সেলাই দেখাল!
তুমি আসছো না, তাই চুলার আগুন পোহায় যে গুটিশুটি বুড়ো
তারে পুছলাম, কী তার হবি? সে কি হিব্রুভাষার নবী?

উৎকর্ণ হতে-হতে শেষে খেয়াল করি নি -- লম্বা হচ্ছিল কান
আঙুল লাগল জোড়া, একি একি, ভেসে আসছে বিপজ্জনক ঘ্রাণ!
হঠাৎ এমনিতর ঘ্রাণের জগতে আমি, ধ্বনির জগতে
হ্যাঁগো অন্তর্যামী, রোম জাগছে কেন চামড়ার পরতে পরতে?

আমার বলবার কথাগুলি, নিশ্চয় ঐ হিব্রুনবীর ঝোলায় গুমরে মরছে
পাসওয়ার্ড চাইলাম পুলিশের কাছে, সেও বাষ্পরূদ্ধ হয়ে পড়ছে
সন্ধ্যা ঘনাল যখন, যারা কেটলিতে ফুটছিল -- তাদের সে কী তেজ!
তারা প্রকাশ্য হবার আগেই যে আমার গজিয়ে গেল লেজ!

খারাপ কি, চতুষ্পদী আমি এবার পরম আরামে লিখব চতুর্দশপদী
ওগো চতুর্দশী, প্রতি শীতে তোমায় পাঠাব উড়ো মেঘের ইমেইল
নানান হুমকিসহ। সন্ধ্যায় ঘাসবিচালির ছুতায় যাব তোমার উঠানে
মুখ দেব যত্রতত্র, রেখে যাব মলমূত্র, আর তোমার বিরহ!


ডায়াবেটিক প্রেমের কবিতা
...............
আহা প্রেম, কেবলি ব্লাডপ্রেসার মাপিয়ে ঘরে ফিরছি
ফেরার পথে রিকশা থামিয়ে চটপট কিনেছি তেলাপোকা মারার বিষ
ঘড়ির কাঁটা এগারোটা টপকালেই বাড়ির দারোয়ান
চন্দন কাঠের চৌকিতে শুয়ে এমন মরণঘুম দেবে আর আমি
ভ্যাবলাকান্ত লেটলতিফ বাকি রাতটুকু ওর সিঁথান-পৈথান করতে থাকবো
সোনার কাঠি রূপার কাঠিসমেত.... এমন সময় তুমি, আহা প্রেম,
যেন দমকল বাহিনীর আগুন নেভানোর সন্ত্রাস
সাইরেন হয়ে বাজলে আমার পকেটে

আমার বিচ্ছেদকামী বিবাহিত পুরুষবন্ধুরা
আমার উকিল-অভিসারিনী বিবাহিত নারীবন্ধুরা
সেই কবে থেকে দু-দুটো বদ ভাইরাস লেলিয়ে রেখেছে আমার পেছন পেছন
এদের টিকটিকিপনায় আমার প্রাইভেসি ঝুরঝুরে পাতলা রুটি হয়ে গেছে
সামান্য হাঁচিতেই আজ এন্টিবায়োটিক চাই
প্রেমের গল্প লিখতে গেলেও রক্তে সুগার বেড়ে যায়
আহা প্রেম, আহা ঝকমারি, বিলাপে ভেজা হাওয়া
ঘনিষ্ঠ হয়ো না, চামড়ায় কালশিটে পড়ে যাবে
চুম্বনের ক্ষত আর শুকাবে না এই নশ্বর জীবনে!



ঝিঁঝিট
........
একদিন সত্যি তোমাকে বিদ্যাকুট বেড়াতে নিয়ে যাবো
চোখ কপালে তুলে দেবো অচেনা অনেক গাছের নাম করে
সিগারেট একদম খাবো না, জোড়া ঘড়িয়াল হয়ে ভেসে
ছুটোছুটি বাধিয়ে দেবো জেলেপাড়ায়, নিশ্চুপ হয়ে শুনবো
কেঁদোবাঘের লেজে আগুন দিল কারা, শুনবো আর হাসবো
ভরসন্ধ্যায় যতরাজ্যির ভুতের গল্প বানিয়ে বানিয়ে
তোমার বাহাদুরির বারোটা বাজিয়ে দেবো

চৌচালার উপর খুব ধীরে চেপে বসবে রাত
তোমাকেও হতে হবে নম্র শান্ত নিরুপায়, আমার-ঘোড়া

কী যে ভালো লাগবে আমার, দূরে, ভাঙ্গা ব্রীজে
চাঁদপুরগামী নৈশ লোকালের প্ররোচনা
কী যে আনন্দ হবে, কখনোই তুমি বুঝবে না
যা বলেছি মিথ্যে ছিল কি না

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন