সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

শামানবাদ: এক ধরনের তান্ত্রিকতা

ইমন জুবায়ের

গতকাল, ১১ জুলাই, ২০০৯, শনিবার; আমাদের সময়-এ একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ বেরিয়েছে: “নলিতাবাড়ি উপজেলার পূর্বপাড়া গ্রামে শিশু কবিরাজ ঘিরে মানুষের ঢল।” এই রকম অদ্ভূতুরে সংবাদ আমাদের একেবারেই অপরিচিত নয়। খবরের কাগজে কিংবা টেলিভিশনে হরহামেশাই দেখি। দেখি না? দেখি। যা হোক। এখন নলিতাবাড়ি উপজেলার পূর্বপাড়া গ্রামে শিশু কবিরাজ ঘিরে মানুষের ঢল। কারণ, নলিতাবাড়ি উপজেলার পূর্বপাড়া গ্রামের লোকজনের মনে হয়েছে শিশুটি নিশ্চয়ই রোগ সারাতে পারে; আর, গ্রামের লোকের রোগবালাইয়ের কি অভাব আছে-যেখানে জনস্বাস্থ্যসেবার নূন্যতম উপকরণটিও প্রান্তিক জনসাধারনের নাগালের বাইরে। কাজেই শিশু কবিরাজ ঘিরে মানুষের ঢল তো হবেই। আরোগ্য যদি সুলভে সম্পন্ন হয়-এই আশায়; যদি ডাক্তার/কবিরাজের টাকা বাঁচে। তা ছাড়া শিশু কবিরাজকে নিয়ে কৌতূহলও তো কম নয়। শিশু কবিরাজ? সে কেমন? শিশুটি কি করতে পারে? কেমন করে শিশুটি চিকিৎসা করে? রোগ সারায়? এই সব চাঞ্চল্যকর প্রশ্ন একঘেঁয়ে গ্রামীণজীবনে এনে দেয় মৌতাত, অল্পখানি ভিন্ন আমেজ।
যা হোক। একটা সময় ছিল- যখন বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে ওঝাদের বেশ দাপট ছিল। ওঝারা ঝাঁড়ফুঁক করত, রোগ সারাত; বালামুসিবত দূর করত। এখন অবশ্য ওঝাদের দাপট অনেক কমে গেছে। তবে আজও বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে লোকে বিশ্বাস করে ওঝাদের রয়েছে অলৌকিক ক্ষমতা, তারা বশীকরণ মন্ত্র জানে, তারা বাণ মারতে পারে ... এই ওঝারাই কি শামান? হতে পারে। একেক সংস্কৃতিতে শামানদের ভূমিকা একেকরকম। যেমন, পৃথিবীজুড়েই শামানরা ড্রাম বাজায়। শামান-ড্রাম বলে একটা কথাই প্রচলিত আছে। দেশি ওঝারা কি বাজায়? নিদেন পক্ষে ডুগডুগি? জানি না। তবে এমন বলতে পারি আমরা যাকে বলি ওজা- তারাই আসলে শামান।
শামান শব্দটি উৎপত্তিসংক্রান্ত কয়েকটি মতামত পাওয়া গেছে।
এক/ শব্দটি তুর্কি ভাষার। দুই/ সাইবেরিয়ার যে রেইনডিয়ার শিকারী তুঙ্গাশ ভাষাভাষী ক্ষুদ্র ইভেঙ্ক সম্প্রদায় রয়েছে -শামান শব্দটি ওই ইভেঙ্ক সম্প্রদায়ের তুঙ্গাশ ভাষার শব্দ। তৃতীয় মতটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। শামান শব্দের উদ্ভব সংস্কৃত শ্রমণ। বা আশ্রম শব্দ থেকে। যা হোক। শামান শব্দটি পরে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইংরেজিতে গৃহিত হয়। শব্দটির স্ত্রী লিঙ্গ শামানকা।
শামান শব্দটি ইংরেজি ভাষায় বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। তো, কারা শামান? এবং তারা ঠিক কি বিশ্বাস করে?
এক কথায় শামান বলতে এমন এক ধরনের মানুষকে বোঝায়- ইচ্ছের বলে যে নিজের আত্মাকে স্বর্গ (আপার ওয়ার্ল্ডস) কিংবা পাতালে (লোয়ার ওয়ার্ল্ডস) নিয়ে যেতে পারে। গানবাজনা করে রোগবালাই দূর করে। এবং সংগীত-বিশেষ করে ড্রাম বাজানো, মন্ত্র উচ্চারণ এবং সমাধি বা ঘুমের মতো অবস্থায় থাকা শামানবাদের সাধারণ বৈশিষ্ট।
শামান শব্দের দুটি অর্থ পেলাম: ১) যে জানে; হি/শি নোজ। (শামানরা তো জানবেই। নইলে রোগ সারাবে কি করে?)
২) শীৎকারের কৌশল। (টেকনিকস অভ ইকটেসি। এই মানেটা গভীর। গভীর ও কাব্যিক। যা আমাদের নিয়ে যায় প্রাচীন জগতে ...।)
যা হোক। বিশিষ্ট একজন রুমানিয় পন্ডিতের নাম মির্চা ইলিয়াদ। ইনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছেন। বিশিষ্ট লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’ পাঠ করেননি এমন বাঙালি সাহিত্যরসিক খুঁজে পাওয়া মুসকিল। মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’ মির্চা ইলিয়াদ কে কেন্দ্র করেই রচিত। মির্চা ইলিয়াদ শামানদের নিয়ে গবেষনা করেছেন ব্যাপক। তাঁর মতে, শামানরা বিশ্বাস করে জগতে আত্মা বলে একটা জিনিস আছে। এবং আত্মা মানুষের ব্যাক্তিজীবনে এবং সামাজিক জীবনে গভীর ভূমিকা পালন করে। শামানরা বিভিন্ন উপায়ে সেই আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। আত্মা শুভ কিংবা অশুভ হতে পারে। অশুভ আত্মার আছর হলে লোকে অসুখে পড়ে তখন শামানরা সারিয়ে তুলতে পারে। শামানদের প্রায়ই ঘোর লাগে; কারণ তারা অদেখা দৃশ্য দেখতে পারে। শামানের আত্মা শরীর থেকে বেরিয়ে বিশেষ কোনও উত্তরের খোঁজে পারলৌকিক জগতে প্রবেশ করতে পারে। এসব বিশেষ ক্ষমতার কারণেই শামানরা ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে।
এখন প্রশ্ন হল-আত্মা জিনিষটি কি? এবং সেটি সত্যসত্যই আছে কি না। আপনি জানেন যে- এই প্রশ্নে দুনিয়া দুটি শিবিরে বিভক্ত। একদল বলে আছে-অন্যদল বলে নাই। ছোটবেলায় বায়োলজি বইয়ে জীবনের সংজ্ঞা পড়েছিলাম। “দি অ্যাকটিভিটিজ অভ প্রোটপ্লাজম ইজ কল লাইফ।” এর মানে: জীবনের মূল আত্মা না-প্রোটপ্লাজমের কার্যাবলী। কাজেই, সে বইয়ে আত্মার কথা লেখা ছিল না। বায়োলজি বইয়ে না থাকলেও আত্মা নিয়ে আমার কৈশরবেলার ফ্রেন্ড সার্কেলে বিস্তর আলোচনা চলত। আত্মা নামানো বা প্ল্যানচেটে আমরা গভীর কৌতূহলী ছিলাম। ( আত্মার আবার ছোটবড় আছে। যেমন, গান্ধীকে বলা হয় মহাত্মা, মহাত্মা মানে, মহৎ আত্মা। তা হলে ছোট আত্মাও যে আছে তা বোঝা যায়) ...আত্মা সম্বন্ধে আমাদের ধারনা ছিল এরকম-এটি অদৃশ্য, মহাশক্তিশালী ও সর্বব্যাপী। শামনরা এই আত্মা নিয়েই কায়-কারবার করে। আসলে আমরা ছোটবেলায় সবাই শামনই হতেই চেয়েছিলাম। অলৌকিক ক্ষমতাধর শামান। রহস্যময় শামান। তখন টিভিতে দেখতাম ব্যাটম্যান, সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, বায়োনিক ওমেন। এরা কি শামান না? এরা সবাই অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। তবে এদের শক্তির উৎস আত্মা ছিল না -ছিল বিজ্ঞান। ছোটরা এখন দেখছে স্পাইডারম্যান। সেও এক ধরনের শামান।
এবার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টিকে দেখা যাক।
শামানদের কার্যকলাপকে এক ধরনের তান্ত্রিকতা আখ্যা দিলে বলতেই হয় যে তান্ত্রিকতার উদ্ভব হয়েছিল সেই প্রাগৈতিহাসিক কালেই। শামানবাদকে আজও মনে করা হয় আদিম ও অপরিবর্তনীয় প্রত্নপ্রস্তর যুগের ধর্ম; তখন আমি শামানবাদের একটা অর্থ বলেছি শীৎকারের কৌশল। (টেকনিকস অভ ইকসটেসি। এই মানেটা অতি গভীর। গভীর ও কাব্যিক। যা আমাদের নিয়ে যায় প্রাচীন জগতে ...২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রত্নতাত্ত্বিকবিদরা ইজরেলে ১২০০০ বছরের পুরনো একটি কবর আবিস্কার করেছেন। কবরটি একজন বৃদ্ধা শামানের। বৃদ্ধাটি একটি বিশেষভঙ্গিতে কবরে শায়িতা ছিলেন। কবরটিতে বৃদ্ধার কংকাল ছাড়াও পাওয়া গেছে দশটি বড় বড় পাথর, পঞ্চাশটি কচ্ছপের খোল, গরুর লেজ এবং মানুষের পা! ঐ বৃদ্ধা নিশ্চয়ই তার জীবদ্দশায় ‘শীৎকারের কৌশল’ রপ্ত করেছিলেন। এই শীৎকার যৌনাত্মক নয়-দার্শনিক; কিংবা বলা যায় রিলিজিয়াস। কেননা, ঐ বৃদ্ধা বিশ্বাস করতেন বিশ্বজগৎ জীবন্ত; এবং আর্ন্তসর্ম্পকযুক্ত। এবং ছন্দোবদ্ধ সংগীত, উত্তেজক নেশা ও অবচেতনে উপকথামূলক অভিযান করে প্রাণি ও মানুষের উপশম করা যায়।
১২০০০ বছর আগেই মানুষের এমনতরো ধারণা ছিল ...আশ্চর্য!
পরবর্তীকালে, বহুদেবতায় বিশ্বাসী প্যাগান গ্রিক পৌত্তিলিক আচারআচরনে শামানদের গভীর ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে রসহ্যবাদী প্রতীকবাদী ধর্মানুষ্ঠানে শামানরা নানান রিচুয়াল করত। গ্রিক উপাসনালয়গুলি ছিল শামানদের প্রধান আখড়া। আমরা দেলফির মন্দিরের কথা জানি। দেলফির মন্দিরে পুরোহিত ছিলেন নারী; মানুষ ওখানে যেত ভবিষ্যৎ জানার জন্য যেত।
...পরে গ্রিসিয়শামানবাদ গ্রিস থেকে পৌঁছয় রোম-এ।
এরপর ৪র্থ শতক থেকে ইউরোপে খ্রিস্টপ্রচারিত একেশ্বরবাদ জনপ্রিয় হতে থাকলে শামানরা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে। একের পর এক গ্রিক উপাসনালয়গুলি ধ্বংস করা হয়। টিকে থাকার জন্য শামানরা বদলে ফেলে পেশা।
মধ্যযুগে অবস্থা হয়ে উঠেছিল আরও ভয়াবহ। তখন খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা ডাইনি নিপীরণ শুরু করেছিল। মধ্যযুগীয় সেই উইচরা তো আসলে শামানই। তো, খ্রিস্টান শুদ্ধবাদের ঠেলায় মেয়ে শামানদের জীবন হয়ে উঠল বিপদজনক। খ্রিস্টান মিশনারীরা যেখানেই গিয়েছে, শামানদের দেখে ‘অশুভ’ ঘোষনা করে ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছে। যেহেতু খ্রিস্টান মিশনারীদের কাছে শামানদের কৃত্যানুষ্ঠান মনে হয়েছে খ্রিস্টবিরোধী!
ওদিকে আবার শামানবাদ উল্টো খ্রিস্টধর্মকেই প্রভাবিত করে বসল। খ্রিস্টধর্মের যে উপাচারে রুটি ও মদের ব্যবহার হয়-তার উৎস তো শামানবাদই!
এভাবেই শামানবাদ মানবসংস্কৃতির একটি শক্তিশালী দিক বা অধ্যায়। এই কারণে, অশেষ দমন পীড়ন সত্ত্বেও শামানবাদ ইউরোপ ও এশিয়ায় কোনওক্রমে টিকে যায়। আজও ইউরোপে ফিনল্যান্ড থেকে হাঙ্গেরি অবধি এর বিস্তার। আমরা যে এক্সিমোদের কথা জানি-তারা নাকি সবাই শামানেরই বংশধর! আয়ারল্যান্ড তো ছিল শামানদের এক প্রধানতম কেন্দ্র। সেইসব কেল্টিক শামানরা বিশবাস করত বিশ্বজগৎ তিন ভাগে বিভক্ত। উচ্চ, মধ্য ও নিু। জীবনবৃক্ষের মাধ্যমে এই ত্রিজগতে যাওয়া যায়। জীবনবৃক্ষের আরেক নাম -মহৎবৃক্ষ। উচ্চজগৎ হলো আধ্যাত্বিক বা নক্ষত্রজগৎ। এখানেই জীবনের নীলনকশা খোদিত থাকে। মধ্যজগতে এখানে আমরা বাঁচি ও নিঃশ্বাস নেই। এখানে অন্য জগতের ছায়া পড়ে।নিুজগৎ হল পূর্বপুরুষের বা পূর্বনারীদের জগৎ । আমাদের চিন্তা ও আবেগের গভীর শিকড় এখানেই প্রোথিত। এটিই আমাদের সাইকির গভীরতা। এখনে জগতের আলোরা খেলা করে।
আর, আফ্রিকায় তো এখনও শামানদেরই স্বর্গরাজ্য। আফ্রিকার অনেক ঐহিত্যবাহী ধর্মই প্রকৃত প্রস্তাবে শামানবাদ। মধ্য মালির ডোগোন যাদুকরেরা (নারী ও পুরুষ) কি প্রকৃত প্রস্তাবে শামান নয়? ওদের প্রধানা দেবীর নাম আমা। মধ্য মালির ডোগোন যাদুকরেরা বলে যে তারা দেবী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। যোগাযোগ সম্পন্ন হলে দেবী আমা বলে দেয় কী ভাবে রোগীর রোগ সারাতে হবে। আফ্রিকার ঐহ্যিবাহী রোগ উপশমকারীকে বলা হয়: ‘উইচ ডাক্তার’। বুশম্যানদের পূর্বপুরুষেরাও ছিল শামান। তারা পাহাড়ের গুহায় দেওয়ালে পশুর ছবি আঁকত। বৃষ্টি নামাতে নাচগান করত। সাঙ্গোমা শব্দটি জুলু ভাষার একটি শব্দ। এর মানে শামান; যে জানে ( হি অর শি নোজ)
এশিয়ায় শামানপ্রধান অঞ্চল হলো সাইবেরিয়ায়। তখন আমি বলেছি, সাইবেরিয়ার যে রেইনডিয়ার শিকারী তুঙ্গাশ ভাষাভাষী ক্ষুদ্র ইভেঙ্ক স¤প্রদায় রয়েছে -শামান শব্দটি ওই ইভেঙ্ক স¤প্রদায়ের তুঙ্গাশ ভাষার শব্দ। এশিয়ার শামানদের আর একটি কেন্দ্র দক্ষিণ কোরিয়া। এখনও দক্ষিণ কোরিয়ায় শামান প্রধানত নারীরাই। এদের বলা হয়, মুডাংগাস। পুরুষ শামানদের (বিরল যদিও) বলা হয় বাকসো মুডাংগাস। কোরিও সমাজে শামানদের নাকি ভালো চোখে দেখা হয় না। তাওবাদী চিন এশিয় শামানবাদের আরেক কেন্দ্র। তাওবাদের স্রস্টা লাওৎ-সে কিছু রহস্যময় শ্লোলোক লিখেছিলেন তাঁর রচিত ‘তা ও তে কিং’ বইয়ে। সেব শ্লোক পরে শামানরা লুফে নিয়েছে।
জাপানের কামিপন্থি শিন্টোধর্মের মূলেও আসলে শামানবাদ।
আসলে শামানরা কোথায় নেই বলুন?
আর আমাদের সবচে চেনাজানা শামান হল তিব্বেেতর লামারা। ওখানকার বন স¤প্রদায় আসলে শামানবাদের অনুসারী ছিল। কাজেই তিব্বতে যখন বৌদ্ধ ধর্ম পৌঁছল-সে ধর্মটির আর শামানবাদী না হয়ে উপায় ছিল না। চতুদর্শ শতকের দিকে বৌদ্ধধর্ম তিব্বত, মঙ্গোলিয়া ও মাঞ্চুরিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলের লোকেরা মূলত দীর্ঘকাল ধরেই শামানবাদে বিশ্বাসী ।
আর আমাদের সবচে চেনাজানা শামান হল আর গ্রামবাঙলার গুণীন ওঝারা। আমার তো মনে হয় বাংলার সাপুড়েরাও একধরনের শামান। সাপুড়েদের তীর্থ হল আসামের কামরুপকামাখ্যা। আসামের পুরাতন নাম প্রাগজ্যোতিষপুর-নিশ্চয়ই একদা শামানবাদের তীর্থ ছিল। আসামের কামরুপে কামাখ্যা মন্দিরটি আজও আছে। সেখান থেকে ফিরে এসে নানাজন নানান কথা বলে।
যা হোক। শামানবাদের পূর্বেকার কারিশমা আজ আর না-থাকলেও এখন শামানবাদ আবার অন্যরুপে ফিরে এসেছে। আজকের দিনে শামানবাদকে বলা হয় নিওশামানিজম বা নব্যশামানবাদ। কথাটা বোঝার আগে বলি নিউ এজ মুভমেন্ট ব্যাপারটা আসলে কি। এক কথায় নিউ এজ মুভমেন্ট হল শাশ্বত সত্যের অন্বেষায় ইউরোপকেন্দ্রিক একটিআধ্যাত্বিক আন্দোলন। এবং এই নিউ এজ আন্দোলন শামানবাদের অনেক ধ্যানধারনা গ্রহন করেছে। এদের উদ্যোক্তারা শামানবাদ নিয়ে অত্যন্ত কৌতূহলী। তারা শামানবাদ সম্পর্কে গভীর জ্ঞানলাভের উদ্দেশে নাকি দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর দূর্গম পাহাড়েও যাচ্ছেন। এর পিছনে রয়েছে এক ধরনের তৃষ্ণা। সরল কথায়: আমরা এই যে জীবনযাপন করছি-এটি আসলে কি। দর্শনের বইয়ের পৃষ্ঠায় কোনও সদুত্তর মেলেনি। ওখানে কেবলই কূটতর্ক আর এক দার্শনিক মতবাদকে খন্ডন করে আরেক দার্শনিক মতবাদের আধিপত্য লাভের চেষ্টা। এর চে বরং প্রকৃতির উপাসক শামনদের জীবনদর্শনের প্রত্যক্ষভাবে খোঁজা হোক জীবনের পরমসত্য।
তো, নবযুগের গুরু কে?
আমার মনে হয় সুইস মনোবিজ্ঞানী কার্ল গুস্তাফ ইয়ূং। তিনি অনেক আগেই বলেছিলেন: পশ্চিমাবিশ্ব যুক্তির ভারে অচিরেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। তাইই কিন্তু হয়েছে। একুশ শতকে দেখতে পাচ্ছি নবযুগ বা নিউএজ জীবনদর্শন ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়ছে । এখনকার বিশিষ্ট সুরকাররা সব নিউ এজপন্থি...ইয়ানি, কিটারো, মার্কিন গিটারিষ্ট মার্টি ফ্রিডম্যান। এমন কী বিশিষ্ট পাকিস্তানি পপ সিঙ্গার নাজিয়া হাসানের সুরকার অসম্ভব প্রতিভাবন কম্পোজার বিদদু জীবনের সায়াহ্নে এসে আধ্যাত্বিক ধরনের কম্পোজিশনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
সবশেষে বলব, শামানরা আজ বিশ্বজুড়ে সেভাবে না থাকলেও শামানবাদ আজও আছে । কারণ, বিশ্বজগৎ মানুষের জানার আগ্রহ আজও আছে। বিজ্ঞান মানুষের প্রয়োজন মেটাচ্ছে ঠিকই-তবে বিজ্ঞান মানুষের কয়েকটি প্রশ্নের বিষয়ে নিরুত্তর। এসব কারণেই দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর দূর্গম পাহাড়েও চলে যাচ্ছে অতৃপ্ত কৌতূহলী মানুষ।
যা হোক, একুশ শতকে শামানবাদ টিকে থাকার কারণ- নিউ এজ মুভমেন্ট শামানবাদকে নতুন এক স্তরে উপনীত করেছে। শিল্পসাহিত্য ও সংগীতে নিউ এজ মুভমেন্ট এর গ্রহনযোগ্যতা ক্রমেই বাড়ছে। (এর একটি ভালো দিক এই যে, এভাবে আমার ধর্মীয় চেতনাও থাকল আবার আমি সেকুলারও থাকলাম। আমর ধর্মই শ্রেষ্ঠ বলার মতো হাস্যকর স্থূলতা থাকল না!) ...
শামানবাদ থাকবে। কেননা, শামানরা মানুষের দেহ ও মনের রোগ সারায়। যেহেতু, শামানবাদ থাকবে। শামানরা মনে করে জগৎ জীবন্ত ও আর্ন্তসর্ম্পকযুক্ত। ছন্দোবদ্ধ সংগীত, উত্তেজক নেশা ও অবচেতনে উপকথামূলক (মিথিয়) অভিযান করে মানুষের রোগশোকের উপশম করা যায়।কাজেই, শামানরা না হলেও শামানবাদ টিকে থাকবে। আর যদি আধুনিক বিজ্ঞান-বিশেষ করে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান শামানদের নির্মূল করে-তা হলে তা হলে মানুষ আরও অধিক সুস্থ্য ও সবল হয়ে বেঁচে থাকলেও মানুষ হারিয়ে ফেলবে অপার রহস্যময়তার একটি নিগূঢ় অধ্যায় ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন