মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

গভীর ঘুমের কবিতা

মাসুদা ভাট্টি


পাখি ওড়ে, তার ডানা আছে, আমি পাখি নই, মানুষ, আমার ডানা নেই - আতিয়া ভাবে, ভাবতে ভাবতে ও এক সময় সিদ্ধান্তে আসে, মানুষের ডানা থাকলেও খুব বেশি কিছু হতো না; মানুষকে কেউ পাখি বলতো না।এই গভীর দর্শণের সঙ্গে আতিয়ার গত জীবনকে কেউ যদি মেলাতে যান তাহলে অনেক বড় ভুল হবে।

আতিয়া চোখেমুখে কথা বলা মেয়ে, ওকে ছোটবেলা থেকেই শুনতে হয়েছে যে, ও দেখতে খুব সুন্দরী। স্কুল পেরিয়ে কলেজে ওঠার পর পরই পাড়ায় ওকে নিয়ে নানা কথা। একেতো সুন্দরী, তার ওপর সদা হাসিমুখ, যে ডাকে তার সঙ্গে হেসে কথা বলে, বাছ-বিচার নেই, তাকে নিয়ে কথা রটবে নাতো কি হবে? ও দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে, ও কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে, ও রিক্সাওয়ালার সঙ্গে গল্প করে, সেই গল্পের আসলে কোনও মা-বাপ নেই। শুধুই গল্প। কাউকে না পেলে ওদের মফস্বল শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো হাওয়ার গলায় দড়ি বেঁধে বসিয়ে তার সঙ্গে পারলে গল্প করে।

ওর বলার কথার অভাব নেই, কখনও হয় না। ওকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, “কী রে আতিয়া, সকালে কি দিয়ে ভাত খেলি?” আতিয়া না ভেবেই বলবে, “সকালে উঠতে আজ দেরি হয়েছেগো খুব, মা বকাবকি করে তুললেন, তারপর, মুখ ধুলাম, কী যে বাজে একটা পেস্ট এনেছে না আমাদের নিমু, বেচারাই বা কি করবে? বাজার থেকে তো সহজে পয়সা মারতে পারে না, আর ওকে তো একটা ফুটো পয়সাও কেউ হাতে তুলে দেবে না, তাই বাজার থেকেই দু’চার পয়সা যা হোক মেরে মার্বেল গুলি কিংবা পুরি-সিঙাড়া খায়, এইতো সেদিন নিমুকে নিখিল ওর দোকানে রেখে দিতে চাইলো। নিমু এসে মাকে বললো, খালাম্মা, আমি আর থাকতাম না আপনেগো বাড়িত। মা মুখ ব্যাজার করে জিজ্ঞেস করলেন, ক্যানরে নিমু? থাকবি না কই যাবি? বোকা নিমু ফর ফর করে নিখিলের দোকানে ওর নতুন চাকরির কথা মাকে বলে দিলো। আর যায় কোথায়, মা তখনই বাবাকে বলে নিখিলের দোকানে পাঠালেন। বাবা কিছুক্ষণ পরেই নিখিলকে সঙ্গে করে এলেন বাড়িতে, নিখিল এসে মাকে বলে, মাসিমা ডেকেছেন আমায়? মা কি সহজে নিখিলের সঙ্গে কথা বলে? নিখিল অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলে, আমায় ক্ষমা করেন মাসিমা, আমার ভুল হয়ে গেছে, এরকম আর হবে না মাসিমা, নিমুকে দিয়ে এইবার ধোয়া কাপড়গুলো আমার দোকানে পাঠিয়ে দেবেন মাসিমা, আমি ইস্ত্রী করে দেবো, পয়সা দিতে হবে না, আপনি যে মাফ করলেন তার প্রমাণ। নিখিলটা কি বোকা, মাকে চেনে না, মায়ের রাগ কি থাকতো নাকি? কিছুক্ষণ পরেই পড়ে যেতো” – এ পর্যন্ত বলে আতিয়া দম নেয় একটু, তারপর যখন নুতন শক্তিতে শুরু হয় তখন প্রশ্নকারীর ধৈর্যকে সত্যিই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। অবাক বিস্ময়ে আতিয়ার চোখের দিকে, মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করা থাকে না। নাতি-ফর্সা মুখে টানা টানা গভীর চোখ দু’টো তখন সামনের মানুষটিকে দ্বন্দ্বে ফেলে দেয়, মানুষটি তখন রাগ আর বিস্ময়ের মাঝামাঝি অনেকক্ষণ থমকে থাকে, থাকতে বাধ্য হয়।

জেলা শহরের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্স শেষ করার মাস খানেকের মাথায়ই বিয়ে হয়ে যায় আতিয়ার। এতো মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষে ভালোবেসে বিয়ে করে আতিয়া খোকনকে। ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা, হৃষ্টপুষ্ট শরীরের খোকনকে খেলোয়াড়দের মতো দেখালেও আসলে সে কবি। জীবনে কোনওদিন ফুটবলে পা লাগিয়েছে কি না সন্দেহ, লাগালেও স্কুল পেরোনোর আগে যখন ছেলে কিংবা মেয়ে, যে কেউই পায়ের কাছে ফুটবল পেলে তাতে একটা লাত্থি মেরে দ্যাখে, কতোদূর যায়। খোকন কম কথা বলা বেশ ভার ভারিক্কি মানুষ। কিন্তু আতিয়ার সঙ্গে ওর ভাব-ভালোবাসা হওয়ার মূল কারণ, আতিয়ার ছট্ফটে কথা বলা স্বভাবটিই খোকনকে আকৃষ্ট করেছে। খোকন এই স্বীকারোক্তি বহুজনের কাছেই করেছে, ওরা যে সংগঠনটি করেছিল সেই জেলা শহরের বেশিরভাগ সংস্কৃতিমনা তরুণ-তরুণীদের নিয়ে, যার নামটাও খোকনেরই দেয়া, অনিকেত – সবাই জানতো খোকন কেন আতিয়াকে ভালোবাসে। খোকন পদার্থ বিদ্যায় মাস্টার্স শেষ করেই একটা চাকরি পেয়েছে ঢাকায়, তখনই আতিয়ারও অনার্স শেষ হলো, বিয়েটাও হলো। ওরা চমৎকার সংসার গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় এলো।মোহম্মদপুরের ছোট্ট বাসাটি ওদের দু’জনেরই বেশ পছন্দ, বেশ খানিকটা ভেতরে রিক্সা দিয়ে আসতে হয় যদিও, তারপরও জানালা দিয়ে অনেকখানি খোলা জায়গা, বর্ষায় ভরা জল ছুঁয়ে আসা উদাম হাওয়া, সব মিলিয়ে দারুণ।

খোকন অফিসে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে লোডশেডিং নিয়ে। ও ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই লোডশেডিং, প্রতিদিনকার এই ঘটনায় আতিয়ার একটি কথা প্রায়ই মনে হয়, ও কি খোকনের চেহারা ভুলে যাচ্ছে? অন্যদিকে খোকন তার নতুন চাকরি নিয়ে মহা ঝামেলায়, বাংলাদেশে কর্পোরেট সংস্কৃতির শুরুর দিকটা, অফিসের বসদের গোয়ার্তুমি সামলে, সারাদিন স্যার স্যার করে তিক্ত-বিরক্ত খোকন ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত ভালোই হতো, তার ওপর আবার ছুটির দিনেও তাকে মাঝে মাঝে অফিস করতে হতো। ঠিক সেই সময় ওর মাথায় আতিয়াকে সময় দেয়ার ব্যাপারটা ঠিক আসতো না।পদার্থ বিদ্যার ছাত্র খোকনকে আবার এমবিএ-টা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন ওর বস। খোকন খেয়ে না খেয়ে, অফিস সামলে এমবি-এ করে যাচ্ছিলো।বাড়ি ফিরে বিছানায় পড়ে ঘুমোনো আর মাঝে মধ্যে ছুটির দিনে বাড়ি থাকলে বই মুখে করে বসে থাকা খোকনকে তখন আর কবি হিসেবে চেনা যেতো না। একসময় খোকনের কবিতা ছাপা হতো জাতীয় দৈনিকগুলির সাহিত্য পাতায়, তখন ওর সাহিত্য-সাময়িকীর বিরোধী বন্ধুরা ওকে যখন-তখন আঘাত করতো কিন্তু এখন যখন ওর কবিতা ছাপাই হয় না কোথাও, তখন কিন্তু কেউ একবারও জানতে চায়নি, “কিরে শ্লা, তোর কবিতা ছাপায় না ক্যান কেউ আর আজকাল?”

খোকনের ভেতর এই না করা প্রশ্ন নিয়ে কোনও অভিমান নেই, একদমই নেই। কিন্তু আতিয়ার আছে। আতিয়ার অভিমান সারাদিন ঘরভর্তি হু হু করা বাতাসের ভেতর হামলে ফেরে, আতিয়া সকালে ওঠে, খোকনের জন্য নাশ্তা বানায়, বানাতে বানাতে কথা বলে নিজের মনে, খোকন তখনও বিছানায়, ঘড়িতে দেয়া এ্যালার্ম বেজে উঠবে যে কোনও মুহূর্তে। তার সেই মুহূর্ত থেকে ঘড়ি ধরে মাত্র কুড়ি মিনিট আতিয়ার হাতে, তাই ও আগে ভাগে উঠেই নাশ্তা বানাতে শুরু করে। নাশ্তা আর কি? রুটি, ডিম কিংবা আলু ভাজা, আগের রাতের অবশিষ্ট তরকারির ঝোলটা আরও একটু জাল দিয়ে কমিয়ে মাখা মাখা করে বাটিতে ঢেলে দেয়া, খোকনের সবচেয়ে পছন্দের এই খাবারটা। খবরের কাগজ সামনে নিয়ে খোকন তার বড় বড় চোখে পলক না ফেলে একটু একটু করে রুটি ছিঁড়ে তরকারি মাখিয়ে মুখে দেয়, আর চিবিয়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে আতিয়া বলে, “আমি ভর্তি হতে চাই, মাস্টার্সটা শুরু করবো। কী সে করবো ভাবছি”।

খোকন তখনও খাচ্ছে, ওর দৃষ্টি সংবাদপত্রের পাতায়। এপাশ থেকে আতিয়া সংবাদপত্রের প্রথম পাতা আর শেষ পাতা দেখতে পাচ্ছে। ওর মনে হলো, খবরের কাগজের পাতায় লম্বা একটা লাইন চলে গেছে, টেলিভিশনে যেমন খবর দেখানোর সময় নীচ দিয়ে লেখা চলে যায় সেরকম। আতিয়া তাকিয়ে আছে, পড়া যাচ্ছে না কেন লাইনগুলো? আতিয়া মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করে কিছুক্ষণ, ততোক্ষণে খোকনের খাওয়া শেষ। খোকন উঠে গ্যালো। বাথরুমে গিয়ে আবার দাঁত ব্রাশ করলো, খাবারের পর দাঁত ব্রাশ করা খোকনের দীর্ঘদিনের অভ্যেস। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে শোবার ঘরে ঢুকে গেলো, মিনিট খানেকের মধ্যে অফিসের পোশাক পরে খোকন আতিয়ার ঘাঁড়ের কাছে, ব্লাউজের বাইরে বেরিয়ে থাকা পিঠ, ঘাঁড়ের অনেকটা, খোকন সেখান মুখ নামিয়ে বলে, “আসি বউ।পাশের বাসার কাজের ছেলেটাকে দিয়ে বাজারটা করিয়ে নিও। টাকা রাখা আছে টেবিলের ড্রয়ারে”। আতিয়া মুখ তুলে কিছু বলার আগেই খোকন দরোজার কাছে, হালকা ক্রীম রঙের শার্ট আর ধূসর ট্রাউজারের সঙ্গে কালো জুতো, টাইটা আরেকটু উজ্জ্বল হলে ভালো হতো, আতিয়ার মনে হয় কথাটা যখন খোকন সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছে। আতিয়া তখনও ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে, সামনে রুটি, ডিমভাজা, বাসি তরকারি। আতিয়ার দিন শুরু হলো এবার।

খাও।খাও না, বসে আছো ক্যানো?
না আমি খাবো না।খেতে ইচ্ছে করছে না।
ক্যানো? শরীর খারাপ লাগছে?
নাহ্ আমার শরীর ঠিকই আছে।
তাহলে?
খাবো না, খাবো না, আমার ইচ্ছে – আতিয়া চেঁচিয়ে ওঠে।
এভাবে চেঁচায় না মনা, পাশের ফ্ল্যাট থেকে লোক শুনতে পাবে যে, কী বলবে তখন ওরা বলো তো? ভাববে না, নতুন বিয়ে করলে কি হবে? স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একদম ভাব-ভালোবাসা নেই?
ভাবুকগে, আমার কী আসে যায়?
তোমার কিচ্ছু এসে যায় না? আমার চোখে তাকিয়ে বলো তো?
এই তো, তোমার চোখের দিকে তাকিয়েই বলছি, আমার কিচ্ছু এসে যায় না।
তুমি মিথ্যে বলছো। দেখিতো আমাকে ছুঁয়ে বলো তো? এই নাও, আমার হাত ধরো, ধরো না।
নাহ্ ধরবো না।
তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে যে, আমি যখনই হাত চাইবো, দেবে, কখনও না করবে না।
আমি সেসব ভুলে গেছি। স..ব ভুলে গেছি।
না তুমি ভোলোনি, তুমি ভুলতে পারোই না। আচ্ছা তোমার মনে আছে আমরা যে পদ্মার পারে বেড়াতে যেতাম, অনেকক্ষণ ধরে হাঁটতাম, তুমি সারাক্ষণ শুধু কথা বলতে, আমি বলতাম, এই কথা বলো না, একটু চুপ করে থেকে এই ধুসর সৌন্দর্য দ্যাখো। তুমি শুনতে না। তুমি কথাই বলে যেতে। আমি অবশ্য তোমার চেয়ে তোমার কথাকেই বেশি ভালোবাসি, জানো তো?
না তুমি বাসো না, তুমি কিছুই ভালোবাসো না, না আমাকে, না আমার কথাকে। কতোদিন হয়েছে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলো না, বলোতো?
কেন প্রতিদিনই তো বলি। কিন্তু প্রতিদিনই একটি কথা বলে আমাকে কষ্ট দাও। ক্যানো দাও বলোতো?

আমি তো এই কথা আজ নতুন করে বলছিনে, আমি তো সেই কবে থেকেই তোমাকে বলেছি, তুমিই না শোনো না। তোমার মনে আছে, কবে আমি প্রথম তোমাকে কথাটা বলেছিলাম?
হ্যাঁ, আছে, খুব আছে।
কবে বলোতো?

কেন ওই যে একবার ভরা বর্ষায় আমরা কলেজ থেকে বেরিয়ে পদ্মা দেখতে গেলাম। কী ভয়ঙ্কর পানির চাপ, ঘূর্ণি, ঘোলা পানি ফুলে ফুলে উঠছে। তুমি আমার হাত চেপে ধরলে ভয়ে, সেই প্রথম তোমাকে ছুঁতে পারলাম আমি। আমি আনন্দে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলাম, আর তুমি হঠাৎ করেই আমায় বললে, “এ্যাই চলো না ঝাঁপ দেই, এই যে ঘূর্ণিটা আসছে আমাদের দু’জনকেই টেনে নিয়ে যাবে, আমরা আর উঠতে পারবো না, কী মজা হবে ভেবে দ্যাখো তো?” আমার কেমন যেনো ভয় করছিলো তোমার কথা শুনে। আমি এক টানে তোমাকে সরিয়ে আনলাম পানির কাছ থেকে। তোমার সে কি মন খারাপ হলো, তুমি একটানা তিন দিন আমার সঙ্গে কথা বললে না।

আমি খারাপ কি বলেছিলাম? ভরা বর্ষায় পদ্মার ওই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে তোমার ইচ্ছে করেনি মরে যেতে? ঝাঁপ দিতে? আমার তো ওই যে পদ্মা থেকে বেরিয়ে আসা খালে যে স্লুইস গেইটটা ছিল, বর্ষায় যেখানে জলের শব্দে শরীরে হিম ধরতো সেখানেও ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করতো। তোমাকে তো বলেওছি, কি বলিনি?

হ্যাঁ, বলেছো। কিন্তু কেন? কেন বলোতো? ওহ্, এই সময় আবার কে এলো? যাও তো দেখে এসো।
কে আবার? পাশের বাসার কাজের ছেলেটা, বাজারে যাচ্ছে হয়তো, যাবার আগে জেনে যাচ্ছে, আমাদের কিছু লাগবে কি না?

ওহ্ হ্যা, যাও না লক্ষ্মিটি, ওই যে ড্রয়ারে টাকা আছে, ওখান থেকে ওকে দিয়ে আসো, আর বলে দাও যা যা আনতে হবে। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, আমার না, তোমাকে ছাড়া কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় তোমাকে সামনে বসিয়ে সারাক্ষণ কথা বলি। যাও যাও সোনা।
যাচ্ছি, তুমি একটু বসো। ওহ্ কী আনতে বলবো ওকে? কী কী খাবে আজ?

আজ একটু ভালোমন্দ রান্না হোক না হয়, কী বলো? ইলিশ মাছ পাবে কি না কে জানে? বলে দেখো তো। আর কচু শাক আনতে বলো, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে রান্না করবে।হেলেঞ্চা শাকও পারলে, ডাল বেটে বড়া ভাজবে। একটা নারকোল আনতে বলে দাও, বুটের ডাল নারকোল দিয়ে খাওয়া হয় না অনেকদিন। এ্যাই তুমি চালকুমড়ো ভেজে শর্ষে বাটা দিয়ে মাখতে পারবে, ইস্ আমার জিভে জল আসছে। তুমি তাড়াতাড়ি যাও, আজ এসবই আনতে বলে দাও। বেচারা এখনও দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়। ওকে কিন্তু আজ দশটা টাকা দিও।

সে তোমাকে আর বলতে হবে না। ওকে আমি প্রায়ই দিই। ভয় লাগে কখন না পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি আবার রেগেটেগে যান। তার কাজের ছেলেকে দিয়ে বাজার করাই, টাকা পয়সা দিলে যদি আবার ভাবেন ভাগিয়ে নিয়ে আসতে চাইছি। আমার ভয় লাগে।

না, এরকম হয়তো ভাববে না। ওরাইতো বলেছেন তোমাকে ছেলেটাকে দিয়ে বাজার-টাজার করানোর জন্য, তাই না?
হ্যাঁ, তা বলেছেন অবশ্য।
তাহলে আর কি!
এই জানো ছেলেটা কি বললো?
কী?

বললো, “ভাবি, ঘরে কে? কার সঙ্গে কথা কন?” আমি বললাম, খবরদার, কাউকে বলিস না। আমার এক পুরুষ বন্ধু আসছে। বলবি না বল্ কাউকে? তোকে দশ টাকা বখশিস দিলাম আজ, ঠিক আছে? ও আমার দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি হেসে চলে গেলো।
তুমি কি পাগল হয়েছো?
কেনো?

আরে বাবা ছেলেটা একদিন না একদিন এই কথা মুখ ফস্কে বলে দেবে কাউকে আর সবাই তোমাকে সন্দেহ করতে শুরু করবে।
করলে করুক। তাও কিছু একটা করুক। এখন তো কিছুই হয় না। তাও মানুষ আমাকে নিয়ে কথা বলতে পারবে একটু।

তুমি না, তোমার এই পাগলামি তোমাকে কাঁদাবে একদিন, বুঝলে?
তুমি না কাঁদালেই হলো।এ্যাই চলো না, বারান্দায় গিয়ে বসি, বসবে?
চলো। তুমি গাছগুলোতে পানি দাও, আমি বসে বসে তোমায় দেখি।

জানো, একটা বেলি ফুলের গাছটা, যেটা ফরিদপুর থেকে আসার সময় আমাদের বাগান থেকে তুলে এনেছিলাম, এখন অনেক ফুল দিচ্ছে। বেলি ফুল সাদা হয় না? এটার রং গোলাপি।

ইস্ আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছে, আমিই না বললাম এই গোলাপি রঙের কথা, ভুলে গেলে?
তুমি বলেছিলে নাকি? জানো, আজকাল না আমার কিছুই মনে থাকে না।

তা থাকবে কেন? ঘরের ভেতর কাকে নিয়ে এসে সারাদিন গল্প করো, আমার কথা মনে থাকবে কেন?

চুপ করবে? আমিতো দুষ্টুমি করেছি ছেলেটার সঙ্গে। আচ্ছা শোনো, তোমার কবিতা শুনিনি অনেকদিন। শোনো আজ?
অবশ্যই শোনাবো, তবে এখন নয়।
কখন?
রাতে খেয়ে-দেয়ে, বাতি নিবিয়ে, শুয়ে শুয়ে, তোমাকে জড়িয়ে ধরে, কবিতা শোনাবো আজ।
তুমি তো বিছানায় ঢুকেই ঘুমিয়ে পড়ো।
না, আজ ঘুমুবো না। প্রমিস।
সত্যিই তো।
অবশ্যই, তোমাকে একদম তরতাজা কবিতাটি শোনাবো, তোমাকে নিয়েই লেখা। এখনও কোনও কাগজে দেইনি।
আমি কিন্তু জীবনানন্দও শুনতে চাই, শোনাবে?
হুঁ শোনাবো, তোমাকে শোনাবো নাতো কাকে শোনাবো মনা?
ইস্ লক্ষ্মি আমার, তুমি আমার মনা পাখি।
তুমি আমার পাখি।এ্যাই আবার বেল বাজে। এবার কে? তোমার সেই লোকটা নয় তো?
না অসভ্য, এবারও ছেলেটাই, বাজার নিয়ে এসেছে। তোমার পছন্দের সব কিছু এনেছে, আমি যাই দরোজা খুলে দেই গিয়ে। তুমি এখানেই বসো প্লিজ। আমি আসছি।
আচ্ছা, কী আর করা, মহারাণীর জন্য বসে না থেকে উপায় কি? আমার কি আর যাওয়ার জায়গা আছে? মহারাণী ছাড়া। এই অধমকে কৃপা করে কখন মহারাণী দ্যাখা দেবেন, তার ওপর ভরসা করা ছাড়া গতি কি?

ইস্ কী কথা, যাও, চুপ করে বসো।
যো হুমুক মালিকৃ ওহ্ নো নো মালকিন।
শোনো এক কাজ করো, রান্না ঘরে চলে এসো। আমি রান্না করবো, তুমি দেখবে। ঠিক আছে?
জ্বি, মালকিন।

আতিয়া রান্না করে, ইলিশ মাছ অনেক পেঁয়াজ দিয়ে মাখা মাখা ঝোল; কাঁটাকুটি দিয়ে কচু শাক; আঁধখানা চাঁদের মতো করে চালকুমড়ো কেটে সব মশলা একটু একটু করে মেখে ডুবো তেলে ভেজে তারপর অনেক রসুন আর শুকনো মরিচ মিশিয়ে বাটা শর্ষে দিয়ে মেখে সাজিয়ে রাখে বাটিতে; মুগের ডাল করে মুচমুচে করে আলু ভাজা ফোড়ন দিয়ে; আর ডাল বেটে রাখে রসুন আর কাঁচা মরিচ দিয়ে, হেলেঞ্চা শাকের বড়া করে দেবে খাবার টেবিলে দেয়ার আগে। তারপর নিজে গোসল করতে যায়, ততোক্ষণে অবশ্য সন্ধ্যা হয় হয়। জানালা দিয়ে ঢাকা রক্ষা বাঁধ দেখা যায় বলে ওর ধারণা।তার থেকেও অনেকখানি দূরে সূর্য অস্ত যায়।

এ্যাই, এখন খাবে?
এখনই, মাত্র তো সন্ধ্যে হলো। একটু পরেই খাই, তোমার কি ক্ষিদে পেয়েছে?
না না, পাগল নাকি? তোমাকে রেখে আমি কখনও খেয়েছি?
তা খাওনি, কিন্তু তোমার ক্ষিদে পেতে পারে না? সকালে তো সেই এক খানা রুটি খেয়েছো। সারাদিনতো কিছুই মুখে দিতে দেখলাম না।

আমার অতো খেতে হয় না, তোমার সঙ্গেই বসে খাবো।
ঠিক আছে ম্যাডাম, আমার সঙ্গেই না হয় খাবেন। দেখুনতো ক’টা বাজলো?
এইতো, সাড়ে আট।
তাই? তাহলে আর আধ ঘন্টা। আসছি। তুমি টিভি দ্যাখো, আমি আসছি। ওক্কে?
ঠিক আছে।

টিভিতে নাটকটি শেষের পর্যায়ে, দরোজায় তখনই ঘন্টা বাজলো। আতিয়া উঠে গিয়ে দরোজা খুলে দিলো। ঘাম চকচকে মুখে খোকন ঘরে ঢুকেই টেবিলের ওপর রাখা জগ থেকে গ্লাশে পানি নিয়ে ঢক্ ঢক্ করে খেলো। পানি খেতে খেতেই বললো, “এই খেতে দেবে, প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছে”।
আতিয়া খাবার টেবিলে খাবার সাজালো, খোকন অফিসের কাপড় ছেড়ে, হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসে ওর পছন্দের সব আয়োজন দেখে খুশি হলো। হুড়মুড় করে খেলো। খাওয়া শেষ হলে হাত মুছতে মুছতে শোবার ঘরের দিকে হাঁটা দিতেই লোডশেডিং।অন্ধকার হাতড়ে ও বিছানায় চলে গেলো। আতিয়া মোম বাতি ধরিয়ে খাবার টেবিল গুছিয়ে, বেঁচে যাওয়া খাবার-দাবার ফ্রিজে রেখে, দাঁত ব্রাশ করে বিছানায় এলো। তখনও লোডশেডিং, বিছানায় ওঠার আগে মোমবাতি নিবিয়ে দিলো। তারপর খোকনের পাশে শুয়ে ফিস্ ফিস্ করে বলে, “কবিতাটা শোনাও, তুমি প্রমিস করেছো আজ”।

খোকন তখন গভীর ঘুমে। আঁধারে সেই ঘুম দ্যাখা যায় না, আতিয়া অনুভব করতে পারে পাশের ঘুমন্ত মানুষটিকে।

সকালে অফিস যাওয়ার আগে নাশ্তার টেবিলে আগের রাতের বাসি তরকারি দিয়ে খোকন রুটি খায়, সামনে খবরের কাগজ, আতিয়া সামনে বসে বলে, “আমি ভর্তি হতে চাই, মাস্টার্সটা করতে চাই”। খোকন তখনও খবরের কাগজের ভেতরের পাতায়, আতিয়ার সামনে প্রথম ও শেষ পাতা, আর সেখানে একটি লাইন টিভির পর্দায় খবরের সময় যেমন ভেসে যেতে থাকে, তেমনই ভেসে যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন