রবিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

দুখী গণ্ডারনামা ০১

হাঁটুপানির জলদস্যু

১.
নোয়া খবর পেলেন, মহাপ্লাবন আসছে সামনে। প্রবল বন্যায় ভেসে ডুবে ছারখার হবে সব কিছু। এক পেল্লায় নৌকা বানাতে হবে তাকে। সেই নৌকায় সকল জীবজন্তু পশুপাখি জোড়ায় জোড়ায় নিয়ে তাকে ভেসে থাকতে হবে অনির্দিষ্টকাল। বাকি পাপীর দল ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে।

নোয়া নৌকা বানানোর কাজে হাত দিলেন। সবাই খুব খ্যাপাতে লাগলো তাকে। কিন্তু নোয়া পাত্তা দিলেন না আবালগুলিকে।

নৌকা বানানোর কাজ শেষ হবার পর নোয়া সব পশুপাখি জোড়ায় জোড়ায় ভর্তি করার কাজ শুরু করলেন। একজোড়া গরু, একজোড়া ছাগল, একজোড়া ভেড়া ...।

দিন যায়। নানা পশুপাখি লক্ষ্মী ছেলেমেয়ের মতো গুটগুট করে হেঁটে এসে নোয়ার নায়ে ওঠে। নোয়া আকাশের দিকে তাকান। মেঘলা আকাশ। গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। সামনে তুমুল বৃষ্টি আর বান আছে। বুড়িগঙ্গা ফুঁসে উঠে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সমস্ত পৃথিবী।

নোয়া নৌকার নোঙর তুলে নেয়ার হুকুম দিলেন বড় ছেলেকে। সিঁড়ি বেয়ে নৌকায় ওঠার সময় দেখলেন, অদ্ভুত এক লোক দাঁড়িয়ে সিঁড়ির গোড়ায়।

"কে তুমি?" নোয়া শুধান।

অদ্ভুত দেখতে লোকটা দুইটা প্রকাণ্ড ময়লা হলুদ দাঁত বার করে হাসে। বলে, "আমি দাঁতাল বাঁশখোর। কবি ও চলচ্চিত্রনির্মাতা। ধর্মে উত্তরাধুনিক।"

নোয়া কিছু বলার আগেই ভীষণ বান ধেয়ে আসে। তিনি আর দাঁতাল দুজনেই পড়িমড়ি করে নৌকায় ওঠেন।


২.
দিন যায়।

চারদিকে পানি থই থই করছে। ডাঙার চিহ্নমাত্র নেই। নৌকার ভেতরে নিরিবিলিতে পাশাপাশি বসে বাঘ আর মোষ, সিংহ আর হরিণ, বেড়াল আর ইঁদুর।

নোয়ার ছেলে এসে বললো, "আব্বু আব্বু, ঐ নতুন লোকটা না প্রত্যেক রাতেই কী যেন করে! জীবজন্তুগুলি শুধু ছটফট করতে থাকে!"

নোয়ার মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়।

তিনি গিয়ে দাঁতাল বাঁশখোরকে বলেন, "তারপর? কেমন কাটছে সবকিছু?"

দাঁতাল তার হলুদ দুই দাঁত বার করে হাসে। বলে, "প্রশ্নটা আমারে ভাবন করাইলো! আসলেই কেমন কাটে কোনো কিছু? আদৌ কি কাটে? কেমনই বা কাটা উচিত?"

নোয়া থতমত খেয়ে চলে আসেন।

একদিন রাত্তিরে হঠাৎ ঝুপ্পুস করে আওয়াজ হয়। নোয়া বিছানা ছেড়ে উঠে বেরিয়ে নৌকার খোলে ঢোকেন। ঢুকে দেখেন, দাঁতাল বাঁশখোরের পাশের জায়গাটা খালি। ওখানে কুমড়োপটাশ আর কুমড়োপটাশিনী বসে ছিলো ঘন্টাদুয়েক আগেও।

তিনি কঠিন স্বরে প্রশ্ন করেন, "দাঁতাল, কুমড়োপটাশ কোথায়?"

দাঁতাল একটা কাঠি দিয়ে তার ময়লা দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলে, "কী জানি!"

নোয়া বলেন, "জানো না মানে? তোমার পাশেই তো তারা ছিলো?"

দাঁতাল উদাস গলায় বলে, "ছিলো, কিন্তু এখন নাই! এমন তো হরহামেশাই হচ্ছে। ছিলো একটা রুমাল, হয়ে গেলো বেড়াল!"

এমন সময় একটা কাঠবেড়ালি উঠে এসে বললো, "মহামতি নোয়া! অনুমতি দিলে কিছু কথা বলতে চাই!"

নোয়া বললেন, "অনুমতি দিলাম!"

কাঠবেড়ালি গলা খাঁকরে বললো, "মহামতি নোয়া, এই দাঁতাল বাঁশখোর প্রতি রাতে, রাতের আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে নিদ্রিত আমাদের উপর হামলা চালায়। সে আমাদের সবার পোঁদে আঙুল দেয়। এই কাজ করে সে কী মজা পায়, তা আমরা জানি না, কিন্তু চেয়ে দেখুন, সবাই কীভাবে তার পেছন ঢেকে ঘুমিয়েছে!"

নোয়া চেয়ে দেখেন, কথা সত্য। গরু ছাগল বাঘ ভালুক সবাই নিজের পেছন আবৃত করে রেখেছে যে যেভাবে পারে।

কাঠবেড়ালি বলে, ছোট্ট ইন্দুর থেকে শুরু করে মস্ত হাতি, কেউ রেহাই পায়নি এই উংলিবাজি থেকে! কিন্তু অভিমানী কুমড়োপটাশ আর সহ্য করতে পারেনি, সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেছে!"

নোয়া চেয়ে দেখেন, দাঁতাল তার মধ্যমা শুঁকছে আনমনে।

তিনি বজ্রকণ্ঠে বললেন, "দাঁতাল বাঁশখোর, এই অভিযোগ কি সত্য?"

দাঁতাল হাই তুলে বললো, "কীসের অভিযোগ? কে করে কার বিরুদ্ধে অভিযোগ? সবার আগে যে প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করতে হয় তা হচ্ছে, অভিযোগ কারে বলে?"

নোয়া আর সহ্য করতে পারেন না, বলেন, "ওহে রাসকেল! এই নৌকার একটা নিয়মকানুন আছে! সেটা মেনে চলতে হবে!"

দাঁতাল হাসে দাঁত বার করে। বলে, "নিয়ম? কীসের নিয়ম? কে নিয়ম তৈয়ার করন ঘটন হওয়াইলো? এই নিয়মানুবর্তিতার জোয়াল কে কার কান্ধে চাপা করাইতে চায়? সমাজে নিয়মের মস্তানি চালু করতে চাওন ঘটায় কারা?"

নোয়া বড় ছেলেকে ডাকেন, "বাপধন! ডিঙ্গাটা নামা!"


৩.
দাঁতাল বাঁশখোরকে একরকম ঘাড়ে ধরে ডিঙ্গায় নামিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় অথৈ সাগরে। সাথে দেয়া হয় একটা দাঁতখিলাল।

দাঁতাল চেঁচাতে থাকে, "এই ফ্যাসিবাদি আচরণের জন্য নোয়াকে জবাবদিহি করতে হবে! স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে নৌকা চালানো যায় না! আমাকে অন্যায়ভাবে নৌকা থিকা বাইর কইরা দেওয়া হৈসে! এই ফ্যাসিবাদী নোয়া নিয়মকানুন বানানোর ক্যাঠা?"

নোয়া বলেন, "খুদাপেজ!"

পশুপাখি সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ছাগল সন্তর্পণে একটা ছিপি বার করে আনে পেছন থেকে।


৪.
দিন যায়, মাছ যায়, বছর যায়। দাঁতাল বাঁশখোরের ডিঙা জলে ভাসে। দাঁতাল জলের মাছ আর আকাশের পাখি ধরে ধরে খায় আর বিড়বিড় করে নোয়াকে বকে।

এইভাবে কেটে যায় হাজার বছর। একদিন দাঁতালের ডিঙা ভেড়ে এক দ্বীপে। দাঁতাল ডিঙা টেনে তোলে সৈকতে। তারপর একটা নারকেল গাছে চড়ে। কয়েকটা ডাব পেড়ে খায়। তারপর লতাপাতা দিয়ে একটা কুটির বাঁধে। এক নিরীহ বুনো ছাগলিকে ধরে আনে এক রাতে।

এভাবেই চলে তার সংসার।

একদিন দাঁতাল কচুর মুখী দিয়ে মাছ রান্না করছে, সেই ধোঁয়া দেখে দূর থেকে এক সওদাগরী জাহাজের কাপ্তান দূরবীণ লাগিয়ে দেখেন, নারকেল গাছের নিচে এক দেড়েল প্রায় উলঙ্গ লোক আগুনের সামনে বসে। তিনি জলিবোট নামিয়ে লোকটাকে উদ্ধার করতে লোক পাঠান।

নাবিকেরা দাঁতালকে নৌকোয় করে নিয়ে আসে জাহাজে।

কাপ্তান বলেন, "হে দ্বীপবন্দী! তোমাকে আমি উদ্ধার করলাম। এখন তুমি আবার ফিরে যাবে মানবসভ্যতায়। তোমার নারকেলপাড়া জীবন, তোমার ছাগলচোদা জীবন, তোমার কচুর মুখী দিয়ে গেঁড়িগুগলি রান্নার জীবনের আজ ইতি ঘটলো!"

দাঁতাল বললো, "হুমম?"

কাপ্তান বললেন, "তা তুমি কোন দেশের লোক? কেনই বা এই দ্বীপে আটকা পড়ে আছো?"

দাঁতাল বললো, "শোনেন তাইলে! ফ্যাসিবাদি নোয়া আমারে তার জাহাজ থিকা অন্যায়ভাবে বাইর কৈরা দিসে!"

দাঁতাল বলে যায়। মিনিট পেরোয়। ঘন্টা পেরোয়। তিন ঘন্টা পর কাপ্তান কপালের ঘাম মুছে এক নাবিককে বলেন, "ঐ মোখলেছ! ডিঙ্গা নামা!"


৫.
দাঁতাল বাঁশখোরকে একরকম ঘাড়ে ধরে ডিঙ্গায় নামিয়ে ছেড়ে দেয়া হয় অথৈ সাগরে। সাথে দেয়া হয় একটা দাঁতখিলাল।

দাঁতাল চেঁচাতে থাকে, "এই আচরণ নোয়ার মতোই ফ্যাসিবাদি! স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে নৌকা চালানো যায় না! আমাকে অন্যায়ভাবে যেমন নোয়ার নৌকা থিকা বাইর কইরা দেওয়া হৈসে, তেমনই তোমাগো নৌকা থিকাও বাইর কইরা দেওয়া হৈসে! তোমরা ফ্যাসিবাদীরা নিয়মকানুন বানানোর ক্যাঠা?"

কাপ্তান বলেন, "খুদাপেজ!"

নাবিকরা সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কাপ্তান সন্তর্পণে একটা ছিপি বার করে আনেন কান থেকে।


৬.
দিন যায়, মাছ যায়, বছর যায়। দাঁতাল বাঁশখোরের ডিঙা জলে ভাসে। দাঁতাল জলের মাছ আর আকাশের পাখি ধরে ধরে খায় আর বিড়বিড় করে নোয়াকে বকে।

এইভাবে কেটে যায় হাজার বছর। একদিন দাঁতালের ডিঙা ভেড়ে আরেক দ্বীপে। দাঁতাল ডিঙা টেনে তোলে সৈকতে। তারপর একটা নারকেল গাছে চড়ে। কয়েকটা ডাব পেড়ে খায়। তারপর লতাপাতা দিয়ে একটা কুটির বাঁধে। এক নিরীহ বুনো ছাগলিকে ধরে আনে এক রাতে।

এভাবেই চলে তার সংসার।

একদিন দাঁতাল কচুর মুখী দিয়ে মাছ রান্না করছে, সেই ধোঁয়া দেখে দূর থেকে আরেক সওদাগরী জাহাজের কাপ্তান দূরবীণ লাগিয়ে দেখেন, নারকেল গাছের নিচে এক দেড়েল প্রায় উলঙ্গ লোক আগুনের সামনে বসে। তিনি জলিবোট নামিয়ে লোকটাকে উদ্ধার করতে লোক পাঠান।

নাবিকেরা দাঁতালকে নৌকোয় করে নিয়ে আসে জাহাজে।

কাপ্তান বলেন, "হে দ্বীপবন্দী! তোমাকে আমি উদ্ধার করলাম। এখন তুমি আবার ফিরে যাবে মানবসভ্যতায়। তোমার নারকেলপাড়া জীবন, তোমার ছাগলচোদা জীবন, তোমার কচুর মুখী দিয়ে গেঁড়িগুগলি রান্নার জীবনের আজ ইতি ঘটলো!"

দাঁতাল বললো, "হুমম?"

কাপ্তান বললেন, "তা তুমি কোন দেশের লোক? কেনই বা এই দ্বীপে আটকা পড়ে আছো?"

দাঁতাল বললো, "শোনেন তাইলে শুরু থিকা! ফ্যাসিবাদি নোয়া আমারে তার জাহাজ থিকা অন্যায়ভাবে বাইর কৈরা দিসে!"

দাঁতাল বলে যায়। মিনিট পেরোয়। ঘন্টা পেরোয়। তিন ঘন্টা পর কাপ্তান কপালের ঘাম মুছে এক নাবিককে বলেন, "ঐ মোখলেছ! ডিঙ্গা নামা!"

...

এই গল্প তার পর থেকে এভাবেই চলছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন