মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

মাজুল হাসানের কবিতা

বেবি রহমান বলে কোথাও কেউ নেই
........................
বেবি রহমান বলে কোথাও কেউ নেই... আছে তার ছায়ার কঙ্কাল। সুখী মানুষের জামার মতো তার কোনো লেখা নেই, নেই শেমিজ-আভরণী দুপুর অম্লান। তবু, হয়তো কোথাও কেউ থাকে, যার নাম চৌরাসিয়া অথবা চরটকাটা। থাকে কমলার খোসার মতো আত্মঘাতী জল। অনল অবিকল। তবু কেন যে কখনো কখনো নিচে নয়, পুরো সমুদ্র উঠে যায় ঊর্ধ্বালোকে; সিলিংফ্যান বরাবর!

আজ এতদিন পর, পাতাকুড়ানী মেয়ে- তুমি ফিরে এলে সোনারঙ মাকড়সা হয়ে। তোমার জরির জালে ফিরে এলো কেটে-ফেলা পুরনো আঙুল, আমাদের পোষা সংসার, মায়া-কাকা, মা-মাসীমা-পরি দিদিমনি। মরে গিয়ে এতদিন তাদের সবার পরিণতি ছিলো নীল-বনসাই আর টালিখাতার লাল স্খলন; রুল-টানা টাউনিয়া রোদ অথবা পাথরকুচি ঘুম। তবু কোথাও কোনো হরতকি-বাঁকলে খোদিত নেই দুধ-ভাতের রূপকথা। রূপকথা, রূপকথা গো... আমি এক বেহায়া নদী। চাই, কেবল চাই একটিমাত্র জামরুল-গন্ধী নাম। আমার বয়স শঙ্খের সমান।

২.
একটা ব্যাঙের ছাতার নিচে আমাদের পরিচয়! তবু চকলেটগন্ধী বৃষ্টির জন্য কত আয়োজন। কত ওয়াগন, কত বগি, কত প্রত্নঅশ্ব-ইঞ্জিন। তবু বিবিধ বাতি আর টালমাটাল লাইটম্যান জানে, রাত এক বর্ণচোরা অধ্যায়। এখন তো তবে বাজির আসরে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এভাবে নিরুপায় ভাগ্যের ষাঁড়ের চোখে লাল কাপড় বেঁধে আদতে কার কী লাভ হয়েছে? জগতের সবকিছুই কি জয়-পরাজয়?! কালা কৈতরের মতো চম্পা-বিবির দোলনা চলে গ্যালো কাছিমবাজার। শ্রীমান বিশ্বনাথপুর হয়ে ফিরে এলো শেষরাতের সেভেন-আপ-মেইল। স্টেশনমাস্টার আজ তোমাকে বলতেই হবে, এভাবে আর কতবার খোয়া যাবে ভেলু বোষ্টমীর পা?

বাড়ি যাও হুইসেল, বাড়ি যাও। নলিনী এখন ঘুম যাবে কেশুর-আলতা পদ্মপাতায়।

৩.
আর একবার অর্কেষ্ট্রা ডুকরে উঠলে আমি একটা নীল চোপড়া মাছ হয়ে যাবো। আমার উড়াল বিষয়ক দুর্বলতাগুলো তখন বন্ধুত্ব করে নেবে আমার স্বভাবের বিপরীত বৃক্ষছানাদের সাথে। আলাপ হবে: নন্দীগ্রাম। জ্বালাও- পোড়াও শরবিদ্ধ চাঁদ। সাল-সাদোইম বলো তো, নন্দিনীর নাকফুল আর আমলকীর তারা; মাঝখানে ফারাক কতটুকু? তোমার উত্তরের আশায় উত্তরাকাশে মাথাগুঁজে হেঁটে গ্যালো শ্বেত-শুভ্র হাতির দঙ্গল। পিছুপিছু একপাল কৃষ্ণ হরিণ, গ্যালো তাদের বাচ্চাকাচ্চারা। ওরা আমায় মনে করিয়ে দিলো পানিফলের স্বাদ।

আর একবার অর্কেষ্ট্রা ডুকরে উঠলে আমি এফোঁড়-ওফোঁড় চলে যাব সিংড়ার জঙ্গল। মাসকলাই ভেবে মুখে তুলে নেবো শতসূচ শোয়াশিং। পায়ের উপর দিয়ে রিং-রিং- চলে যাবে এনি, জলঢোড়া অথবা বিষাক্ত জলবোড়া সাপ। কিন্তু কেউ কোনো রা’ কাড়বে না। কারণ, আমার মুখে তখন আমলকীর তারা। বৃষ্টি এলে জগতের তাবৎ স্বাদ এসে ধরা দেবে একটা চুমুতে।

৪.
রাজহাঁস। প্রথমে ডুব দিলে লাল-পুকুরে, তারপর ডানার আলতো আঘাতে আন্দোলিত হলো আলটোপ্পা-জল। জরির-জহর। সবশেষে অশোকলতার মতো কাঁপলো আকুপাড়ার আরক-জলধি। আসলে রঙের ঊর্ধ্বে কোথাও কোনো জীবন নেই। তাই মিথ্যে রাখালের মিথ্যে অন্ধকারে হারিয়ে গেলেও মানুষ ফেরি করে ডানাওলা ডিম। ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে শত শত রঙিন মার্বেল। শরীরে তার স্মৃতি নান্মী পালক। এহেন সংকরিত উড়াল নিয়ে যেদিন সে হানা দিলো ব্যক্তিগত বিকেলে, দেখলাম— আহা, কী শুভ্র-দীপ্ত দেবদারু!

রাজহাঁস, তোমার শরীরে দাগ কাটে না কিছু। দিনদিন উন্নতগ্রীবা ফুলে-ফেঁপে পুষ্ট হচ্ছে আরো। অথচ জানা নেই, আমার একান্ত পোষ-মানা রুপালি বৃষ্টিগুলো তোমায় ছুঁয়েছিলো কাঁপা নোলকের মতো!

৫.
ঘর মানেই কাঠকয়লা- আগুনরঙা ফুল। ফুলের দেয়াল ফুটো হয় আর আমি তাতে ঠোঁট বুলাই। আজ যা লালা একদিন তাই হবে গোপনেরও গোপন। তখন ছাদ দিয়ে গলগল নেমে আসবে রাইশস্যের রক্ত। করি-করি করে আজও জিজ্ঞেস করা হলো না; হে ক্ষুরধার পিরানহা, মাংস খসে পড়লেও শিকার কি করে বেমালুম থাকে তখন? কেনই বা রক্ত ঝরলে মেঝে সচল হয়ে ওঠে? আমি সেসব এক্কাদোক্কা হেফজ করি উড-প্যাকারের গর্তে। আর ঘৃতকুমারীর রসে লিখে রাখি দুইমাস বয়সী ভ্রূণের আর্তি। একটা নতুন স্কুলফ্রক ছাড়া যার কোনো দাবি নেই; দায় নেই জন্ম প্রার্থনার। বলতে গেলে, সচলতার দায় কেবল মানুষের, যাদের দুই পা... ফুটন্ত, দুই হাত... ভূপাতিত; তবু কী সাবলীল উড়ন্ত! হে ম্রিয়মাণ ঘর, অপেক্ষায় থাকো। একদিন কথার ভারে ঠিক ঠিক হুড়মুড়িয়ে পড়বে সিঁটিমরিচের দুপুর। পড়বে খিলান, কোটাঘর, জমানো ইঁদুরের খুঁত। সেদিনের নাম হবে অশোকলতা।

৬.
শৈশবে যেসব নীল-সারসের স্বপ্ন দেখতাম আজ তারাই এনেছে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ। অভিযোগ যার অন্য নাম শিংমাছ, এমন এক দঙ্গল মুমূর্ষু সাঁতার এসে বলে গ্যালো- ডুমুর-পুকুরে আর কোনোদিন হেলেঞ্চাকুঁড়ির সাথে এনি-সাপের বিয়ে বসবে না। তবে কি হলুদ মেখে রাফেজা’বু কলপাড়ে বসবে না কোনোদিন? অথর্ব ঘুঘুরি এসে চাইবে না ভেঙে ফেলা থালার জীবন? হুঁইসেল বাজিয়ে মাথার ভেতরে থেমে থাকে দমকল। এখন মালগাড়ি স্থির, পেশকার স্থির, তিরতির কাঁপছে সেনবাগের মাথাকাটা মুহুরির বন। সব দিয়ে-থুয়ে, রাফেজার মা আমেনা-আয়া তবে কি এই কিনেছিলো- গুটলি-আমের ভূত! ও ভাই হেড মওলানা- তোমার কি কথা বলা পাখি আছে কোনো? ময়না টিয়া অথবা বুলবুলি? দ্যাখো না, এক ঘড়া জলপানও পাচ্ছে না রিক্সাওলা স্বামী। কেবল দমকল বাজছে। গদ্যেরা বাজছে, কিসামত-তাওরেগা বাজছে, দণ্ডপানি বাজছে। চারিদিকে শুষুকের কান্না। কেবল প্যাডেল ঘুরছে, কাচারিরোড ঘুরছে, বাহাদুরবাজার ঘুরছে, করবী ফুল ঘুরছে, আহা করবী ফুল!

৭.
নরম থাবায় ধারালো নখের বিড়ালেরা বেরিয়ে পড়ছে রাস্তায়। এমন সময়, গঙ্গাফড়িং-ছেলেমেয়েরাই কেবল অতিকায় লাটিম দাবি করতে পারে। লোডশেডিংকে বলতে পারে- মোস্ট ওয়েলকাম। চাইতে পারে- জল-সিঙাড়া, ফিনফিনা মিঠা পানিজাম! সেইমতে প্রতিটি কামরাঙা গাছ আসলে এক-একটা গল্পের ঝুড়ি। গল্পে বড়োরা সার্কারামা দেখছে, সার্কাসের ক্লাউন ছুটছে সরু দড়ির উপর দিয়ে। ঝলসানো আপেলের মতো ম্রিয়মাণ ঘরে জ্বলছে ক্ষীয়মাণ ধূপকাঠি। আমাকে সোনারকাঠি-রুপারকাঠির গল্প শোনাতো রাঙা পিসি। আতাফল, দাড়িকিনি মাছ... জোনাক নয়, পিসির পেট-খসানো বিধবা-রক্তে ভেসে যায় পদ্মপুকুর। গল্পের বাইরে মৃত রক্তজবা, প্লাস্টিকের বাঁশঝাড়। কাঁদছে কেউ! ওরাশিশু। ঝিঁঝিঁ। ঝিঁঝিঁরাই জগতের প্রাচীনতম বিদ্রোহী।

৮.
বেবি রহমান বলে কোথাও কেউ নেই। নেই কোনো মিথ্যের অপসংলাপ। তবু সত্যি: কেউ কেউ লাল-লাঠি খেলতে গিয়ে সূর্যের গুঁড়ো নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলো। বেতার ভেঙে উছলে উঠেছিলো জলোচ্ছ্বাস। আশ্বিনী ঝড় মাথায় করে কেউ গিয়েছিলো তেঁতুলগাছের তলায়। অজগরের ফণায় চড়ে কেউবা গিয়েছিল খুনিয়াদীঘির পাড়। যে যেখানে যাক, আশলে, আমি চেয়েছিলাম মানুষ আর পঙ্খিরাজ সাপ যাতে হাত ধরাধরি করে বাড়ি ফিরে যায়। চেয়েছি স্বর্গস্মারক নখ— তাই দিয়ে হামলে পড়েছি সমুদ্রের গতরে। তবু সত্যি, সমুদ্রে মিঠামন নেই, মুড়কি-উখড়া নেই, মৎস্যকন্যার মতো নেই কোনো জলকুমার। তাই আমাকে ফিরতেই হয় নদীতীরে, জনপদে, চাকায়। তবু গাঙচিল, হায় গাঙচিল... গাঙচিল হয়তো মিথ্যে নয় কখনো!

৯.
তারা আমাকে ভূরিভোজের পরিকল্পনা করে। আর আমার কেবলি মনে হয়, বাবলা-কাটাই পৃথিবীর সবচে উৎকৃষ্ট কাটাচামচ। ওসব শোয়াশিং-চোখ আসলে মার্বেল বৈ অন্য কিছু নয় (রাত, একদিন ক্রুজ কাঁটা খেলবো তখন তোর সাথে)। তবু বাজার থাকে, ঘাট থাকে, থাকে আকাশ বিরুদ্ধ শামিয়ানা। পাশে কলকল জলকেলি। টুথপেস্টমার্কা হাসি দিয়ে আমরা ডলফিন-ফোয়ারা বানাই। হলিডে মেজাজে হাঙরেরা এসে কাচুলির গেরো আলগা করে। বেতারে তখন সন্ধ্যার কশ: ‘আলগা করো খোপার বাঁধন... তুহি বিন জিয়ারা না লাগে... না লাগে...’। পিঠে আমার মুয়ূরপুঞ্জ জিভ; বড় দয়াবান, হ্যাঁ মহাশয়!! ‘তুহি বিন জিয়ারা না লাগে...’। না লাগে চাবুকের দাগ। আহা জল, জটাধারী জল... ডুবোপথ... ডুমুরের ফুল! ফুল বাগিচায়, প্রকৃত আলোচনায়, জলই একমাত্র সত্য। দুধারে তেজপাতা বন। মাঝে জেগে থাকে দুই বাসিন্দার নিমজ্জিত রেললাইন। অথচ স্টেশনের কুলিমুটে, মাটির ভাঁড়ের কম্পমান চা, অয়েটিং রুম অথবা পাইলট-ক্যাপ টিকিটচেকার... কেউ জানে না- ডুবোপথ আমার অপেক্ষায় প্রতিদিন লাস্ট ট্রেনটাও মিস করে।


চালতা-পাতার ঈশ্বর
............
সব মানুষই উঠে যেতে চায় স্তনের এভারেস্টে— এটাই সত্য: এভারেজ পাঠপরিক্রমা শেষে একনিষ্ঠ বইপোকা হলেও আমাদের মন পড়ে থাকে ঐ উষ্ণতার দিকেই। আমাদের নারীকূল সূর্যদেবের জারজ-সন্তান বর নেন। অকপটে আমরা দুধ-চিড়া চিবাই। মেলায় গিয়ে চিলিক-বিলিক করি। তারপরেও একটা মৃতমাছের চোখ কী করে সাবলীল বেঁচে-বর্তে থাকে, সেই রহস্য আমাদের কাছে বেশি মনোযোগ পেয়ে যায়। আশলে আমরা প্রতিদিন একটা গাছের নিচে হা-করে দাঁড়াই। অতিথি পাখিরা বিষ্ঠা বর্ষণ করে। আর আমরা তার গুণাগুণ বিচারে একটা করে কমিটি গঠন করি। এভাবে লাট্টু ঘরতে থাকে, মাটি বিদীর্ণ হয়; আর আমরা কামতাড়িত হয়ে উঠি।

২.
আমি চৌরাসিয়া বুঝি না; বুঝি একমাত্র চালতা ফুল। আর বুঝি সঙ্গিনী মারা গেলে একাকী পেঙ্গুইন বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেয় কাচকাটা হিরার কলে! তাই তুমি যতই পলিগ্যামির কথা পাড়ো, প্রেমকে আমি কণ্ঠার হাড়বদল বলেই প্রচার করবো। তবু হয়তো নাভিরন্ধ্রে একদিন নশ্বর সিমেট্রি ঢুকে পড়বে। খোসপাঁচড়া ঢুকে পড়বে। টাটা-বাইবাই করতে করতে কার্নিশে ফাঁস দেয়া একটা বিকেল ঢুকে পড়বে চোখের সূর্যে। কিন্তু আমি কোনো উপাসানালয়ের চৌকাঠ মাড়াবো না। হায় একটা টাইম-মেশিনও বানানো হলো না জীবনে! সমর্পণের সমস্ত গন্ধম দিয়ে যদি আদতে একটি রূপকথাও লিখা না হয়, তবে আর পঙ্খিরাজ ঘোড়া পুষে কী লাভ?

৩.
আমাদের ছেকড়া মহল্লায় কোনো চালতা গাছ নেই। রেখে যায়নি কেউ; মাসি-পিসি, মহিষাল করিম ভাই; না কোনো পূর্বসূরি। তেমনি আমাদের পূর্বসূরিরা জানিয়ে যাননি কাশফুলের রক্তের কথা। আমরা সত্যিই জানি না- নদী কী করে নারায়ণের প্রসাদ আর লিঙ্গের খাঁজে জমে থাকা ক্বাথ একই ধারায় বয়ে নিয়ে যায়? ফলে এখনো আমরা মাখন চুরি করতে করতে ধুতরা গাছে গিরগিটি উঠার মতো করে দেবতা হয়ে উঠি। মাত্র বাদামি দিনটা পেরুলে এর ব্যতিক্রমও মিলবে। তখন শান্তনুর প্রেমে মজে যাবেন স্বয়ং গঙ্গা। আর শহরের ডাস্টবিনগুলো আলোকিত হয়ে উঠবে উচ্চকিত শিশুর কান্নায়। সেই কান্নায় একটা লাল-ঘুঙুর পরিয়ে দেবো বলে আমি রোজ-রোজ পথ ভুল করি।

৪.
দুপুর মানেই বিস্ময়। তিনিই জানেন, আত্মা কী করে ছোট হতে হতে হেটমুন্ডে মুখ-থুবড়ে পড়ে। তবু ছায়ারা আমাদের সারপ্রাইজ দেয়। ছায়া স্থিতিস্থাপক, ক্রম প্রসারমাণ। কখনো কখনো লিগামেন্ট শিথিল হয়ে যাওয়া আলোর মতো মেলে দেয় প্রচ্ছায়ার পেখম। এসব দেখতে দেখতে আমাদেরও ইচ্ছে করে পদব্রজে বাড়ি ফিরে ড্রইং রুমটাকে চমকে দিতে। ফেরার কথা ভুলতে আমরা স্যান্ডউইচ চিবাই অথবা স্যান্ডউইচ হাসে আমাদের চ্যাপ্টানো ভাব দেখে। মানুষ মাত্রই ক্ষুধাতুর, চৈত্রের নামান্তর। ভাবি, বমন ও বাতাসার মাঝে আদতেই কি ফারাক আছে? ক্ষুধাকে তবে পাপ বলি কী করে? আশলে, আমাদের যত পাপ-অপরাধ, লুপ্ত-সন্তাপ সবই একটা গোল্ডফিশকে কেন্দ্র করে। প্রতিদিনই হেলায়-অবহেলায়, ছরার-বেহালায় মৃত্যু হয় তার। তার জায়গায় চলে আসে আরেকটা নতুন গোল্ডফিশ, সেইম-কালার সেইম-সাইজ। ড্রইংরুমে কুঁচকানো-কুশন। সাবধান কোনো সারপ্রাইজ নয়! জুতোর ভেতরে পচা গন্ধ। রুদ্ধশ্বাস।

হায়, একটা চালতা-পাতায় যতটুকু ঈশ্বর বিরাজমান ততটুকু সান্ত্বনাও অবশিষ্ট নেই আমাদের।

৫.
ঘ্রাণের পাঠশালাফেরত প্রজাপতিরা আজকাল কিডনাপ হয়ে যাচ্ছে। মেয়ের চিন্তায় পুড়ে যাচ্ছে বাসন্তীর কপাল। বাসন্তীর জ্বর। অন্য রকম জ্বর! অথচ আমরাই একদিন, ঘাসদের পৃথিবীর সবচাইতে বর্ধনশীল প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। এখন জন্ডিস-চৈত্র। তাই পল্টনে লাখো জনতায় আমাদের রংচটা অন্তর্বাস কেবলি খসে খসে যায়। এভাবে বিড়াল চলে গেলে পড়ে-থাকা উষ্ণতা আমাদের কাছে আরাধ্য হয়ে ওঠে। আমরা কেবল ঈর্ষাতুর হয়ে উঠি। আচার খাই, বিচার চেয়ে হল্লাধ্বনি দেই। এদিকে অর্জুন-কর্ণ কিংবা মাখনচোরা কৃষ্ণরা ক্রমাগত চক্রবাণ ছুঁড়তে থাকেন! ছুঁড়তেই থাকেন। তবু সিমেট্রিতে, সুররিয়ালিস্টিক মিউজিয়ামে¬ আমরাই কেবল বিষণ্ন বাঘের পিঠ চেটে দিতে পারি।

৬.
সমস্ত জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। পোষা-বিড়াল, বিড়ালের পোষ, হাতের তুলুতে তিনটি চালতা ফুল অথবা কিছুই নয়- একদিন সব ফাঁস হয়ে যাবে। শহরে করমচা ফুল ফুটলেই সবকিছুই হয়ে যাবে চতুর্থ বিষয়, মূল্যহীন- অবান্তর। যেমনি অবান্তর এই পথের ইতিহাস আলোচনা; যেখানে চৈত্রের উত্তাপ আর বহুবর্ণা আইসক্রিম বহুবছর হাত ধরাধরি করে হেঁটে গেছে নিঃশব্দে। আত্মার অমরতা আজ শপিং-বিলাসিতা। আর শরীর সেতো শালপাতার পর্দা। সামনে তিমির হা’র মতো শূন্যতা; পেছনে দুধউরি জলমহলা। এখানে দাঁড়ানোর পর ঝুমঝুম ঘণ্টাবাঁধা অ্যারাবিয়ান ঘোড়ারাও একেবারে কাঠ হয়ে যায়! তবু কাঠের পা নিয়ে দলাদলি চলে, দেশে নির্বাচন হয়, অমোচনীয় কালির নিম্নমান নিয়ে রিট আবেদন হয় কোথাও কোথাও। তবে সবকিছুর আগে-পরে ঠিক থাকে ঈশ্বর ও ইবলিশের গাঁটছড়া।

এসবের বাইরে একটা খুদি-ফড়িংয়ের জন্য আমরা কি শোকদিবস পালন করতে পারবো কোনোদিন?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন