মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

কাপড়ের কারাগারে নারী

মাসুদা ভাট্টি


ফেসবুক-এ “আমার মনে কী আছে?” এই প্রশ্নের জবাবে লিখেছিলাম - ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি সে দেশে বুরখা ও চোখ-মুখ ঢাকা হিজাব নিষিদ্ধ করেছেন, খুব শীগ্গিরই আইন করে তা বন্ধ করা হবে। আজকে লন্ডন শহর গলছে, গরমে, এর মাঝে কালো বুরখায় আপাদমস্তক মোড়া মেয়েদেরকে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিলো খুব- ধর্ম মানুষকে এভাবে কেন বেঁধে রাখে? চেতনার বিকাশকেই কি ধর্ম এভাবে কালো কাপড়ে ঢেকে রাখে?

আলোচনাটি এই প্রশ্ন রেখেই শুরু করতে চাই। হিজাব বা বুরখা পরা নিয়ে বাদানুবাদ আছে, থাকাটাই স্বাভাবিক। ধর্মকে ডিফেন্ড করার জন্য মানুষ অনেক কু-যুক্তিও হাজির করবেন। ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্নে আমি মানতে রাজি যে, কেউ ইচ্ছে করলে হিজাব বা বুরখা পরবেন, তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে কেন রাষ্ট্র? কিন্তু একথাও তো ঠিক যে, পৃথিবীর প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপেই মানুষ গিলেছে, ইসলাম-এর রাজনৈতিক রূপতো সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মানুষকে হাজারো নিয়মের নিগড়ে বেঁধে রেখেছে, যদিও দোহাই পাড়া হয়েছে পরকালে অপার শান্তির। রক্তপাত, ভয়-ভীতি আর রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যদি ধর্ম বিস্তার হয়ে থাকে তাহলে তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে কেন “ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ” বলে বলা হবে? আফগানিস্তানে অমুসলিম বা হিটলারের আমলে ইহুদিদের বিশেষ চিহ্ন ধারণ করার রাষ্ট্রীয় নির্দেশ ছিলো কিন্তু ধর্ম দিয়ে আগাপাশতলা মুড়ে নিজেকে আলাদা করার এই প্রবণতাকে সুস্থ বলে মানতে পারি না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, সভ্যতা এতোটা এগিয়েছে যে, নারী নিজেকে “খোলা খাবার” আর পুরুষকে “মাছি” ভেবে কাপড়ের জালি দিয়ে ঢেকে রাখার এই চিন্তাকে হাস্যকর মনে হয়।

একজন মানুষের সঙ্গে আপনি বসে কাজ করছেন, তার সঙ্গে গল্প করছেন অথচ তাকে আপনি কখনও দেখেননি। তার উপস্থিতি আছে কিন্তু তিনি নেই, ভাষার সঙ্গে বাচনভঙ্গী ও শরীরের ভাষা, পোশাক-আশাক ইত্যাদি বিষয়গুলি জড়িত, সব মিলিয়ে একজন সম্পূর্ণ মানুষকে জানা যায়। কিন্তু যে মানুষ পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো কাপড়ে মোড়া তাকে জানাতো দূরের কথা, তার সম্পর্কে ধারণাও তৈরি হবে কি? হয়তো বলবেন, ধারণা তৈরি হওয়ার কী দরকার?

আমার ভাবনার জবাবে একজন বলেছেন, ফ্রান্সের রাস্তায় নাকি নগ্ন হয়ে চলাফেরার অধিকার আছে! তিনি সারকোজির এই ঘোষণাকে স্ট্যান্টবাজি বলেছেন, কী আর বলবো? কিছুই বলার নেই। প্রকৃতির সন্তান বলে নিজেদের নগ্ন করে রাখায় বিশ্বাসীদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা আছে, সেখানে গিয়ে তারা দিগম্বর হয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যেতেই পারেন কিন্তু জনগণের মাঝে নগ্ন হয়ে নামলে তাকে নিরাপত্তাকর্মীরা হয় হাজতে, নয় মানসিক চিকিৎসালয়ে নিয়ে যান। এইতো সেদিন, ফ্রেন্স ওপেন টেনিস চলাকালে এমন একজন হঠাৎ নগ্ন হয়ে নেমে গেলেন ময়দানে, ব্যস তাকে ধরে-বেঁধে সরিয়ে নেয়া হলো, নেয়ার সময় তাকে একটা কাপড় দিয়ে ঢাকাও হলো। আসলে এই সব যুক্তি দিয়ে কী হবে? এই উপলব্ধি মনে-মননে তৈরি হতে হয়, কারো মগজে ঢুকিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। হ্যাঁ, মগজে ঢুকিয়ে দেয়াও সম্ভব, যখন মানুষ শিশু থাকে, হিজাব বা বুরখার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

কর্মক্ষেত্রে বাচ্চা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি যে, তাদেরকে শেখানো হয়, মাথা না ঢাকলে লম্বা চুল পরকালে সাপ হয়ে তাদেরকে দংশন করবে। কী ভয়ঙ্কর কথা, একটি শিশু বেড়ে উঠছে তার চুলকে ভয় পেয়ে। নিজের শরীরকে এভাবে ভয় পেলে তার বেড়ে ওঠাটাই যে অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে? সে শিখছে, বাইরে সমস্ত পুরুষরা ঘুরে বেড়াচ্ছে তাকে ধর্ষণ করার জন্য, সে জানছে সে একটি লোভনীয় ‘ডিস’, তাকে তাই ঢেকে-ঢুকে থাকতে হবে, নইলে যে কেউ তাকে খেয়ে ফেলবে। বাচ্চা বাচ্চা এই মেয়েগুলোর জন্য কষ্ট হয় খুব, তারা যে ইচ্ছে করে হিজাব পড়ছে তা নয়, তাদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে। এই গরমে, প্রচণ্ড গরমে হিজাবের নীচে ঘামাচিতে মেয়েটি কষ্ট পাচ্ছে কিন্তু কিছুই করার নেই। ছোট্ট বেলায় পড়েছিলাম, ইঁট দিয়ে ঘাস ঢেকে রাখলে দিনে দিনে তা হলুদ হয়ে মারা যায়, আর মানুষের শরীর যদি এভাবে সূর্যালোক-বঞ্চিত থাকে তাহলে তাও কি ফ্যাকাসে হয়ে ধীরে ধীরে নানা চর্মরোগের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র হবে না? আচ্ছা শরীরের কথা বাদ দিই, মানুষের মন? শরীর যার কাপড়ের কারাগারে বন্দী, মন-তো তার কতোটা উদার হবে? এই মেয়ে শিশুটি বড় হয়ে যদি বলে সে স্বেচ্ছায় বুরখাকে বেছে নিয়েছে তাহলে তার চেয়ে বড় মিথ্যে আর দুনিয়াতে আছে কি? প্রশ্ন হলো, পৃথিবীতে ক’জন নারী স্বেচ্ছায় বুরখা পরেন আর ক’জন বাধ্য হয়ে তার খতিয়ান না থাকলেও আশেপাশের বা পরিচিতদের কথা বলতে পারি, তারা কেউই স্বেচ্ছায় এই পোশাকের কারাগার বেছে নেননি, ধর্ম দিয়ে তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছে।

২টি মন্তব্য:

  1. যারা এভাবে ভাবে তাদের সবাই চরিত্রহীন।যেমন নিকোলাস সারকোজি।

    উত্তরমুছুন
  2. দেখুন,মানুষ সব সময়ই নিয়মের বেড়া জাল থেকে বেড়িয়ে আসতে চায় বা অবহেলা করে।সেটা হোক দেশের আইন,স্বাস্থবিধি বা ধর্মীয় আইন।নিয়ম মেনে চলা কষ্ট,কিন্তু যারা নিয়ম মেনে চলেন,তাদের জীবন হয় সুন্দর।অনেকে সিগারেটের পক্ষও যুক্তি দেখায়।ধর্ম স্বাধীনতায় হস্তক্ষেত কি সাম্প্রদায়িকতা নয়।

    উত্তরমুছুন