রবিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
অনন্ত সুজনের কবিতা
বৃশ্চিক
....
রেখে দাও- ডানার বিস্তার আর কিছু তন্দ্রা
অভুক্ত করতলে, বিস্তৃতির গানে বিশুদ্ধ হতে পারে
দেখেছি, এ দৃশ্য গোলকদম ঘিরে বর্ষার বাগানে
তা সত্ত্বেও, কেন তবে মলিন বিবেচনা বনপাতাদের
মতো অযত্নে পড়ে থাকে- প্রতিটি শাপগ্রস্ত দিনে
তবুও দেখ, আপদবস্তু জলের ভেতর শব্দহীন মাছ
হয়ে চলে। অগ্রসর হতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছে
অস্ত্র- দূর পর্বতের গাঢ় অন্ধকারে।
বিলুপ্তিকালে যে নিরব বিভূতি, ছিন্ন কররোল
তা মৃতের ত্বকের গোপন থেকে উঠে আসে
দাবাছক ভেবে এবার যত্রতত্র দিতে পারো চাল
বৃশ্চিক বালিকা মাত্রই নম্র কচুপাতা
চিরকাল উগলে দেয় জলের আদর।
চিত্র
...
বিকেলকে আমি বাগান মনে করি
ধরা যাক- হঠাৎ উদিত পথে কারো
পায়ের আওয়াজ চিত্রল রেখা ফেলে
পরিত্যক্ত ধুলোর জ্বালা বাড়িয়ে দেয়
তা থেকে যে আগুন উঠে আসে
তার বিস্তার নিয়ে রচিত হয় বসন্তগান
কেউ কি জানে, এভাবেই এসেছিল ঋতু
এই তথ্য দূর থেকে বিরচিত হলে
হাওয়াকেই নির্ভর জেনে-চিরকাল
উড়েছে হরিৎ প্রজাপতি।
ব্রা
...
স্নানের অভিজ্ঞান নিয়ে
কী ভীষণ তীর্যক ভঙিমায় ফুটে আছে
উদার বারান্দা যে কারণে গর্বিত উদ্যান
শুনেছি তার উদ্দীপক ঘ্রাণ
যুবকপাড়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে মর্মের আফিম
হলো বুঝি দেহচূর্ণ-নিরাকারে যতসব
মনোবিভূতি লুটায়ে পড়েছে
ছায়ানল গভীরে
তাকে উদ্ধার করে ধীমান বাতাস
রাত্রীরহস্য অন্তর্গত গান হয়ে
দোল খায়- যেন প্রগাঢ় ছান্দসিক
সুরের ভেতর কতশত গোপন বিবরণ
এসব গুনতে গুনতে আঙুলের খোদাই
করা দাগগুলো হারিয়ে ফেলেছিল চিত্রকর
সবুজ পাহাড় দেখে যে কী-না
স্নানঘরে যেত।
স্তন
...
প্রতিনিয়ত খুন হয়ে যাই
ভূ-গোল রহস্য ছুঁতে গিয়ে- বারবার
ছুঁয়ে আসি কামনার মিনার
সম্পর্করীতি আকীর্ণ জেনে
ঘোরলাগা সমুদ্র ভ্রমণে
দেখা হলো পুত্র এবং পিতার।
হল্লা
...
আগুনের হল্লা তোলে সহসা আলোবিদ্বেষী
লাল আলোয়ান ছড়িয়ে গড়েছে বিনোদন
যার বেষ্টনরীতি ডানা ঝাপটায় রাত্রিডাঙায়
আনন্দস্কুল থেকে ঘরে ফেরা যুবক ভাবে-
এ বড় নিকট অধ্যায়, বাতাবী ঘ্রাণ
উদিত হতে গিয়ে শূন্য থেকে মহাশূন্যতায়
যার অবাধ নির্মাণ
হয়তো সে আঁধার অন্ধ-বধির
ছন্দজ্ঞানে, কিছুটা বিকিরণে হয়েছে যুদ্ধবাজ
বস্ত্র ভেবে খুলে রাখা শরীরের সমস্ত রোদ
গ্রহণ বন্দনায় আলোড়িত হতে হতে
প্রতিবেশী মেঘের দখলে চলে যায়
মোহাবিষ্ট চক্রের ভেতর তখন আদুরে হাওয়া
মাংসছুরিতে বিদ্ধ হবার তুমুল উল্লাসে
চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে আনন্দ অশ্রু
এই মুদ্রা রহস্যমুগ্ধ
এই মুদ্রা তাই ঈর্ষাবিভোর।
মেয়েটিকে নিয়ে
..........
জানালার ওপাশে কত সে দৃশ্যময়
পাতার আড়ালে যেন ফলের আবেগ
তাকে কেন্দ্র করে যেসব গৃহস্থালি
আকাশ ছুঁতে চাইতো- শুনেছি
একদা তারা ছিল অভিজাত যাযাবর
প্রতিদিন ইট পাথরের সুরক্ষার ভেতর
বিনাবর্ষায় নিঃসঙ্গ ময়ূরের মতো
মেলে দিত হৃৎপিণ্ডের আরাম
যেহেতু অন্তর্স্নান জরুরি ছিল
প্রাণসখায় নমিত ছিল প্রার্থনা
কে জানতো প্রতিটি বাড়ি মূলত
এক-একটি মন্দির?
পূর্বাপর এই সারল্যে আমিও মলিন
ফলত বুঝে গেছি জিরাফের গ্রীবা
কেন এত লম্বা-দিগজয়ী
আমার সকল পথ চলে গেছে
প্রতিবেশী বাড়ির দোতলা জানালায়
যারে একদিন না দেখলে
দু’দিন আয়ু কমে যায়।
দ্বৈরথ
....
শাদা কাশফুলের মতো নরম-কবোষ্ণ শরীর
তাকালে দেখা যায়- হয়তো দূরের নামহীন দ্বীপ
আলোকবর্তিকাহীন কোনো সমুদ্র-নাবিক সুদীর্ঘ
ভ্রমণ অসমাপ্ত রেখে দ্যুতিভার অনিবার্য ভেবে
ভিড়িয়েছে জাহাজ। করপুটে ধরে আছে জলকথন
চারপাশ থেকে সেলাই করা কামনার রোযা
পিপাসার বিবরণ শুনে সান্ধ্যগীত গেয়েছিল-
পাখি। তা দেখে- স্নেহের পরিধি ছড়িয়ে
ইঙ্গিতময় দাঁড়িয়েছে নিজস্ব দরোজার কাছে কেউ
কেন যে সন্ধিসূত্র এত ভাবপ্রবণ- আসুক মনোজ্ঞ
বাতাস! রক্তনাচ দেখে সেও বিভ্রমে যাবে
আঙুরলতার মতো বেড়ে ওঠে পরস্পর-প্রোথিত মাচা
পতনের সমূহ সম্ভাবনা ভুলে
অন্ধকারে বেহায়া আলোর মতে জ্বলে ওঠে
একটু একটু করে জল ছেড়ে দেয়
যেন ওলাউঠা রোগী।
কথার মহিমা
.........
যে তুমি হৃদয়ের রচনা- যাচনা করি সিজদায়
বলো তাকে- তজবির দানায় তুলে দিয়েছি
জাতীয় সংগীতের দ্বিতীয় লাইন
যেসব বিরতিহীন কথার মহিমা তাড়নাঘাত
সইতে না পেরে নিমজ্জনে গেছে- জোড়া
হাতের অপার শূন্যতার ভেতর- কখনো কী
ফিরবে তারা ক্রন্দন যাকে জন্ম দিয়েছিল
প্রার্থনার মতো সম্বলহীনের শেষ অস্ত্রের কাছে
জল্পনা করি- আকাশ ভেঙে নামুক গজব
কসম খোদার- তাবৎ দুনিয়া ঘুরে কোন
অখণ্ড চিৎকার বিচার বেদনা নিয়ে হাশরের
বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তখন নন্দন খুলে পূর্ব-পশ্চিমে
ছড়িয়ে দেব ভরসার জিকির
আমি তারই উপাসনা করি
যার খোপা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙে যায়।
সাম্প্রতিক
......
আয়নায় নিজেকে দেখার পর-
গলার নিচ থেকে যে আওয়াজ ভেসে এল
তার বিকাশতরঙ্গে শুধুই বিলুপ্ত প্রাণীদের কথা
শ্রবণশঙ্কায় তাড়িত হয়ে নিজের ছায়া থেকে
দূরে সরে আসি- এ কী আমারই স্তব্ধ ভূমিকা
না-কী ছদ্মনামে বেড়ে ওঠা খনিজ আগুন?
চেতনাহারা ছাউনির ভেতর কতশত তীরগান
সংকেতনির্ভর কতশত প্রহসন, গুপ্ত প্রতারণা
অস্থির সদালাপে নিয়ে যায় মরুসম্রাটের কাছে
যার বিস্তৃত পদভারে নতজানু-বিষণ্ন বোবা
আর ওই মেঘগর্জন হাসির আড়ালে উড়ে গেছে
বনাঞ্চলের হরিৎ পাখি-প্রজাকায়স্থ দিনমান
বল তো সুজন, কিভাবে বসত করো নিজেরই ভেতর
রক্তস্বল্পতা জেনে নিয়ে ভালোবেসে নিজের কঙ্কাল
ভোরের চিৎকার দেখে যারা পালাতে চাইলো দিকশূন্যদূর
বহু বহু পথ ঘুরে এসে পুনর্বার করুণাঘেরা
কী জটিল ক্ষতগন্ধ করতলে পুষে
বেঁচে থাকা যাদের সাময়িক বিষাদ
আয়নায় নিজেকে দেখার পর জেনেছি
মানুষ কেন বয়ে চলে নিজেরই শব।
বউ
...
আহা তেতুল!
উচ্চারিত চিত্রকল্পে
উত্থিত বারবার
পূর্বাপর ধারণার ভেতর
প্রলোভনে- দুর্বার তামাশায়
উপচে ওঠা জলের গরিমা।
বেদনাসংগীত
........
আমার শুধু বর্ষসেরা হাহাকার আছে। পূর্বাপর আমি যা ভেবেছি বর্ষিত হয়েছে তা উল্টোমন্ত্রে। সমুদ্র ভেবে নেমেছি বিষাদে হতে পারে এ এক আনন্দভ্রমণ। এভাবে ঠিক করে যে বয়স এসে দাঁড়িয়েছে বঙ্কিম গ্রীবা নিয়ে কাঁধের উচ্চতায় খেয়ালই করিনি। তোমাকে নিয়ে যে মিথ্যাচার প্রচলিত আছে ছয় ঋতুতে, বাতাসে বাতাসে ওইসব শব্দদল মিথবাক্যে বহু আগেই গল্পে গড়িয়েছে। এ ঘটনা পাতাবাহী বধির বৃক্ষেরও অজানা নয়। যদি তা ভুল করে সত্যি হতো কখনো-কোনো অবহেলায় তাহলে হৃদয়ের পেছন দরজা দিয়ে রাজা লক্ষণের মতো পালাতে হতো না আমাকে। কিছুতেই সুখ নেই আর! হারাতে-হারাতে, পালাতে-পালাতে সমগ্র ভূগোল শেষে নিজেকেই দেখি তোমার সম্মুখে।
২.
আমার নিংড়ানো যাতনাকথা যার কাছে বিনোদন বিশেষ, তার উত্থিত বিকার পদে পদে রেখে যায় খুনের বাহবা। জগতে বুঝি বিনামূল্যে যন্ত্রণা কেনা সবচে সহজ। যা ছিল সঞ্চয়, ডুবেছিল নম্র প্রহসনে এখন আমি যেকোনো মানব বিনা বাতাসেই অঙ্গ কাঁপে। তুমি তখনো দ্বন্দ্বসুরা হাতে নিয়ে দৃশ্য শিকারের আমোদে মেতেছো। আমাকে বিরক্তির কারণ ভেবে তোমার দৃষ্টির রূপরেখা নিয়ে একটি অন্ধবুলেট তীব্র শব্দে বেসেছিলো ভালো বুকের এপাশ-ওপাশ। কী আশ্চর্য, এমন নির্দয় পরিণতির পরও দেহস্তম্ভ মাংসকঙ্কাল হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়েছিল নির্বিকার। পৃথিবীর তিনভাগ জল ঘুরে এলেও এমন নজির একটিও পাবে না যে নিজের মৃত্যুকে স্বচক্ষে দেখার পরও বেঁচেছিলো।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন