বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০০৯


সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ যখন আমি…(কিস্তি ১)


চঞ্চল আশরাফ | ২৮ এপ্রিল ২০০৮ ২:১১ অপরাহ্ন
হুমায়ুন আজাদ

১৯৯০ সালের খুব সম্ভবত এপ্রিলে, মাঝামাঝি কোনও এক দিনে হুমায়ুন আজাদের সামনে নিজের কবিতা নিয়ে হাজির হওয়ার প্রথম সুযোগটি পাই। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল টিএসসি ক্যাফেটেরিয়ার দক্ষিণপাশে, রোদ-ঝলমল বিকালে, বেশ অনাড়ম্বরভাবে। উদ্যোক্তা ছিল মঙ্গলসন্ধ্যা। মিহির মুসাকী, সরকার আমিন, লিয়াকত জুয়েল কবিতা পড়েছিলেন। সবার শেষে আমার পালা এলে আমি সে-সময়ের লেখা নিজের সবচেয়ে ভালো কবিতাটি পড়ি। পড়ার সময় থেকে বুকে যে কাঁপুনি শুরু হয়েছিল, তা অনুষ্ঠান শেষ-হওয়া পর্যন্ত ছিল। সবার কবিতা পড়া শেষ হলে হুমায়ুন আজাদ সে-সব নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। কার কবিতা নিয়ে কী বলছেন সেদিকে আমার খেয়াল নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ, (অন্যরা গোল্লায় যাক) আমার কবিতা নিয়ে তিনি কী বলেন, সেই ভাবনায় আচ্ছন্ন ছিলাম তখন। কিন্তু কিছুই বললেন না। শুধু সামান্য তাচ্ছিল্যের হাসি মিশিয়ে আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওকে আল মাহমুদের ছেলে বলেই মনে হয়। এ্যাই, তুমি তার ছেলে না-কি!’
—————————————————————–
আমার কবিতা নিয়ে তিনি কী বলেন, সেই ভাবনায় আচ্ছন্ন ছিলাম তখন। কিন্তু কিছুই বললেন না। শুধু সামান্য তাচ্ছিল্যের হাসি মিশিয়ে আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওকে আল মাহমুদের ছেলে বলেই মনে হয়। এ্যাই, তুমি তার ছেলে না-কি!’
—————————————————————–
উল্লেখ বাহুল্য নয়, ১৯৯২ সালে আন্ওয়ার আহমদের বাসায় আল মাহমুদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই আমি তা বলি এবং তিনি আমাকে নিজের পুত্র বলে ঘোষণা দেন। শুনে আন্ওয়ার ভাই হেসে ওঠেন। আমি বলি যে ব্যাপারটা নিয়ে গর্ব করা যেত যদি আমি কবিতা না-লিখতাম; যদি বাপের পরিচয়ে আমার চলতে হতো। আর, আমার জন্মদাতা বেঁচে আছেন। যা-ই হোক, সাহিত্যিক হিসেবে হুমায়ুন আজাদের সামনে আমার প্রথম উপস্থিতি সুখকর হয় নি। অবশ্য পরে সাপ্তাহিক বিশ্বদর্পণ-এর ঈদসংখ্যায় কবিতাটি ছাপা হলে (সরকার আমিন কবিতাটি সেখানে ছাপতে দিয়েছিলেন) তা সেই অভিজ্ঞতায় অনেকটা মলমের মত কাজ করেছিল। সত্যি বলতে কী, কবিতাটি ভালো ছিল না। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের ভাব ও শব্দসর্বস্বতা দিয়ে লেখা হয়েছিল এটি; যদিও এর চেয়ে বাজে কবিতা এখনও প্রধান দৈনিকগুলোর সাময়িকীতে ছাপা হয়ে থাকে।

যা-ই হোক, ১৯৯২ সালে আন্ওয়ার ভাই (তিনিও, হায়, আজ নেই; ২০০৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাতে নিঃসঙ্গ অবস্থায় লালমাটিয়ায় তাঁর ভাড়া-করা বাসায় মৃত্যু হয়) কিছুধ্বনির জন্যে আমাকে হুমাযুন আজাদের কবিতা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখতে বলেন। আমি রাজি হই; কিন্তু অলৌকিক ইস্টিমার ছাড়া তাঁর আর কোনও কাব্যগ্রন্থ তখন আমার কাছে ছিল না। তখন পর্যন্ত প্রকাশিত বাকি চারটির মধ্যে আমার পড়া ছিল দুটি বই: জ্বলো চিতাবাঘ ও সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। ওই দু’টি বই আমি সহপাঠি এবরার হোসেনের (ছড়াকার ও কবি; ১৯৯০ সালে, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় সাইপ্রাসে গিয়ে উন্মাদদশা নিয়ে দেশে ফিরে আসে এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়; আর সুস্থ হয় নি সে) কাছ থেকে নিয়ে পড়ে ফেরত দিই। চারটি বইয়ের জন্যে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন আজাদের কাছেই যেতে হল। প্রবন্ধ লিখব শুনে তিনি খুবই খুশি হলেন এবং পরদিন কাগজের প্যাকেটে ভরে বইগুলো নিয়ে এলেন। লেকচার থিয়েটারের সেই চেম্বার থেকে আমি তাঁর পিছু-পিছু প্রথমে বাংলা বিভাগের অফিসে, পরে কলা ভবনের মূল সিঁড়ির সামনে, বের হওয়ার পথে বাঁ-দিকে ফটোকপির দোকানে (সেখানে দু’পাশে তিনটি ফটোস্ট্যাটের দোকান ছিল তখন, এখন একটিও নেই) থামলাম। মার্চের শুরুতে, এক দুপুরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের চারটি বইয়ের ফটোকপি করিয়ে আমাকে দিলেন তিনি। আন্ওয়ার ভাই ওই কাজের জন্যে আমাকে টাকা দিয়েছিলেন; কিন্তু কবি নিজেই সেই ব্যয় বহন করায় তা আমার পকেটেই রয়ে গেল। সন্ধ্যায় সেই টাকা ফেরত দিতে চাইলে আন্ওয়ার ভাই ধমক দিয়ে বললেন যে হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে আমার কাজ শেষ হয় নি; তাঁর একটা সাক্ষাৎকার আমাকে নিতে হবে কিছুধ্বনির জন্যে।

সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা তাঁকে জানাতেই তিনি যে আরও খুশি হয়েছিলেন, তা আড়াল করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। এই বৈশিষ্ট্য তাঁর সারল্যের অংশ হিসেবে বহুবার আমি দেখেছি। একটা মাইক্রোরেকর্ডার নিয়ে দু’দিন পর বিকালে ফুলার রোডে তাঁর বাসায় হাজির হলাম। ড্রয়িং রুমে বসার পর প্রথমে তাঁর স্ত্রী লতিফা কোহিনুর এলেন। তাঁর সঙ্গে কথা হল। তিনি বললেন, হুমাযুন আজাদের স্পষ্টবাদিতার কারণে অন্যান্য কলিগের স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো নেই। প্রতিবেশী আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের স্ত্রী উদয়ন স্কুলের শিক্ষিকা, দু’বছর ধরে তিনি তাঁর সঙ্গে কথাই বন্ধ করে দিয়েছেন। এইসব কথাবার্তার মধ্যে হুমায়ুন আজাদ এসে বসলেন। জানতে চাইলেন, তাঁর কবিতার বইগুলো পড়েছি কি-না। রেকর্ডারটা ঠিক আছে কি-না পরীক্ষা করতে বললেন। এই ফাঁকে কলা, বিস্কুট আর চা এল। সাক্ষাৎকার শুরু হল। প্রথম প্রশ্নটি ছিল কবিতার আধুনিকতা ও নতুনত্ব — এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে এবং এর ব্যাখ্যাসমৃদ্ধ উত্তর পাওয়া গেল। সবকিছুই ঠিকমতো চলছিল। যখন তাঁর কবিতা নিয়ে কথা শুরু হল, গোলমালটা লাগল তখনই। ‘আপনার প্রথম দু’টি বই অলৌকিক ইস্টিমার ও জ্বলো চিতাবাঘ ছাড়া অন্য তিনটি শিল্পমনস্কতার দিক থেকে ব্যর্থ, কারণ এগুলোয় বিবৃতি আছে কেবল, কবিতা নেই’ — শুনে তিনি বললেন, ধর্মগ্রন্থের শ্লোকও বিবৃতি। আমি বললাম, ধর্মগ্রন্থকে কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করতে পারলে সুবিধা হতো, কিন্তু তা করা হয় না। তিনি ভীষণ রেগে গেলেন। বললেন, ‘আমার নামের আগে ডক্টর এবং প্রফেসর যুক্ত হওয়ায় আর সব মূর্খের মতো তুমিও আমাকে কবি বলে মানতে পারছ না। এই অবস্থায় আমার সাক্ষাৎকার নেয়া তোমার জন্যে উচিত হবে না।’ আমি বললাম, ‘কথাটা ঠিক না। আমি কেন এখানে এসেছি সেটা মনে করে দেখুন। আপনার কবিতা নিয়ে আমি প্রবন্ধ লিখব।’ শুনে তিনি বললেন, ‘আমার কবিতা সম্পর্কে তোমার যা ধারণা, তাতে ওই প্রবন্ধটা তো বিপজ্জনক হবে।’ বুঝতে পারলাম, এ-দফায় তাঁর
—————————————————————–
তিনি ভীষণ রেগে গেলেন। বললেন, ‘আমার নামের আগে ডক্টর এবং প্রফেসর যুক্ত হওয়ায় আর সব মূর্খের মতো তুমিও আমাকে কবি বলে মানতে পারছ না। এই অবস্থায় আমার সাক্ষাৎকার নেয়া তোমার জন্যে উচিত হবে না।’
—————————————————————–
সাক্ষাৎকার নেয়া সম্ভব নয়। আমি বের হয়ে এলাম। তখন ফুলার রোডের বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে।

ঘটনাটা আন্ওয়ার ভাইকে জানালাম। আমার সামনেই তিনি হুমায়ুন আজাদকে ফোন করলেন কিছুদিন আগে জোগাড়-করা এনালগ ফোন থেকে। তাঁকে বললেন যে সাক্ষাৎকারে অমন বাক-বিতণ্ডা হয়েই থাকে এবং সেটা না-হলে জমে না। তিনি যেন সাক্ষাৎকারটি আমাকে দেন সেজন্যে বোঝাতে লাগলেন এবং তোষামোদের পাশাপাশি নানারকমে যথাসাধ্য আশ্বস্ত করতে লাগলেন। যেমন, আমি আপনার কবিতার ভক্ত, আপনার ওপর কিছুধ্বনির বিশেষ সংখ্যা হবে, রূপম থেকে আপনার কবিতাসমগ্র বেরুবে, আপনাকে নিয়ে আমাদের অনেক পরিকল্পনা আছে ইত্যাদি। কথা শেষ হলে আন্ওয়ার ভাই সাকসেসফুল একটা চেহারা নিয়ে আমাকে আবার হুমায়ুন আজাদের কাছে যেতে বললেন।

সাক্ষাৎকারশেষে তাঁর বাসা থেকে বের হওয়ার সময় তিনি গ্রন্থনার পর তা দেখাতে বললেন। সারারাত ক্যাসেট বাজিয়ে পুরোটাই লিখলাম। কিন্তু তাঁকে না-দেখিয়েই তা কম্পোজে দেয়া হল আন্ওয়ার ভাইয়ের কথাতেই। (উল্লেখ বাহুল্য নয়, তখন রূপম প্রকাশনী, কিছুধ্বনি, সাহিত্য সাময়িকী ও রূপম-এর সমস্ত কম্পোজের কাজ হতো নাসা কম্পিউটারে। এটি ছিল আন্ওয়ার ভাই যে-বাসায় থাকতেন, তার চারতলায়, সালাউদ্দীন আহয়ুব (প্রাবন্ধিক, এখন আমেরিকায় আছেন) আর নাসির নামে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে-পড়া তার এক বন্ধুর বাসা ছিল সেটি।) যা হোক, সেই রাতে আন্ওয়ার ভাই আমাকে বাসায় ফিরতে দিলেন না। তাঁর পাশে আমার শোয়ার ব্যবস্থা হল, যদিও রাত কাটানোর জন্যে আরেকটা ঘর ছিল। কিন্তু সফলতার উত্তেজনায় তিনি আমাকে নিজের পাশে শুতে বাধ্য করলেন। মশারির ভিতরে তিনি ছটফট করছিলেন। একবার খাট থেকে নেমে ফ্লাস্ক থেকে দু’গ্লাসে পানি ঢেলে তাতে হুইস্কি মিশিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকলেন। আগের রাতে গ্রন্থনাজনিত অনিদ্রার কারণে খুব ঘুম পাচ্ছিল আমার; কিন্তু ওই গ্লাসটা আমাকে নিতেই হল। খাওয়া শেষ হলে গ্লাস দু’টি নিয়ে আবার খাট থেকে নামলেন। এবার ঢুকলেন মাইক্রোরেকর্ডারটি নিয়ে। ওটা অন করে ভল্যুম বাড়িয়ে দু’টি বালিশের মাঝখানে রাখলেন। হুমায়ুন আজাদের সাক্ষাৎকারটি সেই রাতে আমার কাছে উপভোগ্য বিষয়ের বদলে একটা উপদ্রব হিসেবে হাজির হয়েছিল। পরের সকাল থেকে কিছুদিনের জন্যে আমি তাঁর বাসায় যাওয়া বন্ধ করে দিলাম।

এর মধ্যে কখন যে কম্পোজ হয়ে লেখাটি হুমায়ুন আজাদের কাছে চলে গেছে, বুঝতেই পারি নি। লেকচার থিয়েটারের সামনে আমাকে দেখে তিনি বিকালে তাঁর বাসায় যেতে বললেন। গেলাম। তিনি আমাকে ভেতরের একটি ছোট ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে একটা কম্পিউটার আর কিছু বইপত্র টেবিলে এলোমেলো হয়ে ছিল। মেঝেতেও কিছু বই ছিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। দেখি, তিনি ওই সাক্ষাৎকারটি সংশোধন করছেন এবং কোথাও-কোথাও বদলেই ফেলছেন তাঁর কথাগুলো। প্রশ্নেও একই কাজ করছেন। ভাবলাম, এখানেই যদি এসব কাজ হয়ে যায়, তাহলে ক্যাসেটে ধারণ করা হল কেন, রাত জেগে তার কপি বানানোই-বা কেন; আমার দু’কান গরম হয়ে উঠল কিন্তু নিজেকে সংযত রাখতে পারলাম। ঠিক করলাম, তাঁর কবিতা সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখব না।

সিদ্ধান্তটি নিয়ে এখনও যন্ত্রণা বোধ করি। যদিও সান্ত্বনা হিসেবে এই কারণটি আবিষ্কার করেছি: ওই অভিজ্ঞতার চাপ প্রবন্ধটির ওপর পড়ত এবং সেই বয়সে তেমনটিই ছিল স্বাভাবিক। সেটা হুমায়ুন আজাদের জন্যেও প্রীতিকর হতো না। কিন্তু না-লিখেও বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল আমাকে। যেদিন কিছুধ্বনি বেরোয়, তার কয়েক দিন পর আন্ওয়ার ভাইয়ের বাসায় ঢুকতে গেলে বিছানায় বসেই তিনি দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে নাড়লেন, যার মানে, ‘এসো না’; আমি সরে গিয়ে গলিতে পায়চারি করতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে সালাউদ্দীন আইয়ুব বের হয়ে এলেন, পিছু-পিছু আন্ওয়ার ভাই। ‘তুমি স্যারের কবিতা নিয়ে প্রবন্ধ লেখো নাই কেন?’ প্রশ্নটার উত্তর দেব, এমন সময় আন্ওয়ার ভাই তাকে ‘তোমার স্যার একা বসে আছেন, তুমি যাও’ বলার পর তিনি চলে গেলেন। ইসমাইল লেনে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার আলো-অন্ধকারের মধ্যে প্রথম যে প্রশ্নটি শুনলাম, তাতে আমার কান ঝাঁ-ঝাঁ করতে লাগল। ‘তুমি কি তার কোন্ও ছাত্রীকে বিয়ের কথা বলে তাকে ভোগ করেছ? সিডিউস করেছ?’ তারপর ‘ওই ছাত্রীটি তোমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করে তোমার স্যারের কাছে চিঠি লিখেছে।’ এমনভাবে তিনি বলছেন যেন ঘটনাটি খুব উপভোগ্য। রাগে, দুঃখে, যন্ত্রণায় আমার শরীর কাঁপছিল। ‘যাকে তুমি এখানে নিয়ে আস, শোনো, সেই লিখেছে এই চিঠি। বুঝলে?’ (এখানে, এখন এই ঘটনার বিস্তারিত লিখতে চাই না, যদি কখন্ও আত্মজীবনী লেখার সুযোগ ঘটে, তখন, তাতে লিখব।) আন্ওয়ার ভাই আমাকে বললেন, ‘যদি এই কথাগুলো মিথ্যা হয় আর এর প্রতিবাদ যদি করতে পার, তাহলে আমার সঙ্গে আস।’ ঢুকে দেখি হুমায়ুন আজাদের এক হাতে গ্লাস, অন্য হাতে কিছুধ্বনির একটা কপি। বসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমার দিকে তাকালেন। তাঁর পরনে লাল গেঞ্জি আর জিন্স। ‘তুমি আমার কবিতা নিয়ে না-লিখে জয় গোস্বামীর কবিতা নিয়ে লিখেছ কেন?’ আন্ওয়ার ভাই বললেন, ‘ও আপনার কবিতার ওপর লিখবে, কিন্তু জয় গোস্বামীর মূল্যায়ন এখানে হয় নাই তো, ওকে দিয়ে আমিই প্রবন্ধটা লিখিয়েছি।’ আমি বললাম, ‘না, আমি নিজেই লিখেছি।’ শুনে তিনি ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘জয় গোস্বামীর কোন কবিতাটি আমার কবিতা থেকে ভালো, বলতে পারবে?’ বললাম, ‘সাহিত্যে এভাবে কিছু বলা যায় না। কিন্তু তার ভালো
—————————————————————–
ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘জয় গোস্বামীর কোন কবিতাটি আমার কবিতা থেকে ভালো, বলতে পারবে?’ বললাম, ‘সাহিত্যে এভাবে কিছু বলা যায় না। কিন্তু তার ভালো কবিতা আছে।’ বললেন, ‘পড়ে শোনাও।’ আমি চুপ করে রইলাম।
—————————————————————–
কবিতা আছে।’ বললেন, ‘পড়ে শোনাও।’ আমি চুপ করে রইলাম। তিনি আমার লেখা প্রবন্ধটি বের করলেন। ‘ডাল থেকে ঝোলে মৃত পশুদের ছাল’ বিড়বিড় করে পড়লেন। মুখ তুলে বললেন, ‘এইসব বালছাল যদি তোমার কাছে ভালো কবিতা হয়, তা হলে কবিতা সম্পর্কে তোমার ধারণা খুব বিপজ্জনক।’ আমি বললাম, ‘তা তো স্বাভাবিক, যখন অলৌকিক ইস্টিমারের একটি কবিতায় পড়ি: বৃষ্টি হচ্ছে যেন সৈনিকের পদপাত; আর ষাটের দশকের বৃটিশ কবি নরম্যান ম্যাকেজ আগেই তা লিখে ফেলেন: ইট ইজ রেইনিং লাইক সোলজার্স প্যারেডিং…’ শোনামাত্র তিনি ভীষণ ক্ষেপে যান। আন্ওয়ার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমাকে আপনি এজন্যেই কি এখানে আসতে বলেন?’ তিনি বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালে আন্ওয়ার ভাই তাঁকে ধরে বসিয়ে দেন এবং বলেন, ‘যা করার আপনার ছাত্র করেছে, সেজন্যে আমাকে অসম্মান করতে পারেন না।’ আমাকে ইঙ্গিত করে আন্ওয়ার ভাইকে তিনি বলেন, ‘ও কি বোঝে চেতনার ঐক্য কী জিনিস? পৃথিবীতে একই চেতনায় বহু কবিতা লেখা হয়ে থাকে, কিন্তু টিকে থাকে দু’একটি।’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি এটা জানো?’ এতক্ষণ চুপ-করে-থাকা সালাউদ্দীন আইয়ুব বললেন, ‘স্যার, আপনার কথাটা ঠিক। কিন্তু ষাটের বাংলা কবিতার যেগুলো খুব বিখ্যাত, সেগুলোর বেশির ভাগই তখনকার ইংরেজি কবিতার হুবহু অনুবাদ।’ হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘কোন কোন কবিতা, বলতে পারবে?’ আমি বললাম, ‘দ্য নিউ পোয়েট্রি নামে একটা কবিতার বই বেরিয়েছিল পেঙ্গুইন থেকে, ষাটের দশকের শুরুতে। জে ওলভারেজ সম্পাদিত ওই সংকলনটা ছিল চল্লিশ আর পঞ্চাশের দশকের আমেরিকান আর বৃটিশ কবিদের কবিতা নিয়ে। ষাটের বিখ্যাত কবিদের অনেকেই সংকলনটির বেশ ক’টি কবিতা অনুবাদ করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন। এই দলে আবুল হাসানও আছেন, কিন্তু লাইসেন্স প্লেটটা বদলানোর কাজ তাঁর মতো নিখুঁত ও মৌলিকভাবে আর কেউ করতে পারেন নাই।’ সালাউদ্দীন আইয়ুব বললেন, ‘এটা তো একটা বই। আরও আছে। নেরুদা আর লোরকার কবিতাও নিজের মতো করে এখানে লিখেছেন অনেকে।’ সেই আড্ডা রাত এগারোটা পার হয়ে যায়। এর মধ্যে হুমায়ুন আজাদ বিশ শতকের সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান এইসব নিয়ে কথা বলেন এবং আন্ওয়ার ভাইকে প্রস্তাব দেন কিছুধ্বনির বিশ শতক সংখ্যা প্রকাশের জন্যে। জানিয়েও দেন সেই সংখ্যার তিনিই হবেন সম্পাদক। ১৯৯২ সালে, সাহিত্য সাময়িকীর ডিসেম্বর সংখ্যায় কিছুধ্বনির বিশ শতক সংখ্যার বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়। কিন্তু সেটি আর বেরোয়নি। বের না-হওয়ার কারণ আমি আন্ওয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে পরে জানতে পারি। তা এই, একদিন আন্ওয়ার ভাইয়ের বাসার দেয়ালে বাঁধাই-করা আয়াতুল কুরসি দেখে হুমায়ুন আজাদ তাঁকে বলেন যে তিনি এত পশ্চাৎপদ তাঁর জানা ছিল না। আন্ওয়ার ভাই তাঁকে বলেন, ধর্মীয় কারণে নয়, এটা তিনি ঝুলিয়েছেন তাঁর মায়ের স্মৃতি হিসেবে। তিনি তাঁর এই অনুভূতি নিয়ে আর কোনও কথা বলতে তাঁকে নিষেধ করেন। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ তা অগ্রাহ্য করে এ-নিয়ে আরও কিছু বলতে গেলে তিনি তাঁকে বের হয়ে যেতে বলেন। হুমায়ুন আজাদ বের হলেন; কিছুধ্বনির বিশ শতক সংখ্যা বের হল না।



কিস্তি-২
..........
চঞ্চল আশরাফ | ১৬ মে ২০০৮ ৯:১০ পূর্বাহ্ন


বেশ ক’বার আমি হুমায়ুন আজাদকে ফুলার রোড থেকে নিউ ইস্কাটনে ইসমাইল লেনের সেই ৩৩ নম্বর বাসায় নিয়ে গেছি। সময়টা খুব সংক্ষিপ্ত, ১৯৯২ সালের মার্চ থেকে ১৯৯৩-র জানুয়ারি পর্যন্ত। সন্ধ্যার সামান্য আগে আমরা রিকশায় উঠতাম, আন্ওয়ার আহমদের বাসায় পৌঁছনোর আগেই রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠত।

খুব আড্ডা হতো। সেই সব আড্ডায় তারাই আসতেন, হুমায়ুন আজাদের ওপর যাদের অসন্তোষ নেই; যাদের ওপর হুমায়ুন আজাদের অসন্তোষ নেই। ফলে, তাঁর আগমনের দিনগুলোয় আন্ওয়ার ভাই অস্থিরতা ও উত্তেজনার মধ্যে থাকতেন। মাথায় সাহিত্যিকদের একটা লিস্ট নিয়ে সম্ভবত তাঁর এই অস্থিরতা — হুমায়ুন আজাদের অপ্রিয় কোনও ব্যক্তি যেন এসে না পড়েন। বা, তাঁকে সহ্য করতে পারেন না — এমন কারও আগমন অন্তত সেদিন যেন না ঘটে। আর, ওই বাসায় অনেক লেখকেরই, নিয়মিত ও অনিয়মিত আগমন ঘটত। এক সন্ধ্যায় আল মাহমুদ এসে ‘আন্ওয়ার, আন্ওয়ার’ বলে গলিতে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ডাকামাত্র তটস্থ হয়ে গৃহকর্তা গেটের দিকে ছুটে গেলেন এবং সেখান থেকেই তাঁকে বিদায় দিলেন। কারণ, বাসায় তখন হুমায়ুন আজাদ। মদ্যপানরত, আর হাতে মেলে-রাখা একটি বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছেন আমাদের সঙ্গে আর সিগারেট ফুঁকছেন। ‘আমি কি স্যারকে আজ নিয়ে আসব?’ ফোনে এ-জিজ্ঞাসার জবাবে আন্ওয়ার ভাই বলতেন, ‘না, আজকে আবদুল মান্নান সৈয়দ আসবে।’ এ-ধরনের ঘটনা বেশ ক’বার ঘটেছে।

আমার খুব কৌতূহল ছিল হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে আল মাহমুদের সম্পর্ক নিয়ে। মনে পড়ে, ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে, এক শুক্রবারের সকালবেলা সালাউদ্দীন আইয়ুবের বাসায় আল মাহমুদের কাছে এ-নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে আমার কাছে এসেছিল নিজের বউয়ের চাকরির তদ্বির করতে। আমি বলেছি, এসব কাজে আমি অভ্যস্ত না। এর পর থেকে সে আমাকে পছন্দ করবে কীভাবে?’

‘আমি শুনেছি আপনি প্রতিক্রিয়াশীল, মানে, রাজাকার হয়ে গেছেন বলে উনি আপনাকে…’

কথাটা তিনি শেষ করতে দিলেন না; কিন্তু যা তাঁর শোনার তা বলা হয়ে গেছে। ‘ওসব ফালতু কথা আমাকে বলো না। একাত্তরে যখন আমি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তখন এদেশের অনেক কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবী গ্রামের বাড়িতে গিয়ে অবকাশ যাপন করেছেন। পুকুরপাড়ে বসে কবিতা লিখেছেন স্বাধীনতা নিয়ে।’ রূপম-এ দেয়া নিজের সাক্ষাৎকারের প্রুফ দেখছিলেন তিনি। সে-কাজ আমার ওই কথা শোনার পর থেকেই থামিয়ে রেখেছেন; কিন্তু তাঁর কথা তখনও থামে না, ‘অথচ যুদ্ধ থেকে ফিরে যখন দেখলাম, আমার পরিবার উপোস কাটায় আর ড্রেনে ভাত বয়ে যায়; ওইসব বুদ্ধিজীবী ঢাকায় বেশ হর্তাকর্তা হয়ে গেছেন, আরাম-আয়েশ করছেন, তখন খুব যন্ত্রণা হল — এইজন্যে কি মুক্তিযুদ্ধ করেছি? শেখ মুজিব, ডেকে নিয়ে আমাকে চাকরি দিলেন। এতেও বাধা দেওয়ার লোকের অভাব ছিল না। তোমাদের মুস্তাফা নূরউল ইসলাম আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। শুনেছি, শেখ মুজিব বলেছিলেন, কবির আবার ডিগ্রি কী-রে? আর যা-ই হোক, শেখ মুজিবের সাংস্কৃতিক মন বাঙলায় আর কোনও নেতার নেই।’

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এ-সব কথা আল মাহমুদের কাছ থেকে বেশ ক’বার শুনেছি আমি। এ-ও তাঁর মুখ থেকে শুনেছি: তোমাদের শামসু মিয়াকে (শামসুর রাহমান) হুমায়ুন আজাদ তো নিঃসঙ্গ শেরপা বানিয়েছে। শেরপা শব্দের অর্থ কি জানে ওই অধ্যাপক? এর মানে হল কুলি। কুলি আবার নিঃসঙ্গ হয় কীভাবে?

বুঝতাম, শামসুর রাহমানের কবিতা নিয়ে হুমায়ুন আজাদ আস্ত একটা বই লিখেছেন বলে তাঁর মনে যন্ত্রণা ও হতাশা খুব আছে। শামসুর রাহমানের কদর সবার চেয়ে বেশি হওয়ায় তিনি যে দুঃখিত, তা নানাভাবে প্রকাশ পেত। যেমন — তিনি সে-সময় প্রায়ই বলতেন, ‘ঢাকায় এসে আমি যখন কবিতা লিখতে শুরু করি, তখন আমার অবস্থান সাতচল্লিশ নম্বরে। তখন জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীও অনেক বড় কবি। আজ আমার নাম শামসুর রাহমানের পরে উচ্চারিত হয়। কিছুদিন পরে একসঙ্গে হবে, তারপর এক নম্বরে, বুঝেছ? কিন্তু কুলি হওয়ার খায়েশ আমার নাই।’ বলতেন, ‘বাংলা কবিতার আধুনিকতার সংগঠক, বুঝেছ, বুদ্ধদেব বসু, আমার কবিতা ছেপেছিলেন, যখন পঞ্চাশের কারও কবিতা ওই বনেদি কাগজে ঠাঁই পায় নাই। বুদ্ধদেব, বুঝতে পারছ, তোমার গুরু হুমায়ুন আজাদেরও গুরু।’

আমি বলি, ‘কিন্তু যারা আপনার কবিতার অনুরাগী, তারাও যখন আপনাকে মৌলবাদী মনে করে কষ্ট পায় তখন আপনার কেমন লাগে?’

‘হ্যাঁ, তোমরা শামসুর রাহমানকে তোলার জন্যে আমাকে মৌলবাদী বানাইছ। এই দেশে একজনকে তোলার এইটা একটা বিজ্ঞান। ঠিক আছে, আমি মোল্লা। একবার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি ত পূর্ববঙ্গের মোল্লা। কথাটা আমার মনে ধরেছিল। আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, তুমি হইলা পশ্চিমবঙ্গের ব্রাহ্মণ, আমি হইলাম পূর্ববঙ্গের মোল্লা। পার্থক্যটা নিয়া একটু জড়াজড়ি কইরা নিলাম।’

‘তিনি আতরের গন্ধ পান নাই?’

‘না, ওদের সেই অনুভূতি আছে না-কি!’ বলে, সে কী হাসি আল মাহমুদের। ৩৩ ইসমাইল লেনের চারতলায় সালাউদ্দীনের রুমের সামনে বেশ বড় একটা ছাদবারান্দা; সেখানকার শীতরোদেও ছড়িয়ে পড়ে সেই হাস্যধ্বনি। বললেন, ‘যতই শহুরে হই না কেন, বেড রুমের জানালা দিয়ে এখনও আমার নাকে ঘাসের গন্ধ এসে লাগে।’

যা-ই হোক, খুব আড্ডা হতো। পরীক্ষা বা কোনও কাজ না-থাকলে সালাউদ্দীন আইয়ুব ছিলেন সেই আড্ডার অবধারিত সদস্য। গল্পকার পারভেজ হোসেন ঘন-ঘন আসতেন। মোহাম্মদ সাদিক, আসাদ মান্নান, সুশান্ত মজুমদার, আহমাদ মাযহার, নাসরীন জাহান — আরও অনেকেই আসতেন। কিন্তু একটা বিষয়ে আমার বেশ খটকা লাগত। সেটি হল, ওই বাসায় ব্রাত্য রাইসুর অনুপস্থিতি।

তিনি কিছুধ্বনি ফেব্র“য়ারি ১৯৯২ সংখ্যাটির সম্পাদক ছিলেন। এর কিছু বিশেষত্ব ছিল। যেমন, প্রচ্ছদে কোণাকুনি করে মুদ্রিত হয়েছিল — ‘ইহা লিটল ম্যাগ’; সেই সংখ্যায় ছিল অকালপ্রয়াত কবি অনন্য রায়কে নিয়ে ক্রোড়পত্র। এই রকম একজন সম্পাদক পত্রিকা প্রকাশের পর থেকে দফতরেই আসেন না, এটা কেমন কথা! আন্ওয়ার ভাইকে এ-প্রশ্ন করতেই তিনি তেলেবেগুনে-রকমের ক্ষেপে উঠে বলেন, ‘যাও, আমি রিকশাভাড়া দিচ্ছি, সুশান্ত মজুমদারের কাছ থেকে জেনে আস।’ এটা জানতে আমি যাই নি, আর তা জানাও হয় নি; যদিও রাইসুর সঙ্গে এরপর বহুবার দেখা হয়েছে।

হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে আমার স্মৃতিকথা ছেড়ে অনেক দূরে সরে গেছি। এবার সেই বিষয়ে ফিরতে চাই। বেশ ক’বার আমি হুমায়ুন আজাদকে আন্ওয়ার ভাইয়ের বাসা থেকে ফুলার রোডে তাঁর বাসায় পৌঁছে দিয়ে নিজের বাসায় ফিরেছি। তিনি আমাকে ভবনটির সিঁড়ি থেকে চলে যেতে বলতেন সেই রিকশাটি নিয়ে; তখন হয়ত রাত প্রায় ১১টা। অবশ্য খুব মদ্যপান হয়ে গেলে, তবেই আন্ওয়ার ভাই তাঁর সঙ্গে আমাকে যেতে বলতেন। শিভাস রিগ্যাল ছিল তাঁর প্রিয় ব্র্যান্ড। যে সন্ধ্যায় তাঁর সামনে প্রথমবার আন্ওয়ার ভাই শিভাস রিগ্যালের বোতল খোলেন, সেই সন্ধ্যা-রাতের কথা খুব মনে পড়ে। তো, বোতলটি খোলার সময় হুমায়ুন আজাদ জানতে চাইলেন এর সঙ্গে যে ছোট বোতলটি বোনাস হিসেবে দেওয়া হয়, তা আছে কি-না। আন্ওয়ার ভাই স্রেফ মজা করার জন্যে বললেন, ‘ওটা সব সময় আপনার এক ছাত্রের জন্যে রেখে দিই।’

তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এ-রকম মহাছাত্রের আবির্ভাব ঘটল কবে?’

আমাকে দেখিয়ে আন্ওয়ার ভাই বললেন, ‘সে আপনার পাশেই বসে আছে।’

‘এখন থেকে ওটা আমার জন্যে রেখে দেবেন।’

‘এই যে, এটা আজ সন্ধ্যার উপহার।’ বলে ছোট শিশিটা আন্ওয়ার ভাই হুমায়ুন আজাদের দিকে বাড়িয়ে দেন। সেটা তিনি ফতুয়ার পকেটে রাখলেন। সেদিন তাঁর মন যে বেশ ফুরফুরে ছিল, কথাবার্তা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। এই রকম তাঁকে আমি খুব কমই দেখেছি। এটা শিভাস রিগ্যালের কন্ট্রিবিউশন কি-না, বলতে পারি না। চুমুকের ফাঁকে-ফাঁকে তিনি আলাপের পাশাপাশি টিভি দেখছিলেন। সুন্দরী প্রিন্ট শাড়ির বিজ্ঞাপন দেখে তিনি বললেন, ‘বিজ্ঞাপনটি আমার ভালো লাগে, কী যেন নাম এই মেয়েটার?’

খাটের পাশে মোড়ায়-বসা পারভেজ হোসেন বললেন, ‘মৌসুমী।’

‘আঃ দারুণ তো! এটা দেখলে মোল্লাদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যােেব।’

আন্ওয়ার ভাই বললেন, ‘কেন, ওরা কি দেখে না ভাবছেন?’

‘মহিলাদের আঙুল দেখলেই ওদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। এটা তো মৌসুমীর নগ্ন বাহু।’ সিগারেটের একদলা ধোঁয়া তাঁর মুখ থেকে বের হয়ে খাটে মুখোমুখি বসে-থাকা আন্ওয়ার ভাইয়ের দিকে উড়ে যাচ্ছিল।

আমি বললাম, ‘স্যার, আপনি কি সিনেমা দেখেন?’

‘একসময় দেখতাম। এখনকার নায়ক-নায়িকাদের থলথলে শরীর দেখে গা গুলিয়ে যায়। অপুষ্টির দেশে এত মাংস! আর ওরা খুব চিৎকার করে কথা বলে। ওদের শরীরে বেশ জোর আছে!’

‘একটু আগে বললেন আপনি সিনেমা দেখেন না।’ পারভেজ হোসেন বললেন।

‘বাঙলা সিনেমা সম্পর্কে জানার জন্যে হলে যেতে হয় না। আমার স্টাডি রুম থেকেই চিৎকার আর বিজ্ঞাপন শুনে বুঝতে পারি, বাঙলা সিনেমা চলছে।’ তখন খালি-করা গ্লাসটি আন্ওয়ার ভাইয়ের দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন হুমায়ুন আজাদ, ভ’রে দেয়ার জন্যে।

আমি বলি, ‘নাটক দেখেন?’

‘আজকাল নাটক বলতে তো টিভি নাটকই বোঝে সবাই। ওগুলো যদি নাটক হয় তাহলে সোপ অপেরা কী? একবার ঈদের রাতে হাসির নাটক দেখতে বসেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল, নাট্যকার থেকে শুরু করে সবাই খুব পরিশ্রম করেছে হাসানোর জন্যে। মুলো ধ্বংস করতেও গর্দভের এত পরিশ্রম করতে হয় না।’

‘হাসতে পেরেছিলেন?’ আন্ওয়ার ভাই জানতে চাইলেন।

‘খুব ইচ্ছা ছিল হাসার; চেষ্টাও করেছিলাম।’

‘আপনি কি তরুণদের কবিতা পড়েন?’ আন্ওয়ার ভাই জিজ্ঞাসা করলেন।

‘তরুণ কারা?’

‘এই এখন যারা লিখছে।’

মুখ থেকে ধোঁয়া বের করে হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘এখন তো শামসুর রাহমানও লিখছেন। তবে সভাপতিত্ব করছেন তার চেয়েও বেশি।’

‘আমি বলছি যে এখন যারা লিখতে শুরু করেছে। যারা নতুন।’

‘পড়েছি। কিন্তু ওসব পড়ে বোঝা যায় বাঙলা ভাষা খুব বিপজ্জনক দূষণের দিকে যাচ্ছে। দিন-দিন এই ভাষার শব্দগুলো কবিতার জন্যে অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে। নতুন যারা লিখছে, তারা ভীষণ চেষ্টা করছে আলাদা একটা ভাষা তৈরির, কিন্তু সেটা পৃথিবীর ভাষা বলে তো মনে হয় না।’

আন্ওয়ার ভাই বললেন, ‘আমার তা মনে হয় না। এই যে, চঞ্চল, আপনার পাশে বসে আছে, ওর কবিতা পড়েছেন?’

‘আমার কথা থাক। কিন্তু আমাদের অনেকেই ভালো কবিতা লিখছেন।’ আমি কিছুটা আড়ষ্ট স্বরে বললাম।

‘আচ্ছা চঞ্চল, তোমার স্যারকে নিজের একটা কবিতা পড়ে শোনাও। দেখি, তোমাদের কবিতা নিয়ে উনার ধারণাটা ঠিক কি-না।’ আন্ওয়া ভাইয়ের কথা শুনে তিনি বললেন আমাকে, ‘হ্যাঁ, পড়ে শোনাও।’

আমি সে-সময়কার লেখা ‘বিলাসিতা’ নামের এই কবিতাটি পড়লাম :
তিনি সবকিছু অগ্রিম চাইতেন :
বৃক্ষের আগে ফল,
সন্ধ্যার আগে চাঁদ –
নিদ্রার আগে স্বপ্ন আর
সূর্যের আগে সকাল।

বিয়ের আগেই তিনি সন্তান চাইলেন,
তার প্রেমিকা গর্ভবতী হলো।
ঘরের আগে চাইলেন জানালা –
আয়তাকার কাঠের ফ্রেমগুলো খুব
দুলতে লাগলো শূন্যে; আর
ছাদের আগে পাখা চাইলে
গোল হয়ে ঘুরতে লাগলো বাতাস।

যেদিন তিনি নিজের গায়ে হাত বুলিয়ে দেখলেন :
তার চামড়ায় মালভূমির মতো ভাঁজ –
মৃত্যুর মিস্ত্রিকে ডেকে তিনি বানালেন
কারুকার্যময় কফিন আর কবর।

সেলাই না-করা শাদা পোশাকে শরীর গলিয়ে
এক লাফে ডিগবাজি খেলেন কফিনে
আর জুতার শব্দের মতো হাসতে লাগলেন –
তার প্রেমিকা ও সন্তানরা
কাঁধে নিয়ে চললো তাকে কবরের দিকে।…

গম্ভীর হয়ে শুনলেন তিনি। কিছুই বললেন না। কবিতাটি ১৯৯৫ সালে আগস্টের কোনও এক বিকালে শাহবাগে আজিজ মার্কেটের দোতলায় ব্রাত্য রাইসুকে শুনিয়েছি। সেখানে একটা মজার কাণ্ড ঘটেছিল। পরে, তা বলব।

বেশ রাত হয়ে গেলে চেয়ার ছেড়ে উঠবার মুহূর্তে ফতুয়ার পকেট থেকে শিভাস রিগ্যালের সেই ছোট্ট শিশিটা বের করলেন। আন্ওয়ার ভাই বললেন, ‘ওটা বাসায় খাবেন।’ তিনি সে-কথায় কান না-দিয়ে একটি গ্লাস চাইলেন। আন্ওয়ার ভাইয়ের বাড়িয়ে দেওয়া গ্লাসে একটু ঢেলে সেটি তাঁর দিকে এগিয়ে দিলেন। এবার শিশিটি উপুড় ক’রে (এক পেগের মতো হবে) কিছুক্ষণের জন্যে ধরলেন নিজের হাঁ-করা মুখে। তারপর বললেন যে, এখনই তিনি উঠবেন না, শিভাস রিগ্যাল তাঁকে নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে করিয়েছে। সেটা বলার এখনই যথার্থ সময়। ঘটনাটি এই: একবার শিভাস রিগ্যালের একটা বোতল নিয়ে নির্মলেন্দু গুণ আর হুমায়ুন আজাদ খুব বিপদে পড়েন। কোথায় বসে খাওয়া যায়, জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। তৃতীয় কাউকে তাঁরা আশা করছিলেন না, কারণ তাতে ভাগ কমে যাবে। হুমায়ুন আজাদের বাসায় মদ্যপান ছিল বারণ। শেষে নির্মলেন্দু গুণ এমন একটা জায়গা নির্বাচন করলেন, যেখানে যেতে হলে ডাস্টবিন পার-হওয়া বাধ্যতামূলক। নাক-চেপে রাখা সার্বক্ষণিক কর্তব্য। হুমায়ুন আজাদ আপত্তি করলে নির্মলেন্দু গুণ তাঁকে বলেন, ‘নেশা ও নিদ্রা নাসিকার ক্ষমতানাশক। দুই পেগেই জগতের সমূহ গন্ধ বিলীন হওয়ার কথা।’ বোতলটি যখন বের করা হয় বড় একটা ঠোঙা থেকে, তখন হুমায়ুন আজাদ বলে ওঠেন, ‘এ-যে আবর্জনার পাশে অপ্সরা!’

খুব পান করা হয়েছিল তাঁর সেই সন্ধ্যায়, রাতে। গলি থেকে রাস্তায় আসতে বাঁ-পাশের দেয়াল ধরছিলেন তিনি, টলতে-টলতে হাঁটার ফাঁকে-ফাঁকে। ‘স্যার’ বলে একবার আমি তাঁর হাত ধরতেই তিনি বললেন, ‘তুমি ঠিক আছ তো!’ রাস্তায় এসে একটা রিকশার দেখা মিলল। ‘এ্যাই, যাবে, ফুলার রোড?’ রিকশাঅলা আরোহীর আসনে বসে মাথা নেড়ে জানাল যে, যাবে না। তিনি এবার হ্যান্ডেল ধরলেন, নেশজড়ানো স্বরে ‘কেন, ওখানে কি রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা থাকে?’ বলে, ঘণ্টা বাজালেন, ‘নামো আসন থেকে। হুমায়ুন আজাদকে বসতে দাও।’ রিকশাঅলা নির্বিকার। আমি বললাম, ‘ফুলার রোড পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটা জায়গা। স্বাস্থ্যকর স্থান। যাইবা না?’ সে বলল, ‘পেরসিডেন কইলেও যামু না।’ ফলে, দিলু রোড থেকে আসা একটা খালি রিকশা থামিয়ে কিছু না-বলে তাতেই উঠে বসলাম আমরা। বললাম, ‘তোমারে খুশি করা হইবো। স্যার যেখানে যাইতে কইবেন, সেইখানে যাইবা। এখন বাংলামোটরের দিকে চলো।’

‘বুজছি ছার, আফনেরা ন্যাশা কইরা গুইরা ব্যারাইবেন। অসুবিদা নাই।’ রিকশা চলতে থাকল। রাস্তায় যানবাহন কমে এসেছে। তবু একটা লোক কেন যে দৌড়ে রাস্তা পার হল! আস্তে চলছে দেখে হুমায়ুন আজাদ রিকশাঅলাকে বললেন, ‘প্যাডেল মারতে থাকো।’ একটা সিগারেট ধরালেন। বললাম, ‘আমিও খাব স্যার।’ আমার দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘তোমার বুদ্ধি আছে। রিকশাটায় চড়ে এই ঠাণ্ডা হাওয়ায় আর ফাঁকা রাস্তায় ঘুরতে পারলে মন্দ হতো না।’ আর তখনই আমার খেয়াল হল, আন্ওয়ার ভাই ব্যাগের মধ্যে তিনটি বিয়ার রেখে দিয়ে বলেছেন, ‘এগুলো বাসায় গিয়ে খেয়ো।’ বাতাসে দিয়াশলাইয়ের তিনটা কাঠি খরচ হয়ে গেছে দেখে তিনি ‘এই সাধারণ কাজটা তুমি এখনও শেখোনি’ বলে নিজের পুড়তে-থাকা সিগারেটটি আমাকে দিলেন। ধরিয়ে, তাঁকে ফেরত দিয়ে বললাম, ‘আজ না, কাল খুব সকালে উঠতে হবে তো, কাজ আছে। অন্য কোনও রাতে ঘুরব স্যার।’ বাংলামোটর এসে গেল। মোড় পার হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে রিকশা থামিয়ে আমি নেমে গেলাম।

‘এখানে নেমে তুমি যাবে কোথায়?’

জবাব দিলাম, ‘আজ ফুলার রোডে যাব না স্যার।’

‘এজন্যেই কি একটু আগে তোমার মনে হল ফুলার রোড পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ একটি জায়গা?’
রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বাড়াতে চাচ্ছিলাম না আমি। বললাম, ‘বাসার গেট সাড়ে এগারোটায় বন্ধ হয়ে যায়। আপনি যেতে পারবেন তো!’ আগফাকালারের একটা বিশাল নিয়নসাইনে (এখন যেখানে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং, সেখানে একটা দোতলা ভবন ছিল, তার ছাদের কিছু উপরে ছিল ওই নিয়নসাইনটি) তাঁর মুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। বললেন, ‘ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।’ বুঝলাম, তিনি বিরক্ত হয়েছেন। ‘আসি স্যার’ বলে শাহবাগ হয়ে-আসা বাস যেখানটায় থামে, সেখানে রওনা দিতেই তিনি জানতে চাইলেন পকেটে টাকা আছে কি-না। একটা বাস ঠিক তখনই এসে গতি কমিয়ে চলতে লাগল। হেলপার যাত্রী আকর্ষণের জন্যে চেঁচাচ্ছিল। ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার’ বলে দিলাম সেই মন্থর-হওয়া বাসের দিকে দৌড়। ফুটবোর্ডে পা রেখেছি, আর দরজাটার গতি তখন বেড়ে গেছে। তার আগেই এক মুহূর্তে দেখি, ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি তাকালেন একবার, তারপর সামনের দিকে; রিকশাঅলা তার পাছা আসন থেকে উপরে, শূন্যে রেখে প্যাডেল মারতে শুরু করেছে।


কিস্তি-৩
........

চঞ্চল আশরাফ | ১ জুন ২০০৮ ৯:৫৭ পূর্বাহ্ন


এটা সত্য, যে-কোনও বিষয় ও প্রশ্নের তাৎক্ষণিক বক্তব্য ও জবাব দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল হুমায়ুন আজাদের; মনে হতো, তাঁর মস্তিষ্ক সব সময় চিন্তা ও জ্ঞানকেন্দ্রিক যে-কোনও পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকে। সুচিন্তিত, লক্ষ্যভেদী, সহজ কিন্তু চাতুর্যপূর্ণ বক্তব্য বা কোনও প্রশ্নের জবাব তাঁর মতো আর কেউ দিতে পারতেন কি-না, আমার আজও জানা নেই। তাঁর কথায় থাকত শ্লেষ, বিদ্রূপ, বক্রোক্তি, চিন্তা-জাগানো রসিকতা বা কৌতুক; আর এ-সবের অন্তর্গত প্রতিটি শব্দের প্রয়োগ সুস্পষ্ট-রকমের হুমায়ুন আজাদীয়। এতে বেশ ক’জন তরুণ লেখককে প্রভাবিত হতে দেখেছি। এখন বলতে দ্বিধা নেই, সাহিত্যচর্চার শুরুতে আমিও কিছুটা হয়েছি। আটের দশকের মেধাবী তরুণ সৈয়দ তারিক (কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক) তাঁর কথা বলার ভঙ্গিটি পর্যন্ত অনুকরণ করতেন।

হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে প্রথম বিতর্কটি ওঠে খুব সম্ভবত ১৯৮৮ সালে, কাজী নজরুল ইসলামকে ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলার মধ্য দিয়ে; কিন্তু তা কিছুদিনের মধ্যে স্তিমিত হয়ে যায়। আমার ধারণা, এর বিপরীতে নজরুলকে প্রগতিশীল প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট রসদ নজরুল-অনুরাগী গবেষক-বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীদের হাতে ছিল না বলে বিতর্কটা মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছোটকাগজ অরুণিমায় (এর সম্পাদক ছিলেন সালাম সালেহ উদদীন, তিনটি সংখ্যা প্রকাশের পর এটি বন্ধ হয়ে যায়) প্রকাশিত তাঁর প্রবচনগুচ্ছ সেই সময়, বলতে গেলে, একটা বিস্ফোরণতুল্য ঘটনা, যার প্রতিক্রিয়া ঘটেছিল মধ্যবিত্ত সমাজে; সেলিব্রিটিদের মধ্যেও এটি আলোড়ন তুলেছিল। ঘটকালিটি করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। তিনি সংবাদ সাময়িকীর হৃৎকলমের টানে কলামে প্রবচনগুচ্ছর সমালোচনা করেন এবং এর মধ্য দিয়েই বিতর্ক শুরু হয়। বিশেষত ‘আগে কাননবালারা আসতো পতিতালয় থেকে, এখন আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে’ — এই প্রবচনটি নিয়ে হৈচৈ পড়ে যায়। হৃৎকলমের টানে কলামে এই প্রবচনটির প্রতিক্রিয়া ছিল লক্ষ করার মতো। এর প্রভাবে মধ্যবিত্ত সমাজ, বিশেষত সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে হুমায়ুন আজাদের প্রতি নিন্দাধ্বনি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সুবর্ণা মুস্তাফা সহ অনেকেই তাঁর প্রবচনটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তরুণদের কেউ-কেউ পক্ষে যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিলেও আজাদবিরোধী পরিবেশে তা কোনও আবেদন সৃষ্টি করতে পারে নি। বলতে পারি, এ-সময় তাঁর পাশে পরিপূর্ণ সক্রিয়তা নিয়ে দাঁড়ান সরকার আমিন ও সৈয়দ তারিক। সাপ্তাহিক বিশ্বদর্পণে (পত্রিকাটি এখন নেই; সম্ভবত ১৯৯১ সালে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়) সরকার আমিন তাঁর যে-সাক্ষাৎকারটি নেন, তা ছিল প্রবচনগুচ্ছ সম্পর্কে ও হৃৎকলমের টানের সেই প্রতিক্রিয়ার জবাবে হুমায়ুন আজাদ কী বলেন, তা হাজির করার জন্যেই। সাক্ষাৎকারে তিনি সৈয়দ শামসুল হককে আখ্যায়িত করেন ‘কপট’ বলে। আর বলেন, ‘সৈয়দ হকের মগজ এত নিষ্ক্রিয়, আমার তা জানা ছিল না।’ কথাটি পত্রিকাটির প্রচ্ছদজুড়ে হুমায়ুন আজাদের ছবির সঙ্গে ছাপা হয়।

যদি আমার স্মৃতিশক্তি খুব খারাপ না-হয়ে থাকে, তখন থেকেই সৈয়দ তারিকের সঙ্গে সরকার আমিনের এবং উভয়ের সঙ্গে হুমায়ুন আজাদের সখ্য লক্ষ করি। ছাত্রাবস্থাতেই তখন সরকার আমিন উস প্রেসের (এফ রহমান হলের পাশে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিস প্রেস) ব্যবস্থাপক। সেখানে দু’জন প্রায়ই আড্ডা দিতেন। কখনও-কখনও আমিও থাকতাম। দেখতে না-দেখতেই হুমায়ুন আজাদের উচ্চারণ ও কথা বলার ভঙ্গি পুরোপুরি রপ্ত করে ফেলেন সৈয়দ তারিক; প্রয়োগও করতে থাকেন সর্বত্র। তো, একদিন, দীর্ঘক্ষণ ধরে এই স্টাইলে কথা বলে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উস প্রেস থেকে বের হয়ে গেলেন তিনি। সরকার আমিনের একটা গুণ — খুব বিরক্ত হলেও তিনি চেপে রাখতে পারেন, তাঁর কাছে বিরক্তিকর ব্যক্তির সঙ্গে সহাস্য বাক্য-বিনিময় করতে পারেন। সৈয়দ তারিকের প্রস্থানের পর, তাঁর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, ‘দেখেছ, হুবহু স্যারকে নকল করে কথা বললেন! কারও চিন্তা-চেতনা ভালো লাগলে তা অনুকরণ করতেই হবে, এমন কোনও কথা নাই। অনুকরণ করলেও অসুবিধা নাই। কিন্তু এর বেশি না।’

সে-সময়, একদিন আমি লেকচার থিয়েটারে হুমায়ুন আজাদের রুমের সামনে পৌঁছেই একই ভঙ্গিতে কথা বলছে এমন দু’টি কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। ঢোকার অনুমতি চাওয়ার জন্যে দরজা ফাঁক করতেই দেখি, সৈয়দ তারিক বসে; হুমায়ুন আজাদ কথা বলার সময় যেভাবে দু’হাতের ব্যবহার করেন, ঠিক সেভাবে তিনি হাত সঞ্চালন করছেন। সৈয়দ শামসুল হকের খেলারাম খেলে যা নিয়ে কথা বলছিলেন তাঁরা, মনে পড়ে। আমি ঢোকার পর সৈয়দ তারিক বললেন, ‘স্যার আমি আপনাকে আমার একটা গ্রন্থ উৎসর্গ করতে চাই। সেটা কবিতার বই হতে পারে, প্রবন্ধের কিংবা অনুবাদেরও হতে পারে।’

চেয়ারে হেলান দিয়ে বেশ আয়েশি কায়দায় সিগারেটে টান দিলেন হুমায়ুন আজাদ। বললেন, ‘তোমার অনুবাদ ভালো।’ বলার সময় এবং পরও কিছুক্ষণের জন্য তাঁর মুখ থেকে ধোঁয়া বের হল।

‘কেন, আমার কবিতা? প্রবন্ধ?’

‘প্রবন্ধও ভালো। ওই যে একটা লিখেছিলে ম্যাথিউ আর্নল্ডের সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে, ভালো।’

‘স্যার, কবিতা?’

‘আমি তো বললাম তোমার অনুবাদ ভালো, প্রবন্ধও ভালো। আপাতত এতেই সন্তুষ্ট থাকো।’

সৈয়দ তারিক ব্যাগ থেকে একটা কবিতা বের করে বললেন, ‘তা হলে একটা কবিতা শোনাই, স্যার। আশা করি এরপর আমার কবিতা সম্পর্কে আপনার ধারণার পরিবর্তন ঘটবে।’

সেই কবিতার নাম এ-মুহূর্তে আমি মনে আনতে পারছি না। তবে প্রথম তিনটি লাইন আমার মনে আছে –

‘স্রবিত রক্তের নীচে উদ্ভাসিত হয়েছিল উজ্জ্বল সুন্দর।
মুগ্ধ চোখে দেখেছিল,
মুগ্ধ চোখে দেখেছিল মধ্যরাতে…’

বাকিটুকু কেন মনে নেই, জানি না। কবিতার বাকি অংশে আমার মনোযোগহীনতা এর একটা কারণ হতে পারে। আমি জানালার দিকে তাকিয়েছিলাম: আকাশ ধূসর হয়ে আসছিল। অন্যমনস্ক ছিলাম কি? কিন্তু এটা তো শুনেছি মন দিয়ে যে, হুমায়ুন আজাদ কবিতাটির প্রথম লাইনের খানিকটা প্রশংসা করে ‘স্রবিত’ শব্দটির প্রয়োগ নিয়ে বলেছিলেন, এ-ধরনের শব্দকেন্দ্রিক রচনা মালার্মেপন্থি কবিরাই করে থাকে এবং তা এমনভাবে করা হয় যাতে পাঠকের দৃষ্টি শুরুতেই বিশেষ কিছু শব্দের ওপর পড়ে। কবিতা সম্পর্কে পাঠককে মনোযোগী করার এটা হল একটা কৌশল; ‘কিন্তু তুমি শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ, কারণ ওই শব্দ ছাড়া কবিতাটিতে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের মতো কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।’

তাঁর মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি আবার কয়েক মুহূর্তের জন্যে জানালায় তাকালাম। আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছিল। সৈয়দ তারিক কী যেন বলতে চাইলেন; তার আগেই হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘সমস্যা নেই, পৃথিবীতে এভাবে হাজার-হাজার কবিতা লেখা হয়ে আসছে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্ব থেকে; কিন্তু বেশির ভাগই ব্যর্থ।’

এতক্ষণ আমি খুব মনোযোগের সঙ্গে তাঁর দিকে তাকিয়েই কথাগুলো শুনছিলাম। এখন আমি তাকালাম সৈয়দ তারিকের দিকে। তিনিও আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘উঠি চঞ্চল। তুমি যাবে আমার সঙ্গে? হাকিমের দোকানে চা খাব।’ এবার দাঁড়ালেন। হুমায়ুন আজাদকে লক্ষ করে বললেন, ‘আসি স্যার।’ সৈয়দ তারিকের পিছু-পিছু আমি যখন বের হচ্ছি, তিনি আমাকে ‘এ্যাই, দাঁড়াও’ বললে আমি দাঁড়ালাম এবং তিনি জানতে চাইলেন আমি তাঁর রুমে কেন এসেছি। ‘আর একদিন আসব স্যার’ বলে আমি বেরিয়ে এলাম।

হাকিমের দোকানে যেতে যেতে সৈয়দ তারিক বললেন, ‘যে-কবিতাটা পড়লাম, তুমি বলো, কেমন লেগেছে? স্যার তো নিজের আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তর কবিতা ছাড়া আর কারও কবিতা যে ভালো হতে পারে, তা ভাবতেই পারেন না।’ তখন দুপুর, কিন্তু মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে বোঝা যাচ্ছিল না। বড়-বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হল আর্টস ক্যাফেটেরিয়া পার হওয়ার আগেই। জোরে পা চালিয়ে আমরা সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনের শেডে দাঁড়ালাম।

“বুদ্ধদেব বসুর কবিতাও উনি পছন্দ করেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতাও। ‘রাত তিনটের সনেট, মৃত্যুর আগে’ তাঁর খুব প্রিয়।”

রুমালে প্রথমে চুল, পরে চশমা মুছতে মুছতে তিনি বললেন, ‘শোনো চঞ্চল, হুমায়ুন আজাদ সত্তরের দশকের কবি। এই দশকে বাংলা ভাষায় কোনও উৎকৃষ্ট কবিতা রচিত হয় নি।’

আমি বলি, ‘স্যারকে আপনার কবিতার বইটা উৎসর্গ করে দেখতে পারেন।’
তিনি আমার দিকে বিরক্তিভরা চোখে তাকালেন। মনে হল, স্থানত্যাগ করতে চান। কিন্তু বৃষ্টি প্রবল হওয়ায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না।

বেশ ক’বার সৈয়দ তারিকের অনুবাদের প্রশংসা করেছেন হুমায়ুন আজাদ। ভাষা ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে সমকালীন সাহিত্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে আগা-গোড়া নেতিবাচক বক্তব্যের মধ্যে কেবল তাঁর অনুবাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর-করা ম্যাথিউ আর্নল্ডের ‘ডোভার বিচ’ কবিতার অনুবাদ সম্পর্কে দু’টি বিশেষণ ব্যবহার তিনি করেছিলেন: মেধাবী ও সৃষ্টিশীল। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে, খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ পত্রিকায়। যখন প্রকাশ্যে ও জনসমক্ষে এর প্রশংসা করেন হুমায়ুন আজাদ, তখন এটি প্রকাশের সম্ভবত সাত বছর পার হয়ে গেছে। কবিতাটি তাঁর চিন্তায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল, বলা যায়। এর দু’বছর পর, অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে বেরোয় তাঁর আমার অবিশ্বাস। বইটির নাম-অধ্যায়ে ব্যবহৃত হয় কবিতাটি, ‘ডোভার সৈকত’ নামে। সৈয়দ তারিকের অনুবাদটি তিনি নেন নি; নিজেই এর অনুবাদ করেন। বিশ্বাসের অবসানের রূপক হিসেবে তিনি ওই প্রবন্ধে কবিতাটি ব্যবহার করেন।

কিন্তু হুমায়ুন আজাদকে কোনও বই উৎসর্গ করা হয়ে ওঠে নি সৈয়দ তারিকের। আর, তাঁর ১ ফাল্গুন ১৪০২-এ প্রকাশিত ছুরিহাতে অশ্ব ছুটে যায় (হুমায়ুন আজাদ কেন, কাউকেই এই বই তিনি উৎসর্গ করেন নি) ছাড়া কোনও বই, আমি যতদূর জানি, বেরোয় নি। এটা নিশ্চিত, অমরতার সমস্ত রসদ রেখে হুমায়ুন আজাদ চলে গেছেন (নইলে, আমিই-বা কেন তাঁকে নিয়ে লিখছি স্মৃতিকথা!) আর সৈয়দ তারিক কোথায় আছেন কী করছেন জানি না। নীল জিন্স, নীল শার্ট আর উপবৃত্তাকার চশমা-পরা এই মানুষকে কত দিন দেখি না! হায়, খুঁজিও না! হস্তরেখায় তাঁর আস্থা ছিল না মোটে; তবু বলতেন কাজের সঙ্গে বদলে যায় হাতের রেখা; ‘একটা ভালো বা খারাপ কাজ করে আমাকে হাত দেখিও, আমি বলে দিতে পারব — কী করেছ তুমি।’ মনে পড়ে, হাকিমের চা-দোকানে বসে আমার হাত দেখে বলেছিলেন, ‘তোমার খ্যাতি কিছু হবে, টাকা হবে না। লোকে তোমাকে মিসইন্টারপ্রিট করবে, তোমার বন্ধুরাও বুঝবে না তোমাকে।’ জানি, এই ভবিষ্যদ্বাণীর জন্যে হাত দেখা লাগে না; কাউকে কিছুদিন লক্ষ করলেই কাজটি সম্ভব। তবু বলি, ‘আপনার পরামর্শ কী?’

‘ধারণ করো নিজেকে; ধীরস্থির হও; নিজের ক্ষমতা জায়গামতো কাজে লাগাও।’

যা-ই হোক, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসার বছরখানেকের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢোকে এবং রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে ভিসির রুমে লাঞ্ছিত হয়। শোনা যায়, ছাত্ররা তাকে লাথিও মারেন এবং শেরওয়ানির দু’একটি বোতাম ছিঁড়ে ফেলেন। এতে হুমায়ুন আজাদ অত্যন্ত আনন্দিত হন। সেই সময় দৈনিক সংগ্রাম, মিল্লাত আর ইনকিলাবের লেখক সালাউদ্দীন নিজামী তার নাম বদলে ফেলেন। তিনি হয়ে যান সালাউদ্দীন আইয়ুব। কিছুধ্বনিতে হুমায়ুন আজাদের সেই সাক্ষাৎকার প্রকাশের আগে, এডওয়ার্ড সাইদের দ্য ওয়ার্ল্ড দ্য টেক্সট এ্যান্ড দ্য ক্রিটিক বইটি সালাউদ্দীন আইয়ুবের কাছ থেকে নিয়ে তাঁকে পড়তে দিই। সেটি ফেরত চাইলে হুমায়ুন আজাদকে আমি বলি যে বইটি সালাউদ্দীন আইয়ুব চেয়েছেন। তখন প্রায় দুপুর, ডিপার্টমেন্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি; জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সালাউদ্দীন আইয়ুব কে?’

বলি, ‘স্যার, চিনতে পারলেন না!’

‘ওই নামে কাউকে আমি চিনি না।’ বলে হাঁটা। চার-পাঁচ পা এগুলেই চেয়ারম্যানের রুমের দরজা। সেখানে তিনি দাঁড়ালেন।

আমি বললাম, ‘চেনেন স্যার, সালাউদ্দীন নিজামীকে তো চেনেন।’

‘নাম পাল্টালো কেন?’

‘ঠিক বলতে পারব না, মনে হয় নিজামী মার খাওয়ার পর তিনি নিরাপত্তাহীনতা থেকে কাজটা করেছেন।’

‘কিন্তু এখন যে আইয়ুব খান হয়ে গেল!’ বলেই তিনি চেয়ারম্যানের রুমে ঢুকলেন।

কিছু বিষয়, যেমন পাকিস্তান, বোরকা, রাজাকার, ধর্মবিশ্বাস, সেনাবাহিনী, আমলা সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ, বিরক্তি ও ঘৃণা ছিল। কখনোই তাঁকে জুতা পরতে দেখি নি; প্যান্টের মধ্যে শার্ট ঢোকাতেও না; স্যুট-টাই পরতে তো নয়ই — এমন কি, পাজামা-পাঞ্জাবিও পরতেন না তিনি। এসব নিয়ে একদিন তাঁকে প্রশ্ন করলে তিনি জানান যে, জুতা তাঁর ভালো লাগে না, এর শব্দ একাত্তরের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কথা মনে করিয়ে দেয়; প্যান্টের মধ্যে শার্ট ঢুকিয়ে টাই আর স্যুট পরে আমলারা; এখন অবশ্য মূর্খ কেরানি, বীমার দালাল, টাউট সবাই পরে। পাজামা-পাঞ্জাবি হচ্ছে ভান ধরার পোশাক — গুরুগম্ভীর ও বিদ্বান অধ্যাপকের ভান, এর সঙ্গে কাঁধে ঝোলা নিলে কবির ভান, সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের ভান — এইসব তাঁর পছন্দ নয়। একদিন তিনি নিজের রুমে টেবিলের উপর পা তুলে হাসতে হাসতে বলেন, ‘আহা, আমি যদি নিয়মিত ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ঘুরে বেড়াতাম, তাহলে বহু আগেই কবি বা পণ্ডিত হতে পারতাম!’

এখন বুঝতে পারি, ‘ডোভার বিচ’ কবিতাটি কেন তাঁর প্রিয় ছিল; তাতে বিশ্বাসের সমুদ্রে ভাটা আর মূর্খ সেনাবাহিনীর উল্লেখ তাঁকে বিশেষভাবে প্রীত-আন্দোলিত করেছিল। প্রায়ই তিনি বলতেন, ধর্মবিশ্বাস সবসময় পরিবার থেকে পাওয়া; কিন্তু এর কোনও ভিত্তি নেই। শৈশব থেকেই আমাদের শেখানো হয় আল্লা সর্বশক্তিমান, স্কুলে ইংরেজিতে কথাটির অনুবাদও শেখানো হয়। উদ্দেশ্য, মানুষকে ভীতির মধ্যে রাখা। কিন্তু সর্বশক্তিমানে বিশ্বাস করা গেলেও তাকে বিশ্বাস করা নির্বুদ্ধিতা, কারণ সর্বশক্তিমান যে-কোনও সময় যে কোনও বিপজ্জনক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতে পারে। অথচ লোকে কথায়-কথায় বলে ‘আল্লা ভরসা’।

একটা খুব স্মরণযোগ্য ঘটনার কথা বলি। ‘শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ, যখন আমি তাঁর ছাত্র’ অংশে ঘটনাটি বলা যেত। যেহেতু তা যায় নি এবং প্রসঙ্গের সমর্থন এখন বরং আরও প্রবল বলে মনে হয়, ঘটনাটি বলা যেতে পারে। তা এই: বিয়ের পর আমার এক সহপাঠিনী বোরকা পরতে শুরু করে। সে তাঁর রুমে ঢুকলে, তিনি এই পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলেন। সে বলল, ‘আমার স্বামী চায় না বোরকা ছাড়া বাইরে যাই।’

‘কিন্তু তুমি যে সবাইকে দেখে বেড়াচ্ছ, তোমার স্বামীর তাতে আপত্তি নেই?’

মাথা নিচু করে সে বসে রইল।

তিনি বললেন, ‘তুমি কার জীবন যাপন করো, তোমার স্বামীর, না নিজের?’

নীরবতা।

‘তোমাদেরকে নিয়ে, মানে নারী নিয়ে আমি একটা বই লিখছি। আচ্ছা, প্রতিদিনই কি তোমরা শারীরিকভাবে মিলিত হও?’

হঠাৎ এই প্রশ্নে হতভম্ব হয়ে গেলাম। শোঁ-শোঁ শব্দে ফ্যান ঘুরছে। তার না-ঠাণ্ডা না-গরম হাওয়ায়, রুমে আমরা তিনজন। কিন্তু আমি যে বসে আছি তাঁর সামনে, সেটা কি তিনি খেয়াল করছেন না? সহপাঠিনীর দিকে তাকালাম। তার নড়াচড়াতেই বেশ বোঝা গেল প্রশ্নটির জন্যে সে প্রস্তুত ছিল না এবং লজ্জা পেয়েছে। তবু বলতে পারল, ‘প্রতিদিনই না, তবে প্রায়ই। এসব প্রশ্ন আর করবেন না স্যার।’

একটা সিগারেট ধরিয়ে তিনি বললেন, ‘একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তুমি আমাকে খুব সাহায্য করেছ। এটা যখন পেরেছ, আর একটা প্রশ্নের উত্তর তুমি দিতে পারবে।’ সে কী-যেন বলতে চাইল, কিন্তু তাকে হাত তুলে থামিয়ে তিনি বললেন, ‘অর্গ্যাজম হয়েছে কখনও?’

সে বলল, ‘অর্গ্যাজম কী স্যার?’

তিনি বললেন, ‘আমি আজ আর তোমাকে কোনও প্রশ্ন করবো না। এখন বলো, কেন এসেছিলে?’

‘একটা টিউটোরিয়াল পরীক্ষা আমি দিতে পারি নাই স্যার।’

‘কেন?’

‘বিয়ের কারণে।’

‘তোমার?’

‘জি, স্যার।’

এ্যাশট্রেতে ছাই ফেলে তিনি বললেন, ‘এখন তো তুমি স্বামীর জীবন যাপন করছ। ভাষাতত্ত্ব তার কোনও কাজেই আসবে না। তা হলে পরীক্ষা দিতে চাও কেন?’

সে নিরুত্তর।

তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, পরীক্ষাটা নেব। তোমার মতো আরও কয়েকজন দিতে পারে নি, তাদের সঙ্গে পরীক্ষাটা তুমি দিতে পারবে। তারিখ জানানো হবে। আর কোনও কথা?’

‘না স্যার। যাই।’

১৯৯৩ সালে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ চোখ নেই দৃশ্য নেই প্রকাশিত হয়। সে-বছরই, মার্চের কোনও এক দুপুরে হুমায়ুন আজাদকে বইটি আমি দিই। তাঁর রুমে তখন আধুনিক বাঙলা কবিতা বিষয়ে বিকল্প কোর্সের টিউটোরিয়াল ক্লাস শেষ হয়েছে। চার-পাঁচজন ছাত্রছাত্রী বসে আছে। একটু আগে একজনের ‘কবিতা কেন বুঝতে পারি না, স্যার’ প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছেন: কবিতা বোঝার জিনিস নয়, অনুভবের, উপলব্ধির জিনিস। কোনও কবিতা সম্পর্কে যদি কেউ বলে যে সেটি সে বুঝতে পেরেছে এবং তার বুঝতে পারার সঙ্গে অন্যরা একমত হচ্ছে, ধরে নিতে হবে কবিতাটি ব্যর্থ। পাঠ্যপুস্তকে এ-ধরনের কবিতা স্থান পেয়ে থাকে।’ আমি বললাম, ‘তাহলে কবিতার যে-ব্যাখ্যা এবং তার পদ্ধতিগুলো কেন?’

‘এসব হল এক ধরনের ব্যবসা। কবিতার ব্যাখ্যা নিয়ে বই বের হয় বাণিজ্যিক কারণে। ব্যাখ্যা করে বহু বাজে কবিতা এই বাঙলায় বেশি করে পড়ার প্ররোচনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কবিতা ব্যাখ্যার নয়, সৌন্দর্যের, উপলব্ধির।’

তো, বইটি মৃদু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তিনি টেবিলের একপাশে সরিয়ে রাখলেন। বললেন, ‘আমি বাঙলা ভাষায় বিশটি শ্রেষ্ঠ কবিতা লিখেছি।’ নিজের বইটির প্রতি অবজ্ঞা দেখে ও তাঁর এই কথা শুনে আমার কষ্ট ও রাগ হল। বললাম, ‘আপনার কথাই ঠিক, স্যার। কিন্তু সেজন্যে পাঁচটি বই আপনাকে বের করতে হয়েছে। প্রতিটি বইয়ে গড়ে আপনি চারটি শ্রেষ্ঠ কবিতা লিখেছেন। আর আমার প্রথম এবং একমাত্র বইয়ে অন্তত তেইশটি শ্রেষ্ঠ কবিতা লেখা হয়ে গেছে।’

এতক্ষণ হেলান দিয়ে-বসা হুমায়ুন আজাদ টেবিলের কাছে নিজের বুক এগিয়ে নিয়ে বইটি ধরলেন এবং আগের চেয়েও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমার দিকে বইটি প্রায়-ছুঁড়ে দিলেন। টেবিলের একেবারে সামনের প্রান্তে এসে পড়ল বইটি; কিন্তু আমি ধরলাম না। বললেন, ‘ব্যাখ্যা করে দেখাও, কোন তেইশটি কবিতা বাঙলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ!’

অপমানে, রাগে, আমার কান গরম হয়ে উঠল। তবু নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে নিয়ে বললাম, ‘স্যার, একটু আগে আপনি বলেছেন কবিতা ব্যাখ্যার নয়, উপলব্ধির। আমার উপলব্ধি, তেইশটি শ্রেষ্ঠ কবিতা এই বইয়ে আছে। ব্যাপারটা তো ব্যক্তিনির্দিষ্ট, আপনিই ঠিক করুন বইটির কোন তেইশটি কবিতা শ্রেষ্ঠ।’

এর পর কবিতা নিয়ে তাঁর সঙ্গে আর কখনও, কোনও কথা হয় নি।


কিস্তি-৪
......

চঞ্চল আশরাফ | ৩ জুলাই ২০০৮ ১০:৫৮ অপরাহ্ন

সমুদ্রে হুমায়ুন আজাদ

১৯৯২ সালের খুব সম্ভবত মধ্য জানুয়ারির কোনও এক সকালে কলাভবনের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শীতকালীন কবিতা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এর আয়োজক ছিলেন আবীর বাঙালী। তিনি তখন বাংলা বিভাগের স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় পর্বের ছাত্র। করতেন ছাত্রদল, কিন্তু হুমায়ুন আজাদের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। সাপ্তাহিক পূর্বাভাস-এ খালেদা জিয়া সম্পর্কে গরিব গ্রহের রূপসী প্রধানমন্ত্রী নামে প্রকাশিত কলামটি তাঁকে আবার আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এটি ১৯৯১ সালের ঘটনা। তখন ছাত্রদলের ক্যাডাররা হুমায়ুন আজাদের হাত কেটে ফেলবে ব’লে হুমকি দিলে তিনি সম্ভবত প্রথমবারের মতো সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। আবীর বাঙালী দলবল নিয়ে তাঁকে বাসা থেকে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসতেন এবং বাসায় পৌঁছে দিতেন বলে শুনেছি। যা-ই হোক, ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন হুমায়ুন আজাদ। বেশ উঁচু করে বানানো মঞ্চে তিনি কেডস খুলে উঠে বসেন। তাঁর পরনে নীল-শাদা-লাল কম্বিনেশনে হরাইজন্টাল স্ট্রাইপের সোয়েটার আর জিন্সের প্যান্ট। অনুষ্ঠানটি ছিল এলোমেলো; সভাপতির বক্তব্যের পরও কবিতা পাঠ চলেছিল দীর্ঘক্ষণ। মনে পড়ে, হুমায়ুন আজাদ বলেন, ‘এই অনুষ্ঠানে আমি আসতে চাই নি। মাইক এখন দালালি আর গালাগালির যন্ত্র; এই যন্ত্রের সামনে আমি দাঁড়াতে যন্ত্রণা বোধ করি। আবীর বাঙালী আমার ছাত্র, তার প্রবল পীড়নে আমাকে এখানে আসতে হয়েছে। আমি মনে করি, কবিদের মাইক আর মঞ্চ বর্জন করা উচিত। কারণ, এই দু’টি জিনিস কবিতার ক্ষতি করেছে সবচেয়ে বেশি। মাইক আর মঞ্চের কাছে কবিরা এখন অসহায়; এ-দু’টি জিনিসই নির্ধারণ করছে কবিতা কীভাবে লিখতে হবে।’

ওই অনুষ্ঠানে জেনিস মাহমুন তাঁর ‘ওম কবিতাম্মৃত’ কবিতাটি পড়েন। সত্যি বলতে কী, কবিতাটি উপস্থিত প্রায় সবাইকে প্রথমত চমকে দেয়, দ্বিতীয়ত মুহ্যমান করে। পরদিন হুমায়ুন আজাদ আমাকে বলেন, ‘কবিতাটি লেখা হয়েছে মঞ্চের জন্যে। কিন্তু মঞ্চের কবিতা এত ভালো হয় না। কবিকে একদিন আমার কাছে নিয়ে এসো।’ আন্ওয়ার আহমদের বাসায় এবং বাংলা একাডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্পে রিসোর্স পার্সন হিসেবে জেনিসের কবিতাটির প্রশংসা করেন তিনি। ১৯৯২ সালে, একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে বাংলা একাডেমীর মঞ্চে জেনিস কবিতাটি দ্বিতীয়বারের মতো পড়েন। সেখানেও শ্রোতারা আচ্ছন্ন হয়ে যান কিছুক্ষণের জন্য। কবিতা পড়া শেষ হলে নরেন বিশ্বাস ও সৈয়দ শামসুল হক তাঁকে খুঁজতে থাকেন; সেই বার্তা তাঁর কাছে পৌঁছনোর আগেই তিনি মঞ্চের পেছন দিয়ে সেদিনের জনস্রোতে মিশে যান। বলতে পারি, সেই সময়ের এবং এখনকার শ্রেষ্ঠ একটি কবিতা ‘ওম কবিতাম্মৃত’। শ্রেষ্ঠ ও অসাধারণ; এজন্যে — এর আগে ও পরের রচনাগুলো থেকে এটি আলাদা। কবিতাটির অংশ বিশেষ :

ওমকবিতাম্মৃত কবিতাম্মৃত
ওমঅগ্নি অগ্নি বোধের হোমাগ্নি
অধমুখি ঊর্ধ্বমুখি ধোঁয়ারা বেগুনি
ওমস্নায়ুর ঘন্টি গভীর ঘন্টি
তৃষিত অঞ্জলি পূর্ণ পুণ্য
ওমকবিতাম্মৃত কবিতাম্মৃত

ওমদিবস রাত্রির মধ্য সীমানায়
ওমস্বপ্ন বাস্তবের মধ্য সীমানায়
বর্ণ স্তূতি গন্ধ স্তূতি
ওমদৃশ্য স্তূতি স্পর্শ স্তূতি

ওমচেতনার দ্রাক্ষারসে
মাতাল আত্মা হবে
মানুষে নমিত

হুমায়ুন আজাদ সমকালীন কোনও কবিতার প্রশংসা করতেন না। অন্তত কারও কবিতা নিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট হতে আমি দেখি নি। ব্যতিক্রম এই ‘ওম কবিতাম্মৃত’। এই নামে জেনিসের কবিতার একটি বই বেরোয়, ১৯৯৩ সালে। একই বছর, সম্ভবত, মাসুদ খানের পাখিতীর্থদিনে প্রকাশিত হয়। দুঃখিত নই, তবু বলি, আমার আর জেনিসের বই নিয়ে কোনও আলোচনাই তেমন করে হয় নি। কারণ, তখন (এবং এখনও), গ্রুপ বা দল কিংবা ফিল্ডওঅর্ক ছাড়া তরুণ কবির আলোচিত হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। এর কোনওটাই আমার আর জেনিসের হয়ে ওঠে নি। কারও ডাক পড়লে এবং সম্ভব হলে বা মন-মেজাজ ভালো থাকলে নিজেদের দু’একটা কবিতা পড়ে শোনাতে পারাটাই আত্মপ্রচারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বলে মনে হয়েছিল। আমার বইটি নিয়ে টুটাফাটা আলোচনা অবশ্য হয়েছিল, সূচক-এ কবির হুমায়ুন আর বরিশাল থেকে বেরোনো অক্ষর-এ হাবিবুর রহমান হাবিব (নাম ভুল হতে পারে; কারণ পত্রিকার সেই কপিটি হারিয়ে ফেলেছি। ক্ষমা করবেন না, নামটি জানাবেন, ভুল হয়ে থাকলে) সেটি করেছিলেন। কিন্তু জেনিসের বইটি নিয়ে কোনও আলোচনাই হয় নি। তা না হোক, পরোয়া তিনি করেন নি। বলা দরকার, মাসুদ খানের পাখিতীর্থদিনে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে তরুণ কবি ও সাহিত্যমনস্কদের মধ্যে। বেশ ঘটা করেই বইটি বের হয় — এর প্রুফ দেখেছিলেন সাজ্জাদ শরিফ, সেটিও আলোচনার বিষয় ছিল তখন। ১৯৯৪ সালে বের হয় শান্তনু চৌধুরীর উৎস থেকে বহ্নি থেকে এবং বইটি পরের বছরেই ছোট কাগজ দ্রষ্টব্য-র বিষয় হয়ে যায়; আর শান্তনু চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। আর এসব উপভোগ করা ছাড়া আমাদের কোনও উপায় ছিল না। ছফা ভাই [আমার চিরনমস্য আহমদ ছফা (১৯৪৩ — ২০০১)] এই উপভোগের কথা শুনে হাসতে হাসতে সত্তরের দশকে লন্ডনে বেড়ে-চলা ধর্ষণের ঘটনায় ভিক্টিমের যন্ত্রণা ও মৃত্যু এড়াতে ব্রিটিশ সরকারের একটি প্রচারমূলক সক্রিয়তার কথা বলেন। সেটি হল একটি পোস্টার টানেলে, বাসস্টপে, মাটির তলার রেলস্টেশনে লাগিয়ে দেয়া; তার বক্তব্য মোটামুটি এরকম: ইফ দেয়ার ইজ নো ওয়ে টু গেট রিড অব দ্য রেপিস্ট, হোয়াই ইউ ডোন্ট এনজয় দ্য সেক্স?

হুমায়ুন আজাদের দিকে ফিরে আসি। তরুণদের কবিতা নিয়ে হতাশা থাকা সত্ত্বেও জেনিসের ‘ওম কবিতাম্মৃত’ তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। সাম্প্রতিক কবিতা নিয়ে যতবার তাঁর মুখোমুখি হতাম, প্রায় ততবার তিনি কবিতাটির কথা বলতেন। একদিন তরুণদের ব্যাপারে তাঁর এই নেতিবাচক মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতিভা হয়তো আছে, কিন্তু আমার আশেপাশে তো তাদের দেখছি না!’ বললাম, ‘কথাটার অর্থ কি এই যে, প্রতিভারা (যদি থাকে) আপনাকে ঘিরে থাকুক, অন্তত কাছাকাছি থাকুক বা যোগাযোগ রাখুক আপনার সঙ্গে, এটা আপনি চাইছেন! না-কি এটা আপনি বোঝাতে চান, আশপাশে থাকার মতো আপনার কাছাকাছি মানের প্রতিভাই নেই!’ ১৯৯২-র মাঝামাঝি, বৃষ্টিজড়িত কোনও এক দুপুরে আমার পরের ব্যাচের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর সামনে তিনি আমাকে বলেন, ‘এখন বেরোও!’ বললাম, ‘আমি যাচ্ছি স্যার। কিন্তু এর তো একটা জবাব থাকবে। আর সেটা না-জেনে চলে যাওয়া কি ঠিক হবে?’

একটা সিগারেট বের করলেন প্যাকেট থেকে, (তখন তাঁর ব্র্যান্ড গোল্ড লিফ এবং এর প্যাকেট ছিল গাঢ় লাল) সেটি ঠুকতে লাগলেন প্যাকেটে; বললেন, ‘কোনও প্রতিভা এখন আসলে নেই। আমার কাছাকাছি দাঁড়ানোর মতো প্রতিভা তো আরও পরের ব্যাপার। ওই যে, ছেলেটা, ওম ওম… এটা তো সে লিখেছে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে। হঠাৎ এরকম একটা দু’টো রচনা সাহিত্যে দেখা দিতেই পারে। যেমন নজরুলের ‘বিদ্রোহী’। যদিও নিয়ন্ত্রণহীন উত্তেজনায় রচনাটি ব্যর্থ ও হাস্যকর হয়ে পড়েছে।’

‘স্যার, দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যাপারটি সব কবির মধ্যে কম-বেশি থাকে। কিন্তু প্রতিভা ছাড়া একটা আলাদা রকমের কবিতা কেমন ক’রে সম্ভব?’

সিগারেটটায় আগুন দিয়ে প্রথম টানের একগাল ধোঁয়া ছেড়ে তিনি বললেন, ‘একটু-আধটু সৃষ্টিশীলতা থাকলেই চলে।’

‘প্রতিভা… সৃষ্টিশীলতা… বুঝলাম না স্যার।’

‘পড়াশোনা ঠিকমতো করো? মানুষ মাত্রই সৃষ্টিশীল। যারা কবিতা লেখে না, ছবি আঁকে না, তারাও সৃষ্টিশীল। চমস্কির নাম শুনেছ? তাঁর কথা হল, প্রতিদিন মানুষ উচ্চারণ করে অসংখ্য সৃষ্টিশীল বাক্য। কিন্তু তারা এসবের খোঁজ রাখে না।’ বলে এ্যাশট্রেতে ছাই ফেললেন।

বললাম, ‘কোনও কবিতাই সাধারণ মানুষের সৃষ্টিশীলতার মানদণ্ডে বিবেচিত হতে পারে না।’

‘তোমাকে বেশ আগেই আমি যেতে বলেছি।’

বুঝলাম, আমাকে এখন তাঁর আর স্বস্তিকর মনে হচ্ছে না। কিন্তু উপস্থিত ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নহীনতা, ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি আর নৈঃশব্দ্য ছিল বিস্ময়কর। আমি বেরিয়ে এলাম। বৃষ্টি থেমেছিল তখন নিশ্চয়, নইলে, সেই ভবন থেকে বেরিয়ে আমি কলাভবনে গেলাম কী ক’রে? বাংলা বিভাগের সামনে আমাকে দেখে জুন আপা (মেহের নিগার; সে-সময়ের বিখ্যাত বিতার্কিক, এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক) বললেন, ‘কী ব্যাপার, তোমাকে বেশ বিমর্ষ মনে হচ্ছে!’ তিনি তখন বিটিভিতে উপহার নামের একটি অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করতেন, অভিনয়ও করতেন। বিটিভিতে তাঁর উপস্থাপনা ও অভিনয়ের খবর শুনে হুমায়ুন আজাদ মর্মাহত হন। মনে পড়ে, এক সকালে লেকচার থিয়েটারের সেই কক্ষে কোনও এক কারণে (মনে করতে পারছি না) তাঁর প্রসঙ্গ উঠলে আক্ষেপ ক’রে বলেছিলেন, ‘আমার এই চিন্তাশীল প্রিয় ছাত্রী বিশ ইঞ্চি পর্দার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তাকে হারিয়ে ফেলেছি, যেমন আমি হারিয়েছি সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকীকে। সে আমার বন্ধু ছিল।’

যা-ই হোক, পুরো ব্যাপারটা শুনে এ-নিয়ে মন খারাপ করতে বারণ করলেন তিনি। তাঁর কথা, শিক্ষক যে আচরণই করুন না কেন, তাতে ছাত্রের মন খারাপ হতে নেই।

জেনিস মাহমুনকে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া, বলতে গেলে, হয়ে ওঠে নি আমার। আর তিনিও এই সাক্ষাতের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর সৃষ্টিশীলতা তখন এতটাই তুঙ্গে যে, এসবের তোয়াক্কা করার সময় তিনি পান নি। অথচ, বাংলা বিভাগের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও সালাউদ্দীন আইয়ুবকে হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কাজটি আমাকেই করতে হয়েছিল; কাজটি সালাউদ্দীন নিজেই করতে পারতেন, অন্তত এই সূত্রে যে, বিভাগের ছাত্র হিসেবে তিনি আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন। ‘তুমি যখন স্যারকে নিয়ে আন্ওয়ার ভাইয়ের বাসায় আসবে, আমি সেখানে আগে থেকেই থাকব। উনার সঙ্গে আমার পরিচয়টা তুমিই করিয়ে দিও।’ আগের দিন সন্ধ্যায়, নিজের বাসায় সালাউদ্দীন আমাকে কথাটি বলেছিলেন। যদিও তিনি তখনকার নবীন পণ্ডিত, হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার দৃশ্যটি ছিল বড়ই মর্মান্তিক। যেন তিনি কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর বিগলিত হাসিসুদ্ধ লুটিয়ে পড়ছেন। কোনও মেধাবীর এমন অবস্থা দুঃস্বপ্নেও দুর্লভ। তো, লুটিয়ে পড়ার আগে বিছানার পাশে-থাকা মোড়াটা দেখিয়ে আন্ওয়ার ভাই তাঁকে বসতে বললেন।

এর মধ্যে আমি একবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। ফলে, আন্ওয়ার ভাইয়ের বাসায় যাওয়া সপ্তাখানেকের জন্যে বন্ধ হয়ে যায়। সুস্থ হওয়ার পর আবার যাওয়া শুরু হয় এবং সালাউদ্দীন আইয়ুবসহ সন্ধ্যায় ইস্কাটন থেকে বেইলি রোডের উদ্দেশ্যে রওনা হই। খুব খুশি দেখাচ্ছিল তাঁকে; রিকশায় উঠে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হুমায়ুন আজাদের সাথে গতকাল মদ্যপান করলাম।’

বলা বাহুল্য নয় যে, সাহিত্য চর্চার শুরুতে আমি বেশ কিছু বিদেশি কবিতা অনুবাদ করেছি। টি এস এলিয়ট, ই ই কামিংস, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস, সিলভিয়া প্লাথ, ফিলিপ লারকিন, এডওঅর্ড বন্ড, রবার্ট পেন ওয়ারেন — এঁদের মধ্যে এলিয়ট আর সিলভিয়ার কবিতাই ভালো লাগত বেশি; আমার বন্ধু এবরার সাইপ্রাস থেকে কালেক্টেড ওয়র্কস অব সিলভিয়া প্লাথ (খুব সম্ভবত এটাই নাম, বইটির) নিয়ে আসে। প্রচ্ছদে কালোর মধ্যে সোনালি রঙে ছাপা নামলিপির বইটি দেখে আমি দিশেহারা হয়ে যাই। সূচিতে দেখি যে তাঁর আত্মজৈবনিক দ্য বেল জার বইটিতে আছে। মাথায় আরও গোলমাল লাগল — এতদিন এর নাম শুনে আসছি, আর এখন একেবারে হাতেই! ভাগ্য ভালো যে সঙ্গে একটা ব্যাগ ছিল (প্রায় সব সময়ই তা থাকত) এবং এবরার ভিতরের ঘরে যাওয়ামাত্র সেটা ঢুকিয়ে ফেলি। ঠিক করি যে, প্রাণত্যাগের আগ পর্যন্ত বইটি সঙ্গেই রাখব। কেননা, সেই সময়ের তরুণ কবিদের অনেকেই ছিল আত্মহত্যাকারী এই কবির প্রতি বিশেষ অনুরাগী। আত্মহত্যার ব্যাপারেও অনেকের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল। তো, বেহাত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এবং অতি অনুরাগবশত কিছুদিন বইটি নিয়ে আমাকে চলাচল করতে হয়। এক বিকালে, ১৯৯২-র বইমেলায়, হুমায়ুন আজাদের সামনে দিয়ে যেতেই তিনি আমাকে ডাকলেন। কাছে দাঁড়াতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার হাতে ওটা কী বই?’

বললাম, ‘সিলভিয়া প্লাথের বই স্যার।’

‘এই গৌণ কবিকে নিয়ে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছ?’

বুঝলাম, এর আগে বইটি তিনি ক্যাম্পাসে আমার হাতে লক্ষ করেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা আড়াল করার চেষ্টা চালাতে গিয়ে সিলভিয়া প্লাথের পক্ষ নিলাম। বললাম, ‘আপনার কথাটা ঠিক না স্যার। সিলভিয়া চল্লিশের দশকের কবিদের মধ্যে প্রধান, যাঁদের হাতে কনফেশনাল কবিতার ধারাটি সৃষ্টি হয়েছিল। এলিয়টের পর এটা ছিল ইংরেজি কবিতার বড় একটা বাঁক, যা শামসুর রাহমানকেও প্রভাবিত করেছে। কিন্তু নিঃসঙ্গ শেরপায় এ-নিয়ে একটা কথাও নাই।’

‘খুব পণ্ডিত হয়েছ তা হলে?’

‘না স্যার, আসলে আমি বইটি হাতছাড়া করতে চাই না। সে-জন্যেই হাতে নিয়ে ঘুরি।’

তিনি চলে যাওয়ার জন্যে পা চালাতেই আমি বললাম, ‘কিন্তু এটা তো বললেন না কেন সিলভিয়া গৌণ কবি।’

আমার দিকে তাকালেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর আয়েশি কায়দায় হাঁটা দিলেন। এর তিন-চার দিন পর বইটি গায়েব হয়ে গেল।

প্রাতিস্বিক (সম্পাদক: মিহির মুসাকী; ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত এর ৪টি সংখ্যা বেরোয়) ২য় সংখ্যার (ফেব্র“য়ারিÑএপ্রিল ১৯৯২) জন্যে প্রেমের কবিতা বিষয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণের দায়িত্বটি আসে আমার ওপর। কাজটি করতে গিয়ে খুব মজার দু’টো অভিজ্ঞতা হয়। একটি নির্মলেন্দু গুণ, অন্যটি হুমায়ুন আজাদ থেকে। তখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছিল। নিউমার্কেটের প্রগতি প্রকাশনীতে (বইয়ের দোকান, এখন নেই) গুণদা প্রায়ই আসেন শুনে আমি সেখানে যাওয়া শুরু করি। প্রথম তিন দিন তাঁর দেখা মিলল না। হয় তিনি একটু আগে বেরিয়ে যান নয় তো আসেন না। এক দুপুরে সৈকত (বাংলা বিভাগের ছাত্র) জানাল যে, গুণদাকে সে প্রগতিতে বসে থাকতে দেখেছে। পড়িমরি ছুটলাম আমি। পৌঁছে দেখি, তিনি দৈনিক সংবাদ-এর খেলার পাতা পড়ছেন। পাশের চেয়ারে বসে আছে একটি মেয়ে। পত্রিকা পড়ার ব্যাঘাত হবে ভেবে তাঁর কাছে না-গিয়ে আমি শেলফের বই দেখতে লাগলাম আর চোরা-চোখে লক্ষ রাখলাম কখন তিনি মুখ তোলেন পত্রিকা থেকে। না, তার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। এর মধ্যে টেবিলে দুপুরের খাবার সাজিয়ে রেখে গেছে শাদা শার্ট ও ছাইরঙা প্যান্ট-পরা খোঁচা-খোঁচা গোঁফ-দাড়ির একটা লোক। এতেও ব্যাঘাত ঘটল না। মেয়েটিও খাওয়ার ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে (অবশ্য, তখন বুঝতে পারলাম, সে তাঁর কন্যা মৃত্তিকা) ব্যর্থ হল। ওদিকে মিহির ভাই ক্যাম্পাসে হাকিম ভাইয়ের চা-দোকানে বসে আছেন। আসার সময় বলেছেন, ‘অন্তত তারিখটা জেনে এসো।’ কিন্তু গুণদার মনোযোগ যেন আরও গভীর হচ্ছে। পত্রিকায় চোখ রেখেই তিনি কন্যাকে বললেন, ‘খেয়ে নাও।’ অধৈর্য হয়ে আমি একটা কাণ্ড করে বসলাম: শেলফ থেকে বেশ ক’টি বই নিয়ে মেঝেয় দিলাম ফেলে। ভাবখানা এমন, যেন পড়ে গেছে হাত থেকে। কিন্তু পুস্তকপতনের সেই শব্দ তুলে ধরল নির্মলেন্দু গুণের বিখ্যাত মুখ, বেশ কাজ হল বলতে পারি। তিনি আমার দিকে তাকালেন। দোকান-কর্মচারি বইগুলো তুলে শেলফে রাখার সময় বললাম, ‘সারা শেলফ তন্ন-তন্ন করে দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী পেলাম না, শালার দিনটাই বরবাদ হয়ে গেল!’ তিনি পূর্ববৎ তাকিয়ে রইলেন। তাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম। এবার বললাম, ‘আমি চঞ্চল আশরাফ, আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই।’

‘কোন পত্রিকার জন্যে?’

‘একটা ছোটকাগজ, প্রাতিস্বিকের জন্যে।’

‘এখন আমি খেলছি।’

‘আমি দেখছি আপনি পত্রিকা পড়ছেন।’

‘সবাই দেখছে। বুঝতেও পারছে। তুমি ছাড়া।’

‘খেলা কখন শেষ হবে?’

‘দেরি হবে। ২৫ তারিখে।’

কন্যাটি বলল, ‘বাবা, ২৩ তারিখে তো আমার জন্মদিন।’

‘হ্যাঁ, তোমার জন্মদিনটাই শুধু হবে।’

বুঝলাম, তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া আপাতত সম্ভব নয়। কারণ, পত্রিকাটি প্রেসে যাবে ফাইনাল খেলার অন্তত সপ্তাখানেক আগেই। সংখ্যাটি ফেব্র“য়ারি-এপ্রিল। এবার বের করতে না-পারলে আর এ-বছরে বেরোবে না। কারণ, এরপর পরীক্ষার ঝামেলা। অন্যদিকে, ফাইনাল খেলার কত দিন পর অখ্যাত ও লেখক-সম্মানী দিতে অক্ষম এই পত্রিকার জন্যে ‘কবিমশাই’ সামান্য ‘অসামান্য’ সময় দেবেন তা অনিশ্চিত। ফলে হাকিম ভাইয়ের দোকানের চা-য় চুমুক দিতে দিতে নির্মলেন্দু গুণকে ওই আইটেমের ফর্দ থেকে মুক্তি দেয়া হল। বিকল্প হিসেবে মুহম্মদ নূরুল হুদার নাম এল। এইজন্যে যে, কাছেই বাংলা একাডেমী, খুব তাড়াতাড়ি তাঁর সাক্ষাৎকারটি পাওয়া যাবে। মিহির মুসাকীর সহযোগিতায় তা গেলও। আমাদের যিনি আধুনিক কবিতা ও বাংলাদেশের কবিতা পড়াতেন, বেগম আকতার কামালের সাক্ষাৎকারটিও কাম্য সময়ের মধ্যেই পাওয়া গেল। বলা বাহুল্য নয়, সবই লিখিত আকারে।

বাকি রইলেন হুমায়ুন আজাদ। তাঁকে ক্যাম্পাসে না-পেয়ে ফুলার রোডের সেই বাসায় গেলাম। দরজা খুলে তাঁর কন্যা মৌলি বলল, ‘আব্বু তো বাসায় নাই, আপনি একটু দাঁড়ান।’ তখন দুপুর। স্কুলফেরত বালক-বালিকার মুখগুলি ফুলার রোডে ইউনিফর্ম আর রোদে জড়িয়ে রিকশায় চলেছে, বা, হাঁটছে, দৌড়ুচ্ছে ঘাসে, এলোমেলো দৌড়ে মাঠ পার হয়ে কোনও-কোনও ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ছে, মনে পড়ে। ‘আমি যখন ঢাকায় পড়াশোনা করতে আসি, আমার সহপাঠিরা দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমাতো। আমি শুয়ে-শুয়ে পড়তাম বই। ফাঁকে-ফাঁকে দেখতাম গাছ-আকাশ, খুব গরম আর বৃষ্টি না-থাকলে কাছে কোথাও হেঁটে আসতাম।’ তাঁর ছাত্রজীবন সম্পর্কে তিনি কথাটি বলেছিলেন। সামান্য পরে মৌলি এল একটা খাতা নিয়ে, সম্ভবত ওর; শেষের পাতাটি দেখিয়ে বলল, ‘আসার কারণ এখানে লিখে দিয়ে যান।’

‘তার দরকার নাই। আমার কথা বললেই চলবে।’

‘না-না। লিখে দিয়ে যান। আমার যদি মনে না থাকে?’

বললাম, ‘যদি আমার লেখা কাগজটা দিতে মনে না থাকে?’

‘আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি আব্বুকে বলে দিব।’

‘আচ্ছা, দাও খাতাটা। লিখছি।’

মৌলি কি রেগেছিল? নইলে, বসতে পর্যন্ত বলল না কেন? কী কাজে এসেছি তা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই লিখতে হল। আর সে ছিল দাঁড়িয়ে, দরজার পাল্লা ধরে, ভিতরে।

পরদিন সকালে, বাংলা বিভাগের করিডোরে আমাকে দেখেই বলে উঠলেন তিনি, ‘তুমি কি গতকাল মৌলির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলে?’

হতভম্ব হয়ে গেলাম। তবু বাসায় যাওয়ার কারণটা বলতে পারলাম। এ-ও পারলাম বলতে, ‘আপনি বলে থাকেন যে বাঙালি জাতিগতভাবে খুবই অভদ্র, বাসায় গেলে তারা দাঁড়াতে বলে, যদিও তাদের থাকে বসবার জন্যে সাজানো-গোছানো একটা ঘর। স্যার, আপনার বাসার দরজায় দাঁড়িয়েই আমাকে ওটা লিখতে হয়েছিল।’

‘তুমি কি সেজন্যে দুঃখিত?’

‘আপনি সাক্ষাৎকারটা দিলেই হবে স্যার।’

তিনি বারোটার কিছু আগে তাঁর রুমে আমাকে যেতে বললেন। গেলাম। লিখিত সে-সব প্রশ্নের কাগজটি তাঁকে দিলে বললেন যে, উত্তরগুলো তিনি লিখে রাখবেন এবং বাসায় রেখে যাবেন। কারণ বাইরে তাঁর একটা কাজ আছে। পরদিন বিকালে সেটি নিয়ে আসতে হবে।


কিস্তি-৫
......
চঞ্চল আশরাফ | ৪ অগাস্ট ২০০৮ ১:৩৫ পূর্বাহ্ন

নিজের বইয়ের সঙ্গে হুমায়ুন আজাদ

একটা ব্যাপারে আমি তখন বেশ বিব্রত বোধ করতাম। সেটি হল, পরিচিতদের অনেকেই আমাকে জুনিয়র হুমায়ুন আজাদ বলে ঠাট্টা করতেন। কেউ কেউ আমাকে বলতেন ছোটদের হুমায়ুন আজাদ বা দ্বিতীয় হুমায়ুন আজাদ। হয়তো হেঁটে যাচ্ছি হাকিম ভাইয়ের চা-দোকানের পাশ দিয়ে, আমাকে শুনিয়ে কেউ বলে উঠল কাউকে, ‘দ্যাখ দ্যাখ হুমায়ুন আজাদের …….
৫০ তম জন্মদিনে স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে হুমায়ুন আজাদ
……..
শিষ্য।’ অনেক সময় এটা ঠাট্টার পর্যায়ে থাকত না, ব্যাপারটা এমন হয়ে যেত যেন আমাকে রাগানোর জন্যে তাদের কাছে এর চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র আর নেই। আমি রেগে গেলেও তা প্রকাশ করতাম না, বরং এক সময় দেখা যেত, তাদের সঙ্গে আমার আড্ডা ও সখ্য বেড়ে গেছে। এ-নিয়ে ব্রাত্য রাইসুর একটা কথা আমার মনে ধরেছিল খুব: কারও কথায় আপনার যদি রাগ হয়, সেইটা তার সামনে প্রকাশ করবেন না। করলে সে ভাববে যে সে যা বলছে তা-ই ঠিক।

১৯৯৪ সালের এক রাতে, আমি জিগাতলা (তখন আজকের কাগজে কাজ করতাম) থেকে আজিজ মার্কেট হয়ে বাসায় ফিরছি। শাহবাগ মোড়ের দিকে যাচ্ছি, রাইসু ডাক দিলে আমি রিকশা থেকে নামলাম। তিনি রিকশাঅলাকে ছেড়ে দিতে বললেন। ছেড়ে দিয়ে, ফুটপাতে উঠে দেখি, সাজ্জাদ শরিফ আর রাজু আলাউদ্দিন লোহার পাঁচিলে (এখন সেটি নেই; সেখানে পিজির বহির্বিভাগের টিনশেড ভবনের দেয়াল) ঠেস দিয়ে বসে সিগারেট ফুঁকছেন। প্রথমে রাজু আলাউদ্দিনই হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে আমার মিল ও সম্পর্কের প্রসঙ্গটি তুললেন। সেই সূত্র ধরে সাজ্জাদ ভাই বললেন, ‘প্রথমত আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র।’

বললাম, ‘এই বিভাগে তো অনেকেই পড়ে। আর এখন আমি সেখানকার ছাত্র না, অনার্স ক’রে মাস্টার্সে ভর্তি হই নাই।’

‘আপনি কবিতা লেখেন।’

‘অনেকেই লেখেন।’

‘প্রবন্ধ লেখেন।’

রাজু বললেন, ‘হুমায়ুন আজাদের মত ইদানিং আবার ভাষাতত্ত্ব নিয়া লেখা শুরু করে দিছেন।’

আমাকে নিরুত্তর দেখে রাইসু বললেন, ‘ঠেকাইতেছেন না ক্যান, শাহবাগে ত বহুত রাজা-উজির মারেন, এখন কি পোতায়্যা গেলেন?’

সাজ্জাদ ভাই বললেন, ‘হুমায়ুন আজাদের মত আপনি সবাইকে বাতিল করে বেড়ান।’

আমার খালি মনে হতে লাগল, ‘রিকশা থেকে নামাটা ঠিক হয় নি। আর মনে পড়ল উচ্চ মাধ্যমিকে-পড়া ইন্ডাক্টিভ লজিকের কথা। গরুর চারটি পা আছে; ছাগলের চারটি পা আছে; গরু দুধ দেয়; ছাগলও দেয়; অতএব, গরু হল ছাগল। বললাম, ‘তাড়া আছে। যাই।’

রাইসু বললেন, ‘না। এখন গেলে আমরা মনে করব, আপনি এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারেন না। আপনার মধ্যে পলায়নপর মনোবৃত্তি আছে।’

সাজ্জাদ ভাই আমার দিকে সিগারেট বাড়িয়ে বললেন, ‘নেন, সিগারেট খান। চা খাবেন?’

আমি ‘চা খাব না’ বলে সিগারেটটি নিলাম এবং ধরিয়ে টানতে লাগলাম।

রাজু বললেন, ‘আপনি জিন্স পরেন। প্যান্টের ভিতরে শার্ট ঢোকান না।’ শুনে সাজ্জাদ ভাই হাসতে লাগলেন।

বললাম, ‘পৃথিবীতে বহু লোক জিন্স পরে, প্যান্টের ভিতরে শার্ট ঢোকায় না।’

‘কিন্তু তারা ত হুমায়ুন আজাদ আর আপনার মত চশমা পরে না।’ রাইসু কথাটা বললেন আর সঙ্গে সঙ্গে বাকি দু’জন হাঃ হাঃ হোঃ হোঃ শব্দে হাসতে লাগলেন। ফাঁকা হয়ে-আসা রাস্তায় সেই হাসি প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল কি-না জানি না, কেননা তখন আমার খুব রাগ হচ্ছিল। রাজু আলাউদ্দিন বললেন, ‘তা হলে এখন কী সিদ্ধান্ত?’ রাইসু বললেন, ‘সিদ্ধান্তটা হইল, চঞ্চল আশরাফকে খাইয়া ফালাইছে ওর গুরু হুমায়ুন আজাদ।’ আবার হাসি। তিন রকমের, একই সময়ে।

‘যাই।’ বলে, তিন জনের সঙ্গে হাত মেলালাম।

২.
১৯৯৩ সালে, ডিসেম্বরের শেষ সপ্তায় আমি দৈনিক আজকের কাগজে যোগ দিই। কিন্তু আমি পত্রিকাটির স্টাফ হই ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি থেকে। হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতাম সম্পাদকীয় বিভাগের কর্মী হিসেবে, কাজ করতাম সাপ্তাহিক খবরের কাগজে। মাঝেমধ্যে আবীর ভাই (আবীর হাসান; তখন আজকের কাগজের সহকারী সম্পাদক) টুকটাক অনুবাদের কাজ দিলে, করতাম। যা-ই হোক, সে-সময় চার-পাঁচবার হুমায়ুন আজাদ জিগাতলার সেই অফিসটায় এসেছিলেন। উদ্দেশ্য, আজকের কাগজ সাময়িকীতে প্রকাশিত ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইল-এর সম্মানী নেয়া। ’৯৩-এ, সম্ভবত অক্টোবরে ধারাবাহিকটি শেষ হয়েছিল; কিন্তু সম্মানী পেতে পরের বছর পর্যন্ত লেগে যায়। এ-নিয়ে হুমায়ুন আজাদ বিরক্ত ছিলেন। শুনেছি, ৪০ কিস্তিতে উপন্যাসটির বিল দাঁড়িয়েছিল ২০ হাজার টাকা।

দুই দফায় তা দেয়া হয়। শেষ দফায় তাঁকে ৯ হাজার টাকার চেক নিতে আমি দেখেছি। তখন ঢাকা নিউমার্কেটে বিদ্যাসাগর থেকে নিউ দিল্লির পিকক বুকস সংস্করণে জেমস জয়েসের অ্যা পোর্ট্রটে অব দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ অ্যা ইয়াং ম্যান কিনতে ৫০ টাকার বেশি লাগত না। জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড থেকে সাকুরায় যেতে রিকশাঅলাকে তখন ৫ টাকা দিলে সে খুশিই হত। যা-ই হোক, ‘এত টাকা দিয়ে কী করবেন স্যার?’ শুনে বললেন, ‘সপ্তম শ্রেণীর বালকের মত প্রশ্ন করো না।’

লক্ষ করলাম, সম্মানীর জন্যে তাঁর মধ্যে যে একটা অপ্রীতিকর অভিব্যক্তি দেখা যেত এখানে এলে, তা একেবারেই নেই; বরং চেহারায় এক ধরনের তৃপ্তি ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে, লেখার সম্মানী না-পেলে, তিনি ক্ষোভটা আড়াল করতে পারতেন না। ১৯৯৬ সালে শুভব্রত ও তার সম্পর্কিত সুসমাচার উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে আজকের কাগজ সাময়িকীতে ৯ কিস্তি প্রকাশের পর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে রীতিমতো ঘোষণা ছেপে বন্ধ করে দেয়া হয়। পরের বছর, আমার খুব মনে পড়ে, কলাভবনের পশ্চিম গেট দিয়ে বাসার দিকে যেতে যেতে তিনি বললেন, ‘আজকের কাগজ আমার উপন্যাসটি ছেপে শেষ হওয়ার বেশ আগেই বন্ধ করে দিয়েছে; তাতে উপন্যাসটির কোনও সমস্যা হয় নি। সেটা বই হয়ে বেরিয়েছে, কিন্তু ওরা আমাকে কোনও টাকাই দেয় নি। ছ’মাস ধরে ওরা শুধু প্রতিশ্রুতিটাই দিতে পেরেছে।’

গেটটি পার হয়ে দক্ষিণের পথ ধরে সামান্য হেঁটে তিনি থামলেন এবং সিগারেট ধরালেন। তাঁকে জানালাম যে, আজকের কাগজের কাজ আমি ছেড়েছি দুই বছর আগে, আমিও অনেক দিন আমার লেখার টাকা পত্রিকাটি থেকে পাচ্ছি না। বললাম, ‘রফিক আজাদ সেদিনও বলছিলেন, এরা কি লেখার টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে?’ হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘কোনও লেখককেই যদি না-দেয়, বিষয়টা অন্যভাবে দেখা যেত। কিন্তু আমি জানি, কোনও কোনও লেখককে এরা টাকা দেয়, বেশ ভালো করেই দেয়। মাঝখানে কী-যেন দুটো পাতা আছে, ওইখানে লিখলে দেয়। সেদিন দেখলাম, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের লেখা ছাপা হয়েছে। ওর লেখা প্রকাশযোগ্য হয়?’ আবার আমাদের হাঁটা শুরু হল। বাতাস বইছিল। বললাম, ‘তাঁর লেখা প্রকাশের উপযুক্ত করে দেয় সালাম সালেহ উদদীন।’ ‘তা হলে তো ওর খুব পরিশ্রম হয়।’ কথা বলতে বলতে আমরা রাস্তা পার হয়ে হাঁটতে থাকি। হুমায়ুন আজাদের হাতে সিগারেটটি নেই, লক্ষ করি। একটু সামনে গেলে একরকম ছায়াময়তা আর ঠাণ্ডা হাওয়া পাওয়া গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁকে বলি, ‘এইভাবে উপন্যাসটির ধাবাবাহিক ছাপা বন্ধ করা ঠিক হয় নাই স্যার।’ বললেন, ‘পত্রিকাটির কোনও দোষ নেই। মূর্খদের একটি অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় থেকেই সমস্যাটি হয়েছে। সেটি ধর্মেন্দ্রিয়। এই ইন্দ্রিয় এত প্রবল যে, পত্রিকাটি ভয় পেয়েছে।’ বলে তিনি ঘড়ির দিকে তাকালেন এবং ‘ঠিক আছে, পরে কথা হবে’ বলে হাঁটা দিলেন বাসার দিকে।

আজও জানি না, হুমায়ুন আজাদের প্রাপ্য সেই টাকা আজকের কাগজ শেষ পর্যন্ত দিয়েছিল কি-না।

৩.
১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার সঙ্গে পরিচয় হয় কবি ও প্রাবন্ধিক আজফার হোসেনের। পরিচয়ের আগেই ভোরের কাগজে হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে তাঁর সেই বিতণ্ডাটি উপভোগ করেছিলাম। বোধ করি ওই বিতণ্ডা সমকালীন সাহিত্যিক ও মননশীল সমাজে আজফার হোসেনকে বেশ পরিচিতি এনে দেয়। তাঁর সঙ্গে অল্প ক’দিনের মধ্যেই সখ্য গড়ে ওঠে আমার। আজকের কাগজের সামনে একটা চা-দোকান ছিল, সেখানে রাস্তা-লাগোয়া বেঞ্চিতে বসে আমরা আড্ডা দিতাম। তিনি একটার পর একটা সিগারেট টানতে পছন্দ করতেন। ভাষাতত্ত্ব, মার্কসবাদ, উত্তর-আধুনিকতা, মৌলবাদ, দেরিদা, হুমায়ুন আজাদ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলতাম। অফিস থেকে বের হয়ে কোনও-কোনও সন্ধ্যায় কথা বলতে বলতে কখন-যে শাহবাগে পৌঁছে যেতাম, টেরই পেতাম না। যা-ই হোক, তখন সবে হুমায়ুন আজাদের প্রথম উপন্যাস ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল বেরিয়েছে। ওই বছরের, সম্ভবত মার্চের কোনও একদিন আজফার ভাই সাপ্তাহিক খবরের কাগজে প্রকাশের জন্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে এলেন। কম্পোজ হল, প্রুফ আজফার ভাই-ই দেখলেন। ট্রেসিং হওয়ার আগে বকর ভাই (আবু বকর চৌধুরী; তখন সাপ্তাহিক খবরের কাগজের সহযোগী সম্পাদক) আমাকে কপিটি দেখতে বললেন। দেখলাম, তাতে ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইলও প্রাসঙ্গিক হয়েছে। যত দূর মনে আনতে পারি, তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে বলছেন যে, শরৎচন্দ্রের রচনায় স্খলনকে সাব্লিমেশন দেওয়া হয়, স্খলিতের জন্যে মধ্যবিত্ত পাঠকের করুণা ও সহানুভূতি আদায় করা হয় — তা-ই দেখা যায় উপন্যাসটিতে। শরৎচন্দ্রের ভাবালুতাঘন উপন্যাসের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে, শহীদ মিনারের সামনে কেন্দ্রীয় চরিত্র রাশেদের যে করুণা-উদ্রেককর অভিব্যক্তি, আজফার ভাই তা উল্লেখ করেছেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একমত হয়েছেন তাঁর সঙ্গে, তিনিও বলছেন যে, শরৎচন্দ্রসুলভ মধ্যবিত্ত-ভাবালুতায় উপন্যাসটির যে-ক্ষতি হয়েছে, সমকালীন কথাসাহিত্যে তেমন দেখা যায় না।

পড়তে গিয়ে, আমার দুটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। একটি হুমায়ুন আজাদের বাসায় সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়কার, অন্যটি ইস্কাটনে তাঁর কবিতা সম্পর্কে প্রবন্ধ না-লিখে জয় গোস্বামীর ওপর লেখার কারণে যা ঘটেছিল। বকর ভাইকে বিষয়টি জানালাম। তিনি পড়ে বললেন, ‘ঠিকই তো আছে। গ্যাঞ্জাম লাগলে লাগুক। ধর্ম নিয়া তো কিছু নাই।’ সে-বছরই সেপ্টেম্বরের কোনও একদিন সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে হুমায়ুন আজাদ আমাকে দেখে ডেকে বললেন, ‘এ্যাই তুমি এখনও ওই গো-শালায় কাজ করো?’

বললাম, ‘বুঝলাম না স্যার।’

‘পত্রিকাটিতে ওসব কী ছাপা হয়? আজফার নামের ওই ছোকরাটি এখন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে ভিড়েছে? ইলিয়াস কী লেখে? আমি তো তার লেখায় কুকুরের সঙ্গম আর নির্বোধের হস্তমৈথুন ছাড়া কিছুই দেখি না।’ কোনওরকম বিরতি না-দিয়ে বললেন এবং লাইব্রেরির দরজায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। আশপাশে তাকালাম। দেখি, লাইব্রেরির সামনে বসা ও দাঁড়ানো ছেলেমেয়েদের কয়েকজন আমার দিকে ‘কী-হল-চোখে’ তাকিয়ে আছে।

১৯৯৫ সালে আততায়ীদের সঙ্গে কথোপকথন নামে একটি বই বেরোয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হুমায়ুন আজাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে। বইমেলায় আগামী প্রকাশনীর স্টলে গিয়ে সূচিতে দেখি, আমার নেয়া সাক্ষাৎকারটি বইটায় নেই। সেই আশা আমি কি করেছিলাম? নইলে, মন খারাপ হল কেন? ডিসপ্লে-টেবিলের ওপারে তখন হুমায়ুন আজাদ বসে আছেন; দেখে আমার ভেতরে কী-যে ঘটল, বললাম, ‘আমাকে যে আপনার আততায়ী মনে হয় নাই এতে আমি খুশি হইছি স্যার। কারণ, কয়েকটা সাক্ষাৎকার পড়ে মনে হয়, কথোপথনের সময় বাটার অয়েলের যথেষ্ট ব্যবহার হইছে।’ হাতেই ছিল বইটি। তিনি বললেন, ‘পড়াশোনায় তো গোল্লায় গেছ, কথা বলতেও তো শেখো নি ঠিকমতো। আর তোমার নেয়া ওই সাক্ষাৎকারটি বইয়ে রাখার উপযুক্ত নয়।’ টেবিলে বইটি রেখে বললাম, ‘কারণ, আমি আপনার কাছে বাটার অয়েলের টিন নিয়ে যেতে পারি নাই।’ তখনই এক মহিলা এসে সব কিছু ভেঙে পড়ে উপন্যাসটির একটি কপি নিয়ে তাঁর দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘স্যার, অটোগ্রাফ দ্যান।’ বইটির মলাট তুলে হুমায়ুন আজাদ কলমের ঢাকনা খোলামাত্র আমি সেখান থেকে সরে গেলাম।

সে-বছরের জুলাইয়ে আজকের কাগজ থেকে অব্যাহতি নিয়ে বাংলা একাডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্পে যোগ দিই। সম্ভবত পরের মাসেই রিসোর্স পার্সন হিসেবে প্রকল্পে বক্তৃতা দিতে আসেন তিনি। প্রকল্প পরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা আমাদেরকে প্রস্তুত হতে বলেন এই মর্মে যে, হুমায়ুন আজাদ এমন কিছু বলতে পারেন — অনেকের কাছে তা অস্বস্তির কারণ হতে পারে। তার কোনও কথায় কেউ যদি বিচলিত বা বিব্রত বোধ করে, তা নিয়ে পরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা হতে পারে; কিন্তু তাঁর বক্তৃতার সময় এমন কোনও কথা বা আচরণ করা যাবে না, যাতে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

সকালে হুমায়ুন আজাদ এলেন। বাংলা একাডেমীর অডিটোরিয়ামে আমাদের সামনে বসেছেন। তাঁর এক পাশে প্রশিক্ষক রফিক আজাদ অন্য পাশে মুহম্মদ নূরুল হুদা। তিনি বক্তৃতা দিলেন ভাষা নিয়ে; তারপর সাহিত্য ও আধুনিকতা প্রসঙ্গে বললেন। অসামান্য বক্তৃতা, সবাই চুপ হয়ে শুনলাম। দেড় ঘণ্টার বক্তৃতা শেষে আধ ঘণ্টার একটা প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকে। এ-সময় চল্লিশ জনের মধ্যে আমি আর অল্প কয়েকজনই সরব থাকতাম বলে অনেকেই আমাকেও প্রশ্ন করার জন্যে পীড়াপীড়ি করতে লাগল। না, আমি কোনও কথাই বললাম না। কারণ, তাঁর সঙ্গে এত দিনে আমার এত বেশি কথা হয়ে গেছে যে অর্থনীতিতে-পড়া ক্রমহ্রাসমান প্রান্তিক উপযোগ বিধির মতোই, তাঁর মুখোমুখি হওয়ার তৃষ্ণা শুরুতে যত তীব্র ছিল, ততটাই মৃদু, বলতে গেলে শূন্য হয়ে এসেছে তখন। কিন্তু প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রশ্ন হবে না, এমনটি তো কাম্য হতে পারে না। বদরুজ্জামান আলমগীর (নাট্যকার, এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী) প্রশ্ন করলেন, ‘স্যার বিদেশি সাহিত্যের প্রতি আপনার উচ্ছ্বাস সব সময় লক্ষ করি আমরা। কিন্তু দেশের সাহিত্য নিয়ে আপনি সব সময় নেতিবাচক কথা বলেন। এর কারণ কী?’

তিনি বললেন, ‘দেশের সাহিত্য কাকে বলে?’

আলমগীর বললেন, ‘বাংলাদেশের সাহিত্য।’

‘বাংলাদেশের সাহিত্য বলে কিছু নেই। আছে বাংলা ভাষার সাহিত্য; পৃথিবীর যে-কোনও দেশে এটি রচিত হতে পারে।’

শোয়াইব জিবরান প্রশ্ন করল, ‘পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য তা হলে এখানকার পাঠ্যসূচিতে থাকে না কেন?’

তিনি বললেন, ‘আবারও ভুল করছ। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য বলে কিছু নেই।’

জিবরান বোঝাতে চাইল, যদি তা না থাকে, তা হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে কমলকুমার মজুমদার বা শক্তি চট্টোপাধ্যায় পড়ানো হয় না কেন?

হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা। যে-সব বই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে রাখা হয়, সেগুলোর ক’টি পাঠযোগ্য, বলতে পারবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো আধুনিক সাহিত্য পড়ানো হয়। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দ্যাখো, ওরা রবীন্দ্রনাথও ঠিকমতো পড়ায় না। আর তোমাদেরকে, কী যেন বললে, কমলকুমার, হ্যাঁ, কমলকুমার পড়তে তো বিশ্ববিদ্যালয় নিষেধ করে নি।’
—————————————————————–
যে-সব বই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে রাখা হয়, সেগুলোর ক’টি পাঠযোগ্য, বলতে পারবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো আধুনিক সাহিত্য পড়ানো হয়। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দ্যাখো, ওরা রবীন্দ্রনাথও ঠিকমতো পড়ায় না।
—————————————————————–

জিবরান বলল, ‘উৎসাহিতও করে নাই স্যার।’

তিনি বললেন, ‘সাহিত্য পাড়ার প্রীতি ফুটবল ম্যাচ নয় যে উৎসাহিত করতে হবে।’

আলমগীর বললেন, ‘দেশের সাহিত্য, মানে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে, স্যার, আপনার নেতিবাচক ধারণার কারণ আমরা কি জানতে পারি?’

‘বাংলা সাহিত্য ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, রুশ বা স্পেনিশ সাহিত্যের কাছাকাছি মানেরও নয়। এখন যা লেখা হচ্ছে বাংলা ভাষায়, তা আসলে শ্বশুরবাড়ির সাহিত্য। জামাই লিখছে, সুতরাং খুব ভালো সাহিত্য হচ্ছে।’
—————————————————————–
বাংলা সাহিত্য ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, রুশ বা স্পেনিশ সাহিত্যের কাছাকাছি মানেরও নয়। এখন যা লেখা হচ্ছে বাংলা ভাষায়, তা আসলে শ্বশুরবাড়ির সাহিত্য। জামাই লিখছে, সুতরাং খুব ভালো সাহিত্য হচ্ছে।
—————————————————————–
৪.
১৯৯৫ সালের নভেম্বরে তাঁর নারী বইটি নিষিদ্ধ হয়। খবরটি আমি শুনি শাহবাগে, আজিজ মার্কেটের দোতলার ’প্রকাশক’ নামের কক্ষটিতে, যেখানে প্রায়ই আমরা আড্ডা দিতাম। উল্লেখ্য, প্রকাশক ছিল ব্রাত্য রাইসু, লীসা অতন্দ্রিলা, শাহ্‌রীয়ার রাসেল ও শহীদুল ইসলাম টিটুর যৌথ মালিকানার বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান! যদিও এটি বিজ্ঞাপনের ব্যবসার কোনো কাজেই আসেনি। শেষ পর্যন্ত কক্ষটি আড্ডাস্থল হিসাবে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। পরে জানতে পারি, ভাড়ার টাকা পরিশোধ না করতে করতে দেড় দুই বছরে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ দাঁড়ায় ছফা ভাই তা মিটিয়ে দিয়ে আসবাবপত্র সহ সেই কক্ষে বসতে শুরু করেন। এর আগে তিনি পাশের আরেকটি কক্ষে মাদুরের উপরে টেবিল এবং মুখোমুখি দুটি চেয়ার নিয়ে বসতেন। টেবিলের উপরে সব সময়ে একটি অ্যাসট্রে থাকত।

প্রকাশক-এ প্রায়ই সাজ্জাদ ভাই, রাইসু, রাজু আলাউদ্দিনসহ অনেকের সঙ্গে আড্ডা হতো, কথা হতো। সেখানে কারও সঙ্গে দেখা না-হলে পাশের ছফা ভাইয়ের সেই রুমটিতে উঁকি দিতাম। দেখে ছফা ভাই ডাকতেন। কোনও-কোনও সন্ধ্যায় দেখতাম, সেই রুমে তাঁর মুখোমুখি বা টেবিলের পাশের চেয়ারটায় বসে আছেন সমুদ্র গুপ্ত, নয়তো জাহিদ হায়দার। তো, কার কাছ থেকে নারী নিষিদ্ধ হওয়ার খবরটা শুনি, আমার মনে নেই। তা না-থাকলেও, ছফা ভাইয়ের রুমে উঁকি দিয়ে দেখি, তাঁর টেবিল ঘিরে চার-পাঁচজন লোক, তিনি বেশ উত্তেজিত; ‘এখানে বই যারা বিক্রি করে সবাইকে আমার সাথে দেখা করতে বলো। যাও।’ কাকে যে বলছেন তা বুঝতে পারছিলাম না। দেখতে পাচ্ছিলাম, তিনি দাঁড়িয়ে চিৎকার করছেন, ‘লুৎফর (লুৎফর রহমান: বইয়ের দোকান ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সন্দেশ-এর স্বত্বাধিকারী) কোথায়, ওকে আমার এখানে নিয়া স।’ পেছন ফিরে দেখলাম খাটো, গোঁফঅলা, সাদার উপর কালো চেক শার্ট-পরা একটা ছেলে; শোনামাত্র সে দ্রুত স্থানত্যাগ করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছ’সাতজন লোক সেখানে হাজির। তবে আগে এলেন লুৎফর। তাঁকে ছফা ভাই বললেন, ‘নারী বিক্রি বন্ধ করবে না।’ তিনি বললেন, ‘পুলিশে ধইরা নিয়া গ্যালে আমারে কি আপনি ছুটাইয়া আনতে পারবেন?’ ছফা ভাই অন্যদেরকেও নারী বিক্রি চালিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু লুৎফরের কথার সূত্র ধরে কেউ রাজি হলেন না। ছফা ভাই রেগে গেলেন। বললেন, ‘তোমরা আমার কথা বুঝতেই পার নাই। এইটা একটা প্রতিবাদ। বই ব্যাচাটাই বুজলা। যাও, সব বই আমার এখানে পাঠাইয়া দাও। আমি আহমদ ছফা আজিজ মার্কেটের সামনের ফুটপাতে প্রকাশ্যে নারী বেচব। প্রতিবাদ আমি করবই। কারণ, এই নিষিদ্ধ আমি মানি না।’
—————————————————————–
ছফা ভাই বললেন, ‘নারী বিক্রি বন্ধ করবে না।’…আমি আহমদ ছফা আজিজ মার্কেটের সামনের ফুটপাতে প্রকাশ্যে নারী বেচব। প্রতিবাদ আমি করবই। কারণ, এই নিষিদ্ধ আমি মানি না।’
—————————————————————–
তারা সেখান থেকে বের হলেন; কিন্তু বইটির একটা কপিও এল না। ততক্ষণে রুমটায় ২০-২৫ জন লোক, ছোটখাটো একটা সমাবেশ। মাদুরে বসেছেন সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যে আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গণিকে সঙ্গে নিয়ে হুমায়ুন আজাদ এলেন। কেডস খুলে তিনিও বসলেন। এর সামান্য আগে এক জার্মান ভদ্রলোক এসে ছফা ভাইয়ের পাশে বসেছেন। হুমায়ুন আজাদ জানালেন, তিনি ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের সঙ্গে এ-নিয়ে কথা বলেছেন। বললেন, ‘বিএনপি-জামাত সরকার বেশি দিন বইটিকে নিষিদ্ধ রাখতে পারবে না।’ ছফা ভাই জার্মান ভদ্রলোকের সঙ্গে হুমায়ুন আজাদকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁর বই যে সরকার নিষিদ্ধ করেছে, তা তাঁকে জানালেন। হুমায়ুন আজাদ ইংরেজিতে তাঁকে বললেন যে, বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার আছে, কিন্তু গণতন্ত্র নেই। কারণ এখানে বাকস্বাধীনতা নেই। ছফা ভাই এর সমর্থনে উদাহরণ দিতে গিয়ে তসলিমা নাসরিনের কথা বললেন। শুনে হুমায়ুন আজাদ বিরক্তি নিয়ে তাকালেন তাঁর দিকে। বললেন, ‘তসলিমার নাম উচ্চারণ করতে হবে, এমন কিছু এখানে আমি দেখছি না।’

রাত ন’টার দিকে হুমায়ুন আজাদ চলে গেলে ছফা ভাই বললেন, ‘দেখছ, ও এতগুলা লোকের সামনে কী করল! বাইরের লোকের সামনে তসলিমারে নিয়া এইটা বলা ঠিক হইছে? ভদ্রলোক বাংলা জানলে ইজ্জত বলে কিছু থাকতো?’ আরও বললেন, ‘ওর এখনও বুদ্ধিসুদ্ধি হল না। আরে, এত সোজা, জামাত-বিএনপির হাত থেকে মুক্তি এত সহজ! উন্মাদ! বোকা লেখক! ওর আরও বিপদ আছে।’

কিস্তি-৬
......
চঞ্চল আশরাফ | ৬ অক্টোবর ২০০৮ ৩:৪৬ অপরাহ্ন

১৯৯৭ সালে, শীত আসি-আসি করছে এমন এক সন্ধ্যায় হুমায়ুন আজাদকে রিকশায় সেন্ট্রাল লাইব্রেরির উত্তর পাশের রাস্তা দিয়ে পুব দিকে যেতে দেখি। ‘স্যার, স্যার’ বলে চিৎকার করি। কেন যে! তিনি রিকশা থামালেন। ‘শাহবাগ যাচ্ছি। যাবে?’ বললাম, ‘যাব।’ উঠে বসলাম। লাইব্রেরির পেছনে বসে-থাকা জুটিবদ্ধ ছেলেমেয়েদের প্রসঙ্গ এনে তাঁকে বললাম, ‘স্যার, এই-যে প্রেমের বা শারীরিক ঘনিষ্ঠতার দৃশ্য দেখা যায়, এতে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা খুব খারাপ হয়ে গেছে।’
—————————————————————–
‘দেখেছি ঈদ সংখ্যার অপদার্থ লেখক ও টিভির শোচনীয় নাটক, হুমায়ুন আহমেদের শরৎসমগ্র; দেখেছি কবির চেয়ে আবৃত্তিকারের সম্মান … বাস্তবিক, আর কিছু দেখেছি কি? দেখি নি কি তোষামোদে উড়ে আসে সব পুরস্কার?’ পরের বছর, বইমেলায় হুমায়ুন আজাদ আমাকে দেখেই বললেন, ‘তোমার দারুণ সাহসী একটা লেখা পড়লাম। আরও যা-যা দেখছ, সব লিখবে, তুমি পারবে। থেমো না।’
—————————————————————-
বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের এই অবস্থা দেখে আমার আনন্দ হয় আবার বেদনাও বোধ করি। তাদের শারীরিক আনন্দের কোনও ব্যবস্থা নেই। সেটা অবশ্য কোনও অবিবাহিতেরই নেই। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের যৌনানন্দের জন্যে, বিশেষ করে যারা অবিবাহিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত হলগুলোতে একটা ব্যবস্থা রাখা। কী বলো!’

বললাম, ‘সাধারণ মানুষের ধারণার ব্যাপারটা?’

বললেন, ‘সাধারণ মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের কী বোঝে? বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা বড় মাপের মসজিদ-মাদ্রাসা-মক্তব হিসেবে দেখতে চায়, যদিও নারায়ণগঞ্জে এক ইমাম মসজিদের ভেতর নিয়ে গিয়ে এক নাবালিকাকে ধর্ষণ করেছে আর মাদ্রাসাগুলোতে কী হয় তা তো জানো।’ যাদুঘরের উত্তর-পশ্চিম কোণে জ্যামে পড়ে রিকশা কিছুক্ষণের জন্যে থামে। তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়ত, তারা ভাবতে চায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ে এবং পড়ায় তাদের রক্তমাংস বলে কিছু থাকতে নেই; তৃতীয়ত, যৌনানন্দ তাদের কাছে খুব খারাপ জিনিস, যদিও সুযোগ পেলে তাতে আপত্তি তাদের নেই। নিজের দৈহিক সুখ প্রত্যেকেই চায়; কিন্তু সেটা অন্য কেউ পেলে মাথা ঠিক থাকে না।’ পাশের রিকশারোহী এক মহিলা আমাদের দিকে তাকালেন। জ্যাম কেটে গেলে সেই রিকশা গতি পায় আর আমাদের বহনকারী রিকশাটি ডানে বাঁক নিয়ে বাঁ-দিকে যায়, থামে আজিজ মার্কেটের সামনে। রিকশাভাড়া মিটিয়ে ‘পাঠক সমাবেশে’র সামনে সিগারেট-দোকান থেকে এক প্যাকেট বেনসন কেনেন তিনি। কিনে মার্কেটের ভিতরে ঢুকে ডান দিকের প্যাসেজ ধরে হাঁটতে থাকলে, তাঁকে ‘কেমন আছেন, স্যার?’ বা, ‘স্যার, ভালো আছেন?’ — এই ধরনের প্রশ্ন অন্তত বিশ জন করেন এবং তিনি ‘ভালো’ বলতে বলতে ‘বিদিত’ নামের বইদোকানটিতে ঢোকেন। বাবুল তাঁকে বসার জন্যে একটা চেয়ার দেন। চায়ের ব্যবস্থাও করেন।

সেই সন্ধ্যায়, সেখানেই তাঁর সঙ্গে একরকম বিতণ্ডা হয় আমার। কিছুই না, সাধারণ একটা জিজ্ঞাসা থেকে অসাধারণ সেই বিতণ্ডার উৎপত্তি। জিজ্ঞাসাটি ছিল: স্যার, আপনার লেখালেখি কেমন চলছে?

‘লিখছি। কিন্তু তুমি যেটা বললে, ওসব আমি করি না।’

‘করেন না মানে! এই যে বললেন, লিখছি!’

‘আমি লিখি। লেখালেখি করি না। ওটা হাতাহাতি অথবা ঠেলাঠেলির মতো ব্যাপার। যেমন একজন লিখলে তার বিরুদ্ধে যদি কেউ লেখে সেটাই লেখালেখি। বুঝেছ?’

‘আপনি যা বোঝাচ্ছেন, তা আমি মানছি না স্যার। লেখালেখি সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে হাতাহাতির মতোই, কিন্ত এর মানে লিখে-যাওয়া, একটা কিছু লিখলেন, তো আর-একটা কিছু লিখছেন।…’

‘তুমি আমাকে শেখাচ্ছ?’

‘তা কেন হবে! সবই তো আপনার জানা।’

‘যা বলতে চাও বলো।’

‘শব্দ সৃষ্টির কোনও কাজেই লাগে না প্রথাগত ব্যাকরণ, অর্থ সৃষ্টিতে তো প্রশ্নই ওঠে না। শব্দ সৃষ্টি করে মানুষ। অর্থও, আবার সেটা তারা বদলেও ফেলে। লেখালেখি শব্দটা মানুষ যে-অর্থ দিয়ে বোঝে, আপনি যদি সেটা বদলাতে চান, মানুষ গ্রহণ করলে আমার আপত্তি থাকবে কেন!’

তিনি রেগে গেলেন। বললেন, ‘ব্যাকরণের কী জানো তুমি?’

বললাম, ‘কোনও শিক্ষক যখন তার ছাত্রের জ্ঞান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন, তখন সেই শিক্ষকের জ্ঞান নিয়ে সন্দেহের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়।’

‘কী বলতে চাও?’

‘স্যার, আমার ব্যাকরণজ্ঞান সম্পর্কে আপনার ভালো করে জানার কথা। কারণ আপনি আমার শিক্ষক।’

‘তোমার অবস্থা কী-রকম জানো? তোমার অবস্থা হয়েছে প্রাচীন গ্রিসের জেনোর মতো, যার যুক্তিপদ্ধতিতে কুতর্কেরই বিকাশ ঘটেছে।’ বলতে বলতে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং দোকান থেকে বের হয়ে গেলেন।

পরে হিস্ট্রি অব ফিলোসফিসহ ইংরেজি ও বাংলা মিলিয়ে চার-পাঁচটি বই পড়ে দেখলাম যে, জেনোর যুক্তিপদ্ধতি আসলেই গোলমেলে; কিন্তু আমার ওই কথাটার সঙ্গে এর কোনও মিল বা সম্পর্ক নেই। তবে এতে আমার লাভই হয়েছিল। কিছু বই তো পড়া হল!

১৯৯৮ সালে বইমেলা চলাকালে বাংলা একাডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্পের বইয়ের স্টল বরাদ্দ এবং তরুণ লেখক পুরস্কার নিয়ে দুর্ভাগ্যজনক যে-দু’টি ঘটনা ঘটে, তা না-বললে হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে আমার চিরসুখকর এক স্মৃতি বর্ণনার পথই খুলবে না। প্রথম ঘটনাটি সে-ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না-হলেও, দ্বিতীয় ঘটনার আগে যেহেতু তা ঘটেছে, অন্তত সেই কারণে সংক্ষেপে তার উল্লেখ জরুরি। প্রকল্প থেকে প্রকাশিত বই মেলায় বিক্রির জন্যে পুকুরের দক্ষিণ-পুব কোণে যে-স্টলটি বরাদ্দ করার কথা ছিল, তা থিয়েটারকে, মানে রামেন্দু মজুমদারকে দেয়া হয়। এতে প্রতিবাদ আমরা অল্প ক’জন করেছিলাম, কাজও হয়েছিল। (এর মধ্যে কিছু ঘটনা আছে, সে-সব পরে বলব। এই প্রকল্প নিয়ে স্মৃতিকথা তো আমি লিখবই!) আমাদের স্টলটি বর্ধমান হাউসের সামনের গাছটিকে ঘিরে গোলাকৃতি (শূন্যও গোলাকার!) করে বাংলা একাডেমীই বানিয়ে দেয়। শামসুর রাহমান স্টলটি উদ্বোধন করেন। প্রতিবাদস্থলে তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে ‘আমি পুলিশ দিয়ে তোমাদের মেলা থেকে বের করে দিতে পারি’ — বাংলা একাডেমীর তখনকার মহাপরিচালক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের এই উক্তির প্রতিবাদে উদ্বোধন-অনুষ্ঠানটি বর্জন করি। যারা পুরস্কারের লোভে বা প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরির আশায় প্রতিবাদে অংশ নেন নি, তারাও মহাউৎসাহে নিজেদের বই নিয়ে হাজির অবশ্য হয়েছিলেন। আহমেদ মাওলা নামের এক লেখক নিজের বইয়ে ‘বাংলা একাডেমী তরুণ লেখক পুরস্কারপ্রাপ্ত’ লাল রঙে মুদ্রিত একটি কাগজ সেঁটে দেন। তখনও সেই পুরস্কার ঘোষণাই হয় নি! দু’দিন পরে তা ঘোষণা করা হলে তাতে ওই লেখকের নামও শোনা গেল। প্রকল্প থেকে প্রকাশিত যে-বিশটি বই পুরস্কৃত হল, সেগুলোর অন্তত এক ডজন ছিল প্রকাশের তো বটেই, পাঠেরও অযোগ্য। কবিতার জন্যে ফয়জুল আলম পাপ্পু, প্রবন্ধের জন্যে আহমেদ মাওলা, সৈয়দা আইরিন জামান এরকম আরও থোকা-থোকা নাম, যাদের বই পুরস্কৃত হওয়ার ঘটনায় অনেকের সঙ্গে আমিও স্তম্ভিত হয়ে যাই। সৈয়দা আইরিন জামানের বইটির কথাই একটু বলি। জীবনানন্দের বনলতা সেন/ কবিতার গদ্যভাষ্য ও অব্যয়ের ব্যবহার বইয়ে ‘কমলালেবু’ কবিতা নিয়ে তিনি লিখেছেন: ‘আকৃতিগতভাবে পৃথিবী কমলালেবুর মতো। এই অর্থে পৃথিবী কমলালেবুর প্রতীক। কমলালেবু কবিতাটি ফিউচারিজমে আক্রান্ত একটি গদ্যকবিতা। ফিউচারিজমের অন্যতম লক্ষণ হলো যুগজ্বর।…’

আলোচক বোঝাতে চাইছেন, কবিতাটি ফিউচারিজম নামের একটা ব্যাধিতে ‘আক্রান্ত’ হয়েছে! বইয়ের শেষদিকে আবার পাই চার্টও করেছেন তিনি, বনলতা সেন-এ অব্যয়ের হিসাব দিতে গিয়ে! এত কিছু ‘করেও’ পুরস্কৃত না-হওয়াটা বাংলা একাডেমীর জন্যে খুব দুঃখের হতো নিশ্চয়। যা-ই হোক, পুরস্কার প্রদানের পর যখন শামসুর রাহমান সভাপতির ভাষণ শুরু করছেন, তখনই আমি স্টেজের সামনে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম: এই পুরস্কার মানি না! আমি এর প্রতিবাদ করছি, ধিক্কার জানাচ্ছি বাংলা একাডেমীকে, রাহমান ভাই, বক্তৃতা বন্ধ করুন, এই অপকর্মের সঙ্গে যে আপনি নাই সেটা প্রমাণ করুন!’

পুরস্কৃত মুজিব ইরম আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমাকে তিনি থামানোর মৃদু চেষ্টা করলেন, কিন্তু হৈচৈ শুরু হয়ে গেলে আমি বেরিয়ে পড়লাম অডিটোরিয়াম থেকে। দরজা ঠেলে বের হওয়ার সময়, রাহমান ভাই বলছেন, শুনতে পাচ্ছিলাম, ‘ওকে আমি চিনি, কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।…’ মাইক বন্ধ হয়ে গেল। আর আমার সঙ্গে উপস্থিত তরুণ লেখকদের একটা অংশও বেরিয়ে এল। অডিটোরিয়ামের বাইরে সেলিনা হোসেন (তখন তিনি প্রকল্প পরিচালক) আমাকে একপাশে দেয়ালের কাছে নিয়ে বললেন, ‘এই প্রকল্প থাকুক, তুমি চাও না?’ বললাম, ‘এইভাবে চাওয়া যায় না।’ বললেন, ‘পুরস্কার পাও নি, সে জন্যে মাথা খারাপ হয়ে গেছে!’ বললাম, ‘নিজের পুরস্কারের চিন্তা করলে স্টলটি যে কেড়ে নেয়া হয়েছিল, প্রকাশ্যে তার প্রতিবাদ করতাম না।’ ততক্ষণে দু’তিন জন সাংবাদিক এসে কয়েকটা প্রশ্ন করে চলে গেলেন, আর শামসুর রাহমানের হাত ধরে বেরিয়ে এলেন সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। রাহমান ভাই কিছু যেন বলতে চাইলেন; কিন্তু তার আগেই আমাকে লক্ষ করে সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বললেন, ‘রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত তাঁকে সমীহ করেন।’ বললাম, ‘তাতে কী!’ একজন ভিড়ের ভেতর থেকে বলে উঠল, ‘আপনি সাহিত্যের মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে ঢোকাচ্ছেন কেন?’ শামসুর রাহমানের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘দেখেছেন কী-রকম বেয়াদব!’ তারপর আমাকে ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘তুমি তাঁকে যে-অপমান করেছ, তার জবাব অবশ্যই পাবে।’ (জবাব তিনি কীভাবে দিয়েছিলেন, তা এক সময় লিখব) বলে, চোখ রাঙিয়ে চলে গেলেন। ঠিক করলাম, ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে দেয়া যায় না। আর-একটু প্রসারতা দরকার।

বঞ্চিতদের, বিশেষ করে পুরস্কার পাবেন বলে যারা আশা করেছিলেন এবং যোগ্যও ছিলেন — এই ধরনের মুহূর্তে মিলিত হওয়াটাই সাধারণ বাস্তবতা। ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন এতে গৌণ, তারা যে পান নি, সেটাই তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে। এই না-পাওয়ার দল, যাদের অধিকাংশই স্টল-ঘটনার প্রতিবাদে সশরীরে থাকা দূরের কথা, প্রতিবাদপত্রে স্বাক্ষরই করে নি বা আমাদের দেখেই অন্য দিকে সরে গেছে, অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর, আমার সঙ্গে থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই আর দেখা যায় না। শুরু থেকে, মানে প্রথম ঘটনা থেকে প্রতিবাদী কয়েকজন আমার সঙ্গে বাংলা একাডেমীর বাইরে দেয়ালের পাশে চা-দোকানে এসে তাদের অন্তত সেদিনের সমস্ত ক্ষোভ নিষ্কাশন করে চলে যান। বুঝতে পারি, বঞ্চিতদের খুব বড় অংশটির আর-একটা আশা আছে, সেটি বাংলা একাডেমীতে তাদের চাকরি। এটা আমার তখনকার ধারণা; সবার ক্ষেত্রে তা সমানভাবে সত্য না-ও হতে পারে।

বিকেলে আমি প্রকল্প থেকে প্রকাশিত নিজের বইটির সমস্ত কপি পোড়ানোর জন্যে শূন্যাকৃতির সেই স্টলটির সামনে দাঁড়ালাম। অনেকেই আমাকে কাজটি না-করার অনুরোধ জানালেন। দু’একজন শুধু এক কপি পুড়িয়ে ‘প্রতীকী প্রতিবাদ’ জানানোর পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তাতে কান না-দিয়ে যখনই দেশলাই বের করেছি পকেট থেকে, তখন হুমায়ুন আজাদ হাজির; সঙ্গে একদল ছেলেমেয়ে। বই পোড়ানোর কারণ, মনে হল, ইতোমধ্যেই তিনি জেনেছেন। বললেন, ‘এই বাংলা একাডেমী পুড়িয়ে দিতে পারো না? এই বই তো তোমার সন্তান। সন্তানের গায়ে কেউ আগুন দেয়?’ বর্ধমান হাউসের দিকে আঙুল তুলে আরও বললেন, ‘পারলে এই ভবন জ্বালিয়ে দাও। তোমার বই এই ভবন থেকে অনেক বেশি মূল্যবান। এখানে যারা বছরের পর বছর মুলো ধ্বংস করছে, তাদের জীবনের চেয়ে তোমার বই অনেক বেশি মূল্যবান। সেলিনা হোসেন জীবনভর যা লিখেছে, তার যোগফল তোমার একটা কবিতার সমান হবে? তোমাকে আমি বই পোড়াতে দেব না। বরং তুমি, নাও, সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করো।’ বলে, প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দিলেন; নিজেও নিলেন এবং অগ্নিসংযোগ করলেন। মুক্তকণ্ঠের এক ফটোসাংবাদিক এলে হুমায়ুন আজাদ আমার কাঁধে হাত দিয়ে ছবি তুললেন। আমাদের হাতে সিগারেট। আরও কয়েকজন সাংবাদিক এলে হুমায়ুন আজাদ তাঁদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘চঞ্চল আশরাফ আমার ছাত্র, সে বাংলা একাডেমীর অপকর্মের প্রতিবাদে নিজের বই পোড়াতে চেয়েছে। আমি তাকে তা করতে দিই নি।’ বাকি কথা আপনারা ওর কাছ থেকে জেনে নেবেন। বলে তিনি স্থানত্যাগ করলেন।

১৯৯৯ সালে, সম্ভবত নভেম্বরের কোনও এক সন্ধ্যায় হোটেল সোনারগাঁওয়ে আমার বড় ভাইয়ের শ্বশুরপক্ষের এক নিমন্ত্রণে (ওটা ছিল ভাবির কানাডাপ্রবাসী এক জ্যাঠাতো ভাইয়ের বিয়েরই অনুষ্ঠান) সপরিবারে যাই। সেখানে দেখি হুমায়ুন আজাদ বরের বাবার (তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২২ নম্বর আসামি মাহফুজুল বারী, সে-সময় পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের অফিসার ছিলেন) সঙ্গে কথা বলছেন দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে তিনি ডাকলেন এবং হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন! পাশে আমার স্ত্রী ঝুমু ছিল। ওকেও পরিচয় করিয়ে দিলে হুমায়ুন আজাদ আমাকে লক্ষ করে বললেন, ‘তুমি আবার বিয়ে করেছ?’ ইঙ্গিতটা খুব পরিষ্কার। এসব জায়গায়, বা, কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে এই ধরনের কথা যিনি বলতে পারেন, তাঁর সঙ্গে প্রত্যুত্তরে যাওয়ার ফল কী, আমার জানা হয়ত ছিল না; কিন্তু যা আমার স্বভাববিরুদ্ধ, আমি তা-ই করলাম; মানে, মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যার, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না পড়ে আমারও ঘুম হয় নাই।’ তিনি বললেন, ‘এখনও সেই শোক কাটে নি দেখছি!’ কাছাকাছি বসেছিলেন আমার বাবা, মা, ভাই আর ভাবি। ভাগ্য ভালোই বলতে হয়, তখন সেখানে তাঁরা ছিলেন না। যা-ই হোক, আমি আর ঝুমু সেখানে গিয়ে বসলাম।

পরের বছর অর্থাৎ ২০০০ সালে বেরোয় তাঁর উপন্যাস নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু। প্রথম আলোর সাময়িকীতে সমালোচনার জন্যে বইটি আমাকে দেন ব্রাত্য রাইসু। দেয়ার সময়, তিনি হাসতে হাসতেই বলেন, ‘আপনার গুরুর বই, শিষ্যত্ব বাদ দিয়া আলোচনা করবেন।’

বইটি পড়তে দুই রাত লাগল। পঞ্চাশের দশকে কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে জলকদর নামে এক শিশুর বেড়ে-ওঠা এবং তার যৌবনপ্রাপ্তির (ফ্রয়েডীয়) ব্যাখ্যা হাজির করা হয়েছিল উপন্যাসটিতে।

প্রথম আলোর সাময়িকীতে ‘কেবল ভাষা যখন উপন্যাসের সম্বল’ শিরোনামে সেই উপন্যাসটির সমালোচনা প্রকাশিত হলে তার একটি প্রতিক্রিয়াও ছাপা হয়। আমি সম্ভবত পরের সংখ্যায় এর জবাব দিই। দিলে কী হবে, ২০০২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা এগারোটার দিকে, বইমেলায়, বাংলা একাডেমীর অগ্রণী ব্যাংকের সামনে হুমায়ুন আজাদকে দেখে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে যখন বললাম ‘কেমন আছেন স্যার?’ তিনি বললেন, ‘তুমি কে? তোমাকে আমি চিনি না।’

বললাম, ‘চেনেন ঠিকই স্যার। হয়ত কোথাও গোলমাল হয়ে গেছে।’

ঝুমু ছিল আমার সঙ্গে। তার চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, সে কষ্ট পেয়েছে। আমার হাত ধরে বলল, ‘চলো, এখানে আর দাঁড়ানো যাচ্ছে না।’ আমরা তাঁর সামনে থেকে সরে ‘দ্রৌপদী’ নামের স্টলটির দিকে গেলাম। সেখানকার কয়েকজন তরুণ (অশোক দাশগুপ্তর কথা মনে পড়ছে) ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলেন। আমার সঙ্গে কথা বলে চলে গেলেন তাঁরা এবং কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলেন। বললেন, ‘স্যার, মানে হুমায়ুন আজাদ আপনাকে যেতে বলেছেন।’ কিছু বলতে যাব, এমন সময় ঝুমু আমাকে বলল, ‘না চঞ্চল তুমি যাবে না।’

একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলে আমি পরবর্তী কিস্তির জন্যে দম নেব। ১৯৯৮-র ডিসেম্বরে গদ্য নামের একটি ছোটকাগজে ‘আত্মজীবনীর কয়েকটি পাতা’ লিখি। তাতে একটা অনুচ্ছেদ ছিল — ‘কী দেখিতে চাই আর? দেখেছি ঈদ সংখ্যার অপদার্থ লেখক ও টিভির শোচনীয় নাটক, হুমায়ুন আহমেদের শরৎসমগ্র; দেখেছি কবির চেয়ে আবৃত্তিকারের সম্মান, সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবন-বৃত্তান্ত ও উপন্যাসের কাহিনী লিখে অধ্যাপকের ডি লিট অর্জন; বাস্তবিক, আর কিছু দেখেছি কি? দেখি নি কি তোষামোদে উড়ে আসে সব পুরস্কার?’ পরের বছর, বইমেলায় হুমায়ুন আজাদ আমাকে দেখেই বললেন, ‘তোমার দারুণ সাহসী একটা লেখা পড়লাম। আরও যা-যা দেখছ, সব লিখবে, তুমি পারবে। থেমো না।’ নিজের লেখা নিয়ে আমার সব সময় সন্দেহ; প্রকাশের পরও, বেশির ভাগ সময় লেখার ত্রুটি খুঁজতে থাকি। কারও প্রশংসাও তাতে কোনও ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। কিন্তু হুমায়ুন আজাদের সেই কথা শুনে কী-যে ভালো লেগেছিল আমার, চোখে পানি এসেছিল; প্রিয় পাঠক, এই-যে এখন লিখছি, আমার চোখ ভিজে আসছে।…


কিস্তি-৭
........
চঞ্চল আশরাফ | ২৯ মে ২০০৯ ৫:০৬ পূর্বাহ্ন
বইমেলা প্রিয় ছিল তাঁর; বছরের এই সময়টায় তাঁকে বেশি উৎফুল্ল দেখা যেত; সপ্তাহের প্রতিদিনই তিনি আসতেন বিকালে, থাকতেন মেলা শেষ হওয়া অব্দি; শুক্রবার দুপুরেই চলে আসতেন; প্রায়ই দেখা যেত অনুরাগী ও উৎসাহী কয়েকজন তাঁর সঙ্গেই হাঁটছে, তিনি আগামী প্রকাশনীর স্টলে বসলে সেখানে তাৎক্ষণিক ও সাময়িক আড্ডা জমে উঠেছে তাঁকে নিয়ে। ১৯৯৬-৯৭-র দিকে দেখেছি তাঁর পাশে বসে আছেন আকিমুন রহমান (কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক; হুমায়ুন আজাদের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি করেছেন); দু’জনেই কলা খাচ্ছেন। কলা তিনি পছন্দ করতেন খুব, আন্ওয়ার ভাইয়ের বাসায় গিয়ে সামান্য কথাবার্তার পর বলতেন, ‘আন্ওয়ার সাহেব, কলা আছে? কলা খাবো।’

তো, একদিন বইমেলায়, সেটা ২০০১ সালে সম্ভবত, দৈনিক আজকের কাগজ-এর (২০০৭-এ বন্ধ হয়ে গেছে পত্রিকাটি) সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ আগামী প্রকাশনীর স্টলে গিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়েই সেলসম্যানকে বললেন. ‘হুমায়ুন আজাদের যত বই বেরিয়েছে, সব প্যাকেট করুন। প্রতিটা দশ কপি করে দেবেন।’ একটার পর একটা বই জড়ো করছেন সেলসম্যান, হুমায়ুন আজাদ সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে তারপর তাকালেন ক্রেতার দিকে; তারপর সন্ধ্যারঞ্জিত পশ্চিমাকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ততক্ষণে মেলার সব আলো জ্বলে উঠেছে। চশমায় সেই আকাশ আর আলো তত বিপুল ছিল না; কেননা, নিজের বই বিক্রির আনন্দ তাঁর মুখে যে আভা ও রেখা তৈরি করেছিল, তা-ই দর্শনীয় হয়ে উঠেছিল। তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে খুব আয়েশি ভঙ্গিতে ধোঁয়া ছাড়লেন। মনে হয়েছিল, ধূমপান তাঁর উদ্দেশ্য নয়; উদ্দেশ্য কাজী শাহেদ আহমেদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করা। সেটা হয়ত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। নইলে এটা তিনি বলতে পারতেন না যে, ‘ধূমপান পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।’ হুমায়ুন আজাদ গম্ভীর চেহারা ও স্বরে বললেন, ‘বাঙালির জ্ঞানভাণ্ড উপচে পড়ছে দেখছি!’

এক বার মেলা থেকে তাঁকে বের হতে দেখে পিছু নিলাম। আণবিক শক্তি কমিশনের সামনের দোকান থেকে সিগারেট কেনার মুহূর্তে একটা ছেলে এসে তাঁকে সালাম দিল। ততক্ষণে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছি আমি। সে যে বাঙলা বিভাগের ছাত্র, তা মোটামুটি বুঝতে পারা গেল তখন, তিনি যখন বললেন, ‘সালাম পেলে আমি খুশি হতে পারি না। কারণ, আমার খালি মনে হয়, বাঙালিকে পাকিস্তান যেভাবে চেয়েছিল, সেভাবেই আছে এখনও।’ ছেলেটি দু’হাত জোড় করে বিব্রত ও লাজুক চেহারায় সামান্য হাসল। আমি বললাম, ‘স্যার, মানুষ এই সংস্কৃতি কিন্তু গ্রহণ করেছে। সেটা পাকিস্তান চেয়েছিল বলে নয়, নিজেদের মুসলমান ভাবে বলে।’

ছেলেটি স্থানত্যাগ করল। সঙ্গে-সঙ্গে আরও দু’জন ছেলে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। ‘ভালো আছেন স্যার?’ তখন হুমায়ুন আজাদ সিগারেটে অগ্নিসংযোগের উদ্যোগ নিচ্ছেন মাত্র, তা না-করে বললেন, ‘ভালো আছি। তোমরা ভালো আছ?’ সিগারেট ঠোঁটেই ছিল, ধরিয়ে, ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘চা খাবে?’ ওই দোকানের সামনের বেঞ্চটিতে বসার জায়গা ছিল না। ছেলে দু’টি বসে-থাকা লোকদের উদ্দেশে বলল, ‘স্যারকে বসতে দেন।’ শুনে দু’তিনজন উঠে দাঁড়াতেই তিনি তাদের বসতে বললেন। পরের বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি ওই দোকান থেকে ২০-২৫ গজ দূরে তিনি ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন। সেই রাতে আমি তাঁকে ফুলার রোডের বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। টিএসসি পার হতে হতে তিনি জানতে চাইলেন আমি কোথায় থাকি; বাসায় আমার কে-কে থাকে; বললাম, ‘ইন্দিরা রোডে থাকি। বাসায় আমার বউকে নিয়ে বাবা-মা-ভাই-বোনের সঙ্গে থাকি।’

‘সন্তান আছে?’

বলি, ‘আছে। ছেলে। একটা।’

‘কী নাম রেখেছ?’

‘ঋষভ।’

‘হুম। ভালো। হামা দেয়, না হাঁটে?’

‘হাঁটার সময় এখনও হয় নাই স্যার।’

ডাসের সামনের রাস্তাটি পার হওয়ার আগে আরেকটা সিগারেট ধরালেন তিনি। বললেন, ‘উত্তর দেয়ার এই ধরনটা তুমি কোত্থেকে পেয়েছ? বলবে হামা দেয় বা হাঁটে।’

‘স্যার, জন্মসূত্রে মনে হয় এটা আমি পেয়েছি। তবে উত্তরটা আমি নিজের মত দিতে পছন্দ করি। আর প্রশ্নকর্তাকে কিঞ্চিৎ খটকায় ফেলতেও ভালো লাগে স্যার।’

আমরা রাস্তা পার হয়ে রোকেয়া হলের সামনে আসি। তিনি বললেন, ‘সেজন্যেই তো পরীক্ষায় তুমি ভালো করতে পারো নি।’ বললাম, ‘সেটা পারা আমার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষায় আমি ভালো করেছিলাম। মাস্টার্সের মৌখিক পরীক্ষায় স্যার আমিই একমাত্র ফার্স্ট ক্লাস নম্বর পেয়েছিলাম। তবে সেজন্যে আমার কোনও প্রস্তুতি ছিল না। কারণ, মৌখিক পরীক্ষায় প্রথম হওয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না।’

আমার একটা ‘বদঅভ্যাস’ আমি খুব শব্দ করে কথা বলি। আবেগ আর উত্তেজনায় বেশ চেঁচিয়ে উঠি। ফলে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ও বসে থাকা ছেলেমেয়েরা আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। হয়তো তারা হুমায়ুন আজাদকে দেখছিল—এও ভেবে যে, কোথাকার এক চশমাপরা লোক বিখ্যাত এই লেখকের সঙ্গে ‘বেয়াদবি’ করছে!

আমরা দেয়াল ঘেঁষে হাঁটছিলাম। ‘কারা তোমার পরীক্ষা নিয়েছিলেন?’

বলি, ‘আনিসুজ্জামান, আহমেদ কবীর এঁরা ছিলেন। আর ভুঁইয়া ইকবাল এসেছিলেন বাইরে থেকে।’

‘প্রশ্নগুলো মনে আছে?’

‘আছে। পরীক্ষাটা খুব উপভোগ করেছি স্যার। কার জন্ম কত সালে, কোন বইয়ের মলাট কেমন, লেখক কে—এই ধরনের প্রশ্ন আমাকে করা হয় নাই।’

‘তা হলে কী প্রশ্ন করা হয়েছিল?’

‘এটা নিয়ে আমি প্রবন্ধ-গোছের একটা গদ্য লিখেছি। অরুন্ধতীতে।’

‘আবার তুমি ঠিকমতো উত্তর দিচ্ছ না।’

‘আমি তো স্যার পরীক্ষা দিচ্ছি না।’

‘তোমার পরিবর্তনের আশা আমি ছেড়ে দিয়েছি। এই স্বভাব নিয়ে কোনোদিন তোমার উন্নতি হবে না।’

‘স্যার, একটা প্রবচনে আপনি বলেছিলেন, উন্নতি হচ্ছে উপরের দিকে পতন।’

কিছুক্ষণ তিনি চুপ করে রইলেন। ভিসির বাড়ি পার হয়ে বাম দিকে হাঁটছিলাম আমরা। তিনি আমার দিকে না-তাকিয়েই বললেন, ‘এখন বাসায় যাও।’

বলি, ‘আপনাকে আর একটু এগিয়ে দিই।’

‘তুমি যাও। আমি কখনও পিছিয়ে থাকি না।’

‘সেটা জানি। কিন্তু আমি আপনার সঙ্গে আর একটু হাঁটতে চাই।’

আমরা চুপচাপ রাস্তা পার হলাম, হাঁটতে হাঁটতে আবাসিক ভবনগুলোর সেই গেটে যখন এলাম, তিনি বললেন, ‘আর যেতে হবে না তোমাকে। অরুন্ধতীর ওই সংখ্যার একটা কপি আমাকে দিও তো!’

সেই কপি আমি তাঁকে দিতে পারি নি। এই না-পারার কথা ভাবলে আমার ছফা ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। তাঁর কবিতার বইয়ের ওপর সাপ্তাহিক খবরের কাগজে আমি একটা আলোচনা লিখেছিলাম ২০০০ সালে। প্রকাশের তিন দিন পর তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, ‘তুমি খুব চমৎকার লিখেছ, কবিতা তুমি এত ভালো বোঝ, আমার জানা ছিল না। নিশ্চয় তুমি ভালো কবিতা লেখো। তোমার কবিতা আমি পড়তে চাই।’

আনন্দে তখন আমার বাকযন্ত্র প্রায় নিষ্ক্রিয়; আমি শুধু ‘জ্বি-জ্বি’ করতে লাগলাম। উল্লেখ বাহুল্য নয়, সাপ্তাহিক খবরের কাগজে প্রতি সংখ্যায় ওই সমালোচনা লিখে আমি খুব কমই প্রশংসা পেয়েছি; নিন্দিত হয়েছি অনেক বেশি, বিশেষত যাঁদের বই নিয়ে কাজটি করেছি। প্রায় সব বই হাসান মাহমুদের হাত থেকে আসত, যেগুলোর বেশির ভাগই ছিল সমালোচনার অযোগ্য। সম্পর্ক ভালো বা টিকিয়ে রাখার জন্যে সাহিত্যে যে-অসততার চর্চা হয়ে আসছিল, তা থেকে নিজেকে মুক্ত বা দূরে রাখার চেষ্টা করেছি আমি। ফলে, অনেকে আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। সমালোচনা প্রকাশের পর দু’একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে শুনেছি। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবেই ছফা ভাইয়ের এসব কথা শুনে আমার মন ভালো হয়ে গেল।

তিনি বললেন, ‘তুমি কী খাবে, বলো। তুমি চাইলে আমি একটা বোতল পাঠিয়ে দিতে পারি।’

বললাম, ‘না-না, আমিই আসবো।’

বললেন, ‘এ-বছর তোমার কোনও বই বেরিয়েছে?’

‘না।’

‘তোমার বই অবশ্যই বের হবে। তুমি পাণ্ডুলিপি নিয়ে চলে এসো। মেলায় হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। সৃষ্টিশীলদের মৌসুম থাকতে নেই।’

তাঁর আবেগ আমাকে তছনছ করে ফেলেছিল, সেই সুখকর তাণ্ডবে এইসব কথা আমি সারাদিন মনে-মনে বহুবার শুনতে পেয়েছি। না নিজের কবিতার বই, না পাণ্ডুলিপি, কোনওটাই আমি দিতে পারি নি তাঁকে।

হুমায়ুন আজাদকে একদিন ছফা ভাইয়ের লেনিন ঘুমাবে এবার কবিতার কথা পাড়তেই তিনি বললেন, ‘বামপন্থিদের এটা পড়া উচিত; খুব পড়া উচিত।’

বললাম, ‘কেন? অন্যদের নয় কেন?’

‘আমি বলছি বিশেষত বামপন্থিদের কথা, এখানকার বামদের কথা, তাদের মধ্যে আবেগ বলে কিছু নেই। তারা ব্যবসা করে; কিন্তু ব্যবসার লক্ষ্য তো মুনাফা। মুনাফা দিয়ে বিপ্লব হয় না।’

‘আপনি কি মনে করেন কবিতাটি পড়ে তাঁরা ব্যবসা ছেড়ে দেবে?’

‘তা ছাড়বে বলছি না। কিন্তু কবিতাটির যে আবেগ তাতে একটা সৌন্দর্য আছে। কবিতা লেখার জন্যে যে জ্ঞান ও সৌন্দর্যবোধ দরকার আহমদ ছফার তা আছে। আমি বুঝি না, এরকম কবিপ্রতিভা নিয়ে কেন তিনি উপন্যাসে নিজেকে উজাড় করে ফেলছেন!’

ছফা ভাইয়ের মৃত্যুর (২৮ জুলাই ২০০১) পরদিন টিএসসিতে তাঁর লাশ আনা হয়। আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। সালাম সালেহ উদদীন, সাখাওয়াত টিপু আর আমি আজকের কাগজ-এর পক্ষ থেকে যাই তাঁকে ফুল দিতে। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। হুমায়ুন আজাদের লাশ জার্মানি থেকে যেদিন ঢাকায় আসে সেদিনও আকাশের চেহারা এমন ছিল; বৃষ্টি হয়েছিল। আমার খুব মনে পড়ছে সমুদ্র গুপ্তর কথা (হায়, তিনিও নেই আজ, ২০০৮ সালের ১৯ জুলাই ভারতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়); ফুলে-ফুলে ছফা ভাইয়ের লাশ ঢেকে গেলে সমুদ্রদা আর্তনাদ করে উঠেছিলেন, ‘এত ফুল কেন? এত ভালোবাসা কি তাঁর সহ্য হবে?’ তখন দেখি টিএসসির ভেতরবারান্দায় ছফা ভাইকে শেষবার দেখার জন্যে দীর্ঘ লাইন; তাতে হুমায়ুন আজাদ, হাতে ফুল তাঁর—রজনীগন্ধা; বিষণ্ণ, শোকগ্রস্ত মুখ নিয়ে তিনি আস্তে আস্তে লাশের দিকে এগুচ্ছেন। ততক্ষণে আমরা ফুল দিয়ে লাশের এক পাশে দাঁড়িয়েছি। আমাদের পেছনে দাঁড়ানো কে যেন বলে উঠল, ‘মাসখানেক আগেই তো দেখলাম স্যারের সঙ্গে ছফা ভাইয়ের কথা কাটাকাটি হইছে।’ ঘাড় ঘুরিয়ে টিপু বলল, ‘আপনার সমস্যা কী?’ ‘না, মানে স্যার তো ফুল দিতে আইছেন।’ টিপু বলল, ‘মতের পার্থক্য থাকলেও উনাদের জগত একটাই। পথ ভিন্ন হইলেও লক্ষ্য এক।’

কিন্তু কেন যেন মনে হল সব অর্থহীন। মনে হল, আমাদের আবেগে বৈধতা আরোপের জন্যে যত যুক্তি থাকুক না কেন, জীবিতের ফুল মৃত গ্রহণ করে না। মৃত ব্যক্তি যত অমর হোক, যত বড় পণ্ডিত হোক জীবিত ব্যক্তি—এই ফুল, শোক, বিষণ্নতা তাকে স্পর্শ করে না।

১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হারালে খুব উৎসব হয়েছিল। যারা পাকিস্তানের সমর্থক তারা একে পাতানো খেলা মনে করে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। বাকিদের জন্যে এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মতোই। এই আনন্দে নির্মলেন্দু গুণ থেকে শুরু করে সবাই মেতেছিলেন তখন। তো, হুমায়ুন আজাদ কেমন আনন্দিত তা জানার চেষ্টা করতেই তিনি বললেন, ‘খেলাটি আমার পছন্দ নয়।’

‘কেন?’

‘এটা তো পাকিস্তানের প্রিয় খেলা।’

‘অন্য দেশগুলিও তো খেলে।’

‘সেটা সেই সব দেশের ব্যাপার।’

‘তা হলে?’

‘বাংলাদেশের এই খেলা বর্জন করা উচিত। খেললেও পাকিস্তানের সঙ্গে নয়। বাঙালির উচিত নয় ওদের সঙ্গে কোনও খেলায় অংশ নেয়া। শুধু খেলা কেন, ওদের সঙ্গে বাঙালির কোনও সম্পর্ক রাখা উচিত নয়।’

‘কিন্তু অনেকেই বলে, খেলার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই।’

‘এটা পাকিস্তানপন্থিরা বলে। নির্বোধরা তা মেনে নেয়। একটা দেশ যখন আরেকটা দেশের সঙ্গে খেলে, রাজনীতি অবশ্যই থাকে। তারা তো নিজেদের পতাকা নিয়ে যায়।’

‘পাকিস্তানকে হারানোর পর সবাই ফূর্তি করছে। আপনার কি একটুও ভালো লাগছে না?’

‘যারা ফূর্তি করছে, তারা কি জানে, পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকে আরও খেলতে হবে? আমি তো ওই চাঁদতারা পতাকার পাশে আমাদের পতাকা দেখতেই চাই না।’

ব্রাত্য রাইসু একটা কবিতা লিখেছিলেন শেষ চরণে হুমায়ুন আজাদের নামোল্লেখ করে, ঘণ্টা (সন্‌ত বেলাল সম্পাদিত, প্রথম সংখ্যা) পত্রিকায়। আমি সেই প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথা ওঠানো মাত্র তিনি বললেন, ‘কবিতাটি আমি পড়েছি। উপহাসের প্রতিভা ওর আছে।’

বললাম, ‘স্যার, এই প্রথম কারও কবিতায় আপনার নাম উঠলো।’

‘হুম। মশকরাও হলো।’

তখনও রাইসুর সঙ্গে আমার পরিচয় ঠিকমতো হয়ে ওঠে নি। এর আগে একবার দেখা হয়েছিল টিএসসিতে, সেটা খুব সম্ভবত ১৯৯০ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের ঘটনা। দিনটি সকাল থেকেই মেঘাচ্ছন্ন ছিল। সেখানে ছিলেন মিহির মুসাকী, মাহবুব মাসুম (এখন মাহবুবুল হক— মাঝেমধ্যে লেখেন, সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন), নীনা আহমেদ (চার-পাঁচটি গল্প লিখে সংসারে হারিয়ে গেছেন), পিনাকী রায় (খুব কষ্ট করে দু’একটি কবিতা লিখে কোথায় হারিয়ে গেছেন, জানি না); প্রায় এক ঘণ্টা সেখানকার ঘাসে বসে আমরা কথা বলেছিলাম। ‘ক্লাসিক’ শব্দের বাংলা কী—এটা নিয়ে সামান্য তর্কও হয়েছিল, মনে পড়ে। তো, ওই কবিতা নিয়ে কথাটা অনেক দিন পর তাঁকে বলি এই ভেবে যে, হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে তাঁর বিশেষ খাতির আছে। আমাকে যখন তিনি বললেন ‘আপনি কি হুমায়ুন আজাদের চ্যালা?’—বুঝতে পারলাম, এ-নিয়ে আর এগোনো ঠিক হবে না। এবং সেই বিকালে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে। টোকন ঠাকুর রুমের মধ্যে ঢুকতেই তাঁকে রাইসু বললেন, ‘কিস হিম!’ টোকন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমার পাশে উর্মিলা আফরোজ (দু’তিন দিন আগে পরিচয় হয়েছে, কবিতা লেখার চেষ্টা করছে এবং সবই রবীন্দ্রনাথের মতো হয়ে যাচ্ছে), তার উপর আমার শরীরটা যেন না-পড়ে, সেই চেষ্টায় সরে গিয়ে শাহরিয়ার রাসেলের (গ্রাফিক আর্টিস্ট, এখন অ্যানিমেশন চিত্রনির্মাতা) পাশে দাঁড়ালাম। কিন্তু টোকন আমাকে চুমু খাওয়ার জন্যে জড়িয়ে ধরেছেন ততক্ষণে; আর রাইসু পানির প্রায় খালি একটা বোতল নেড়ে নেড়ে বলছেন, ‘সাবাশ টোকন, সাবাশ!’ আর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘আপনিও খান, প্রতিশোধ নেন।’…

টোকনের সঙ্গে এটাই আমার প্রথম সাক্ষাৎ। পরিস্থিতি শান্ত হলে আমরা পাশাপাশি বসলাম। এই ঘটনার হেতু রাইসুর কাছে জানতে চাইলাম। জবাব না-দিয়ে তিনি স্বর উঁচু করে বললেন, ‘হুমায়ুন আজাদের চ্যালা বাংলাদেশে ম্যালা।’…

যখন খুব উপন্যাস লিখছেন, তাঁর কবিতা লেখা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ‘কবিতা আর লিখছেন না?’ বা, ‘কবিতা কি ছেড়ে দিলেন?’ এই ধরনের প্রশ্ন তাঁকে করতেন অনেকেই। তিনি প্রায়ই একটা কথা বলতেন, ‘ভাষা দূষিত হয়ে গেছে; বাংলা ভাষার শব্দগুলো কবিতায় নতুন অর্থ সৃষ্টির শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।’ ১৯৯৮-র বইমেলায় এক সাংবাদিক বোকার মত প্রশ্ন করেছিলেন, ‘উপন্যাস লিখছেন কেন?’ তাঁর উত্তর ছিল, ‘কোনও বদমাশকে কি তুমি প্রশ্ন করেছ—আপনি বদমাইশি করছেন কেন? প্রশ্নটি না করে থাকলে কাজটা আগে করে এসো এবং জবাবটাও নিয়ে এসো; তার আগে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেবো না।’ সাংবাদিক সঙ্গে সঙ্গে স্থানত্যাগ করলেন। আরও বললেন, ‘এই সাংবাদিক বেশ অভিজ্ঞ, কিছুদিন আগে সে হুমায়ুন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে; তাতে সে জানতে চেয়েছে, হাসির নাটক লেখার সময় তার হাসি পায় কি-না।’ বললেন, ‘এর আগে এক সাংবাদিক আমার সাক্ষাৎকার নিতে এসে প্রশ্ন করেছিল, আপনার প্রিয় নায়িকা কে? বললাম, তোমার সম্পাদক তোমাকে কার কাছে পাঠিয়েছেন? ওই মহিলা বোঝাতে চাইল যে, সে আমার কাছেই এসেছে। জানতে চাইল, হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস আমি পড়েছি কি-না। বললাম, তিনি আমাকে তাঁর কয়েকটি উপন্যাস উপহার দিয়েছিলেন। তাতে আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা প্রীতিভাজনেষু শব্দে তিনটি ভুল ছিল। এটা দেখেই মনে হয়েছে, এই লেখকের মধ্যে গোলমাল আছে।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন