বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

রবীন্দ্রনাথের ঘর সংসার

ইলা মজিদ

যশোরে নরেন্দ্রপুর গ্রামে রবীন্দ্রনাথের বৌদি জ্ঞানদানন্দিনীর বাপের বাড়ি । একেবারে বালিকা বয়সে বিয়ের পর এই গ্রাম
ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন । তারপর দেশ বিদেশ ঘুরে এতকাল বাদে আবার ফিরলেন । সাথে তাঁর দুই ছেলেমেয়ে ছাড়াও
রয়েছে দুই দেবর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথ এবং জা কাদম্বরী । নিছক বেড়াবার জন্যই আসেননি জ্ঞানদানন্দিনী,তাঁর
প্রধান উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথের জন্য পাত্রী খোঁজা । এই যশোর জেলা থেকেই অনেকগুলি মেয়েকে ঠাকুর বাড়ির বধূ হিসেবে
নির্বাচিত করা হয়েছিল । ঘটক-ঘটকীর আনাগোনা শুরু হয়ে গেল ।
দিনের পর দিন কাটে,একটিও পাত্রী পছন্দ হয় না । রবীন্দ্রনাথ এইসব পাত্রী সন্ধান অভিযানে যেতে চান না
কিছুতেই । জ্ঞানদানন্দিনী জোর করে তাঁকে নিয়ে যান । রবীন্দ্রনাথ ঠিক করেছেন, তিনি কোনো মতামত দেবেন না ।
বউঠানরা যা সিন্ধান্ত নেবেন, তাই-ই তিনি গ্রহণ করবেন ।
জোড়াসাঁকোর বাড়ির এক কর্মচারী বেণী রায়ের সঙ্গে একদিন দেখা হলো জ্ঞানদানন্দিনীর । বেণী রায় একেবারে
বিগলিত হয়ে অনুরোধ জানালো তার বাড়িতে যাবার । সবাই মিলে একদিন উপস্থিত হলেন বেণী রায়ের বাড়িতে ।
একজন সাধারণ লোকের বাড়িতে প্রখ্যাত জমিদার ঠাকুর বংশের কয়েকজন এসেছেন শুনে পাড়া প্রতিবেশীরাও দেখার
জন্য ভিড় করলো । বেণী রায় আন্তরিক ভাবে আপ্যায়ন করলেন । আট-ন বছরের শ্যামলা রঙের বেণী রায়ের মেয়ে
ভবতারিণী এলেন সবার সামনে জল-খাবার নিয়ে । জ্ঞানদানন্দিনী বাড়ি ফেরার পথে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে আলাপ করে
ঠিক করলেন, বেণী রায়ের মেয়ের সাথেই রবীন্দ্রনাথের বিয়ে দেবেন । কেননা, কোনো বিশিষ্ট হিন্দু পরিবারই ঠাকুর
বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না ।
অবশেষে ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিয়ে ঠিক হলো । রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন তেইশ । অতি সাধারণ,
মুখচোরা নয় বছরের মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করে তার সাথে জীবনের কোন কথা আলোচনা করবেন ? এই ভাবনা
রবীন্দ্রনাথকে পীড়িত করলো । লেখাপড়াও প্রায়ই কিছুই শেখেনি মেয়েটি ।
বিয়ের উদযোগ শুরু হয়ে গেল । জ্ঞানদানন্দিনী রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর সার্কুলার রোডের বাড়িতে উঠলেন । বেণী রায়ের
আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল না । তার কন্যাকে যাতে ঠাকুর বাড়ির বধূর উপযুক্ত বস্ত্রালঙ্কারে সাজিয়ে দেয়া হয়, সে
জন্য ঠাকুর বাড়ি থেকেই নানারকম গয়না ও শাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে । বিয়ের দিন রবীন্দ্রনাথ পরলেন গরদের কাপড় ও
কাঁধে একটি পারিবারিক শাল । মাথায় মুকুট পরেননি । পায়ে হেঁটে বারান্দা ঘুরে রবীন্দ্রনাথ এলেন অন্দর মহলের বিবাহ
আসরে । হিন্দুমতে এর আগে আইবুড়ো ভাত খাওয়া এবং গায়ে হলুদ সবই হেেয়ছে । আদি ব্রাহ্মসমাজের বিয়েতে শুধু

শালগ্রাম শিলাকে সাক্ষী রাখা হয় না । রবীন্দ্রনাথ দুষ্টুমি করতে লাগলেন ভাঁড়কুলো খেলার সময় । একটা কুলোর উপর
চাল থাকে । ভাঁড়ে করে সেই চাল একবার করে ভরে ফেলে দিতে হয় । মেয়েরা তখন নানা রকম কৌতুক করে । সেই
খেলা শুরু হতে না হতেই রবীন্দ্রনাথ ভাঁড়গুলো উপুড় করে দিতে লাগলেন । মেয়েরা একটা পিঁড়ির ওপর রবীন্দ্রনাথকে
দাঁড় করালেন । কনেকে আর একটা পিঁড়িতে বসিয়ে ঘোরানো হলো সাত পাক । কনে জড়সড় হয়ে এমন মাথা নিচু করে
রইলো যে, তার মুখখানি দেখাই গেল না । সম্প্রদান শেষে নতুন আসবাবে সজ্জিত ঘরে বসলো বাসর ।
দেবেন্দ্রনাথ বিয়েতে আসেননি । পুত্র কন্যাদের বিয়ে সাঙ্গ হবার কয়েকদিন পর তিনি যৌতুক পাঠিয়ে দেন । এটাই
তাঁর প্রা । রবীন্দ্রনাথের দাদারাও অনেকে অনুপস্থিত । রবীন্দ্রনাথে বিয়ে হলো অনাড়ম্বর । বাসরে আমোদ-প্রমোদও
কিছুটা নি¯প্রাণ । ভবতারিণী থেকে কনের নাম হলো মৃণালিনী । মৃণালিনী এত বড় প্রাসাদ,এত মানুষজন,এত দাস-দাসী
দেখে দিশেহারা । ঠিক যেন রূপকথার মতন, কুঁড়েঘর থেকে রাজবাড়ির বধূ হয়ে চলে এসেছে । রাজপুত্রের মতো
রবীন্দ্রনাথ ।
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের পরেও কয়েকদিন উৎসবের রেশ থাকার কথা । কিন্তু বিয়ে বাড়িতে তখন শোকের ছায়া । হঠাৎ
হৃদরোগে মৃত্যু হয় রবীন্দ্রনাথের বড় জামাই বাবু সারদা প্রসাদ গাঙ্গুলির । রবীন্দ্রনাথের বিয়ের রাতেই শিলাইদহে তাঁর
মৃত্যু ঘটলে রবীন্দ্রনাথের বড় দিদি সৌদামিনী সেখানে চলে যান । বড় দিদি সৌদামিনী রবীন্দ্রনাথের প্রায় মায়ের মতন ।
তিনিই সংসারের কর্ত্রী । তাঁর অবর্তমানে সংসারে কিছুটা শূন্যতার সৃষ্টি হলো ।
রবীন্দ্রনাথের ভাই হেমেন্দ্রনাথের স্ত্রী নীপময়ীর কাছে মৃণালিনীর থাকার ব্যবস্থা হলো । নীপময়ী তাকে ঠাকুরবাড়ির
রীতিনীতি শেখাবেন । দেবেন্দ্রনাথ কনিষ্ট পুত্রবধূর মুখ দেখলেন আনুষ্ঠানিকভাবে । মৃণালিনীর মুখ দেখে হাতে চারটি
মোহর দিলেন ।
মৃণালিনীকে কোন স্কুলে পাঠানো হবে তা নিয়ে অনেক আলোচনা হলো । আসল সিন্ধান্ত নিলেন জ্ঞানদানন্দিনী ।
লোরেটো হাউসে ভর্তি করা হলো তাকে । জ্ঞানদানন্দিনীর মেয়ে বিবির সাথেই যাবে সে গাড়িতে করে । মৃণালিনী
জ্ঞানদানন্দিনীর বাড়িতেই থাকতে লাগলো । কিছুদিনের মধ্যেই শাড়ি ছেড়ে স্কার্ট পরতে অভ্যস্ত হলো । লোরেটো হাউসে
মৃণালিনীকে শুধু ইংরেজি শিক্ষাই নয়, পিয়ানো বাজানো ও পাশ্চাত্য সঙ্গীত শেখানোরও ব্যবস্থা হলো । মৃণালিনীর ইংরেজি
স্কুলে যেতে ভালো লাগে না । একথা শুনেও রবীন্দ্রনাথ কোন প্রতিμিয়া দেখাননি । দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে তাকে
জমিদারীর কাজ কর্ম দেখতে হয় । লেখালেখি ও নতুন বইয়ের প্র“ফ দেখা অনেক সময় চলতে থাকে । রবীন্দ্রনাথ
বেশিদিন সার্কুলার রোডের বাড়িতে থাকেননি । মৃণালিনীকে সেখানে রেখে চলে এলেন জোড়াসাঁকোয় । জোড়াসাঁকোয়
থাকাকালীন প্রায়ই মশারি না টাঙ্গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন তিনি ।
রবীন্দ্রনাথের একমাত্র নিজের বইয়ের প্র“ফ দেখার সময় অন্য কোন কথা মনে পড়েনা । প্র“ফ দেখতে বসে তিনি
অনবরত কাটাকুটি করেন । তখন তাঁর বাহ্যজ্ঞান পর্যন্ত থাকে না । মাঝে মাঝে øান করতে, খেতেও ভুলে যান । ভৃত্যরা
খাবার নিয়ে সাধাসাধি করলে সামান্য কিছু মুখে দিয়ে বাকি সব খাবার ফিরিয়ে দেন । যখন তিনি কবিতা লিখতে
বসেন,তখন কবিতার মধ্যেই বসবাস করেন । কবিতার এক একটি শব্দ তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা মাতিয়ে রাখে । আবার
কোন শব্দের সঠিক প্রয়োগ না হলে যন্ত্রণা হতে থাকে । কবিতাই তাঁর আসল সত্তা ।
একদিন শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলেন রবীন্দ্রনাথ । খুট করে শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকালেন । দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে
একটি কিশোরী । জবরজং শাড়ি পরা, তাকে দেখাচ্ছে একটি রঙিন পুঁটুলির মতন । একটু নজর করেই তিনি
বুঝলেন,এতো তারই বিবাহিতাপতড়বী ! ভালো করে এখনও পরিচয়ই হয়নি এর সঙ্গে । মৃণালিনীর মুখে ভীতু ভীতু
ভাব,আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে,যেন ভেতরে আসতে সাহসই করছে না । রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন,তুমি?
তুমি কখন এলে ? মৃণালিনী কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, আমার ও বাড়িতে থাকতে আর ভালো লাগে না । রবীন্দ্রনাথ
বললেন,কেন,ভালো লাগে না কেন ? ওরাঁ সবাই তোমাকে ভালবাসেন । তাছাড়া ইস্কুল যাওয়ার সুবিধে ওখান থেকে ।
মৃণালিনী বললো,আমার স্কুলে যেতে ভাল লাগে না । রবীন্দ্রনাথ হাসলেন । তিনি নিজেই স্কুল পালানো ছেলে । তাঁর স্ত্রীও
কি সেই রকমই হবে ? স্কুল বিষয়ে উপদেশ দেয়া কি তাঁর সাজে ? তবু তিনি বললেন,তা বললে কী হয়! বিবি ইস্কুলে যায়
। মৃণালিনী তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,স্কুল এখন ছুটি! রবীন্দ্রনাথ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন ,এখন কিসের ছুটি ? এইতো
সামার ভ্যাকেশন শেষ হলো। মৃণালিনী বললো,তা জানিনা । সত্যি ছুটি,ছুটি । রবীন্দ্রনাথ নেমে এলেন পালঙ্ক থেকে ।
বালিকা বধূর সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত । বিয়ে করেছেন ,তবু এই মেয়েটিকে তিনি চেনেন না এখনও ।

রবীন্দ্রনাথ আঙুল দিয়ে মৃণালিনীর থুতনি তুলে বললেন,ছুটি,ছুটি ভারি মিষ্টি শোনাচ্ছে তোমার গলায় । আজ থেকে তোমার
ডাক নাম দিলাম ছুটি ।
চব্বিশ বছরের রবির সুঠাম দেহ,গালের দু’পাশে সরু দাড়ি,মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত ঢেউ খেলানো । পায়ে মোজা ও
পাম্প সু , পরণে,কোঁচানো ধুতি ও বেনিয়ান,তার ওপর একটি চাদর জড়ানো । জোড়াসাঁকোর বাড়ির সামনের চত্বরে
একটি নতুন জুড়িগাড়ি থেকে নামলেন রবীন্দ্রনাথ । এই প্রম জুড়িগাড়ি হয়েছে তাঁর । দেবেন্দ্রনাথ উপহার দিয়েছেন ।
তিনি রবীন্দ্রনাথকে মাসোহারার টাকাও বাড়িয়ে দিয়েছেন । মৃণালিনীকেও আলাদা হাত খরচা দেন । তাছাড়াও খাজাঞ্চি
খানায় নির্দেশ দেয়া আছে রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর মহলটি অকৃপণভাবে সাজিয়ে দেবার জন্য । রবীন্দ্রনাথ প্রতিমাসে
চুঁচড়োয় এসে সমস্ত কাজের রিপোর্ট দেখান দেবেন্দ্রনাথকে । তাঁর দাযিত্ব জ্ঞানে সন্তুষ্ট তিনি । তবুও প্রশংসা বাক্যের সঙ্গে
সঙ্গে ঈষৎ ভৎর্সনাও করেন মাঝে মাঝে ।
আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক পদে নিযুক্ত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ । সম্পাদককে অনেক রকম সামাজিকতা রক্ষা করতে
হয় । আদি ব্রাহ্মসমাজের নিজস্ব প্রেস আছে । রবীন্দ্রনাথ বিভিনড়ব উৎসবের জন্য,সমাজের প্রার্থনা সভার জন্য গান রচনা
করছেন । সেগুলি শুনে দেবেন্দ্রনাথ সন্তোষ প্রকাশ করছেন । তিনি বরাবরই রবীন্দ্রনাথের কবিত্ব শক্তির অনুরাগী ।
রবীন্দ্রনাথকে উৎসাহিত করেছেন আরও নতুন গান রচনা করার জন্য । তবে রবীন্দ্রনাথে প্রণয়ের কবিতাগুলি তাঁর পছন্দ
নয় । আধ্যাতিড়বক গান আর কত লিখতে পারবেন! এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ সন্দিহান ছিলেন । তা ছাড়া প্রেম ছাড়া কাব্য হয়
না ,এটা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন । বালক বয়সে তাঁর কবিতাগুলি উৎসাহ নিয়ে বই ছাপিয়ে দিয়েছেন দাদারা । এখন
সেই উৎসাহ স্তিমিত । তাই নিজেই প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন । দুই মলাটের মধ্যে আবদ্ধ না হলে কবিতাগুলির যেন
নিজস্ব রূপ খোলে না । পত্র পত্রিকায় ছাপা হলেও কেমন যেন একটা অস্থায়ী ভাব থাকে । কাব্য গ্রন্থের মধ্যে স্থান না
পেলে তা যেন সামগ্রীক কাব্য প্রবাহের অন্তর্গত হয না । রবীন্দ্রনাথ পর পর বই ছাপিয়ে চলেছেন । চব্বিশ বছর বযসেই
তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা ছিল ষোল ।
রবীন্দ্রনাথের বই তেমন বিμি হতো না । এক অভিনব প্রস্তাব দিরেন গুরুদাস বাবু । তিনি নিজের সুবিদে মতন
দামে রবীন্দ্রনাথের বই বিμির ব্যবস্থা করবেন । তবে কমিশনের ভিত্তিতে নয় ্ তিনি এক সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সব বইয়ের
সমস্ত অবিμিত কপি কিনে নিবেন কিছু টাকা দিয়ে । প্রায় আট হাজার বই । তারজন্য গুরুদাস বাবু দিতে চাইলেন
দু’হাজার তিনশো টাকা । রবীন্দ্রনাথ দরাদরি করলেন না । কারন আর কিছু দিনের মধ্যেই এইসব ছাপানো পৃষ্ঠা উই
পোকার খাদ্য হতো । চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হলো । রবীন্দ্রনাথের হাতে অগ্রিম হিসেবে দেয়া হলো নগদ এগারশো টাকা ।
তাঁর প্রায় বিহ্বল অবস্থা । এতগুলো টাকা ! এ পর্যন্ত লিখে সে কোনও জাযগা থেকে একটা পয়সাও পায়নি । রবীন্দ্রনাথ
কল্পনায় দেখতে পেলেন ,তাঁর বইগুলো পৌঁছে যাচ্ছে পাঠকদের ঘরে ঘরে, দূর দূরান্তের মানুষ তাঁর লেখা পড়ছে ।
বন্ধু বান্ধবদের ডেকে রবীন্দ্রনাথ একটা ভোজ সভার আয়োজন করলেন । তাঁর বালিকা বধূ এরমধ্যেই রানড়বা ব্যাপারে
বেশ দক্ষতা অর্জন করেছে । জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে রোজ স্কুলে যায় মৃণালিনী । বাড়িতে সে যখন শাড়ি পরে ঘুরে
বেড়ায়,তখন আর তাকে ছোটটি মনে হয় না । রানড়ব্া ঘরের ঠাকুরদের সে পাকা গিনিড়বর মতন নির্দেশ দেয় । অনেক গভীর
রাত পর্যন্ত লেখালেখি করেন রবীন্দ্রনাথ । প্রায় রাতে মৃণালিনী ঘুমিয়ে যায় । মস্ত বড় পালঙ্কের এক পাশে সে গুটিশুটি
মেরে শুয়ে থাকে । ঘরে মৃদু গ্যাসের বাতি সারা রাত জ্বলে । স্বচ্ছ মশারি দিয়ে দেখা যায় ,ছোট্ট একটা পাশ বালিশ
জড়িয়ে একপাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে মৃণালিনী । পরণে গোলাপি ডুরে শাড়ি ,খানিকটা চুল এসে পড়েছে মুখের উপর ।
তার ফাঁক দিয়ে ঝিকমিক করছে কানের হীরের দুল ।
একদিন মশারি তুলে ভিতরে ঢুকলেন রবীন্দ্রনাথ । অন্যদিন যাতে মৃণালিনীর ঘুম না ভাঙ্গে তাই তিনি সন্তর্পনে
অনেকটা দূরত্ব রেখে ঘুমান । সেদিন আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে দিলেন মৃণালিনীর মুখের উপর পড়ে থাকা চুল । সেই সামান্য
স্পর্শেই চোখ মেলে তাকালো মৃণালিনী । চমকে উঠলো না । উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলো ।
বন্ধুদের সঙ্গে সাহিত্য বিষয়ক আড্ডাই রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে প্রিয় । কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক হিসেবে তিনি ব্যস্ত
থাকেন বেশি । চুঁচড়োয় দেবেন্দ্রনাথের কাছে নির্দেশ নিতে যেতে হয় প্রায়ই । জমিদারীর কাজে ঘোরাঘুরির সময় সাধারণ
দরিদ্র মানুষদের দিকেও তাঁর চোখ পড়ে । দারিদ্র্য ,অশিক্ষা,কুসংস্কারের ভারে জর্জরিত মানুষদের মুখগুলি দেখে তিনি

ব্যথিত হন । রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন,ওই সব মানুষদের জন্য সমবেদনামূলক কবিতা রচনাই যথেষ্ট নয় । আগে
মানুষগুলোকে বাঁচানো দরকার । দুর্ভিক্ষ,পীড়িতদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রম উপলব্ধি করলেন,ক্ষুধা কি
সাঙ্ঘাতিক বস্তু । অন্যান্য অনেক বিপদ মানুষের মনুষত্ব জাগিয়ে তোলে, কিন্তু ক্ষুধায় মনুষ্যত্বও দূরে চলে যায় । ক্ষুধার
সময় মানুষ যেন একটা ক্ষুদ্র প্রাণী । প্রায় পিঁপড়ের মতন । এক মুষ্টি অনেড়বর জন্য মানুষ হন্যে হয়ে থাকে । সমস্ত মহৎ
আশা ,আদর্শ ধরাশায়ী হয়ে যায় । মানুষ তখন এমন দীন! আরও একটা ব্যাপার রবীন্দ্রনাথকে ভাবায়, শহরের কত
মানুষের বাড়িতে অনড়ব উদ্বৃত্ত হয় । বিয়ে ,অনড়বপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠানে কত খাদ্যের অপচয় যে হয় তার ঠিক নেই । রাস্তায়
ফেলে দেয়া হয় বাসি ভাত,মাংস । তখন ক্ষুধিত মানুষের কথা এই সব শহরবাসীর মনে পড়ে না । আবার এইসব
লোকেরাই রাজনীতি করতে গিয়ে জ্বাালাময়ী বক্ত ৃতা দেয় । দেশের মানুষের দু:খে বুক ভাসায় । রাজনীতির মধ্যে এত
ভন্ডামি থাকলে দেশের উপকার হওয়ার সম্ভাবনা নাই বললেই চলে ।
রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি বিবি আর মৃণালিনী প্রায়ই একই বয়েসী । বিবি রবীন্দ্রনাথের ভীষণ ন্যাওটা । যখন তখন সে
রবীন্দ্রনাথের নাক টিপে দেয় ,চিমটি কাটে । রবীন্দ্রনাথ অন্যদের সাথে বেশিক্ষণ কথা বললে বিবি পেছন থেকে এসে
রবীন্দ্রনাথে গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ে । রবীন্দ্রনাথকে সে নানান আদরের নাম ধরে ডাকে । বিবি একদিনের জন্য
রবীন্দ্রনাথকে চোখের আড়াল করতে চায় না । রবীন্দ্রনাথকে সে বুজি নামে ডাকতে পছন্দ করে । কোন কাজে রবীন্দ্রনাথ
বাইরে থাকলে বিবি অধীর হয়ে থাকে । ফিরে এলে বিবি দৌড়ে গিয়ে তাঁর গলা জড়িয়ে বলতে থাকে বুজি,বুজি,বুজি
এতক্ষণ কোথায় ছিলে ? পড়াশোনায় যেমন সে মেধাবিনী ,তেমনি গানের গলা । সাহিত্য বিষয়ক সভা-সমিতিতে গেলে
রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই বিবিকে নিয়ে যান । অপরাপর পুরুষেরা মুগ্ধ বিস্ময়ে এই রূপসী কুমারীটিকে দেখে । ঠাকুরবাড়ির
মেয়েদের তখন কম বয়সে বিয়ে হত না । কলকাতার বাইরে কোথাও গেলে রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখতেন
বিবিকে । মাঝে মাঝে কবিতা লিখেও বিবিকে উপহার দিতেন । ভাইঝি হয়েও বিবির সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর
মতন । অথচ মৃণালিনী স্ত্রী হয়েও তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গিনী হতে পারে না। বাইরে বেরুবার ব্যাপারে কিছুতেই লাজুকতা
কাটিয়ে উঠতে পারে না মৃণালিনী । বাইরের কেউ-ই মৃণালিনীকে চেনে না । ঠাকুর বাড়ির অন্য সব কন্যা কিংবা বধূ
বাইরে বেরিয়ে আসছে,মৃণালিনী অন্তঃপুরিকা ।
একদিন জ্ঞানদানন্দিনী বললেন,রবি তোমার বউকে আর স্কুলে পাঠাচ্ছি না । শুধু শুধু মাইনে দিয়ে কি হবে ?
রবীন্দ্রনাথ একটু ক্ষুনড়ব হলেন । মৃণালিনীর স্কুলে পড়ার দিকে তেমন মন নেই তা ঠিক । তবে একেবারে বন্ধ করে দিতে
হবে? রবীন্দ্রনাথ বললেন, কেন ? জ্ঞানদানন্দিনী চোখ,মুখ ঘুরিয়ে হেসে বললেন,এই অবস্থায় স্কুলে না যাওয়াই ভাল । যদি
কোন দিন শরীর খারাপ হয় । রবীন্দ্রনাথ এবার উদ্বিগড়ব হয়ে বললেন,সে কি! ওর কোন অসুখ করেছে বুঝি ? জ্ঞানদানন্দিনী
বললেন,আহা,তুমি জান না বুঝি ওর কী হয়েছে ? রবীন্দ্রনাথ খাঁটি বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন,না,সত্যি জানি না ,কী হয়েছে ।
জ্ঞানদানন্দিনী ঝুঁকে এসে রবীন্দ্রনাথের গাল টিপে বললেন,উস,ছেলে একেবারে ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না । তুই
যে বাবা হতে যাচ্ছিস রে ! রবীন্দ্রনাথ যেন আকাশ থেকে পড়লেন,বাবা! সত্যি সে বাবা হতে চলেছে । তাঁর রক্তের
উত্তরাধিকার । রবীন্দ্রনাথের বিস্ময় ও লজ্জাকর মুখ দেখে জ্ঞানদানন্দিনী আবার বরলেন,বউকে নিয়ে বাইরে কোথাও ঘুরে
আয় । এই সময় হাওয়া বদল করলে উপকার হয় । রবীন্দ্রনাথ এতদিন পর্যন্ত কারুর না কারুর সাথে বেড়াতে গেছে ।
একা একা সব দায়িত্ব নিয়ে ব্যবস্থা করা তাঁর ধাতে নেই । একবারই শুধু সস্ত্রীক সে প্রবাসে গিয়েছিল,তাও মেজদাদা
সত্যেন্দ্রনাথের কর্মস্থল সোনাপুরে । সত্যেন্দ্রনাথই যাওয়া আসার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন । কোথাও যাওয়া হলো না
মৃণালিনীকে নিয়ে হাওয়া বদল করতে । দেবেন্দ্রনাথ বোম্বাইতে বান্দ্রা অঞ্চলৈ কিছু দিনের জন্য বাসা বেঁধেছিলেন ।
কখনও পাহাড় ,কখনও সমুদ্র তাঁকে হাতছানি দেয় । হঠাৎ খবর এলো দেবেন্দ্রনাথ গুরুতর অসুস্থ । রবীন্দ্রনাথ অবিলম্বে
ছুটলেন বোম্বাই । দেবেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন,বান্দ্রায় থাকতে থাকতেই একদিন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস
ফেলবেন । মিলিয়ে যাবেন মহা অসীমে । কিন্তু তাঁর সে সাধ পূর্ণ হলো না । অচিরেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন এবং
কলকাতার দিকে যাত্রা করলেন । রবীন্দ্রনাথ এ যাত্রায় পিতার সঙ্গী হলেন না । তিনি মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের আহ্বানে
নাসিকে গেলেন কিছুদিনের জন্য । কিন্তু সেখানে এসেই তাঁর বিষম আফসোস হলো ,কেন সে মৃণালিনীকে নিয়ে এলো না?
মৃণালিনী তাঁর সন্তানের জননী হতে চলেছে । এটা জানার পর থেকেই পতড়বীর প্রতি তীব্র টান অনুভব করছেন । আসার
আগে মৃণালিনীর সঙ্গে ভাল করে দুটো কথাও বলে আসেননি তিনি । হঠাৎ মনে পড়ে যায় সোনাপুরের দিনগুলির কথা ।
সেখানে দুপুর বেলা বাড়িতে আর কেউ থাকত না । সেই নির্জন দুপুরগুলিতে অনেক সুন্দর সময় পার করেছেন দুজনে ।
সেটা মনে পড়ায় তিনি বিরহ যন্ত্রনায় কাতর হয়ে পড়লেন । যে সব কথা রবীন্দ্রনাথের কলমের ডগায় কখনও আসেনি
আগে,এখন তা নিঃসঙ্কোচে লিখে ফেলতে পারছেন । যদিও মনে বেশ দ্বিধার ভাব রয়ে যায় ।

রবীন্দ্রনাথের বন্ধু নবীন ব্যারিষ্টার আশুতোষ চৌধুরী,সে একই বছরে বিএ ও এমএ পাশ করে কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা দুর্লভ নজির স্থাপন করেছিলেন । কেমব্রিজে পড়তে গিয়ে অঙ্কে কৃতত্ব দেখান । অঙ্ক ও আইনে যথেষ্ট
দখল থাকা সত্ত্বেও তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বিষয় হচ্ছে সাহিত্য । বাংলা,সংস্কৃত,ইংরেজি,ফরাসি ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তির
নির্যাস তিনি উপভোগ করেন এবং বন্ধুদের জানাতে চান । সেই জন্যই আশুতোষের কাছে একটা তৃষ্ণিত পাখির মতন
যখন তখন ছুটে যান রবীন্দ্রনাথ । প্রায় সমবয়েসী তাঁরা ।
আশুতোষের সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ইংল্যান্ড যাবার সময় জাহাজে । মাত্র কয়েকটি দিন একসাথে কাটিয়ে
ছিলেন । কিন্তু এক-একজনের সঙ্গে অল্প পরিচয়েই বেশি ভাব হয়ে যায়। কোথাও একটা তরঙ্গে তরঙ্গে মেলে, পারস্পরিক
একটা আস্থা জন্মায় । সেই থেকেই দু’জনের গভীর বন্ধুত্ব । আশুতোষ বিলেত থেকে ফেরবার পরই রবীন্দ্রনাথ কৃষ্ণ নগরে
চলে গিয়েছিলেন । আশুতোষের সানিড়বধ্যে এলে তিনি ভরসা পান । যেমনটি আর তাঁকে আর কেউ দিতে পারে না ।
কবিতার প্রকৃত রস উপলব্ধি করতে পারে ক’জন ! রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রধান পাঠক তাঁর বিশাল পরিবারের লোকজনরা
। তাঁরা সবাই উচ্ছসিত ভাবে প্রশংসা করেন । বন্ধুরা পত্র পত্রিকায় খুব উচ্চ স্থান দেয়। কিন্তু নিছক প্রশংসায় তাঁর মন
ভরে না । মনে হয়, কোথায় যেন একটা ফাঁকি থেকে যাচ্ছে । আবার সমালোচনাও সহ্য করতে পারেন না তিনি ।
সমালোচকরা যখন বলে রবীন্দ্রনাথের কবিতা দুর্বোধ্য,অস্পষ্ট,ভাবালুতায় ভরা,তখন রবীন্দ্রনাথের গা জ্বলে যায় । এরা মনে
করে প্রেম,বিরহ,প্রকৃতি নিয়ে লেখা অকিঞ্চিৎকর । সব কবিতাই দেশাতড়ববোধ বা মহৎ আদর্শের হতে পারে । আশুতোষ
চৌধুরীর সানিড়বধ্যে এসে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারলেন ,নিছক নিন্দা বা প্রশংসায় কবিতার বিচার হয় না । রবীন্দ্রনাথের কবিতা
এক একটি লাইন তুলে তুলে আশুতোষ দেখিয়ে দেন ,বিশ্বের বিখ্যাত কবিদের রচনার ভাবও শব্দ ব্যবহারের সঙ্গে রবির
কতখানি মিল আছে । আশুতোষ রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলি এমনই পছন্দ করে ফেলেছে যে ,রবির সাম্প্রতিক কবিতাগুলি
থেকে নির্বাচন করে সে নিজেই একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন ।
রবীন্দনাথের মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে । মুখে কুচকুচে কালো দাড়ি,গৌরবর্ণ মসৃণ চামড়ায় রয়েছে
চিক্কণতা , চোখ ও নাক গ্রীক দেবতার মূর্তির মতন,দীর্ঘকায় সুগঠিত শরীর । গ্রীষ্মকালে রবীন্দ্রনাথ গায়ে কোন জামা দেন
না । ধুতির উপর শুধু একটা পাতলা চাদর জড়ানো থাকে ঊর্ধাঙ্গে । আশুতোষের ভাই প্রমথ সতরো –আঠারো বছর বয়েস ।
সে রবীন্দ্রনাথের রূপে মুগ্ধ । এমন সুপুরুষ সে আগে কখনও দেখেনি । আশুতোষের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যখন কাব্য আলোচনা
করে ,আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে প্রমথ । কাছে আসতে সাহস করে না । আশুতোষ কোলকাতায় ফেরার পর
রবীন্দ্রনাথের মনে একটা বিশেষ ইচ্ছে দানা বেঁধে ছিল এমন গুণবান ছেলের সঙ্গে একটা ভাল পারিবারিক সম্পর্ক স্থ্াপন
করা । ঠাকুর পরিবারে বেশ বিবাহ যোগ্যা কন্যা রয়েছে । তাদের মধ্যে হেমেন্দ্রনাথের কন্যা প্রতিভার বিয়ের ব্যবস্থা করা
খুব জরুরি । প্রতিভার বয়স প্রায় একুশ । লেখাপড়ায় সে যেমন ভালো ,তেমনই তার গানের গলা । দেবেন্দ্রনাথ অনেক
হিন্দু রীতিনীতি মানলেও পণ প্রার ঘোর বিরোধি । রবীন্দ্রনাথ একদিন আশুতোষকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে চায়ের
নিমন্ত্রণ করেন । মৃণালিনী বাইরের লোকের সামনে বিশেষ আসতে চায় না । এখন তাঁর শরীরে গর্ভলক্ষণ স্পষ্ট । পর
পুরুষের সামনে আসার প্রশড়বই ওঠেনা । প্রতিভাকে চা-নাস্তা পরিবেশনের জন্য ডাকা হয়েছে । লোরেটো স্কুলে পড়া মেয়ে
প্রতিভা কথাবার্তায় অত্যন্ত সপ্রতিভ । সে কারো সামনে লজ্জায় বাক্যহারা হয়ে যায় না । রবীন্দ্রনাথ গান বাজনার প্রসঙ্গ
তুলে প্রতিভাকেও যোগ দেয়ালো সেই আলোচনায় । বাংলা গানতো বটেই ,বিলিতি সঙ্গীতও বেশ ভ ালো জানে সে ।
কথায় কথায় এ দেশী সুরের সঙ্গে বিলিতি সুরের সংমিশ্রনের কথাও উঠলো । রবীন্দ্রনাথ কয়েকখানা গান শোনাতে
বললেন,প্রতিভাকে । প্রতিভা গিয়ে পিয়ানোতে বসল । তারপর একটার পর একটা গান গাইতে লাগলো আশুতোষ মুগ্ধ
হলেন গান শুনে । প্রতিভা ও আশুতোষ পরস্পরকে পছন্দ করেছে তা জানতে দেরী হলো না রবীন্দ্রনাথের ।
চুঁচড়ায় গিয়ে দেবেন্দ্রনাথের কাছে কথাটা বললেন রবীন্দ্রনাথ । দেবেন্দ্রনাথ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন
রবীন্দ্রনাথের দিকে । রবি ঘটকালি কছে । তাঁর পুত্রদের কার কী যোগ্যতা তা সঠিক বুঝেন তিনি । রবীন্দ্রনাথের
ব্রহ্মসঙ্গীত রচনার প্রতিভায় দিন দিন মুগ্ধ হচ্ছেন তিনি । কাব্য ও সঙ্গীত রচনায় তাঁর এ ছেলে অনেককে ছাড়িয়ে
যাবে,তাতে আর কোন সন্দেহ নেই । জমিদারীর কাজও কিছু কিছু শিখেছেন রবীন্দ্রনাথ । কিন্তু ঘটকালি করা যে রবির
পক্ষে সম্ভব,তা তিনি চিন্তা করেননি । কবিরা তো শব্দের সাথে শব্দের বিয়ে দেন । অন্য কারো বিয়ে নিয়ে কি মাথা ঘামান!
প্রতিভাকে যে এতোদিন অরক্ষণীয়া করে রাখা হয়েছে ,তার জন্য বেশ বিরক্ত ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ,নানান প্রশড়ব করে ,খুঁটিয়ে
খুটিয়ে পাত্রটির যোগ্যতা ও বংশ পরিচয়ের কথা জানতে লাগলেন তিনি । । শুনে বললেন, এতো খুবই উপযুক্ত প্রস্তাব ।

। তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যবস্থা করতে বললেন । ঠাকুর পরিবারের রীতি অনুযায়ী বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠান হলো জোড়াসাঁকোর
বাড়িতেই । সার্থক হলো রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রম ঘটকালি । ঠাকুর পরিবারের সবাই খুুশী রবীন্দ্রনাথের এ কাজে ।
রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য ও রূপ ছিল অতুলনীয় । তিনি যখন তিন সন্তানের জনক তখন তাঁর বয়স বত্রিশ । জমিদারী
দেখাশুনার কাজে বজরায় চড়ে অনেক জায়গায় যেতে হতো তাঁকে । সে সময় বজরায় রাত্রিবাস করতে ভালবাসতেন তিনি
। নদী পথে যাত্রার সময় কিংবা মধ্য নদীতে নোঙর করে রাত্রিবাসের ইচ্ছে হলে, যাতে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কোনও ব্যাঘাত না
ঘটে,সে জন্য সব ব্যবস্থা করা থাকতো । প্রতিবার কলকাতা ত্যাগের সময় সঙ্গে দিয়ে দিতো কাঁড়িকাঁড়ি কামিনী ভোগ চাল
,সোনা মুগ ডাল,বাদাম পেয়ারা,কলা কমলা,লেবু,আপেল,ওটমিল,ঝুনো নারকেল,পান-সুপারি,সরষের তেল,আমসত্ত্ব,আমচুর
,হাঁড়ি ভর্তি মিষ্টি,সুগন্ধ সাবান ,μিম,টু পাউডার,,এ ছাড়া কয়েক কেস ব্রান্ডি,শ্যাম্পেইন ও ওয়াইন । শেষোক্ত দ্রব্যগুলির
প্রতি রবীন্দ্রনাথের কোন আসক্তি ছিল না । সে হিসেবে অন্যান্য জমিদার তনয়দের তুলনায় তিনি এক মূর্তিমান ব্যতিμম ,
তবু ওগুলো রাখতে হতো,সাহেব সুবোরা কখনও আসতো । দেশীয় উচ্চ পদস্থ রাজকর্মচারী কিংবা অন্য জমিদার বন্ধু
,আপ্যায়ন করতে হতো তাদের ।
রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি ইন্দিরা আর মৃণালিনী প্রায় একই বয়েসী । তবু দুজনের মধ্যে অনেক তফাত । মৃণালিনী কে
শিক্ষিত ,সুসংস্কৃত করে তোলার চেষ্টা যতই করা হোক,তার কাব্য রুচি জন্মালো না । গান-বাজনার দিকেও মন গেল না ।
একটা গান লিখে কিংবা একটা গান রচনা করে সঙ্গে সঙ্গে তাকে শোনাবার কোনও ইচ্ছেই জাগে না রবীন্দ্রনাথের । কারন
প্রকৃত রস গ্রহণ করতে পারলে মুখে যে ভাবোল−াস ফুটে ওঠে,তা কোন দিনও দেখেননি রবীন্দ্রনাথ । একটা দীর্ঘ কিছু
শোনাতে গেলে কখনও কখনও ঘুমিয়ে পড়েছে মৃণালিনী । গৃহণী হিসেবে তার ত্র“টি নেই । কিন্তু সে তাঁর মর্ম কিংবা
নর্মসঙ্গিনী হতে পারল না কিছুতেই । যখন বাড়িতে স্ত্রী পুত্র কন্যাদের সাথে থাকেন রবীন্দ্রনাথ,তখন কিছুক্ষণের জন্য
সংসারী হয়ে যান । ছেলে মেয়েদের আদর করেন । যখন বাইরে একা থাকেন,তখনও মাঝে মাঝে মনে পড়ে স্ত্রী পুত্র
কন্যাদের কথা । ইচ্ছে করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে । কিন্তু যখন তিনি কবিতা রচনা করেন ,তখন তিনি কারু স্বামী
কিংবা পিতা নন । তিনি তখন এক ব্যাকুল বিরহি,কবিতার ছত্রে ছত্রে বিচ্ছেদের বেদনা । কবিতা রচনার সময় রবীন্দ্রনাথ
দু এক পংক্তি লিখেই চোখ বন্ধ করেন । সদ্য লিখিত পংক্তিগুলো গুন গুন করেন কয়েকবার । পছন্দ হলে ওষ্ঠে হাসি
ফোটে । পরবর্তী পংক্তি রচনায় মন দেন । ¯ে−টে লেখা তাঁর অনেক দিনের অভ্যেস । ¯ে−টে লেখার সুবিধে সহজেই
কাটাকুটি মুছে ফেলা যায় । এক ¯ে−ট লেখা হয়ে গেলে তিনি একটি বাঁধানো খাতায় কপি করেন । কখনও সঙ্গে সঙ্গে অন্য
কাগজে দ্বিতীয় একটি কপি করে কোনও প্রিয়জনকে চিঠির সঙ্গে পাঠিয়ে দেন ।
রবীন্দ্রনাথের ভীষণ ন্যাওটা ইন্দিরা । রূপে ঠাকুর বাড়ির অন্য সব কন্যা বা বধূদের ছাড়িয়ে গেছে সে । তার
গুণেরও শেষ নেই । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রমস্থান অধিকার করে পদ্মাবতী স্বর্ণপদক পেয়েছে । ইংরেজি,ফরাসি
ও বাংলায় তার সমান জ্ঞান । পশ্চিমী ও দেশীয় সঙ্গীত দুটোই খুব ভাল জানে । রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি করে
ফেলতে পারে অতি দ্রুত । নিজের মনটাকে এমন সম্পূর্ণভাবে আর কারুর কাছে মেলে ধরতে পারেন না রবীন্দ্রনাথ । শুধু
ইন্দিরাই তাকে বুঝতে পারে । রবীন্দ্রনাথ পুরুষদের কাছে খানিকটা আড়ষ্ট,মেয়েদের কাছে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য হতে পারেন ।
রবীন্দ্রনাথ ঠিক করলেন ,ইংল্যান্ড ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ ঘুরে আসবেন । সে সব দেশের শিল্প সঙ্গীত নাটক
উপভোগ করবেন । লন্ডনে পৌঁছবার কয়েক দিন পর থেকেই রবীন্দ্রনাথের মন কেমন করতে লাগলো । একেবারে
ছেলেমানুষের মতন প্রতিদিন সকালে উঠেই ডাক বাক্সের কাছে ছুটে যান । চিঠি পেলেও স্বস্থি নেই ,ইন্দিরা প্রতি চিঠিতেই
লেখে ,রবীন্দ্রনাথকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে । মৃণালিনীর চিঠি আসে ,তাতে সংসারের খবর থাকে । সে রকম চিঠি
পেলে আস্বস্থ হওয়া যায় কিন্তু মন ভরে না । ইন্দিরা ইংরেজি স্কুলে পড়েছে । বাড়িতে পশ্চিমী কায়দায় অভ্যস্থ হলেও
রবীন্দ্রনাথের সানিড়বধ্যের প্রভাবে সে বাংলাকাব্য-সাহিত্য-সঙ্গীত প্রাণ দিয়ে অনুভব করে ।
রবীন্দ্রনাথ যখন বজরায় থাকেন ,তখনও কবিতা রচনা করেন ,বই পড়েন ও চিঠি লেখেন । বজরায় একটা সুবিধে
তা ঘোড়ার গাড়ির মতো লম্ফ ঝম্ফ করে না । মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথ বজরার বাইরে দাঁড়ান । প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে তাঁর
চোখ জুড়ায় । রাত্রিরে অনেকক্ষণ জেগে থাকেন তিনি । মাল−া পাহরাদাররা ঘুমিয়ে পড়লেও তিনি লন্ঠন জ্বেলে গল্প কবিতা
লেখেন । মাঝে মাঝে ইন্দিরাকে চিঠি পাঠান । রাত্রিরে নদী ফিসফিস করে কথা বলে ,অনেক রাত্রেও কিছু কিছু নৌকা যায
। দূরে দেখা যায় বিন্দু বিন্দু আলো । আকাশে চাঁদ ও মেঘের লুকোচুরি চলে । øিগ্ধ বাতাস নিয়ে আসে রাত্রে ফোটা
ফুলের সুগন্ধ । চলন্ত নৌকোয় শোনা যায় মাঝিদের গান ।
রবীন্দ্রনাথের জমিদারী পরিদর্শনে আসার প্রধান উদ্দেশ্য যতদূর সম্ভব কর আদায় করে তহবিল ভরা । এ ছাড়াও
গ্রাম বাংলার কত গান ,কত মানুষের মুখ,জীবনের কত বিচিত্র বিকাশ ,প্রকৃতি ও মানুষের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের অনুভব

রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে বোঝাই করে চলেছেন । একাকী লেখার টেবিলে তিনি মুক্ত বিহঙ্গ,সেই টেবিল ছেড়ে
উঠে এলেই টের পান যে আসলে তিনি সংসারে আবদ্ধ জীব । অনেক সময় সেই কল্পনাবিহারী মন বাস্তবের মাটিতে এসে
আছড়ে পড়ে ক্ষত বিক্ষত হয় ।
রবীন্দ্রনাথের শীত এবং গ্রীষ্ম বোধ দুই-ই বেশ কম । শীতকালে তিনি খুব একটা উষ্ণ বস্ত্র অঙ্গে চাপান না । গরমের
সময়ও তাঁর তেমন অস্থিরতা প্রকাশ পায় না । ঘরে ঘরে টানা পাখার ব্যবস্থা আছে । ঠাকুর বাড়ির কর্তা ও গৃহণীরা সারা
দুপুর ঘরের বার হন না । রোদ্দুরের আঁচ লাগলে গাত্রবর্ণ মলিন হয়ে যাবে বলে কুমারী ও তরুণী বধূরা সব ঘরের দরজা
জানালা বন্ধ করে রাখে । ভৃত্যেরা বাইরে বসে পাখার দড়ি টানে । রবীন্দ্রনাথ দ্বিপ্রহরেও বেরিয়ে পড়েন প্রায়ই, তাঁর ছাতার
দরকার হয় না ।
তিন তলার মহলের ঢাকা বারান্দায় সকালে কিংবা বিকেলে রবীন্দ্রনাথ লিখতে বসেন । ষেখানে টানা পাখার ব্যবস্থা
নেই, তিনি হাত পাখাও ব্যবহার করেন না । দরদর করে সারা শরীরে ঝরতে থাকে ঘাম । তাতেও ভ্রুক্ষেপ নেই
রবীন্দ্রনাথের । কোন রাতেই তাঁর তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে না । বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে,তখন সেই
নিস্তব্ধতা তিনি উপভোগ করেন । সংসারের চিন্তা,বিষয় কর্মের চিন্তা যেন সম্পুর্ণ মুছে যায় মন থেকে । নদীর তরঙ্গের
মতো ছুটে আসে কবিতার পংক্তি । কোনও কোনও দিন কিছু না লিখলেও কাগজ কলম নিয়ে টেবিলে বসে থাকতে
ভালবাসেন । না- লেখা কবিতা নিয়েও যে খেলা করতে কত আনন্দ পাওয়া যায় ,তা অন্য কেউ বুঝবে না । কলম খোলাই
থাকে । তিনি চুপ করে বসে থাকেন ।
রবীন্দ্রনাথের ছেলে মেয়েদের মধ্যে রথী আর মাধুরী কিছুটা বড় হয়েছে । তাদের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে আলাদা কক্ষ
। বড় ঘরটিতে বাকি সন্তানদের নিয়ে শোয় মৃণালিনী । রাত দশটার মধ্যে বাচ্চাদের বিছানায় পাঠাবার দৃঢ় নিয়ম আছে ।
তারপরেও খানিকটা হুটোপাটি করে তবে ঘুমায় বাচ্চারা । তখন সেলাই নিয়ে বসে মৃণালিনী । রাতের বেলা সেলাই করা
নিয়ে রবীন্দ্রনাথ অনেকবার নিষেধ করেছেন । মৃণালিনী তা শোনে না । এ সময় স্বামীর পাশে গিয়ে বসে না মৃণালিনী ।
বাধা নেই কোনও,যদি যায়,গিয়ে কথা বলে,রবীন্দ্রনাথ ঠিকই উত্তর দেবেন । বিরক্তি প্রকাশ করবেন না । তবু মৃণালিনী
বুঝতে পারে স্বামীর সেই সব কথার মধ্যে কোনও আন্তরিকতা নেই । যেন একজন অন্যমনস্ক ,উদাসীন মানুষ । প্রশেড়বর
উত্তর দেন , নিজে থেকে কিছু বলেন না । এই মানুষের মনের কাছাকাছি কিছুতেই পৌঁছানো যায় না । মৃণালিনী লক্ষ্য
করেছেন ,বাইরের লোকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ অতি নিখুঁত ভদ্রতা মেনে চলেন । বাড়ির মানুষের কাছেও সেই লৌকিকতা ও
ভদ্রতা আবরণ পুরোপুরি ঘোচে না । ভাইঝি বিবির সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলেন তিনি । ঠাকুর বাড়ির অনেকেই
বলে,বিবিকে রাশি রাশি চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথ । শিলাইদহ কিংবা পতিসরে গিয়ে যখন বোটে থাকেন,তখন প্রায়ই
প্রতিদিন বিবির নামে একখানা করে চিঠি আসে । আর মৃণালিনীর নামে চিঠি আসে দায়সারা গোছের । তিনি বুঝেছেন
,রবীন্দ্রনাথের মনোজগতে তার ঠাঁই নাই ।
বিয়ের পর প্রম প্রম রবীন্দ্রনাথ রাতের বেলা মৃণালিনীকে কাছে ডেকে সদ্য রচিত কবিতা গল্প শোনাতেন ।
দু’একবার সে সব শুনতে শুনতে মৃণালিনীর চোখে ঢুলুনি এসেছিল ,সেই তার দোষ হয়েছিল । সারাদিন সংসারের কত
রকম কাজ থাকে ,চতুর্দিকে গুরুজন,বাচ্চাদের দৌরাতড়ব্য সামলাতে হয় । রাত্তিরে একটু শান্ত হযে বসলে ঘুম আসে । এখন
রবীন্দ্রনাথ কখন কী লিখছেন তা নিয়ে উচ্চ বাক্য করেন না মৃণালিনীর সামনে । অথচ বিবির সাথে তাঁর কথা ফুরোয় না।
মৃণালিনী মেনেই নিয়েছেন,বিখ্যাত স্বামীর সেবাপরায়না স্ত্রী ও পুত্র কন্যাদের জননী হয়েই তাকে থাকতে হবে । এটাই তার
প্রাপ্য ।
মধ্য রাত্রি পার হযে গেছে । একটা হাম্বীর সুর গুনগুন করছেন রবীন্দ্রনাথ । একটু পরেই সুরটাতে তেওরা তাল
এসে গেল । তালের সাথে তাতে বসে গেল শব্দের ডানা । ‘আরও কত দূরে আছে সে আনন্দধাম..................
আমি ক্লান্ত,আমি অন্ধ,আমি পথ নাহি জানি’......................
μুদ্ধ মেজাজ নিয়ে গান লেখা উচিত না । রবীন্দ্রনাথ আগে কয়েকবার লিখেছেন বটে ,কিন্তু বুঝতে পেরেছেন তাতে গানের
মান ঠিক থাকে না । μোধ,ক্ষোভ,ঈর্ষা,বμোক্তি,কারুর প্রতি ব্যক্তিগত আμোশ নিয়ে গান হয় না , মনকে এসব থেকে
মুক্ত করে নিতে হয় ।
রবীন্দ্রনাথের মেয়ে মাধুরী চোদ্দো পেরিয়ে পনেরেয় পা দিয়েছে । এখনও তার বিয়ের ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের হুঁস
নেই । মৃণালিনী প্রায়ই পাত্র খোঁজার জন্য তাড়া দেয় স্বামীকে । রবীন্দ্রনাথ গা করেন না । বেশি দেরী করলে মেয়ে
অরক্ষণীয়া হয়ে যাবে বলে মৃণালিনী রবীন্দ্রনাথের কান ভারী করে । জোড়াসাঁকোর বাড়িতে প্রতি বছরই দু’তিনটি বিয়ে হয়
। ঘটক-ঘটকিরা নানা রকম সমন্ধ নিয়ে আসে । কিন্তু ঘটকের মারফত পাত্র নির্বাচন রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয় না । দফায়

দফায় বিভিনড়ব পাত্র পক্ষ এসে মেয়ে দেখে যাবে,তাদের খাতির যতড়ব করতে হবে,তারা কোনও অসমীচীন প্রশড়ব করলেও মেনে
নেয়া ছাড়া উপায় নেই,এবং সহ্য করতে হবে প্রত্যাখ্যান । মাধুরী তাঁর বড় আদরের,কত যতড়ব করে তাকে শিখিয়েছেন
বাংলা,ইংরেজি,সংস্কৃত । অতি চসৎকার তার লেখার হাত । চর্চা করে গেলে সে কালে একজন বড় লেখিকা হতে পারে ।
এমন কন্যারতড়বকে কী যার তার হাতে দেয়া যায় ! নিজেই সে উদ্যোগী হয়ে পাত্র খুঁজবেন ,সে সমযও নেই রবীন্দনাথের ।
তাঁর খ্যাতি অনেক ছড়িয়েছে,বিভিনড়ব সভা সমিতিতে প্রায়ই তাঁর ডাক পড়ে । ভাষণ দিতে হয়, গানও গাইতে হয়
,লেখালেখির চাপও বেড়ে গেছে,লিখতেও হচ্ছে প্রচুর । এই সবের ওপর জমিদারীর কাজ দেখাশোনার দায়িত্বতো আছেই
। একদিন রবীন্দ্রনাথের বন্ধু প্রিয়নাথ সেন কথায় কথায় বললেন,বন্ধু ,তোমার বড় কন্যাটির বিয়ের কথা কিছু ভাবছ নাকি?
শুনলাম বিহারী লাল চμবর্তীর ছেলে শরতের বিয়ের উদ্যোগ চলছে । ছেলেটি বেশ উপযুক্ত । ওরা আমার প্রতিবেশী,আমি
অনেকদিন যাবৎ ওদের চিনি । রবীন্দ্রনাথ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন । দুই পরিবারের মধ্যে কুটুম্বিতার চেয়ে আদর্শ
আর কী হতে পারে । ছেলেটিও বেশ যোগ্য ,উচ্চ শিক্ষিত.মুঙ্গের শহরে ওকালতি শুরু করেছে । ভবিষ্যতে উনড়বতির
সম্ভাবনা আছে ।
রবীন্দ্রনাথ ছেলেটিকে দেখার প্রয়োজন বোধ করলেন না । সম্মতি জানিয়ে দিলেন । তিনি মৃণালিনীকে খবরটা
জানাতেই একটু ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন,ছেলেটিকে না দেখেই কথা দেয়া ঠিক হয়নি । রবীন্দ্রনাথ বললেন,বিহারীলাল
চμবর্তীর ছেলে কখনও খারাপ হতে পারে না । তাছাড়া প্রিয়নাথ আমার বিশেষ বন্ধু,সে কখনও জেনে শুনে মাধুরীর সাথে
খারাপ ছেলের সমন্ধ দিতে পারে? মৃণালিনী বললেন,তারপরও ছেলেকে দেখার দরকার আছে । রবীন্দ্রনাথ বললেন,পাত্র
পক্ষের বাড়িতে গিয়ে দেখার রীতি নেই । তা ছাড়া বিহারীলালের ছেলে শরৎ থাকে মুঙ্গেরে । এক কাজ করা যায় ।
প্রিয়নাথকে বলে একখানা ফটোগ্রাফ জোগাড় করা যায় কিনা দেখছি । মৃণালিনী বললেন,তুমি কত জায়গায় যাও । একবার
মুঙ্গেরে গিয়েওতো ছেলেটাকে দেখে আসতে পারো । পাত্র পক্ষের বাড়ির অবস্থা ,সেটাও জানার প্রযোজন আছে । প্রিয়নাথ
সেনের বাড়িতে উভয় পক্ষের কথা শুরু হলো । পাত্রের এক ভাই অতি সুপুরুষ,তাকে দেখেই বোঝা যায় ,শরৎও সুপুরুষ
হবে। মাধুরীর সাথে মানাবে । বিহারীলালের বাড়ির অবস্থা সাধারণ । তারপরও রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনী সম্মতি দিলেন ।
পাত্র-পক্ষ কুড়ি হাজার টাকা পণ চেয়ে বসল । রবীন্দ্রনাথ খুব দমে গেলেন । অত টাকা তিনি কোথায় পাবেন? ব্যবসা
করতে গিয়ে অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে ,সদ্য নিজের জন্য একটি বাড়ি বানিয়েছেন ,হাত একেবারে শূন্য । বিয়ের
আনুসাঙ্গিক খরচ নিয়ে চিন্তা নেই । দেবেন্দ্রনাথ এখনও নাতি নাতনীদের বিয়ের ব্যয় বহন করেন । মৃণালিনীর গহনা
থেকে যৌতুক দেয়া যাবে যথেষ্ট । কিন্তু পণের ক্যাশ টাকা জোগাড় করা যে অসম্ভব । তবু,এমন সুপাত্রকে কিছুতেই
হাতছাড়া করা চলে না । বিহারীলাল চμবর্তী কাদম্বরীর প্রিয় কবি ছিলেন । রবীন্দ্রনাথও তাঁর লেখা পছন্দ করেন ।
কাদম্বরী বেঁচে থাকলে ,এই বিয়ের সমন্ধতে নিশ্চয়ই খুব উৎসাহিত হতেন । মৃণালিনী বিহারীলালের নামের অর্থ কিছুই
বোঝেন না ,কাদম্বরী বুঝতেন । ‘নষ্ট নীড়’ লিখতে লিখতে ইদানিং নতুন বউঠানের কথা আবার মনে পড়ছে রবীদ্রনাথের ।
এমন কী ‘চোখের বালি’ লেখার সময়েও । দশ-বারো বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল ,এখনও রবীন্দ্রনাথের অনেক লেখায়
কাদম্বরীর ছায়া এসে যায় ।
দেবেন্দ্রনাথ পণ প্রার ঘোর বিরোধি । বিয়েতে পণ দেয়া যে গরু ছাগল কেনা বেচার সমান,এই কুপ্রা সমাজ
থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার কথা রবীন্দ্রনাথ নিজেও অনেকবার ভেবেছেন । কিন্তু বিহারীলালের ছেলেকে জামাতা হিসেবে
পাওয়ার জন্য পণ দিতেও রাজি । শুরু হলো পণ নিয়ে কথা । কুড়ি হাজার থেকে নামতে নামতে দশ হাজারে পৌঁছে পাত্র
পক্ষ অনড় হয়ে রইলো । শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ তাতেই রাজি হলেন । তখন পাত্র পক্ষ আবার কৌশলে মুঙ্গের থেকে
শরতের যাওয়া-আসা ও বরযাত্রীদের খরচ বাবদ আরো দু’হাজার বাড়িয়ে দিল । মোট বারো হাজার । রবীন্দ্রনাথ বললেন,
বিয়ের কয়েকদিন আগে পাত্রকে ব্রাহ্ম-ধর্মে দীক্ষা নিতে হবে । এটা আমাদের একটি পারিবারিক প্রা । প্রিয়নাথ
জানালেন,শরৎ ব্রাহ্ম হতে রাজি আছে ।
পণের বারো হাজার টাকা দেবার সংস্থান রবীন্দ্রনাথের নেই । কিন্তু তিনি জানেন,বিয়ের পর কন্যা জামাতা যখন
দেবেন্দ্রনাথকে প্রণাম জানাতে যায়,তিনি তাদের বেশ কয়েকটি গিণি দিযে আর্শীবাদ করেন । সেই গিণিগুলোর মূল্য বারো
হাজারের কম হবে না । পিতাকে সব জানাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ গেলেন । দেবেন্দ্রনাথ সব শুনলেন,পাত্রের পারিবারিক
অবস্থা,কতদিন ধরে ওকালতি শুরু করেছে,কটি ভাই বোন সব জেনে নিলেন খুঁটিনাটি প্রশড়ব করে । তারপর বললেন,বেশতো
খাজাঞ্চিকে বলে দাও সব ব্যবস্থা করতে,আতিথেয়তার যেন ত্র“টি না থাকে । রবীন্দ্রনাথ বললেন ,ওঁরা পণের টাকা আগে
চেয়েছেন। খাজাঞ্চি মশাইকে আশীর্বাদী গিনিগুলো সংগ্রহ করে দিতে বলব ? নিষ্পলকভাবে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন
দেবেন্দ্রনাথ । তারপর অতিশয় ধীরভাবে বললেন,ওই যৌতুকতো আমার আশীর্বাদ স্বরূপ । আগে দিতে হবে কেন? ওঁরা
কি আমায় বিশ্বাস করেন না ? বিয়ের পূর্বেই যৌতুক চাইবার কি কারন ,তা তো বুঝতে পারলাম না । রবীন্দ্রনাথের মাথায়

যেন বজ্রপাত হলো । একি করেছেন তিনি? এ যে তাঁর পিতার প্রতি চরম অপমান । দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন মানুষের
বদন্যতায় অবিশ্বাস ! রবীন্দ্রনাথ কী করে এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন । কোন মূঢ়তা তাকে পেয়ে বসেছিল ! নিঃশব্দে
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর তিনি বেরিয়ে গেলেন মুখ নিচু করে । পুরো একটা দিন তিনি বসে রইলেন চুপচাপ ।
রবীন্দ্রনাথ এই সঙ্কটের কথা মৃণালিনীকেও বলতে পারেন না । এমন অসম্মানজনক শর্ত শুনে মৃণালিনীও দারুণ
চটে উঠবেন নিশ্চিত । শর্ত বদলের কথাই বা তিনি এখন বলেন কোন মুখে ,প্রিয়নাথকে সাক্ষী রেখে তিনি নিজেই যে রাজি
হয়ে এসেছেন । কাজের ছুঁতো দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই চলে গেলেন শিলাইদহে । যাবার আগে প্রিয়নাথকে ইঙ্গিত দিয়ে
গেলেন,অন্য কোন ভাবে এই সঙ্কট নিরসন করা যায় কিনা তার উপায় খুঁজতে । সে সম্ভাবনা খুবই কম । পাত্র পক্ষেরও
মানে লেগেছে । ভাবী শ্বশুর রবীন্দ্রনাথ নিজেই কথা দিয়ে কথার খেলাপ করছেন, এ কী রকম ব্যাপার ? ঠাকুর বাড়ির
পারিবারিক প্রা আছে,তাদেরও বুঝি কিছু প্রা থাকতে পারে না । জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছাড়া আর কি কোথাও পাত্রী
পাওয়া যাবে না ? শরতের মতন পাত্রের জন্য শত শত মেয়ের বাবা ছুটে আসবে !
শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ একেবারে একা । মন ভাল নেই । কন্যার বিয়ের জন্য টাকা পয়সা নিয়ে দরাদরি । আগে
দেয়া,পরে দেয়া এসব চিন্তা করলেই মনে কেমন জানি গ−ানির ভাব আসে । এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে হবে,না হলে কিছু
লিখা যাবে না । লেখাাইতো তাঁর আসল কাজ । জ্যোৎøায় রাতে বোটের ছাদে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকেন আকাশের দিকে ।
নদীর ছলোচ্ছল শব্দ বাজতে থাকে সঙ্গীতের মতন । রবীন্দ্রনাথের মনে হয় ,কে আমি,কী আমার পরিচয় ? কারুর চোখে
আমি ধনীর নন্দন,সংসারী ,পাঁচটি পুত্রকন্যার জনক। কেউ ভাবে আমি এক বিশিষ্ট জমিদার । কারুর কাছে আমি
সম্পাদক,লেখক,গায়ক,কবি । একই মানুষের অনেক পরিচয় থাকতে পারে। কিন্তু যখন আমি সম্পূর্ণ একা,তখন আমি
শুধুই কবি । একজন কবির প্রকৃত পরিচয় কি কোনও মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব ?
মাধুরীর বিয়ের ব্যাপারটা উপেক্ষা করা যায না । বিহারীলালের ছেলের সাথে মাধুররি সমন্ধের কথাটা অনেকেই জানে
,এখন এটা ভেঙ্গে গেলে লোকে হাসবে । অনেক ভেবে চিন্তে রবীন্দ্রনাথ শরৎ কুমারকেই চিটি পাঠালেন সব ব্যাপারটা
খোলাখুলি লিখে । সে শিক্ষিত,আধুনিক মনস্ক যুবক,সে নিশ্চিত পণ প্র া সমর্থন করবে না । কয়েক দিনের মধ্যেই
শরতের কাছ থেকে ঝটিতি উত্তর এসে গেল । আগাগোড়া শ্রদ্ধা ও বিনয় পূর্ণ বচনে লেখা । সে জানিয়েছে যে, সে পণ
প্রা সমর্থন করে না । তার নিজের দিক থেকে টাকা পয়সার কোনও দাবী নাই । ঠাকুর পরিবারের কন্যাকে স্ত্রী রূপে
পেলে সে গর্বিত বোধ করবে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সানিড়বধ্য পাবার জন্য সে আগ্রহী । কিন্তু সে
তার জননী ও ভাইদের বিরুদ্ধ মতে গিয়ে কোনও কাজ করতে পারবে না । পরিবারের লোকদের মনঃক্ষুনড়ব করে বিযে
করতে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় । সুতরাং এ ব্যাপারে তার মা ভাইরে সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত । রবীন্দ্রনাথ চিঠিটা পড়ে অখুশি
হলেন না । তিনি ভাবলেন,বিহারীলাল বেঁচে থাকলে এত জটিলতা দেখা দিতো না। তাঁর নিজেরও পুত্র সন্তান আছে ।
সেই পুত্র যদি বাবা-মায়ের মতামত অগ্রাহ্য করে বিয়ে করে তাতে কি তিনি খুশি হবেন? এ ছেলেটির নিজের গুরুজনের
প্রতি শ্রদ্ধা আছে ,এটাওতো একটা ভাল গুন । তা হলে বুঝি এই সমন্ধ ভেঙ্গে দেয়া ছাড়া আর গতি নেই । দেবেন্দ্রনাথ
বিয়ের আগেই আশীর্বাদ যৌতুক দিতে কিছুতেই রাজি হবেন না । হটাৎ একটি সমাধানের সূত্র এলো প্রিয়নাথ সেনের কাছ
থেকে । যদি কোন বন্ধু দীক্ষার দিনে ওই টাকাটা দিয়ে দেয় ,তা হলেই তো হলো । পরে বিয়ে চুকে গেলে যৌতুকের টাকা
থেকে সেই বন্ধুকে শোধ করে দেয়া যেতে পারে । প্রিয়নাথ নিজেই সেই দশ বারো হাজার টাকা জোগাড় করে ফেলতে
রাজি আছেন। এ প্রস্তাবে খুবই উৎফুল− বোধ করলেন রবীন্দ্রনাথ ।
প্রিয়নাথ সেনের সাহিত্য বোধ আছে,সংসার সর্ম্পকেও অভিজ্ঞ । প্রিযনাথের প্রতি কৃতজ্ঞতায মন ভরে গেল
রবীন্দ্রনাথের । খাঁটি বন্ধুর মতো কাজ করেছেন প্রিয়নাথ । মাধুরীর বিয়ের ব্যাপারে তাঁর উপর পুরেপুরি নির্ভর করতে
পারছেন ।
নদীর বাঁধের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্রনাথ ভাবলেন ,কলকাতায় ফেরা দরকার । কলকাতায় এসে আরো
ভালো খবর পেলেন প্রিয়নাথের কাছ থেকে । দীক্ষার দিনে নগদ টাকা হাতে তুলে না দিলেও চলবে । শুভ কাজের দিন
ঠিক করে ফেললেই হবে । মাঝখানে অবশ্য একটা অনুষ্ঠান বাকি আছে । পাত্র পক্ষের তরফ থেকে মেয়েকে এখনও
দেখাই হলো না । ছেলের মা-মাসীরা একবার পাত্রীকে দেখতে চান । পাকা-দেখা নামে একটা ব্যাপার থাকে । হিন্দু
বাড়ির শাশুড়িরা কখনও জামাই বাড়ি যান না । মেয়েকে একবার শরৎদের বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে । প্রিয়নাথ বললেন,
রবীন্দ্রনাথ যেন তাঁর গাড়িতে করে মাধুরীকে নিয়ে আসে । মেয়েকেতো পছন্দ হবেই জানা কথা ,ওঁরা ধান-দুর্বো দিয়ে
মেয়েকে আর্শীবাদ করবেন ।
কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার ভূমিকায় আর একবার ভুল করলেন রবীন্দ্রনাথ । অগ্র পশ্চাৎ বিেিবচন না করে তিনি এই প্রস্ত
াবেও রাজি হয়ে গেলেন । মৃণালিনী এই কথা শোনা মাত্র যেন খন্ড প্রলয় শুরু হয়ে গেল । ঠাকুর বাড়ির মেয়েকে নিয়ে

যাওয়া হবে পাত্রের বাড়িতে! মেযে কি জলে পড়ে গেছে নাকি যে রাজি হতে হবে এমন অপমানজনক শর্তে! ঠাকুর
পরিবারের অনেক মেয়েকে বিয়ের পরেও শ্বশুর বাড়িতে পাঠানো হতো না ,আর মাধুরীকে পাঠাতে হবে বিয়ের আগে ্?
মৃণালিনী দুঃখ বেদনা μোধে অধীর হয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে বলতে লাগলেন,কেন তুমি ওদের এমন প্রস্তাবে রাজি হলে ?
এতে তোমাদের বংশের যে কত অসম্মান ,তা তুমি ভেবে দেখলে না ? চিরটাকাল বরপক্ষের লোক আসে কন্যাপক্ষের
বাড়িতে । মেয়েকে আগ বাড়িয়ে পাঠাতে হবে,এমন কথা তুমি জগতে শুনেছ? অতি গরিব ঘরের মেয়ের বাবাও নিজের
বাড়িতেই যথাসাধ্য ব্যবস্থা করে,আর তুমি মেয়েকে নিয়ে ছেলের বাড়ি যাবে? এত তোমার নিজের সম্মান,তোমাদের বংশের
সম্মান ধুলোয় লুটোবে,তা একবারও ভেবে দেখলে না ? ওই পাত্র ছাড়া কি আমাদের মেয়ের কি আর বিয়ে হবে না ! ওদের
সব আব্দার আমাদের মেনে নিতে হবে ?
রবীন্দ্রনাথ লজ্জায়,আতড়বগ−ানিতে,অপরাধবোধে ভুগতে লাগলেন। সত্যিইতো বাঙালি সমাজের অনূঢ়া কন্যাকে ভাবী
স্বামীর গৃহে কখনও নিয়ে যাওয়া হয না । দেবেন্দ্রনাথ শুনতে পেলে আবার অপমান বোধ করবেন । এটাও তাঁর মনে
পড়েনি । পাত্রপক্ষের কাছে নত হতে গিয়ে তিনিই সব গোলমাল পাকিয়ে ফেললেন । তাঁর স্ত্রী বিরূপ,মাধুরী সব জানতে
পারলে মনে আঘাত পাবে । কিন্তু পাত্রপক্ষের সামনে রবীন্দ্রনাথ নিজে কথা দিয়ে এসেছেন ,এখন প্রত্যাহার করবেন কী
করে ? সেওতো আর এক অপমানজনক ব্যাপার । রবীন্দ্রনাথের সব রাগ গিযে পড়ল প্রিযনাথ সেনের উপর । সেই-তো
ভুল পরামর্শ দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ না হয় সংসার সম্পর্কে অনভিজ্ঞ,সব দিক বিবেচনা করে দেখতে পারেন না ।এই প্রম
মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন । প্রিয়নাথ যথেষ্ট অভিজ্ঞ ব্যক্তি,এর আগে নিজের দুটি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন । রবীন্দ্রনাথ ভুল
করলেও তাঁর ভুল ধরিয়ে দেয়া উচিত ছিল । বিয়ের আগেই দু’পক্ষের মধ্যে একটা তিক্ততার সৃষ্টি হতে চলেছে ।
প্রিয়নাথকে একখানা কড়া চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথ । তারপর সবকিছু অসমাপ্ত রেখে দার্জিলিং চলে গেলেন । দার্জিলিং
থেকেই প্রিযনাথের সঙ্গে চিঠি চালাচালি চলছিল । প্রিয়নাথ এক চিঠিতে জানালেন যে,মেয়ে দেখার ব্যাপারে যে জটিলতার
সৃষ্টি হয়েছিল ,তা কেটে গেছে । এবার পাত্র স্বয়ং হস্তক্ষেপ করেছে । পাত্র পক্ষই ঠাকুর বাড়িতে যাবে । সেখানে পাকা
দেখার অনুষ্ঠান হবে । এবার রবীন্দ্রনাথের দ্রুত ফেরা দরকার । চিঠি পেয়ে রবীন্দ্রনাথ তৃপ্ত হলেন । শেষ পর্যন্ত শেষ রক্ষা
হয়েছে।
ঠাকুর বাড়িতে আর কোনও উৎসবে এমন আলোর ঝলমলানি দেখা যায নি । সব কিছুই সম্পনড়ব হলো সুষ্ঠু ভাবে ।
ঋজু স্বভাব,বিনয়ী অথচ দৃঢ় চরিত্রের জামাইকে খুবই পছন্দ হলো রবীন্দ্রনাথের ।
ঠাকুর পরিবারের সকলেরই বিয়ের খরচ দেন দেবেন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে । অশতীপর দেবেন্দ্রনাথ মাঝে
মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েন । তিনি চক্ষু বুজলেই ভাইদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগি হেেয় যাবে । তখন সব খরচই
প্রত্যেকের নিজস্ব । দেবেন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতে থাকতে ছেলে মেযেদের বিয়ে দিতে পারলে বেশ কয়েক হাজার টাকা
বাঁচানো যায় । মাধুরীর বিয়ের মাস দেড়েক যেতে না যেতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর দ্বিতীয় কন্যা রেনুকার বিয়ে দেবার জন্য
উঠেপড়ে লাগলেন । প্রেমতোস বসু এক প্রেসের মালিক,রবীন্দ্রনাথের বই যতড়ব করে ছাপেন । তিনি একদিন বললেন,তাঁর
এক বন্ধুর ভাইপো ডাক্তার,সে আবার হোমিওপ্যাথি পড়বার জন্য বিলেত যেতে চায় । সেখানে যাবার সঙ্গতি নেই ,তাই
কোন উচ্চ পরিবারে বিয়ে করার জন্য উৎসুক। রবীন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ সত্যেন্দ্র ভট্টাচার্য নামে সেই ছেলেটিকে দেখতে
চাইলেন । ছেলেটিকে দেখে ও কথাবার্তা শুনে রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হযে গেল । বিলেত পাঠাবার ও সেখানে পড়াশোনা
চালাবার খরচ জোগানো শর্তে রাজি হয়ে সম্বন্ধ স্থির করে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ । মাধুরীর বিযে হয়েছিলো ১লা
আষাঢ়,রেণুকার বিয়ে হলো ২১শে শ্রাবণ । রেনুকার মাত্র সাড়ে দশ বছর বয়েস । রবীন্দ্রনাথ এক সময় বাল্য বিবাহের
বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছিলেন ,প্রয়োজনের তাগিতে তা বিস্মৃত হলেন । রেণুকার বিয়ের ব্যবস্থা নিখুঁত ও সার্থক হলো ।
মাধুরী ও রেণুকা বিয়ের পরের দু’তিন মাস রবীন্দ্রনাথের মাথায় একটাও কবিতা এলো না ,কন্ঠে এলো না নতুন গান ্
রবীন্দ্রওনাথ উপলব্ধি করলেন ,লেখার টেবিলে তিনি মুক্ত বিহঙ্গ হলেও আসলে তিনি সংসারে আবদ্ধ জীব । জমিদারীর
কাজ,ব্যবসা ,বৃহৎ পরিবারের বিলি ব্যবস্থা ,এসব করতেই সময় চলে যায় । তাই দিনের বেলায় লেখার সময় পান না।
লেখেন রাতের বেলা । দিনের কর্মব্যস্ত মানুষটির সাথে রাতের মানুষটির যেন কোন মিল নেই । সকলের থেকে আলাদা
এক নির্জন মানুষ । নিজের মধ্যে বিভোর ।
রবীন্দ্রনাথের ছেলে রথী কোন স্কুলে ভর্তি হয়নি । তার জন্য একাধিক গৃহ শিক্ষক রাখা হযেছে । রথীর চোদ্দ বছর
বয়েস । এন্ট্রাস পাস করার জন্য স্কুলে ভর্তি করা দরকার । আর এক ছেলে শমীকেও স্কুলে পাঠানো উচিত । নিজের দুই
ছেলে আরও কিছু ছাত্রকে নিয়ে একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপনের ইচ্ছা আস্তে আস্তে রবীন্দ্রনাথের মনে দানা বাঁধে । শান্তি
নিকেতনের নির্জনতায় স্কুল শুরু করলেন তিনি । দেবেন্দ্রনাথ মাসিক দুশো টাকার অনুদানের ব্যবস্থা করে দিলেন ।
বিদ্যালয়টি সম্পূর্ণ অবৈতনিক এবং ছাত্রদের খাওয়া থাকার ভার নিয়েছেন রব’ীন্দ্রনাথ । তিনি তাঁর সামর্থ্যরে চেয়ে অনেক

বেশি দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন । যখন তখন খরচের ধাক্কা । রবীন্দ্রনাথ প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় পৌঁছেছেন । জমিদারী
তদারকির জন্য তিনি মাসোহারা পান তিনশো টাকা । তাতে তাঁর সংসার চলে । পৃ ক ব্যবসা করতে গিয়ে এক
মাড়োয়াড়ির কাছ থেকে চলি−শ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন ,সে ব্যবসা ফেল পড়েছে । সে মাড়োয়াড়ি এক সঙ্গে পুরো
টাকা শোধ করতে বলায় তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে । অতগুলি টাকা কোথায় পাবেন ।
এক এক সময় রবীন্দ্রনাথের মনের মধ্যে কেউ যেন প্রশড়ব করে ,তুমি তো কবি,শিলাইদহে নির্জন নদীর বুকে বজরায়
গভীর নিশীতে মোমবাতি জ্বালিয়ে কবিতা কিংবা গান রচনা করতেই তুমি বেশি তৃপ্তি পাও । স্কুল স্থাপনের মতো গুরুতর
কাজের দায়িত্ব নিতে গেলে কেন তুমি ?তিনি উত্তর দেন কবি শুধু গগন বিহারী হবে ? যত বাধাই আসুক ,স্কুলটি আমি বন্ধ
করবো না । স্কুলটা চালানো আমার প্রধান কাজ ।
রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর কয়েকটি গয়না বন্ধক দিলেন । মৃণালিনীর কাছ থেকে বারবার গয়না চাইতেও তাঁর লজ্জা হয় ।
সর্বক্ষণ অর্থচিন্তায় মগড়ব থাকেন তিনি । ছোট্ট একটা বাড়িতে সকলের স্থান সঙ্কুলান হয় না । ছাত্র সংখ্যা μমে বেড়ে চলছে
। তাই আর একটা নতুন স্কুল বাড়ির কাজে হাত দিয়েছেন । কিন্তু অনেক টাকা দরকার । মৃণালিনী স্বামীর মুখ দেখেই
বুঝতে পারেন,কোনও একটা সমস্যায় তিনি পীড়িত । বারবার কারন জিজ্ঞেস করেন স্বামীকে,রবীন্দ্রনাথ বলতেই চান না ।
শেষ পর্যন্ত বলেই বসলেন,নতুন স্কুল বাড়িটার কথা । মৃণালিনী নিজের হাত থেকে এক জোড়া মকরমুখো বালা খুলে
দিলেন । রবীন্দ্রনাথ ব্যস্তভাবে বললেন,না,না ওগুলো দিয়োনা । ও আমার মায়ের গহনা । পারিবারিক জিনিস ,ও দুটো
তোমার প্রম পুত্রবধূকে দিয়ো । মৃণালিনী বললেন,ভাগ্যে থাকলে রথীর বউয়ের জন্যে আবার গহনা হবে । এখন এই
দিয়ে কাজ চালাও । রবীন্দ্রনাথ বরলেন,তোমার হাত খালি করে ? ও আমি নেই কি করে ! মৃণালিনী বললেন,মেলার সময়
অনেক বেলোয়ারী চুড়ি পাওয়া যায় ,তাতেই আমার হাত ভরে যাবে । রবীন্দ্রনাথ বললেন,অনেকে বলে,এই স্কুলটা
চালানো আমার একটা উৎকট শখ । তুমি যে আমার এই শখের বিরূপতা করোনি,আমার তালে তাল মিলিয়েছো,এ জন্যে
আমি যে কতখানি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ । এই শেষ তোমার কাছে আর চাইতে হবে না ।
রবীন্দ্রনাথকে না জানিয়েও মৃণালিনী কিছু কিছু গয়না বিμি করেছেন ।স্কুল নিয়ে স্বামী এমনই ব্যস্ত যে সংসার কী
করে চলে,সেদিকে খেয়াল নেই । রথী স্কুলে অন্য ছেলেদের সঙ্গেই খাবার খায় । প্রতিদিন এক ঘেয়ে নিরামিষ
খাদ্য,পরিমাণও যথেষ্ট নয় । উঠতি বয়সের ছেলে,এখন পেট ভরে ভাল করে না খেলে স্বাস্থ্য ভাল হবে না । নিজের
ছেলেকে বাড়িতে ডেকে এনে সুখাদ্য খাওয়ানোটাও অতি বিসাদৃশ্য ব্যাপার । মৃণালিনী তাই প্রায়ই স্কুলের সবকটি
ছেলেকেই নিমন্ত্রন করে পঞ্চ ব্যঞ্জন রেঁধে খাওয়ান । মায়ের কাছে প্রশয় পেয়ে রথীও যখন তখন সহপাঠিদের বাড়িতে
এনে রানড়বাঘর,ভাঁড়ার ঘরের সব কিছু সাফ করে দেয় । এতগুলি ছেলের খাদ্য জোগানোর খরচ অনেক ।
সকালবেলা ছাত্ররা সার বেঁধে যখন উপাসনা শুরু করে,তখন সেদিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথের মন ভরে যায় । কঠোর
নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতে হয় ছাত্রদের । প্রতিদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে হয় ভোর সওয়া পাঁচটায় । তাদের প্রম কাজ ঘর ঝাট
দিয়ে নিজেদের জিনিসপত্র ও শয্যা গুছিযে রাখা । তারপর øান করা । দশটায় ক্লাশ শেষ,তখন কেউ হারমোনিয়াম
বাজিয়ে গান শিখবে,কেউ গল্পের বই পড়বে। সাড়ে এগারটায় মধ্যাহ্ন ভোজন.প্রত্যেক ছাত্রের নিজস্ব থালা বাটি,খাওয়ার
পর নিজেদেরই মেজে-ধুয়ে রাখতে হয় । সাড়ে বারোটায় আবার ক্লাশ শুরু,তিনটের সময় মাত্র পনের মিনিটের বিশ্রাম
,আবার সাড়ে চারটে পর্যন্ত ক্লাশ,এরপর খেলাধুলোর ছুটি । ছাত্র-শিক্ষক সবাই মিলে কিছুক্ষণ ফুটবল খেলে । সন্ধ্যে হতে
না হতেই আবার হাত পা ধুয়ে উপাসনা,এরপর,যে সময় রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত থাকেন তখন তিনি সবাইকে নিয়ে বসেন ।
গল্প কবিতা গান শোনান,নানা রকম মজার মজার খেলাও উদ্ভাবন করেন । তিনি যখন থাকেন না ,তখন আর বিশেষ কিছু
করার থাকে না ,আবার নিরামিষ আহার শেষ করে রাত নটার মধ্যে শয্যা গ্রহণ ।
স্কুলের একটা সমস্যা মিটলে আবার আরেকটা সমস্যা দেখা দেয় । দেবেন্দ্রনাথ কখনও সখনও কিছু অতিরিক্ত অর্থ
বরাদ্দ করেন বটে ,কিন্তু বারবার তাঁর কাছ থেকে অর্থ নেয়ার বিপদও আছে । স্কুলটি রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব উদ্যোগে
চলছে,অন্য ভাইরা এতে উৎসাহ দেখাচ্ছে না । এমন শখের স্কুল চালাবার জন্য দেবেনন্দ্রনাথের তহবিল থেকে অনবরত
ব্যয় করলে অন্যান্য শরিকদের ভাগে কম পড়ে যাবে । রবীন্দ্রনাথ সব সমস্যার সমাধান করছেন দৃঢ় চিত্তে । গেরুয়া
আলখেল−া পরা উদ্দীপনাময় কচি কচি মুখগুলিতে যেন ভবিষ্যতের ছবি উদ্ভাসিত হতে দেখেন তিনি । পরিপূর্ণভাবে শিক্ষিত
হয়ে এরা মানুষের মতন মানুষ হবে । স্বাবলম্বী ,আতড়বমর্যদাসম্পনড়ব নাগরিক,প্রাচীন ভারতের এতিহ্য আতড়বস্থ করে,এরাই দেশ
গড়বে।

রবীন্দ্রনাথ একটানা বেশি দিন থাকতে পারেন না শান্তিনিকেতনে । শিলাইদহে জমিদারী তদারকিতে যেতে হয়
,কলকাতাতেও নানান সভায় বক্তৃতা ও গান করতে হয় , ‘বঙ্গ দর্শন’ পত্রিকার কাজও আছে । সেখানে ধারাবাহিক
উপন্যাস‘চোখের বালি’ ও অনান্য প্রবন্ধাদি লিখতে হচ্ছে ।
রবীন্দ্রনাথের বন্ধু –শুভার্থীরা অনেকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে স্কুলটি দেখতে চায় । রবীন্দ্রনাথও অনেককে নিয়ে গিয়ে
তাঁর কর্মকান্ডটি দেখাতে আগ্রহী ,না হলে ভবিষ্যতে আরও ছাত্রসংগ্রহ হবে কি করে ? কারুকে কারুকে তিনে যাতায়াতের
ভাড়া দিয়েও নিয়ে যান । এতেও আছে অতিরিক্ত খরচের ধাক্কা । বন্ধুরা সকলেই অবশ্য রবীন্দ্রনাথের এই উদ্যোগটি
সমর্থন করেন না । তাঁর বিশেষ বন্ধু প্রিয়নাথ সেনও এর বিরোধিতা করেন ।
একদিন রাত্রিবেলা,সকলে ঘুমিয়ে পড়ার পর তিনি পত্রিকার জন্য প্রাচীন সাহিত্য বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লিখতে
বসেছেন ,বেশ খানিকটা লেখার পর থেমে গেলেন । হটাৎ তাঁর মনে হলো,অনেক দিন তিনি কোন প্রেমের কবিতা
লেখেননি । ইন্দিরার বিয়ে হবার পর তেমন অন্তরঙ্গ চিঠিও লিখেননি কারুকে । উপন্যাস লিখছেন বলে কবিতা কমে
আসছে । কলম হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলেন প্রেম তাঁকে ছেড়ে গেল ! নতুন বউঠানের কথাও মনে আসেনি অনেক দিন ।
সেই মুখখানি যেন অস্পষ্ট হয়ে গেছে । এখন তিনি শুধু কাজের মানুষ । যে সব কাজকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় ,বক্ত ৃতা করা
,লেখালেখি,এখানে সেখানে ছুটে বেড়ানো,দেশ উদ্ধার করবার ফিকির ,এগুলো কি সত্যি তাঁর কাজ ! প্রেম এমন কিছুর
চেয়ে বড় নয় ! প্রেম ছাড়া জীবনটাই তো শুষ্ক । ছিলেন প্রেমিক কবি ,হযে গেলেন এক আশ্রমের গুরুদেব ।
বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ । আকাশে পূর্ণ চাঁদের মায়া । একটা মসলিনের চাদরের মতো ছড়িয়ে
আছে জোৎøা । বাতাসে ভেসে আসছে কোন ফুলের সুগন্ধ । বাইরের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ বিষনড়বভাবে দাঁড়িয়ে
রইলেন। যে-সব দায়িত্ব নিয়েছেন ,তা কোনটা থেকেই বিচ্যুত হবেন না । কিন্তু কবিতা রচনাই তাঁর প্রধান কাজ । আবার
কবিতা লিখবেন তিনি ।
এক সময় ঘোর ভাঙল । অনেক রাত হয়ে গেছে । কটা বাজে দেখার জন্য তিনি পকেট ঘড়িটা বার করলেন ।
তারপর ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে । এটা তাঁর বিয়ের সময় যৌতুক পাওয়া সোনার ঘড়ি । একটা
বোতাম টিপলে ওপরের ডালা খুলে যায় । ডালার ভেতর দিকে ইংরেজি অক্ষরে তাঁর নামের আদ্যক্ষর খোদাই করা । হঠাৎ
অন্য কথা মনে পড়লো রবীন্দনাথের । বাস্তবতা তাঁকে আঘাত করেছে । স্কুলের শিক্ষকদের এ মাসের বেতনের টাকার
সংস্থান করা যায়নি এখনও । নির্দিষ্ট দিনে মাস-মাইনে দিতে না পারলে সম্মান রক্ষা করা যাবে না । টাকা সংগ্রহের কোন
উপায়ও দেখা যাচ্ছে না । মৃণালিনীর কাছ থেকেও আর গহণা চাওয়া যায় না । এবারে এই ঘড়িটা বিμি করে দিলেই কাজ
চলে যাবে ।
শ্রাবণ মাসে যখন তখন বর্ষা নামে । ফুলে ফেঁপে উঠেছে পদ্মা ও গোরাই নদী । অনেক দিন পর পদ্মা বোটটিকে
মেরামত করিয়ে কাজে লাগানো হয়েছে । বিশাল এই বজরা খানি একটি বিস্ময়কর দর্শনীয় বস্তু ,যেন ধপধপে সাদা রঙের
একটি অলৌকিক পাখি । ভেতরে রয়েছে দুটি বড় বড় কক্ষ,তাতে আরাম-বিলাসের কোন উপকরণের অভাব নেই,মেঝেতে
গালিচা পাতা ,চেয়ার টেবিল-পালঙ্ক দিয়ে সাজানো । এমন কী ঝাড়লন্ঠন পর্য়ন্ত রয়েছে । উপরে প্রশস্ত ছাদে বিশ-পঁচিশ
জন বসতে পারে । এই বজরাটি তৈরি করিয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর । ঢাকার অভিজ্ঞ কারিগরদের হাতে গড়া এই সুন্দর
বজরাটি দেখে অন্যান্য জমিদাররা ঈর্ষা বোধ করতেন । পরে দেবেন্দ্রনাথ এই বজরায় কলকাতা থেকে কাশী-এলাহাবাদ
পর্যন্ত গিয়েছিলেন । আকারে বড় হলেও বারোটা দাঁড় ফেলে এই বজরা চালানো যায় বেশ দ্রুত গতিতে । দেবেন্দ্রনাথ
বহুদিন বাড়ি ছেড়ে এই বজরাতেই বাস করেছেন । রবীন্দ্রনাথ এটির নাম দিয়েছেন পদ্মাবোট ।
বজরাটি বাঁধা থাকে পদ্মাবক্ষে শিলাইদহের ঘাটে । এখন আর এই বোটটি বেশি দূরে যায় না । মাঝে মাঝে যখন
লোকজনের উপদ্রুব বেড়ে যায় ,লেখার জন্য নির্জনতার প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ পদ্মাবোটকে কিছুটা দুরে নিয়ে গিয়ে একা
রাত্রিবাস করেন ।
রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসেছেন পুরো পরিবার সঙ্গে নিয়ে । তার জন্য কুঠি বাড়িটিও সাফসুতরো করে কিছুটা অংশ
বাড়ানো হয়েছে । এই বাড়িটি নদীর ধারে নয় ,বেশ দূরে একেবারে ফাঁকা মাঠের মধ্যে । রবীন্দ্রনাথ কুঠিবাড়ি থাকাকালীন
এক একদিন চলে আসেন পদ্মাবোটে । পরিবারের অন্য লোকজনেরও এই বোটে আসা নিষিদ্ধ নয় । লেখা থামিয়ে এক
এক সময় তিনি নিজেই ছেলে- মেয়েদের ডাকেন ।
পরপর দুদিন একটানা বৃষ্টির পর সকালটি ঝলমল করছে রোদে । সবাই এসে বসেছে বজরার ছাদে ,শুধু মৃণালিনী
আসেনি । ছেলে মেয়েদের খুব শখ কুমির দেখার ,পদ্মায় মাঝে মাঝেই কুমির ভেসে ওঠে,আবার টুপ করে ডুবে যায় ।

শীতের সময় যখন নদীতে চড়া পড়ে,তখন দেখা যায় বালির ওপর তিন চারটে কুমির এক সঙ্গে পাশাপাশি শুয়ে রোদ
পোহাচ্ছে। পাশ দিযে কোন বড় নৌকো গেলে তারা সর সর করে জলে নেমে যায় । কুমিরগুলোর আকার এতো বড়
যে,তাদের তাদের ধরা কিংবা মারা সহজ নয় । কিছুদিন আগে গোরাই নদীর মোহনা কাছ থেকে কুমির একটা ছাগল ধরে
নিয়ে গেছে,তাই নিয়ে স্থানীয় ছেলেরা খুব উত্তেজিত ।
রবীন্্রনাথের এক ভাতৃষ্পুত্র নীতিন্দ্র কৌতুক করছে খুড়তুতো ভাই-বোনদের সঙ্গে । নদীতে কিছু একটা ভেসে
যাচ্ছে,সেদিকে আঙ্গুল তুলে সহাস্যে বলছে,ওই দ্যাখ কুমির! অমনি সবই চোখ বড় বড় করে বলছে,কই,কই?
একটা চেয়ারে বসে রবীন্দ্রনাথ ডব−ু,এইচ হাডসানের লেখা ‘গ্রিণ ম্যানসনস’ বইটি পড়ছেন ও মাঝে মাঝে চোখ তুলে
ছেলে মেয়েদের ওৎসুক্য ও ব্যগ্রতা দেখছেন। তাঁর পরণে শুভ্র ধুতি ও বেনিয়ান,পায়ে লাল রঙের রেশমি চটি । নীতীন্দ্র
রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে বলল,রবিকা,রথীটা বড় ভীতু হয়েছে। আমি ওকে বলি,চল জলিবোটে করে ওপারে গিয়ে কচ্ছপের
ডিম খুঁজে আনি , তা ও যাবে না । ওখালি বলে,যদি নৌকা উল্টে যায় ।
দশ বছর পেরিয়ে এগারোতে পা দিয়েছে রথী । তার মাথাটি কদম ফুলের মতন । তিন মাস আগে ন্যাড়া হয়েছিল ।
মুখখানি লজ্জা মাখানো । কুমির ও জলকে সে ভয় পায় ।
রবীন্দ্রনাথ বই মুড়ে রেখে উঠে এসে রথীর পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,সে কী রে,রথী তুই জলকে এতো ভয় পাস? এতো
জলেরই দেশ । সাঁতার শিখলে ভয় কেটে যাবে। কাল থেকে বদন মিঞা তোকে সাঁতার শেখাবে । রথী ছটফটিয়ে
বলল,না,আমি সাঁতার শিখব না । কুমিরে কামড়াবে। রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন,মানুষজন দেখলে কুমির পালায় । গ্রামের
সব ছেলেইতো সাঁতার শেখে । রথী তবু বলল,না আমি জলে নামতে পারবো না । রবীন্দ্রনাথ বললেন জলে নামবি না?
তারপরেই তিনি রথীকে দু‘হাতে উঁচু করে তুলে ছুঁড়ে দিলেন নদীতে । সবাই আঁতকে উঠল । ছোট্ট মীরা কেঁদে ফেলল।
কয়েকজন দাঁড়ি মাঝি নীচ থেকে ব্যস্ত হয়ে বলল,কী হলো,কী হলো,কেউ পড়ে গেল নাকি? রবীন্দ্রনাথ হাত তুলে
বললেন,কিছু হয়নি,আর কেউ জলে নামবে না । জলের মধ্যে আঁকু-পাঁকু করছে রথী । একবার ডুবছে,একবার ভাসছে।
সে চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করছে,শোনা যাচ্ছে না । শমী,মাধুরী,রবীন্দ্রনাথের হাত চেপে ধরে ব্যাকুলভাবে বলতে
লাগল,বাবা রথী ডুবে যাবে,রথী ডুবে যাবে । রবীন্দ্রনাথ মাধুরীর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন,দ্যাখ না কিছু হবে
না । নীতীন্দ্র বরলো,রবিকা ও আর পারবে না । আমি জলে নামব? রবীন্দ্রনাথের মনে হলো রথীকে স্রোতে টেনে নিয়ে
যাচ্ছে । তিনি ঝটিতি নিজের পিরাণ খুলে ফেললেন,মালকোঁচা বাঁধলেন ধুতিতে । তারপর ঝাঁপ দিলেন জলে । সাঁতার
কেটে রথীকে ধরে ফেললেও তক্ষুণি তাকে তুললেন না । এক একবার জলের ওপরে ভাসিয়ে দিয়ে আবার ছেড়ে দিয়ে
বললেন,হাত-পা এক সঙ্গে ছোঁড়ার চেষ্টা কর । আমার সঙ্গে সঙ্গে আয় । প্রায় আধঘন্টা জলে দাপাদাপি করে তারপর
পাড়ে উঠলেন দু‘জনে । রথীর পিঠে চাপড় মেরে বললেন,আর একদিন এরকম করলেই তুই সাঁতার শিখে যাবি। তারপর
আমার সঙ্গে নদী এপার ওপার করবি তুই ।
কয়েকদিনের মধ্যে রথী সাঁতার শিখে গেল,তারপর আর সে জল ছেড়ে উঠতেই চায় না । তাকে জোর করে টেনে
তুলতে হয় । রবীন্দ্রনাথ তখন রথীকে বললেন, সাঁতার কাটতে ভারি মজা তাইনা! রথী লাজুক হেসে মাথা নাড়ে ।
চন্দন নগরে মোরান সাহেবের বাগান বাড়িতে জ্যেতিদাদা ও নতুন বউঠানের সঙ্গে থাকবার সময় রবীন্দ্রনাথ গঙ্গায়
রোজ সাঁতার দিতেন । এখানে আর তেমনিটি হয় না । এখানে তাঁকে জমিদার সেজে থাকতে হয় । তবে তাঁর সাঁতার
কৃতিত্বের কথা এখানেও অনেকে জানে । কয়েক বছর আগে,রথী তখন আরো ছোট ছিল ,তাকে সঙ্গে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ
একবার এসেছিলেন। একদিন এই রকমই বোটের ছাদে বসে সন্ধ্যেবেলা বই পড়ছিলেন । বই পড়ার সময় পা দোলানো
তাঁর অভ্যাস,তাঁর পায়ে এটকি চটি । হঠাৎ পা দোলানিতে এক পাটি চটি পড়ে গেলো জলে । চটি জোড়া খুব পুরনো
হলেও রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ছিল । বোট তখন মাঝ নদীতে,জলে প্রবল স্রোত,চটিটা ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে,রবীন্দ্রনাথ
কোন কিছু চিন্তা না করেই জামা কাপড় পরা অবস্থাতেই লাফিয়ে পড়লেন জলে । বজরার কর্মচারীরা ভীত,সন্ত্রস্ত। কী এমন
অমূল্য বস্তুর জন্য জমিদার মশাই নিজে ঝাঁপ দিয়েছেন এই খরস্রোতা পদ্মায়? খানিক বাদে রবীন্দ্রনাথ সাঁতরে ফিরে এলেন
,তাঁর মুখে বিজয়ীর হাসি,হাতে সেই এক পাটি চটি ! প্রিয় জিনিসটির জন্য জীবনের বাজি ফেলতেও পেছপা হননি ।
রথীকে সাঁতার শেখানোর মতন ,লেখাপড়ার ব্যাপারেও রবীন্দ্রনাথ ডাইরেক্ট মেথডে বিশ্বাস করতেন ।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ছোটদের প্রম থেকেই সাহিত্যরসে দীক্ষা দেয়া উচিত । ছোটদের যে আজ আম-ইট মুখস্থ
করতে হবে,তার কোন মানে নেই । এবারে তিনি শুধু জমিদারী পরিদর্শন বা নিজের লিখার জন্যই আসেননি । এবারে তাঁর
স্বামী ও পিতার ভূমিকাটাই প্রধান । মৃণালিনী তাঁর সঙ্গ পাবে । ছেলে-মেয়েরা এমন নিবিড় ভাবে আগে তাঁকে কখনও
পায়নি । এতখানি খোলা প্রান্তর ,এমন সজল আকাশ,কাছাকাছি দু‘দুটো নদী ,প্রকৃতির এই μীড়াঙ্গনে আনন্দের ভাগই
বেশি । রবীন্দ্রনাথ এই সাংসারিক ভুমিকা বেশ উপভোগ করছেন , কিন্তু সর্বক্ষণের জন্য নয় । তিনি মূলত এক রোমান্টিক

কবি ,এই জগতের কাছে এক ব্যাকুল প্রণয়ী,সুন্দরকে ছোঁয়ার আকাক্সক্ষায় এক গোপন বিরহি । যখন তিনি কবিতা রচনা
করেন,তখন তিনি কারুর পিতা নন,কারুর স্বামী নন ,প্রজাদের জমিদার নন ।
রবীন্দ্রনাথের মাথার মধ্যে সব কাজের জন্য সুশৃঙ্খল বিভাজন আছে। জমিদার সেরেস্তার কাজকর্ম যখন দেখেন
,তখন তাতে পুরোপুরি মন দেন । আয় বৃদ্ধির দিকে তাঁর তীক্ষè নজর আছে । আবার দরিদ্র প্রজাদের অভাব-অভিযোগ ও
নালিশ তিনি সহায়ভাবে শোনেন,সুবিচারের ত্র“টি রাখেন না । পুত্র-কন্যাদের উজাড় করে দেন øেহ । মৃণালিনীর মনে যে
ক্ষোভ জন্মেছিল ,তা অনেকটা দূর করতে সক্ষম হযেছেন । এই সবই করে যাচ্ছেন ঠিক মতন ,কিন্তু অন্তঃশীলা টান সব
সময় কাগজ-কলম নিয়ে নিভৃতে বসার সময়টার দিকে । প্রতিদিন কিছু না কিছু না লিখলে তাঁর ভাল লাগে না । অক্ষর
,শব্দ,ছন্দ,সুর এই নিয়ে যে জীবন,সেটাই যেন তাঁর প্রকৃত জীবন । যে-কোন একটা লেখা শেষ হলেই তাঁর ইচ্ছে জাগে
কারুকে শোনাতে । শিলাইদহতে সে রকম কেউ নেই । তখন নির্দিষ্ট কয়েকজন বন্ধুবান্ধবদের জন্য মনটা তাঁর আকুলি–
বিকুলি করে । ইচ্ছে করে কলকাতায় ছুটে যেতে । মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন তিনি । বিবির সাথে চিঠি বিনিময় হয় না ।
আগে যেমন বিবি প্রত্যোকদিন চিঠি লিখতো,রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেও সেরকম চিঠি আশা করতো ,নানা অভিযোগঅনুে
যাগ,অভিমান,রবীন্দ্রনাথও পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা চিঠিতে তাঁর সমস্ত অনুভূতির কথা বিবিকেই জানাতেন ,তেমন আর
নেই,সেই পর্বটি যেন চুকে যেতে বসেছে । বিবি ভুলে গেছে তাঁর রবিকাকে ।
বন্ধুদের সঙ্গ পেলে রবীন্দ্রনাথ উদ্দীপিত হযে উঠেন । তাঁর নতুন নতুন রচনার স্ফুর্তি আসে । তাদের অনুরোধ
মতনও বিভিনড়ব আঙ্গিকে লিখতে হয় । রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে বিশেষ উৎসাহী । পদার্থ বিজ্ঞানী জগদীশ
সম্প্রতি জড় ও উদ্ভিদ সম্পর্কে ঝুঁকেছেন,রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছ থেকে এই সব বিষয়ে শুনতে চান । আর জগদীশ কলেজের
ছুটি হলেই চলে আসেন শিলাইদহে সাহিত্য-রস-তৃষ্ণা মেটাতে । রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েদের সাথে তাঁর বেশ ভাব হয়ে
গেছে । সাহিত্যের আড্ডায় রবীন্দ্রনাথ ছেলে-মেয়েদের দূরে সরিয়ে রাখেন না । আলোচনা শুনুক,শিখুক,যতটা বুঝতে
পারে বুঝুক ।
সাহিত্যপাঠ ও সঙ্গীতের আসর বসে সন্ধ্যের পর । কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যখন আসেন,তাঁর হাসির গানে ভান্ডার
অফুরন্ত,তিনিই সেদিন মাতিয়ে রাখেন । সেই সব দিনে রবীন্দ্রনাথ নিজে গান করেন না । তবে জগদীশচন্দ্রের অনুরোধে
মাঝে মাঝে গাইতে হয় । পদ্মাবোটের ছাদে চাঁদের আলোয় সেই গানের লহরীতে বাতাস ভরে যায় । সঙ্গে কোন বাদ্য যন্ত্র
থাকে না । রবীদ্রনাথের ভরাট গলায় গান শোনার জন্য দূর দূর নৌকোর মাঝিরা কাজ থামিয়ে দেয় । জগদীশচন্দ্রের
কয়েকটি প্রিয় গান আছে । সেগুলি শুনতে চান বারবার । রবীন্দ্রনাথ নতুন গানও শোনান । বেশির ভাগ দিনই আগে থেকে
ঠিক করা থাকে না ,যে গানটা মনে আসে,রবীন্দ্রনাথ সেটাই গেয়ে শোনান । তিনি যেটাই গান,সেটাই সবাই উদগ্রীব হয়ে
শোনেন । বিভোর হন ,যাদু আছে রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে । একদিন গাইছেন,‘ওগো কাঙাল,আমারে কাঙাল করেছ,আরো কী
তোমার চাই।’ বেশ গেযে চলেছেন আপন মনে,হটাৎ অন্তরায় এসে‘,আমি আমার বুকের আঁচল ঘেরিয়া তোমারে পরানু
বাস’ এ পর্যন্ত গেয়ে থেমে গেলেন । একটুক্ষণ চুপ করে থেকে হাসলেন মুখ তুলে। জগদীশচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন,থামলে
কেন বন্ধু? বড় চমৎকার গান,রবীন্দ্রনাথ লাজুকভাবে বললেন,ভুলে গেছি । জগদীশচন্দ্র বললেন,নিজে লিখেছো ,তবুও ভুলে
গেছ ? রবীন্দ্রনাথ বললেন,কথা মনে আছে । কিন্তু সুরটা ,আমি নিজেই বুঝতে পারছি,অন্তরায় অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে ।
জগদীশচন্দ্র বললেন,আমি কিছুই বুঝতে পারিনি । সুরটা মনে হছ্ছে ভৈরবী । রবীন্দ্রনাথ বললেন,অন্য সুরেও গেয়ে
দিতে পারতাম । কম গানতো লেখা হলো না । এখন সব সুর নিজের মনে থাকে না । এখন সুর বেঁধেই চট করে অন্য
কারুকে শিখিয়ে দিতে পারলে ভাল হয় ।
কলকাতায় লেবরেটরিতে জড় পদার্থ ,গাছপালার বিভিনড়ব রকম প্রতিμিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করলেও শিলাইদহে এসে
জগদীশচন্দ্র মেতে উঠেন কচ্ছপের ডিম খোঁজায় । এখানে কচ্ছপ প্রচুর ,ডিম পাড়ার সময় নদী থেকে উঠে এসে কচ্ছপ
উঁচু ডাঙ্গায় বালি খুঁড়ে ডিম পেড়ে যায় । ঠাকুর বাড়ি লোকেরা কচ্ছপের মাংস কিংবা ডিম খেতে জানে না । জগদীশচন্দ্র
ঠাকুর বাড়ির সবাইকে এই উত্তম খাদ্যের স্বাদে দীক্ষা দিলেন । রথীকে তিনি শিখিযে দিলেন কীভাবে কচ্ছপের ডিমের
সন্ধান পেতে হয় । নদী থেকে কচ্ছপগুলো যখন উঠে আসে তখন বালির ওপর তাদের পায়ের ছাপ পড়ে । সেই ছাপ
অনুসরণ করতে করতে গেলে এক জায়গায় দেখা যায়, সেই ছাপ থেমে গেছে । লোকচক্ষুর আড়াল দেবার জন্য কচ্ছপরা
সেখানে গর্ত খোঁড়ে,সেই গর্তের মধ্যে ডিম পেড়ে আবার বালি চাপা দিয়ে দেয় । জগদীশচন্দ্র রথীকে নিয়ে খুরপি দিয়ে
বালি খুঁড়তে থাকেন । ডজন ডজন ডিম পাওয়া যায় ।

রথী কচ্ছপ ধরায় এক্সপার্ট হয়ে গেছে । পেছন দিক থেকে কচ্ছপটাকে একবার উল্টে দিতে পারলেই কচ্ছপটা অসহায়
। চিত হওয়া কচ্ছপ কিছুতেই আর উপুড় হতে পারে না ,তখন অনায়াসেই বেঁধে ফেলা যায় ।
রব্ন্দ্রীনাথের ভক্তের সংখ্যা বাড়ছে ,অনেকে তাঁর কোনও কোনও রচনায় বিমোহিত হয়ে স্তুতিপত্র লেখে,একদিন
একটি বিচিত্র চিঠি পেলেন । ঠিকানা নেই । গোটা গোটা হস্তাক্ষর,একটু মেয়েলি ধরণের ,কোন রমণীর লেখা বলেই
রবীন্দ্রনাথের মনে হলো । তারপর থেকেই ওই রকম অস্বাক্ষরিত ,ঠিকানাবিহীন ও একই হাতের লেখার চিঠি আসতে
লাগলো মাঝে মাঝে । সব চিঠিই মধুর ভাবে ভরা । রবীন্দ্রনাথের বিভায় মুগ্ধ কেউ একজন দূর থেকে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে
তাঁর চরণে নিবেদন করতে চায় । উত্তর দিতে না পারলেও চিঠিগুলো সযতেড়ব রেখে দেন রবীন্দ্রনাথ ।
রেণুকার স্বামী সত্যেনের চিঠি পেলেন একদিন রবীন্দ্রনাথ । খরচপত্র দিয়ে হোমিওপ্যাথি শেখবার জন্য আমিরিকায়
পাঠানো হয়েছিল শ্রীমান সত্যোনকে । কিন্তু মাঝ পথে সে লন্ডনে নেমে পড়ে । সেখানেই সে হোমিওপ্যাথি পড়া শুরু
করেছিল ,পাশ করে ফিরে এল সে স্বাবলম্বী হবে ,এই ছিল আশা । কিন্তু সেই আশার মূলে কুঠারাঘাত পড়ল । সত্যেন
জানিয়েছে যে বিলেতি আদব-কায়দা তার পছন্দ হচ্ছে না । ডাক্তারি পড়তেও ভাল লাগছে না ,সে দেশে ফিরতে চায়
অবিলম্বে । রাগ করার উপায় নেই । যেমন করে হোক টিকিটের টাকা সংগ্রহ করতে হবে । রেণুকার মুখ চেয়েই সন্তুষ্ট
রাখতেই হবে জামাইকে । রেণুকার শরীর ভাল নয় ,তার ঘুষঘুষে কাঁশি ে গেই আছে ,মাঝে মাঝেই জ্বর হয় ।
লন্ডন থেকে ফিরে এসে সত্যেন ঘরজামাই হিসেবে থাকছে । তার বাবুয়ানার শেষ নেই ,তাকে মাসে দেড়শো টাকা
হাত খরচ দিতে হয । তা ছাড়াও যখন তখন সে গাড়ি ভাড়া বাবদ আরও টাকা চেয়ে নেয় । এখন আবার নতুন বায়না
ধরেছে । ডাক্তারি শেখা তার হলো না ,সে একটা ওষুধের দোকান খুলতে চায। একটা ডিসপেনসারি সাজাতে গেলে অন্তত
দু হাজার টাকার দরকার ,সে টাকাও দিতে হবে রবীন্দ্রনাথকে । খরচের ধাক্কা সামলাতে হচ্ছে ।
তাড়াহুড়ো করে রেণুকার বিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ । এখন তাঁকে তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে । ওইটুকু মেয়ে
রেণুকা ,বয়স মাত্র সাড়ে এগারো বছর । সেও তার বাবার মনের অবস্থা বোঝে । সে সব সময় বিষনড়ব হয়ে থাকে । তার
স্বামীটা যে একটা অপগন্ড,বিলেতে শুধু শুধু গুচ্ছের টাকা খরচ করে এলো ,কাজের কাজ কিছুই শিখল না ,সে শুনেছে
বাড়ির লোকেরা আড়ালে আবডালে টিপ্পনী কাটে । সে অপমান তাকে মুখ বুজে সহ্য করতে হয় । শরীর এমনিতেই ভাল
নয় ,এর মধ্যে সে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল । তার কাশির সঙ্গে একটু একটু রক্ত পড়ে । রবীন্দ্রনাথ কখনও পাশে এসে বসে
মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে রেণুকা হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে ,মুখে কিছু বলে না । রবীন্দ্রনাথের বুক মুচড়ে ওঠে । মেয়েকে তিনি
কি করে সান্ত্বনা দেবেন? তাঁরও চোখ ভিজে আসে । সন্তান যেন নিজের আত্মারই একটা টুকরো । মানুষ নিজে অনেক কষ্ট
সহ্য করতে পারে ,কিন্তু সন্তানের কষ্ট দেখলে বুক একেবারে আথালি পাথালি করে । সবচেয়ে অসহায় লাগে যখন সেই
কষ্ট দূর করার কোন উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না ।
শিলাইদহ থেকে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলো কাজের দায়িত্ব নিয়ে এলেন । একদিন রথীর চিঠি পেলেন ।
পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল । মৃণালিনী হঠাৎ অস্স্থু হয়ে পড়েছে । একেবারে শয্যাশায়ী । ঠিক কি
রোগ হয়েছে রথী তা লেখেনি । তবে গুরুতর কিছু না হলে সে নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথকে জানাত না । মৃণালিনীই বারণ
করতো । চিঠিটা হাতে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ স্থি হয়ে বসে রইলেন । মৃণালিনী এতদিন পর শুধু স্ত্রী বা গৃহিণী নয়
,সহধর্মিনী হয়ে উঠেছিলেন । শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের ব্যাপারে তার কাছ থেকে অনেক সাহায্য পাওয়া যেত ।
পরদিনই শান্তিনিকেতন থেকে একজন লোক এল,তার কাছে মৃণালিনীর রোগের বিবরণ পাওয়া গেল । বোলপুরের এক
মুন্সেফ বাবু মৃণালিনী রথী-শমীদের একদিন নিমন্ত্রণ কিেছলেন । সেদিন প্রবল বর্ষা ,তারই মধ্যে যেতে গিয়ে সেই মুন্সেফ
বাবুর বাড়ির সামনে মৃণালিনী জোর আছাড় কেয়েছেন । তারপর থেকে তাঁর পেটে অসহ্য ব্যথা । উঠতে পারছেন না,
কোনও খাদ্যেও রুচি নেই । মৃণালিনী তখন কয়েক মাসের অন্তঃসত্তা ।
কলকাতায় অনেকগুলো কাজ না করলেই নয় ,রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তখনই শান্তিনিকেতনে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না ।
তিনি স্ত্রীর জন্য ওষুধপত্র পাঠিয়ে দিলেন । মনটাকে সম্পূর্ণ চিন্তামুক্ত করতে চাইলেন ।
মৃণালিনীর শরীর সুস্থ হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না । শান্তিনিকেতনে তাঁর সেবা করবে কে ? মৃনালিনীর
সম্পর্কে এক বিধবা পিসি রাজলক্ষèীকে নিয়ে আসা হলো । তিনি সংসারটা সামলাচ্ছেন,ছেলে-মেয়েদের দেখাশুনোর ভার
নিয়েছেন ।সঠিক চিকিৎসার জন্য মৃণালিনীকে কলকাতায় নিয়ে আসা দরকার । রবীন্দ্রনাথ নিজেও শান্তিনিকেতনে যেতে

পারছেন না । তাঁর সমস্ত কবিতাগুলো ‘কাব্যগ্রন্থ ’ নামে খন্ডে খন্ডে প্রকাশ করার উদ্যোগ চলছে । সম্পাদনার ভার যদিও
নিয়েছেন মোহিতচন্দ্র সেন,তবু রবীন্দ্রনাথ কবিতাগুলো পরপর সাজানোর ব্যাপারটা নিজে দেখে নিতে চান,মুখবন্ধ হিসেবে
কিছু কিছু নতুন কবিতাও লিখে দিতে হচ্ছে ।
মৃণালিনীর এক ভাই নগেন আছে শান্তিনিকেতনে । রবীন্দ্রনাথ শ্যালককে চিঠি লিখে দিলেন মৃণালিনীকে নিয়ে আসার
জন্য । রথীও সঙ্গে আসবে । কলকাতায় মৃণালিনীর চিকিৎসা হবে ।
মৃণালিনীর শরীর খুবই দুর্বল । শান্তিনিকেতন ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তাঁর । এ পর্যন্ত কোথাও ঠিক গুছিয়ে সংসার
করতে পারেন নি । জোড়াসাঁকোয় অত আতড়বীয় পরিজনের মধ্যে তার থাকতে ইচ্ছে হয় না । শিলাইদহ বেশ পছন্দ
হয়েছিল ,সেখান থেকে পুরো পরিবারটিকে রবীন্দ্রনাথ আবার নিয়ে এসেছেন শান্তিনিকেতনে । এখানে তিনি আস্তে আস্তে
নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন । এখনকার সংসারে তিনিই ছিলেন পুরোপুরি কর্ত্রী ।
বাধা দেওয়ার মতন মনের জোরও আর অবশিষ্ট নেই মৃণালিনীর । ধরাধরি করে তাঁকে ট্রেনের কামড়ায় এনে শুইয়ে
দেয়া হয়েছে,মাথার কাছে বসে আছে রথী । চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখছিল ,গাছ-গাছালিতে ঘেরা ছায়া সুনিবিড়
শান্তির নীড় ছোট ছোঠ গ্রাম ,ফসল ভরা মাঠ ,পুকুরে ছেলে-মেয়েরা সাঁতার কাটছে ও গোসল করছে ,ছাগল,মহিষ মাঠে
চড়ছে, রাখাল ছেলে বাঁশি হাতে বাঁশঝাড়ের ছায়ায় বসে আছে । কোন কোন পুকুরে হাঁস উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ।
ছেলেমানুষি উৎসাহে রথী বললো,মা মা দেখ,কত শাপলা !
কোনও মতে হাতে ভর দিয়ে উঠলেন মৃণালিনী ,তাঁর দুই চক্ষু জলে ভরে গেল । তাঁর অনবরত মনে হচ্ছে ,এই সব
দৃশ্য তিনি আর কখনও দেখবেন না । মৃত্যু তাঁকে গ্রাস করবে ।
জোড়াসাঁকোয় যখন পৌঁছলেন মৃণালিনী,তখন রবীন্দ্রনাথ বাড়িতে নেই । তাঁকে প্রকাশকের কাছে যেতে হয়েছে ।
ফিরলেন সন্ধ্যে বেলা,ঘর্মাক্ত কলেবরেই সোজা চলে এলন স্ত্রীর শয্যা পাশে । মৃণালিনীর রক্তহীন পান্ডুর মুখখানি দেখে
তিনি নিদারুণ বিমর্ষ বোধ করলেন । অবস্থা যে এতেখানি খারাপ হয়েছে,তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি । রবীন্দ্রনাথ
একটা হাতপাখা নিয়ে স্ত্রীকে বাতাস করতে বললেন,কলকাতায় গরম পড়েছে সাঙ্ঘাতিক । শান্তিনিকেতনে কি এর চেয়ে
বেশি ছিল? মৃণালিনী বলেন,শান্তিনিকেতনে কষ্ট হয় না । সন্ধে বেলা কী হাওয়া বয় । ক্লিষ্টভাবে হেসে বললেন,ভাল হয়ে
যাব । তুমি চিন্তা করোনা । ঘামে তোমার পিঠ ভিজে গেছে । যাও,জামা কাপড় ছেড়ে এসো ! রবীন্দ্রনাথ উঠলেন না
মৃণালিনী বললেন,মুঙ্গেরে শরৎকে চিঠি লিখে দাও,ওরা চলে আসুক । কতদিন ওদের দেখিনা । শিগগিরই তো পূজার ছুটি
পড়ে যাবে ।
নাটোরের রাজা জগদীন্দ্র যাচ্ছেন শান্তিনিকেতনে । এ সময় রবীন্দ্রনাথের না গেলে চলে না । মৃণালিনী স্বামীকে চক্ষু
ছাড়া করতে চান না । রবীন্দ্রনাথ বুঝালেন মৃণালিনীকে । নাটোরের রাজা পারিবারিক বন্ধুই শুধু নন ,এই ধরণের ধনী
ব্যক্তিদের শান্তিনিকেতনের কর্মকান্ড দেখাতে পারলে অনেক রকম সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা আছে । মৃণালিনী আর আপত্তি
করলেন না ।
শমীকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ । নাটোরের রাজা শান্তিনিকেতনে সফর শেষে বিদায় নেওয়ার
পরেও রবীন্দ্রনা্েযথর ফেরা হলো না । অনেক কাজ তাঁর হাতে । তবে ভেবে তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন এই যে মুঙ্গের থেকে
মাধুরী এসে গেছে । সে যেমন বুদ্ধিমতী ,তেমনিই কাজের মেয়ে । সে থাকতে মৃণালিনীর সেবাযতেড়বর কোন ত্র“টি হবে না

বাইরের পৃথিবী ও সংসারের মধ্যে একটা দোটানায় পড়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ । বাড়িতে তাঁর দুজন রোগিণী । রথী
সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ ,তার সর্বক্ষণ বাড়িতে বসে থাকতে ভাল লাগে না । সে এখন একা একা বেড়াতে পারে ,সারা
কলকাতা ঘুরে বেড়ায় । শমীকে সারা বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায় না । মাঝে মাঝে গালে হাত দিয়ে কি যেন ভাবে । এই
বয়সের এমন ভাবুক ও পড়–য়া বালক খুব কম দেখা যায় । মীরা খুবই ছোট । সে মৃণালিনীর ঘরে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে
,মৃণালিনী তাকে আদর করতে পারেন না । রেণুকার ঘরে গেলেও তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়া হয় । মীরার দিকে
মনোযোগ দেয়ার কারুর সময় নেই । কিন্তু সে কারুর সঙ্গ চায় । রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে করে স্ত্রীর পাশে বসে থাকতে
,রেণুকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে । কিন্তু বাইরে এমন কিছু কিছু আহ্বান আসে ,যা প্রত্যাখ্যান করা যায় না ।

মাধুরী স্বামীর সঙ্গে ফিরে গেছে মুঙ্গেরে । শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীর চিকিৎসার খবরা খবর নিচ্ছেন ।
মৃণালিনীর পেটের ব্যথা কিছুতেই কমছে না । এই ব্যথার জন্য তাঁর ঘুমও আসে না । তাতে শরীর আরো বিশীর্ণ , মলিন
হয়ে যাচ্ছে । অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় কোন কাজ হচ্ছে না দেখে রবীন্দ্রনাথ হোমিওপ্যাথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন ।
শেষ পর্যন্ত মৃণালিনীর সেবার জন্য তিনি একজন নার্স ও দাইকে নিযুক্ত করার পরামর্শ দিলেন ।
অনেক কাজ ফেলে চলে এলেন রবীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকোয় । এক বিকেলে তিনি মৃণালিনীর ঘরে ঢুকলেন । শরীরটা
একবারে শুকিয়ে গেছে মৃণালিনীর ,কন্ঠার হাড় প্রকট । মুখখানি রক্ত শূন্য ,নির্জীবের মতো চিত হযে শুয়ে আছেন বিছানায়
। রাতের পর রাত তাঁর ঘুম আসে না । পেটের যন্ত্রণার খেতেও ইচ্ছে করে না কিছু । রবীন্দ্রনাথ শিয়রের কাছে এসে
পতড়বীর একটি হাত মুঠোয় ভরে বললেন,চোখ চেয়ে থাকো কেন সর্বক্ষণ ? চোখ বুজে থাকলে ঘুম আসতে পারে । মৃণালিনী
তবু স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে । আস্তে আস্তে তাঁর চোখ জলে ভরে গেল । রবীন্দ্রনাথ হাত দিয়ে মুছে
দিলেন সেই অশ্র“ ।
রবীন্দ্রনাথ বাইরে বেরুবার সময় মৃণালিনীর পাশে বসে কথা বলে যান । ফিরে এসেই আবার স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করেন
। মৃণালিনী একদিন ধীর স্বরে বললেন,তুমি শমীকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দিলে ? আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করলে না
? রবীন্দ্রনাথ বললেন,স্কুল খুলে গেছে,যাওয়ার সময় তোমার ঘরে এসেছিল,তোমাকে ডেকেছিল,তুমি শুনতে পাওনি । তখন
ঘোরের মধ্যে ছিলে ,তাই বেশি ডাকাডাকি করিনি । মৃণালিনী বললেন,শমী কখনও আমাকে ছেড়ে থাকেনি । ও শান্তি-
নিকেতনে কী করে একা একা থাকবে? রবীন্দ্রনাথ বললেন,একা কেন,একা কেন? ওখানে ওর বয়েসী আরো ছাত্র আছে
্,তারা যেমন থাকে,তাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে শমী । মৃণালিনী বললেন,আমার দিন শেষ হয়ে যাবে,শমীর সঙ্গে আর
দেখা হবে না । রবীন্দ্রনাথ বললেন,ও কথা বলছো কেন? তুমি ভাল হয়ে উঠবে । আমরা সবাই মিলে কোন পাহাড়ে
বেড়াতে যাব । তাতে তোমার শরীর সারবে । এখন একটু ঘুমোবার চেষ্টা করে দেখো । মৃণালিনী পাশ ফিরলেন ।
রবীন্দ্রনাথ বেরিয়ে গেলেন । ফিরলেন রাত নটার মধ্যে। মৃণালিনীর ঘরে এস দেখলেন মৃণালিনী আগের মতোই চোখ খুলে
শুয়ে আছেন । একজন নার্স পাশের টুলে বসে হাতপাখায় বাতাস করছে । নার্সকে সরে যাবার ইঙ্গিত করে রবীন্দ্রনাথ
নিজে টুলে বসে হাতপাখাটি তুলে বাতাস করতে করতে বললেন,আজও ঘুম এলো না ?
মৃণালিনী রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে রইলেন। উত্তর দিলেন না । রবীন্দ্রনাথ বললেন,খেয়েছ কিছু ? একটুখানি গরম দুধ
দিতে বলব। মৃণালিনী শুধু চেয়ে রইলেন এক দৃষ্টে। আবার দু চোখ জলে ভরে গেল । রবীন্দ্রন্রা ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস
করলেন,কষ্ট হচ্ছে কিছু? মৃণালিনী কোন কথারই উত্তর দিচ্ছেন না । রবীন্দ্রনাথ বললেন,শমীকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা
করবো। শমী পারে,তুমিই ওকে ছেড়ে থাকতে পারো না । ছেলেমেয়েদের তো বেশিদিন ধরে রাখতে পারি না আমরা
,তারা একটা সময়ে দূরে সরে যাবেই । মৃণালিনী তবু নিঃশব্দ ।
রবীন্দ্রনাথ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ মৃণালিনীর দিকে । তারপর কিছুটা অনুতপ্ত স্বরে
বললেন,জানি,আমার সম্পর্কে তোমার অনেক অনুযোগ আছে । পুরোপুরি স্বামীর দায়িত্ব পালন করতে পারিনি সব
সময়,তোমাদের জন্য সময় দিতে পারিনি। আমার অনেক দোষ আছে । আমি ক্ষমা চাইছি । এবার থেকে দেখো,তুমি
সেরে ওঠো ,আমি আর তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না । মৃণালিনী কিছুতেই সারা শব্দ করছেন না দেখে রবীন্দ্রনাথ
বিচলিত হলেন । তিনি উঠে গিয়ে রথীকে ডেকে আনলেন । রথী এসে ডাকল, মাÑÑ
মৃণালিনী রথীর ডাকেও সাড়া দিলেন না । তাঁর দুই চোখ দিয়ে শুধু বযে যাচ্ছে জলের ধারা । অবিলম্বেই বোঝা গেল
,মৃণালিনীর বাক রোধ হয়েছে ।
ডাক্তারদের ডাকার জন্য ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেল । সারারাত আর সারা দিন রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীর খাটের পাশ ছেড়ে
নড়লেন না,বারবার মনে হলো,বুক ভরা অভিমানের জন্যই কি মৃণালিনীর কথা বলা বন্ধ হয়ে গেল ?
আতড়বীয় স্বজনরা ভিড় করতে লাগলো । মৃণালিনীর অবস্থা দেখে আশঙ্কার ছায়া ঘনিয়ে এসেছে সবার মুখে । ঠাকুর
বাড়ির অনেকেরই হোমিওপ্যাথিতে তেমন বিশ্বাস নেই । অনেকে একজন অ্যালোপ্যাথকে ডাকার জন্য রবীন্দ্রনাথকে
বললেন । রবীন্দ্রনাথ রাজি হলেন না । তাঁর মতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা মধ্য পথে থামিয়ে দেয়া উচিত নয় । ধৈর্য ধরতে
হয় ।
শমীকে আনানো হয়েছে শান্তিনিকেতন থেকে । চার ছেলেমেযেকে এক সময় দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো মৃণালিনীর খাট
ঘিরে । শুধু মাধুরী রয়েছে মুঙ্গুরে । মৃণালিনীর মুখ দিয়ে আর একটি শব্দও বেরুলো না। অপলক চেয়ে রইলেন । আস্তে

আস্তে তাঁর জীবনী শক্তি শেষ হয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল । শয্যাপার্শ্ব ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ। কারুকে কিছু না
বলে উঠে গেলেন ছাদে । কেউ যাতে ডাকতে না আসে সে জন্য দরজা বন্ধ করে দিলেন । চেয়ে রইলেন তারা ভরা
আকাশের দিকে । মেঘশূন্য অমলিন,জ্যোৎøাময় আকাশ,ঝিকমিক করছে অজস্র গ্রহ-নক্ষত্রপুঞ্জ ,সেদিকে তাকিয়ে থাকলে
আর চোখ ফেরানো যায় না ।
মৃণালিনীর মৃত্যু নিয়ে বিশেষ শোক করার অবকাশই পাননি রবীন্দ্রনাথ । তখন রেণুকাকে বাঁচিয়ে রাখাই ছিল প্রধান
কাজ । মৃতদের থেকে জীবিতদের দাবী বেশি । বরাবরই শীর্ণ আর দুর্বল রেণুকা,কিন্তু মনটি সুক্ষè,অনুভূতিপ্রবণ,তার দিকে
তাকালেই মায়ায় বুক টনটন করে ওঠে । যতই অর্থ সংকট থাক ,তবু রেণকার চিকিৎসার জন্য কার্পণ্য করেননি রবীন্দ্রনাথ
। চিকিৎসকরা হাওয়া বদলের পরামর্শ দিয়েছিলেন,তাই রবীন্দ্রনাথ রেণুকাকে নিয়ে আলমোড়ায় চলে গিয়েছিলেন।
জামাতাটি অপদার্থ,তাকে দিয়ে কোন সাহায্যই হয় না ,বরং তার জন্যও অর্থ ব্যয় করতে হয় । হাওয়া বদল করেও
রেণুকার জ্বর কমেনি,কাশি কমেনি। রেণুকা জোড়াসাঁকোয় ফিরে যেতে চাইলো। তার মন টিকছিলো না ।
গায়ে রোদ লাগলে উপকার হতে পারে শুনে রবীন্দ্রনাথ বাড়ির ছাদে রেণুকার জন্য একটি কাচের ঘর বানিয়ে দিলেন
। এমনই ব্যাধি,যার কোন ওষুধ নেই । শরীরটা একটু একটু করে ক্ষয় হয়ে যায় । কাচের ঘরটিতে রবীন্দ্রনাথ মেয়ের
পাশে বসে থাকতে চান । রেণুকাই তাতে আপত্তি করে, সে বারবার তাড়া দিয়ে বলে,বাবা,তোমার কত কাজ,তুমি
যাও,আমার জন্য সময় নষ্ট করোনা । রেণুকা টের পেয়ে গিয়েছিল ,তার সময় আর বাকি নেই । একদিন সে রবীন্দ্রনাথের
হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে বলেছিল,বাবা,ওঁ পিতা নোহসি বলো । আমার কানে কানে শোনাও । সেই দিনই সে চলে
গেল । রেণুকাকে আর ধরে রাখা যাবে না তা বোঝাই গিয়েছিল ,বরং সে কষ্ট পাচ্ছে দেখে কারুর কারুর মনে হয়েছিল
,তার চলে যাওয়াই ভাল । ক্ষয় রোগ ছোঁয়াচে,অন্য ছেলেমেয়েদের রক্ষা করার জন্য পরিশুদ্ধ করা হল সারা বাড়ি ।
সন্তান বিয়োগের ব্যথা কারুকে বোঝানো যায় না । অনেকেই অবাক হয়েছিল,রেণুকার মৃত্যু রবীন্দ্রনাথ এমন শান্ত
ভাবে মেনে নিলেন কী করে ? বরং এর পরেই সতীশের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ বেশি উতলা হয়ে পড়লেন ।
রবীন্দ্রনাথের সানিড়বধ্য পাবার জন্য সতীশ চন্দ্র রায় স্বল্প বেতনে শিক্ষক হয়ে যোগ দেয় শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ে ।
সতীশের মতন এমন প্রাণবন্ত যুবা ,সর্বক্ষণ রসে মাতোয়ারা,রবীন্দ্রনাথের এত বড় ভক্ত কমই আছে । শিক্ষক হিসেবেও সে
একটি অমূল্য রতড়ব ,ছাত্রদের সাথে তাঁর বন্ধুর মতো সম্পর্ক ,ক্লাসের বাইরেও সে ছাত্রদের কত বই পড়ে শোনায় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠিক এই রকম শিক্ষকই চান । সতীশ রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি রচনা নিয়ে উৎসাহে লাফালাফি করে,নিজেও সে ভাল
কবিতা লেখে,সেই সতীশ কোথা থেকে বসন্ত রোগ বাঁধিয়ে এল। রবীন্দ্রনাথ তখন কলকাতায় । বসন্ত রোগের প্রকোপ যে
কী সাঙ্ঘাতিক হতে পারে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেননি । সতীশের সাথে শেষ দেখাও হলো না ,তিনি পৌঁছবার আগেই
সতীশ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল । রেণুকা চলে গিয়েছিল ভাদ্র মাসে,সতীশ গেল মাঘ মাসে ।
অন্যমনস্কভাবে জানালার বাইরে তাকিয়ে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ । ক‘দিন ধরেই রাত্তির বেলা খাওয়াদাওয়ার পর
তিনি কুঠি বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন বজরায় । বজরার জানালা দিয়ে প্রায়ই কিছু দেখা যায় না । অন্ধকার তেমন গাঢ়
নয়,চৈত্র মাসের রাত্রির আকাশ প্রায় পরিষ্কার,চাঁদও ওঠেনি,কয়েকটি তারা ফুটেছে,অমবস্যা গেছে ক‘দিন আগে । এই
তরল আঁধারে কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না,কিন্তু বোঝা যায় পৃথিবীর অস্তিত্ব । শোনা যায় জলের ছলছল শব্দ । কেন যেন
মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় তাঁর ।
রবীন্দ্রনাথ নিজের মনকে সব সময় দমন করতে চান । বিশেষত যে মন খারাপের কারণ বোঝা যায় না,তাকে প্রশয়
দেয়া ঠিক নয় । অল্পবয়সের সেই ভাবুলতা ,সেই যখন তখন মন খারাপের উপভোগ,সে সব দিন কবে শেষ হয়ে গেছে ।
এখন কত দায়িত্ব,কত ব্যস্ততা,এর মধ্যে মন খারাপ যেন অবাঞ্ছিত বিলাসিতা । মানুষের মন কী? নিজের মন কী নিজের
বশীভূত নয় ?
শিলাইদহে আসার পর থেকেই রবীন্দ্রনাথের মনটা কেমন যেন অসাড় হয়ে আছে । মনে হয়,এই যে এত
কর্মোদ্যোগ,এত দায়িত্ব,এ সবই যেন তুচ্ছ । কী হবে এত কিছুর মধ্যে জড়িয়ে থেকে ? যদিও কেউ জোর করে তাঁর উপর
এসব দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়নি ,সবই তাঁর স্বকৃত,এসব তাঁর ভাল লাগে । তবু এক এক সময় মনে হয় সব ছেড়ে ছুড়ে
দিতে,এই বৈপরিত্ব্যের জন্য দায়ি ওই মন খারাপ । মন খারাপের কারণটা তাঁর কাছে কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে । অল্প বয়সে
কোনও বিশেষ নারীর প্রতি আকুলতায় মন খারাপ হতো । প্রেম নামে একটি বায়বীয় ধারণায় মত্ত হয়ে থাকা যেত
সারাক্ষণ। এখন সে সব কোথায়! ইদানিং তাঁর জীবন নারী বিবর্জিত । সেই জন্যই কি দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে

,একটাও কবিতা লেখা হচ্ছে না । নতুন গানের লাইন গুনগুন করে না মাথার মধ্যে । কবিতা আর গান জীবন থেকে বাদ
হয়ে গেলে তিনি যেন আর আসল মানুষ থাকেন না । একটা নকল মানুষ হয়ে যান ।
মন প্রস্তুত না হলে মিছেই কাগজ কলম নিয়ে বসা । আশ্চর্য ব্যাপার,রবীন্দ্রনাথের হাতে কলম ধরা রইল । মাথা
জুড়ে রইল রাজ্যের চিন্তা । যে মানুষের কলম হাতে এলেই অনর্গল লেখা হয়ে যায় ,একই দিনে পাঁচ ছ’টি কবিতা-গানও
লিখে ফেলেছেন অনেকবার,সেই মানুষটি একটি লাইনও লিখতে পারলেন না । ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গেল,এক সময়
বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন । তারপর অনেকক্ষণ ঘুম এল না তাঁর চোখে ।
রবীন্দ্রনাথ লেখার টেবিলে কাগজ কলম নিয়ে বসে থাকেন চুপচাপ । তিনি বুঝলেন,কবিতা অতি সুক্ষè শিল্প,জোর করে
লেখা যায় না । গদ্য তবু সম্ভব । মনে মনে অনেক কবিতা আনাগোনা করে,আবার হারিয়ে যায় । অনেক দিন কিছু না
লিখেই লেখার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন । হ্যাজাক বাতিটা জ্বলতেই থাকে সারা রাত । মাঝে মাঝে ভাবেন আর
কোনদিনও বোধ হয় কবিতা লিখতে পারবেন না । যদি বাগদেবী বিমুখ হন,তারপরেও কি বেঁচে থাকতে হবে? এটা কি
রকম বাঁচা ? কবি যদি হতেন নিছক কল্পনা বিলাসী কিংবা বাস্তব বিমুখ,সংসারের নানানমুখী স্রোতের মধ্যেও নিজস্ব একটা
দ্বীপ নির্মাণ করে যদি থাকতেন স্বেচ্ছা নির্বাসিত,তা হলে তিনি অনেক সমস্যা এড়িয়ে যেতে পারতেন । কুসুমগন্ধ,চন্দ্রকিরণ
আর দখিনা পবন সেবন করে কবিরা বাঁচতে পারে না । সব কবিবেই অনেক সময় জল কাদার পথ হেঁটে পার হতে হয়
,পারিপার্শ্বিকের লোভ,বঞ্চনা,শোষণ,দারিদ্রের আঁচ শরীরে অনুভব করতে হয় ,সমসাময়িক বাস্তবতার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে
হয় কখনও কখনও । দেশ ও সমাজের সংকটে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে যদি নাও পারেন,তবু তিনি অতন্দ্র
পর্যবেক্ষক । কবিতা বা গদ্য যাই লিখুন,সবই মানুষের কথা ।
রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে পড়েছেন অনেক বেশি । একসঙ্গে অনেকগুলো দায়িত্বের বোঝা তাঁর কাঁধে । জমিদারী দেখাশুনার
সব ভারই এখন তাঁর ওপর,আয় বাড়াবারও চিন্তা করতে হয় ,দেবেন্দ্রনাথ গত হয়েছেন,তাঁর কাছ থেকে জমিদারী
পরিচালনার প্রনালী রবীন্দ্রনাথই বেশি শিখেছেন । অন্য দিকে আছে শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয় । একটি বিদ্যালয়
পরিচালনার দায়িত্ব নেয়াই একজন মানুষের পক্ষে যথেষ্টরও বেশি,উপরন্ত রবীন্দ্রনাথ আরো অনেক কিছুর সাথেই জড়িত ।
তিনি সংসার থেকেও মুক্ত পুরুষ নন ,মাতৃহীন ছেলে-মেয়েগুলিকে সামলাতে হয় তাঁকেই । রথীকে কৃষিবিদ্যা শেখানোর
জন্য পাঠানো হয়েছে আমিরিকায় । তার খবরাখবর রাখতে হয় । মাধুরী স্বামীর ঘর করছে,তার সাথেও যোগাযোগ রক্ষা
করছেন । মীরা বেশ ডাগরটি হয়ে উঠেছে । রবীন্দ্রনাথ মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছেন । শমী থাকে শান্তিনিকেতনে । সে
ছিল মৃণালিনীর সবচেয়ে প্রিয় সন্তান । শমীর ভাবভঙ্গি অবিকল রবীন্দ্রনাথের মতন । অনেকে বলে রবি ঠাকুরের ছেলে শমী
ঠাকুর । এর মধ্যেই সে ভাল গান গায় ,অসাধারণ স্মৃতিশক্তি । রবীন্দ্রনাথ এই কনিষ্ঠ পুত্রটিকে বেশি সঙ্গ দিতে পারেন না
। তাঁকে অনবরত ঘুরে বেড়াতে হয় ,তবু শমীর পড়াশোনার যাতে ক্ষতি না হয় সে চিন্তা সর্বক্ষণ তাঁর মন জুড়ে থাকে ।
রবীন্দ্রনাথের রয়েছে দেশের চিন্তা । আর কোনও লেখক মাতৃভূমির এবং দেশের মানুষের অপমান ও দুর্দশা নিয়ে
এতখানি ভাবিত নন । ইংরেজদের যে কোনও দুষ্কর্ম যেন তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করে । বঙ্গভঙ্গ তিনি কিছুতেই
মেনে নেননি । বাঙালি জাতিকে এইভাবে দু’ভাগ করে দিলে এক সময় বাংলা ভাষার ওপরেও খড়গাঘাত হবে । তাঁর অতি
প্রিয় বাংলা ভাষা ।
এতসব চিন্তা ও দায়িত্ব থাকলে কি কবিতা রচনা করা যায় ?কবি ভাববিলাসী নন আবার নিরন্তর কর্মযোগী হযে
থাকলেও তাঁর শিল্প সত্তা চাপা পড়ে যায় । পলায়নবাদী নন কবি,কিন্তু সৃষ্টির সময়টাতে তাঁকে পলাতক হতেই হয় । সে
সময়ই পাচ্ছেন না রবীন্দ্রনাথ ,তাই কবিতাও লেখা হচ্ছে না তেমন,ইদানীং একটার পর একটা প্রবন্ধ লিখছেন,তাতে
প্রকাশ করছেন ধেশ কাল সমাজ নিয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তা । এসব পড়ে বা ক’জনের চৈতন্য উদয় হবে কে জানে !
মীরার বিয়ের চিন্তাটাই প্রাধান্য পাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের কাছে । মীররা বয়স তের পেরিয়ে গেছে ,পাত্রের অনুসন্ধান
চলছে নানা স্থানে । অনেক পাত্রপক্ষ নিজেরাই প্রস্তাব নিযে আসে । চর্তুুর্দিকে রটে গেছে ,ঠাকুরবাড়ির কোন কন্যাকে বিয়ে
করলে ,রাজকন্যা ও অর্ধেক রাজত্ব পাওয়া যায় । শ্বশুর বাড়ির খরচে বিলাতে গিয়ে ব্যারিষ্টার হবার লোভে অনেক যুবকই
উঁকিঝুঁকি মারে । মীরার বিয়েতে কিছুতেই পণ দেবেন না রবীন্দ্রনাথ ঠিক করে রেখেছেন । বিদেশে পাঠাবার প্রতিশ্র“তির
বিনিময়ে বিয়ে দেবেন না । রেণুকার বিয়ের ব্যপ্যারে তাঁর যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে । সত্যেন্দ্রর অপদার্থতায় রেণুকার মন
ভেঙ্গে গিয়েছিল,শেষ পর্যন্ত রেণুকা বাঁচলই না ।

রবীন্দ্রনাথের বন্ধুরা কিছু কিছু পাত্রের সন্ধান আনছেন । কোনওটি বোম্বাইয়ের,কোনওটি লাহোরে । বিভিনড়ব
রাজ্যের,ভিনড়ব ভাষাভাষীর ছেলেমেয়েদের বিয়ের কিছু কিছু চল হয়েছে । রবীন্দ্রনাথ মেয়েকে খুব দূরে পাঠাতে চান না ।
একদিন বরিশালের বামনদাস গাঙ্গুলির এক ছেলে একটি চিঠি নিয়ে এল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে । সে
এসেছে ব্রাহ্ম সমাজ সম্পর্কীয় কাজে,তাকে দেখেই রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয়ে গেল । সতেরো-আঠারো বছর বয়েসী সদ্য
কৈশোর উর্ত্তীর্ণ যুবক,বেশ দীর্ঘকায গৈারবর্ণ,সুঠাম স্বাস্থ্য ,মুখমন্ডলে বেশ তেজস্বী ভাব আছে । তার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা
বলে আরও মুগ্ধ হলেন রবীন্দ্রনাথ । এ যেন দৈব যোগাযোগ । ছেলেটির নাম নগেন্দ্র । সে ব্রাহ্ম পরিবারের সন্তান,আবার
গঙ্গোপাধ্যায় বংশীয় বলে খাঁটি ব্রাহ্মণ । যাকে বলে সোনায় সোহাগা । রবীন্দ্রনাথ বামনদাসের চিঠির উত্তরে কাজের কথা
লেখার পর নগেন্দ্রর সঙ্গে নিজের কন্যার বিয়ের প্রস্তাব জানালেন,যথাসময়ে উত্তর এল, বামনদাস জানালেন যে একতো
সুবিখ্যাত ঠাকুর পরিবার,তার উপরে প্রখ্যাত কবি ও ব্রাহ্ম সমাজের নেতা রবীন্দ্রনাথের কন্যার সঙ্গে নিজের পুত্রের বিয়ে
দেওয়াতো অতি ভাগ্যের কথা । । কিন্তু নগেন্দ্র এখন বিবাহে ইচ্ছুক নয় ,সে ব্রাহ্ম সমাজের কাজ করতে চায় ও উচ্চ শিক্ষা
গ্রহণ করতে আগ্রহী । রবীন্দ্রনাথ আবার লিখলেন,ব্রাহ্ম সমাজের প্রচার কার্য ও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ ,দুািটই বিশেষ সমর্থন
যোগ্য ,তবে এর সঙ্গে বিবাহ করতে বাধা কী ? বামনদাসের কাছ তেকে এবার উত্তর এল যে তিন বুঝিয়ে সুঝিয়ে পুত্রকে
রাজি করিয়েছেন । কিন্তু নগেন্দ্র উচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকা যাবে বলে মনস্থির করেছে । জাহাজ ভাড়া ও সেখানে পড়াশোনা
ব্যয় জুগিয়ে যাওয়ার সামর্থ তার পিতার নেই । সুতরাং রবীন্দ্রনাথ যদি জামাতাকে পুত্রবৎ মনে করে আমেরিকায় পাঠাবার
ব্যবস্থা করে দিতে পারেন ,তবেই এ বিবাহ সম্ভব হতে পারে । ঘুরে ফিরে সেই একই প্র্স্তাব ।
রবীন্দ্রনাথ নিজের জেদ আঁকড়ে থাকতে পারলেন না । পাত্রটি তাঁর এমনই মন মতো যে তিনি ওকে হাতছাড়া করতে
চান না । তিনি আবার ভুল করলেন,বিয়েতে রাজি হয়ে গেলেন ।
ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের দুর্বলতা আছে । কিন্তু পদবীতে ব্রাহ্মণ হলেও নগেন্দ্র ব্রাহ্মণত্ব কিছুই মানে না ।
প্রম দর্শনে রবীন্দ্রনাথ তাকে মনে করেছিল তেজস্বী ,আসলে সে স্বভাবে উদ্ধত ও গোঁয়ার । বিয়ের রাতেই তার আচরণে
সে প্রমাণ পাওয়া গেল।
শান্তিনিকেতনে বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছে । এর আগে শান্তিনিকেতনে বড় রকমের কোন পারিবারিক উৎসব হয়নি
,রবীন্দ্রনাথ আতড়বীয় বন্ধু-বান্ধব অনেককে আমন্ত্রণ জানালেন । এই তাঁর শেষ কন্যার বিয়ে ,সেজন্য বেশ বড় রকমের
অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হলো ,পাত্রপক্ষ সদলবলে একদিন আগেই উপস্থিত ।
বিয়ের দিন সকাল থেকেই শোনা গেল,নগেন্দ্র নাকি বলেছে,মেয়েদের পায়ে আলতা দেওয়া ও মাথায় সিঁদুর পরা সে
পছন্দ করে না । যাকে তাকে সে ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করতেও পারবে না । হিন্দুরা যে কোলাকুলি করে,তাও তার
অপছন্দ । ব্রাহ্মদের ওসব মানতে নেই । কথাগুলি রবীন্দ্রনাথের কানে গেল,তিনি মৃদু হাসলেন । সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের
অল্প বয়েসী ছেলেরা কিছুটা বাড়াবাড়ি করে,তিনি জানেন । নগেন্দ্রকে পরে বুঝিয়ে বললেই হবে । তিনি নিজেও সিঁদুর
আলতা পরা বা কোলাকুলিকে সমর্থন করেন না ,আবার পরিত্যাজ্যও মনে করেন না। এগলো কোন ধর্মের অঙ্গ নয়
,লোকাচার ,স্থানীয় সংস্কৃতি । এক একটি অঞ্চলে এরকম কিছু কিছু সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থাকে,তার বিরুদ্ধাচারণ করাও
হাস্যকর গোঁড়ামি । যা অনেক মানুষে চায় ,যা একটি সামাজিক প্রা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে,তা শুধু শুধু অবজ্ঞা করতে
চাওয়া হবে কেন? কোন মেয়ে যদি পায়ে আলতা পরে কিংবা কপালে একটা লাল টিপ পরে আনন্দ পায় তো পাক না ,এর
সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই । নগেনদ্র এই বযসেই গোঁড়া ব্রাহ্ম ।
নগেন্দ্র গায়ে হলুদে আপত্তি জানালো । তাতে কেউ বিশেষ আমল দিল না ,খানিকটা হলুদবাটা বরের অঙ্গে ছুঁইয়ে
কনের কাছে পাঠিয়ে দিতে হয় ,তা এমনি পাঠিয়ে দেওয়া হলো । তবে গোলমাল বাধল বিবাহ বাসরে । নগেন্দ্র কিছুতেই
পৈতে পরতে রাজি হলো না । পুরোহিত মশাই জোর করে নগেন্দের কন্ঠে নয় পাক দেওয়া পৈতেটি পরিয়ে দিতেই সে
উঠে দাঁড়াল ,পৈতেটি ছিঁড়ে নিক্ষেপ করল দূরে । কর্কশ কন্ঠে বলল, এই সব জঞ্জাল ছাড়া বিয়ে হয় কিনা বলুন ! নইলে ...
কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন একটু দূরে । যেন একটা নিথর মূর্তি,নিঃশ্বাসও পড়ছে না । অনেক
কষ্টে μোধ সংবরণ করলেন । সতরো আঠরো বছরের এই অশিষ যুবকটিকে জোর ধমক দেয়া উচিত ছিল । কিন্তু কেউ
তা করল না । নগেন্দ্রর বাড়ির লোকজন যেন মজা দেখছে । হিন্দু সমাজে একটা অদ্ভুত রীতি চালু আছে ,আিদ ব্রাহ্ম
সমাজও তার থেকে মুক্ত নয় । বিবাহ বাসরে বর পক্ষ যেমন খুশি অভদ্র ,অন্যায় আচরণ করতে পারে,কিন্তু তার প্রতিবাদ
করতে পারে না কন্যা পক্ষ । বিবাহ বাসরে পণের টাকা পুরোপুরি পাওয়া যায়নি কিংবা প্রতিশ্র“ত স্বর্ণারঙ্কার সব দেওয়া
হয়নি,এই অজুহাত দেখিয়ে বিবাহ সম্পূর্ণ না করেই পাত্রকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায় বরপক্ষ,কন্যাপক্ষ তখন অসহায় ,কারন
পূর্ব নির্দিষ্ট দিনে,নির্দিষ্ট লগেড়ব যদি কন্যার বিবাহ না হয় তা হলে সে লগড়বভ্রষ্টা হয়ে যায় । সে অতি কলঙ্কের কথা । সে

কন্যার আর বিবাহ হয় না । সেই জন্য কন্যাপক্ষ সেই সব লোভী,কুৎসিত ব্যবহারকারী পাত্রপক্ষের কাছে হাত জোড় করে
কাকুতি-মিনতি করে ,পা ধরতেও বাকি রাখে না ।
নগেন্দ্র কাব্য-সাহিত্য পাঠের ধার ধারে না । তার ভাবী শ্বশুর যে একজন কবি এবং সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ,তা সে
গ্রাহ্য করল না । যেন এ পরিবারের একটি মেয়েকে বিয়ে করে সে ধন্য করে দিচ্ছে । তার আচরণ দেখে বোঝা যায় ,তার
সহবত জ্ঞান নেই । রুচি নিুস্তরের ,এ যুবক ঠাকুর বাড়ির যোগ্য জামাতা হতে পারে না । মীরা যে সংস্কৃতির পরিমন্ডলে
বর্ধিত হয়েছে ,তাতে সে শ্বশুর পরিবারে গিয়ে স্বস্তি বোধ করতে পারবে না ।
রবীন্দ্রনাথের মন দ্বিধান্বিত । এ বিবাহ সম্পনড়ব না হলে যদি মীরাকে অনূঢ়া অবস্থায় কাটাতে হয সারা জীবন?
তখনতো আতড়বীয-বন্ধুরা রবীন্দ্রনাথকেই দুষবে । অনুপুযুক্ত স্বামীর সঙেগ সহবাস,না সারা জীবন কুমারী থাকা ,কোনটা
বেশি কাম্য ? পুরেহিত মশাই অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছেন,রবীন্দ্রনাথের দিকে । রবীন্দ্রনাথ বললেন,পৈতা ছাড়াই মন্ত্রপাঠ
হোক!
রবীন্দ্রনাথ বাকি সময় রইলেন না বিবাহ বাসরে । তাঁর বাড়ির পেছন দিকে নির্জন স্থানে পায়চারি করতে লাগলেন ।
জৈষ্ঠ মাসের আকাশ একেবারে পরিষ্কার,মেঘের চিহ্ন নেই ,অসংখ্য তারা দেখা যায়, যখন মনের মধ্যে সংকট থাকে ,তখন
রবীন্দ্রনাথ আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্তি পান । কী বিপুল,কী অনন্ত এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সেদিকে মাথাটা উঁচু করলেই মনে
হয়,এর মধ্যে মানুষের সুখ-দুঃখ কত তুচ্ছ !
রবীন্দ্রনাথ একটা আর্তচিৎকার শুনতে পেলেন । কোনও নারী কন্ঠের প্রানান্তকর আর্তনাদ । খুব কাছেই, রবীন্দ্রনাথের
বুক কেঁপে উঠল । মীরার কন্ঠ বুঝতে পারলেন। ঝোঁকের মাথায় মীরা একটা সাঙ্ঘাতিক কিছু করে বসল নাকি ! ঘোমটায়
মুখ ঢেকে সে বসেছিল ,তবু বাবার অপমানের ব্যাপারটা টের পেয়েছে । সে কী আতড়বঘাতিনী হলো ?
রবীন্দ্রনাথ দৌড়ে ঢুকে গেলেন বাড়ির মধ্যে । আওয়াজ এসেছে øানের ঘর থেকে । আরও কয়েকজন এরই মধ্যে
জড়ো হয়েছে সেখানে । প্রমে রবীন্দ্রনাথ কিছুই বুঝতে পারলেন না । øান ঘরের দরজা খোলা ,ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে
মীরা,অঙ্গে নববধূর বেশ,ডায়নামো দিয়ে বিজলি বাতি জ্বালানো হয়েছে তাই ভেতরটা বেশ আলোকিত । মীরা গলায় দড়িও
দেয়নি,গায়ে আগুনও লাগায়নি । তার চক্ষু বিস্ফারিত ,সে থরথর করে কাঁপছে ।
রবীন্দ্রনাথ একটা সাপ দেখতে পেলেন। ফনা মেলে দুলছে সেই সাপ ।এত বড় গোখরো সচারচর দেখা যায় না ।
রবীন্দ্রনাথের মনে হলো মীরাকে বাঁচানো যাবে না । সাপটাকে মারতে গেলেই সেটা øান ঘরে ঢুকে পড়বে । মীরা বেরিয়ে
আসতে পারবে না । গোখরো সাপ বদমেজাজি হয় । মীরাকে সামনে পেয়ে দংশন করবে । উপস্থিত সবাই হতবুদ্ধি হযে
আছে ।
কয়েকজন লাঠিসোটা নিয়ে এসেছে । অগ্রসর হতে সাহস পাচ্ছে না । রবীন্দ্রনাথ একজনের হাত থেকে লাঠি নিয়ে
নিলেন । তাঁকে যদি কামড়ায় তো কামড়াক ,তবু মেয়েকে বাঁচাতে হবে । কোনও দিন কোন প্রাণীকে আঘাত করেননি
রবীন্দ্রনাথ । আজ তিনি দৃঢ় মনস্ক । লাঠিটা উঁচিয়ে এক এক পা করে এগুতে লাগলেন রবীন্দ্রনাথ । সাপটির পরমায়ু
আরো কিছুদিন বাকি ছিল । অকস্মাৎ ফনাটা নিচু করে নিল,তারপর প্রায় বিদ্যুত গতিতে চৌকাঠের এক পাশের গর্তে ঢুকে
পড়ল । সবাই হই হই করে উঠল ।
মীরা ছ ুটে এসে রবীন্দ্রনাথের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল । দু’হাতে মীরাকে বুকে টেনে নিলেন রবীন্দ্রনাথ । অমঙ্গলের
আশঙ্কায় তাঁর হৃদয়ে মোচড় লাগলো । আর কোন ছেলেমেয়ের বিয়েতে এরকম সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটেনি । তিনি কন্যাকে
সব অমঙ্গল তেকে বাঁচাতে চান । মনটা ভারি হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের ।
বিবাহ পরবর্তী পরিকল্পনা নগেন্দ্র আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে । নবোঢ়া পতড়বীকে নিয়ে মধুযামিনী উপভোগ
করার বাসনা তার নেই । অবিলম্বে সে আমেরিকা যাবার ব্যবস্থা করতে চায় । তার আগে সে স্ত্রীকে নিয়ে বরিশাল যাবে ।
মীরাকে সেখানেই রেখে আসবে কিছুদিনের জন্য ।
বিবাহের পর পিত্রালয় ছেড়ে যাবার সময় সব মেয়েই কানড়বাকাটি করে । কিন্তু মীরার কানড়বা থামতেই চায় না ।
বাবাকে ছেড়ে সে আগে কোথাও যায়নি ,মায়ের মৃত্যুর পর সে-ই সাধ্য মতন বাবার সেবা করেছে , এখন বাবা একলা
থাকবেন কী করে ? রবীন্দ্রনাথ কত করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন ,কিন্তু মীরা একেবারে অবূঝ । দেবেন্দ্রনাথের আমলে
ঠাকুর বাড়ির মেয়েরা বিয়ের পরেও বাপের বাড়িতেই থাকত ,স্বামীরা ঘর জামাই হত । কিন্তু সে সময় বদলে

গেছে,গোষ্ঠীপতি দেবেন্দ্রন্দ্রনাথ বেঁচে নেই,ঠাকুরবাড়ির আগেকার জাঁকজমও নেই,রবীন্দ্রনাথের ভাইয়েরা যে-যার নিজস্ব
অংশে থাকে,পারস্পরিক সম্পর্ক μমশ আলগা হয়ে আসছে । মীরাকে শ্বশুর বাড়ি যেতেই হলো । মীরার দিদি মাধুরীও
গিয়েছে । মীরার পীড়াপীড়িতে রবীন্দ্রনাথও মীরার সঙ্গে বরিশাল গেলেন । নগেন্দ্রের পরিবারটির ধরন-ধারণ রবীন্দ্রনাথের
মনঃপুত হলো না । কথাবার্তার সুর কেমন জানি রুক্ষ । নগেন্দ্রের ভাই গুলি আর বেশি কট্টর ,হিন্দু সংস্কৃতির অনেক কিছু
নিয়েই তারা ঠাট্টা তামাশা করে । ব্রাহ্মদের এই বাড়াবাড়ি রবীন্দ্রনাথের পছন্দ নয় । তিনিও নিরাকার ব্রহ্মে বিশ্বাসী ,তা
বলে কি তিনি রাধা –কৃষ্ণের প্রেম বিরহ কাহিনী উপভোগ করতে পারবেন না ! এ কাহিনীর মধ্যে যে চিরন্তনতা আছে, তা
কোন বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে আবদ্ধ নয় ।
মীরাকে রবীন্দ্রনাথ কিছুই বুঝতে দেন না । তার শ্বশুর বাড়ির সকলের নামেই খুব প্রশংসা করেন । নগেন্দ্র বিদেশে
গেলে মীরা পড়াশোনা করার অনেক সময় পাবে । তিনি মীরাকে নিয়মিত চিঠি লিখবেন ।
একদিন চট্রগ্রামের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এসে রবীন্দ্রনাথকে ধরলেন । সেখানকার অধিবাসীরা কবিকে একবার
নিজেদের মধ্যে পেতে চায় । তাঁকে সংবর্ধনা জানাবে । রবীন্দ্রনাথ কখনও চট্রগ্রাম যাননি ,তিনি রাজি হয়ে গেলেন ।
বরিশাল থেকেই কলকাতায় ফিরতে তাঁর মন চাইছিল না, মীরা থাকবে না ,জোড়াসাঁকোর বাড়িটা তাঁর কাছে শূন্য মনে হবে।
মীরা বরিশালের মতন অচেনা স্থানে,শ্বশুর বাড়ির প্রায় অপরিচিত লোকজনদের সঙ্গে একা থাকতে রাজি হলো না ।
রবীন্দ্রনাথ চট্রগ্রাম থেকে ফিরে এসে দেখলেন নগেন্দ্রের সঙ্গে মীরাও ফিরে এসেছে । আর কয়েকদিন পরেই নগেন্দ্র
আমেরিকা যাত্রা করবে,মীরা তখন চলে যাবে শান্তিনিকেতনে ।
রবীন্দ্রনাথ আবার প্রবন্ধ রচনা ও বক্তৃতায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । নিজেকে তিনি ব্যস্ত রাখতেই চান,নইলে এক একদিন
যেন বুকের মধ্যে আকাশ জোড়া শূন্যতা ঢুকে পড়ে । মনে হয়,তিনি যা কিছু করে যাচ্ছেন ,সবই যেন অর্থহীন । জীবন
যেন প্রতিদিন শুষ্ক থেকে শুষ্কতর হয়ে উঠছে । সম্পূর্ন নারী বর্জিত জীবন । একটুও মধুর রসের ছোঁয়া নেই । কোন পুরুষ
বন্ধুর সঙ্গে তিনি পুরোপুরি মন খুলে দিতে পারেন না । শুধু কোনও কোনও নারীর কাছেই তিনি সহজ হতে পারেন । এটা
তাঁর স্বভাব । বিবির বিয়ে হবার পর যোগাযোগ অনেক ক্ষীণ হয়ে গেছে। আর কোনও নারীকে তিনি চিঠি লিখেন না ।
সেই জন্যই কি কবিতা লেখাও কমে আসছে ? নারীর সৌন্দর্য,নারীর হৃদয় রহস্য পুরুষকে সৃষ্টির প্রেরণা দেয় । স্ত্রী নয়
,সংসারসঙ্গিনী নয় কোনও নারী কি শুধু বন্ধু হতে পারে না । তেমন নারীই বা কোথায় ?
কিছুদিন ধরেই শরীর বেশ খারাপ রবীন্দ্রনাথের । মন খারাপের সাথে শরীর খারাপের সম্পর্ক আছে । প্রায়
প্রতিদিনই জ্বর হচ্ছে তাঁর । একটা গুরুতর রোগের আশঙ্কা জমছে আস্তে আস্তে মনে । একজন স্পেশালিস্ট দেখানো
দরকার,কিন্তু সময় পাচ্ছেন না তিনি । জ্বরের জন্য শরীর দুর্বল লাগে ,তা কারুকে জানানো হয়নি । পুরুষ মানুষে অসুখের
কথা মা এবং স্ত্রীর কাছে লুকোনো যায় না । রবীন্দ্রনাথের এই দু’জনের কেই নেই ।
মৃণালিনী যখন শয্যাশায়ী ছিল তখন রবীন্দ্রনাথ রাত জেগে নিজের হাতে সেবা করেছেন । যার ফলে ক্লান্তিতে ও
শ্রান্তিতে শরীর মন ভেঙ্গে পড়েছে । দু’একজন বন্ধু মাঝে মাঝে ইঙ্গিত দেয়,বিপতড়বীক রবীন্দ্রনাথের আবার বিবাহ করা
উচিত । তাঁর বয়েস মাত্র ছেচলি−শ,এই বয়সে অনেক পুরুষই বিয়ে করে । এতে দোষের কিছু নেই । সাংসারিক দায়দায়িত্ব
থেকেও তিনি অনেকখানি মুক্ত । রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী মারা যাবার পর আবার বিবাহের কথা কখনও চিন্তা করেন নি । তিনি
পাঁচটি সন্তানের পিতা ,তাদের মধ্যে জীবিত রয়েছে চারজন । সম্পূর্ণ এক অচেনা নারীকে তারা মা বলে ডাকবে ? এটা
তিনি কখনও ভাবতে পারেন না ।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন রবীন্দ্রনাথ । তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু এই ধরণী তাঁর দিকেই
চেয়ে রয়েছে ।

...........
সহায়ক বই-
অন্য চোখে রবীন্দ্রনাথ ও বিবিধ প্রসঙ্গ -- পীযুষ দাশগুপ্ত
শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ ---- শচীন্দ্রনাথ অধিকারী
প্রম আলো ÑÑ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
২৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন