মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

চিকন কালা গো, বাঁশি না বাজাইও দুপুর বেলা

মাসুদা ভাট্টি


আমাকে মাঝে মাঝে ভূত-এ পায়, আমার পাশের মানুষটি এই ভূত-এ পাওয়া আমিকে খুব ভয় পান, আমি নিজেও বুঝি যে, তিনি খুব অসহায় হয়ে পড়েন এই সময়গুলিতে। এ যেনো চাঁদগ্রস্ততা এক, হাঁটছি ফিরছি সংসার করছি জীবনের ঘানিতে তেল দেয়ার প্রয়োজনেও নিত্য জীবনক্ষয়কারী চাকরিটিও ঠিকই করে যাচ্ছি, কিন্তু আমি নেই, এই জীবনে কোথাও নেই। তাহলে কোথায় আমি? প্রশ্নটা করি, উত্তর নেই। এ এক অসম্ভব হেঁয়ালিময়তা, নিজেরই সাথে নিজের। এই সময়টা বেশ কষ্টের।

অনেক দিন আগের এক গল্প বলি। কোনও এক কার্ত্তিক মাসের গল্প। তখন আমাদের ওদিকে ইরি চাষ হতো না। ইরি-র চাষকে সবাই তখনও “বোলোক করা” বলে জানতো। আমাদের বাড়ি থেকে মাইল পাচেঁক দূরে আমার ফুপু বাড়িতে তখন সবেমাত্র এই ব্লক করা শুরু হয়েছে।তার ফলাফল তখনও অজানা বলে, আমাদের শুধু বিলের নীচু জমিতে বোরো ধান আর তার চেয়ে আরেকটু উঁচুতে আউশ ধান আর বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে প্রবল বৃষ্টিপাতের পরে (যার নাম বাইন পড়া) আমন ধান বোনা হোত। আমন ধান বলে আমরা অবশ্য তাকে জানতাম না, জানতাম লক্ষ্মী দীঘা ধান হিসেবে। এই ধান পানির সঙ্গে বাড়ে। যতো পানি ততো ধান, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যখন দক্ষিণ থেকে জল শুধু আসতেই আসতেই থাকে, তখন এক রাতে নাকি এই ধান আধ হাত বাড়ে, জানি না কতোটা সত্যি কতোটা মিথ্যে, এই হাত মাপায়।

আশ্বিনের সংক্রান্তিতে এই ধানে ফুল আসে, আর সেই সংক্রান্ত্রিতে যে “আড়ং” হয় কুমার নদে, সেই আড়ং-এ আসা বাইচ-এর নৌকোর বৈঠার ঘায়ে ফুল ঝরে দুধ-ধান ধরে। জলের ওপর সত্যি সত্যি তখন ধানের ফুলের পাপড়ি ভাসে। আর সাত হাত আট হাত গভীর জলের তলায় সবুজ শ্যাওলা দোল খায়, নৌকোয় বসে সেই জলের ভেতর রোদ ঢুকে যেতে দেখতে কী যে ভালো লাগে, সে বলে বোঝানোর নয়। তবে সবচেয়ে মজা হতো ছোট্ট নৌকোয় করে কোনও ধান ক্ষেতের ভেতর ঢুকে গিয়ে “ঢিমা” দিয়ে পুঁটি মাছ ধরায়।ভাতের সঙ্গে কুড়ো মিশিয়ে একটা মন্ড তৈরি করা হয়, তার সঙ্গে অনেকখানি পাটেনর “ফেউসা” মিশিয়ে শক্ত গোল করা হয় যাতে পানিতে ভিজে ভিজে ঢিমাটি ভেঙে না যায়। একটা মোটা পাটখড়ির মাঝে চিকন দড়ি বেঁধে তার আগায় এই ঢিমা ঝুলিয়ে পানিতে নামিয়ে দেয়া হয়, মিনিট খানেকের মধ্যে পুঁটি মাছ সেই ঢিমা খেতে আসে আর তার পাশেই তিন চারটি ছোট ছোট বড়শিতে ভাত গেঁথে টপাটপ পুঁটি মাছ শিকার। এই শিকারের হিসেব হয় কুড়িতে, এক কুড়ি কোনও ব্যাপারই না, সাত আট কুড়ি না হলে লোকে তাকে ঢিমা দেওয়া বলে শিকারই করে না। মাঝে মাঝে অবশ্য পুঁটির সঙ্গে ছোট ছোট কই মাছও ধরা পড়ে, কিন্তু সেগুলো সব ‘কাইশ্যা কই’, আমাদের বিলে-অঞ্চলে কই মাছ “দো-সইনা, তে-সইনা” না হলে খায় না কেউ, ছোট কই খেলে নাকি কাশি হয়।

যাহোক, আশ্বিনের শেষেই আমাদের বাড়িতে পদ্মার চর এলাকা থেকে লোকজন আসতো ধান কাটার জন্য। স্থানীয়রা নিজেদের ধান কাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো বলে অতো দূর থেকে তারা আসতো ধান কাটতে। যদিও তারা আষাঢ় মাসে একবার এসে জেনে যেতো ধানের কি অবস্থা। আর তখন নিয়ে আসতো কাঁঠাল, ছানার সন্দেশ, দানাদার, আমার অবশ্য গজাই খুব প্রিয় ছিল। ময়দার ছাঁচ ভেজে চিনির শিরায় ডুবোনো গজা। ওহ্ ভুলে গেছি, আশ্বিন সংক্রান্তির আড়ং আসলে বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষে, তাই এ সময় মিশ্‌রি দিয়ে ঘোড়া হাতি শিঙাসহ নানা ধরনের ছাঁচ পাওয়া যেতো, আমি সারা বছরের জন্য সেই সব ছাঁচ জমাতাম, মনে হতো আমি সব দিয়ে দিতে পারি, কিন্তু সেই সব ছাঁচ দেবো না, যদিও খেতে কী যে ইচ্ছে হতো। কিন্তু খেতাম না। আমার প্রিয় কুটিকালের প্রেমিক বনি আমিনকেও দিতাম না। উল্টো বনি আমিন সেসব চাইলে ওর পেটের ওপর পা দিয়ে নিজে মা-কালি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। এটা ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা। বনি আমি শিব, আর আমি কালি। যদিও সে ছিল আমাদের মসজিদের হুজুরের ছেলে।

কার্ত্তিকে ধান পাকলে বাড়ি ভর্তি কিষ্‌ষান, তারা বিশাল পাতিলে ভাত রাঁধে, বাইর-বাড়ির উঠোনে গর্ত করে চুলো বানিয়ে তাতে ইটেঁর ঝিক্ দিয়ে তাতে রান্না করতো। সেই ভাতের সঙ্গে পাতলা ডাল, মাঝে মাঝে কচুর “গাঠি” দিয়ে মাঝের ঝোল। কেন যে তারা শুধু কচুর মুখি কিনতো কে জানে? সেদ্ধ কচুর মুখি আমি ছিলে দিতাম। যদিও আমার ওদের ওখানে যাওয়া মানা ছিল। কে শোনে কার কথা, আমি রেঁধে দিতাম, বেড়ে খাওয়াতাম। নিজেও খেতাম, চুলোর পাশে গনগনে আগুন (আসলে ছাই) তুলে তার ওপর বড় বড় শুকনো মরিচ ছেড়ে পুড়িয়ে নিয়ে, সামান্য শর্ষের তেল দিয়ে সেই মরিচ ডলে, সেই পাতলা ডাল আর গাঠি ভর্তা দিয়ে লাল লাল লক্ষ্মী দীঘা ধানের ভাত খেতে অমৃত মনে হতো। তখন সন্ধ্যে বলে বনি আমিন থাকতো না, কিন্তু ওকে খাওয়াতে খুব ইচ্ছে করতো। কি আর করা? আমি বনি আমিনের জন্য এক মুষ্টি ভাত চুলোর মধ্যে ফেলে দিতাম।

একেক দিন কিষ্‌ষানরা একেক ক্ষেতে যেতো। সারাদিন বাড়িতে ধান নিয়ে নানা কাজ হচ্ছে, আগের রাতে মাড়াই করা (আমরা বলি মলন দেয়া) ধান শুকোনো হচ্ছে, বাতাসে ধরে উড়িয়ে ধুলোমুক্ত করা হচ্ছে, তারপর ঝনঝন আওয়াজ হলে শুকনো ধান গোলায় তোলা হচ্ছে। ঠিক এই সময়ই তিনি আসতেন। পরনে আধ ময়লা ধূতি, কোমর থেকে লুঙ্গির মতো করে এক খন্ড, আরেক খন্ড এখনকার ল্যাহেঙ্গার ওড়নার মতো এক পাশ কোমরে গুঁজে অন্য পাশটি গলার দু’পাশে পেঁচিয়ে রাখা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, খালি পা, শিরা দ্যাখা যায়। এসেই বলতেন, “আইলামগো মা, সেই যে গ্যালো বছর আইছিলাম, আর এইবার আইলাম। আইজ কিন্তু চাইড্‌ডা স্যাবা করবো আপনাগো বাড়ি”।
আমার জন্মের পর থেকে তাকে দেখেছি, চিনি, কোথায় থাকে তাও জানি, কিন্তু বছরের আর কোনও সময় তার সঙ্গে আমার দ্যাখা হতো না। আমাকে দেখেই বলতেন, “যাওতো তাকের উপর বাতাসা রাখা আছে, পেতলের গিলাশটা মেজে জল আনবা, আর তিনটে বাতাসা আনবা, বড্ড তেয়াশ লেগেছে”। আমি “ভুন্নুত” (এটাও সেই মানুষটির থেকে শোনা শব্দ) করে ছুট লাগাতাম, হয়তো তখন ধান নাড়ছিলাম, কিংবা হাতে কোনও কাজ থেকে থাকবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? তখন মনে হতো না, এখন মনে মনে ভাবি, উনি কেমন করে জানতেন যে, তাকের ওপর বাতাসা রাখা আছে? সেই ধানের সময় উদাসীন ময়রা আসতেন, নানা রকমের মিষ্টি নিয়ে, বিশাল এক গামলার মধ্যে অর্ধেক পানি দিয়ে তার ভেতরে আরেকটি গামলায় করে নানা পদের মিষ্টি রাখা থাকতো, আমি সেখান থেকে প্রতিটি পদ একেকটি করে পেতলের থালায় সাজিয়ে, তেঁতুল দিয়ে মাজা গ্লাশে জল ঢেলে নির্মল দা’র বউ মাধবী বউদি যেমন করে পুজোর কোশাকুশি মেজে ঘাট থেকে বাড়ি ফিরতেন, ঠিক তেমন করে ডান হাতটা উঁচু করে তার পাতার ওপর পেতলের থালায় মিষ্টি নিয়ে, বাঁ হাতে জলের গ্লাশ নিয়ে তার সামনে নামিয়ে রাখতাম। তিনি তৃপ্তি করে জল খেতেন, তা দেখে আমার খেতে ইচ্ছে করতো খুব। এটা অবশ্য আমার আজীবনের, কাউকে কিছু খেতে দেখলেই আমার খেতে ইচ্ছে করে।
এই জল খাওয়ার পর্ব শেষ হলেই শুরু করতেন গান। প্রথম গানটি আমি এখনও মুখস্ত পারি, “আমি পরের জন্য বানলাম রে বাড়ি ঘর” এবং তারপর দীর্ঘ সময় নিয়ে গাইতেন যে গানটি, সেটি আমি এই হঠাৎ একজনের মুখে শুনতে পেলাম, তিনি নাকি কোলকাতা থেকে শান্তি নিকেতন যাওয়ার পথে রেলে এক গাতক-এর গলায় শুনেছেন। কার্ত্তিকের দুপুর, বউঝিরা ধান ওড়াচ্ছে, ঝকঝকে রোদে কেউ ধান নাড়ছে, বাড়িতে কোনও পুরুষ নেই, সবাই গেছে ধান কাটতে। তখন তিনি গাইছেন, “চিকন কালা গো, বাঁশি না বাজাইও দুপুর বেলা গো” – আমি সেই বয়সে, তখনও রোহিনী হয়েছি কি না মনে নেই, তখনও সেই চিকন কালার জন্য শরীরে মনে পুলক অনুভব করতাম। এতে কেউ আমায় ইঁচড়ে পাকা বললে, আমার কোনও আপত্তি নেই। একের পর এক গান হতো, কেউ বলতেন, “ও গুসাঁই, ওইড্যা গাও না?” কেউ বলতেন, “ও গুসাঁই কালার বাঁশি শুইনা মন জানি কী অয়, ওইড্যা গাও দিহি”।

আমি কার্ত্তিকের গল্প বলি, কতো কার্ত্তিক আসে, আমি কেন যেনো এখনও সেই লোকটির অপেক্ষায় থাকি, নাকি কে জানে আমি সেই চিকন কালার অপেক্ষায় থাকি? যে বেছে বেছে শুধু দুপুরেই বাঁশি বাজায়। আমার খুব মন কেমন করে সেই গোসাঁইয়ের জন্য। মনে হয়, কতো কাল, ক. . তো. . কা. . ল আমার গোঁসাই আসে না।

(বালিকার ঋতু-দর্শণ শীর্ষক রচনার খণ্ডাংশ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন