শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

জল ও শ্রীমতী

জল ও শ্রীমতী
...........

মোস্তাক আহমাদ দীন


পাঠসূত্র
....
প্রকাশকাল ২০০৮



উৎসর্জন
.....
মণীন্দ্র গুপ্ত
মোহাম্মদ রফিক


সূচিপত্র
....
দর্শক
শীতা
সময়
পাখি
গৌর
শয়তান,
অগ্নিভ
মেঘ, মেঘ নয়
অলোকরঞ্জিত
পথলিপি
সফরনামা
কুঁজোগাথা
রূপসী,
প্রত্যাবর্তন
সাঙাৎ
ভার
ঝিনুক
উপহার
জল ও শ্রীমতী
পিতা
৬ আগস্ট
অপেক্ষা
জাল রাজা
পান্থ
ছায়া
চাঁদ
রাজ্য
সে
নেতিহাস
নিদ্রা
সুস্থতা
রাধা
ঘুম
গান
হাওয়া হাওয়া
ছবি
স্মৃতি
(ভিম)রতি
মুহূর্ত
নিঃশব্দ
স্তরান্তর
পূণ্ড্রবর্ধনে
বিহ্বলতা
ময়ূর
আষাঢ়ে গল্প নয়
খনন
কৌতুক
কালিক
খেলা
নারী
আত্মহননের অংশ



দর্শক

একটি আগুন তার দীন আকুলতা নিয়ে জানে
বিষম করুণ জলে ডুবে মরেছে যেজন, সেও
খুব নিচু বীজ ভেদ-করে-ওঠা নীল কেয়াগাছ

অযথা প্রেরিত তাই তার ও ইমেল,
মান্দার বাগানে ফের ফিরে আসে কৃষ্ণভ্রমরের
লাল বর্ণমালা; এর ক্ষুদ্র দর্শক আমি দেখি-
তার প্রৌঢ় ব্যথা এক অচিন কুষ্ঠিনীর কাছে
চায় নিরাময়; চায়, অতি খলবল না-হলেও দেহ এসে
নিঃশব্দে বিদ্ধ করে যাক।


























শীতা

লবণ ও ধানের গূঢ় মরতবা কি
বুঝে গেছে শীতা?
উষ্ণ পাথরঠেকে মাথা ছুঁয়ে আছে-এই স্বপ্নে
আজো কেঁদে ফেরে তার চৌষট্টি মহল

চুপে চুপে ওই মুদ্রণ পড়েছি ঠিকই
অস্বচ্ছ জলের তোড়ে হাত-মুখ-চুলের প্রস্তাব
ফাঁসা পাখিটির হৃদয়ের রূপে ডুবে
মরে যায়, যার পায়ে পায়ে বহুবলয়িত জগদ্কারণ

দুঃখ ও ব্যথার কণা কণা আলোড়নে
সহজে যে ডুবে-যাওয়া যায়-
এই তত্ত্বটুকু তার অনন্ত নির্বেদে
কতটুকু পৌঁছে যাবে আর

কখনো সে-কোলাহলে এলে মনে হয়
অগ্নি অগ্নি বলে আজো বসা যায় গূঢ় বোধিগাছে



















সময়

চুল মিথ্যে করে দিচ্ছে হাওয়া
সুখ-ধারণ-করা এই জরাগুচ্ছ আমাকেই বিদ্ধ করতে আসে!
আমি দুঃখ-পান-করা ধুলার পথিক

শরীর ঠিক অনুধাবনীয় নয় যে তার গলি-ঘুপচি
যে-কোনো পাতার রাজ্যে তোলে আলোড়ন
বরং অতিনিন্দিত এক বাতিল সুলতান তার ভাঙা নৌকাটিকে
ফেলে রেখে গেছে পাশে
তাকে দেখে কিছু যৌনপাখি অযথাই করে উচাটন

সেও তো অ-ক্ষমা পরিন্দাবিশেষ, আর তার
লফজ-মশক-করা মিথ্যে ফরজন্দ
ফলে হয়ত সত্য নয়-কালঘুমে দেহ-ছেঁচে-আসা হাওয়ায় হাওয়ায়
অতিপরিচিত আমি ছুটে যাই সেনাসদনের দিকে

বৃথা গল্প-গাথা জেগে ওঠে-পরাগানে,
তবু মনে-মনে, বাঘজিহ্বাসহ তার মিথ্যে চুল ছুঁতে যাই



















পাখি

শরীর খুলছি
কতটা লিপ্ত হয়েছে দেখি বাতাসের ব্যথা ও ছত্রাক
আর শীতপীড়িত আমি উড়ছি বালুতীর থেকে

বলছে উড়–ক্কু বন্ধু
‘জলে ডুববার স্মৃতি আজ
চিত্রিত করতে পারো জল-তেল রঙে’
তখন শরীরে পাচ্ছ
সমগ্র চাঁদবণিকের দেশ

আমার আসবার-কথা পথে প্রচারিত

আমি উড়ছি
আমার বঙ্কিম লেজে লেপ্টে রয়েছে অসংখ্য উদ্গান
আমার হৃদয়ে যদিও জেনসন্তের স্থিতিস্থাপকতা
হয়ত তাহারো অস্থির নিধি জলে ঘুরে মরে
হয়ত তার দেহগাছে জলের শিকড়
তাহার অশেষ গানে
সোম কিংবা অতিলোকগানের সহজ ভণিতা
ফলে দেখছে
এক অন্ধ জাতিস্মরের অনন্য নিদ্রা

আমি চুম্বন করছি
আর ছুঁয়ে যাচ্ছি নিচুপাহাড়ের শান্ত গণ্ডদেশ
কেশর উড়ে চলেছে হাওয়ায়
দাঁড়া-য় মেঘমাত্র নেই
পাখনার ভারে এই ঘুরে-চলা

পাখিজন্ম পাঠ করছে পথের মানুষ







গৌর

স্থির করে আনো সেই দূরলক্ষ্য গৌরপ্রতিমাটি;
আমার সকল বুঝি আজ ভেসে যায়-
কৃষ্ণসূর্যের পথে কিছু অসনাক্ত লণ্ঠনের বিন্দু বিন্দু
কান্নার স্মৃতি মঙ্গোচিৎ বৃষ্টিতে ভেজে

আমার এমন লব্ধি আজি কোন অর্থে যে ব্যথিত-
ষড় গোস্বামীরা সেসব জানে না (কিছু জানে জয়দেব রাজ)
তালিতাপ্পিতে-ন্যস্ত করুণ আঙুলগুলি দেখি
আর ভাবি আমার স্ত্রী-আঙুলটি যেন
স্পর্শ করছে রাজকাঁকড়ার দেহ


























শয়তান

মেহফিলে হাজির আজ দীর্ঘকণ্ঠ
স্মার্ত লুসিফার!
গজলের মজমা ছুঁয়ে আছে, তথাপি অসুর, আর
কঠিন ভূমির পত্রে বিরাজিত, তবু
মনে হয় পীন হাবশি রমণীকে
মনে ধরে করে তানালাপ
নাগামরিচের লাল প্রকৃতিকে ছুঁয়ে এসেছে তার আনোখা হৃদয়

তাকে দেখেও তো কারো কারো
হৃদয়ের ধুলোপথ ভেজা-
গোল জলাশয়ে যেতে বেফানা শরীর;
উচ্চণ্ড গোধূলিকে দেখে যেরকম কারো কারো
নিদ্রাহীন কাটে সারারাত-
সেই ছাঁদে ডুবে যেতে ফড়িঙের রূপ ধরে আছে


















অগ্নিভ

ঠিক ভেঙাচ্ছে না কেউ, তবু
বাতাসের খুল্লামখুল্লায় তুমি ব্যবহৃত,
তোমার টাটকা হাতে কীটপতঙ্গের শরীর পুড়ছে
তুমি আগ্নেয় আর স্বভাবে শৃঙ্গগামিনী
অতল মৈথুন থেকে তুলে এনে পিনে-পিনে গাঁথছ হৃদয়

এখনও আচ্ছন্ন-
হৃদয় ও শরীরে ঠিক কতটা ব্যবধি জানি না
গাছ ও আগুনের মর্মে তারা কী ভাবে যে অখণ্ড রূপক!

স্ফূর্ত ও অভাবিত তুমি, নিদারুণ ভালো!
নিষাদ-গর্জন ফেলে নিত্য দূরগামী;

বনে ও বাজারে লাল রঙ,
আর আমি যদিও অহেতু,
পতঙ্গ-পোড়া আগুন থেকে সবকিছু বাঁচাতে মরিয়া
















মেঘ, মেঘ নয়

তোমার মাথার নিচু পথে তাকিয়েছি
অতি নিরিবিলি উঠে গেল কার্তিকের সাদা ছাতা;
জানো না জলের বিচ্ছেদ-ব্যথা ফোটে কি না,
নতুন-ধানের-ছায়া-চোখে-নিয়ে-আসা নারীমুখে
ছড়িয়ে দিয়েছে কি না নাদান তুলির কোনো কবি

পায়ে পড়ে আছে সাদা ছায়া

কিছুই-না-বোঝা কোনো মাথার ওপর
ছাতাটিকে মনে হয় ভৌত উদ্দীপনা-ভ্রমজাল,-
আমি তার নিচু পথে গিয়ে কঁকিয়েছি
চোখে-ব্যথা-পাওয়া কোনো মুরগির মতো মনে হয়েছে নিজেকে




















অলোকরঞ্জিত

পাখিটি দুলছে
বৃষ্টিজ্বলা সন্ধ্যাটিতে, আর
এই ইহজন্ম
শিরাল গাছের ডালে

তার প্রতিটি শিরায়
আদিশিহরণ প্রবাহিত হলে
মনে পড়ে,
চর্যাতাড়িত আমি কবে থেকে
ক্রৌঞ্চশৃঙ্গারের খাঁচা ছেড়ে
অলোকের সাদা এক স্তন-লোভে পড়ে আছি
যদিও কালে, পত্রে মাতৃপতনের ভয়

আমি গাছটির ভূত-স্পন্দন থেকে
প্রাণ নিয়ে ভাবি,
দূরে যাওয়া যাবে কি না
উড়ে পাওয়া যায় কি না...

















পথলিপি

এই দাহপথে ভিজতে চলেছে
সুপ্রস্তাবের আদি ঘোরপাতা, যখন
আমার নতুন কোর্তায় ঝুলে-
থাকবার কথা রৌদ্রের তামা তখন
আমি এক দেহমাত্র,...অহৃদ;
অবাস্তবের মতন ভিজতে কিংবা
পুুড়তে যাবার বেলাও নীরব;

উঠে দাঁড়িয়েছি শুধু একবার যখন
এই জাগানিয়া বাতাসের কাছে
উজ্জীবনের সে-এক অলীক বাহন

আজ, গাঁয়ে-গাঁেয় শহরে-শহরে
পুরোনো বাখান কিছু উড়ে আর দাপায়
অল্প অল্প হৃদয় কাঁপায়...

















সফরনামা

ত্রিকাল-পেরোনো øেহে অভিভূত বদর এবার
জল ছেড়ে একান্ত আশ্রমে এসেছে;
পাঞ্জিপত্র খুলে বসে দেখে মাছধ্যান
শুকনো শাখায় বসে কারা আগে করে গেছে স্বপ্ন সীবন

যে-রূপে নিয়েছি তারে, আড়ালে বসিয়া যেন নিত্য
পিরচর্চা করে চলি আমি আর পিরতুতো ভাই
জখম সারাতে যেন করি নাই অলীক সেলাই
আমাকে চোবাতে যেন আসে নাই সত্যি কোনো মিথ্যে গ্লোবালিনী
-এই ভাবে খুলে ধরে জলরাজ্য : প্রবালের বহু গুঢ় কথা-
জাহাজডুবিতে কারা সোহবতে মৃত্যু খেলেছিল
কোন মতলবে লাল নকশাতে মেতেছিল গামা-কলম্বাস

এই গাঢ়ভাষে সব মর্মগাথা আচ্ছাদিত আর
একাট্টা রহস্যগল্পে জাদুকেলিময় স্থান আরো
বহু ছাঁদে বোজা














কুঁজোগাথা

শরীর তার সাদা চঞ্চু থেকে ফেলে দেবার আকাক্সক্ষা করছে একশত
একটি চুম্বন;
পতন থেকে উঠে কোথায় যে যাচ্ছে জানি না শুধু এক রঙ্গ-ছাওয়া গ্রামে
সেদিন শুনেছি তা
বিস্ফোরিত হলো, সত্য তবু চির ছন্দ মেনে নিয়ে;-বৈয়াকরণের
পত্র উড়ে যায়
একদা কাফনের ইশতেহারে-ভরা কঠিন শরীর বা শৈল বরফের
দেশের শাদা পাতা
কায়দা করে ঢেকে দিয়েছে বহুবার, চান্নিপসরের বহুধা বি¯তৃত
ভ্রান্তি খুঁজে পেয়ে।
এখন হৃদয়ের সচল নিদ্রিত জখম পিঠে নিয়ে নিকট-সমুদ্রে
লম্ফ নিয়ে যাই


















রূপসী

জল ভিক্ষা করে শৃঙ্গমুখী হয়েছে রূপসী,
তবে জল শিলাময়-উঁচু উঁচু গানে মর্মরিত আর
আমি পাতালদলিত যদিও
দৃষ্টি মেলে দিতে নতুন কুয়াশা-ভিড়ে-
ভিড়ে অবনীল;

তোমার চোখের কাছে আমি এক অব্যক্ত পাতার মুকুট

তবু একচোখে চারচোখ নিয়ে নিত্য তাকিয়েছি-
তাহার পাশেই-পড়া তৃণে বাঘছাপ-
ফলে একসঙ্গে ঈর্ষা ও রক্তরাঙা একঅনুভব
অস্পষ্ট ফলের বিস্তারে সমরূপে ডুবে যায়























প্রত্যাবর্তন

রক্তমহল থেকে ফিরবার কথা
তোমার।

মনে হচ্ছে ধাতু ও লবণাভা
এইবার নির্জন ইহলোক ছেড়ে
নক্ষত্রস্পৃহা নিয়ে দূর কোনো ফাঁদে

আমি পিপাসাহীন, তবু কী গুণ এসে
ঘিরে ধরে এই উন্মুক্ত সভায়;
তুমি বলো মায়া-
আলখাল্লা-পরা ছায়াগণের সাথে মিশবার ইচ্ছা নিয়ে
বাঁধা পড়েছ বলে জানি

এই জ্ঞান ও প্রতিভা মিথ্যে হলে
ক্ষতি কিছু নেই
প্রত্যাবর্তনের পথে যদি কিছু আলো ফুটে থাকে




















সাঙাৎ

তরণী না বয়ে গেলে এই রুদ্রমাস
ধীরে প্রবাহিত ডোমকলোনির প্রতি-
এক অদ্বিতীয় পাণ্ডুপরমার খোঁজে যেরকম
ঝরে পড়ে লশ্করের সাজ

ছিলাম মগ্ন আমি ‘শান্ত সন্ত্রাসের চাঁদমারি’
উদযাপনের রীতিনীতি মেনে; রমণীরূপম দ্যুতি নয়,
দেওলার ছিরিছাঁদে-খাড়া এক অচির আশেক মানদার
আমাকেই দেখে বেশ কৌতুকে খেলে
ভয়াবহ মেঘনীলিমায়
যেন মর্তনে যেতে পারি ইশকাপনের গাঁয়

তখন আমারও লাগবে চূড়ার কালমেঘ
আমাকে দেখাবে দূর দেশে দেশে হলুদ মঞ্জিল
যদিও প্রেমিক নই, ভঞ্জনের সঘোর প্রস্তাবে
অনীহ ও লোভী;
তাম্র ও কংসের গুহ্য ফাঁদের
রূপকের কতিপয় মদ-মাংস আমাকে লোভায়

ফলে মুক্তকচ্ছের ভাবে রূপে বর্ণে
মরে বেঁচে আমি এক আজিব সাঙাৎ















ভার

ক্লান্ত ইদুর-পায়ে
কত আর খেলে রণদ্যুুতি?
ইচ্ছে, টপকাবে লবণদেওয়াল

যদিও স্পষ্ট দেখা যায়-
নফস সামলেসুমলে,
সাদা পাতা কুড়াবার বদলে
আঙুলে লাঠি জুড়ে দিয়ে
দাঁড়িয়েছে পিনগাঁথা লিঙ্গে;
ইচ্ছে, কুড়াবে পিপে ও নারীছাল,
যোনী ও আপেল-

তা দেখে
আমার ক্ষুদ্র শিরদাঁড়াটিতে
জমে ওঠে ব্যথা,
মাথায় ভর করে ফেলে নিদ্রা, অনন্তকালের





















ঝিনুক

কয়লাখনি থেকে উঠে এইবার বাড়িয়েছি দাম
সোনার মূল্যে শুধু গাত্রপশম, অন্যসব শ্বেতপত্রমালা পেলে রাজি

কৃষ্ণগাথা নিয়ে বাজারের অট্টহাস্য তৈরি হয়ে আছে!
আমি তা জানি না।

আনাভি তৃষ্ণা দেখে তারও আগে আমি ডহরনিবাসী
অতি নিরজনে মনে বেসেছি এক বন্দুকের নল

তখন নিদ্রাবেলা, শাদা পাথরের গানে বাজারের মর্ম খুলে গেছে!
আমি তা জানিনি।

ফলে, ঝিনুক বন্দরে গিয়ে একা একা খেয়ে আসে জল

ঝিনুকের অধিক ঝিনুককথা? কেউ তা জানে না




















উপহার

উপহার হিসেবে কিছু জলগুঞ্জন আর
(একমাত্র তুমিই জানবে)
কিছু রতিরিক্ত পাতা

এর প্রতিক্রিয়া প্রকাশযোগ্য নয়
শুধু রূপকথা হওয়ার ভয়ে
অব্যস্ত ভাটির দেশে ঘটে খালডুবি
আমাকে কেন্দ্র করে উঠেছে মাতম

স্বয়ং আমিও কেঁদে ফেলি
পাতা ও জল একই পাত্রে ঝরে পড়ে

পাত্র থেকে ব্রহ্ম উড়ে যায়






ৃৃ













জল ও শ্রীমতী

সমুদ্ররাজ্যের কথা ভেবে
কাতর শ্রীমতী আজ বাঘসিংহের থাবার মুখে
হেঁটে হেঁেট জঙ্গলের নীলবাড়ি যায়

কোনো অনসূয়া পাখিপরিবার পেলে কণ্ঠে তার
উজ্জ্বলন্ত গান তুলে নেবে-
যেখানে নাচে-নৃত্যে ভরা যে প্রহর
মাথা ও শরীরের চারপাশের হাওয়ার স্তব্ধতা ভেঙে অনাকার
একধ্যানী কাকও যার কিছুই জানে না

এই ঘটনার ফলে আমি দেখিয়েছি
রূপকথারঙিন রাজার মুকুট,
আর প্রজাপতিরাঙা ভাবীসময়ের
দ্রুতি ও বিস্তারে-কাঁপা হৃদয় তুলে
অনাপদ দূরত্বে থেকে শুনিয়েছি জলবৃন্দগান-

তাতে একটু-আধটু কেঁপেছে শ্রীমতী














পিতা

ঘুমেও শিহরিত ছেলে
মাটি ও ফেরেশতার সর্ববিধ আদর খেয়ে
নিকট-অতীতে শব্দ সঞ্চয়নে গেছে

গেছোভূত নিঃশব্দে দেখে
তার অন্যায্য পিতার চোখ
আর কান শুনে নেয়
অতলে বি¯তৃত এক সর্প-শিহরণ

কখনও জগদ্মায়ায় এলে
দুইজনা এইরূপ ছন্দে মুখোমুখি...

বহুকাল পর,
আদিদর্শনের যোগছলে
দুই পথিকের ছাতা দুটি
মিথ্যে দুই ভাব নিয়ে ওড়ে















৬ আগস্ট

১.
রহস্য বাঁধতে থাকলে মনে হয়
তুমি ঠিক জলেও থাকছ না
বৃথা নদী পান করে এসে বেশ স্মার্ত,
তুমি বেশ জঙ্গলেও রানি

তারা জেনে নিতে পারে দূরাগত
ঈর্ষা অনুক্রম...

আমি জলে হৃত-এখন কিছু কৌতুক নানা মর্মে
চলে এলে শঙ্কা কিছু জমা রবে আর
এই পৃথিবীতে প্রাণিদের কৌতুহলী
ভিড়ে এসে এই প্রকার দ্বিধা রয়ে যাবে :
হয়ত গুল্মজন্ম নীরবে হয়েছে

২.
কী অক্ষর মুদ্রিত হয়ে রয়েছে ঝুটিতে,
পড়তে পড়তে আমি অন্ধ
কোথা হতে কিছু ঘূর্ণিশব্দ চলে আসে

এমন ডাকের সঙ্গে তোমার কণ্ঠ যেন
উড়ে যেতে থাকে দূরে, দূরদেশে

আমি ছুঁতে পেয়ে আরো কত জটিলতা!
অন্ধের নিকটে যেমন হায়ারোগ্লিফিক্স

৩.
অঙ্গে তামাপাহাড়ের হাওয়া

বেলা গেল
ফের আমি পেতে চাই শুধুমুখীটির জল

বেলা গেল

আমি দেখি
শ্যাওলাজড়িত শুধুমুখীটির হৃদিখানি বোজা

৪.
এখন সারল্য বুঝেছে, আর
দেখতে পেরেছিল ধানরঞ্জিত
ক্ষেতের গোপন

ক্ষীণ বৃষ্টিপাতে জল উঠে পড়ে, তাতে
সঙ্কুচিত হয়ে থাকে গাথা ও ঘটনা

এই কথা অবনত হয়ে বোঝে আর
কিছু হার্দ্য কথা তুলে আনে
সে-ও

৫.
এই সূত্রজাল ঢেকে দিতে চেয়েছে আগুন
মোহে ঘোরে-ফেরে পাখি
কিন্তু তার ডানা পুড়ে যেতে পারে বুঝে
দূরে উড়ে যায়

আগুন ঢাকতে চাইছে সাড়ে দশ হাত কিংবা
এগারটি হাতের তাকত

হয়ত ব্যর্থ; হলে, আমি রাজি,
পূর্ণ পুড়ে যেতে


৬.
উদ্বন্ধনে এসে মরে গেল
শ্রান্ত তিতির পাখিটি

স্থানে কি বাতাস ছড়াল, তার রহস্য
নিকট-ছায়া কি জানল
অনেক ব্যথার পুঞ্জ কীরকম ছাঁদে বাঁধা আছে?

আমাকে বধির করছে
গর্জনশীল রাতের স্তব্ধতা

৭.
বলেছে তারও আছে অশেষ লবণ

সমুদ্র সামান্য ছুঁয়ে এসে
সহপ্রাণিদের কীরকম স্পৃহা জেগে ওঠে-
একথা জানতে ইচ্ছে প্রোক্ত রাত্রিগণকের

অবশ্য সে-ও সুস্থ বিধিরীতি নিয়ে
ঘুরে এসেছে সব ধরনের গূঢ়ভূমি

তবু অখাদ প্রার্থনা তার, মাংস-কাদা
আর পুরাণের-স্মৃতি-ছুঁয়ে-আসা
জলেদের প্রতি


৮.
তোমার চোখের প্রতি তাকিয়ে মনে পড়ল
বৃষ্টিপাতের কথা
যদিও তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে নিদ্রা
আমি শরীরজ্ঞানে এই নিদ্রা বুকে তুলে নিলে
ভূমিজুড়ে পতনের দাগ
আমার বৃষ্টি পান করে নিয়েছে বাঘরোদ

আর শৈত্যপ্রবাহ এসে ঝরে পড়ে
অর্ধনিমীলিত চোখে




অপেক্ষা

বহুবার কেটে বাদ দিতে গেছি তবু এ হৃদয়
খসড়া জানলা প্রণয়নে সুখী, তৃপ্ত-
দূরে দৃষ্টি ফেলে রাখে আর
বনদীর্ণ লতা-পাতা গৃহসঙ্গী করে আছে
নির্জন অসুখ এসে খেয়ে যায় গুপ্ত সোনাদানা

আমি ওই পত্রে খোদকারি করে দেখি
চারদিকে স্বতঃকোলাহল
রাতজাগা-অক্ষরের-লাফে-ফুঁসে-ওঠা দেশে তারা
অন্ধকার চিনতে না পেরে
উষ্ঠা-বিষ্ঠা খেয়ে ফেলে রাখে বাতি
ফলে, (অতি স্বাভাবিক) রাত্রি
অসমাপ্ত থেকে যায় তারার বিহনে

অথচ কিম্ভূত এই রোদবেলা জুড়ে
অযথা চেয়েছি এক সৌররাহবর

ধুঁকতে-ধুঁকতে দেখি পাশে তৃণ-কীট
এবং হৃদয় সুখী খসড়া জানলা-প্রণয়নে;

অহেতু দৃষ্টি গিয়ে পড়ে রয় দূরে










জাল রাজা

আগুনে ভেজালে ধ্র“বনিরূপম জ্বালা;
যখন গ্রহণে যাবে তখন বাতাস ঠিক নয়,
মাটির নিকটে তুমি রাজা!

আমিও দেখব তোমার দুর্বল হাতে এক ফাটা তরমুজ
কীরূপে আদল পায় ধ্র“বতারকার সাদা গানে;
এক শেতানের মাথা আমি চর্বিত হতে দেখেছি যেখানে, তুমি
সেই হুজরাতে পাত্রবাহকের প্রতি এক বর্ণদক্ষ খাজা

তোমার উজ্জ্বল মুখে প্রগাঢ় খোলতাই,
প্রাচীন কাঁসার পরা সৌন্দর্য্য নিয়ে
জ্বলে আর নেভে !

আজিব নূরানি দেখে মানুষেরা হতেছে নির্বাক

















পান্থ

শেষতক তীর্থপথে গেছে।


দূরবর্তী জানালার দিকে চেয়ে
কৃষ্ণকন্যা তার সব ইচ্ছা বুকে নিয়ে
ব্যথায়-ভরে-যাওয়া বেলুনের
অনিশ্চিত দেশে ডুবে যায়

ওই খানে একান্ত অঙ্কনরীতি প্রচারিত হলে
রক্তশিরা নীল হরিণীশরীর নিয়ে বেশ কৌতুহলী-
যখন ময়দানে নিশ্চুপ ভৌত পাতাটির নিচে
দরবেশের সাদা পানজাবি ওড়ে

আমারও পান্থবেশ-
ঠিক এক নয়-অদ্বৈত-
মিহি সূত্র তার পুঙ্খে পুঙ্খে বিজড়িত
















ছায়া

ছায়া এই বল্কলে মিশেছে
তুমি সাত সত্যেরই ভ্রাতা, তাকে খুঁজে চলেছ শিকলে

এই সুতোপথে চলো বন্ধু পুরানস্মৃতিতে
তাহলে এই ছায়া ছুঁয়ে যেতে
তুলে ধরতে পারব গুড়ি-মেরে-রাখা স্বপ্নসমুদয়

তাদের রয়েছে স্বপ্নদক্ষ অশেষ জোয়ার
এই প্লাবনে বৃক্ষ পরাজিত,
আর পর্বতচূড়ার কাছে লালঝুটি মোরগের ডাকে
যখন আসবার কথা ভোর
আপাতত দশ হাতে রতিগন্ধা রাত্রি তুলে নেয়

অন্দরমহলে আজ ছায়াশরণের ধাঁধা

















চাঁদ

চাঁদ থেকে পত্রপতনের ব্যথা
অতি সাবধানে আমাকে পেয়েছে
যখন আমি মৃত্যুপ্রভাবিত

তোমার গোরলুপ্তি আরো অসীম বিষাদ নিয়ে
নিরজনে পুঁতেছে আমাকে

অন্য তীর থেকে আমার আত্মলণ্ঠনের দ্যুতি
তোমার গোরপারে জ্বলে




















রাজ্য

রাজ্য জেগেছে
সোনার পাথর বাটির চেয়েও অমূলক;
বন্যায় যেমন ভাসে খড়ো মাথা ও শরীর
অনেক ইমতিহান জিহাদের পরেও
মনতাড়–য়া বহু ডালপালা-বিস্তারিত-হওয়া
ঘটনার রূপ ধরে আমি সশরীর;
থেৎলে-যাওয়া মিরতিঙ্গার মতো খাড়া
যারা এসেছে ভরভরন্ত লিরিকের টানে
পরিত্যক্ত ভাঁড়ারের স্বপ্নে ম্রিয়মান

জানি যে সকল চোখের কাছে
বিস্বাদিত এক বাতিল পয়গম্বর
জিহ্বা ও লালার মাঝে ক্ষীণ সত্যের পাতায় তরতাজা!

মাঝে মাঝে বি¯তৃত, তবে কিমাকার;
মুক্ত ভেদে ক্ষমাহীন, আর বেমানান।















সে

রাজ্য কি ছেড়ে গেছে সেও?

নীলকণ্ঠ রমণীর হাতে
অগ্নিলাল বালি দেখে তার ভ্রমণেচ্ছা
ছুটে গেছে স্থির পাহাড়ের ধ্যানে-
ওইখানে কারো সখ্য না-মেনেই
এস্কিমো-সন্ধ্যা উদযাপন-
যেন ক্রমপতনের রীতির কথা বলছে
গহন মাটির প্রতি অশ্বত্থ পাতার প্রস্তাব

অথচ দেখেছি তারে
সেই বোধিবৃক্ষ-ছোঁয়া কালে
কান্তিকুশলের কথা-বলা এক বৃদ্ধের নিকটে জবুথবু,
যদিও স্পষ্ট দেখা গেছে তার স্তনপোড়া ঠোঁট।

















নেতিহাস

ভূগোলই জানালা, বলো আদিপত্রে ডুবে গিয়ে; তুমি
আদিতালুকের ম্যাপে মজে অক্ষরের
সব চাতুরিয়া মিথ্যে করে দিতে চাও পাঠিনীর কাছে; মানে
আমার সাকিন হলো স্মার্ত কোনো জনের নিকট

ঈর্ষা থেকে নিরাপদ। আমি তো নারাজ-
ক্ষাত্র-জরিপের কথা : চিরসন্ধ্যা বলে কিছু নেই পৃথিবীতে
ফলে বসে আছি গাঢ় গোধূলির কাছে
আমাকে ফেলতে যাচ্ছে বিঁধে-যাওয়া পাখিপরিবার

আমি শুয়ে দেখি ক্ষাত্র-অঙ্গুলিনির্দেশে
লাল বালি-লাগা নেতিহাসের পালক


















নিদ্রা

তুমি শুতে চলিয়াছ। বোলো নিরূপায়।
বোলো যে সময় তার অষ্টধাতুনির্মিত গাছে মরে আছে।
সাফল্য দেখোনি কিছু, তাই সে-কবরগাহে চেয়ে নিরূপায়-
তুমি দেখো খনকের হাসিতে কৌতুক

আমার অনিদ্র ছায়া বাতিশূন্য দানের নিকট
একলা উঙায় খুব; কহে সে মিথ্যে জুজুখেলা
কহে শুতে চলিয়াছ; খনক না হলে মানি, তবে
কোন পথে পড়িয়াছ, নিদ্রা তব ধোঁয়াজালে ভরা?




















সুস্থতা

শেষ নিক্তি ছুঁয়ে বহু আশা চোখে করে
উঠে কি দাঁড়াবে চণ্ডাল? আমি ভেবে চলেছি ক্রমশ...

হস্তে তার দড়ি, চোখে বন্ধনের নেশা,
হয়ত-বা প্রহরী দণ্ডিত, ফলে অতি সহজেই
তোমার আরক্ত দেহ চাষ করে চলে যাচ্ছে রাত্রিপড়োশিরা

ওই ঘটনা-বাতাসের থেকে সামান্য সুস্থতা নিয়ে
আমি এক রাজপুত্রের তল্পিবাহক কি না
অব্যক্ত ধ্বনিতে বয়ান করে চলেছি তোমাকে

বাতাসে বাণিজ্য, কিন্তু যে-কোনো ফোকরে গিয়ে
মনে হচ্ছে, তোমাকে শুনতে পেলে
কিছু সুস্থতা পেতে পারে ব্যধিগ্রস্ত আর্তপাখিগণ





















রাধা

দাঁড়িয়েছ জল র‌্যাঁদা করে,
পিছে এক অন্ধ জেলেনী
শতজনমের দুঃখে বেঁধে রেখে দিয়েছ হৃদয়

গাছসম্প্রদায় হেতু তুমি ভীতা;
উপরন্তু নারী।
Ÿস্তু-অভিজ্ঞানে-ভরা লক্ষ আদিরজনীর কাল

তুমি দাঁড়িয়েছ, পাশে
চোট্টা কানাইয়ের রূপ



















ঘুম

সৌরছালে তৈরি কি না-
ভেবেছে রাতের দুইটি পহর চলে গেলে,
এই স্থিতিস্থাপকতা
শরীরের তিন ভাগ জলে ডুবে মনে হলো তার

জলজন্তুতে-ভরা সমুদ্র ছেড়ে
উঠে যেতে হবে তীরে-
ভাবছে স্থলের ভূমি কোন বালিতে জড়িত,
ভাবে, খুঁজে পাওয়া যাবে কি না মরুর আশ্লেষ

সন্তরণপটু নাবিকের কাছে গিয়ে নিয়ে এসেছে সবক :
এইখানে রয়ে গেছে বহু লবণের ভোজ

দূরে, জনগ্রামে
বহু পথিকের ছায়া পড়ে আছে

















গান

একদা গিয়েছি রূপগানে-ছাওয়া জালে
রূপ-সঙ্কীর্তনে ফাটে-ফাটে তবু দেখি,
কান্নাবাষ্পের সঙ্গে মিশে আছে সুদর্শন-পালকের মেঘ
কিন্তু আমি বৃষ্টি যদি চাই কোথায় খুঁজব পোকা, যার গুঞ্জন
মিশে আছে নারীবাগানের শেষ আয়ুষ্কালে

হতে পারে তার চোখ খুলে
পাওয়া যায় খতরনাকের অশেষ কৌতুক, যাতে
আপাতমুহূর্তটিও সূক্ষ্ম-খাড়া পশমে জড়িত

তবু আমি বারবার ভীষণ আকুল
ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্যে উড়ে চলে মৌণ-চিৎকৃত হাওয়া

চারদিকে রক্তবেহালা বেজে যায়

















হাওয়া হাওয়া

এই অলজ্জ হাওয়ায়,
পানদানে তোমাকে দুইরোখা দেখে
খুশি তো থামে না দেখি অন্তরের আর্ত রূপসীর;
তার জামা উড়ছে অ-ভাবে-এইটুকু জেনে
যারা কেঁদে মরেছিল, (তাদের ব্যথা তো থামে না কোকিল!)
আমিও তাদের দলে-
এই দুঃখ-স্বস্ত্যয়নে কবে উবে গিয়েছে ফকিরি

এখন মুখের কাছে
কেঁপে উঠছে এক অস্ট্রিচের ঠোঁট-
পাখি নয়, অন্ধকারের গোপবালিকারা
























ছবি

কীর্তিমানের মৃত ছবি ভাসছে কাগজে;
তার আছে শত শত তীর;
তীর ও ধনুক হাতে শিকারির চোখ জ্বলে ওঠে
যখন ব্যাকুল পাখি, একটিমাত্র সুপসর ছাতা খুঁজে হয়রান

আমি মুরশিদের হলুদাভা টুপি ছুঁয়ে
আপাতত পুরাতন সেই বোধিগাছে

মাঝে-মধ্যে ক্যাপশনের ক্রিয়াপদ-গুণে
ফরমালিনের ছন্দ নিয়ে
এই শোকসভা টেনে আনে ভাইবোনকন্যাজায়ামাতা
আর মাটির ভিতর থেকে আদিস্মৃতি;
কান্না-মেশা গাছের পাতার বর্ণগুলো
এলো-হরফের ইতিকথা নিয়ে ভীষণ আকুল-
যদিও গোপন øিগ্ধ কোনও মুখের
শীতশান্তি থেকে আজ আর পাওয়ার কিছু নেই।




















স্মৃতি

বাঁকা সাপের
চোপা ও জাগরণ দেখতে
আমারও যেতে লাগে
ক্বচিৎ ভাটির দেশে,
সিংহিনীর খোটা খেতে খেতে

তারা উত্থানপ্রবণ,
তারা মনে মনে
হরিতকি ফলের বিস্তারে
পূর্ণতৃপ্ত কাল পেতে অনুরাগী

যেতে যেতে
গোপন বেণেরক্ত জেগে ওঠে-
যখন বিন্নাঘাসের নিচে
আমাকেই লক্ষ্য করে
সঙ্গতেচ্ছু খনিপাথরেরা বাজে




















(ভিম)রতি

তিনটি জগৎ কাঁপিয়ে ঝাঁকড়া-চুলের
গাছ যে হাঁসছে-
মনে হয় : তার ভেতর নাদান
ফোকলা দাঁতের ভিয়েনে

ভর সাঁঝবেলা অদ্বৈত ঠমক-
ঐশ আওয়াজ শুনছে
তথাপি পক্ষকেশের বুড়োটি অকাল
যুবক-গড়নে



























মুহূর্ত

চুম্বনের উপর থেকে
দেখা। হাওয়ার তাড়না যেমন এক-এক প্রস্ত
রুটির তারল্য নিয়ে বেড়ে উঠে, দূরযন্ত্রে গিয়ে
বাজে যে-হাওয়া, শোনে শুধু ইস্তেগফাররত কিছু গাছ,
আমারই নিয়মে, হৃদয়ের অবশিষ্ট দূরগানে-
পৃথক মর্মে যেমন সম্ভাবিত পাহাড়ের
দিকে চেয়ে থাকে চোখ-সেই প্রীতিহাস
আচ্ছন্ন হয়ে আছে বহু দীনভারে।

নিচে মেঘ। ছায়াবাতাসের চূড়া ছুঁয়ে
বস্তুপৃথিবীর উপরে ঝুলে আছে
চোখ ও চুম্বন।
























নিঃশব্দ

অনুধাবনযোগ্য মনে হয়েছে তাহাকে
ঠিক পাতার উপর অযাচিতভাবে জেগে-যাওয়া ক্ষত,
অন্তরালে যার মেধা ও বিরল বেদনাটি টের পাওয়া যায়,
যদিও হয়েছে বর্ষণ তবু হাওয়ার চাপড়ে মুখটিকে
জলসম্ভাবিত হাওরের রূপে খোলা মনে হয়, আর
স্পষ্ট ও সাদা;
ঝড় এলে আরো বিস্তারিত হতে পারে পথ-
এই নীরব আশাটি নিয়ে মুখের নিকটে বসে থাকি,
যদি আরো অনুধাবনযোগ্য মনে হয়-
এই লক্ষ্যে কুলু কুলু বইতে থাকে নলুয়ার হাওয়া


























স্তরান্তর

বল্কলে কি প্রমাণিত আমি বৃক্ষজন,
আর বাগান বলিবে কি আমি পাঙ্ক্তেয় কি না?
-একথা বাতাসে ওঠে রমণীভঞ্জনের ক্লেশে

অতি বিনয়ের ধাঁচে দীর্ঘ সত্ত্বেও দেহ জড়ীভূত
আর আত্মগত খামারের নিচ দিয়ে চলে-যাওয়া
হংস-শৃগালের ঘোষধ্বরি উড়ে যায়

কেন যে ভেবেছি প্রাণিকুলে আড়ষ্ট জিহ্বা-
এই প্রকারে আমার জীবনেচ্ছা কিছু দ্বন্দ্ব নিয়ে
প্রাজ্ঞ পরানিয়া

অথচ, রয়ে গেছে চর্যাখনিজের কতশত মাটি
মনে হয় ছোঁড়া তীরেরই কোনো অভিমুখে
রয়ে গেল ফিরতি ঝড়গান
যখন রঙ্গের কালে আমি স্তরীভূত শীতঘন বনে




















সিদ্ধান্ত

দর্শনলিপ্ত হওয়ার আগেই সত্য মনে হলো
করমচা গাছের ছায়া, ঢেউয়ে মিশে যায় দেহ
আমি যে বাতাসের অশান্ত সাঁতারু, তার জন্যে
অহেতু ব্যথা জমা করে রাখে সে গভীরে

বলেছি কেন দুর্খ্যাতিটাই ব্রহ্ম করে রেখেছ হৃদয়ে।
বর্ম মিথ্যে তার, এই বিকেলে দাঁড়ালে তাহা স্পষ্ট বোঝা যায়।
পুকুরে ভূতের ছায়া পড়েছে দেখেও বলিনি আজ
তালপাতাটির দেহ কাপাতে-আসা
এ-মিথ্যে শরীর অযথাই চাবকাতে আসে

তুমি জলে ভাসাতে পারো বাতি,
আমিও নির্লিপ্ত নই করমচা গাছের ছায়ায়























পুণ্ড্রবর্ধনে

রাত্রি হলে কী কথা কুড়োবার থাকে
পুণ্ড্রবর্ধনের কাছে?
আমি শুয়ে দেখেছি রাতরমণীর অনার্য গুঞ্জন

পুংপাঁজরে জন্ম-এই মিথ ও মিরাকলের
ধূসরতা নিয়ে কত স্মৃতি জাগে আর
দ্রুত ঝরে পড়ে মেধা ও মগজ

বলব যে ঝুঁকে পড়ো, তার অবশিষ্ট
ক্ষমতা ও নিদ্রাবালি হারিয়েছি অসুস্থ দ্বিধায়

শুধু দিবসে, ভাতঘুমকালে
পুণ্ড্রবাতাসে আমি ছড়িয়েছি ইচ্ছেবিবাহ

এই ক্ষণদূরত্বের যন্ত্রণা খেয়ে
আমাকে ক্ষমা করবে বারুদের গান




















বিহ্বলতা

বালবিধবার সাদা আভা নিয়ে
স্বতোচ্ছল নদীর টানে
তুমি দাঁড়িয়ে-পড়া রোদ

আমার সায়ংকালে
তোমার আগুনডানা দিতে এসেছে আধার,
যদি বনযাপনের দুঃখ ভুলে যেতে পারে হৃদয়

মোহনারীদের ইতিহাস লিখে লিখে
ক্ষয়িত আমার আঙুল জানি না
কতটা ব্যগ্র হবে দাঁড়িয়ে-পড়া এই ম্লান অবয়বে

























ময়ূর

জঙ্গলে ময়ূর পুড়ছে, তুমি তা জানো না

তুমি ক্লান্ত আর বহু দূরাগতা,
চুপে চুপে এসে মিশে গেছ
শান্ত আতরদানে, মর্জিমহলে

আমি এই ওষ্ঠলাঞ্চিত সুরার ফ্যাসাদে
লিপ্ত হতে হতে কথার প্রকারে ডুবে যাই,
তোমাকে লক্ষ্য করত যদি অনুগায়িকারা

যদিও জেনেছি আমি, এ-ও এক নিদ্রাবিশেষ-
অন্য ওছিলা নিয়ে, হাটে হাটে,
কারো কারো ছুঁড়ে-দেওয়া ফাঁদে

জঙ্গলে পালক পুড়ছে;
আমি অতি নিরিবিলি তোমার জঙ্গলে ছেড়ে এসেছি ময়ূর-
কেউ তা জানে না।



















আষাঢ়ে গল্প নয়

বসে তো থেকেছি আমি ঘড়িটির দুই পাশ ধরে
বলেছি আমিও, মম নিদ্রা উড়ে যায়
একান্ত শামুকরীতি ধীরে ধীরে গতিপ্রিয় হরিণের কাছে

অতলান্ত খুঁড়ে-খুঁড়ে নিয়ড়পিয়াসী হলে পরে
বদ্ধ পাতালের থেকে উঠে আসে নিধি-
আমিও নিকটজন, তখন বসতে পারি ট্রাফিকের খোলা
চৌহদ্দি না মেনে, তার চারদিকে কোকিল বাতাস

তা দেখে ফেললে কোনো নগরমেশিন,
মাথার ঝিমুনি নিয়ে রসাতলে যায়,
ফের স্বতচলাচলে খুব আগ্রহী কি না, জানবার আগে আগে
তাকে সৌর সিরামিকে ধরে রাখে তরুণ ভাস্কর

আমরা রসিয়া এই দেশে, কালে বহুপত্র গাছে।
জল ও অজল কিছু নেই, সমুদ্রসাঁতারের
শতবক্র কাহিনীতে ব্যগ্র, কাল-অন্ধ যে-কোনো জনের চেয়ে বেশি


















খনন

তারে কি বন্দিতে চলো, দেখছে অসংখ্য মেঘ
ইবাদতে মগ্ন হতে গিয়ে
তার সব চুম্বনেচ্ছা যৌন করে দেয়,
দেখো, জীবনবৃক্ষের থেকে বক্রদ্যুতি পাতা ঝরে যায়

না হয় তর্পণ করো। মন পড়ে নাও।
উষ্ণ তীর থেকে হরিণের গতিবিদ্যা চুরি গেলে
তার বিহ্বল মুখ ফুটে ওঠে-
তখন আগুনলাগা সন্ধ্যা চারদিকে;
পারিলে তর্পণ করো, গাঢ় আলো দিয়ে খেলো

আমার পিঠের কাছে যে-বৃক্ষটি খাড়া,
ফলভারানত, তবু তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে


















কৌতুক

ঠিক বলা যায় না যদিও, রাঙা এক
পাতায় উড্ডীন,
তবু সে উড়ন্ত পত্রিনী, ধান খেতে চলে আসে
আমাদের উঠোনসভায়;

কখনও খোলা রাজপথ ধরে ওড়ে সেই গান :
খাঁচা ও বনের দুই পাখিটিরে ছুঁয়ে
তার চতুর দীক্ষা মিথ্যে এক আচমনে ডোবে;
আমি তার ঠোঁটের বিস্তারে মগ্ন অন্য গ্রহজন;

ধ্র“বরেখাটির দিকে চেয়ে মনে পড়ে
বহু বছরের অচেনা কৌতুক-
বেশ সাব্যস্ত এক স্থাপনা গড়েছে






















কালিক

দিশা না হরায় যেন, সে-জন্যে ব্যাকুল
সতুনের পাশে এনে পুতে দিচ্ছ সোনার কবচ

চিন্তা আমাকে ছেড়ে চলে যায় বহুর নিকট,
নানান গমন নিয়ে তারা খ্যাত,
দুস্থ রাত্রি নিয়ে খেলে আর
রাজকুমারের জন্যে করে মোনাজাত

আমিও নাদান নই, কৃষ্ণচূড়ার নিচে বসে
সাদা মৌলভির কাছে মশ্ক করেছি হরফ,
সামান্য কঞ্চির মুখে জেগে গেছে কত মিনার-মসজিদ

ফলে, আমারও কামনা মন্দ-প্রবাহিত হাওয়া
না-কিতাব মানুষের ছায়া এসে
দাঁড়াবে হৃদয়ে, বহুজনে/একলা নিরজনে





















খেলা

একটি রাতে সহজ খেলা খেলতে গিয়ে দেখি
বন্য মৃগী শাণিয়ে তোলে দাঁত
তাহার বুকে খুঁজেছিলাম শয্যাসহা রাতের মহাধ্বনি
ভিন বাসনা আদিম মেটাফর
কিন্তু দেখি ভ্রমেরই পাঠ ভুল হরফে হঠাৎ লেখা হলো
বনের আমি এটুকু বুঝলাম
আমার মনে দস্যি পাখি ঝাপটে ওঠে ভীষণ মাতোয়াল
ঢুকরে চলে তথাপি থামছে না





























নারী

দেখো কী বকম বকম!

তোমার বনের পাখি তুমি বেঁধে ফেলো নারী

ঘরে ঘরে পাখিভ্রমি, তাতে নিত্য পরিবাদ

খড়ে ও দালানে, পোড়ামাটি পাতার প্রকারে.
হোমারে ও ব্যাসে তার নিত্য কোলাহল

কিন্তু, যারা শীতপ্রিয়, রাত্রিদিন আগুন জ্বেলে
পড়ে ফেলে ত্রস্ত সেই পাখির জীবন,
আর তার ডানার খণ্ডে লিখে রাখে পুড়ে-যাওয়া ব্যর্থ দিনলিপি
























আত্মহননের অংশ

১.
আমার চুল ও বয়স নিয়ে তোমার ঠাট্টা
বিস্তারিত হতে হতে মন্দিরে-মসজিদে,
টোলে ও মক্তবে।
পথ ভুল না হলে যেখানে আমারও যাওয়ার কথা
মানি বা না মানি, বায়ুস্তরের রূপে
আলম্ব নসিহতগুচ্ছ ভারী করে দেবে
পথমূর্তির-দিকে-যাওয়া কোনো বালকের রূপ-
যে কি না আমারই কঠিন সত্যে বেড়েছে বিরলে।

২.
ভেবেছি তুমি যেতে চাও ক্রমশ
মধুমালা কাঞ্চনমালাদের দেশে, যেখানে জল দেখে
নিয়ত তৃষ্ণার্ত তুমি; কিন্তু
আরাধ্য নদীর নাম আমি তো জানি না
গঙ্গা-সুরমা-সরস্বতী কি না
তুমি চলে গেলে কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে অতৃপ্ত রাতের গুঞ্জন

অথচ আমার পানিপড়া খেয়ে
খলবল করে উঠেছিল জিনগ্রস্ত অসংখ্য যুবতী
লজ্জাবতী পাতার আড়ালে তারা ক্রমে ম্রিয়মান;
বন্ধন ঠিক কোথায় যে জানি না
ফুঁপে-ওঠা গান্নাগমকের বাঁধা তারে
অশনাক্ত রাত্রিজালে
আমার রিক্ত মুখ কিছু স্তিমিত বাতির কথা বলে-
আমি কইতে পারছি না ও জঙ্গল ও সমুদ্র আমার

বুঝি এও অপস্মার বৈ অন্যকিছু নয়
কিন্তু লালিত বেদনার কাছে
এই হাহাকার এই সহিতত্ত্বটুকু সামান্য বাতাস
দেখি প্রস্তানরত তোমার পায়ের ব্যর্থতাটুকু
ঠুকরে-ঠুকরে পাঠ করে নেয়
ভাঙা দালানের কামুক চড়–ই, যারা আমাকেও
বাসে সহচর, এবং শুনেছে
আমার নগ্ন বাহুর কাছে
জিকির করছে লালনের জিয়ন্ত হরফ,
তারই মুজেযায় দুলে উঠছে সুরামত্ত অসংখ্য কিশোর;
আমি সে পথিক না যদিও, তারা সঙ্গত করছে
এ বসন্তে মিষ্টি কোকিলের

৩.
থাকলে ঈর্ষার কথা কিছু ছিল,
আঁকড়ে আঁচড়ে দেওয়া ছিল সদর দরোজার প্রতি
ফলে আজ মনে হয়,
তোমার মধ্যে কোনো প্রাণী প্রবেশিল কি না-
ভাবতে ভাবতে ভীত আমি ভাটির কুমার;
আমার লড়াই শুধু জলশাসনের,
মাৎস্যন্যায়ের কথা কিছু আছে, তবে আমাকে
কীরূপে যে দুস্থ করে টানা খেয়াজালের বিচিত মর্ষতা।

কখনো নলুয়া ও দেখার হাওরে
ফুঁসে-ওঠা দেওলার রহস্য ভাঙতে ভাঙতে
তাকে বন্দি করেছি বটে খাঁচায়
তার কান্নায় কেঁপেছে বটে বেতো-বাখালের স্বচ্ছ মর্মমূল,
তবু ঠুনকো পাতার তরাসে কভু দৌড়ে গিয়ে
ধরতে গেছি খোয়াজ খিজিরের গলা

অথচ উনিশতাড়িত আমি পাঞ্চপ্রদীপের
ভাসান মানিনি, তাই জলে ও চিক্বণ হাওয়ার ওপরে
ঘুরতে দেখে সকলে বিস্মিত
অথচ তারই নিকটস্থ বনপাথারে আমি ডরালোক
বনসরদানীকে আমিও শুনেছি, তুমি যার সুরাকাক্সক্ষী
আমার নেই কণ্ঠাপেক্ষী হওয়ার তাগত

৪.
তবু এ চৈত্রে আমি আজলতাড়িত।
গত শবেবরাতে আমি বৃথাই গেয়েছি দীর্ঘ দীর্ঘ
আজল-সঙ্গীত,
তারই রাগে কেঁপেছে জল, বৃক্ষ, নদী ও আতরাফ

রঙিন ঘুঙুর-পরা সাত পরী এসে
চেয়েছিল কুমার যৌবন,
আমি সেজদার সকল কায়দাকানুন মেনে উঠে দেখি,
ভবের বাজারে কী অপরূপ জমে গেছে খেলা,
কিন্তু এ-পাথারে অন্ধের অধিক বলবার
কিছু নেই তো আমার।

প্রত্যাহ্বানও কিছু নেই।
যারা প্রত্যাখ্যাত আরো বেশি
বিস্তারিত হতে চলেছে সেখানে, যার আগা-পাছা
ঘিরে আছে মিনাবাজারের নিত্য কোলাহল।
এখানে রাজ্যটি মেঘের,
ময়ূরের ঘূর্ণিনৃত্যে তবু একা একা অরূপ সফর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন