রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

অতনু তিয়াসের কবিতা












যাত্রা...

ছায়ার আশ্রয় ভেঙে
প্রখর রোদের নিচে দাঁড়াও একবার
একবার আপনারে জাগাও
একবার সাহসেরে রাগাও
পরম ধনুকে তোলো টঙ্কার...
একবার প্রাণ মেলে গেয়ে ওঠো গান
একবার মাঠে নামো ছিঁড়ে পিছুটান
বিদ্ধ হও নিঃস্ব হও শূন্য হও
সৃষ্টি করো ছায়ার মিছিল
ছায়াদের কোলাহলে নামলে আঁধার
নিশ্চিতে ঘুমিয়ে যাবে জনপদ
সারারাত ঘুমকে পাহারা দেবে ছায়া
পরম আশ্রয় হবে মর্মের
একদিন মাঝরাতে ঘরে ফিরে দেখবে
তোমার ছায়া মানুষের শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে আছে বিছানায়
সর্বাঙ্গে লেপ্টে আছে মসৃণ অন্ধকার
সেই রাতে পূর্ণিমা অমাবশ্যা একাকার
আসুমদ্র হিমাচল তোমাকে ধারণ করবে ছায়াহীনতায়
আর তুমি উড়তে থাকবে অমৃত আলোর দিকে...


মনীষা তোমাকে
.............
মনীষা, তোমাকে শ্মশানে দেবো না
পৃথিবী জাগার আগেই শবদেহ কাঁধে নিয়ে নেমে যাবো পথে
নরলোকে প্রায়শ্চিত্ত বলে যদি প্রচারিত হয়, হোক
তবুও মনীষা, তোমাকে শ্মশানে দেবো না

তুমি চলে গেছো তবু নির্লিপ্ত প্রত্যঙ্গে ফুটে আছে উজ্জ্বল প্রেমের উৎপল
তোমার চোখে মুখে ঠোঁটে স্তনে অজস্র কথার মঞ্জরি
যেন এইমাত্র হাসতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছো
আধবোজা চোখের কোণে জমে আছে প্রশান্ত হ্রদ
আবহমান কাল ধরে সাঁতরে সাঁতরে অকস্মাৎ থেমে গেছো
একান্ত রাজহাঁস

পুষ্পিত শবদেহ কাঁধে নিয়ে অনন্ত ভ্রমণে যাবো বিশ্বচরাচর
স্থানে স্থানে খসে পড়বে এক একটি অঙ্গের শিল্পিত কথা
তোমার প্রত্যঙ্গ দিয়ে পৃথিবীর খাতা ভরে
লিখে দেবো মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা!


বাড়ি যাবো
.......
পুরুষ বেশ্যার মতো আমি এই নগরীতে আছি
ইচ্ছে হলেই পালাতে পারি না
আমাকে পালাতে দেয় না কাম

সারা দুপুর ফড়িঙের পিছে পিছে ছুটতে ছুটতে
ছোট্ট ফড়িং হয়ে ধানপাতায় ঘুমিয়ে পড়তো যে কিশোর
তার
মফস্বলের মধ্যরাতের ছাদ
মধ্যরাতের চাঁদ
সুর আর কবিতার
নিবিড় আড্ডা ভেঙে যায়
সেই থেকে আমি এই নগরীতে আছি
আমাকে পালাতে দেয় না কাম
আমাকে পালাতে দেয় না সিঁড়ি

ইটের অরণ্যের সোনার হরিণ হে, আমাকে
কোন পথে নিয়ে যাচ্ছো তুমি
পাটক্ষেতের আল ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি বাড়ি ফিরতে চাই
পুনই বিলের পুঁটি আর রুপালি বাঁশপাতা মাছে খালুই ভর্তি করে
ঘোর সন্ধ্যায় আমি বাড়ি ফিরতে চাই
শীতরাতের ঢপযাত্রা শেষে রাধার বিরহ আর কুয়াশায়
ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরতে চাই


সময়, একটু পেছনে চলো
মা আমার দুধভাত মেখে অনন্তকাল ধরে বসে আছে পৈঠায়
আমি বাড়ি যাবো!
আমি বাড়ি যাবো!!


বরযাত্রা
.........
একযোগে নেচে উঠলো আনন্দগুলো
অগণিত গুচ্ছ গুচ্ছ আনন্দ দখল করে নিলো পাঞ্জাবির পকেট
বিকেলের হাসিতে আবির ছড়িয়ে পড়লো পশ্চিমে
ঝাঁক ঝাঁক নেমে এল গোলাপি রোমান্স
ঠাট্টায় রাঙিয়ে দিলো মন
আমার পাঞ্জাবির পকেট তখন উপচে পড়ছে আনন্দে
আর এক এক করে লাফিয়ে পড়ছে ঘাসের ডগায়
আনন্দের বিন্দু বিন্দু শিশির
পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে কংস
আর আমি সারি সারি হলুদ রুমাল বিছানো হেমন্ত পেরিয়ে
প্রিয়মুখ সমীপে
প্রযত্নে: পিযূষ কান্তি

সান্ধ্য প্রদীপ-জ্বলা তুলসী তলায়
প্রদীপ শিখার মতো তারও কি চন্দন ঘ্রাণে কেঁপে উঠছে মন?
উলুধ্বনির সাথে উড়ছে কামনা?

উনত্রিশ বসন্তের প্রতীক্ষা পেরিয়ে আজ আমার প্রতিমা দর্শন
কালোদিঘি জলে
সাঁতারের ছলে
আজ আমার আত্মসমর্পণ।


বৌ
...
কেমন পুতুল বৌ এনে দিলে মা
সারাবেলা বৌ বৌ খেলে ভেসে যায় সোনার সংসার
বৌ আমার কুয়াতলায় মাটির কলসি ভাঙে রোজ
চালুনি-কুলার কাজে ভুল করে কাঁদে
হাঁড়ির ভেতর পুড়ে চাড়া হয় লাউফুলভাত।

কেমন পুতুল বৌ এনে দিলে মা
বৌ আমার বাউটির শাদা রঙ সিঁদুরের লাল দেখে হাসে
সাঁঝের তুলসী তলায় হাসে না কেবল মাটির পিদিম।

লাঙলের ফলায় এখনো লেপ্টে আছে গাভিন জমির দো-আঁশ শরীর
মাটি থেকে তুলে আনা সোনার মোহর কাঁদে অযত্ন লালনে
যে বোঝে না ফসলের সোনালি কীর্তন
আঁচলের গিঁট খুলে তার হাতে তুলে দিচ্ছ ভাঁড়ারের চাবি...

তোমার শীর্ণ হাতের স্নেহজ পূজার লোভে
শূন্য হতো এ বাড়ির ও বাড়ির লক্ষ্মীর আসন
আজ এই ঘর ছেড়ে অনাহারী দেবতার হাত ধরে সুখ চলে যায়।

আমার পুতুল বৌ কোনোদিন বিষ্ণুপ্রিয়া হলে
হাতের রেখায় তার ফুটে উঠবে প্রসন্ন ধানছড়া।


অকাল যাত্রা
........
চোখে তোমার জলের মহাল বুকে খরার অনন্ত মাঠ
রাত দুপুরের বিজন পুকুর শ্যাওলা ধরা শানবাঁধা ঘাট

ডাক দিয়েছে অরণ্যঘুম শামিল হতে মধ্যরাতে
আঁকড়ে ধরে মাটির কলস দড়ির গোছা শক্ত হাতে

চলছো রাধা কলঙ্কিনী কোন আবেশে একলা একা
বিক্ষত মুখ বিক্ষত বুক ছিন্নভিন্ন স্বপ্নরেখা

নিন্দা সকল ফুলাঞ্জলি ভেবেই হাসে চাঁদনারীমুখ
বোকা মেয়ে ডুবলি জলে কলঙ্কতেই প্রকৃত সুখ।


তন্দ্রা
......
এইমাত্র মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো একজন প্রেতাত্মার অবশিষ্ট ছায়া
এইমাত্র চোখের পরত ফেলার যতটা সময় আমার উষ্ণ শরীর
শুঁকে শুঁকে উড়ে গেলো জমাট অন্ধকার যার বিশাল হা-এর মধ্যে
একে একে ঢুকে যাচ্ছে মানুষের কোলাহল, সুবর্ণ গ্রাম, শিশু ধানক্ষেত
শঙ্খের মতো রোদ
যারপর সমস্ত আকাশ
তীব্র গর্জনে কাঁসার বাটির মতো কেঁপে কেঁপে উল্টে যাচ্ছে নদী ও পুকুর

তন্দ্রা নামের যে রঙিন মেয়েটি আমার চোখে এসে বসলো তাকে আমি চিনি
তার সাথে নিয়মিত দেখা হয় অশ্বদের আস্তাবলে
ঢেউটিন চালের সরুছিদ্রপথে জ্যোৎস্নার আলোর সাথে
নিঃশব্দে সে আস্তাবলে ঢোকে
তখন আমি অশ্বের ভূমিকায় বিভোর- অশ্বরাখাল
যতদূর দেখা যায় সুদর্শনচক্রের মতো ঘুরছে সৌরজগৎ
ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবী নামের গ্রহটি বিচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ছে
নেমে আসছে ঠিক আমার মাথার উপর
এটম বোমার মতো ফেটে যাচ্ছে মৃন্ময় পৃথিবী
প্রেতাত্মার ছায়ার মতো দিক-বিদিক লাফাচ্ছে কালো ধোঁয়ারাশি
একে একে গিলে ফেলছে মানুষের কোলাহল
সুবর্ণ গ্রাম
শিশু ধানক্ষেত
শঙ্খের মতো রোদ
যারপর সমস্ত আকাশ

অকস্মাৎ অশ্বেরা ডেকে উঠলো হ্রেষা
তন্দ্রা নামের রঙিন মেয়েটি চোখ থেকে নেমে পালিয়ে গেল দ্রুত
জানতেও পারিনি কখন যে হাত ফসকে পড়ে গেল
আশ্চর্য বাঁশির মতো সেই গল্পটি
‘হিরোশিমা কথা বলে’।


চাঁদ উপাখ্যান
.........
জন্মে তার ছিলো নাকি পাপ
সে এক ঝিনুক সন্তান
কবেকার প্রাচীন ডুবুরি এক সমুদ্রের তলদেশ খুঁড়ে
মাতৃ উদর চিরে তুলে ছিলো অরূপ ডাঙায়

কোনো কোনো পাপ সুন্দর
বুঝেনি সে অবোধ মুক্তা শিকারি
আনমনে ছুড়ে মেরেছিলো এই অনন্ত আকাশে...


হাওড়
...
হিজল বনের তলে সুন্দরী হাওড়ের জলযৌবনের গহিনতা
আমাকে বুঝতে হবে
পরাণ মাঝির গানে কিশোর এই মন ছুটেছিলো কোন ভাটি গাঁয়
আমাকে খুঁজতে হবে
ধামাইল গানের তালে কোন সে শ্যামাঙ্গিনী
আলতা রাঙানো পায়ে ঘুঙুর বাজায়
আমার প্রাণের ঘাসে
অঙ্গের বাঁকে বাঁকে কী রহস্য তার
প্লাবনে মাতাল কেন মধ্য আষাঢ়
আমাকে বুঝতে হবে দামানের বেশে
মধুপূর্ণিমারাতে নৌকাবিলাসে...


ওড়ো, পাখি ওড়ো
............
অনুতাপ বেজে ওঠো মগজের কোষে
অনুতাপ বেজে ওঠো নিজ মুদ্রা দোষে
অনুতাপ জ্বলে ওঠো আকাশে আকাশে
অনুতাপ জ্বলে জ্বলে আলো হয়ে যাও

ত্রিভুজ সন্ধ্যায় আকাশে জ্বেলেছো কে অচেনা লণ্ঠন
আমাকে দীক্ষিত করো আলোব্রহ্মজ্ঞানে
ভারাক্রান্ত মেঘগুলো পুষে আছি বহুদিন
উষ্ণতা ঢেলে কোনোদিন বৃষ্টি ঝরাবো বলে
বৃষ্টির চুমোয় যদি হেসে ওঠে অন্তত একটি ঘাসফুল
বোবা সময় যদি বলে ওঠে শ্রেষ্ঠ কথকতা

অরণ্যে আগুন লাগিয়ে একদিন স্বপ্নে এঁকেছিলাম ইউরেনাস
সেই থেকে দুই চোখ ধাতবখচিত
সেই থেকে দুই হাত কুঠার কুঠার
ডানা পোড়া পাখিদের পতন দৃশ্যে ভুলেছিলাম আত্মার স্পন্দন
আজ আমি সেইসব পাখির নামে
প্রাণ খুলে মেলে ধরি নতুন আকাশ
ওড়ো...
পাখি ওড়ো...

1 টি মন্তব্য:

  1. খেপা নাগর

    ওরে ও আমার খেপা নাগর
    তোর জন্য অমার মনটা পাগল।

    অন্ধার ঘরের বান্ধা জালে
    ভূইলা নাগর আইল ঘরে।

    জালের মধ্যে ধরা পড়ল কৈ মাছ
    নাগর আমার খারি খায় বারমাস।

    জালের সুতা টেনে ডাঙ্গায় তলি
    জাল ঝেড়ে কৈ মাছ বাছে।

    ডুলার মধ্যে যতন করে কৈ মাছ রাখে
    নদীর জলে নাগর আমার খেপলা জাল বায়।

    নাগর আমার কৈ মাছে প্রাণ
    গরম তৈলে প্রাণ যায় না আর।

    ওরে ও আমার খেপা পাগল
    দরত দেখিয়ে খাইলি ডাগর।

    জলে মাঝে দুলছে নাও
    ওরে আমার বৈঠা দিয়ে যা।

    হেইয়া রে হেইয়া রে হেইয়া রে
    মনটা আমার খেপাস নারে।

    মন মাজারে খামছি মারে
    ইছামতি নদী তোর বহনে।

    ও অমার দরদীয়া নাগর
    উতাল পাতাল করিস না এখন।

    উত্তরমুছুন