মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের নির্বাচিত কবিতা












হজরত বায়েজিদ বোস্তামির প্রতি প্রার্থনা
(তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক)
...................
(উপক্রম :

চাটগাঁয় বাবা বায়েজিদ বোস্তামি
রেখে গেছেন কিছু কাছিম, যাদের আমি
ভীষণ ভয় পাই, কারণ, তারা ঢের
বৃদ্ধ, এমনকি আমার হৃদয়ের
চেয়েও। কাজেই তাদের আছে সে-গ্রাম্য চোখ
যাতে শুধু ভুলচুক ধরা পড়ে আমার। সে যাই হোক,
তাদের খোলগুলি যেহেতু ভরা শুধু পুরানো নৈতিকতায়,
আমি জানি, জবাবে আমারও কিছু বলবার থেকে যায়,
যা আমি বলতে পারি না, কেননা আমি শিশু, আর, হায়!
আমি শিশুই র’য়ে যাই, কারণ, তারা বুড়াই র’য়ে যায়।)

“আমি কী করিব, বাবা, তুমি ব’লে দেও।
আকাশের পিলা রঙে কী করিব আমি।
মাটির পাটল রঙে কী করিব আমি।
কী করিব সাদা মেঘে তুমি ব’লে দেও।

“তটিনীর রূপে রসে আশীবিষ হাসি।
নটিনীর রূপে রসে বিবমিষা রঙ।
জননীর ভুখা কোলে বিবমিষা রঙ।
ধমনির গলিপথে আশীবিষ হাসি।

“বাবা, কী দারুণ ভালো ছিল এই ঘাস।
মেঘ-ছেঁড়া, ঝাঁকেঝাঁক বুলবুলি চোর।
মোর ধান খেয়ে যেত বুলবুলি চোর।
কুমারী মায়ের মতো ছিল এই ঘাস।

“আমি কী করিব, বাবা, তুমি ব’লে দেও।
কী করিব সাদা ঘাসে তুমি ব’লে দেও।”

(উপসংহার :

পাপবিদ্ধ ইডিপাস ব্রোচের শয্যায়,
মৃতের পুস্তক থেকে প’ড়ে যায় প্রথম অধ্যায় :
পা- নি-
নিক্ষিপ্ত তিরের মুখে প্রতিধ্বনি আসে,
শির্কার শরবত আসে স্পন্জের গেলাসে :
আ- মিন্ ॥)

(ঢাকা, ১৯৮৯)


বহুড়ি
....

দেওর আমার, সাধের দেওর আমার,
আজ উঠো না আমার আতা গাছে,
ওখানে এক তোতার বাসা আছে।

দেওর আমার, সাধের দেওর আমার,
কাল শিমুলের ফলটা ফেটে গেছে,
জোনাক পোকা ছুটছে রাতবিদিকে,
আঁধার ঘরে ঢুকে সে যায় পাছে!

দেওর আমার, সাধের দেওর আমার,
আজ ফিরে যাও, পরশু কথা আছে।


ঠাকুরঝি, তুই আমার চোখের নীচে
খুঁজে মরিস কোন্ শাওনের রাত?
আমার নাভির নীচে, ঠাকুরঝি লো,
খুঁজিস রে, বোন, কোন্ বাঁওনের হাত?

তোরে তিন সত্যি করছি, ঠাকুরঝি,
আমি ষড়্ঋতুর আকাশ দেখি নি,
শুধু একটা স্বপন দেখেছিলাম কালকে-
মিছিল ক’রে আসছে ভাসান-পালকি!

তিন সত্যি করছি, ঠাকুরঝি,
আমি সে-পালকিতে চড়ি নি।


তোর চোখে, সই, সিঁদুর-রাঙা মেঘ,
বুকের ভিতর পশলা,
আমার চোখে একটু চেয়ে দ্যাখ্,
চোতের আকাশ, ফরসা!

হেথায় ঝিঁঝির অসহ্য উৎপাত,
হোথায় ব্যাঙের জলসা-
ছোঁব না তোর মেন্দি-পিন্দা হাত,
আমার হাতে মসলা!

জায়ের আমার হাজার গড়খাই,
খোয়াইডাঙায় গোরুর গাড়ির চাকা,
শুকনো ফুলে চৌদ্দটা মৌমাছি-
ভাসুর আমার কী ফাঁকা, কী ফাঁকা!

বিলের জলে ঢিল ছুঁড়েছে কেউ,
নিথর দেহে থিরথিরানো ঢেউ,
থরথরিয়ে কাঁপছে সিঁদুর, শাঁখা,
ভাসুর আমার কী ফাঁকা, কী ফাঁকা!

(ঢাকা, ১৯৮৯)


ঘাতক
....
এ-ঘর নিষিদ্ধ ব’লে তুন্তি শুধু ঢোকে এই ঘরে
যখনই থাকি না আমি, কিংবা মনে করে আমি নেই-
তুন্তি উঁকিঝুঁকি মারে, আনাচেকানাচে খুঁজে মরে
কোন্ এক মেঘ বুঝি, কোন্ এক মেঘের পিছেই।
আনাচেকানাচে শুধু অন্ধকার-মশা ঝাঁকেঝাঁক
গুনগুন করে, তুন্তি পাতে তাতে সহজিয়া কান :
যেন কী খবর এলো- দু’হাতে আঁধার করে ফাঁক।
এ-ঘরে অরুণ কোন্ শিশু বুঝি রাত্রিদিনমান
বইয়ের স্তুপের পিছে, অথবা খাটের নীচটাতে
অসম্ভবসম্ভব ভাষায় আমার তুন্তির সাথে
কথা কয়;- সেই ঘরে, যে-ঘর এমন সদাশয়,
নীল নিশি গাঢ় হ’লে নিজেকে ঘাতক মনে হয়;
তুনি- যেন কয়, ‘মামা, অ্যাতো লক্ত ক্যানো?’- সকালেই
এই ঘরে ঢুকতে ফের তুন্তিকে নিষেধ ক’রে দেই।

(ঢাকা, ১৯৯০)


বিনির্মাণ
.........
তীর্থযাত্রা করে ওস্তাগর;
ঘনায় চৌদিকে
তার দুগ্ধপোষ্য, তস্য দুগ্ধপোষ্যগণ :
সাতশ’ জোগালি আর তেরশত ঠিকে

যারা প্রায় সহজাত প্রতিভায়
ওস্তাদের অগোচরে নিয়েছিল শিখে
কীভাবে- উপর থেকে ক্রমাগত নীচে-
গেঁথে যেতে হয়

বেলুন-বোঝাই-করা নশ্বর সময়।

(ঢাকা, ১৯৯১)


জাগরণপালা
......
O my heart which I had from my mother!
O my heart which I had from my mother!
O my heart of my different ages!
Do not stand up as a witness against me…
For you are my Ka…
(Spell 30 B, THE BOOK OF THE DEAD)


আমার গলায় তুমি কে গো কথা কও অহোরাত্র?
কে গো দেখ আমার নয়নে, শোনো শ্রবণে আমার?
এই দেহের ভিতর দিয়ে দ্বিতীয় সে কোন্ পথ
চ’লে গেছে কোন্ দিকে, কোন্ আলোয়, কোন্ আলেয়ায়?
শত-পিতা-শত-পুত্র-পরম্পরা বংশলতিকায়
দোল খায়, অন্ধকারে সুরভি ছড়ায়! ধমনিতে
যে-তুমি রোপণ করো বিস্ময়ের বিষবৃক্ষ, আর
সন্ধ্যাভাষা- সাঁটলিপি- নিজস্ব নিয়মে, অহোরাত্র-
এবারে আমারে কহো কী আমার নাম, কী তোমার...

আমারে আমার কাছে কে দিল ফিরায়ে? কী-চক্রান্ত
নিদেন দু’দিন-থেকে রসরক্ত করিল দোহন?
এ-জাদু কোথায় ছেল? কোন্ ঠেঁয়ে? কোন্ চরাচরে?
আমার ভাঁড়ারঘরে সিঁদ কেটে কোন্ রেতে, আহা-
হে সা’ব, হিসাব দ্যাখো, খিচুড়ির চেয়ে চেলডেলে;
হ্যাঁ রে, কেনে আলি তুই, কানা কাক, কাক-তাড়-য়ার
ভাবে ম’জে? এই নায়ে বিন্দুবিসর্গের চেয়ে ছোট-
অথচ, তালেব আলি, কান্সা নাড়ো জিয়োলের মতো-
তোমারে চিনি নে? তুমি পয়লা লম্বর দুশমন!
আমারে ফাঁসাবে ব’লে সুজ্জির আগেই তুমি, সোনা,
উঠে ব’সে আছ, আর কী-জানি-কী ছুরা উল্টা ক’রে
পড়তিছও! ভাবো আমি কিছুই বুঝি নে? তবে শোনো,
তোমারে খোলসা করি পিতেপিতেমোর জোতাজুতি,
নানান বানের কথা, খরা, আর নানান উৎসব-
আজকাল বর্ণিবারে নাই আর বিশেষ সেসব।
ফিকশনে ফায়দা নাই তবে আর। আহা, বৈসো তিন
বিঘৎ তপাতে। আজও ছোঁওয়াছুঁয়ি কিছু থাকে, ভায়া।
রিচুয়াল। কী করা। বরঞ্চ ঐ ফাঁকটুকু রেখে
আঠারো অক্ষর গুনে বুনে যেতে পারো তুমি মোড়া,
ব’নে গেলে বসতে আপত্তি নেই, যেতে পারে ওড়া।

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও বিগ বেন-এ?

যে-ঘাটে ছিলেম ব’সে দিবসাবসানে, মর্মপীড়া
তার থেনে বিঘা-তিন দূরে যেয়ে শস্যবান্, আহা!
আমাদের তোমাদের তাহাদের- আহা, কাহাদের?
এই জমি কারও ছিল? এই জমি ছিল শিশুদের।
এই নদী নদী নয়, যদি নয় শিশুদের গান-
দিগনে-র ব্যূহ ভেদি’ এই নদী গগনে উধাও।
(তব কুলদেবতার পরিচয় নদীরে শুধাও।)
তারারা মিছিল ক’রে নেমে আসে যেখানে নিয়ন-
-নীল জোনাকির মতো, যেখানে পশ্চিম থেকে পূর্বে
গগনের গায়ে এক গনগনে লাল শিরা কাঁপে,
যেখানে প্রেমের তলে ঈশ্বর পোড়েন হিম পাপে
সেখানে জীবন- মাটি গোরুর খুরের ছুঁচে উল্কি
আঁকে তার সারা গায়ে, পৃথিবীর শিশুদের তরে,
আমাদের তোমাদের তাহাদের প্রস্থানের পরে।
কাজেই, নাদান মোর, এ-ভিটেয় বৈসে তুমি শোনো,
পূর্বপুরুষেরা গায় তোমার গলায় কালেংড়ায়
যেই গান (শ্মশানেও না শুনি’ নিষেধ, নিষধের),
শ’য়ে-শ’ শিশুর চোখ জ্বলে যেথা অন্ধকার ঘুমে
খনির চুনির মতো খুন-টসটসে, প্রেতলোকে
যেথায় পৃথুলা এক ছিঁড়িছেন মন্দারের থোকা
ভূয়সী খোঁপার লাগি... ধবলগিরির শীর্ষ ফেটে
গড়ায়ে আসতেছে এক অক্ষয় ক্ষীরের বসুধারা-
নরম বলের বুকে পোরো তুমি ইসব ইশারা।

* * * * *

সত্য কি নিহিত ছিল এই বুনো-ষাঁড়ের লড়াই
বসুধার এই কোণে? যেখানে দোআঁশ-মাটি প্রতি-
-কাঠায়, -বিঘায় রইত সুফলন-, বিবৃতজঘন;
বনের বিজন বুকে অচেতন কিরাত-শবর;
উড্ডীন হরিণকেও পালাতে হয় নি মেলা-দূর
আপন নাভির থেকে... হিমালয়ে হৈম হিমবাহ
গর্বিণী গর্ভিণী হয়, সাগরে সাজশ করে ঝড়,
কোথাও নিস-ার নাই- ডোবো আর ভাসো, পর-পর...

কখনও কি ভাবো তুমি ছিলে ঐখানে, আর আছ
এইখানে? ছিলে-কি-ছিলে-না তাতে কী-বা এসে যায়,
যদি ভাবো : বিধিলিপি ঐ-ভাবে এড়ায়ে গিয়াছ-
প্রাচীন প্রাচী-র মৃত্যু ঠেকাবে না চীনের প্রাচীর!
হাউশ ক’রে কেউ আর খায় না সুপুরি-হীন পান,
কালেরও হয়েছে পেট, যা ঘটে তা নেসেসিটি বটে,
‘বৃক্ষেরও নড়ে না পাতা...’- মনে রেখো, হাড়-হাভাতের
ছোঁকছোঁকও মেনে নাও হে, কারণ, ‘কে জানে কী ঘটে...?’
ধ’রে নাও, দুনিয়ার দু’টো দিন বেসামাল ক’রে
বর্ষানে- ফেরাও যেতে পারে তবু যক্ষিণীর ঘরে
পরিপাটি ফিটফাট তৃতীয় দিবসে- এরকমই
ব্যাপারস্যাপার প্রায় গেছে হাতে এসে, এরকমই।

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও বিগ বেন-এ?

ভবিতব্য, বুইলে কিনা, ভবিতব্য ভেবে আমাদের
অনেক পেকেছে মোচ, আমরা আর ওসবের মধ্যি
নাই। বুইলে কিনা। যদি আয়-ব্যয় বুঝি উঠতি চাও,
সন্ধারণই শ্রেষ্ঠ পন্থা- অবশ্যি বিকল্পও আছে :
ঊর্ধ্বরেতঃ আত্মরতি, আত্মক্ষয়, মর্ষণপুলক
(কেউ জানলা খুলে রাখে, কেউ বন্ধ, উদ্দেশ্যমূলক)।

তবে কিনা, আরাম হারাম-সম,- হারামিও জানে,
আরাম মুফত পেলে হারামের ভাতে পড়ে নুড়ি।
তেকারণে শয়তানেরা পৃথিবীতে যন্ত্রণার যন্ত্র
এক সন্তান করেছে। নৈলে বুঝে দ্যাখো, কী আচ্চৈর্য!
টয়েল ক’রেও তবু টয়লেট নাহি তব ভাগে!
ইসব তাঁদেরই কীর্তি। তাঁদের কিউ-তে যদি আজ
আলগোছে সান্ধাই মোরা, তেনারা কি বাদ সাধবেন?
তেনারা কি হাঁকবেন,- ঘোড়া হোস্ নে, খোঁড়া হ’য়ে থাক্!?
বলবেন,- নেমে যা নেমে যা তোরা, বুড়ে যাবে নাও!?
মনে তো হয় না ঠিক, যেরকম ভাবসাব দেখি :
ওপি এক, ওপি দুই- ঠেকে যাবে ওপি একশ’য়-
ওদের মতলবটা কী? মান্ষের ডেইরি ফার্ম্ নাকি?
পাতা-বেশি-চিনি-কম, স্ট্রং অ্যান্ড্ এনারজেটিক?
শামলা শিরে দিলেই উকিল- এমনকি শামলাও,- লাও!
এখন সামলাও ল্যাঠা- ঠ্যালাঠেলি, আমি আগে, আমি,
ফুল আগে, ফল আগে, গাছ আগে, বীজ আগে, আমি,
আমার আগেতে আমি, আমার পিছেও আমি ঠিক-
মেনে নাও, উঠে পড়ো, ভালো থাকো- যৎপরোনাসি-ক।

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও বিগ বেন-এ?

পুষ্পকের ভেজাল টিকেট-হাতে অসঙ্খ্য সারস
ঠায়াসনে, অপান কোরাসে ভনে আবাহনী সাম :
অমরিকা! অমরিকা! অমরত্ব দেহো! ভিজা দেহো!
উদরে গ্রহণ করো ঔদরিক আমাদেরে, দেবি!
প্রত্যাহার করছি আমরা লক্ষ-লক্ষ নক্ষত্রের দাবি,
পঞ্চাশ নক্ষত্র-তলে প্রশমিত করো গাত্রদাহ!
ঊর লো, রিলিফ-ভুজে! দুঃস্বপ্নের চেয়ে দুরত্যয়
বিমূর্তধামে লভুক বাঙালের বিলাতান- প্রাণ
সুচিররুচিররূপে অগ্নিশুচিসূচিত নির্বাণ!
আমরা একান্নবর্তী প্রতিযোগী সহযোগিতায়
মগজ-মজ্জায় তব চন্দ্রযানে জোগাব ফ্যুয়েল-
লোহিতা, তরলা, ফুল্লা, ফানাফিল্লা, ফেনিল, ফুলেল!

* * * * *

তোমারে শুধাই শেষে রহস্য এ-রগড়ের, আর
নিরোধের ইতিবৃত্ত, বৃত্তবন্দি এই ইতিহাস-
মায়ের জঠরে ব’সে যে-সকল বাদ-অনুবাদ
অষ্টাবক্রি আবশ্যিক করেছিল, আর যে-নিবিদ্
‘আল্লাহু আকবর’ শুনে গুনেছিল সমূহ প্রমাদ;
দশম দুয়ার দিয়ে কিমাকার রাহুর মতন
সে আজ বেরিয়ে আসে- রক্তবীজ- আমার রতন!
বিশদ বেদান- তার ব্যাখ্যা করো, হে সবুজ সখা,
হে কমরেড, এ-আজাব কোন্ পাপে, কার পাপে, কার?

তখন বললেন তিনি, আঁধিয়ারে শ্যেন-দিঠি ঠেরে :
একদিন সভ্যতার হাবি-জা.বি. নব্য নালন্দায়
মিশ্কাত আন্জুম, আহা, মেশকাম্বর করেছিল সেপ্র
অমানিশাম্বরে, আর বেখেয়াল ব্যাঙের ছাতায়
ডিপোজিটেড হচ্ছিল ভাইটামিন শনৈঃ শনৈঃ।
কতিপয় ভোজনরসিক তার দ্রব্যগুণ বুঝে
বিমূঢ়া প্রকৃতি-পানে মুহুর্মুহুঃ দিতেছিল হানা-
সে-কাহিনি বলতে বলতে নক্ষত্রপ্লাবিত এক রাতে
শকুনের শুকনো হাড়ে গজিয়ে গেছিল তাজা ডানা;
সেই জোশে, ছায়াপথে, অতিদূরপাল্লার সাঁতারে,
ছাড়িয়ে গিয়েছিল সে সূর্যের সপ্তাশ্ব-রথ গতি-
উক্ত ঘোড়ারোগ, অত্র, মহা-এপিডেমিক, সমপ্রতি।
অ্যাবইউজ করছেন কেন, একটু ইউজ করুন-না, ব্রাদার,
দেখবেন, একই দাওয়াইয়ে সর্বরোগ সারিছে আপনার।

ডোবাল ডোবাল, আহা, নাঙ্গা-গায়ে মরেছে মেয়েটা!
কী দেখি, দেখনহাসি, উহার মরণ, নাকি সেটা ?

এপিকের হিরোদের ট্র্যাজেডিকে ধামাচাপা দিয়ে
কখনও সাইড-রোল নারী চাউর করে রতির প্রতিভা,
পিতার অগস্ত্যযাত্রা কাঁধে নিয়ে তবু মনে হয়,
দ্যাখো দ্যাখো কীরূপ সন্তপ্ত আমি, আড়নজরে, হায়,
আমার অপূর্ব দুঃখে স্বর্গের প্রস্বাদ পিয়ো, প্রিয়,
(অতিরিক্ত দু’টি ফোঁটা এঁকে দিনু তুঁহার জিহ্বায়!)

বেচারি আমেথিনাথ, একদিকে মুণ্ডু তব ফ্লাই
করে, আর আর-দিকে মাতমের তলে-তলে লোকে
হাপুস নয়নে লখে তব তন্বী কন্যার চেকনাই!
আভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান খাড়া বক-পায়ে
তার পাণিপীড়নের তরে (সের্ফ্ দরদ-বশতঃ)।
বোমারু ফুলের তোড়া ছিল না কি এরও চেয়ে প্রেয়?
প্রিয় তুমি ছিলে না কি এরও চেয়ে তামিলের চোখে?
হা পণ্ডিতকুলসূর্য! কী দেখালে মিশেলের খেল্!
(আমাদের সম্বাদপত্রগুলি এককাটি সরেস :
টপলেস স্ত্রী-লাশ-চিত্রে জলোচ্ছ্বাস করে উদ্বেল-
‘কাঁদো, দেশবাসী, কাঁদো! অশ্রুপাত, বীর্যপাত করো!’)
কেবল মুর্দাই দেয় মৃত্যুকে সহজ প্রোটোকল,
কেবল মুর্দাই পারে শিশ্ন যোনি রাখিতে শীতল।

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও বিগ বেন-এ?

সৌম্যের সাধন-ধনে, ত্রিশঙ্কু হৃদয়, ত্রিসন্ধ্যায়
উদ্যম-বিহীন বেগে জিতেন্দ্রিয়-জীন-পুরঃসর
রংহাৎ ধাবন করো পুনশ্চ প্রবল রিরংসায়
স্বপ্নের গোমুখ-মুখে- জযন্ত্র জাগাও- অনশ্বর।

আমি জানি, ও হৃদয়, পনিরূপে তোমার উদয়,
সৌন্দর্যের সার্থবাহ- আহা, তবু ভুলে যেতে হয়
সেইদিন কোন্ তারা অভ্যুদিত হয়েছিল, কোন্
দেউলের গর্ভগৃহে আরতির ধ্বস- স্বস্ত্যঃয়ন
আভাসিত করেছিল অবম ওমেন- অতঃপর
আকাশের গোলটুপি পুড়ে গেল সূর্যের ভিতর।
হৃদয়, মৃত্তিকাসনে পেতে রাখো শ্রুতির গালিচা,
সর্বাঙ্গে শ্রবণ করো সুপারনোভার ফ্যান্টাজিয়া,
চুম্বক-চুম্বনে চুষে বিচ্ছেদের তীব্র অ্যাম্ব্রোজিয়া
জর্জিয় প্যাথস ছাড়া ধুনিবে না অন্য ধুন কোনো :
‘কালো কাক কত ভালো, ভালো কাক কত কালো’- ওম্।
‘ঈট্স্ ওয়ার্ম্, পোকা খায়, কালো-কালো’- দুয়েন্দয়ে নমঃ!
‘এই এই এই এই এই’ (- ইতি সরকার মাসুদ।)

ঘুমোবেন্না, ঘুমোবেন্না, গান সবে শুরু হ’ল মম।

(রাজশাহি, ১৯৯২)

‘তনুমধ্যা’- থেকে
...........
তামাদি
Order in all things, logic in the dark;
Arrangement in the atom and the spark;
Time in the heart and sequence in the brain…
CANTOS, Conrad Aiken


প্র থ ম স র্গ
.........
একবার শখ হ’ল, বীজ ভেঙে ভিতরে তাকাই :
তাতেই অনর্থপাত, এখানে যা চাই তা তো নাই!
পেন্ডুলাম-ফণা দোলে কাঁচা-পাকা দুই অন্ধকারে;
টিকি খাড়া হয়ে যায় অগ্নিশর্মা তালুতে আমার।
আলো ফুঁড়ে উড়ে এলো জনা-তিন উদার পুরুষ-
এক জন চোখে দিল সুন্নতি সুর্মা- তিন দিকে
না আলো না অন্ধকার, গুলে গেল সকল হদিস;
তখন আরেক জন ধুয়ে দিল পথিক চরণ,
ভূমিতে সটান শুয়ে অতঃপর হ’য়ে গেল পথ;
বোঁচকায় কম্বল দিল, হাতে লাঠি, তৃতীয় পুরুষ,
এবং আমার যাত্রা রাত-রাত অগস্তের পিছে।
মেরু-দিন থামে মেরু-রাতের স্টেশনে- তিন জন
নেমেই গা-ঢাকা দিল তাল-তাল কল্কি অবতারে।
অনেক দুঃস্বপ্ন হেঁটে বুঝে যাই ডিম্বাকার সব,
আপন বোধির তলে জেগে উঠি দুরন্ত মনসুর-
বীজ ভাঙি, নিজেকেই খুঁজে পাই বীজের ভিতর।

ঘাসেদের সর্বনাশ ঘ’টে গেছে তরশুরও আগে।
পদ্মার শরীরে থান, কে রাখে হিসাব কত দিন।
কাঁঠাল-ছায়ায় এক লুকানো কুটির আর কুটিরে লুকানো
সোনাবউ- আর তার দেড়গজি ঘোমটায় লুকানো হরিণ...
হরিণ! হরিণ! ওরা পশু নয়, তাই
ওদের জিহ্বার ‘খাই’ চোখের চামড়া দিয়ে বিসমিল্লা করে।
সঠিক আইজা আমি জানি না অবশ্য, এরও বহু যুগ পরে
প্রসূত প্রভূত আমি পলিহীন রক্তের ভিতরে-
রক্ত বলতে যে-আঁতুড়ে বোঝায় না ঊষার পূষন্,
আকাশকুসুম নয়, বালু-তেল, প্রবীণার অকালকুসুম-
পলাশ কিংশুক নয়, এমনকি সে জবাও তো নয়, সুতরাং
লাগে না সে দেব দৈত্য নর কিংবা বানরেরও ভোগে,
তথাচ অভাবে তার মম চিত করে সদা হারাঙ্ হারাঙ্!

এতকাল নদীকূলে চাঁদ সদাগর
যাহা ল’য়ে ছিল ভুলে সকলই সে দিল তুলে
ত্রিকাল ভেলায়...
এই ভেলা থামবে না থামবে না আর,
ভেসে যায় ভেসে যায় ডালিমকুমার।

একদিন ধানের নদীতে নাও বেয়েছি, সুজন,
থেমেছি বিক্রমপুরে, বেসাতি করেছি শ্রীনগরে,
আর কলাকোপায় ‘মাতার ছেলে’ খেলারাম-দাতা
চুবিয়ে মেরেছে তার বউটিকে দুধের পুকুরে-
ওরা আগে তেলি ছিল, পদ্মার ভাঙনে আচানক
রাজার গোপন ধন ঝরেছিল তেলের নৌকায়,
সেই থেকে ‘সাহা’ তারা (‘তেলিসাউ’ বলে মন্দলোক),
শান-বাঁধা ঘাটে তারা দিয়েছিল নদীটাকে শান
(অকৃতজ্ঞ ইছামতি বেশিদিন বয় নি পাষাণ)।
কত জমি গিলে খেলো গোবিন্দপুরের জমিদার,
চাঁড়ালের খুলি দিয়ে সাজাল সে কত-না মশান,
সেও তো পারে নি খেতে ইছামতি নদী-ভরা গান,
আর নদী-ভরা ধান- নদী-ভরা ধানের বাইচ-
আর তা-ই পুঞ্জি ক’রে ফেঁপেছিল আমার ব্যাপার।
সেই আমি- খেলারাম, জমিদার, কেউ নয়, সেই
কেউ-নয় আমি, শেষে নদীটাকে করেছি সাবাড়!
মানুষের ভুখা পেট আকাশ, বাতাস, নদী, কিছুই বাছে না,
শিশুর সবুজ হাসি, মায়ের শাড়ির পাড়, কিছুই বাছে না।

একদা গোলাপি এক ঝড় উঠেছিল,
ভেঙে প’ড়ে গিয়েছিল আমার কার্নিস তার তোড়ে,
ভাঙা বাক্শে ইচ্ছামৃত্যু মলিন স্মৃতির চিঠিগুলো
‘দে জল দে জল’ ব’লে গিয়েছিল উড়ে-
ধিন তাতা ধিন তাতা ধিন তাতা তা ধিন তা ধিন ধিন ধিন
তার পরে দপ্ ক’রে ঝড় বুজে বাতাস হলুদ হায় হায়,
চিঠিগুলি বাজ হ’য়ে ঝাঁপ দিয়ে আমার দু’-চোখ
ঠুক্রে, উপ্ড়ে, তুলে নিয়ে গেল রাতের গুহায়,
আর আমি রাত-রাত রাতের পাহাড়ে কী অসুখ...
চোখ গেল চোখ গেল চোখ গেল

রাত-রাত রাতের দুধের দহে উথালপাথাল,
আর রাত, তোলপাড় অন্ধকার প্রসব-ব্যথায়
কোঁকায়, গোঙায় রাত-রাত,
অন্ধকার রাঘব বোয়াল
রাত-রাত বদহজমি আংটি গিলে ফেলে
কাতরায়, ফুটি-ফাটা জমি চোষে রাত-কানা হেলে,
স্মৃতিবিস্মৃতির কুশপুত্তলিকা পোড়ে রাত-রাত,
চোখ গেল চোখ গেল চোখ গেল
দে জল দে জল
রাত-রাত...

পুলিপোলাও
.......
উৎসর্গ: বিষ্ণু বিশ্বাস, সৈয়দ তারিক, মনিরুল আলম।


এখন তো সব আমি মেনেই নিয়েছি।
সেই সব সেই সব, সেই হাহাকার-রব, ঠেলে
দিয়েছি কয়েক-কোটি বহুমুখী সুড়ঙ্গের কোনোটিতে, আর ভুলে গেছি;
কী আশ্চর্য সঙ্ঘটনা হবে তা হঠাৎ ফিরে পেলে!
চোয়ানো-ওয়াইন-হেন গ’লে পড়ে ঊষার শিশির,
চোয়ানো-ওয়াইন-হেন ঘনায় দুপুর,
রাতের পাতাল-রেলে ঢুকে পড়ে তারপর পলাতক শির,
টানেলে ফানেলে ডুবসাঁতার- আনখ সমুদ্দুর!
অথচ কীইবা দাবি করেছিনু তোমার নিকটে :
সকল প্রকারই ছিল তুচ্ছ, অবান্তর-
শুধুই প্রকৃতি, শুধু প্রকৃতির উচ্ছিষ্টেই তুষ্ট ছিনু বটে;
না মরে পাষাণ দেশ, দিলা দ্বীপান্তর!
তোমার- তোমারই জন্যে তবু আমি দিবা-বিভাবরী
পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি!


যদি এ-বোতল-বার্তা কোনোদিন পৌঁছে যায়, যদি পৌঁছে যায়,
সেই ঘাটে- যে-ঘাটে একদা যতী বেহুলার ভেলা
ঠেকেছিল বৃহস্পতিবার বারবেলা :
অসম্ভব অঘটন অনুমিত হয়েছিল আকাশের ঈশান কোনায়-
জানি, সেও হবে এক দুর্ঘটনা, প্রকৃতির দুর্গতির প্রায়,
চম্কে গিয়ে থম্কে যাবে হয়তো কোনো ভেঙে-গিয়ে-শুরু-হওয়া মেলা,
যেম্নিতরো ঘটেছিল সেদিন পহেলা
আষাঢ়ে- সেদিন, মানে, সেই অনিশ্চিত আবহাওয়ায়,
পাষণ্ড যৌবন যবে ঈশ্বরের আরশের ভিৎ
ধ’রে চণ্ড নাড়া দিয়ে স্যামসন-সম
বোমার মতন ফেটে বাহিরিতে চায়, আহা, আপনার থেকে,
এমনকি লখিন্দরও যেদিন উঠেছে ন’ড়ে বর্ষার অজস্র অভিষেকে...
আর আজ- এ-বোতল-বার্তা পড়তে পড়তে, প্রিয়তম,
যে-ঋতু আমার মাঝে দেখ তুমি, তার নাম শীত।

১৬
ইছামতি- এই নাম, অক্ষরে অক্ষরে বহমান
সদ্যঃপাতী জীবনের চিরায়ত বামে :
ইছামতি- এই নাম, আর তার ব্যঞ্জনার ধুল-পরিমাণ
অভিঘাতে বাস্তুহারা, আমি, পরিণামে-
এবং আকাশ চিরে আড়াআড়ি সমান দু’-ভাগে
দুগ্ধশুভ্র পারাবত নেমে আসে অন্তরিন রাতে,
সর্ব গর্ভপ্রসূনের পরাগে পরাগে
ঋতুর ঝাপট লাগে- কী যে মোহে মাতে
জীবনের, জননের দোতারার তার!
কী-মায়ায় কমপ্রপক্ষ্ম, ফুল্ল মুখখানি
পলকের তরে ঐ রুপালি রেখার
অধিজ্যামিতির জালে ধরা দেয় : জানি,
ইছামতি- এই নাম, কোনো দেশে উচ্চারিত হয়,
হারাবার ভয়ে যারে স্বপ্ন ক’রে রেখেছে সময়।

২১
কও তোতা, কাহিনি তোমার বাখানিয়া,
টক্কা টরে টরে টক্কা টক্কা টরে টরে
কেমনে আইলা তুমি আধখানা পোড়া পাখা নিয়া
উড়িতে উড়িতে আর পুড়িতে পুড়িতে এই কদলী নগরে?
আহা ও কিসের দাগ লেগে আছে ঠোঁটে
আরক্তিম? জ্যোৎস্নার ঝিলিক্ বুঝি চোখের কোনায়
এক কণা? অথচ তোমার কণ্ঠ বুজে গেছে ঝড়ের ঝাপটে,
কনীনিকা জ’মে গেছে সমুদ্র-নোনায়!
টক্কা টক্কা টরে টরে টক্কা টরে টরে
ক্যান্ বা আইলা, পাখি, কদলী নগরে?
কোন্ বা নমাজ তুমি করেছিলে কাজা,
নতুবা সাবাথে কোন্ করেছিলে আমিষভোজন,
যে, তোমারই শিরে শুধু নেমে এল আকাশের সাজা,
তোমারই জেনিথে শুধু ফুটো হ’য়ে গেল যে ওজোন?

২৪
জানি না কোত্থেকে, কবে, আমি ভেসে এসেছি হেথায়,
এই অতর্কিত দ্বীপে, এই নিরালায়,
যেখানে রক্তের ধূপ নিয়ত জ্বালায়
অগণ্য অমারাত্রির নির্ধারিত, কিন্তু তবু অনিশ্চিত, জন-ুরা; যেথায়
হৃদয় বিদরে, হায়, পুরবৈয়াঁ বায়;
কোথাও, প্রশ্নের তোড়ে, সন্দেহে পাণ্ডুর, তেতালায়,
যদিও মদির কোনো অন্ধকার, অন্ধ কা’রে ছলিয়া পালায়
অসঙ্খ্য সূর্যের চোখে- অব্যয় আভায়-
সাধনায় বেদনায় যারে আমি জানি নি কখনও,
যে-মৌন লুকায়ে রয় নিজকীয় গোধূলিবেলায়, কোনো বন্দি, অন্ধ দেবতার কামনা-নিকোনো
আলোহিম গোধূলিবেলায়,
বিগলিত আপন ছায়ায়। তারে চেয়েছি কি চাই নি তা স্পষ্ট
নয় এই গোধূলিবেলায়। কোন্ ঘাটে, আঘাটায়, কিংবা কোন্ ভ্রষ্ট নষ্ট
রজোধারা- আমার আকাশ থেকে- আঁধারে- অমায়- এই বাস-ুহারা গোধূলিবেলায়!

৩১
একটি অন্ততঃ ফুল না-ঝরুক, একটি অন্ততঃ
সবুজ মুখের রূপ অম্লান রহুক চিরকাল-
ঠাকুরের কানে কত শত
এমতো প্রার্থনা উড়ে যায় ফি-সকাল...
উড়ে যায় ও হারায়- কোথায়, দেবতা
নিজে তা জানে না (যদি জানার উপায়ও তার থাকে;
কেননা অকর্ণ সে তো- এত মানুষের এত কথা
শুনিবে যে, বয়রা হওয়াই লাগে তাকে)।
আমি দেবতাকে নয়, নিজেকেই বলি, ওরে মন,
একটি ছবিকে তুই ধ’রে রেখে রেটিনার পিছে,
তা-ই দেখে পার ক’রে দে রে এই জঙ্গম জীবন
যাবৎ অচিন পাখি খাঁচায় নাচিছে-
যেমন মাসুদ খান এঁকেছেন তূর্ণ ট্রেনে আলোকবধূর
পিত্রালয়ে যাওয়া -নাম্নী কবিতায়, তেমন রঙিন, বহুদূর!

৩৫
ঋতু রুদ্ধ হয়েছে আমার,
ঝ’রে গেছে জরায়ুর মুকুল সকলই,
থেমে গেছে আদিগন্ত কোকিল-কাকলি,
তবু কি রে ক্লান্ত হয় জন্তু কামনার?
এই যে মোহন পূতি- নন্দনবনের নর্দমার,
ভুবন-বিসার এই কস্তুরীর আবিল আমোদ,
কোথায় পালাই আমি এর থেকে, এই বেশুমার
ঘাম, রক্ত, রোদ,
পুরাতন দেহ ফেটে বের-হ’য়ে-আসতে-চাওয়া এ-নূতন বোধ,
এই গ্লানি, অপমান, পূর্ণ-পরাজয়
গুঁড়ো ক’রে উড়ে-আসা বোমারু এ-ক্রোধ!
দ্বিতীয় ঋতুর মতো এই রক্তক্ষয়-
এই প্রেম! এই শিশু- এর কাছে কার
শরীর গড়িয়ে আসবে খেলনার আকার?

৪৪
কোথায় আমার ঘর? কে-ই বা আপন? কে বা পর?
মোছলমানের দেশে জন্ম মম নাছারার কুলে!
অবস্থা এমন, হায়, প্রায়শঃ কাপড়-জামা খুলে
পরীক্ষা করিয়া দ্যাখে কেমন নাগর।
কেহ কহে- ‘মদ খায়!’ কেহ-বা- ‘শুয়োর!’
‘গোছল করে না এরা, আজন্ম নাপাক!’
অথবা- ‘এখনও খৎনা হয় নাই ওর!
এমনও আদম নাকি পয়দা করেন আল্লাপাক!’
- অতঃপর আসিলাম খেরেস্তানি দেশে :
কেহ কহে- ‘শুয়োর কি চলে, বাছা? গোরু? মাংস? মাছ?
শুনেছি তোমার দেশ ফি-বছর দলাদলি, মৌলবাদ, ঘূর্ণিঝড়ে, বানে যায় ভেসে-
আমরা রিলিফ দিই; তবু কেন রিফ্যুজি-দূষিত করো আমাদের সচ্ছল সমাজ?
‘তোমার দেশে কি আছে মানবাধিকার, আর গণতন্ত্র, অন-র্জাল, বিশ্ববিদ্যালয়?
অনেক দেখেছ, বাপু, সাহেববাড়ির বৈঠকখানা, এইবেলা ভালোয় ভালোয়...’

৪৫
নীরবে এসেছি ভেসে, এসেছি একাকী,
মানচিত্র-বহির্গত গোধূলি-বাঁধুলি-রাঙা দ্বীপে,
বাংলাদেশের এক ছোট্ট কালো পাখি-
বেঁধেছি বিবিক্ত বাসা বাত্যা-ভাঙা ক্লিফে।
এসেছি যেখান থেকে সেথা ছিল অস্তি নঞর্থক,
সদর্থক নাস্তিময় বর্তমান এই অন্তরীপ-
যা ছিল তা ছিল না কো, যা আছে তা নাই- ভয়ানক
বিপ্রতীপে বিপ্রতীপে চ’লে চলে আমার জরিপ।
এসেছি উড়ে কি আমি? উড়ি নাই। আমি শুধু নিশ্চল ছিলাম।
আকাশই এগিয়ে গেছে, অথবা পিছিয়ে, আমি কিছুই জানি না।
জানি নি- কখন বাস্তু হয়েছে নিলাম।
ঘুম থেকে জেগে উঠে (অথবা ঘুমিয়ে প’ড়ে) দেখি সবই কেমন অচেনা!
অবশ্য সকলই তবু খাড়া বড়ি থোড় আর থোড় বড়ি খাড়া-
শুধু- আর কোনোদিন, কোনোদিন, কোনোদিন দেখব না একখানা দোহারা চেহারা!

৬০
কে-সব কী-সব বলে আমার মাথায় অবিরত?
কিছুই বুঝি না আমি- বিজাতীয় সেইসব কথা,
টর্নেডো করেছে খাড়া আমার মগজে তারা বাবেলের মতো-
এ নির্বাক্ কোলাহল, নাকি এ সবাক্ নীরবতা?
আমি কান বন্ধ করি, প্রাণের ভিতরে তারা বাজে,
অজস্র ঝিঁঝির ডাক কর্কট রোগের মতো পাঁজরে চ্যাঁচায়,
আমাকে বাজায় তারা অপার্থিব বেতার এস্রাজে-
আমাকে তারের মতো কেবলই আমার সাথে গিঁট দেয়, কেবলই প্যাঁচায়।
পরিশেষে পাসরি মায়ের বুলি, মায়েরে পাসরি,
দিব্যি কথা ব’লে চলি অসঙ্খ্য ছায়ার সাথে, তাদেরই ভাষায়,
আমার চুটকিতে, হায়, জ’মে যায় যে-কোনো আসরই-
আমার যে-কথা নিজে বুঝি না, সে-কথা, আহা, সবেরে হাসায়!
এ-আমি কে? এ-আমি কী? ও মা, তুমি দেহো দরশন!
দশ-হাতে আঁধার সরিয়ে করি তোরই অন্বেষণ।

৬৪
সহসা আশ্চর্য এক আলো ভায় : বুকে বাজে আখেরি আজান-
গায়ের নরম রোম তৎক্ষণাৎ শক্ত হিম শজারুর ঝাঁটা...
কে জানি দেয়ালা হাসে বিড়ালের পারা, বলে, ‘চলেন, বাজান!
আল্লারসুলের নামে ভিতরে বাড়ান ডান পা-টা।’
আমি আঁৎকে উঠে কই, ‘সে কী কথা! আমি কেন, আলা হজরত?
অন্য লোকে মরে-টরে, অ্যাক্সিডেন্ট্ করে, কলে হাত-পা হারায়,
ফাঁসি যায়, চাকু খায়, পুড়ে মরে, ডুবে মরে, আচমকা বেমক্কা অক্কা পায়-
সেসব কাগজে পড়ি, টিভি-রেডিওতে শুনি, তারপর হাঁটি নিজ পথ,
যে-পথ অন্যের নয়- যারা মারে, মরে যারা, যাদের জীবনে হয় নানা খুনাখুনি...
ভালো কথা। আমি কী করিতে পারি তাহার বিহিত? আপনি ভুল ঠিকানায়,
ফেরেস-াপ্রবর!’ তিনি না-কন কিছুই, শুধু জেব খুলে দেখান তখনই
প্রজাপতি চিহ্ন এক... উচ্চক্ষু কাতরে ভনি, ‘অ্যাই বাপ, তোরে কি মানায়
এ-নৃশংস শিশুহত্যা!’- পবনেতে জগন্ময় উঠিল গুমরি’
পাঁজরের শূলব্যথা : ‘তুমি কেনে থাক, সাঁই, আমি কেনে মরি!’

(সিডনি, ১৯৯৫-২০০১)



ম্যাকাবার
......
কালোর চেয়ে কালো কেবল রাত আছে,
তারচে’ কালো প্রেম কেন তোর কল্পনা?


কালো বিদ্যুৎ চমকায়, আহা, শোঁ-শোঁ কালো হাওয়া ধমকায়, ভাই,
কালো সূর্যটা জ্বেলে কালো রোদ প্রাণ জড়ে মোর শঙ্কায়, ভাই।
আমি কোন্ দিকে কোন্ বোন-ঝিকে ডাকব, বাড়ায়ে অন্ধের হাত!
ভালো কালো রাত, কালো আখেরাত, কালো ধারাপাত কর্ আঁধিয়ার;
সকল কালোর সেরা কালো তুই,- আয়, আমি শুই- শব-এ-বরাত!
গ্র্যানিট-কঠিন এ-কফিন মম আজ হোক তমোপহ হাতিয়ার!
কালোতে কালোতে কাটাকাটি হবে, লাঠালাঠি হবে লঙ্কায়, ভাই,
রগ-রঙ-চটা কালো সূর্যটা নীল হ’য়ে যাবে শঙ্কায়, ভাই!


কে তুমি কালো রাতে এসেছ আলো হাতে, বালিকা?
কোথায় ছিলে তুমি নীল-নিখিলে, ভূমিপালিকা?
আমি তো আমাতেই ছিলাম ঘামাতেই মাথাকে
কে তুমি অগোচরে ছিলা এ-চরাচরে, সকলই
আট্কে রেখে নখদর্পণের দখলে, কাকে
গেঁথেছ অক্ষিতে- সে যে এ-ধক্কিতে, ধকলই!
কোথায় তারে নিয়ে যাবা রে ছিণ্ডি’ এ-জালিকা?
কেন গো কালো রাতে মেতেছ কালোয়াতে, বালিকা?

(সিডনি, ২০০৩)


শাহ্ মখদুম
.......
রাত : সম্নাম্বুলিস্ট্ ট্রেনটা ছুটে যায়, সুনসান
শূন্যমার্গে; যেন মর্গের দেরাজে দেরাজে লাশ
বার্থে বার্থে হিমায়িত ঘুম-গুমসুম ইনসান;
রাত-কানা এক টিকেট চেকার করে খানাতল্লাশ।

উৎকণ্ঠার ন্যায় নিঃসীম পদ্মার বিস্ফার,
শাহ্ মখদুম দুম দুম হয় হার্ডিন্জ্ ব্রিজ পার।

রাত : ছাইচাপা আপার বার্থে ধূমপিণ্ডের মতো
গুলে-যাওয়া কোনো প্রত্যঙ্গের করি অনুসন্ধান,
চোখ কান হাত চুল নখ দাঁত ছড়ায়ে ইতস্ততঃ
ঢুঁড়ি লাপাত্তা আত্মা আমার- হৈহৈ হয়রান।

উৎকণ্ঠার ন্যায় নিঃসীম পদ্মার বিস্ফার,
শাহ্ মখদুম দুম দুম হয় হার্ডিন্জ্ ব্রিজ পার।

তিরিশ পাখির মতো উড্ডীন এক-ট্রেন খণ্ডতা,
মহান্ সেমুর্গ্ আর কত দূর? পোড়াদহ জংশন
আর কত পথ? শত শত প্রাণ শুষে নিয়ে, অন্ধটা
কই আমাদের নঞ্ হ’য়ে, হায়, ব’য়ে যায় শন্ শন্?

উৎকণ্ঠার ন্যায় নিঃসীম পদ্মার বিস্ফার,
শাহ্ মখদুম দুম দুম হয় হার্ডিন্জ্ ব্রিজ পার।

রাত : তকরার- একবার যদি পড়শি আমায় ছুঁতো!
গলন্ত-লোহা-বহা যমুনায় খেয়া দেয় নিশি-কানু;
শরীর পালায় শরীরীকে ফেলে; সময়ের চেয়ে দ্রুত,
একটা মানুষ হবে ব’লে, ছোটে এক-ট্রেন শুক্রাণু!

উৎকণ্ঠার ন্যায় নিঃসীম পদ্মার বিস্ফার,
শাহ্ মখদুম দুম দুম হয় হার্ডিন্জ্ ব্রিজ পার।

(সিডনি, ২০০৪)

কাকে?
.....
তুষারে-ঢাকা তোমার লাশ
বেরিয়ে আছে একটা শেষ
কুঁকড়ে-থাকা আঙুল-
আমি মাড়াই তোমার বুক,
পাথর-যোনি, হিম চিবুক,
রক্ত-জমা জানু,
ঊষর কেশ-

পেঙ্গুইন, মেরুভালুক-
দুই আকাশে নাচে আলো-
মধ্যে সব সবুজ
গ্র্যাফাইট-গাঢ় কুজ্ঝটিকা,
অন্ধকূপে ঊহ্য শিখা,
তবু আমার সবুর
অনিঃশেষ।

(সিডনি, ২০০৯)


অনুবাদ কবিতা
.........
মাহমুদ দারবিশ
আমি গণহত্যা দেখেছি

আমি গণহত্যা দেখেছি, একখানা
মানচিত্র মেরেছে আমাকে
সরল কথার আমি ছানা
দেখেছি কাঁকর-খোয়া উড়তে ঝাঁকে-ঝাঁকে
দেখেছি নীহারকণা বোমার মতন ঝ’রে পড়তে
মুখের উপরে হায় আমার মনের দরজা বন্ধ করল ওরা
কার্ফিউ কায়েম করল, ব্যারিকেডে রাস্তা ভরল ওরা
আমার হৃদয় বদ্লে গেল সরু একটা গলিতে
বদ্লে গেল পাঁজর পাথরে
আর, কার্নেশন ফুটল থরে-থরে
আর, কার্নেশন ফুটল থরে-থরে

ডব্ল্যু বি ইয়েটস
তিন ঝাড়
......
বলল রমণী একদা প্রিয়েরে তার,
‘হায়, সেই প্রেমে আস্থা রাখে না কেউ
যে-প্রেমে সঠিক খাদ্য অপ্রতুল;
আর, যদি তুমি হারাও সে-প্রেমকেই
গাইবে কীভাবে আর ও-প্রেমের গান?
ত্রুটি যে আমার সত্যিই অতিকায়।
ও প্রিয় আমার, ও প্রিয় আমার।

‘কক্ষে তোমার প্রদীপ রেখো না জ্বেলে,’
বলে রমণীয়া রমণী সে পুনরায়,
‘গোপনে, যখন রাত্রি দ্বিপ্রহর,
আসব তোমার অপেক্ষ শয্যায়,
নিজেকেই নিজে যদি তা করতে দেখি,
মনে হয়, আমি ম’রে যাব লজ্জায়।’
ও প্রিয় আমার, ও প্রিয় আমার।

‘গোপনে গোপনে ভালবাসি আমি তাকে,
দাসী রে আমার, বলি তোকে, বলল সে,
‘আমি জানি, আমি ম’রে যাব বুক ফেটে
যদি সে তিলেক আমাকে ভালো না বাসে,
কিন্তু আমার শুচিতা নিছনি দিলে
তখনই-বা প্রাণ ধরব কীভাবে, কীসে?
ও প্রিয় আমার, ও প্রিয় আমার।

‘কাজেই, তোকেই শুতে হবে তার পাশে,
ও যেন ভাবতে পারে যে আমিই সেটা।
আর, মনে হয়, আমরা সবাই একই
জ্বলে না যখন কোনোই প্রদীপ সেথা,
আর, মনে হয়, আমরা সবাই একই
যখন শরীর- ঢাকা নয় পোশাকে তা।’
ও প্রিয় আমার, ও প্রিয় আমার।

না-ডাকতে কোনো কুকুর, ঘণ্টা-ধ্বনি
মধ্যরাতের- শুনে সে বলত নিজে,
‘ভাগ্যে মাথায় এসেছিল চিন্তাটা,
কী-সুখী আমার প্রিয়েরে দেখাচ্ছে যে’;
অথচ যখন দাসীটিকে সারাদিন
ঝিমাতে দেখত- ব্যথা কি উঠত বেজে?
ও প্রিয় আমার, ও প্রিয় আমার।

‘না, আর কোনোও গান নয়,’ বলল সে,
‘কেননা প্রেয়সী এসেছিল চুপিসারে
এক-সাল আগে পয়লাবারের মতো
দুপুর-রাতের প্রহরে আমার ঘরে,
এবং ঘড়ির ঘণ্টাটি বাজলেই
শুতে যে হবেই আমাকে চাদর মুড়ে।’
ও প্রিয় আমার, ও প্রিয় আমার।

‘হাসি-কান্নার গান, পবিত্র গান,
কামনার গান’- বলেছিল লোকগুলো।
কেউ কি কখনও শুনেছে অমোন গান?
না- কেবল তারা সেইদিনই শুনেছিল।
কেউ কি অমোন হাঁকিয়েছে ঘোড়া আর?
না- শুধু সেদিন সে-ই তা হাঁকিয়েছিল।
ও প্রিয় আমার, ও প্রিয় আমার।

কিন্তু যেমনি ঘোড়াটির এক খুর
ইঁদুর-গর্তে গেল বিলকুল ঢুকে,
মাথা নীচে দিয়ে প’ড়েই সে ম’রে গেল
তার প্রেয়সীর চ’ক্ষের সম্মুখে-
হায় সে-ও ম’রে গেল যে তৎক্ষণাৎ,
এমনই আঘাত বেজেছিল তার বুকে।
ও প্রিয় আমার, ও প্রিয় আমার।

দাসীটি কেবল বহুদিন বেঁচে তার
কবর-দু’টির তদারকি করে, আর
দু’-কবরে দু’টি বুনেছিল সে যে ঝাড়;
যখন সেগুলি বড় হ’ল, তো সবার
মনে হ’ত, একই শিকড়ে তাদের বাড়,
গোলাপও তাদের মিলেমিশে একাকার।
ও প্রিয় আমার, ও প্রিয় আমার।

যখন দাসীর মরণের এল কাল,
পুরুত এসেছে তার পাপ-নিরাময়ে,
গোপন যা-কিছু ক’য়ে দিল বুড়ি তায়।
তাকিয়ে থাকল মুখে তার মূক হ’য়ে
পুরোহিত, আর সে ছিল সমঝদার,
বুড়িটার কথা শুনেছিল সে হৃদয়ে।
ও প্রিয় আমার, ও প্রিয় আমার।

কবর দিতে সে বলল সে-দাসীটার
তার কর্ত্রীর প্রিয়ের অপর পাশে,
তার কবরেও লাগাল গোলাপঝাড়,
আর তারপর যে-কেউ সেখানে আসে
গোলাপ তুলতে ঝাড়গুলি থেকে, কার
শিকড় কোথায়, জানতেই পারে না সে।
ও প্রিয় আমার, ও প্রিয় আমার।

1 টি মন্তব্য:

  1. সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ দা’র কবিতা সবসময় উপভোগ করি। বায়োজীদ বোস্তামি- কালজয়ী

    উত্তরমুছুন