রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

দুখী গণ্ডারনামা ০৪-ক

হাঁটুপানির জলদস্যু


দাঁতাল বাঁশখোর একদিন দুপুরে পাটশাক দিয়ে ভাত খেয়ে তার প্রকাণ্ড ময়লা দু'টি দাঁত খোঁচাচ্ছিলো একটি ইমপোর্ট করা খিলাল দিয়ে, এমন সময় ফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠলো।

দাঁতাল ফোনের বোতামে টিবি দিয়ে বললো, "হেলু হেলু! দাঁতাল কইতেছি!"

ওপাশে বন ও পশুসম্পদ মন্ত্রী উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, "কে, বাঁশখোর ভাইয়া?"

দাঁতাল দাঁত বের করে বললো, "হ। আপনে ক্যাঠা?"

মন্ত্রী সালাম দিলেন, তারপর নিজের পরিচয় দিলেন। তারপর বললেন, "আপনি খবরের কাগজ পড়েন ভাইয়া?"

দাঁতাল উদাস গলায় বললো, "নাহ। আমি খবরটবর ভালু পাই না। খবরের ধারণাটাই ভুল। কতগুলি লোক মিল্লা একটা ঘটনারে নিজেগো মনমতো, নিজেগো মননমতো মাইনষের চোক্ষের সামনে তুইলা ধরন ঘটাইতে চায়, সেইটারে মাইনষের মনে বীজ হিসাবে বপন করন হওয়াইতে চায়, মাইনষের মনে যে বিচ্ছিন্ন ভাবনা, যে পরস্পর সংলগ্নতাহীন ধারণাগুলি আছে, সেগুলিরে মোচন করাইয়া নিজেগো ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাগুলিরে রোপন করন ঘটন হওয়াইতে চাওন করে। ফরহাদ মগবাজার ভাই কইছেন, খবর বইলা আসলে কিছু নাই। আছে কেবল খাবরিকতা।"

মন্ত্রী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেন, "কিন্তু ভাইয়া, আপনি কি জানেন, আমাদের চিড়িয়াখানার একমাত্র গণ্ডারটা যে ইন্তেকাল করেছে?"

বাঁশখোর মনে মনে একটু খুশিই হয়। যাক, কম্পিটিশন কমলো। সে বলে, "গণ্ডারের মৃত্যুর খবর লৈয়া বৈসা থাকলে তো আমার চলবে না। আমার আরো জরুরি কাজ কাম আছে। আপনি কী কৈতে চান এই বেলা কৈয়া জল্দি জল্দি ফুনখানা রাখন করন ঘটান না কেন?"

মন্ত্রী বলেন, "দ্যাখেন, গণ্ডার আমাদের চিড়িয়াখানার গর্ব।"

বাঁশখোর শুনে যায়।

মন্ত্রী বলেন, "একমাত্র গণ্ডারটা মারা যাবার পর চিড়িয়াখানা এখন এতিম। দর্শক কমে গেছে।"

বাঁশখোর বলে, "আরেকটা আনায়া লন। তাহইলেই তো হয়া যায়। নেপালে এখন মাওবাদী সরকার। উনাদের কাছে গিয়া শুধু আমার নামটা কৈবেন। বলবেন জাহাঙ্গীরজঙ্গল বিশ্ববিদ্যালয়ের দাঁতাল বাঁশখোর আপনাকে পাঠাইছে। গণ্ডার পাইয়া যাবেন এক প্লাটুন।"

মন্ত্রী বলেন, "না ভাইয়া। ভুল করছেন। গণ্ডারের জন্য কেনিয়া সরকারের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে। উনাদের গণ্ডারগুলি বিশ্বসেরা গণ্ডার।"

বাঁশখোর একটু ক্ষেপে ওঠে। "হৈছে হৈছে, গণ্ডারের খোসামুদি আর কত করবেন? কী কৈতে চান তাহইলে? গণ্ডার তো পাইয়াই গেছেন!"

মন্ত্রী বিনীত সুরে বলেন, "ভাইয়া, মাত্র তো অর্ডার দেয়া হয়েছে। উনারা গণ্ডার ধরবেন, প্যাক করবেন, জাহাজে করে পাঠাবেন, সব মিলিয়ে মাস তিনেক লাগবে আসতে আসতে। আপনি এই সময়টা আমাদের একটু উপকার করেন।"

বাঁশখোর বলে, "কীরম উপকার?"

মন্ত্রী বলেন, "এই একটু গণ্ডারের খাঁচায় মাঝে মাঝে গিয়ে একটু বসবেন।"

বাঁশখোর রাজি হয়ে যায়।

এরপর চিড়িয়াখানায় অবসরে গিয়ে গণ্ডারের খাঁচায় বসতে শুরু করে বাঁশখোর। সন্ধ্যার দিকে খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে আজিজের আড্ডায় যায়। আবার দুপুরের দিকে খাঁচায় একটু বসে। জ্যাক লাকা, ফুকো, দেরিদার কিছু বই সাথে নিয়ে যায়। পাতা উল্টায়। বিড়ি খায়। এদিকে লোকজনের ভিড় ভেঙে পড়ে গণ্ডারের খাঁচার সামনে। কেউ কেউ ফুলকপি কিনে ছুঁড়ে দেয় খাঁচার ভেতরে। চিড়িয়াখানার স্টাফরা রা রা করে তেড়ে আসে, কারণ পশুকে খাবার খাওয়ানো নিষেধ। বাঁশখোর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, এক্টু ডাইলপুরি দেন না কেউ? কাচা ফুলকপি ক্যাম্নে খামু?

চিড়িয়াখানা মোটামুটি সরগরম হবার পর একদিন গণ্ডারের রক্ষণাবেক্ষণকারী খাবার নিয়ে আসে ঝুড়িতে করে। বাঁশখোর সরেস দেখে একটা বাঁশ নিয়ে চিবিয়ে খায়, আর বলে, "গণ্ডারটার হৈসিলো কী? মরলো ক্যান?"

রক্ষণাবেক্ষণকারী অশ্রুসজল চোখে বলে, "স্যার, দর্শকগুলির দোষ স্যার! সারাটাক্ষণ ত্যক্ত করতো বেচারা জীবটারে।"

বাঁশখোর বলে, "ক্যাম্নে ত্যক্ত করতো?"

রক্ষণাবেক্ষণকারী বলে, "স্যার, আজেবাজে কথা বলতো খালি?"

বাঁশখোর বলে, "কী কথা?"

রক্ষণাবেক্ষণকারী মাথা নিচু করে বলে, "বলতো ... বলতো ... বলতো ঐ ব্যাটা গণ্ডার, তোর গায়ে নাকি দাঁতাল বাঁশখোরের চামড়া?"

বাঁশখোর বলে, "তারপর?"

রক্ষণাবেক্ষণকারী বলে, "তারপর আর কী? গণ্ডারটা লজ্জায় মইরা গেলো!"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন