মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

রাষ্ট্র ও সমাজের যে ভাঙন ব্যক্তি-মানসে ধস নামায়

মাসুদা ভাট্টি


প্রতিটি মানুষই তার জীবদ্দশায় বার বার ভাবতে বাধ্য হয় যে, সে একটি ভয়ংকর দুঃসময় অতিক্রম করছে। এ এক ভয়াবহ অনুভব, আমি নিশ্চিত সবারই এই অভিজ্ঞতা রয়েছে। কি ব্যক্তি জীবনে, কি সামাজিক, কি রাষ্ট্রীক, প্রতিটি পর্যায়েই এমন ভাবনা মানুষকে আচ্ছন্ন করে যে, এই ভয়ংকর ও দুঃসহ অবস্থা থেকে বুঝি পরিত্রাণের আর উপায় নেই। এই-ই বুঝি শেষ, এই-ই বুঝি সবকিছু ভেঙে পড়লো হুড়মুড় করে। মানুষের এই যে বোধ, এই যে চিন্তার ঝড়, এ শ্বাশ্বত এবং যুগে যুগে এই চেতনার টানাপড়েনই আজকের পৃথিবীকে তথাকথিত আধুনিক, অথবা বলা ভালো বাসযোগ্য করে রেখেছে। প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সৃষ্ট এই সমাজের, রাষ্ট্রের নিয়মিত ভাঙন-গঠনও আজকের আধুনিক মানুষের জীবন বাস্তবতায় অত্যন্ত দৃঢ় বাঁধনে আবদ্ধ।

যে কথা বলার জন্য এতো ঢাকঢোল পেটানো, তাহলো বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনার কি মনে হয় না যে, ওহ্ ঈশ্বর, এ কী সময় পার করছি আমরা? রাষ্ট্রের প্রতিটি খুঁটি একের পর এক গুড়িয়ে পড়ছে। ভেঙে পড়ছে কাঠামো, শেকড়-বাকড় শুকিয়ে রাষ্ট্র একটি ফাঁপা গোলকের মতো আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। প্রকৃতি এবং মানুষের সম্পর্ক যদি দেয়া-নেয়া, ভালোবাসা বিনিময়ের হয়ে থাকে তাহলে একই কথা প্রযোজ্য রাষ্ট্র-সমাজ এবং ব্যক্তির ক্ষেত্রেও। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি এখন এক বন্ধ্যা জমিন, আমি কোনও বৃহন্নলাকে খাঁটো না করেই বলছি, তার বন্ধ্যাত্বকেও হার মানিয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঊষরতা। যদিও রাষ্ট্র একটি প্রতিষ্ঠান মাত্র, এবং এর পরিচালকগণ মানুষ। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েই মানুষ খুব দ্রুত বদলে গিয়ে এমন এক প্রাণীতে পরিণত হয় যে, পৃথিবীতে এমন কোনও প্রজাতির প্রাণী খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। প্রকৃতির যে কোনও প্রাণীর সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালক-শ্রেণীর তুলনা টানা হলে সাধারণ প্রাণীর শুধু অবমাননাই হয় না, রীতিমতো তাদেরকে অপমান করা হবে বলে সেই চেষ্টা থেকে বিরত থাকলাম।

কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি বর্তমান পরিস্থিতির, যদিও এসব সবই চর্বিত চর্বন, সবারই জানা এবং বোঝা। রাষ্ট্রের চরিত্র কী হবে, গণতান্ত্রিক, নাকি সেনাতান্ত্রিক, নাকি একটা জগা-খিচুড়ি কিছু একটা তা কারো কাছেই স্পষ্ট নয়। আমার ধারণা সকলেই তাকিয়ে আছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিকে, সেই নির্বাচনের ফলাফলের পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র চরিত্রেরও ভাগ্য নির্ধারিত হবে। তবে সেটাও অনুমান মাত্র। আমাদের উপদেষ্টারা প্রতিদিন টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কাশেম বিন আবু বক্করের দুর্বল সাহিত্যের ভাষায় কথা বলেন। আমার সাংবাদিক বন্ধুরা তাই-ই ক্যামেরায় ধারণ করে প্রতি ঘন্টার সংবাদে সাউন্ড বাইট হিসেবে প্রচার করেন। আমার বিশ্বাস, এটা উপদেষ্টারাও জানেন, সাংবাদিক বন্ধুরাও জানেন, আপনি-আমি সবাই জানি যে, এই যে দুর্বল সাহিত্যের ভাষায় বচনমালা, তার আসলে কোনও অর্থ নেই। শুধু সময় ক্ষেপণ এবং সময়টাকে তাড়িয়ে নেওয়ার বিনোদন ছাড়া। একটি রাষ্ট্রের কার্যক্ষমতা কতোটা নিম্নস্তরের হলে এরকম প্রতিদিন এসব বচন গ্রহণ-প্রচার-পাচন প্রক্রিয়া ঘটে এবং জনগণকে তা নির্বিকার ভাবে হজম করতে বাধ্য হতে হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু এই ফাঁকা, কার্যক্ষমতাহীন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই কিন্তু চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে উগ্র মৌলবাদ। ধর্মভিত্তিক শাসন-ব্যবস্থা চালুর নামে মধ্যযুগীয় ভোগতন্ত্র কায়েম করার প্রক্রিয়ার কাছে রাষ্ট্রের দৌর্বল্য পুরোপুরি প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে। আবারও একটি নিম্নস্তরের উদাহরণ দিতে হচ্ছে বাধ্য হয়েই।শিক্ষা ও আধুনিকতার আলো বঞ্চিত কোনও
নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে (কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে) পুরুষটি নানা শারীরবৃত্তিয় অত্যাচারের ফলে যখন তার পৌরুষ-ক্ষমতা হারায় তখন নারীটি হয়ে ওঠে যথেচ্ছ, পুরুষটিরে এই অক্ষমতার সুযোগে ব্যক্তি নারীর এই দ্বিধাহীন হয়ে ওঠার প্রবণতা তবু মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু রাষ্ট্রের মতো বিশাল প্রতিষ্ঠানের এই বীর্যহীনতা কতোটা গ্রহণযোগ্য? খুব কৌশলে সংখ্যাধিক্য শ্রেনী গড়ে তোলা হয়েছে যাতে গণতন্ত্রের ধূয়া তুলেও এদের হাত থেকে নিস্তার না মেলে। আমি মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত আর প্রচলিত বাংলা মাধ্যমের শিক্ষিতদের সংখ্যাসাম্যের কথা বলছি। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কাদের নিয়ন্ত্রণ কতোটা শক্তিশালী হবে এই দ্বন্দ্বই কি বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র-সংকটের মূল বিষয় নয়? অবশ্যই এর সঙ্গে আরও কিছু বিভাজন, কিছু অপ্রাপ্তি এবং সেই সঙ্গে তুমুল স্বার্থের দ্বন্দ্ব (জিয়া-এরশাদ সৃষ্ট নতুনতর কোটিপতি শ্রেনীর)ও বিরাট একটা গহ্বরের জন্ম দিয়েছে যা দিয়ে অনায়াশেই মূল শত্রুরা টেরাকোটা আর্মির মতো ঢুকে পড়েছে রাষ্ট্রের শিরায় শিরায়। আর এতে ইন্ধন জুগিয়েছে অবশ্যই আমাদের জাতীয় সুবিধাবাদী চরিত্রের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত (পড়ুন সুশীল সমাজ) শ্রেনী। মুড়ো না লেজ – এই দড় কষাকষির পরিণাম আপনি আমি সবাই প্রত্যক্ষ করছি।

আরও একটি বড় উদাহরণ দেওয়া যেতো বিচার তথা আইনী ব্যবস্থার কিন্তু এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। আপনারা সবাই এই তথাকথিত স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার পশ্চাৎদেশ দেখতে পাচ্ছেন নিজামী-মুজাহিদের নূরানী চেহারায়। এর বেশি আর কি বলবো?

আসলে রাষ্ট্রের এই পরাজয়, অবক্ষয়, নপুংশকতা, নোংরামি এবং আবালহোসেন ধরনের কার্যকলাপ যে ব্যক্তি মানসে কতো বড় প্রভাব ফেলতে পারে তার উদাহরণ দেখা যাবে সমাজে ব্যক্তি মানুষের ননা অসংগতিপূর্ণ কার্যকলাপ দেখে। আমি বলছি না যে, কার্যকর এবং স্থিতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এসব ঘটে না বা ঘটছে না। কিন্তু দিনের আলোয় রাজপথে আইনজীবীর কাটা-মাথা নিয়ে দৌঁড়ে বেড়ানো কিংবা শোবার ঘরে রাজনৈতিক নেতাকে গিয়ে কুপিয়ে কিংবা সরাসরি খুলি উড়িয়ে দেয়ার ঘটনাবলী কি রাষ্ট্রের অকার্যকারিতার ফলস্বরূপ ব্যক্তির অক্ষম ফুঁসে ওঠা নয়? রাষ্ট্র যেখানে অক্ষম ব্যক্তি সেখানে অতিরিক্ত সক্রিয় হতে বাধ্য। মজার কথা হচ্ছে, ধর্ম কখনওই ব্যক্তির এই অতিরিক্ত সক্রিয়তা দমাতে পারে না, পারেনি, সৌদি কিংবা আরও দু’একটি ধর্মরাষ্ট্রের দিকে তাকালেই আমরা সেই সত্যটিও জানতে পারি। কিন্তু তাতে কি, বাংলাদেশ রাষ্ট্র তো এখন এক ধ্বজভঙ্গ অবকাঠামো মাত্র।

যদিও আমি নৈরাশ্যবাদী নই, তারপরও আমার সময়ের এই অস্থিরতাকে আমি এভাবেই দেখছি। হয়তো তাই লেখাটাও সেরকমই এক অস্থির লেখা হলো। কিছু করার নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন