রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

কবি নৃপ অনুপ-এর সাতটি কবিতা







নৃপ অনুপ প্রণীত ত্রিশঙ্কুর কররেখা কাব্যগ্রন্থ অর্ন্তভুক্ত ডাকপত্র হতে প্রকাশিত...

প্রতি,
নিঃসঙ্গ পতন

তোমার পত্র পেয়ে এক আকস্মিক আনন্দ পেলাম এবং একই সাথে তোমাকে চিনতেও পারলাম না।

কাহিনি হল, ফেরার পথেই ছিল রোদের ডাকঘর, সেই ছাঁদহীন ঘরে মরনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে তরঙ্গভঙ্গের সুর। সেই সব সুর নিয়ে পাঠাভ্যাসের মতো গড়ে তুলি আপনার চিন্তা-প্রাচীর। বহু জ্ঞান-অজ্ঞান এসে জড় হলো সাজানো মগজে। বহু বহু খেলা শেষ হয়ে আরও কত খেলার আয়োজন হলো শুধু তুমি নেই আজ এই বাহুল্যে।

প্রতিবার পতনের পরে এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততায় ডুবে যায় বাতিঘর। তবুও ঠিকঠাক গড়ে উঠে আজব বিমান। মহাকাশের রেস্তোরায় বিক্রি হচ্ছে না কি গোলাপি বার্গার? আর এই বাঙলায় বয়ে গেছে পথের রেখা; বয়ে গেছে কতোসব বাউলা নদী। খরার কালে মাটি হিংস্র হলে বন্যায় ডুবে যায় তুলে রাখা ছাতি।

যদিও মৃত্যুরে ডরায় পাখি-
বেঁচে থাকাই জীবের মৌলিক লোভ।

আজ এই পর্যন্তই;
সময় আমাদের পথ নির্ধারণ করে দেবে।
আপাতত পূর্বপুরুষের ক্ষতচিহ্ন
আমরা যে যার শরীরে মেলে দিয়ে
উড়াতে পারি এমন এক পাখি
যে কেবল পতনের দিকেই চেয়ে থাকে...

ইতি
নৃপ অনুপ
১৮.০৮.২০০৭



আগুনলতা সিরিজ কবিতা

আগুনলতা
২য় পাঠ

এবার তোমার চোখ থেকে নয়, কন্ঠ থেকে
ঝরাবো আমি সেই বরষার গান।
ডাকবে ময়ূর পেখম মেলে, দূর পরবাস গাঁয়,ডাকুক না হয়!
কাদলে কাদুক আমার আত্মা,
কোথায় সত্য, কোথায় স্বত্ত্বা?
কোদাল হাতে ঝাঁপ দিয়েছি, গোড় খুড়েছি নিজের জন্য
তোমার জন্য এই শশ্মানে দাওয়াত পত্র নাই।
বরঙ তুমি কণ্ঠ থেকে ঝড়াতে পারো
বৃষ্টি এনে, আমার এপিটাফে!
এখন তোমার মন থেকে নয়, মনন থেকে তুলবো টেনে-
নীল সাগরের অন্তরঙ্গ ঢেউ।
ভাসবে আমার ছোট্ট ডিঙি, ভাসুক না হয় এই অবেলায়।
দিন চলে যায়, দিন আসে ফিরে ঘরে
তোমার জন্য মোমের আগুন একলা জেগে থাকে।
শোন মেয়ে বলছি তোমায়, গহীন থেকে কাব্য ঝড়াও
অন্ধ করে হলেও দাও বজ্রপাত, তেমন অন্ধকারে
মেঘদল আজ উড়ছে দেখো তোমার অসীম সুরে,
আমার নৌকা আবার ভাসবে সুরের সমুদ্দুরে।



আগুনলতা
৮ম পাঠ

না দিতে পারি হীরের আঙটি, নাকের নোলক ফুল
এই কি ছিল হারানো দিনের প্রাথমিক যত ভুল।
পারি নি দিতে সত্যি বলতে ‘আমার চোখে দেখতে শেখা’
কিন্তু আমি চাই যে বড়ো, নিজের চোখেই ভূবন দেখা।
শুনি নি আমি ক্ষ্যাপাটে বলে, নিজেরই মুদ্রাদোষে
তাই বলে কি ছুঁড়ে দিয়েছি, তেপান্তরের মাঠে...
বধূ তুমি একলা হেঁটে চলো কোন নক্ষত্রের তলে
মাথার উপর উড়বো আমি, বর্ণচোরা মেঘের রঙে।
পারি নি কি দিতে সেই মহুয়া ঘ্রাণের তলে?
যখন বাড়িয়েছিলে হাত- চন্দ্রের দিকে মেলে অসীম শূণ্যতায়;
চাও নি কি- এই হাতে আর কোন হাত এসে
হৃদয়ের বন্দরে ছোয়া দিয়ে যাবে। পলাতক প্রস্থানে
বিপন্ন নই সরলা, আমি শুধু ভাবছি এখন এই গুহাতে-
মানুষের মুক্তি বলো- কোথায় গিয়ে মিলতে পারে...



আগুনলতা
১০ম পাঠ

যেন এক নির্বিকার ঘড়ির পেন্ডুলাম হয়ে, হায়!
দোল খাই পুর্ণিমার রাতে, জ্বলে নাই জলে তবু আলো।
কি যে এক বিবমিষা ঋদয়ের নির্জনে একা ওঠে কেঁদে,
পুষে রাখা আত্মহননমুখী পাখিটি- কেবলি উড়তে চায়।
মানুষকে বিশ্বাস করে মাঝে-মাঝেই মনে হয়,
পৃথিবীর সবথেকে অবিশ্বস্ত কাজ, করে ফেলেছি আজ!
আপোষের নৈকট্যে থেকেও চতুর হরিণীর মতো তুমি-
চুরি কর স্বপ্ন আর ব্যাধিনীর মতো ছুঁড়ে দাও মৃত্যুসুধা।
হায়রে আমার পথের ধূলা; পদ্মার পাড়ে উড়িয়ে বাতাস
শুনছো কি আজ, কীর্ত্তনখোলা কেমনে তোলে সুর।
পৃথিবীটা এক গোলাকার এ্যাসট্রে; আর আমি নিত্যদিন-
ওই বিষাক্ত এ্যাসট্রেতে ছাইসহ আনুসাঙ্গিক দ্রব্যাদি ফেলি!
আকাশের কনসার্টে নদীদের বোধোদয় ঘটে; আর তাহারা'তো
নিরিবিলি মুক্ত হতে চায় আপনার কাছ থেকে, কবির দৃষ্টি থেকে...



আগুনলতা

জানালার ওধারে বাজখাই কণ্ঠে ডেকে যায় ক্ষুধার্ত কাক,
ঘুম মগ্ন আমি যেন চোখ বুজলেই পাই, আমাকে ভীষন।
পায়ের স্মৃতিচিহ্ন ধরে ছেড়া-ছেড়া দ্বীপে নিভৃতে খুঁজে চলি
শকুন্তলাকে। দুষ্মন্ত নয়, কৃষ্ণের রূপ ধরে ফিরে ফিরে আসি।
আর বাসিতে কেবল জমাতে থাকি প্রাণের প্রেমের অগ্নিগিরি,
‘সত্যম শিবম সুন্দরম’- ঘুম ভেঙে আনমনে যদি বলে উঠি-
লোকসমাজের ভীরে। তাহলেই যেন তকমা লেগে যাবে গায়ে;
কিন্তু ততক্ষণে আমি শকুন্তলা সমেত পাহার ঘেষা সাগর সংলগ্নে...
জোয়ারের দুঃখ শব্দে, কখন যেন রাত ভেঙে হয়ে গেলো ভোর
কখনো কি বলেছি বলো, মেঘ এলে ছড়িয়ে দেবো তীব্রতার রোদ।
চোখ খুলতেই তুমি আর তুমি থাকো না, হয়ে যাও দূরবর্তী
ঘরভর্তি অন্ধকার ছেড়ে পথে নামতেই শুধু মানুষের হুড়োহুড়ি।
এখন অনেক রাত, তোমার ঘরে জ্বলছে হয়তো সিকিউরিটি আলো
শকুন্তলা, আমার এখন ধ্যাণের সময়- এভাবে রাত্রিও ফুরাইয়া গেলো...



আগুনলতা
১৫তম পাঠ

আকাশ ঢেকেছে আজ বিল্ডার্সের পাহাড়সাম্রাজ্যে
স্বপ্নমনের সৈকতে শুধু নোঙর ফেলছে যুদ্ধজাহাজ।

বাড়িওয়ালাদের খিস্তি-খেউর,
বাক্সবন্দী লম্পট প্রেম অলি-গলি খেলা।
বিলবোর্ডের আলোয় ভেসে তুমি
নগরের মোড়ে হারিয়েছো আজ প্রসূত বেদনা!

একদিন এই বেদনার গান
তোমার একার শহর থেকে দূরে,
আমাদের এই দেয়ালের ক্ষতে
জাগাবেই জানি আদিমত্তার অবাধ আনাগোনা ।

আপাতত কবি পথ থেকে দূরে
চাষ করে নেয় বিপথের সব দৃশ্যকল্প
মধ্যরাতের একাকীত্বের সঙ্গীতে,
উঁচু ভবনের গরাদ ভেঙে নামে নিয়নআলোর কান্না...



রাজ্যহীন রাজা

হায়রোগ্লিফিক্সের চেয়েও আদি অথচ প্রথম প্রেম ছায়ার উষ্ণতায় বাষ্পীভূত হলে আকাশেতে মেঘ করে। জলাধারে নির্বিবাদে গবাদির তৃণ খাওয়া দেখে তৃষিত ফড়িঙ উড়ে যায়। পরে থাকে বৃষ্টির সংসারী জল, ঘাসপিতার কোলে। ওদিকে বাতাসের ব্যালেড্যান্সে ছুটে যায় বৈদ্যুতিক সাপ মেঘেরও অলক্ষ্যে; আমাদের রহস্যাকাশে শুধু বাইনস্টার ফুটে রয়!

চেয়ে দেখো নার্সারির গোলাপ বাগানের দিকে- কতখানি ইউরিয়া নির্ভর? এইকথা বলে উড়ে গেলো প্রাণভ্রমরা পত্রহীন বৃক্ষের কাছে। যার তলে জীবছায়া বিচরণ করে, বাদুরেরা কোলাহল থামিয়ে আঁকে নিশাচর নদী। অথচ মনের সুখ মরে যায় মাঠে; শখ চলে যায় জানালায় মাথা রেখে থেমে থাকা দৃশ্যের গহীনে। মাথার শিয়রে বসে থাকা ধর্মগ্রন্থ ভাবে, একদিন এইসব পুঁথি ভেসে যাবে হাওয়ার ঘরে। জ্বলে উঠবে লন্ঠনভাতি। ওদিকে ধীবরের ছুড়ে দেওয়া উড়ন্ত জাল একরাশ শুন্যতা নিয়ে সমুদ্রের উপকণ্ঠে পড়ে। এই দেখে উড়ে যায় দুইটি সারস একটি সূর্যের ডাকে।

বহু পুরাতন আমি... বহুবার নানারূপে এসে ফিরেও গিয়েছি এইসব রেখে। নিঃশব্দে অজস্র্ নদীর থেকে তুলে দেয়া পথে রাখা হলে পা অফেরা গ্রাম শুধু ডাকে। সেইখান থেকে দুইহাতে তুলে দেখি প্রকৃত চাঁদের রঙ কতখানি সূর্যের মতো! শুনে চলি অফুরান বিস্ময়ে নক্ষত্রের হাসি, ছুটে চলা যুগ্ম শালিকের দিকে চেয়ে।

যা-যা কিছু বর্ণের বাইরে, রূপের অলক্ষ্যে তার কিছুই দেখি নি আমি। যেমন দেখে না পাতা, ঝড় শুরু হয়ে গেলে শিকড়ের ভীত মুখখানি। জীবনের অবসাদলিপি পাঠ করে নেমে আসে অন্ধকার আর বাদুরেরা ফিরে পায় আলোকরশ্মি।

জনাকীর্ণ পৃথিবীর চূড়ান্ত ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে দাঁড়িয়েও আমি এক রাজ্যহীন রাজা, করে চলি রাজার সাথেই তাই জেহাদ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন