মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়

মাসুদা ভাট্টি


এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে, মুখে চুন, কালি, চুন-হলুদ মিশিয়ে লাল রং বানিয়ে সেটা মেখে, পাটের “ফেউসা” দিয়ে দাঁড়ি-গোঁফ বানিয়ে, ছেঁড়া কাপড় বা চটের আলখাল্লা পরে এ বাড়ি থেকে ওবাড়ি যাচ্ছে, তাদের মাঝে এক কুমারী, কলাপাতা দিয়ে মোড়া, পাড়ার বউঝিরা আগে থেকেই তাদের চালের কোণায় কুলো গুঁজে রেখেছে, সবাই জানে, আসবে “দ্যাওয়া-নামানিরা”।

উঠোনের কোণে রাখা এক হাড়ি জল, দুষ্প্রাপ্য জল, চৈত্র মাস। গ্রামের পুকুরগুলো প্রায় সবই শুকিয়ে আসছে প্রায়, আর না শুকুলেও প্রচণ্ড রোদে তলা থেকে দলা দলা বুদ্বুদের সঙ্গে শ্যাওলা ভেসে উঠছে, দুর্গন্ধে পাশে গিয়ে দাঁড়ানো যায় না। শুধু দু’একটি পুকুর, যেগুলো অনেক গভীর, সারা বছর সেখানে কচুরি-দাম পোষা হয়, যাতে রোদে পানি পঁচে না ওঠে, কচুরির লম্বা দাঁড়ি পানির তলায় আটকে রাখে শীতলতা। সেই সব পুকুরের জল ধরা যাবে না, কেবলমাত্র খাওয়ার জন্য তা। যে সময়টার কথা বলছি সেটা খুব বেশি দূরের নয়। মাত্রই পঁচিশ বছর আগের, আবার সেই অর্থে পঁচিশ বছর সিকি শতাব্দীও বটে।তখন আমাদের গ্রামে মাত্র দু’টো চাপকল ছিল। তারমধ্যে একটিতে পানির সঙ্গে গিজগিজে বালি উঠতো বলে, একটার ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়তো। বেচারা চাপকল চাপ খেতেই থাকতো, খেতেই থাকতো, সূর্য ওঠা-ডোবার আগে-পরে সব সময়।

দ্যাওয়া-নামানি’রা এসেছে। উঠোনের কোণে এসে দাঁড়িয়েছে, সুর ধরেছে,
একজন বলে, “ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়”
তারপর সমস্বরে, “ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়”।
এরপর দলনেতা একেকটি লাইন বলে আর সমস্বরে সবাই সেই লাইনটি শেষে বলে, “ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়”

এই বাড়ির বিটিরা ঘামে জর জর
ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়
এই বাড়ির বিটাগো, পিঠি নুন জাগে
ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়
এই বাড়ির ঝিয়েরি নাবার পারে না
ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়
এই বাড়ির ছাওয়ালডা সাঁতরাবার পারে না
ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়
এই বাড়ির মুরগিডা ট্যাও ট্যাও করে
ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়
এই বাড়ির হাঁসটি জল-বিনে মরে
ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়
এই বাড়ির গাইডা ঘাস না পাইয়া মরে
ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়
এই বাড়ির দামড়াডা ছট্‌ফট্ ছট্‌ফট করে
ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়
এই বাড়ি বাছুরডা হামলাইয়াগো মরে
ওরে দ্যাওয়া এই বাড়ি আয়
এই বাড়ির কুত্তাডা তৃষায় ফাইডা যায়
ওরে দ্যাও এই বাড়ি আয়

এভাবে বাড়ির প্রতিটি জীবিত প্রাণীর কথা বলা শেষ হলে বাড়ির হাঁড়ি-কুড়ি, এমনকি ধান রাখা ডোল, গোলা; গুড় রাখার জ্বালা এবং শেষাবধি বাঁশের চটি দিয়ে বোনা পেঁয়াজ রাখার “চাঙ”-এর জন্যও বৃষ্টি কামনা করে
তারপর “দ্যাওয়া” তাকে কি কি দেয়া হবে তার ফিরিস্তি হতো।
যেমন
দ্যাওয়া তোরে দুধ দিবো
দ্যাওয়া তোরে ত্যাল দিবো
দ্যাওয়া তোরে সিন্দুর দিবো
দ্যাওয়া তোরে ধান দিবো
দ্যাওয়া তোরে পান দিবো
দ্যাওয়া তোরে আম দিবো
দ্যাওয়া তোরে কাঁঠাল দিবো
দ্যাওয়া তোরে শাক দিবো
দ্যাওয়া তোরে মাছ দিবো
দ্যাওয়া তোরে সোনা দিবো
দ্যাওয়া তোরে রূপা দিবো

এরকম দীর্ঘ ফিরিস্তি থাকতো “দ্যাওয়া”র জন্য। সবশেষ যে বাক্যটি বলা হতো তা আমাকে এখনও দারুণ ভাবে নাড়া দেয়।
বলা হতো,
দ্যাওয়া তুই রাইতি আসিস
দ্যাওয়া তুই বিয়ানে আসিস
দ্যাওয়া তুই যহনই আসিস পাবি যুবতী।

এরপর ঘরের চালে গুঁজে রাখা কুলোর ওপর হাঁড়িতে রাখা জল উঁচু করে ঢেলে দিতেন বাড়ির কত্রী। সেই জল কলাপাতা দিয়ে মোড়া কিশোরীর ওপর পড়তো, এবং সেই জলের সঙ্গে আরও জল মিলে উঠোনে কাঁদা করা হতো, এবং সেই কাঁদায় পড়ে গড়াগড়ি যেতো দলের বাকিরা।এরপর বাড়ির কত্রী একমুঠ বা কখনও তার চেয়ে বেশি কিছু চাল এনে দলের কেউ একজনের হাতে থাকা বেতে তৈরি “ধামা”য় ঢেলে দেন। একে পাড়ার প্রতিটি বাড়ি যাওয়া হতো। একেবারে শেষ বাড়ি থেকে যখন দলটি বেরুতো তখন তাদের চেহারা হতো দ্যাখার মতো। কাউকেই ঠিক চেনা যেতো না। কাঁদা গড়াগড়ি দিতে দিতে শরীরে ওপর পুরু কাঁদার স্তর পড়তো। কিন্তু সেদিন দত্ত বাড়ির বিশাল দীঘিটি, যদিও তখন আর দত্ত বাড়ি ছিল না, তার মালিকানা গিয়েছিল রহিম শেখের হাতে, রহিম শেখ শশী দত্তের লাঠিয়াল ছিল এক সময়, ১৯৫০ সালে রহিম শেখের লাঠি শশী দত্তের মাথাটি দু’ভাগ করে দিয়েছিল।

বৃষ্টির কথায় যাই।বৃষ্টির আকুতি শুরু হতো মাঘের শেষ কিংবা ফালগুনেই। ফালগুনের কোনও এক শনি-মঙ্গল বারে বাড়ির বউ “জলি দুধের শিন্নি” দিতেন জলে। সেদিন সকালে উপোষ, শুধু উপোষ নয়, কারো সঙ্গে কথাও বলা যাবে না। খুব ভোরে পুকুরে একটা ডুব দিয়ে এসে ভিজে কাপড়ে “আগলা চুলোয়” এক দাম দিয়ে কিনে আনা (দোকানী প্রথমেই যে দাম চাইবে সে দাম দিয়েই কিনতে হবে) মাটির ছোট্ট “চৌরা”য় করে একমুঠ আতপ চাল আর এক হাঁড়ি (আমাদের ওখানে দুধ বিক্রি হয় মাটির হাঁড়ি বা পেতলের বদনা মেপে) দুধ দিয়ে শিরনি রান্না করে সেই মাটির পাতিলটি হাতে নিয়ে বউ জলে নেবে যাবে, এক ডুবে শিরনিশুদ্ধ পাতিলটি বসিয়ে দিয়ে আসবে পুকুরের তলায়। জলকে “জলি দুধ” (যে দুধে আর কিছুই মেশানো যাবে না)দিয়ে তুষ্টু রাখা, যদি চৈত্র মাসে কখনও আগুন লাগে তাহলে যেনো হাতের কাছে জল থাকে। অনেকেই হয়তো একে হিন্দু রীতি, কুসংস্কার বলবেন কিন্তু এমনটাই দেখেছি গ্রামের বেশিরভাগ মুসলমান বউকে করতে। আর আগুনের ভয়? সে এক ভয়ঙ্কর রূপ, চৈত্রে যদি কোথাও আগুন লেগেছে, তাহলে সেই গ্রামের আর একটি বাড়িও আস্ত থাকতো না, সে জন্য আগের দিনে দুই বাড়ির মাঝখানে খালমতো কেটে দূরত্ব বাড়ানো হতো বলে শুনেছি।

আর চৈত্রে আরেক ভয় ছিল কলেরার। আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে প্রায় প্রতি বছরই এই কলেরায় গ্রামের কয়েকজনকে ওপারে যেতে হতো। আমার খেলার সাথীদের মধ্যে কয়েকজনকে আমি হারিয়েছি এই কলেরায়। বৃষ্টির জন্য আকুতির সঙ্গে এই কলেরা থেকে মুক্তির ব্যাপারটিও তাই একীভূত। আসলে কি রেখে কীসের কথা বলবো? এই বৃষ্টির সঙ্গে ফসল বোনা, বিশেষ পাট বোনা, আউশ ধান বোনা এইসব জড়িত। আসলে বৃষ্টির সঙ্গে জীবন জড়িত, আজ বৃষ্টির কথা বলতে গিয়ে আমি তাই জীবনের ঘ্রাণ পাচ্ছি।

নিজেকে আমার মাঝে মাঝে প্রাগৈতিহাসিক মনে হয়। মনে হয় কারণ, প্রতিবার বৃষ্টির জন্য কলাপাতায় মোড়া হতো আমাকে। আমি কলাপাতার ভেতর ভিজে চুপচুপে হয়ে থাকতাম যতোক্ষণ না পাড়ার প্রতিটি বাড়িতে “দ্যাওয়া” নামানো শেষ হতো। খুব বেশি খর না হলে বৈশাখেল শেষ দিকে এমনিতেই বৃষ্টি আসে। মাঝে মাঝে দেরি হয় কিছুদিন, কিন্তু প্রতিদিনই বিকেলে আকাশ ভারী হতো। আর আমরা “দ্যাওয়া-নামানি”রা ভাবতাম আমাদের জন্যই বৃষ্টি আসছে। আমরা আনন্দে দাঁড়িয়ে থাকতাম আকাশমুখো হয়ে, বৃষ্টি এলে চাতক হবো, জল খাবো। একদিন ঠিকই বিকেলমুখো রোদ কালো হয়ে যেতো, উত্তর পশ্চিম কোণ থেকে প্রথমে গরম হাওয়া আসতে আসতে এক সময় ঝপাত করে আরামদায়ক ঠাণ্ডা বাতাস আসতো।অবশ্য বাতাসের যে গতি, তাকে ঝড় বলতেই হতো। কিন্তু তাতে কি? ঝড়ের সঙ্গে জলওতো আসতো বৃষ্টি হয়ে। আর সেই বৃষ্টিতে আমি, কলাপাতা পরা মেয়েটি “বৃষ্টিদেবী” হয়ে যেতাম। প্রতিটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বউঝিদের বৃষ্টিতে নামিয়ে সাদা ঠোঁট লাল চোখ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। আমার দেবীত্ব কে কেড়ে নিলো? বয়স? সময়? আধুনিকতা?

আমি বৃষ্টিদেবী ছিলাম, আজ আমার দাওয়া শুষ্ক খটখটে ইঁট-পাথর।

(লেখাটি আমার বালিকাবেলা নিয়ে বিশাল লেখার একটি ক্ষুদ্রাংশ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন