বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

জোড়াসাঁকোর সেই নারীরা

গোলাম রসূল মারুফ


এক পশলা বৃষ্টির পর স্নিগ্ধ হয়ে উঠা ঠাকুরবাড়ির দিকে তাকাতেই যেনো মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের গানের কথা, “দূরে কোথায় দূরে দূরে/ আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে.. .. ..। মনে পড়ে যায় একদিন শঙ্খমালার সুরে মুখরিত ছিলো এ ঠাকুরবাড়ি, নিক্কন ধ্বনির কল্লোলমুখরতায় মূর্ত হয়ে উঠেছিলো সৃষ্টির প্রেরণা। ফলে সময়ের বিবর্তনে আর রবীন্দ্রনাথের অমিত সৃষ্টিসম্ভারের আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো পাঠকের কাছে এ ঠাকুরবাড়ির নারীরা হয়ে উঠেছে চাঁদের আলোয় আলোকিত চন্দ্রমল্লিকার মতো, কতো রবীন্দ্রপ্রেমী হৃদয়ে-মননে এসেছে কামরাঙা কবিতার মতো। আবার জোড়াসাঁকোর কর্কশ হট্টগোলের মাঝে প্রায় হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট একটা গলির শেষে যে সেকেলে মস্ত বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, বাইরে থেকে তাকে বিশেষত্বহীন মনে হলেও বাঙলার নবযুগের বিকাশ হয়েছিলো এ বাড়ি থেকেই। এ বাড়ির নারীরাই একদিন ঝিমিয়ে পড়া সমাজের বুকে একটার পর একটা আঘাত হেনে তার জড়তা ঘোচাতে চেষ্টা করেছিলেন।

ঠাকুরবাড়ির নারীদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী ও জ্ঞানদাননন্দিনীর নাম বহুশ্রুত, তবে তাঁদের প্রপিতামহী অলকাসুন্দরী ও পিতামহী দিগম্বরীও ছিলো ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দ্বারকানাথ মাত্র তেরো বছর বয়সে পিতৃহীন হন। অলকাসুন্দরীকে তখন শক্তহাতে সংসারের হাল ধরতে হয়। ধর্মে অলকাসুন্দরীর অত্যন্ত নিষ্ঠা ছিলো, তবে এ নিষ্ঠা কখনোই তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতার চৌকাঠ পেরোতে পারেনি। কাত্যায়নী দেবী ছিলেন তাঁর দীক্ষাগুরু। অলকাসুন্দরী মৃত্যুর সময়ও তাঁর স্বাধীন চিন্তাকে ব্যক্ত করেছিলেন, গঙ্গায় অন্তর্জলি যাত্রায় সম্মতি দেননি। সে যুগে কেউ তাঁর কথা শোনেনি, তবে তাঁর প্রতিবাদ সে যুগের ক্যানভাসেও ছিলো অতুলনীয় তৈলচিত্র। অন্যদিকে দিগম্বরীর ধর্মনিষ্ঠা ও নির্ভীক তেজস্বীতার মধ্যেও ঠাকুরবাড়ির নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার ছাপটুকু চোখে পড়ে। সেই সময়ে তিনি যে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে নারী জাগরণের ইতিহাসে এক আশিসবাণী।

যোগমায়া ছিলেন গিরীন্দ্রনাথের স্ত্রী আর সারদা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের স্ত্রী। তাঁরা কিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন। সারদা অবসর সময়ে প্রায়ই একটা না একটা বই খুলে বসতেন। সংস্কৃত ‘রামায়ণম্ব, ‘মহাভারতম্ব পড়ে শোনাবার জন্য কখনো কখনো ডাক পড়তো ছেলেদের। হাতের কাছে কোনো বই না থাকলে অভিধানই খুলে বসতেন। চাণক্যশ্লোক তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ছিলো। যোগমায়াও নানাধরনের বই পড়তেন। মালিনী আসতো বটতলায় ছাপা বইয়ের পসরা নিয়ে। সেখান থেকে বেছে বেছে বই কিনতেন ঠাকুরবাড়ির নারীরা। এ বাড়ির আরো দুই নারী সৌদামিনী ও সুকুমারী। তাঁদের বোন স্বর্ণকুমারী বাঙলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক লেখিকা। সে সবদিক থেকেই ছিলো বিরল ব্যতিক্রমী। ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখলেও, তাঁর বিশেষ নাম ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক উপন্যাস লিখে। তাঁর আলোকছটায় ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল আলোকিত। তবে তাঁর এ সাফল্য ও কৃতিত্বের সঙ্গে আরো একজন জড়িয়ে আছেন, যাঁর নাম জ্ঞানদাননন্দিনী, যিনি এ বাড়ির নন, বিবাহসূত্রে এসেছেন ঠাকুরবাড়ির অঙ্গনে। সত্যি বলতে, তিনিই প্রথম ঠাকুরবাড়ির নারী, যিনি সমস্ত বাধা-নিষেধ অতিক্রম করে নারীদের জন্য এক অনবদ্য মুক্তির আর্কেস্ট্রা তৈরি করেন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক লেখায় লিখেছেন, “আমার বিয়ের কোনো গল্প নেই.. ..ঃ। তবে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে হয়েছিলো জোড়াসাঁকোতেই। ঠাকুর স্টেটের কর্মচারী বেণীমাধব রায়ের বড়ো মেয়ে ভবতারিণীর সঙ্গেই বিয়ে হলো রবীন্দ্রনাথের। তবে বিয়ের পরই ভবতারিণী মৃণালিনী হবার দীক্ষা গ্রহণ শুরু করে। প্রথমে মহর্ষির নির্দেশে তিনি ঠাকুরবাড়ির প্রচলিত আদব-কায়দা-বাচনভঙ্গি শেখার ঘরোয়া তালিম নেন নীপময়ীর কাছে। পরে নীপময়ীর অন্য নারীদের সঙ্গে ‘মৃণালিনীম্ব পড়তে গেলেন লোরেটো হাউসে। রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রাণীম্বর প্রথম অভিনয়ে মৃণালিনী সেজেছিলেন ‘নারায়ণীম্ব আর ‘দেবদত্তম্ব-এর ভূমিকায় ছিলেন তাঁর মেজো ভাশুর সত্যেন্দ্রনাথ। ঘরোয় অভিনয় নয়, বেশ বড়ো মাপের আয়োজন হয়েছিলো সেদিন। মৃণালিনী এ অভিনয়ের মাধ্যমে বেশ জনপ্রিয় ও প্রিয়শ্রুত নাম হয়ে উঠে।

স্ত্রীর কাছে রবীন্দ্রনাথ কী প্রত্যাশা করেছিলেন? তাঁর এক চিঠি থেকে জানা যায়, “আমাকে সুখী করবার জন্য তুমি বেশি কোনো চেষ্টা করো না- আন্তরিক ভালোবাসাই যথেষ্টঃ। তবে একথা সত্য, তাঁর প্রত্যাশার প্রায় সবটুকুই পূরণ করেছিলো মৃণালিনী। জীবনের সবক্ষেত্রে এমনকি শন্তিনিকেতনে আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বাসনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সেখানে গেলে মৃণালিনীও তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

সময় যতো এগুতে লাগলো ঠাকুরবাড়ির শিল্প-সাহিত্য কেন্দ্রীক সংস্কৃতির একটা নিজস্ব ছাপ পড়তে শুরু করলো সমাজের বুকে। বস্তুত ১৮৭৫ থেকে ১৯২৫- এ পঞ্চাশ বছরটাকে যদি এক ঝলকে, এক পলকে দেখে নেয়া যেতো, তাহলে ঠাকুরবাড়ির সোনালি-উজ্জ্বল দিনগুলোকে একসঙ্গে দেখা যেতো। বাঙলার নারী সমাজেও এ সময়ে এসেছে পরিবর্তন। ঠাকুরবাড়ির হৃদমহলেও জ্ঞানদাননন্দিনী-স্বর্ণকুমারী-মৃণালিনী-সৌদামিনীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন প্রতিভা-ইন্দিরা-সরলা-সুষমা-শোভনারা। সময় ও সমাজকে তাঁরা যা কিছু দিয়েছেন, তাতে উপকৃত হয়েছে পুরো নারী সমাজ এবং এতে উঠে এসেছে তৎকালীন বিপরীত কালস্রোতেও ঠাকুরবাড়ির ভেতরে প্রবহিত প্রগতিশীলতার কথা। এ যেনো নারী জাগরণের ইতিহাস পর্যালোচনার এক মূর্ত প্রচ্ছদপট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন