সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

জীবনানন্দ দাশের ‘অবসরের গান’: একটি জ্যামিতিক পর্যবেক্ষণ

এহসানুল কবির |

গোড়াতেই একটা গোড়ার প্রশ্ন রেখে শুরু করি — ‘অবসরের গান’ কেন ‘গান’, ‘কবিতা’ নয় কেন? স্মরণ করতে পারি, বাংলা কবিতায় আধুনিকতার (ব্যাপক অর্থে; রোমান্টিকতা-উত্তর অর্থে নয়) যিনি প্রথম উদ্গাতা, সেই রবীন্দ্রনাথের আগমন ঘটেছিল ‘গান’ নিয়েই। সন্ধ্যাসঙ্গীত, প্রভাতসঙ্গীত, jibananda.jpg…….
জীবনানন্দ দাশ (১৭/২/১৮৯৯ — ২২/১০/১৯৫৪)
……..
ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল প্রথম চারটি কাব্যগ্রন্থের নামের মধ্যে প্রথম তিনটিই সঙ্গীত/গান-শব্দযুক্ত, বাকিটি সঙ্গীত-অনুষঙ্গযুক্ত। আরও স্মরণ করতে পারি, বাংলাদেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে। আধুনিক বাংলা কবিতার কালগত দিক থেকে দু’প্রান্তের দু’জন কবির উদাহরণ টানলাম জীবনানন্দকে মাঝখানে রেখে একটা সরলরেখা টানার সুবিধার্থে। সরলরেখা টানায় অতি-সরলীকরণের ঝুঁকি আছে, এটা যেমন ঠিক তেমনি
—————————————————————–
যাদেরকে জীবদ্দশায় পান নি, তাদেরকেও তিনি জিতিয়ে দিচ্ছেন ‘অনেক মাটির নিচে’ কোনো এক সম্রাটের খুলির সঙ্গে তাদের খুলি মিশিয়ে… সেইসব ভাঁড়দের গল্প বলতে বলতে এঁকে দিয়েছেন প্রাক-সামন্ত থেকে সামন্ত হয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পর্যন্ত সমাজবিকাশের দীর্ঘ রেখাটি।
—————————————————————–
এটাও ঠিক যে, এক শতাব্দীর দীর্ঘ কালপরিক্রমায় বাংলা কবিতা তার চলার পথে যেসব আন্তর সাধারণ সূত্র রেখে গেছে, সেসবের কিছু মৌল ইশারাও এর মাধ্যমে পাওয়া যাবে।

পৃথিবীর অন্য যে-কোনো ভাষার সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও কবিতা গানের উত্তরসূরি। গান থেকে কবিতায় উত্তরণের মাঝপথে সোপানের মতো এসেছে গীতিকবিতার ধারা। আর গীতিকবিতা থেকে আধুনিক কবিতায় উত্তরণের সোপানটা গানের দিক থেকে না-সূচকতা দিয়ে তৈরি। সাঙ্গীতিকতাকে পরিহার করার মধ্য দিয়েই বাংলা কবিতা উত্তীর্ণ হয়েছে আধুনিকতায়। রোমান্টিক-উত্তর অর্থাৎ নগরমনস্কতা-চিহ্নিত আধুনিকতার প্রধান স্বরগত চিহ্নায়ক তাই অ-সাঙ্গীতিকতা। সামন্তব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উত্তরণের উপরি-কাঠামোতেই কবিতার এ-বিবর্তন। কিন্তু বিবর্তন মানে অতীতের পুরোপুরি বিলোপ নয়। বিবর্তনের বাঁকে বাঁকে পড়ে থাকে পুরোনো পথের রেখা। ফলে, নগরমনস্ক আধুনিক কবি যখন ‘গান’ কথাটা ব্যবহার করেন, তখন শতাব্দীব্যাপী বিবর্তনের ঐ দীর্ঘ রেখাটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে, কিন্তু তা আমাদেরকে পশ্চাৎমুখী করে না। অতীতের স্মৃতিকাতরতায় আমরা হাহাকার করে উঠি না। যদি কেউ ওঠেন, তবে তাকে আমরা ‘আধুনিক’ বলে চিহ্নিত করি না। আধুনিক কবি অতীতকে আবহমানের সঙ্গে মিলিয়ে নেন, একে আত্মস্থ করে নেন সমকালীনতার মধ্যে। অতীত, আধুনিক কবির কাছে তাই, আবেগী স্মৃতির অনুষঙ্গ যতটা — তার চাইতে অনেক বেশি, বর্তমানের প্রেক্ষাপটে অতীতের প্রয়োজনীয় রেফারেন্সের আকর। অতি-সরলীকরণের ঝুঁকি নিয়ে আলাপ এগিয়ে নেওয়ার ফলে আমরা এই মূল্যবান ইশারাটা পেলাম।

গোড়ার প্রশ্নটার উত্তর আমরা পেয়ে গেছি — ‘অবসরের গান’ আদতে ‘গান’ নয়, বরং গানের রেফারেন্স-ঋদ্ধ কবিতা। ‘গানের রেফারেন্স’ মানে কেবল ‘গান’-নামক আঙ্গিকের রেফারেন্স নয়, বরং সমাজব্যবস্থার বিবর্তন এবং সেই-সূত্রে শিল্প-সাহিত্য-আঙ্গিকেরও বিবর্তনের রেফারেন্স এটি। ‘অবসরের গান’ কবিতার পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে এর প্রমাণ মেলে।

একটি নির্দিষ্ট সমাজের এবং এর উপরি-কাঠামোস্থ শিল্প-সাহিত্যের বিবর্তনের সরলরেখাটা উল্লম্ব। আর, ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে দেশ, দেশ থেকে পৃথিবী — এরকম বিকাশের যদি একটা সরলরেখা কল্পনা করা যায়, তা হলে সেটা হবে আনুভূমিক। এই আনুভূমিক সরলরেখাটিকে ঐ উল্লম্ব সরলরেখাটির সঙ্গে ক্রস করে বসিয়ে, এটাকে সূচক-দণ্ডের মতো ব্যবহার করে যদি কবিতা পড়তে যাই, তা হলে বাংলায় অন্তত একজন কবির ক্ষেত্রে দণ্ডটি কোথাও টাল খাবে না — তার নাম জীবনানন্দ দাশ।

দুই
‘অবসরের গান’ কবিতার বড়ো তিন ভাগ — ‘১’, ‘২’ ও ‘৩’ দিয়ে কবি এগুলো চিহ্নিত করে দিয়েছেন। প্রথম ভাগে ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে/ অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে’; দ্বিতীয় ভাগে ‘পুরোনো পেঁচারা সব কোটরের থেকে/ এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে/ মাঠের মুখের ’পরে’; আর তৃতীয় ভাগে ‘পুরোনো ক্ষেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার’। প্রথমটি ধান পাকার সময়ের উৎসবের আমেজে মজে ‘হাতে হাত ধ’রে ধ’রে গোল হ’য়ে ঘুরে-ঘুরে-ঘুরে’ নাচবার গান; দ্বিতীয়টি ‘ফলন্ত মাঠের ’পরে’ ‘মরণের স্থান’ না খুঁজে গাওয়া ‘প্রেম আর পিপাসার গান’; আর তৃতীয়টি ‘অলস মাছির শব্দে’ ভরে থাকা সকালে ‘গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে’ ভেসে আসা ‘চোখের ঘুমের গান’।

তিন
সূচক-দণ্ডটিকে এবার সামনে নিয়ে আসা যাক। উল্লম্ব ও আনুভূমিক রেখাদুটো নিয়ে দেখে নেওয়া যাক ‘অবসরের গান’ কবিতা থেকে রঙ নিয়ে রেখাদুটোকে কীভাবে রাঙানো যায়।


পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় জীবনযাপনকারী কবি, পৃথিবীর ইতিহাসপাঠে ঋদ্ধ হওয়া কবি, যখন দেখছেন ফসল-কাটা বিরান মাঠের দৃশ্য, তখন তার কল্পনায় ভেসে আসছে পাড়াগাঁর পুরোনো ভাঁড়দের মুখ:
আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড় —
যুবরাজ যাহাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড়
মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটির নিচে পৃথিবীর তলে!
কোটালের মতো তারা নিশ্বাসের জলে
ফুরায়নি তাদের সময়;
পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তারা করে নাই ভয়!
প্রণয়ীর মতো তারা ছেঁড়েনি হৃদয়
ছড়া বেঁধে শহরের মেয়েদের নামে! —
চাষাদের মতো তারা ক্লান্ত হ’য়ে কপালের ঘামে
কাটায়নি — কাটায়নি কাল!

পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড়েরা পৃথিবীর সব পুরোনো সাম্রাজ্যকে উপেক্ষা করতে পেরেছিল ফসলের প্রাচুর্যে শক্তিমান হয়ে — ‘ফসল — ধানের ফলে যাহাদের মন/ ভ’রে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সম্রাজ্যেরে, অবহেলা ক’রে গেছে/ পৃথিবীর সব সিংহাসন’। আর আজ এত এত শতাব্দী পরে জীবনানন্দ যখন তাদেরকে স্মরণ করছেন, তখনও:
অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল
কোনো এক সম্রাটের সাথে
মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে!
যোদ্ধা — জয়ী — বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে — পাশাপাশি –
জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি!

যাদেরকে তিনি তার জীবদ্দশায় পান নি, তাদেরকেও তিনি জিতিয়ে দিচ্ছেন ‘অনেক মাটির নিচে’ কোনো এক সম্রাটের খুলির সঙ্গে তাদের খুলি মিশিয়ে, তাদের ‘খুলির অট্টহাসি’ আমাদেরকে শুনিয়ে! সেইসব ভাঁড়দের গল্প বলতে বলতে জীবনানন্দ এঁকে দিয়েছেন প্রাক-সামন্ত থেকে সামন্ত হয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পর্যন্ত সমাজবিকাশের দীর্ঘ রেখাটি। ফলে, উল্লম্ব রেখাটির জন্য যথেষ্ট রঙের সন্ধান আমরা পেয়ে গেছি।


কবিতাটা যখন শুরু হয়েছিল, তখন:

চারিদিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল
তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল!
প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে
পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে!

‘অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের দেশে’ পর্যন্ত বলার পর কারো বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে, গল্পটা ‘পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে’রই। তবু জীবনানন্দ সেটা বলে দিলেন। তাই, এখান থেকে আমরা আনুভূমিক রেখাটা হাতে নিয়ে তাকে ট্রেস করতে শুরু করব। ধানের ক্ষেত থেকে যখন ফসল বিদায় হয়েছে, যখন ‘সবুজ ধানের নিচে — মাটির ভিতরে/ ইঁদুরেরা চ’লে গেছে — আঁটির ভিতর থেকে চ’লে গেছে চাষা’, তখন ‘সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে/ শহর — বন্দর — বস্তি — কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে’ কবি আসলেন সেই ক্ষেতে। উদ্দেশ্য — ‘অগাধ ধানের রসে আমাদের মন/ আমরা ভরিতে চাই গেঁয়ো কবি — পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন’। দেখা যাক, এসে তিনি কী দেখলেন, কীইবা করলেন:

জমি উপড়ায়ে ফেলে চ’লে গেছে চাষা
নতুন লাঙল তার পড়ে আছে, — পুরানো পিপাসা
জেগে আছে মাঠের উপরে :
সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা ওই আমাদের তরে!
হেমন্তের ধান ওঠে ফ’লে –
দুই পা ছড়ায়ে বস এইখানে পৃথিবীর কোলে।

দেখতে পাচ্ছি, ‘পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে/ শহর — বন্দর — বস্তি — কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে’ যিনি এই ছোট্ট ক্ষেতটিতে এসেছিলেন ‘শরীরের অবসাদ — হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে’, তিনি এই ক্ষেতে এসে দুই পা ছড়িয়ে বসে গেলেন পৃথিবীরই কোলে! পৃথিবীর কোলে যিনি বসে গেছেন, তাকে ট্রেস করার আর উপায় থাকে না। সেটার আর প্রয়োজনও নেই। কারণ, আনুভূমিক রেখাটির জন্যও পর্যাপ্ত রঙ আমরা পেয়ে গেছি।


তাকে ট্রেস করার আর প্রয়োজন নেই ঠিকই, কিন্তু ওখানে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি কী করছেন, তা দেখে নিতে তো দোষও নেই! তাই, গোয়েন্দাগিরি বাদ দিয়ে, তত্ত্ব-ব্যাখ্যা ঝেড়ে ফেলে, শুধু দূরে থেকে তাকে একবার দেখে আসব। দেখতে দেখতে শেষ হবে আমাদের আলোচনা:

অলস মাছির শব্দে ভ’রে থাকে সকালের বিষণ্ন সময়,
পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়;
সকল পড়ন্ত রোদ চারিদিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে,
গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে,
এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার
সাধ ভালোবেসে!

চার
প্রশ্ন হতে পারে, এ-চিত্রে জীবনানন্দকে আমরা বসাব কোথায়? আনুভূমিক ও উল্লম্ব রেখাদুটি যেখানে ক্রস করেছে, সেই বিন্দুটিকে কেন্দ্র ধরে রেখাদুটির প্রান্তবিন্দুগুলোকে পরিধিতে রেখে একটা বৃত্ত আঁকলে তাকে আমরা বৃত্তটির পরিধিতে পাব। তাই বলে এটা মনে করার সুযোগ নেই যে, বৃত্তাবদ্ধ করে আমরা তাকে সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছি। সরলরেখাকে দুই প্রান্ত বরাবর ইচ্ছেমতো বাড়ানো-কমানো যায়। বৃত্তটিকেও সে-অনুযায়ী বাড়ানো-কমানো যাবে। ফলে, পরাবাস্তব থেকে অধিবাস্তব, ব্যক্তিক থেকে বৈশ্বিক — জীবনানন্দের সব অবস্থানকেই এ-চিত্রে চিহ্নিত করতে কোনো অসুবিধা হবে না। জ্যামিতিকভাবে জীবনানন্দ পাঠের মজাটা এখানেই!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন