মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

মোহাম্মদ রফিকের কপিলা থেকে
















কানে ফুল নাকের নোলক তারও
বহু আগে
পঞ্চাশের মন্বন্তর, ডোম্বি বাড়ন্ত আহার

তবু
বাবুদের আনাগোনা
এমন শরীল একহারা
নরম কাদায় চ্যাং

বন্ধকী দিছিস বাজু
এই বাজী
বিয়ের রাতের থনে
জউনার উচাটন সোতে

নাও দিয়ে পারাপার
পারানির কড়ি
চোলাইয়ের
স্বাদে

কার্পাসের ডালে ডালে ফাট্যা পড়ে ফুলের আগুনি
হরিণী কতোটা জানে কতোটা সে সত্যিই হরিণী

নগর বাহিরে
দূরে
ভোর-ভোর পৌষের পার্বণে অন্য
ঢেঁকিতে ধানের গন্ধ
অন্যের দাওয়ায়
হাত পেতে
দু’একটা তেলেভাজা পিঠের আস্বাদ
ঝোলা গুড়

কানে ফুল নাকের নোলক তারও
বহু আগে
বুড়ি মা জমির ভাগ চলে গেছে মহাজনী সুদে

বড়ো হবি
তোরও একদিন রাগ করেচে রাগুনি
এক্ষুনি রে আসবে বর
দূর গাঁয়ে

ফিরবি নাইয়োরে
গ্রামপথে দু’একটা কোঠাবাড়ি হাল
আমলের জমিদারী

কাছারি ঊঠোন
ভ’রে
বাও দিচ্ছে ধানের মাড়াই
ওড়ে তুষ

তুষের কুহেলি

বৈঠকখানায় হাঁটু গেড়ে লোক
তামুকের ধোঁয়া

বাপমা’র ছনঘর
ঠিক
ঠিকই আছে পোড়ো-পোড়ো
স্বামীর সোহাগ বাহু
গলায় গুঞ্জের মালা

ব্যবহৃত আদর শরীলে এক
ওঠা-নামা হঠাৎ বকুনি
মুখ ঝাড়া দু’একটা

ওরে ডম্বি
চড় বা থাপ্পর
এই
বাদশাহ না হ’লেও বাদশাহী রীতি

কানে ফুল নাকের নোলক তারও
বহু আগে
পাল্টেছে শাসন রাজা অমাত্য রাজন তবু

কিছুই পাল্টেনি

খাল পাড়ে
বড়োজোর দু’একটা চালকল

ইতস্তত কিছু কাক

জউনার খরস্রোত জউনায় আজও উচাটন





অ্য মাগী তুই ফ্যাচরফ্যাচর দাঁত ক্যল্যায়া অত্তো হিহি
এ্যত্তো বড়ো অসুখ লইয়া কোন মুহে তর হাসন আয় যে
ক্ষয়ের রোগী হাসির লগে দাঁতের গোড়ায় অ ছ্যামড়ী তর
পুঁজের মতোন আজ মরিবি না হলি তো কাল মরিবি

অ মাসী তুই ঐ যে দ্যাখ না
দোরের গোড়োয় বেলির কুঁড়ি
মুখটি টিপে ক্যামনে হাসে
অরে একবার ক্যান জিগাও না

সন্ধে হলি পায়ে আলতা ঠোঁটেঁ আলতা চোখে কাজল
একবার কাঁদস একবার হাসস বুকের আঁচল খুইল্যা পইড়্যা
একবার উইঠ্যা গুনগুনায়া গাইতে থাহস জানলা খুইল্যা
গাঙ্গের পানে ভোলা নায়ের সুজন মাঝি ফ্যালফ্যালাইয়া

অ মাসী তুই এট্টু দ্যাখ না
গাঙ্গের জোয়ার ক্যামনে ক’রে
নিজের বুকে মোচড়ানি দেয়
অরে একবার ক্যান জিগাও না

দু’দিন পরে গতর খাগী মইরা যহন পইড়া রবি
ধনচাবনে কুকুর আইসা টান্যা লইবো শিয়াল খাবো
বাবুরা সব ভুইলা গিয়া অন্য মাগীর ঘর টোয়াইবো
ভুল কইর‌্যা কেউ তোর কথাডা খালি ঘরডা খোঁজ নিবো না

অ মাসী তুই পায়ের মলডা
হাতের বাজু কানের লকেট
খুইল্যা নিবি তারপরে না
পা ছড়াইয়া কাঁদতে বইবি

অ মাসী হোন ঐ টুহুতেই আমি খুশী বেজায় খুশী
ও পারেতে কালোরঙ্গা বৃষ্টি পড়ে এ পারেতে
লঙ্কা গাছটি রাঙ্গা টুকটুক গুণবতী ভাইরে আমার
আমের পাতা জামের পাতা ছুটছে এবার পাগলা ঘোড়া

অ মাসী তুই বল না দেহি
পাগলা ঘোড়া দেখতে ক্যামন
ছুইট্যা চলে পাঁজর ভাইঙ্গা
ক্যামনে তারে সামলে রাহি

অ মাসী তুই পোড়ামুখী জবাব না দি কানতে বইলি







প্রতিটি হাঁটার ঢঙএ
হাতের মুদ্রায়…মৃত্যু
সারামাস রোজা রেখে ঈদের সকালে গোস্ত
অনাহারী পেটে খাদ্য…মৃত্যু/বমি/ওলাওঠা/জ্বর

কব্বরের ভেতর কবর ভাঙ্গা ঝুরঝুরে খসা কব্বরের ভেতর কবর শীত
খ্যাঁক শিয়ালের…বাসা

এক দুই দুই এক
চোয়ালের ভাঁজে…ক্ষুধা
বোক্ষের পাঁজরে…ক্ষুধা
কুয়াশার তাজা ভোরে…ক্ষুধা

এক বুড়ি। জটা বুড়ি। বটের পাতায় জ্যোৎস্না ঝিলিমিলি দীঘিজলে
বাদুরের ডানা…ছায়া

নিদ্রাহীন চোক্ষে ঐ
চোক্ষের আগুনে…ক্ষুধা
নবান্নের
পার্বণে আমন গন্ধে
প্রত্যেক চীৎকারে…মৃত্যু/জরা/ক্ষুধা/ছায়া
উঠোনে উঠোনে ক্ষুধা
ছড়ানো ধানের…ক্ষুধা

বিপ্লবে
বিপ্লবে উত্তোলিত হাত দাঁতে দাঁত কামড়ে উত্তেজিত
প’ড়ে থাকা মাটি…জরা

খালেকের বেতো বৌ জুরুর কপালে
কবিতার কালসিটে স্পষ্ট গাঢ় বিরাট অক্ষরে
ক্ষুধা/মৃত্যু/মৃত্যু/ক্ষুধা

রঙ্গিলা নায়ের মাঝি ভাটির নদীতে যাও বাইয়া…ক্ষুধা
বাওকুংটা বাতাস যেমন মরে ঘুরিয়া ঘুরিয়া…জরা
ফান্দেতে পড়িয়া বগা বন্দী হইলো ধর্লা নদীপাড়ে…মৃত্যু
খানকীমাগী স্বভাব যেমন ধরা পাঁচ টংকা স্বামী…ছায়া

খসম গ্যালো রে কৈ ছাড়ি…জরা/মৃত্যু/মৃত্যু/ছায়া

যদি ভাগ্যি ভালা হয়

খোদার ফজলে য্যান

মরণের বহু আগে কাফনের সাদা থান

রাখা যায় মাচানে গোছায়ে,
ক্ষুধা
মৃত্যু
ভয়
থাক
প্রতিঘরে ঢেঁকিশালে
রান্নাঘরে
থাক
বেঁচে থাক

জরা
খুদকুঁড়ো
ক্ষুধা

ভাগ্যির কপাল, যে যে ভুলুক, তবু তো ওলাবিবি
ভোলেনি কিচ্ছুতে…ঠিক চিনে নিছে…ক্ষুধা







প্রাসাদের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে
অনাড়ষ্ট
রাঙ্গা জলে রক্তের জোয়ার বেয়ে নিজ হাতে
ভাঙা ডিঙি নাও
পৌঁছে যাবে পদ্মার চরের কোনো এক ছন ঘরে
সন্ধ্যায় দু’হাতে মুখ ঢেকে

চোখে জল। অভিষিক্ত হবে সাধারণ ঘরে খেটে খাওয়া
সাধারণ মেয়ে। শস্যের রাণীমাতা
ব’লে উঠবে তারস্বরে; না, ওটা ছিলো ঘুম, ঘুমের
কুহকে ভুল স্বপ্ন
ডাইনী বুড়ির লাশ প্রাসাদের সিঁড়ি গড়িয়ে-গড়িয়ে
কোথায় মিলিয়ে গেছে
ভুল ইতিহাসের বেনো জলে গেছে বেনা ভুবনের বেনা
স্রোতের তাণ্ডবে

বেঁচে আছি, বেঁচে থাকবো, সত্যিকার রাজমাতা

পেরিয়ে রুপোর দেশ মাটির সানকিতে লাল চাল
নোনা ডাল দাঁতে কামড়ে কালো মাটি ভেজাল কাঁকর

রাজহংসী
অংশীদার সম উৎপাদনে








একজন গপ্পো বলে অন্যজন সেই গপ্পো শোনে টুপটাপ
হাসিখুশী

গাইয়ের ওলানে মুখ শস্যের খামার, ওড়ে চুল
চোখে স্বপ্ন, রাখাল বাজায় বাঁশী, ছুটে আসে শুক
সারস ময়ূর বেজী হাটভাঙা মানুষের মুখ
নিশ্চিন্তে অচিন
স্বপ্ন

হাতে সড়কি কাঁধে ধনু বাহুতে কবিতা খাপখোলা
তরবারি, এই স্বাদ
চুঁ’য়ে পেকে ওঠে ধানশীষ। বটবুড়ো
নাড়ে জট

কুঁচের বরণী কন্যা মেঘের বরণী চুলে পায়ে প্যাঁক শাড়ির আঁচলে
ছেঁড়া লজ্জা ঢাকে মুখ

তবু নেই শেষ। নেই-নেই নিরুদ্দেশ
স-বু-জ
সবুজ
দেশ

উড়ে আসে কাক। বেশ! বেশ!
যার কোনো শুরু নেই তার নেই শেষ।

মোছো রক্ত, পৈঠার ওপরে কালসিটে এই
লড়াই চলবেই

কপিলা বই থেকে নির্বাচিত অংশ পুনর্মুদ্রিত হলো। স্কেচ: কাইয়ুম চৌধুরীর করা কবিতার অলঙ্করণ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন