মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

রেঙ্গুন সনেটগুচ্ছ : গৌতমই সর্বহারাদের ঘরামি

চয়ন খায়রুল হাবিব


১.
নীল আশ্বস্ত হয় শুধুমাত্র অন্যান্য নীলে
নীল বদলে যায় আকাশ্চুম্বী বিদ্যুতের নীল
কাতর নীল পূর্ণিমা হেঁটে যায়
বাংলার রাজকীয় বাঘের থাবায়
ক্ষিপ্ত বৈশাখের বিক্ষিপ্ত মহামল্লারে
নীলে নীলে নীল নীলপাহাড়ি মূর্ছনায়
আমার দেহঘড়ির চোদ্দতলায় চোদ্দ নীলের জালা
শিশু ণিল সবসময় ঘুমোচ্ছে
নৌনীল ভালোবাসে সাগরে ডুবসাঁতার
তাহলে কোন ণিল সবচেয়ে সত্যিকারের নীল
এর উত্তরে নীল রানার বয়ে আনে
মহানীল পদ্মসূত্রের শ্লে­াক
যখন শেষবারের মতন থামে নীল হৃতস্পন্দন
যখন ধনুর জাতক চিৎকার করে ওঠে : নির্বাণ নীল

২.
দীর্ঘমেয়াদি
সুদীর্ঘ পুরোপুরি পাস্তুরিত গেরুয়া সকাল
সকালের পেয়ালায়
ফট ফট ফট মাখন রঙের ভুট্টার খৈ
সোনালি কিশমিশগুলো
ভ্রু কোচকায় নরম শীত সূর্যের ছায়ায়
ব্রিওশ পাউরুটির
জিভে পানিতোলা থুতুর ফিশফিশ
শাদা হাতির পাকস্থলিতে
হাতির দাতের রান্নাঘরে
সিদ্ধার্থের মধু চুয়ে চুয়ে মিশবে
অসমীয়াদের বাঙালি খেদাও চায়ে
আমি সুখি : কারণ দুঃখ উধাও মহাদুঃখের মাদলে
বাদলাবাতাস আমার মা বৌদ্ধ পিতা

৩.
রক্তজবারা বিচিত্র নিজেদের রক্তাক্ততায়
রজনীগন্ধারা পবিত্র রাতের নির্লিপ্ততায়
শেফালিরা মুগ্ধ নজরুলের গানের সুরে
কদমেরা হতবাক গ্রীস্মের তাণ্ডবিতণ্ডায়
মহুয়ারা দোলে পাহাড়ের তিন চোয়ানি তালে
বর্ষবরণের খোপায় ঘুরে বেলি হেসেছে
টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে
গোলাপেরা অভিমানের আতরজলে গাঢ়
গাঁদাফুল আমাদের হাসিখুশি সেবিকা দিদি
ঘণ্টিফুল বাতাসে বাজায় স্কুল শেষের ঘণ্টা
তোমরা আমরা সবাই ফুল গোত্রের সর্বহারা পুতুল
চাইলেই পারি নিজেদের সুবাস নিজেরাই নিংড়াতে
মানুষেরা শুধু ফুল থেকে ভিন্ন ধর্ষণে ও সমরে
ফুলদেরও জীবন গড়ায় বিচ্ছেদে ও বাসরে

৪.
পরদেশে প্রবাশে সুতো কাটছে তিব্বতী চরকা
হিমালয় গলছে পুর্ণিমার প্রাচীনতম ঝরকায়
কুয়াশার আঁচলে দীর্ঘনিঃশ্বাসের জমিনে
একের পর এক প্যাগোডা জ্বলে ওঠে
যদিও জ্বলবার কথা ছিল না
এমনি মরণবাণ হেনেছিল চৈনিক লাল ফৌজেরা
ধর্মশালায় ঐ ভিক্ষু ভিক্ষুনীদের ভিড়
তারাদের বাস্তব রূপকথায় ত্রিপিটকের ভেলা
ভেলাগুলো কালবেলার কুমার কুমারীদের বাহন
লেজ আঁশ কানকো দাঁড়াসহ ওরা কখনো মাছ কখনো মানুষ
আর ওদের পূর্বপুরুষ পূর্বরমণীরা
ইতিহাসের ডুবসাতারে ভাসবার আগে অস্ফূটে বলে
শরণাং গচ্ছামি : গৌতমই এখন সর্বহারাদের ঘরামি

৫.
ঘুটঘুটে অন্ধকার এক রেস্তরায়
খাদ্যের পরিবেশক ও পাচক সবাই অন্ধ
মেনুতে সব দেশের সব রকম খাদ্য
মসলার বদলে অনুপান হল অনুভূতি
জাফরাণ-অনুভূতি, দারুচিনি-অনুভূতি
পুদিনা-অনুভূতি, রংধুনু-অনুভূতি…
পাচক আসলে পাকাতে চায় খদ্দেরদের মাংস
কিম্বা খদ্দেররা এরি মধ্যে পরিণত খাবারে
ঘরে বাইরে খাদ্যগুলো এখন খোদক
হজমির অষুধ দেবে বোধিসত্যের নির্মোক
গোধূলিমাখা বিচিত্র বকুলের সালাদের পর
চাওয়া-পাওয়ার হিসাবের নেতৃত্ব দেয়
পরমের গেরুয়াধারীরা। রংধনু এখন রেঙ্গুন।
রেঙ্গুন ক্রমশ গড়ায় নির্বাণের রেস্তরায়

৬.
আমাকে খুন করে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে
রেঙ্গুন নদীতে : আমি ডুবে যাচ্ছি
আমার নির্ভার গেরুয়ার ভারে
প্রতিবেশীরা ঘুমিয়ে পড়েছে নদীর তলায়
যাতে আমার শরীর না ছোঁয় যন্ত্রণার পাতাল
আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে
জলচরেরা জিভ ছোয়াচ্ছে নির্বাণের প্রথম সিড়িতে :
বন্ধুবৎসল শুশুকের ঝাঁক
আমার শ্বাসপ্রশ্বাস বয়ে নিচ্ছে
ওদের ওপরগামী ফিরতি সাঁতারে
প্রত্যেক জলচর প্রাণ শঙ্খনাদে হেসেছে
আমার উভচর অরহৎ দোলুনীতে
আমি ডুবে যাচ্ছি : আমাকে খুন করে
ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে রেঙ্গুন নদীতে

৬.
নির্বাসনে যাই আনন্দের পানশালায়
আজলাভরে পান করি সূর্যমুখীর রেণু
সূর্যরসে টইটম্বুর হবার পর
দেখতে পাই আমি পুরুষ কিন্তু স্পর্শকাতর
এবং অক্টোবর বীর্য খালাশের মাস
হরিণীরা সঙ্কেত পাঠাবে হরিণদের
ধাওয়া পালটা ধাওয়ার আদুরে ভঙ্গিতে
তাড়িত হরিণীরা ভান করবে পালানোর
কিন্তু আড়াল নেবার কোনো তোয়াক্কা করবে না
শান্তিনিকেতনে ও সুন্দরবনে
হরিণ-হরিণী মিলিত হবে চাঁদের বাগানে
বুদ্ধসঙ্গমে হরিণ হরিণী যখন ভরপেট
মিতকথনের মলাটে ছররা হানে ঘাতকের বেয়নেট
হরিণশাবক তখন লিঙ্গনিরপেক্ষ হরিণা

লন্ডন, সেপ্টেম্বর ২০০৭

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন