শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

রাধারমণের গানে নারী, তার রূপক ও বাস্তব


মোস্তাক আহমাদ দীন


ভাবুক ও রসরাজ হিসেবে রাধারমণের স্থান যে-শিখরে, তাতে, এ-পর্যন্ত
তিনি যতটা মূল্যায়িত তা একদমই সামান্য, তবে আশার কথা, তাঁর গানের নানাবিধ সংকলন প্রকাশের পর থেকে গানের ভাবব্যঞ্জনার দিকে এখনকার রসিক-গবেষকের আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। এই আগ্রহীদের বেশির ভাগই রাধারমণের পদ-অন্তরিত বৈষ্ণব-রসের দিকটাকে ফুটিয়ে তুলতে ব্যগ্র। এমন নয় যে তার পদে সেই রস নেই, বরং, আমাদের অজানা নয়, তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন বৈষ্ণব রঘুনাথের কাছে, নলুয়ার হাওরসংলগ্ন আশ্রম স্থাপনের ব্যাপারটিও তো তারই প্রমাণবহ। আমাদের অনুযোগ/আপত্তি সেই জায়গায় যেখানে আলোচকেরা তাঁদের লক্ষ্য মূর্ত করতে গিয়ে পদকারকে তাঁর সত্তার মানব-অনুভূতিগত দিক থেকে খারিজ করে দিতে চান, এবং তা কখনও এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে-আলোচক, পদকারকে তত্ত্বলীন করে দিয়ে তাঁকে অতিমানবের স্তরে নিয়ে যেতেও এতটুকু কুণ্ঠিত হন না। তাঁরা ভাবেন, প্রেমপ্রকাশের এই যা কিছু-সে রাধাই হোক বা কৃষ্ণ-সবসময়ই রূপক। আর গোলটাও বাধে সেখানে। অথচ তাঁদেরও অজানা থাকবার কথা নয়-সৌন্দর্য্য বা সত্য যাই হোক-তার মর্মে পৌঁছাতে গেলে হলে, বাস্তব-রূপক-উপমান-উপমেয়সহ একযোগে না গেলে সে-যাত্রা পূর্ণ হয় না, পূর্ণ হওয়ারও নয় : কারণ, রূপকে তো ছড়িয়ে থাকে পদকারের জীবনাভিজ্ঞতারই চিহ্ন-ফলে, তাকে ছাড়া মূল্যাঙ্কনটা যে একমুখী হয়ে পড়বে এ আর আশ্চর্য কী। দান্তে কবে তাঁর একটি চিঠিতে দি ডিভাইন কমেডি বিষয়ে লিখেছিলেন :


এ কথা বোঝা উচিৎ এই রচনার অর্থ কেবল একরকম নয়; বরং এর অনেকগুলি অর্থ রয়েছে, প্রথম অর্থ সঞ্চারিত হয় অক্ষর-শব্দ ভিত্তি করে আর তার পরের অর্থ নির্ধারিত হয় অক্ষর-শব্দের তাৎপর্য অনুযায়ী; প্রথমটিকে যদি বলি অভিধাত্মক তাহলে দ্বিতীয়টিকে বলে রূপকাশ্রিত... সম্পূর্ণ গ্রন্থটির বিষয়, অভিধাত্মক অর্থ ধরলে বেশ শুদ্ধ আর সরল-তা হলো মৃত্যুপরবর্তী কালের অবস্থা।...যদি রূপকের দৃষ্টিকোণ থেকে এ রচনার ব্যাখ্যা করা হয়. তাহলে এর বিষয়-মানুষ, যে তার স্বাধীন চেতনার অনুশীলনের ত্রুটি-নির্ভুলতা অনুযায়ী বিচারের নিক্তিতে শাস্তি বা পুরষ্কার পায়।


দান্তে তাঁর ধ্রুপদী মহাকাব্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার একাধিক অর্থগত ব্যঞ্জনার মধ্যে রূপকাশ্রিত অর্থের যে-সম্ভাবনার কথাটুকু বললেন, তা এখনকার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ আমরা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস পাঠ করে এসে দেখছি, এইরকম রূপক-ই কীভাবে ইতিহাসের অবলম্বন হয়ে ওঠে। আজকের সাবলটার্ন স্টাডিজ-এ রাজ-রাজড়ার বাইরের যে-ইতিহাস-অনুসন্ধান চলে, সেই প্রান্তপৃথিবীর মধ্যে সেই তত্ত্ব/রস/লক্ষ্য অভিমুখী বাস্তবের রূপকাশ্রিত বিষয়টুকুর অন্তর্ভুক্তিটাও জরুরি; কারণ, এই রূপকের মধ্যে যে জীবন-অনুভব স্পন্দমান, তার পরিচয় তো নিরন্তরই পেয়ে থাকি আমরা। আজ রাধারমণের পদের রূপকাশ্রিত বাস্তবের দিকটাকে জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে না-দেখলে সে-দেখা টাকে কেউ ‘খণ্ডিত দর্শন’ বললে তাকে অযৌক্তিক উক্তি বলা যাবে না কিছুতেই।




শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-উক্ত রাধাকৃষ্ণ লীলার পরবর্তী পর্যায়ে কৃষ্ণ যখন মথুরায় তখনকার রাধার যে-অনুভব, রাধারমণের অনেক গান সেই অনুভবের; এই অনুভব বিরহের, তাতে কখনও-কখনও অভিমানের সুর বাজলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আকুতিটাই প্রবল। তাই বলে এ-কথা বলা যাবে না যে তার গানে কৃষ্ণ-অনুভব একেবারেই দুর্লভ। লোকশ্রুতি রয়েছে-এই গানগুলো গাইবার সময় দিব্যোন্মাদ হয়ে যেতেন রাধারমণ-এ নিশ্চয়ই রস-অভিভূতিরই পরিচায়ক; আমাদের আগ্রহ রাধা-অনুভব-এর সেই গানগুলোর দিকে যেখানে রাধারমণ শুধু বৈষ্ণব রসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেন না, বরং তা চিরায়ত বাঙালি নারীর অনুভবকেই ধারণ করে। এই অনুভব কখনও বেদনার, কখনও বিরহের, আবারও কখনও তা স/নী-রব দ্রোহেরও বটে;-কথিত দিব্যোন্মাদনা সত্য হলে এই পরিগ্রহণ কিছুটা বিস্ময়েরই ঠেকবে। তবে এ-পরিগ্রহণটা সত্য এবং এই ধারণা যে স্বকপোলকল্পিত নয়, তা তাঁর নারীভাবনার গানগুলোর মধ্যে মূর্ত রয়েছে; এ-ছাড়াও এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেকের অভিজ্ঞতাসম্পৃক্ত ব্যাপারও। যেমন বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত রাধারমণ-গীতিমালা সম্পাদনা করতে গিয়ে শ্রীনন্দলাল শর্মা তাঁর ভূমিকায় জানাচ্ছেন :


কৈশোরের দিনগুলোতে নিজবাড়িতে প্রবিবেশী ও আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে রাধারমণের গান বিভিন্ন পালাপার্বণে শুনতাম। তার গানের বাণী ও সুর আমার কিশোর মনকে আন্দোলিত করতো। গ্রামের বসন্তরাম মালাকার (প্রয়াত) আমাদের বাড়িতে আসলে আমার ফরমায়েশ মতো রাধারমণ গেয়ে শুনাতেন। ধামাইল নৃত্যে সম্মিলিত নারীকণ্ঠে রাধারমণের গান সম্মোহন সৃষ্টি করতো।


নন্দলাল শর্মার যে-কৈশোরক অভিজ্ঞতা, তা আরও অনেকের থাকবার কথা, বিশেষত যারা রাধারমণের পড়োশি তাদের অভিজ্ঞতা যে আরও প্রবল ও ঘনিষ্ট হবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই সত্তর-আশির দশকেও যারা ওই অঞ্চলে শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন তাঁরা দেখেছেন-হিন্দু মহিলারা ধর্ম-ভাবে গান গাইতেন ঠিকই, কিন্তু এর বাইরেও হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মহিলারা ব্যক্তিগত দুঃখ বিরহ আর দুর্দশাজড়িত নানা বেদনায় গেয়ে উঠতেন রাধারমণের গান। এর কারণ কী?...বৈষ্ণব-রসের আড়ালে তাঁর গানে এমন কী বিষয় রয়েছে যে এদের একাত্ম হয়ে পড়তে হয়? সমাজে নারীর যে অবস্থান-নানা প্রক্রিয়ায় বিশেষ করে ধর্মের বিধিনিষেধের সূত্রে বঞ্চনা চলে, তারই রূপকায়ত বাস্তবটুকু ধারণ করে বলেই যে এই একাত্মতার ব্যাপারটি ঘটে তাতে সন্দেহ কিছু নেই।






নারীদের বিষয়ে মনু বলেছেন :


পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।

রক্ষতি স্থবিরে পুত্রা স্ত্রী স্বাতন্ত্র্য মর্হতি \’ (নবম অধ্যায় শ্লোক ৩)...


অর্থাৎ নারীকে কুমারী অবস্থায় রক্ষা করবে পিতা, যৌবনে রক্ষা করবে স্বামী, বার্ধক্যে রক্ষা করবে পুত্র, স্ত্রীদের কখনোই স্বাতন্ত্র্য দেওয়া যাবে না।


অন্যত্র :


পতি সদাচারহীন, পরদাররত বা গুণহীন হলেও সাধ্বী স্ত্রী পতিকে দেবতার মতো পূজা করবে।...স্ত্রীদের স্বামী ছাড়া পৃথক যজ্ঞ নেই, পতির অনুমতি ছাড়া কোনো উপবাস নেই। শুধু স্বামী সেবার সাহায্যেই নারী স্বর্গে যাবে। (৫ : ১৫৪-১৫৫)


মনুর শ্লোকগুলির রচনাকাল-নির্ণয়ের দুরূহতা স্বীকার করেও পণ্ডিত মানে অনুমান করছেন- এর বিকাশ ঘটেছে খ্রিস্টপূর্ব ২০০থেকে ২০০ খ্রিস্টাব্দে। এর পাশাপাশি সপ্তম খ্রিস্টাব্দে ইসলাম ধর্মের মূলগ্রন্থ কুরানে পাই :


পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ তাদের এককে অপরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এজন্যে যে পুরুষ ধনসম্পদ ব্যয় করে।...স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশংকা করো তাদের সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের সজ্জা বর্জন করো এবং তাদের প্রহার করো। (সুরা নিসা : ৩৪)


অন্যত্র :


তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শস্যক্ষেত্র; তাই তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছে প্রবেশ করতে পারো। সুরা বাকারা : ২২৩)


একই সময়কার হাদিসগ্রন্থে পাই :


যদি আমি অন্য কাউকে সিজদা করতে আদেশ দিতাম তাহলে নারীদেরই বলতাম তাদের স্বামীদের সিজদা করতে। (মিশকাত, ১৯৭৯, ১৮১)



মনুশ্লোক, কুরান ও হাদিস প্রচারের পর আরও কয়েক শতক চলে গেল, কিন্তু কতদূর এগুলো মানুষ? নাকি পিছাল? নারী-প্রসঙ্গে আমরা কি ঋগ্বেদে পড়িনি : সম্রাজ্ঞী শ্বশুরে ভব সম্রাজ্ঞী শ্বশ্রাং ভব।/ননান্দরী সম্রাজ্ঞী সম্রাজ্ঞী অধি দেবৃষু \ ১০.৮৫.৪৬ (শ্বশুর শ্বাশুড়ী ননদ দেবর সকলেরই কাছে তুমি সম্রাজ্ঞী হও); অন্যদিকে ইসলামপুর্ব যুগের কবিতা ও গল্পে আমরা কি পড়িনি যে ওই সমাজের অনেক নারীই ছিলেন উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন, সমাজ মাতৃতান্ত্রিক ছিল বলে সন্তানরাও পরিচিত হতো মায়ের পরিচয়ে? এরপরও বেগম রোকেয়াকে আজীবন ওই সমাজের লড়াই করতে হয় আর রাধারমণের গানে দেখা যায় মনুশ্লোক-এর উল্লিখন। তার কারণ মনুশ্লোক-উক্ত ধারণার নির্মূল আজও হয়নি? রাধারমণ যে-সমাজে বেড়ে উঠেছেন সেখানে নানা অনাচার রোধের জন্যে নারীর স্বাতন্ত্র্য লোপ করার ক্ষেত্রে একটা স/অ-চেতন মানসিকতা তো ছিলই, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নারীরাও তো ততোটা কুণ্ঠিত ছিলেন বলে মনে হয় না। রাধারমণ জন্মেছেন ১৮৩৪ সালে, ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স তখন চোদ্দ; এরপর ঈশ্বরচন্দ্রের চেষ্টায় ১৮৫৫ সালে বিধবা বিবাহ আইন বলবৎ হবে ঠিকই কিন্তু তার সহগামীর সংখ্যা তখনও থেকে যাবে একেবারেই হাতে-গোনা। ওই সময় সোমপ্রকাশ নামক সাময়িকপত্রটিতে প্রখ্যাত ব্যাক্তি দ্বারকানাথ মিত্রকে অভিযুক্ত করে ছয়জন বিধবা মহিলা তাঁদের একটি চিঠিতে লিখেছিলেন :


বাবুর স্ত্রীবিয়োগ হইলে দুইবার বিবাহ করিলেন ছয়মাস অতীত হইল না। জজবাবুর সন্তান-সন্ততি বর্তমান। আমরা যে আদৌ পতি কেমন তাহা জানিলাম না। বাবু কি আমাদের দুঃখ একবারও অনুভব করিয়া দেখিলেন না?’


কিন্তু এ তো বিশেষ ছয়জন বিধবার আকুতি মাত্র, আরও কেউ-কেউ এই দুঃখ উপলব্ধি করেছেন হয়ত, কিন্তু তারা কি প্রকাশের ভয়/সংস্কার কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন? এমন অবস্থায় বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ আইন বাস্তবায়িত করলেন ঠিকই কিন্তু সমাজে তার সুব্যাপক প্রভাব যে পড়েছিল এমন পরিচয় ইতিহাসে নেই, বরং আমরা দেখেছি অনেক জায়গায় বিধবা-বিবাহ দিতে গিয়ে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করতে-করতে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। আমরা এখানে শেষবয়সে-লেখা একটি চিঠিতে বিদ্যাসাগর যে-মন্তব্য করেছিলেন, তা পড়লে ওই সময়টাকে মোটামুটি বুঝে-উঠতে পারব। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত একটি চিঠিতে লিখেছিলেন :


আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্ব্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না। তৎকালে সকলে যেরূপ উৎসাহ প্রদান করিয়াছিলেন তাহাতেই আমি সাহস করিয়া এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম নতুবা বিবাহ ও আইন প্রচার পর্যন্ত করিয়া ক্ষান্ত থাকিতাম। দেশহিতৈষী সৎকর্মোৎসাহী মহাশয়দিগের বাক্যে বিশ্বাস করিয়া ধনেপ্রাণে মারা পড়িলাম।’


দেশহিতৈষী ও সৎকর্মোৎসাহী-এই দুটি বিশেষণের অধিকারী কারা যাদের নিয়ে বিদ্যাসাগর সক্ষোভ শ্লেষোক্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন? বিনয় ঘোষের মতে, এরা হলেন সেই মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণী, বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার শিক্ষাসংস্কার যাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। বিনয় ঘোষের মার্কসীয় বীক্ষণের প্রতি কারও-কারও ভিন্নমত থাকতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্রের সংস্কার-চেষ্টা যে অন্তেবাসীদের নিকট গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি, তা তো ভুল নয়। রাধারমণ এরকমই এক প্রান্তপাড়ার অধিবাসী। যেখানে বিদ্যাসাগরের সমাজ ও শিক্ষা-সংস্কারের প্রভাব গিয়ে পৌঁছয় না সেখানে একজন লোকায়ত রাধারমণের গান ঠিকই পৌঁছে যায়, কারণ রাধারমণ দেহ-মনে সেই প্রান্তের বাসিন্দা, তাঁর ভাষাও সেখানকার নানারকম বিভঙ্গ ধারণ করতে সক্ষম। তত্ত্বের আবরণ থাকলেও তার গান এমনভাবে সেখানকার বিষয় ধারণ করে, যে-কারও মনে হতে পারে তিনি অন্যের, বিশেষ করে রাধা/নারীভাব-বাস্তব অর্থে তিনি নিজেও বুঝি যাপন করে চলেন। তাই তাঁর গানে রাধাকে দেখা যায় কখনও বিদ্রোহী, কখনও বিরহী, আবার কখনও অতিশয় সমর্পিতপ্রাণা। রাধারমণের গানে পাই -


আমায় নারীকূলে জন্ম কেন দিলায় রে দারুণ বিধি

নারীকুলে জন্ম দিয়া ঘটাইলায় দুর্গতি রে \


শিশুকালে পিতার অধীন, যৌবনেতে স্বামীর অধীন রে

ওরে বৃদ্ধকালে পুত্রের অধীন আমারে বানাইলায় রে \



যদি আমি পুরুষ হইতাম মোহন বাঁশি বাজাইতাম রে

কত নারীর মন ভুলাইতাম বাজাইয়া মুরলী রে \


ভাইবে রাধারমণ বলে নারীজনম যায় বিফলে রে

না লাগিল সাধের জনম বন্ধুয়ার সেবায় রে \


যারা রাধারমণের অঞ্চলের অধিবাসী তারা জানেন, প্রচলিত সংকলনগুলিতে যুক্ত না-হলেও এটি তাঁর খুবই পরিচিত একটি গান; বিভিন্ন আসরে তো গাওয়া হয়ই, এছাড়া, সাধারণত ঘরোয়া (মেয়েলি) আসরে এটি যে গীত হয়, তার সামাজিক কারণ উপরে আলোচিত। আমরা যে মুসলিম বিধবার কাছ থেকে এই গানটি সংগ্রহ করেছি তাঁর নাম আফিয়া বেগম, বয়স আনুমানিক ৬০, সাকিন ইসহাকপুর, ডাক ভবের বাজার, থানা জগন্নাথপুর, জেলা সুনামগঞ্জ, তিনি অন্য একটি ধর্মজীবন পালন করে থাকলেও নারী হিসেবে যাপন করে চলেছেন দলিতার যৌথ সমাজজীবন, ফলে মনু আবু হানিফা-এই দুই শাস্ত্রীর বিধিনিষেধের তাবৎ বিড়ম্বনা যে তার জীবনের উপর দিয়ে বয়ে গেছে, সে-বিষয়ে তাকে সচেতন মনে হলো না, কিন্তু তিনি যখন গানটি গেয়েছিলেন তখন মনে হয়েছিল, তাঁর সারাজীবনের দলনবিরহযন্ত্রণাআক্ষেপঅভিযোগ সবকিছু একাকার হয়ে গানের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। এমনিতেও গানটি পড়লে আমরা দেখতে পাব ধুয়াপদের প্রথম পঙ্ক্তিটি প্রশ্নের মতো শুরু হয়ে দ্বিতীয় পঙ্ক্তিটিতে এসে অভিযোগের রূপ পায়; এই অভিযোগ কীসের জন্যে, তা আলোচনা করার আগে নারীকুলে জন্ম হওয়ায় কী ঘটেছে, তা দেখা যেতে পারে; এর জন্যে তাকে শিশুকালে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বৃদ্ধকালে পিতার অধীন থাকতে হলো। নারীকে এই রূপে রাখবার বিধান মনুর বেঁধে-দেওয়া; রাধারমণ যখন রাধার মুখ দিয়ে এই কথাগুলো বলান/বলেন, তখন বোঝাই যায় যে এ-বিধানে তার শ্রদ্ধা নেই। প্রথম অন্তরার দ্বিতীয় পঙ্ক্তিটিতে ‘বানাইলায়’ ক্রিয়াপদটি আক্ষেপ ধারণ করছে, আর পুরো অন্তরাটিই বলছে অধীনতা-বিষয়ে তার এন্তার আপত্তির কথা; দ্বিতীয় অন্তরাটি রাধা/রাধারমণ, পুরুষ/কৃষ্ণ হলে কী করতেন সেই বিষয় : মোহন বাঁশি বাজিয়ে নারীদের মন ভোলাতেন। তা কি আক্রোশমূলক? তা হয়ে থাকলে, সে-আক্রোশ-রাধা না কৃষ্ণবন্ধুয়ার প্রতি? তা স্পষ্ট নয়; বিশেষ করে শেষ অন্তরায় গিয়ে যখন গানটির বিষয়ে মোটামুটি মীমাংসায় যেতে পারি, সেখানে দ্বিতীয় অন্তরাটিকে প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয়। (এর একটি ভিন্ন পাঠ থাকায় সন্দেহ আরো গাঢ় হয়ে ওঠে।) ধুয়াপদে নারীজন্মজনিত যে-দুর্গতির কথা বলেন রাধারমণ, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় শেষ অন্তরায় এসে- বলছেন, ‘নারীজনম যায় বিফলে’; বিফল, কারণ এই জনম বন্ধুয়ার সেবায় লাগছে না, তাতে বাধা একটাই : পিতা-পতি-পুত্রজনিত অধীনতা। ফলে, ধুয়াপদে উল্লিখিত অভিযোগ-বিদ্রোহাভাস যে-টুকু মেলে, তা শেষ অন্তরায় এসে অনুযোগ/আফসোস-এর রূপ নেয়। কিন্তু গন্তব্যবিন্দুতে আসবার আগে ধুয়াপদে উক্ত ‘ঘটাইলায়’ ক্রিয়াপদ এবং বিশেষত ‘দুর্গতি’ শব্দটি বঞ্চিত নারীদের যে-চিত্র তুলে ধরে, তা আমাদের বঞ্চনার ইতিহাসকেই মনে করিয়ে দেয়। এ-প্রসঙ্গে অন্য আরেকটি গান পড়া যেতে পারে :


মান ভাঙ রাই কমলিনি চাও গো নয়ন তুলিয়া।

কিঞ্চিত দোষের দোষী আমি চন্দ্রার কুঞ্জে গিয়া \


এক দিবসে রঙ্গে ঢঙ্গে গেছলাম রাধার কুঞ্জে।

সেই কথাটি হাসি হাসি কইলাম তোমার কাছে \


আরেক দিবস গিয়া খাইলাম চিড়া পানের বিড়া।

আর যদি যাই চন্দ্রার কুঞ্জে দেওগো মাথার কিরা \


হস্ত বুলি মাথে গো দিলাম তবু যদি না মান।

আর কত দিন গেছি গো রাধে সাক্ষী প্রমাণ আন \


নিক্তি আন ওজন কর দন্দলে বসাইয়া।

অল্প বয়সের বন্ধু তুমি মাতি না ডরাইয়া \


ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া।

আইজ অবধি কৃষ্ণ নাম দিলাম গো ছাড়িয়া \


তত্ত্বধারার গানে বিশেষত দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব কখনো-সখনো গুরুতত্ত্বেও নারীদেরকে সাধনপন্থের নানারকম অন্তরায়রূপে দেখা যায়; কারণ তাদের সৌন্দর্য মোহবিস্তারক, ছলনাযুক্তও বটে, ফলে মায়াজালরূপে উপস্থাপন করলে, যেহেতু এই রূপকের বাস্তবটাও মিথ্যে কিছু নয় তাই তার যুক্তিটা দাঁড়ায় ভালো। কিন্তু এখানে রাধারমণের রূপকটা অন্যরকম-তিনি এই জাযগায় পুরুষকে নিয়ে এসে সমাজে অবস্থানকারী কিছু পুরুষের যে-চরিত্র চিত্রিত করেন, তা এককথায় অনবদ্য। গানটির ধুয়াপদের প্রথম পঙ্ক্তিতে রাইকে মান ভাঙার কথা বলে দ্বিতীয় পঙ্ক্তিতে গিয়ে কৃষ্ণ বলছে-‘কিঞ্চিত দোষের দোষী আমি চন্দ্রার কুঞ্জে গিয়া’। পঙ্ক্তিটিতে কিঞ্চিত শব্দের ব্যবহারটাই পুরুষচরিত্রের আবরণটা খুলে ফেলে-যেখানে পুরুষ/কৃষ্ণ তার এই অন্যচারিতাকে স্খলনই মনে করছে না। ধারণা করা যায় এটা পুরুষতন্ত্রের প্রতি রাধারমণের একধরনের ব্যঙ্গ এবং এর পরে কৃষ্ণের যে অজুহাত-ফিরিস্তি, তার মধ্য দিয়েই সে দারুণ হাসির পাত্রও বটে। কিন্তু এসব তো রূপকের আর সমাজের বাস্তব; রাধারমণকে যেতে হচ্ছে তার নিজের বাস্তবে, ধরতে হচ্ছে রাধাভাবের সাজ; ফলে, গানের প্রথাগত বয়ন ভেঙে যেখানে আগের অন্তরাগুলির পরম্পরা-অনুযায়ী ভণিতা-পদে কৃষ্ণের কথা-বলার রীতি সেখানে তিনি নিজে অভিমানী রাধার রূপে হাজির-‘ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া/ আইজ অবধি কৃষ্ণ নাম দিলাম গো ছাড়িয়া।’ তাঁর এই অভিমান মিলনাকাঙ্ক্ষারই দ্যোতক নয় শুধু, এর মধ্যে দ্রোহবীজও উপ্ত-এই ভাবনাকে কেউ-কেউ অতিকল্পন হিসেবে অভিযুক্ত করে হয়ত বলতে পারেন, এতে কৃষ্ণের মতি-ফেরাবার গোপন আকাঙ্ক্ষাও তো থেকে যেতে পারে; কিন্তু আশা করি, একথা সকলেই স্বীকার করবেন যে এর মাধ্যমে কোনও-কোনও দলিতার, বা অনেক অভক্ত/অবৈষ্ণব-এরও তো আকাঙ্ক্ষাপূরণ ঘটে। রাধারমণের গানের এই বহুমুখী আবেদনের কারণে তাঁর গানের প্রতি মানুষের আগ্রহ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এই সূত্রে আরও তিনটি গান পড়ে, এই কথার বাস্তবতা খোঁজার মধ্য দিয়ে এই লেখাটি শেষ করা যেতে পারে :




কৃষ্ণ আমার আঙিনাতে আইতে মানা করি।

মান ছাড় কিশোরী \


যাও যাও রসরাজ, এইখানে নাহি কাজ

যাওগি তোমার চন্দ্রাবলীর বাড়ি \


চন্দ্রাবলীর বাসরেতে সারারাত পোহাইলায় রঙ্গে

এখন বুঝি আইছ আমার মন রাখিবারে \


ভাবিয়া রাধারমণ বলে দয়ানি করিবে মোরে

কেওড় খোলো রাধিকা সুন্দরী \




কার কুঞ্জে নিশি ভোর রে রসরাজ রাধার মনচোর

সারা নিশি জাগরণে আঁখি হইল ঘোর \


হাসিয়া ঢলিয়া পড়ে যেমন নিশা ঘোর

কোন কামিনী দিল তোমার কপালের সিন্দুর \


নিশি ভোরে আসিয়াছ নিদয়া নিষ্ঠুর

পথহারা হইয়া নাকি আইলায় এতদূর \


মিটিমিটি চাও বন্ধু রাধার মনচোর

রমণ বলে রাধার হাতে বিচার হবে তোর \




অউত যারায় গিয়া-বন্ধুরে, আমায় পরাণে বধিয়া।

আরে সত্যি করি কওরে বন্ধু আইবায়নি ফিরিয়া রে \


আর চূড়া-ধড়া মোহন বাঁশিরে, বাঁশি যাও নিকুঞ্জে থইয়া।

ওরে, অবশ্য আসিবায় তুমি-ওই বাঁশি লাগিয়া রে \


আর ভাইবে রাধারমণ বলে রে-বন্ধু শুনো মন দিয়া।

ওরে, নারী যদি হইতায় তুমি-জানতাম প্রেমজ্বালা রে ‍‍/

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন