বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০০৯

বেদনার বহুবর্ণ ধ্বনিরাগ

অভিজিৎ দাসের প্রথম কবিতার বই নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙা কেমন সবুজ। এখানে উৎসর্গ পত্রে মাতৃ সংকীর্তন করতে গিয়ে অভিজিৎ লিখে যান ‘মাতৃগর্ভে ফিরে যাই/আর আকাশের ঐ মেঘপুঞ্জ/বিমর্ষতা ছাড়া কিই বা যোগাতে পারে/আমার হৃদয়ে!’ প্রথম থেকেই বিমর্ষতার বৃত্তান্ত, পরবর্তী পর্যায়ে অভিজিতের কাব্য-প্রদেশের অনেকাংশ জুড়েই এই বিমর্ষতার রঙ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। তবে বিমর্ষতামণ্ডিত জগৎবাড়ির খেরোখাতাটি কোথাও ছকবন্দি নয়। কবির স্তবকের মতোই বিমর্ষ আবহের রং-গন্ধ-পালক যেন ‘স্বর্গ-নগকের মধ্যবর্তী অপেক্ষমাণ’ স্তরে দাঁড়িয়ে থাকে। আর এক ধরনের অস্থির সময়-পরিপার্শ্ব এবং পরিপার্শ্বজাত ব্যক্তিমানসের মনোগত বিপন্নতার বীজ মুখে করে কবিতার পাখিরা তৈরি করে কুটির। সেখানে স্বর্গ-নরক নেই কিন্তু যা আছে তা ‘জীবাশ্ম দিয়ে তৈরি মৃত্যুর ইউনিফর্ম’। আছে জ্নকেন্দ্রে বসে সেই শিকার যুগ থেকে অদ্যাবধি বেদনার নীল মাটি, খনিজ তামা, অভ্র, লোহা অবশেষে আয়নার সামনে নিজেরই জ্নচিহ্ন এবং শবদেহ দেখে ফেলা!
দেখাদেখি পর্বের মাঝপথে ভাবগত অনুভবের মাঝখানে আর কী কী ঘটে-‘নিজের জ্নের দুই যুগ পরে প্রসূতিসদনে গিয়ে দেখি/এক প্রবীণ দর্জির কারখানা। জ্নকেন্দ্রের ইতিহাস, নির্মাতা/মায়াদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন সূর্যের মাতৃগর্ভে আর/সেখানে বৃত্তাকার এক দোলনায় দোল খাচ্ছে আমার আঁতুড় ঘর। এই দর্জিকে আমি শৈশবে দেখেছি/লালা ঝরবার কাপুড়ে ঝুড়ি বানাতে, আজ উল্কা/ঝড়ের এই রক্তবর্ণ রাতে, যখন চাঁদ ও সূর্য/একই প্রান্তরে গড়াতে গড়াতে একে অপরকে/করছে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, আমারই জ্নের/দুই যুগ পূর্তিতে প্রসূতিসদনে জ্নচিহ্ন খুঁজতে এসে/দেখি, সবুজ এ্যাপ্রনে ঢাকা সেবিকারা ঝোপের/ভেতর দাঁড়িয়ে গাছ সেজে দুলছে।’ (‘ইউনিফর্ম’)’
প্রান্তরে গড়াগড়ি খেতে খেতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া আর সংঘর্ষে চন্দ্র-সূর্য দুলছে। তার মধ্যে বসে অনুভূতির রঙধনু বাঁকিয়ে ছবি বানাচ্ছেন কবি। রূপান্তরের কৌশলে সবুজ অ্যাপ্রণে ঢাকা সেবিকারা হয়েছে উঠছে গাছ-বকুল, সন্ধ্যা মালতি! যেন এক বি্নয়বালকের খেলা, খেলতে খেলতে ছবির রঙে কথা বলা। সেই কথার পরম্পরায় বারবার ছুটে আসে কেবল কবিরই মুখচ্ছবি। তাঁর রক্তবর্ণ মা, মধুবালার মতো প্রেমিকারা। বোধ করি অভিজিৎ দাস নিপুণভাবেই চিত্রকল্প সাজাতে জানেন। তবে তাঁর চিত্রকল্পগুলো পাখা মেলে উল্টো দিক থেকে। নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙা কেমন সবুজ কাব্যগ্রন্থের ৫২টি কবিতার অধিকাংশ কবিতায় এই প্রমাণ মিলবে। এক প্রকার মর্মরিত ধ্বনিরাগে অভিজিৎ কথা বলছেন। কিন্তু যতক্ষণ পাঠক কবির ক্ষিপ্র ছবির সঙ্গে কথাকে মিলিয়ে না নিতে পারছেন, সেই অবধি কথা-বাক্যের অর্থও ধরা দিচ্ছে না তাঁর কাছে। অধিকন্তু ছবির সমান্তরালে কথা কিংবা কথার সঙ্গে দৃশ্যের ঐক্য যখন অদ্বৈত হয়ে উঠছে, তখনই পাঠকের কাছে পূর্ণাঙ্গরূপে ধরা পড়েন অভিজিৎ। সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্টতার বাইরে দাঁড়িয়ে, তাঁর চেয়ে অধিক স্পর্শ-গন্ধময় হয়ে ওঠে তাঁর জগৎ। সেখানে বেলে মাটি, বারুদ, আগ্নেয়গিরির স্পন্দন, তেজস্ক্রিয়তা, তামার ঠোঁট ও লোহার দাঁত জেগে থাকে। এরই পাশে কথার গুণ্ঠন খুলতে খুলতে একটি ব্যক্তিগত বেদনার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে কবি চলেন-
‘মহাকাশগামী এক এ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে/প্রায়শই আবর্তিত হয় আমাদের ঘিরে/গতরাতে দেখি/মুমূর্ষু স্বপ্নদের নিয়ে গানের ক্লাসে যাচ্ছে/মৃত্যুর স্বরলিপি শিখতে/বেসুরো কণ্ঠে যে কিছু ইস্পাতের/ধ্বনিরাগ ছুঁড়ে দিয়েই খালাস!/আমি আমার দেহের গ্যারেজে ওই ব্যক্তিগত বেদনার্ত নীল/অ্যাম্বুলেন্সটিকে রেখে পথে নেমেছি।/···আমি আমার ব্যক্তিগত লাল এ্যাম্বুলেন্সের সাথে/একবার লিপ্ত হতে চাই সহবাসে।’ (‘এ্যাম্বুলেন্স’)
ব্যক্তিগত বেদনার লাল অ্যাম্বুলেন্স সঙ্গে করে বারবারই অভিজিৎ জানতে চান নিগ্রো পরীর হাতে কামরাঙা কেমন সবুজ। মজার বিষয় হলো, এই জিজ্ঞাসাবিন্দুতে স্থির কবি তাঁর কবিতার দৃশ্য আঁকেন বটে, কিন্তু দৃশ্যের যৌথ ছবি আঁকেন না। তাঁর ভাষায় ‘···আমি এ দৃশ্যের কোনো যৌথ ছবি রাখিনি/অথবা রাখতে চাইনি।/অথচ যখন এক ভগ্নস্বাস্থ্য চোর এসে অভিপ্রায় জানাল, আমি একে একে/সিন্দুকের মধ্যে সাজিয়ে রাখা আমার পূর্বপুরুষের প্রেতগুলো/তার হাতে তুলে দিলাম।/সে তৃপ্তির চোখে একদলা আলো ছুঁড়ে দিয়ে পাতালের দিকে উড়ে গেল-যেখানে তার নিবাস।’ (‘মৃত্যুদিন’) ভগ্নস্বাস্থ্য চোর পাতালে ফিরে যায়। ক্লান্তির দীর্ঘ ্নারক হাতে কবি একটি সমগ্রতাকে ধরতে যান-ছবিগুলো টুকরো হয়ে পড়ে। আবার দৃশ্যের পাশে ছোট্ট একটি শব্দবন্ধ বেঁধেও দৃশ্যকল্পকে বিস্তারিত করে তোলেন তিনি-‘মৃত্যু গড়াতে গড়াতে/গড়ায়ে নেমেছে কৃষ্ণবেলা/অনুভবে কবে-ধীরগতি!’
মৃত্যুর বাস্তবিক অথচ বিমূর্ত বিষয়কে গড়িয়ে গড়িয়ে, অনুভবের ফুলবাগানে দুলিয়ে তার সঙ্গে যুক্ত করলেন ‘ধীরগতি’ শব্দটি। ফলে মুহূর্তের পাঠকের দৃষ্টিসীমায় উ্নোচিত হলো মৃত্যু, বস্তুগতরূপে যাকে ছোঁয়া যায় না কখনো, সে গড়িয়ে নামছে! কবিতা হয়ে উঠেই এ যেন এক সঘন ছবিময়তার দেশে পাঠককে ডুবিয়ে দেয়। ক্রমাগত ছুটিয়ে মারে। এভাবে কামরাঙা কেমন, কতটা সবুজ জানতে চাওয়া কবি অভিজিৎ দাসের কবিতায় ছবির পর ছবি, দৃশ্যের পর দৃশ্যের খণ্ডাংশ অথবা একটি ছবির মধ্যে আরও অনেক ছবির আভা উঁকি দেয়। আর ‘বহুবার জীবনের যন্ত্রণার বিষে/ঘিলুশব্দ শুনে’ প্রেত, মৃত্যু, কর্কশতার লৌহজগৎকে মেনে নিয়েই কবি ফেরার পথে তাকান-
‘ফেরার পথগুলো কেন এত ঢালময়/যাবার সময় এ কথা তো বলে দাওনি কেউ।
‘যাত্রাকালে যা কিছু দিয়েছ সাথে ঠিকঠাক সাজিয়ে গুছিয়ে/গড়িয়ে নেমেছে সে তো পথের ধুলোয়
‘এ কেমন খাড়া পথে আমাকে পাঠালে/পাহাড়ে ওঠাও সহজসাধ্য এর চেয়ে···’। (‘ফেরার পথ’)
প্রথম কাব্যগ্রন্থে কবি অভিজিৎ দাস সজ্জিত, সুন্দরতম চারপাশকে পথের ধুলোয় লুটান। পরিবর্তে পূর্বপুরুষের প্রেত হাতে অবিরল ‘পতন সংলাপ’ বলতে বলতে বলেন, ‘ঝরা পাতা গো আমি তোমারি দলে’ আর নিজস্ব কথনভঙ্গিমা কণ্ঠে ধরে, ব্যক্তিক বেদনার সাইরেন বাজাতে বাজাতে যেন বলতে চান-কালো, নিগ্রো পরীর হাতে সবুজ কামরাঙাটি সবচেয়ে সুন্দর।

শেখর আহমদ

সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন