শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

বৈশাখী পূর্ণিমার আলো-অন্ধকার : কবি মোহাম্মদ রফিক


মোস্তাক আহমাদ দীন


পাঠ্যতালিকাভুক্ত লেখার কথা বাদ দিলে, কবিতা-পড়ার সূত্রপাত নির্মলেন্দু গুণের কবিতার মধ্য দিয়ে, তখনও শামসুর রাহমানের কোনও কবিতাবই এককভাবে পড়া হয়নি¬¬; এর পর, একদিন কিনে পড়া হয়ে গেল জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন ; পড়ার পর, ‘হাওয়ার রাত’, ‘কুড়ি বছর পরে’, ‘ঘাস’, ‘নগ্ন নির্জন হাত’ প্রভৃতি কবিতা হৃদয়ে স্থান করে নিলেও, কাব্যসংস্কারহেতু বইয়ের কয়েকটি ক্রিয়াপদ ও অনুষঙ্গকে মনে হয়েছিল অনাধুনিক, এবং গতানুসারী। জীবনানন্দকে না-বোঝার কারণে সেকালের সজনীকান্ত দাসকে দোষ দিয়ে কী লাভ, একালের আমি নিজেও তখন প্রত্যক্ষত রাহমান-সুনীল-গুণ আর পরোক্ষত মান্নান-সিকদারপন্থী, এবং নিজের গ্রহণদৌবল্যহেতু জীবনানন্দের প্রতি দ্বিধাশীল। তখনই কারও লেখায় পড়ে থাকব, আধুনিক কবিতায় পথ-এর বদলে রাস্তা, সাথে ব্যবহার না-করে সঙ্গে ব্যবহার করা উচিৎ¬-এই সময় বইয়ের দোকানে ধুলোর সংসারে এই মাটি, মেঘে এবং কাদায় চোখে পড়ে থাকবে, যা ছুঁয়ে-দেখে আবার রেখে দিতে মনে এতটুকু কুণ্ঠা জাগেনি; তারও কিছু পরে, কপিলা নামটি শুনে মনে হয়েছিল একটি উপন্যাসের চরিত্রের নামে নাম রাখার মানেটা কী? এই নাতিবিরক্তিই পরে চরমে পৌঁছয় যখন দেখি তাঁর আরও একটি কবিতাবইয়ের নাম-যেটি তাঁর প্রথম বইও বটে-বৈশাখী পূর্ণিমা, সেদিন- এখন বলতেই লজ্জা লাগছে যে-খাঁটি রবীন্দ্রপন্থী বলে তাঁকে উপেক্ষা করে নিজেকে গর্বিতই মনে হয়েছিল এবং নিরভিজ্ঞ ছিলাম বলে তাঁকে একবারের জন্যেও গৌতম বুদ্ধের অনুরাগী মনে হয়নি।

দুই
কীভাবে মনে হবে, তখন বৈশাখী পূর্ণিমা চেখে দেখা তো দূরের কথা, চোখে দেখাও হয়নি, তবে ইতোমধ্যে পড়া হয়ে গেল মান্নান সৈয়দের পরাবাস্তব মায় সচিত্রসংবাদী/প্রতীকী কবিতা, সিকদারের পার্স/পাজ-প্লাবিত ঠান্ডা পাথরের মদির জগৎ, আর ঘোরা হয়ে গেল রাহমানের চিড়িয়াখানাও; পড়ে, ঘুরে কখনও-সখনও ক্লান্ত হলেও-রফিকের সশব্দ পদচারণা সত্ত্বেও-পড়া হয়ে ওঠেনি তাঁর কবিতা। তখন মোহাম্মদ রফিক পড়ব কি, ইন্দ্রিয়-সুখকর আর মগজ-উত্তেজক নয় বলে রবীন্দ্রনাথও তো পড়া হয়নি; এবং প্রাসঙ্গিক কারণে স্বীকার করা উচিৎ, তখনও পড়া হয়নি বুদ্ধের জীবনীও। তবে, তখন ঠিকই পড়ছি বোদলেয়ার-র‌্যাঁবো আর মনে-মনে খুঁজে চলেছি সেই রকমেরই কবিতা, কিন্তু তখনও এই কথাটি মনে জাগে¬নি যে-জীবনকে পা-মাথা-কাঁধ বুক-পিঠ যেদিকেই দেখা হোক না কেন, চোখের অধিকারীকে শেষপর্যন্ত দাঁড়াতে হয় তার নিজের জলমাটিআগুনের মধ্যেই।

তিন
নতুন শিং-ওঠা এই আধুনিক পড়–য়ার একদিন বোধোদয় হলো, অথবা বলা যেতে পারে বোধিলাভ ঘটল কীর্তিনাশা, খোলা কবিতা বা গাওদিয়া পড়ে নয়, বৈশাখী পূর্ণিমা পড়ে। ইতোমধ্যে বুদ্ধচরিত পড়ে জানা হলো, বুদ্ধের জন্ম যেমন বৈশাখী পূর্ণিমায় তেমনই তাঁর নির্বাণও ঘটে একই দিনে; কিন্তু মোহাম্মদ রফিকের কবিতার বইয়ের নাম বৈশাখী পূর্ণিমা কেন? বইয়ের নামকবিতার যে-বিষয় তার সঙ্গে কি বুদ্ধের জন্ম বা তাঁর নির্বাণ-এর কোনও গূঢ় সম্পর্ক রয়েছে? খুঁজলে, সম্পর্ক-দুঃসম্পর্ক কিছু একটা পাওয়া যাবে হয়ত, কিন্তু এই সবকিছু পেরিয়ে সেই ভাবনাটাই জাগে : একজন কবি, যিনি বহুদূরের যাত্রী, তাঁর প্রথম বইয়ের নামের আড়ালে কবিজীবনের কোনও বিশেষ সূচনাবিন্দুর নির্দেশ দিয়ে যান কি না? এই প্রকারের চিন্তা যখন অনেকদিন ধরে তাড়িত করছিল, তখনই একদিন চোখে পড়ে মোহাম্মদ রফিকের একটি লেখা ‘আমার প্রথম বই : বৈশাখী পূর্ণিমা’, যেখানে তিনি লেখেন :

কেউ হঠাৎ করে শুধু অকারণ উৎসাহেও জিজ্ঞাসা করে বসতে পারেন, কাব্যগ্রন্থটির কেন নাম দিয়েছিলাম ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’। আমি কৈশোর-যৌবনের সেই টালমাটাল দিনগুলোতে গৌতম বুদ্ধের ভীষণ অনুরক্ত হয়ে পড়ি। অমি বিশ্বাসী নই, অবিশ্বাসীও নই। এমনই আমার চৈতন্যের ধারা সেই কাল থেকে। ...সেই অর্থে আমার তো অনেক দূর যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যাওয়া হলো কই। কিন্তু বেশ কয়েক যুগ হয়ে গেল ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে গ্রন্থটির যথারীতি অন্তর্ধানও ঘটে গেছে অলক্ষ্যে।

এরপর একই লেখার বি. দ্র. অংশে লিখেছেন :

২৫ মার্চের আগে স্বল্পসংখ্যক বই-ই দোকানপত্তরে গোছানো গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে লেখক-প্রকাশক উভয়েই নিয়োজিত ছিল অন্যত্র যুদ্ধসংক্রান্ত বিভিন্ন কাজকর্মে। বইগুলো সমগ্র জাতির সঙ্গেই মুক্তির দিন গুনছিল বন্দিগুমোটে, গুদামে। সেখানেই পঞ্চত্ব্প্রাপ্তি ঘটে ক্ষীণায়ু বৈশাখী পূর্ণিমার।

পুরো লেখাটি-বিশেষত উদ্ধৃত অংশ দুটি-পড়ে, যে-কোনও পাঠকের মনে হতে বাধ্য যে, তাঁর কাব্যপরিক্রমার শুরুতে বৈশাখী পূর্ণিমা বইয়ে কোনও সম্ভাব্য যাত্রার এমন কোনও সূচনাবিন্দু ছিল; কারণ, তাঁর লেখায় পাচ্ছি : যে-সময়ে তিনি বুদ্ধের অনুরক্ত, চেতনায় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব তখন সেই ধারায় তাঁর ‘অনেক দূর যাওয়ার কথা ছিল’ কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠেনি; কারণ, মুক্তিযুদ্ধে লেখক-প্রকাশক দু-জন যুদ্ধসংক্রান্ত নানা কাজে জড়িয়ে-পড়ার কারণে বন্দিগুমোট গুদামের মধ্যেই বৈশাখী পূর্ণিমার কপিগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এরপর তিনি লেখেন :

যা ঘটে সবসময় ভালোর জন্যে না ঘটলেও, অবশ্যই যা ঘটার, তা-ই ঘটে। সে-ই যে বলে না, এরপর একযুগ শেষ, অন্যযুগের শুরু। এবং সর্ব অর্থেই।

‘যা ঘটার তা-ই ঘটে’-এই বাক্যে তিনি নিয়তির কথাই বললেন যেন; মুক্তিযুদ্ধের-কারণে-ঘটা এই ঘটনা আর খোদ মুক্তিযুদ্ধই তাঁর বৈশাখী পূর্ণিমার যুগকে শেষ করে দিয়ে তাঁকে অন্য যুগের দিকে ঠেলে দেয়; বৈশাখী পূণিমা-পরবর্তী কবিতার মধ্য দিয়ে বাঙালি এখন যে-রফিককে চেনে, (অথবা বলা যায় রফিক যে-বাংলাকে চেনান) যার কথা আলোচক তাঁদের আলোচনায় নিয়ে আসেন, তা তাঁর ‘অন্যযুগের’ কবিতার মাধ্যমেই। কবি নিজেই বলেছেন, অন্যযুগের শুরুটা ছিল ‘সর্ব অর্থে’।

কিন্তু, এরপরও কথা থেকে যায় : যে-চেতনা ধারণ করার কারণে কবির মনে হয়,‘অনেক দূর যাওয়ার কথা ছিল', হঠাৎ-করে তাঁর জীবনে/চেতনায় সর্ব অর্থে অন্যযুগের শুরু হতে পারে না, তাতে পূর্ব-যুগের রেশ তো থাকেই, এমনকি প্রভাব থেকে-যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়; বৈশাখী পূর্ণিমা ও ধুলোর সংসারে এই মাটি -এই বই দু-টির বিষয়-বিবেচনা করলে তার সত্যতা পাওয়া যাবে। তারপরও এমন মন্তব্য কেন করলেন রফিক? সময় বিচার করলে আমরা দেখব, মোহাম্মদ রফিক তাঁর এই স্মৃতিধর্মী লেখাটি লিখেছেন প্রায় তিন যুগ পরে, ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে, ইতোমধ্যে তাঁর অন্যযুগের চিহ্নায়ক কবিতাগুলি লিখিত হয়ে গেছে, আলোচকেরাও তাঁর লেখায় ‘বাংলাদেশ’কে আবিষ্কার করে ফেলেছেন, পাঠকসাধারণেরাও সেই পরিচয় পেযে যাচ্ছেন-এই সব মিলিয়ে মোহাম্মদ রফিকের যে-ভাবমূর্তি দাঁড়িয়েছে, তা কবি পাঠক উভয়ের জন্যে কম গর্বের নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে এ-কথা উঠতে পারে যে কবিজীবনের এই বড় ঘটনাটি তাঁকে এমন কথা বলায় প্রলুব্ধ করল কি না। এই কথা তোলায়, আশা করি কারও মনে হবে না যে, যে-সব কারণে আমাদের সামনে তাঁর মূর্তিটি দাঁড়িয়েছে তাতে কোনও আপত্তি আছে; আমাদের আপত্তি সেখানে, যেখানে রফিকের কবিতার আলোচকেরা তাঁর প্রথম যুগের গুরুত্বপূর্ণ দিকটিকে বিবেচনায় না এনে তাঁর মূর্তিটি দাঁড় করিয়েছেন, যার ফলে তাঁর তাঁর স্বাতন্ত্র্য-লক্ষণ এতদিনে আড়ালে পড়ে গেছে। মোহাম্মদ রফিকের এই স্বাতন্ত্র্য-লক্ষণ প্রথম বই বৈশাখী পূর্ণিমা ও তার সেই সময়কার কিছু গদ্যে ধৃত; কিন্তু আশ্চর্যের কথা, আলোচকরা যখন তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন তখন বৈশাখী পূর্ণিমা বিষয়ে কবির মনোভাবকে গুরুত্ব দিলেও, বইটির অন্তর্গত ভাবনার সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও গদ্যভাবনাকে গুরুত্ব দেননি।

রফিক তাঁর প্রথম বইটি নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন কিছু জায়গায়- ‘আমার প্রথম বই : বৈশাখী পূর্ণিমা’ শিরোনামক লেখার কথা তো উপরে আলোচিত, মোহাম্মদ রফিক রচনাবলি ১-এর ভূমিকায় কবি লিখেছেন : ‘প্রথম খণ্ড রচনাবলির অন্তর্গত বৈশাখী পূর্ণিমা অতি দুর্বল কবিতা নির্মাণের প্রয়াস হিসাবে টিকে রইল। এখন তো আর তাকে ছেঁটে ফেলা চলে না, চলে না অস্বীকার করাও। তাছাড়া কবিতা কর্মের ক্ষেত্রে সক্ষমের দুরাচারের চাইতে অক্ষমের দুর্বলতা শ্রেয়তর।’ অরুণ সেনকেও কবি তাঁর অস্বস্তির কথা জানিয়ে থাকবেন, না-হলে তিনি একথা লিখতেন না : “বইটির নাম ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’- বেরিয়েছিল ১৯৭০-এ, ১৯৬২ থেকে ৬৮ সালের মধ্যে লেখা। অর্থাৎ প্রায় গোটা ষাটের দশক জুড়ে। অনেক তল্লাসি করে পেতে হয়েছে। কবি নিজেও খুব লজ্জিত এই ‘কাঁচা’ বইটিকে নিয়ে।’’ প্রথম বইটি বিষয়ে শুভাশিস সিনহা লিখেছেন, ‘এ কবিও তাঁর তারুণ্যে প্রকৃতির রোমান্টিক আবহের ভিতর ছিলেন’ আর এতে তিনি ‘জিজ্ঞাসার অনন্যতা’ দেখতে পেলেও বলেছেন, ‘তখনও তাঁর সেই চোখ ফুটে ওঠেনি। যে চোখ সকল জীবন্ত বাস্তবতা থেকে স্পন্দনের সম্ভাবনার কথা ছড়াতে পারে, কাঠিন্যের সত্যে সহজতার চিরায়ত রূপ চেনাতে পারেন, তাঁর নিজের কথায় দারিদ্র্যের হাহাকারকে নিয়ে অন্তর্গত ক্ষোভ ও বিপ্লবের রসায়নে গড়ে তুলতে পারেন অধিবাস্তবতার কাব্যিক নন্দনে, যা ধীরে ধীরে রচিত হতে থাকবে পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ থেকে।’ আহমদ মিনহাজ তথ্য হিসেবে একবার মাত্র বৈশাখী পূর্ণিমা-র কথা উল্লেখ করলেও তাঁর আলোচনায় বইটির কবিতা-বিষয়ে কোনও মন্তব্য থেকে বিরত থেকেছেন। মোহাম্মদ রফিকের অস্বস্তির পাশাপাশি বইটি বিষয়ে তিনজন আলোচকের সমভাব দেখে এই প্রশ্নটিই জাগে যে, এরা সকলেই আলোচনা করার সময় কবির অস্বস্তির কথাটি ভুলতে পারেননি। অথচ বইয়ের কবিতাগুলি যেসময়ে রচিত হচ্ছিল সেই সময়-যুগস্রোতের বাইরে-কবির ব্যক্তিত্ব এমন স্বতন্ত্র আভায় ফুটে উঠেছিল যার প্রচ্ছন্ন চিহ্ন কবিতাগুলিতে তো আছেই, গদ্যেও রয়েছে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত। কিন্তু বিস্ময়ের কথা , মোহাম্মদ রফিকের এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের বিষয়টি এখনপর্যন্ত অশনাক্ত, তাই এ-বিষয়টিকে এখানে বিবেচনার দাবিদার।

ষাটের দশকের কবিদের মধ্যে বোদলেয়ার ও বুদ্ধদেবপ্রীতির ব্যাপারটি তো প্রায় সর্বজনবিদিত; আবদুল মান্নান সৈয়দ ও সিকদার আমিনুল হকের একাধিক গদ্যেও তাঁর প্রমাণ অস্পষ্ট নয়, কিন্তু এ-কথার পক্ষে সবচেয়ে বিশ্বস্ত বিররণ আছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভালোবাসার সাম্পান-এ। তিনি লিখেছেন, বুদ্ধদেব বসুকৃত বোদলেয়ারের চিত্ররূপশালী অনুবাদবইটি কীভাবে তাঁদের মাতাল করে রেখেছিল। তাঁর ভাষায় :

যে-ব্যক্তিটি আমাদের জীবনে এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটালেন তিনি কেবল ফরাসি কবি বোদলেয়ার নন, কেবল বুদ্ধদেব বসুও নন, তিনি বুদ্ধদেবীয় বোদলেয়র; বুদ্ধেদেবের দ্বারা আবিস্কৃত ও তাঁরই অসাধারণ ও সজীব অনুবাদে আমাদের চোখের জীবন্ত করে তোলা বোদলেয়ার। ...
দেখতে দেখেছেন বোদলেয়ার আমাদের রাজা হয়ে উঠলেন। বোদলেয়ারের প্রভাব প্রায় আপাদমস্তক গ্রাস করে ফেলল আমাদের।...
আমার ধারণা যেসব প্রভাব প্রথম ষাটের কবিতাকে ভিন্ন পথের দিকে এগিয়ে দিয়েছিল বুদ্ধদেব বসু অনূদিত বোদেলেয়ারের প্রভাব তার একটি।

বোদলেয়ারের প্রসঙ্গটি ছাড়াও, ষাটের দশকের লেখকদের আরো যে-কয়টি বৈশিষ্ট্যর কথা তিনি তাঁর পাদটীকায় উল্লেখ করেছেন সেগুলো মোহাম্মদ রফিকের কবিতায় অভিব্যক্ত হয়েছে বলে মনে করেননি। তিনি স্পষ্টই লিখেছেন, ‘ষাটের কবিরা আমাদের কবিতা-শরীরে যে-একটি নতুন সুরের সংযোজন করেছিল এ নিয়ে অনেকেই এযাবৎ বলেছেন। রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, ফরহাদ মজহার, মহাদেব সাহা, হুমায়ুন কবির, মুহম্মদ নূরুল হুদা-মোটামুটি এদের হাতেই ধারার উন্মোচন ঘটেছে।’ এই তালিকায় মোহাম্মদ রফিকের নাম না-থাকার অর্থ এ নয় যে, তিনি কবি হিসেবে উল্লেখযোগ্য নন, বরং এই বইয়ের অন্যত্র রফিক-বিষয়ে সায়ীদের সংপ্রশংস উল্লেখ রয়েছে : ‘অনেক ভালো কবিতা লিখেছে রফিক। সেগুলো কবিতাপ্রেমিকদের মন ছুঁয়েছে’ ইত্যাদি; আমাদের ধারণা, এখানে তাঁর নাম অনুল্লেখের কারণ, যাটের মূর্তিমান বৈশিষ্ট্যাবলির মধ্যে তাঁর বৈশিষ্ট্য ধরা না-পড়া। ষাটের অন্যান্য কবির মানস-প্রবণতার বিবরণ দিয়েছেন সায়ীদ, আর ১৯৬২ সালে কি তার কাছাকাছি সময়ে, মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর লিখছেন, ‘ধ্র“পদী ইয়োরোপীয় সাহিত্যের বড় বড় লেখকদের জগতে পাল উড়িয়ে ছুটছে তখন ও’। তারও প্রায় এক দশক পরে, ১৯৭২ সালে, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত কণ্ঠস্বর-এ ‘আমরা ও আমাদের ক্লাসিকস চর্চা’ নামে যে-প্রবন্ধটি লিখলেন তাতে একদিকে যেমন সায়ীদের কথার সত্যতা মেলে তেমনি যাটের অন্য কবিদের থেকে তাঁর স্বাতন্ত্র্য-লক্ষণও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই প্রবন্ধে রফিক বলেছিলেন, আমাদের সাহিত্য থেকে থেকে ক্লাসিকস চর্চা প্রায় উঠে গেছে, তাই আমাদের কবিতা আজ নিঃপ্রাণ, আমাদের চিন্তন ও চেতনা অস্বচ্ছ; একসময় মাইকেল বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথ অতুল গুপ্ত শশাঙ্কমোহন সেন অজিত চক্রবর্তী পর্যন্ত তার চর্চা ছিল, এরপর তিরিশের যুগ থেকে তা ছিন্ন হয়ে গেছে। এই জায়গায় অর্থাৎ তিরিশের যুগ-সম্পর্কে এই অভিযোগটি ব্যাখাযোগ্য মনে করায় রফিক এর সঙ্গে একটি পাদটীকা যুক্ত করেছেন আর এতে, বুদ্ধদেবপ্রীতির যুগে তাঁর সম্পর্কে যে-কথা কটি লিখেছেন তা নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক। তিনি লিখেছেন :

বুদ্ধদেব বসুর সমস্ত সমালোচনা সাহিত্যে বিদেশী কবি ও কবিতার
অনুষঙ্গ কারণে ও অকারণে অহরহ এসে পড়লেও গ্রিক ও রোমান
কবিদের প্রসঙ্গ তিনি সযতেœ এড়িয়ে গিয়েছেন।

লক্ষ করার বিষয় এই যে, তার প্রায় বছর দেড়েক আগে বেরিয়েছে বৈশাখী পূর্ণিমা, যার রচনাকাল ১৯৬২ থেতে ১৯৬৮-এই বিবেচনায় এই অনুমানের সুযোগ আছে যে, এই প্রবন্ধের ভাবনার সঙ্গে ওই বইয়ের কাব্যদর্শনের মিল আছে। শুধু অনুমান কেন, চিরায়তের সঙ্গে যোগ ছিন্ন হওয়ার কারণে যে-কবি তাঁর গদ্যে দুঃখপ্রকাশ করেন তাঁর কবিতায় সেই যোগ-স্থাপনের আকাক্সক্ষা থাকা স্বাভাবিক। অন্তত বৈশাখী পূর্ণিমা-য় যে আছে, তার প্রমাণ বইয়ের কবিতা পড়লেই বোঝা যাবে।

চার
বৈশাখী পূর্ণিমা-র প্রথম কবিতার অন্তরঙ্গ-বহিরঙ্গ বিবেচনায় আনলে রবীন্দ্রনাথের শেষপর্যায়ের কবিতার কথা পড়ে যেতে পারে। বইটি বহুলপঠিত নয় বলে এখানে এই ছোট্ট কবিতাটি উদ্ধৃত করছি :

আবেগ

প্রস্ফুট আবেগ আসে
নম্র পদে
সত্তার বিরলে
যেখানে সে বাস করে কিছুক্ষণ
এবং অন্তিমে দিয়ে যায়
অনন্য উপহার :
বৈরাগ্যে প্রবাহে আর্দ্র
অস্থির ক্রন্দন

রবীন্দ্রনাথের কবিতার সঙ্গে এই কবিতার বিষয়গত দূরত্ব থাকলেও, ভাবগত দূরত্ব কম, ফলে এ-কথা বলা যেতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথের সমাপ্তিবিন্দু থেকেই মোহাম্মদ রফিকের সূচনা। প্রভাবগত বিচারে এখানে দোষের ব্যাপার যতটা, গুণের ব্যাপারটি তার চেয়ে অনেক বেশি। বৈশাখী পূর্ণিমা-য় রবীন্দ্র-যোগের যে-পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল, এখনও তা অক্ষুণ; তিনি তাঁর ভালোবাসার জীবনানন্দ বইয়ের এক জায়গায় লিখেছেন : ‘এ-কথা আজ আর কিছুতেই অস্বীকার করার প্রশ্নই উঠে না যে বাংলা কবিতার যথার্থ আধুনিকতার মূল সূত্রটি রবীন্দ্রনাথেই নিহিত’।
বইয়ের দ্বিতীয় কবিতাটি সেই পুরাণচরিত্র ক্ল্রিওপেট্টাকে নিয়ে, মোহাম্মদ রফিকের বয়ানে যাকে মানুষের যৌনতার স্রোতে ভাসতে হয়; কবিতাটির শেষ পঙ্ক্তি, ‘লীন হয় অন্ধকার অসীম সৈকতে’। কবিতাটি জটিল নয়, আবার নির্দ্বন্দ্বও নয়-প্রথম স্তবক পড়ার পর শেষ পঙ্ক্তির গতিমুখ সাধারণ পাঠকের কাছে বিপরীতস্রোতা মনে হওয়া অবাস্তব নয়। এ-ই হচ্ছে মরমিয়া, এখানে যা রবীন্দ্রকাব্য-দর্শন ছুঁয়ে প্রকাশিত, আর অন্যত্র বুদ্ধের দুঃখবোধে আক্রান্ত হয়ে।
এই বইয়ের কয়েকটি কবিতায় নানা ভাবে কান্নার প্রসঙ্গ এসেছে, যা দুঃখবাদেরই নিকট/সূদূর বিস্তার। যেমন :

১. বৈরাগ্যে প্রবাহে আর্দ্র
অস্থির ক্রন্দন

২. প্রান্তরে প্রান্তরে কাঁদে যেখানে ছড়িয়ে থাকে
অনন্ত গোধূলি আর শোকাহত নীরবতা

৩. যারা শুধু ভ’রে তোলে
দিগন্ত কান্নার মৃদু লয়ে

৪. বেদনার কতোনা চৈতালী
দয়িতার আবেদন, বিজন ক্রন্দসী

৫. তমসায় ঢেকে দেয় সব স্মৃতি সব কান্না

৬. শুধুই দাঁড়িয়ে বাইরে ভিজেছি বৃষ্টির ধারাজলে
ভিজেছি কান্নায় ঘামে আকণ্ঠ সে রৌদ্রের গহনে

৭. ভালো লাগে দেখে যেতে নির্জনে এই
রাস্তার আলো ঘিরে বৃষ্টির ধারা
শুনে যেতে বাতাসের চাপা ক্রন্দন

এই ভাবে তালিকা করে গেলে তালিকা অনেক দীর্ঘ হবে, এর সঙ্গে আছে বিষাদ, মৃত্যু ও তদসম্পর্কিত নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ; আছে বৈদেহ-কথা, নানারকম অশরীর মরমি আহ্বান প্রভৃতি। এখানে সর্ববিধ মিছাল টেনে না এনে নামকবিতা থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করা যেতে পারে :

আজ রাতে দেখি আমি তন্দ্রায় বিবশ সবে,
পাখিদের কোলাহল বৃক্ষের মর্মর
কি এক বৈদেহী সুরে
বিভাসিত চরাচর চাঁদ আর তারার প্রণয়ে;
... ... ... ... ... ...
তবু কি দেখিলে তুমি নীরব নির্জন
সেই ক্ষণে রাতের দুপুরে? সেদিনও এমনি
সবকিছু শুনেছিলে;- মৃত্যু জরা প্রেম
মানুষের ব্যর্থতার হাসি, বাতাসের স্রোতে!

এই পঙ্ক্তিগুলো গৌতমের জীবন আর বৌদ্ধ-অনুষঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে গেলে এ-নিয়ে কথা না বাড়ালেও চলত, কিন্তু এই উদাহরণগুলো তো বটেই, এ-ছাড়া বৈশাখী পূর্ণিমার আরও কয়েকটি কবিতায় মূর্ত ও অমূর্ত রূপে চিরায়তের যে-অনুভব ব্যক্ত হয়েছে তা সকল কবির ক্ষেত্রে সচরাচর ঘটে না।
কিন্তু, এরপরও যারা ওই কবিতাগুলি সম্পর্কে রফিকের অস্বস্তি যেমন- ‘কাঁচা’ ‘দুর্বল’ প্রভৃতি দোষের কথা তুলবেন তাদের জন্যে রূপসী বাংলা (বাংলার ত্রস্ত নীলিমা) নিয়ে জীবনানন্দের অস্বস্তিজড়িত দৃষ্টান্তই যথেষ্ট; এ-ছাড়া প্রথম কবিতাবই হিসেবে এর যে-গঠনশৈথিল্য, কোনও-কোনও স্থানে তৎসম শব্দের বাহুল্য, কোথাও কোথাও যথোচিৎ শব্দ-নির্বাচনের ব্যর্থতা-প্রথম বই হিসেবে এগুলো খুব দোষের ব্যাপার নয়।
বরং এই বইয়ের যে-অভিব্যক্তি, তা তার সমকালের কবিদের থেকে ছিল ব্যতিক্রম। এবং এ-প্রসঙ্গে একটু বিশেষ কথা বলবার আছে যে-বুদ্ধ ও রবীন্দ্রনাথের মহাজগৎ থেকে যে-কবির যাত্রা শুরু, তাঁর পরিক্রমণ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মধ্যে কিছুতেই সীমাবদ্ধ হতে পারে না। অরুণ সেন তাঁর মধ্যে বাংলাদেশের স্পর্শ পেয়েছেন (পেতেই পারেন), আহমদ মিনহাজ তাঁর মধ্যে সেই বাংলাদেশে পৌঁছনোর চেষ্টা দেখেছেন (দেখতেই পারেন)-এই দুই আলোচকের আলোচনার আগে পরে, এই ভাবমূর্তি গড়ে উঠবার পেছনে, তাঁর নিজেরও কিছু সশব্দ অবদান আছে, তাই, আমাদের মনে হয়, এই মূর্তি ভাঙবার জন্যে এখন নিজেকেই হাতুড়ি নিতে হবে, কারণ এখনও তিনি সক্রিয় ও সজীব আর কব্জিতেও রয়েছে একজন যুবকের ক্ষমতা।

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্তিত্ব আয়োজিত তিন দিন ব্যাপী মোহাম্মদ রফিক বক্তৃতামালার সমাপনী দিন ২৮ জুন ২০০৯-এ প্রবন্ধটি পঠিত হয়েছে

1 টি মন্তব্য:

  1. ধন্যবাদ। পড়তে পড়তে খুব পরিচিত লাগছিল লেখাটি। শেষতিনলাইনে এসে ঘোর কাটলো...

    উত্তরমুছুন