মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

দ্বি-জাতি নয়, ধর্মের একত্ববাদই মূল কথা

মাসুদা ভাট্টি


(ঘোষণাঃ বর্তমান নিবন্ধটি লেখকের নিজস্ব বক্তব্য এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বই-পুস্তক থেকে গৃহীত তথ্য থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত। তাই একটি বিবলিওগ্রাফির’র বাইরে নির্দিষ্ট কোনও পুস্তক কিংবা পৃষ্ঠার কথা এখানে উল্লেখ করা হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কারও পুস্তক থেকে ধার করে নিজের সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠার তাত্ত্বিকতায় আমি বিশ্বাসীও নই। অতএব, লেখাটি আমার নিজস্ব মতামত এবং চিন্তাভাবনার ফসল হিসেবে ধরে নিয়ে পাঠ করলেই খুশি হবো)

কথা দিয়েছিলাম দ্বি-জাতিতত্ত্ব নিয়ে লিখবো, কিন্তু লিখতে বসে সিদ্ধান্ত বদলালাম, কারণ আসলে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বলে কিছু নেই, মূল কথা হচ্ছে এক-জাতিতত্ত্ব। যেহেতু এর মূল নির্যাস হচ্ছে ধর্মবাদ তথা ইসলাম সেহেতু একটি ধর্মগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় প্রাধান্য পাইয়ে দেওয়ার যে তত্ত্ব বা বাদ তাকে দ্বি-জাতিতত্ত্ব বলার কোনও কারণ দেখি না। ভারত ভাগের প্রেক্ষিতে জিন্নাহ্ যদিও বা দ্বি-জাতিতত্ত্বের ধূয়া তুলেছিলেন কিন্তু তা বিভাজিত পাকিস্তানে এসে আর দ্বি থাকেনি, পরিণত হয়েছিল একত্বে। আমাদের ভুললে চলবে না যে, ইসলাম একত্ববাদী ধর্ম এবং এটাই যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং এর বাইরে যে আর কিছু আছে বা থাকতে পারে ইসলাম সেটা স্বীকারও করে না। যেখানে পালিত ধর্মটি অন্য কোনও ধর্ম বা বিশ্বাসকে স্বীকৃতিই দেয় না সেখানে ধর্মবিশ্বাসীরা কি করে অন্য কোনও ধর্মে বিশ্বাসীদের ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্রে স্থান করে দেবে? এটা তো খুব সহজ এবং সাধারণ একটি হিসেব।

ভারত-ভাগ ও তার এপাশে-ওপাশে দশ বছর কালকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই একটি পক্ষ ইংরেজ শাসক শ্রেণীর হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করতে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করার লক্ষ্য নিয়ে ছুটছে, আর অপর পক্ষটি কখনও ইংরেজের দালালি করে, তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতার অংশীদারীত্বেই খুশী থেকেছে। এই দ্বিতীয় পক্ষটিই যখন বুঝতে পেরেছে যে, স্বাধীনতা আসন্ন তখন ভেবেছে যে কোনও মূল্যেই হোক না কেন, তাদের অংশটি সম্পূর্ণটাই তাদের একার হতে হবে, নইলে ধর্মবিশ্বাসের মতোই তাদের একত্ববাদে হানি ঘটবে। নইলে যে পরিস্থিতি এবং সময়ে জিন্নাহ্ সাহেব দ্বি-জাতিতত্ত্বটি প্রকাশ্যে আনেন তখন কারুর পক্ষেই স্বাধীনতা-ভিন্ন অন্য কোনও কিছু চিন্তায় আনা সম্ভব নয়। অথচ দেখুন, এই পক্ষটি কিন্তু ভারত-ভ’মে বহিরাগত, অন্ততঃ তাদের ধর্মতো বটেই।
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো, ভারতবর্ষে ইসলাম এসেছে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন স্তরে, কিন্তু কোনওটাই যে খুব একটা শান্তির প্রক্রিয়ায় ঘটেছে তা বলা যাবে না। বরং বার বার সোমনাথের মন্দির লুটের ঘটনা থেকে শুরু করে দিল্লি বিজয়, বঙ্গ বিজয় ইত্যাদি ঘটনাবলী রক্তপাতহীন ভাবাটা এক ধরনের বোকামিই। ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী কথিত সতের জন সৈন্য নিয়ে লক্ষণ সেনের প্রাসাদে ঢুকে বঙ্গ-বিজয় করেন Ñ এটা মিথ, আসল সত্য খুঁজে পাবেন আদিনা মসজিদ কিংবা সোনা মসজিদের মতো পুরোনো মসজিদগুলির দেয়ালে যেখানে দেখা যায় হিন্দু মন্দিরের পাথর, দেবতাদের পাথুরে-পট। শাহ্জালাল সিলেটের গোবিন্দ-রাজাকে পরাজিত করেন জালালী-কবুতর পাঠিয়ে এই সত্য যারা বিশ্বাস করবেন তাদেরকে কোনও সত্য দিয়েই বোঝানো সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এই যে বহিরাগত মুসলিম শাসক, তারা এদেশে মিশে গিয়েছেন কিংবা এদেশেই স্থিতু হয়েছেন সে সত্যও অনেকটাই পরের দিকের ঐতিহাসিকদের মনগড়া তথ্য। কারণ বঙ্গ থেকে দিল্লি হয়ে আফগানিস্তানের দিকে যে পথ চলে গেছে, যা বিখ্যাত উত্তরা-পথ নামে ইতিহাস-খ্যাত, মুসলিম শাসকগণ সর্বাগ্রে সেই পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন যাতে ওই পথে ভারতবর্ষ থেকে লুটের মাল সরানো সহজ হয়। হ্যাঁ, তারা যৌধবাঈ কিংবা উদয়পুরের রাজকন্যাকে বিয়ে করেছেন সত্য, কিংবা বাঙালি কন্যার কমনীয়তায় ভুলে এখানে একটি ঘর বেঁধেছেন সত্য কিন্তু সে ঘর যে তাদের মূল-ঘর নয় তার প্রমাণ হচ্ছে তাদের ভারত-বংশকে শিক্ষিত করতে কোনও মুসলিম শাসকই ভারতবর্ষে একটি বিদ্যাপীঠও স্থাপন করেননি। অবশ্য ইসলামে বিদ্যাশিক্ষাকে একটু দূরে সরিয়েই রাখা হয়েছিল কারণ তাতে মানুষের জ্ঞানচু খুলে যেতে পারে, তারা সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারে Ñ হতে পারে একারণেও তারা কোনও বিদ্যাপীঠ স্থাপনের দিকে হাত বাড়াননি।
যাহোক, দীর্ঘ মুসলিম শাসনের পরাজয় ঘটিয়ে ইংরেজ শাসনভার নেওয়ার আগে যে বিদ্রোহ ভারতবর্ষে দেখা দেয় তাতে হিন্দু-মুসলিম উভয়েই কিন্তু অংশ নিয়েছে সমানভাবে। আমরা স্মরণ করতে পারি শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর দিল্লিতে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তাতে হিন্দু সেনাপতিরাই নেতৃত্ব দেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি, ইংরেজ ভারতবর্ষের শাসনভার তুলে নিয়েছে নিজ হাতে, এবং হিন্দুরা ভেবেছে অন্ততঃ মুসলিম শাসনের চেয়ে খ্রীস্ট শাসন ভালো হবে। তবে এই চিন্তায় বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে বর্ণহিন্দুর আধীক্যই ছিল, এবং মুসলিম আতরাফ-শ্রেণীও কিন্তু খানবাহাদুর খেতাব আর ক্ষমতার খুঁদকুড়োর জন্য কম লালায়িত থাকেনি। কিন্তু কালান্তকে ইংরেজ শাসনকে বুড়ো অঙ্গুলি দেখানোর ধৃষ্ঠতা যদিও শুরু করেছে হিন্দুরাই, তাও বর্ণহিন্দুরাই। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের তালিকা থেকেই তা সহজে বোঝা যায়। এবং আরও মজার ব্যাপার হলো, এই বিপ্লবীদের একটি বিশাল অংশ হচ্ছে পূর্ব বাংলার অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের। বীর প্রসবিনী বাংলা - এমনি এমনিই নাম হয়নি। কেউ যদি ব্রিটিশ সরকারের বেঙ্গল গেজেট-এ চোখ রাখেন তাহলে দেখতে পাবেন, বাংলার এমন কোনও এলাকা ছিল না যেখান থেকে ব্রিটিশ পুলিশের গোয়েন্দা রিপোর্ট আসেনি কোনও একজন বিপ্লবীর নামে, এবং এই নামগুলির পদবীও বিস্ময়কর।
(ক্রমশঃ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন