শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

প্রত্নপিপাসার জল

প্রত্নপিপাসার জল
...........
শাহানা আকতার মহুয়া



উপক্রমণিকা
.........

মাঝে মাঝে ভুলে যাই এইসব দাসত্বের দহন। কী বিপুল পরাক্রমে গিলে খায় মগ্নতার গান, ইথারে ভাসে ফিসফিসে সব বোমারু বাক্যবান। মনে হয়, আমারই জন্য সাজিয়েছে কেউ বিষকাঁটা আর শরবন মায়াবী পথের অস্থির বাঁকে।

আমি জানি বৃষ্টি কিংবা ঝড় প্রকৃতির এক অনিবার্য ঘটনাÑ তারপরও বিমোহিত হই উত্তুঙ্গ ঝড়ো প্রভাবে, জানি প্রেম আর প্রশ্রয় পাশাপাশি চললে বদলে যাবে গতিপথ- তবুও বৃষ্টিকে ছুঁতে দিই চুলের গোছা, ঠোঁটের অস্ফুট বাঁক, বিলুপ্তপ্রায় করতল-রেখা।

মাঝে মাঝে উঠে যায় প্রভেদ-দেয়াল। খ’সে পড়ে নোনাধরা সীমানা-প্রাচীর। এতে জানি বড় দোষ, বিপদের আশঙ্কাও খুব। দু’হাতে তাই সরিয়ে দিই আকাক্সক্ষার জলরাশি। তবু সব অদ্ভূত স্রোত আসে নিয়তির মতো, কাঁটাঝোপ আর শরবনে আটকে যায় দু’একটি রঙিন নুড়ি, দু®প্রাপ্য কোনো ফুলের ছেঁড়া পাপড়ি!

ক্ষুরধার প্রজ্ঞাপনে যখন ঝলসিত হয় মোড়ের উজ্জ্বল বিলবোর্ড, আকণ্ঠ জ্যোৎøার শ্যাম্পেন পান করে নিমজ্জিত কবি উঠে আসে কবিতার সাম্পানেÑ তখন যদি বলি আমিও যাব কাকজ্যোৎøাভেজা পদ্মার বালুকাবেলায়, আমিও ছোঁব বুনোরাতের ওই ব্যাকুল-যাতনা-

জানি হিমবাহ সৃষ্টি হবে উষ্ণ চরাচরে।
ছিঁড়ে যাবে অবগুণ্ঠনের নিজস্ব ঘরানা।


একলা হতে হতে জনারণ্যে প্রবল একাকী তাই...
ক্রমশ নিজের সাথে সখ্যতা বাড়াই।


হাওয়া-রমণীরা
.........

খুলে ফেলে হাওয়া অবদমনের ঘের
নিঃস্ব প্রলাপে নিজেকে জাগায় ফের।
এই যে এখানে শূন্য ছায়ারা নাচে
হাওয়ায় হাওয়ায় হৃৎকমলের ভাঁজে।

এই তো এখানে অগ্নিঝরানো রাতে
রমণীরা কাঁদে, কাঁদে হাওয়াদের সাথে।
গহন কষ্টে স্নান ক’রে বিভাবতী
হাওয়া-সমুদ্রে ছড়ায় রুগ্ন জ্যোতি।

কিছুই গোপন থাকে না তাদের কাছে
নগ্ন ছায়ারা করতালি দিয়ে নাচে।
হাওয়া রমণীরা উত্তাপে পুড়ে মরে-
নিজেদের দেখে লাশটাকা কোনো ঘরে।


ধৃষ্টতা
....


কিভাবে যেন রটে যায় সব অহেতুক সংবাদ
গুঞ্জনে কাঁপে শহরের রোদ একলা নিরুদ্দেশে,
হৈ চৈ করে ছুটে আসে মেঘ-বৃষ্টির জলস্বাদ
পায়ের নিচে গ’লে যায় মেঘ-ঘনপিচ অবশেষে।

মাংসের খোঁজে কসাইখানায় ভিড় করে যত কাক
প্রাচীন গলিতে গ’লে গ’লে পড়ে লাল মাংসের লোভ-
ঘুলঘুলি থেকে চুপিসারে উড়ে সাদা পায়রার ঝাঁক;
কিভাবে কোথায় ফেলে রেখে যায় রক্তের গাঢ় ছোপ।


সেই ছোপ দেখে সারমেয়কূল খুঁজে খুঁজে দিশাহারা-
তাদের হল্লার কাঁসর বাজানো সংবাদে রোদ হাসে
নিস্তরঙ্গ শহরের বুকে আগুনের স্রোতোধারা
উগড়ানো ক্রোধে ঢেলে দেয় বিষ বিপুল সর্বনাশে।


উৎসমুখ
......
খুব প্রিয় হয়ে ওঠা মানুষদের বেশি কাছে যেতে নেই
কেননা তাতে জ্বলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে-
ক্লিশে হয়ে যাওয়া এই সরল সত্যটা বারবার আবিষ্কার করি
নিজেরই আড়ষ্ঠ হয়ে ওঠা আত্মক্লেশ থেকে।
চান্দ্রেয়ী সকল বাসনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে
ক্ষমাহীন নিয়তির মাঝি
হাতে তুলে দিয়েছে এক অদ্ভূত বৈঠার বোঝা।
আঁধার ঘন হলে সবাই ডুবে যায়
ঘনঘোর স্বপ্নের স্রোতে, থিকথিকে লাভাস্রোতেও
খুঁজে পায় আগুনের মমতা-
আর এই মায়াবী নদীর স্রোতে আমি বৈতরণী কিনার খুঁজি।
নিরাপদ কোনো নদীকূল খুঁজি।
সারি সারি পাথরের মুখ ঝলসে ওঠে উৎসমুখে; অগ্নিমুখে,
বরফশীতল চোখে দুলে ওঠে কুচি কুচি করুণ ছায়া।


প্রকৃত সত্তা কবেই তো হারিয়েছে তারা
লোভের সোনালি আপেল খুঁজতে গিয়ে।
কখনো কখনো আসে আগুনের বার্তাবাহক
পৃথক কিছু অভিবাসী।


বৈঠাটা পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে তাদের
আগুনের দাহে। ইচ্ছে করে ফিরে যাই আগুনের মমতায়।
অথচ সে আগুনে বিশ্বস্ততা নেই!
পৃথিবীর মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসে
তারা প্রলুব্ধকের হাতছানিতে-
অথবা এমনো তো হতে পারে প্রিয় হয়ে ওঠা এইসব
মানুষগুলো নিজেরাই জ্বলে যায় উল্কার মতো।



রাই-রজনী
......

রাই, চলো যাই কৃষ্ণসখার কৃষ্ণনদী তটে
বিনোদিনী-জ্যোৎস্না দেখো ঝরছে নিরন্তর
কৃষ্ণ ও মুখ দেখছ বসে ভরা-জলের ঘটে
তোমায় টেনে রাখছে কেন মনপোড়ানো ঘর!


মোহনবাঁশি খুঁজছে তোমায় পদ্মনীলা রাতে
কুঞ্জতলে কৃষ্ণ দেখো খুঁজছে একা ওই-
গোপনারীরা ডাকছে আকুল জ্যোৎস্নাধারার সাথে
রাই চলো যাই- যাই গো চলো বকুলবোনের সই।


আয়ান ঘোষের মস্ত ঘরে পুড়ছে রাধা বিষে
অযুত চোখের দৃষ্টিতে সব ছুরির বাঁকা হাসি;
জলজোছনায় রাধার চোখের ব্যাকুল ছোঁয়া মিশে
তমালবনের মাতাল বাতাস ঢালছে বিষাদ-রাশি।


রাধার চোখে রাত্রিশেষের আঁধার নেমে আসে
কৃষ্ণ একা কুঞ্জতলে সাজায় তাসের ঘর
আয় রাধিকা- বিষ-নিয়তির অগ্নিদেবী হাসে;
সেই আগুনে জ্বলছে রাধা, পুড়ছে নিরন্তর।


সংবাদ
.....


সকলেই জেনে গেছে-
সূর্যেরও আগে জেনে গেছে জনপথ
পাথরে পাথর ঘ’ষে বহুকাল আগে
যে পবিত্র আগুন তৈরি হয়েছিল
ব-দ্বীপের নাভিমূলে
যে আগুনের নদীতে ব’য়ে যাচ্ছিল
ঝলসানো বনের গন্ধ
অসময়ে বৃষ্টি এসে ধুয়ে দিয়েছে সেই
আগুনের সংরাগ


গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির পরাগ
মদমত্ত যুবকের মতো চণ্ডাল আগুনে
ঝাঁপিয়ে পড়ে কি রকম স্তব্ধ করে দিয়েছে;
পিচ্ছিল ঠোঁটে টেনে নিয়ে লালাভ মধুরংধনু
করে তুলেছে আগুনের ক্ষোভ-
জেনে গেছে জনপদ
পেয়ে গেছে সূর্যেরও আগে
নিভন্ত অগ্নিশরীর পুড়ে যাওয়ার সংবাদ।


ইউটোপিয়া
........


কপালে আরো দুঃখ আছে, এখনো এতো স্বপ্নের রং! এখনো চিড়বিড় ফোটে রূপশালি কবিতার খই, হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে যায় ছটফটে ইচ্ছের ফানুস। অজ্ঞাতে কিভাবে যেন ভেতরে ভেতরে বাসা বেঁধেছে ভয়ানক অসুখ। সুখের উষ্ণতায় নিজেকে সেঁকে সকলেই বানাতে চায় তুলতুলে পালংকের শোভা- অযথাই পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে আমার যতসব উপাখ্যান তৈরির প্রবণতা। অযথাই নিজেকে ভেঙে ভেঙে চূড়ান্ত অভিমানে হাড়ে-মজ্জায় বেদনার মালা গাঁথা। প্রব্রজ্যা ইচ্ছেরা এতো দুর্বিনীত হয়, এমন পাগলাটে আর একগুঁয়ে যে সকল বিঘ্নের মুখে চুনকালি লেপে ত্বরিত এগিয়ে যায় অগম্যতার দিকে। তাতেই খুলে যায় ঝলমলে একেকটি বর্ণিল মুখোশ! ক্ষমাহীন স্বজনেরা হয়ে ওঠে নৃশংস মৌমাছি। আমার সমস্ত শরীরে বিঁধে যায় তাদের ভ্রুকুটির হিংস্র হুল। চোখে চোখে উড়ে আসে তাদের নগ্ন চালচিত্র। রাতজাগা চোখে এক আকাশ শূন্যতার মেঘ নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি। চিরন্তন প্রথার মতো সোনার শিকল বাজে রুমঝুম করে আর আমি ভয়ানক অসুখে ভুগি, অপ্রতিরোধ্য স্বপ্ন দেখার অসুখ। জিউসের সোনালি ঈগল এসে যেভাবে চিরে ফালাফালা করেছে প্রমিথিউসের নির্ভীক বুক- তেমনি অপলাপের বজ্রে ছিঁড়ে যায় আমার সমস্ত আকাক্সক্ষার সূত্র। নির্লজ্জ ভিক্ষুকের মতো তবুও স্বপ্নের দরোজায় হাত পেতে থাকি। প্রত্নপিপাসায় জ্বলজ্বল করে অকরুণ আগুনের দেশ। যেতে হবে অনেক দূরে, বহুদূরে ইউটোপিয়া- সেখানে নাকি স্বপ্নেরা অনিঃশেষ!


কাজলরেখা
.........
মন্দিরে একা নিশুতি-নিয়তির সাথে
চিরদিনই সব কাজলরেখারা কাঁদে।
মেনে নিয়ে যত দুর্বাশা-অভিশাপ
মুছে দেয় তারা আত্মক্ষয়ের পাপ।

কাঁকনদাসীরাও পেরিয়ে যোজন দূর
বুকে ব’য়ে আনে খ্যাপা পাতকীর সুর।
বিপরীতমুখী জলের ধারায় বাহিত প্রীত
রাজ্যপাট আর রাজাদের ধ্বনি গীত
স্রোত ব’য়ে যায় কাজলরেখার চুলে
দুখে জর্জর একফোঁটা নাকফুলে।

কাজলরেখার ভাগ্য জড়ানো শুকপাখিটার ঠোঁটে
দিবসযামিনী বুকের ভেতরে কোন্ বিষফুল ফোটে!
কাঁকনদাসীরা নিজেদের ভাঙে; ভাঙে আগুনের বাঁধ,
কাজলরেখারা বুকে পুষে রাখে স্রোতোময় অবসাদ।


শৈত্যশিলা
....

আমারো তো ইচ্ছে করে পাথরে পাথরে ঘ’ষে
আগুন জ্বালাই, সাজানো অভিসন্দর্ভগুলো ছিঁড়ে
ছুঁড়ে ফেলি সেই অপরূপ আগুনের কুণ্ডে।
উত্তাপে ঘষে ঘষে মেজে তোলা নাগরিক ত্বকের সুষমা
ইচ্ছে করে আগুনের কাঁচুলিতে জড়িয়ে বাসন্তী-বিলাস
উড়িয়ে দিই পলাশ আর পারিজাতপ্রীতি।


কমলার রসের মতো ফাল্গুনী রোদ
কি রকম তীব্রভাবে বাতাসের গান গায়!
আমিও তো মুঠোয় তুলে প্রাজ্ঞ-অভিলাষ
সুচতুর পালিয়ে যেতে পারি
পাহাড় অথবা বনের হৃৎপদ্মে।


ইচ্ছেগুলো মরে যায়, মরে যায় সবুজ হরিয়াল,
মরে যায় ইচ্ছের রূপালি মাছ।
সোনার শিকল বাজে শীতল পায়ে-
সোনার শিকলে বাঁধা সোনার সকাল।
কিভাবে কিভাবে যেন ইচ্ছেগুলো পাখি হয়ে যায় !
আমারো তো ইচ্ছে করে শুশ্রুষার হাত মুছিয়ে দিক
ক্লান্তির কালি, দিঘির ধূপজলে ভেসে যাওয়া
প্রশান্তি খুঁজে এনে ছড়িয়ে দিক নির্ঘুম চোখের পাতায়,
ঘাসের বিছানায় শুয়ে খুঁজে নিয়ে আকাশের ওপারের আকাশ
নিশ্চল বরফখণ্ড ভেঙে আমাকে
খুঁজে আনুক বনপ্রভাতলে।


এ সকল গৌরচন্দ্রিকায় কেঁপে ওঠা কুশিলবরা ফিরে যায়
একে একে, প্রভূর বিধানে বরফখণ্ড গলে যায় ভুল প্রবাহনে;
ঝরে যায় ভুল গতিপথে।


খাঁচা
...

আমাকে দিয়েছ অশেষ আকাশ, দিয়েছ ওড়ার ডানা,
দিয়েছ নিপাট মুক্তির গান সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে
তার ওপারের বিহ্বলতায় নিজেকে জড়াতে মানা
আকাশ পেরিয়ে মহাকাশে যাবে কল্পিত রথে ভেসে।


অকরুণ হাতে এঁকেছ নিখাদ সময়ের কারুকল্প
কৃষকের মতো মাটির প্রতি মমতার সামিয়ানা,
আমার ভেতরে ছড়িয়েছ যত প্রাণপুরুষের গল্প
তাকে ছাড়া কোনো বিহ্বলতায় নিজেকে জড়াতে মানা।


হামাগুড়ি দিয়ে আঁধারেরা আসে, বিপন্নতার কালে
দলে দলে আসে পক্ষীসকল খুঁটতে শস্য দানা
আমাকে ঢেকেছো আচ্ছাদনে- পুঞ্জিত মেঘদলে
আমার আকাশেই উড়বো আমি; অবারিত হতে মানা!


করাত-বাতাসে ফালা ফালা হয় গহীনের স্বাধীনতা !
আদিম আকাশ ছাড়িয়ে দূরে- বহুদূর বুনোদেশে
পড়ে আছে কত ধুলি-কঙ্কর, কুসুমের ব্যাকুলতা
‘খুলে দাও ডানা’- খুঁজে নেব তাই অদ্ভূত ভালবেসে।


মিরিক
.....

সবুজ শান্তির মতোন ছায়া জমে আছে
বাধ্য শিশুর মতো ঘন মেঘদল
ঝুলে আছে অপরূপ পাহাড়ে পাহাড়ে,
দূরে বহুদূরে উর্বশী নদীবালা নাচে-
মাতৃস্নেহের মতো টলটলে জল
ব’য়ে যায় আবিষ্ট জলাধারে।


কমলা-বনে নাচে আহ্লাদী রোদের পরী
সোনালি আভার ব্রীড়াময়ী মেয়ে
ফেলে রেখে যায় কুরচি ফুলের হাসি
পাইনের গন্ধ ও বাতাসের জড়াজড়ি
প্রকৃতির কাছে বরমালা চেয়ে
ঝ’রে পড়ে তাই জুঁইফুল রাশি রাশি।


পাহাড়ের শিলারাশি পুরুষালি বুনো টানে
ছিঁড়ে আনে যেন সমতল কটিতট,
শ্রমণ যুবারা সবকিছু ভুলে যায়
অমিতাভ বুদ্ধের নির্মল আহ্বানে
নতজানু হয় অকরুণ হৃদিপট-
প্রকৃতি কেবল সৌমাভ গান গায়।


অমন সন্ধ্যা কখনো আসেনি আগে
শান্ত, গভীর, নীরব গোধূলিকাল-
কখনো দেখিনি শুভ্র ধবলগিরি
ব্যাকুল করা পিপাসায় শুধু জাগে
পাহাড়ি-কন্যা মিরিকের মায়াজাল-
ছুঁড়ে দেয় যেন স্বর্গে যাওয়ার সিঁড়ি।


চোরাস্রোত
......
কেন যে এতো লোভ দেখাও!
কেন যে স্বপ্নের সম্মোহন ছড়িয়ে দাও
মন্ত্রপুত জলের মতো!
এখনো তো লোভের গলায়
সমূলে বসাতে পারিনি ঘাতক ছুরি।

তুমি তো জানো- স্বপ্নের প্রতি লোভ
আমার আজন্মের দূর্বলতা
পায়ের নিচে ধ্বসে যায় মাটি
চড়চড় করে ভাঙে বৃক্ষদের ডালপালা;
ভাঙে আমার পাঁজরের হাড়গোড়।
তুমি তো জানো- চারিধারে প্লাবিত,


কেবল একটুকরো বালিমাটিতে শিকড় গুঁজে
একলা গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছি।
আমার চারপাশে উৎরোল মানুষের ভিড়
বিজুলি-লতার মতো মোহক-ঝিলিক;
তারি মাঝে একখণ্ড শিলা হয়ে যাওয়ার জন্য
আকরিক প্রয়াস এখন।


চোখের চামচে তুলে শিশিরের মধু
জমিয়ে রাখো অর্পণের জন্য;
স্রোতের মতো কেন যে টেনে ধরো
বিবশ শ্বাসমূল!


রাই সমাচার
.......


এই দেখো কোনো প্রতিহিংসায় কাঁপেনি আমার বুক
দুর্মুখেরা কত কিছু বলে, হাসে কত নিন্দুক।
নিন্দার ঝাঁপি পাশে ফেলে তাই বারবার ছুটে যাই,
বোঝোনি তুমি, দুর্দম ক্রোধ ঝরিয়েছ অযথাই।


প্রেম কি শুধু শরীরেই থাকে, অবিনাশী যত ভাষা,
তারো বেশি কিছু চেয়েছি বলেই নিপতিত ভালবাসা!
শরীর ছাপানো আরো কিছু আছে, বোঝেনি তোমার চোখ
বোঝোনি আমার প্রাণময়তা, খোঁজোনি হৃদয়ালোক।


আমি জানি তুমি নিপাট মানুষ, জান্তব কিছু নয়-
তোমার ভেতরে আমি আছি তাই সবটুকু তুমিময়।
তুমি কি জানো কোনো ঘৃণা নয় এখনো সমর্পিত
তোমার নিয়তির কল্লোল-ধ্বনি আমাতেও প্রবাহিত।
তোমার ভেতরে যদি বাঁশি বাজে আমি শুনি তার সুর
সময় কেবল নিয়ে গেছে দূরে, দ্বিধাহীন বহুদূর!


ব্যাধ
...

মাথার ভেতরে নড়েচড়ে ওঠে বেসামাল ঘুণপোকা
নিদানকালের স্বজনেরা সব দূরে দূরে সরে থাকে,
লুকানো বীজের জয়গানে ফোটে বিষফুল থোকা থোকা
মাটির চাদর মমতার মতো সেই বিষ ঢেকে রাখে।


কেবলি হয়েছে শ্রুতির ক্ষরণ, মমতার অপচয়
আবেগের পাখি উড়ে গেছে কবে ফেলে ফাগুনের গান,
বিষাদের মতো পাশাপাশি থাকে পরাভূত যত ক্ষয়-
মাথার ভেতরে রিনিঝিনি বাজে পোকাদের কলতান।


বহুদূর থেকে হাতছানি দেয় অযাচিত কোনো মুখ
কারো কারো চোখে ব্যর্থ-ব্যথিত প্রলয়ের ভূত নাচে,
পাথরের ঘরে কানাকানি করে রমণীরা উৎসুক;
পরিণতিহীন ভাবনার ঝড় ছুটে আসে মাঝে মাঝে।


এসো ব্যাধ- এই মাথার খুলিতে সোমরস করো পান
পাথরের বুক তীরের দাপটে ভেঙে ক’রো খানখান।


শ্রমণ
.....
এইসব স্বপ্নভঙ্গের বেদনা অথবা
দিনক্ষয়ের প্রাপ্তিযোগ্য গ্লানি
এসব আমারই থাকুক
তোমার জন্য থাকুক রাতজাগা উঠোন,
আবহমান অপেক্ষা-
আবুল হাসানের কবিতার মতো দূরাগত ব্যথাতুর সুর।
সন্ধ্যার আগে শ্লেটরঙা আকাশে ভেসে উঠলে
দৈত্যাকার মেঘের পাহাড়- জানি তুমি কেটে কেটে
বানাবে সেখানে নতুন খাজুরাহো।


আঁজলায় তুলে নিয়ে জ্যোৎøার জল
যতই করি না পান- নিভৃত তৃষ্ণার ঘুঙুর বাজে
আমার অবসন্ন শিরায়।
তাপদগ্ধ এবং পাংশুল সকল অভিজ্ঞান
জমে থাকে তবুও গলন্ত মোমের আঁচে।


তোমাদের জন্য থাকুক বন্ধুদের উন্মাতাল প্রীতিস্পন্দন
নোংরা চায়ের কাপে বাণী শোধনের ঝড় আর
অনুরক্তাদের ভাঁজভাঙা শাড়ির গন্ধ।

জাতিস্মর হয়ে যাই প্রভু হে- অধমর্ণ জাতিস্মর!।



আঁধার
.....

এখানে জমেছে আঁধারের বুনো রং
শ্যাওলার মতো পিচ্ছিল পথ-ঘর,
নিঝ্ঝুম রাতে হায়েনার হিম হাসি
শান্তির বুকে তোলে নিদারুণ ঝড়।


নখড়ে নখড়ে মাংসের কষ লাগা
হাতেরা বাজায় রুমঝুম করতালি,
এখানে এখন মধ্যযুগের ছায়া
কেটেকুটে করে আশাদের ফালি ফালি।


ইচ্ছেমতোই চলছে রথের চাকা
উড়ছে শত হাজার রঙিন ফানুস,
স্বপ্ন বেচে কিনছে মেদুর নেশা
স্বল্প মূল্যের পণ্য এখন মানুষ।


আঁধার ঢুকেছে পৃথিবীর কোণে কোণে
প্রলয়েরই গান বাজবে উপল-বনে।















বৃষ্টির রাত

শাহানা আকতার মহুয়া





মেঘেরা কাঁদলে আমি দেখেছি

তুমিও কী রকম ঝরোকা হয়ে ওঠো

সকল বিন্যাস পাশে সরিয়ে রেখে

কী রকম সোঁদা আর ভেজা ভেজা হয়ে যাও।

তখন তোমার ঠোঁটে পিছলে পড়ে মেঘমল্লার।



বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় তোমার জন্ম হয়েছিল কী?

তুমি হয়তো জান না আমর বুকের ভেতরে

তোমার পুনর্জন্ম হয়েছিল বৃষ্টি আর বজ্রের

উন্মাতাল প্রহরান্তরে।

ইদানীং বৃষ্টির ফোঁটাগুলো হুল ফোটায়

তোমার কথার মৌমাছি হয়েÑ

সেই বৃষ্টিই সেদিন উঠোনে আছড়ে পড়ে

খুনখুন করে কাঁদছিল বর্ষার দাদিমার মতো।

ইরাক-মার্কিন যুদ্ধ, ভূমিকম্প কিংবা

মানব ক্লোনিং, পতিত মহাকাশযান ইত্যাদি ইত্যাদি

নিয়ে এতো বেশি ব্যস্ততা যে

শেষ বৃষ্টির ঝরে পড়া তেমন

মুখ্য হয়ে ওঠে না তোমার কাছে। তারচে’ বরং গুরুত্ব পায়

আনুশেহ্ আনাদিলের অদ্ভূত গান!



বৃষ্টির কান্না বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে যেতেই

অদ্ভূত স্বপ্ন দেখলাম, জানো!

হতে পারে তুমি কিংবা আমার পরিজন কেউ

অথবা কুয়াশায় অস্পষ্ট একজন কাছের মানুষ

বিশাল এক ডেগচিতে সেদ্ধ করছে













আমার হাত-পা, বড় বড় টুকরো করে কাটা

ঊরুর মাংস। আমার চোখদুটো অদ্ভূতভাবে

চেয়ে আছে বল্কে ওঠা পাত্রের ভেতরে।



পাশে রাখা একটি পুটুলি খুলতেই

হাত ঢুকে গেল নরম চটচটে কিছুর মধ্যে

চোখের সামনে আঙুল তুলে ধরে

শিউরে উঠি ভয়ানকভাবে। আমার আঙুলে

থকথকে হলদেটে মগজ! ছালছাড়ানো

মুরগির মতো লালচে মাংস ভাসছে

টগবগে ডেগচির ভেতরে।



হঠাৎ বৃষ্টি এলো। দশদিক ভেঙেচুরে বিদীর্ণ ক’রে

নামলো মুক্তোর দানার মতো জ্বলজ্বলে বৃষ্টি।

আর ঘুমের ভেতরেই আমি

ফিরে পেলাম অপরূপ স্বস্তি।

























অবান্তর





একেকটি দিন আসে একেবারে ভিন্ন

চারিদিকে ধূ ধূ করে শূন্যতা-ফুল

একেকটি সাঁঝ আসে হতশ্রী, ছিন্ন

সারাদিন এলোমেলো, সব ভুল-ভুল।



কুচি কুচি করে কাটি মাখন সময়

শুকনো বকুলে খুঁজি সুবাসের সুখ;

জলের ছুরিতে কাটি গ্লানি-পরাজয়Ñ

যাতনার ঝরনাতে ঝ’রে কিংশুক।



বহুদিন হয়নি যে নিজেকে খোঁজা

নিজেকে নিয়ে নেই কোনো উপাসনা,

মাথার ওপরে চাপা বিহ্বল বোঝা

কেবল খুঁজেই যাই বাসনার সোনা।





নির্বেদের উৎসব





আর কোনো প্রতীতি ব্যাকুল করে না

এই ঊষর বালিয়াড়িতে বন্ধ্যাত্ব চিরকালÑ

বাকল ছাড়ালে সরিসৃপ সরিসৃপই থাকে

অথচ মুখোশ সরালে মানুষ আর মানুষ থাকে না!



পরাশ্রয়ী এইসব জীবনের গান

মর্শিয়া জাগায় অবিরাম

অন্ত:ক্ষরণে ক্লান্ত এই আধোবিন্যাসে

ঐশ্বরিক বিধানসমূহ অযথাই সব।



স্বার্থের জটাাজাল, ক্ষয়িষ্ণু প্রভুত্বের দাবী

আভূমি নত হওয়া সন্তের মহিমা

জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতে থেকে যায়

আবহমানকাল...

শোলক



লৌকিক আচরণগুলো কি রকম দেয়াল তুলে রাখে

সাজাতে গেলেই ভেঙে পড়ে বৈতালি ঘোর

চূর্ণ ক’রে দিয়ে যায় আরোপিত সব সুখভোর

মুখোশের আড়াল শুধু নিয়তির ছায়া দিয়ে ঢাকে।



কালিগোলা অন্ধকারে ডুবে যায় অষ্টাদশী চাঁদ

অলাতচক্রের মতো জ্বলে ওঠে নিয়তির চোখ

রাত্রির বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে অতর্কিত শোক

পরম প্রভু শোনেন বৃক্ষের তিক্ত আর্তনাদ।



আঁধারে ডুবে গেছে মধ্যরাতে খ’সে পড়া নামহীন তারা

সকল শোলক সে রেখে গেছে স্বজনের কাছেÑ

যেন একদিন ভাঙায় কেউ দুর্বোধ্য শোলকের মাঝে

কিভাবে হারিয়ে যায় স্বপ্নময় চোখ, মত্ত জলধারা।

























নিরুদ্দিষ্ট





বৃষ্টির সাথে ঝরেছিল কবে অরূপ কবিতাকল্প

প্রকৃতি ও প্রেম বুকে তুলে নিই প্রভুর নামের মতো

অচেনা নগরে পরবাসী দিন সমাহিত, সংযত

পিচগলা রোদে হাঁসফাঁস করে বিস্মৃতপ্রায় গল্প।



ঋতুুরা আসে, ফিরে ফিরে যায় দরজায় কড়া নেড়ে

বর্ষায় ফোটা কদমে যেন শ্রান্তির ঘাম ঝরে,

কবিতা ও প্রেম দূরে সরে যায় মরুমায়সাজ পরে;

অন্ধকারের কথামালা আসে বৃষভের মতো তেড়ে।



আড়াল খুঁজি, নিজেকে লুকাই চন্দ্রালোকের নিচে

দিব্যকান্তি লোভকে নিয়ে ছোটে নাগরিক ঘোড়া,

চোখ থেকে চোখে, বুকে বিঁধে যায় আমূল তৃপ্ত ছোরা

ছলছলিয়ে রক্তও মেশে তৃষাতুর কালো পিচে!



জলপাই রং আঁধার শুষে কবিতাবিলাসী হাসেÑ

চোখে তুলে দিয়ে বিমূঢ় আকাশ, কল্পলোকের ঘোর

একলা রেখে কল্পলোকে এঁটে দিলে সব দোর

নিজেকে নিয়ে ফিরে আসি ফের আদিষ্ট কারাবাসে।

















নাগরিক আগুন

আমাদের আগুনগুলো জমা আছে সময়ের কাছে

সে আগুনে ভস্ম হ’য়ে কবিতার জলপরী নাচে।



তুমি তো জানো যাত্রাযজ্ঞকালেও আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই।

ভালবেসে হেঁটে যাব অদ্ভূত নক্ষত্রালোকে

পাশাপাশি, ছায়ামগ্ন...



শব্দহীন অথচ বুকের ভেতরে বাজবে নিশুতি-কলতান



এ রকম একটা অচ্ছেদ্য যাত্রার কথা কতদিন ভেবেছি!

কান পাতলেই শোনা যাবে ঝড়ের শব্দ,

টুপটাপ জুঁইফুল অথবা বকুলের মৃদু কথোপকথন

শোনা যাবে উচ্ছ্বসিত রক্তের গান

তারপর স্থবিরতা, দেবত্বের ভান!



আমাদের কোনো ঘর নেই, ঘর হবে না

পায়ের নিচে হাঙরের দাঁত, বিক্ষত পায়ের পাতায়

পদ্মের মতো ফুটে ওঠে দাঁতের কোরক।

উদ্ধত থাবার নিচে থরথর কেঁপে ওঠে

প্রেষণার পাখিÑ পাখি ও প্রজাপতিদের জন্য

কোনো অভয়ারণ্য নেই। মানুষও তাই এতো

স্থিতিহীন, শঙ্কার জ্বরে পুড়ে পুড়ে

হারিয়ে ফেলে মানবশৈলী।



একে একে ছিঁড়ে যাবে শিকড়ের মমতা,

অভিমানে চোখ মুছে সতীর্থরা বাড়িয়ে দেবে

কম্পিত হাত বিদায়ী বন্ধনেÑ











রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টগুলোর আলো

একাকিত্ব সইতে না পেরে ভেঙে পড়বে

ঝনঝন করে। কেবল কিছুটা সৌম্যভাব নিয়ে

ওপারের দিঘি কেবল আকাশের সাথেই রাখবে

কিছুটা সুসম্পর্ক

নানাবিধ নান্দনিক কথোপকথন শেষে বুঝে ফেলি

আসলে আমাদের কোনো প্রতিশ্র“ত পথ নেই।

গৌরচন্দ্রিকার বাতাবরণে ভেঙে যায় মৌনলোক

একাকি রাস্তা শুধু সারাটা সময়

শব্দহীন সঙ্গ দেয়; এগিয়ে দেয় বোধনের কালে।



























বৃষ্টির কাল

শাহানা আকতার মহুয়া





সে রাতে বৃষ্টি ছিল খুব!

কখনো মুষলধারে

কখনো বা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দ

আর সব কি রকম চুপ!



কেবল কোলাহল যত আমার ভেতর

বালুকাবেলায় কাঁপা ঘনতরুবিথীÑ

কেবল পাঁজর জুড়ে বৈশাখী ঝড়

বয়ে যাওয়া উন্মনা প্রণয়ের তিথি।



তখন বৃষ্টির কোনো ছিল না ঠিকানাÑ

তোমার বিদ্যুত-চোখ

আর আমার লুপ্ত চেতনায়

ঝ’রে ঝ’রে পড়েছিল বৃষ্টির দানা।

























খাঁচা

শাহানা আকতার মহুয়া



আমাকে দিয়েছ অশেষ আকাশ, দিয়েছ ওড়ার ডানা,

দিয়েছ নিপাট মুক্তির গান সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে

তার ওপারের বিহ্বলতায় নিজেকে জড়াতে মানা

আকাশ পেরিয়ে মহাকাশে যাবে কল্পিত রথে ভেসে।



অকরুণ হাতে এঁকেছ নিখাদ সময়ের কারুকল্প

কৃষকের মতো মাটির প্রতি মমতার সামিয়ানা,

আমার ভেতরে ছড়িয়েছ যত প্রাণপুরুষের গল্প

তাকে ছাড়া কোনো বিহ্বলতায় নিজেকে জড়াতে মানা।



হামাগুড়ি দিয়ে আঁধারেরা আসে, বিপন্নতার কালে

দলে দলে আসে পক্ষীসকল খুঁটতে শস্য দানা

আমাকে ঢেকেছো আচ্ছাদনেÑ পুঞ্জিত মেঘদলে

আমার আকাশেই উড়বো আমি; অবারিত হতে মানা!



করাত-বাতাসে ফালা ফালা হয় গহীনের স্বাধীনতা !

আদিম আকাশ ছাড়িয়ে দূরেÑ বহুদূর বুনোদেশে

পড়ে আছে কত ধুলি-কঙ্কর, কুসুমের ব্যাকুলতা

‘খুলে দাও ডানা’Ñ খুঁজে নেব তাই অদ্ভূত ভালবেসে।













অসুখ





আপাত: সাবলীল আর সুখময়

মানুষের ভেতর অসুস্থ এক মানুষ

অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাতরায়।

রাবারের ঠোঁটভরা বিম্বিত হাসি

ডালিম ফুলের মতোই প্রজ্জ্বোল খুব।

চোখে থাক অলীক যন্ত্রণায় মেঘ

মেঘ নিয়ে অতশত খোঁচাখুঁচি নেই!



মাথার ভেতরে ঢুকে যায় প্রমত্ত আকাশ;

মাথার ভেতরে পাক খায়

শকুনের ছায়া,

গভীর নিঃশ্বাসের মতো

পবিত্র স্তবের মতো উঠে আসা

নিঃস্ব ভালবাসা আর আজন্ম তৃষ্ণায়

বিক্ষত মানুষের শরীর আর শরীর থাকে না।

আত্মায় অসুখ পুষে

হেসে হেসে ঘুরে বেড়ায় অসুস্থ মানুষ।























বৃষ্টি

বৃষ্টি আমার মুগ্ধ চোখে প্রেমের স্মরণগাথা

মেঘ-বালিকার লুকিয়ে রাখা জলের রঙিন খাতা।





তুমি আসবে বলে কাল সারারাত মেঘ-মেয়েরা হাসছিল

চালসে ছাদের আলসে জুড়ে মল্লার-রাগ ভাসছিল।

আকাশ চিরে ঝলসে ওঠা পুরাণগাথার বিদ্যুতে

ব্যাকুলতায় হাত বাড়ালাম একটুখানি তোমায় ছুঁতে।



কাল সারারাত কী যাতনায় গুমড়ালো ঝড়-হাওয়া!

আমার সকল আবেগ কেবল তোমায় কাছে পাওয়া।

ভাবনা বিলাস তোমার জন্য নীল ময়ূরীর সাজ

তোমার জন্য শিব ঠাকুরের থই থই যত নাচ।



তমালের মতো নিকষ রাতে তারাদের অভিমানে

জ্বালেনি তো আলো জোনাকির মেয়ে নির্জনতার গানে।

হাত পেতেছিÑ জলধারা দাও অভূত প্রেমের মন্ত্রণা

জলের কাব্যে প্রশমিত হোক গুপ্ত প্রণয়ের যন্ত্রণা।





















ক্রান্তিকাল





হয়তো দেখা হবে ফের

এ অপেক্ষোয় কোনো মিথ্যে নেই;

ভ্রান্তির ঘেরাটোপ নেই



কতকিছূ হারিয়েছি!

ক্রমাগত হারিয়েছি শৈশবের সরলতা

ঘুমভাঙা বিছানায় ব’সে

অলৌকিক স্বপ্ন খুঁজে খুঁজে কেটে গেছে

বিপন্ন ভোর...



পাঁজরভাঙা দীর্ঘশ্বাসে আমার সোনালি দিনগুলো

ক্ষ’য়ে গেলেও আমি জানি

অসম্ভবকে বুকে পুষে ক্রমশ নিঃস্ব হ’লেও

বৃষ্টির জন্য ব্যাকুল নিসর্গের মতো

আমি জানি দেখা হবে ফের!

























অথৈ দিনের গান



সকল মানুষই জানি নিয়তির দাস

তবুও রক্তে-রন্ধ্রে জমে গভীর বিশ্বাস





ঈশ্বর কোথায় থাকেন, কোথায় বসতি

কোথা থেকে ঢেলে দেন তোষণের রতি!

তিনি তো ঘুমন্ত বোধ গ্রন্থের মাজে

একান্ত উপাসনা মায়াবতী সাঁঝে

ঈশ্বর কোথায়!Ñ এই বোধনের কালে

কেন এতো আসক্তি আঁধার-পাতালে

ঘোলাজলে হাবুডুবু দিনান্তের ত্রাসে

ক্লান্তির পালক ঝ’রে বিনমিত ঘাসে।

সকল কুহক ঠেলে, নির্জনে-আঁধারে

একাকী মুখোমুখি নিজের ভেতরে।



ঈশ্বর, যদি তুমি সর্বদ্রষ্টা হও

জানি তবে কোনো মিথ্যায় অবলুপ্ত নও

আমি তো আরুণি নইÑ নেই কোনো বাঁধ

তাই তো হারিয়েছি সকল প্রবাদ।

হায় ঈশ্বর, অবরুদ্ধ শিল্পগ্রামে এসোÑ

উপবীতে-দ্রাক্ষা রসে-জলপদ্মে ভেসো।

যতই আড়াল তোলে মহামায়ালোক

ছ্য়াামন্ত্রে উপচে ওঠে প্রলম্বিত শ্লোক।



নমিত করপল্লব, নির্জনতার গান বাজে বুকের ভেতরÑ

একান্ত সুরের মতো সেখানেই গুঞ্জরিত বিধাতার স্বর।









অনির্ধারিত শূন্যপথে





সহজ কথা আর সহজ থাকে না!

নিজের ভেতরে বারংবার

সংলাপের কলাকৈবল্য নিরাপদ যদিও

তবে অর্থহীন খুব!

হস্তরেখার মতো ক্রমশ জটিল হ’য়ে ওঠা

অন্তহীন কথামালা

বুক থেকে উঠে আসে এবং

ফিরে যায় আবারও উৎরোল ঢেউয়ের মতো।



মাথার ভেতরে ফের কুয়াশা জমে!

অসহজ মানসচরিত বোঝে না কেউ;

কেবলি মর্মপীড়নের কাব্যপাঠÑ

অথৈ ক্লান্তির নুন-জলে জ্বালা করে

পোড়া আর পচাগলা শরীর।



লিরিকের সাথে মিশে যায় বন্ধুর মুখ

জলের কাগজে আঁকা ছবি

মিশে যায় জলের ছায়ায়; আর

দুর্বোধ্য চিত্রলিপির মতো মানুষ

ক্রমশ আরো জটিল হ’য়ে ওঠে...





বিভ্রম



চোখের পাতায় সপ্ত-সাগর, গ্রীবায় শালুক ফোটে

সারা শরীর ঝমঝমিয়ে রোদন বেজে ওঠে।

সবাই যখন মোহর খোঁজে মোহন গীতিকায়

আমি তখন দু’চোখ মুছি তোমার অবজ্ঞায়।

প্রসাধনের ছায়ায় বসে পাটরানীরা হাসে

শূন্য-রেখায় তখন আমার দিনরাত্রি ভাসে।

সবার ভেতর একলা হয়ে নিজেকে খুঁড়ে আর

উজান স্রোতের পলকা-ঝিনুক ভাসি বারংবার।

পেঁচক-রাতে বাতাস যেন গমকে ওঠে ভ্রমে

আমার শিথিল-শিকলটাতে লাল মরিচা জমে।



আমি তোমার রোদসী নই, কাক্সিক্ষত নই মোটে

সংশুদ্ধির পদ্ম তবু নিলাজ-জলে ফোটে।





































জলগাত্রের বান্ধব



হাতের উল্টোপিঠে এককণা জল ঝ’রেছিল।

একবিন্দু শিশিরের মতো টলমলে জল

সহজিয়া আমন্ত্রণে ছুঁয়েছিল বিবশ অধর।

ওরকম স্বপ্নের মতো ঘোর লাগা দেশে

স্বপ্নের মানুষেরা ঘোরাফেরা করেÑ

বাতাসে ছড়িয়ে থাকে হাস্যকলধ্বনি;

ডানা থেকে ঝ’রে পড়া বেদনার্ত পালক আর

শীতের ঝুরঝুরে পাতায় অব্যক্ত যন্ত্রণা

কুড়িয়ে কুড়িয়ে জড়ো করি একলা নদীতীরে।



ঝিরির কাকচক্ষু জলে ধুয়ে নিই

অপলক মুগ্ধতার আলো,

প্রভুর নামে উৎসর্গীকৃত এই আলো

আটকে থাকে পাহাড়ের খাঁড়িতে;

বনকুমারীরা দোলাচলে ভুলে যায়

এই বনভুমি, এই অরণ্যবাসে

অবিনশ্বর প্রাপ্তি লুকিয়ে আছে।



হয়তো ভুলে যাওয়া স্বজনের মুখ অথবা

ঠিক তেমন কিছুই নয়Ñ

হঠাৎ আছড়ে পড়া আবেগের ঢেউ

এককণা জল হয়ে ঝ’রে পড়েছিল

হাতের উল্টোপিঠে।















৫ জুন



সেই অদ্ভূত রাতে উত্তাল বৃষ্টি হয়েছিল খুব

শেষ বর্ষণ ঝ’রেছিল যেন ম্লান শিউলির মতো

হাওয়ায় হাওয়ায় ময়ূরীরা ছিল পাখা মেলে নিশ্চুপ

প্রকৃতিও তাই শিহরণময় বিস্ময়ে অবনত।



চাঁদ-রমণীর ঠোঁটেও তখন ভেজা শিউলির ঘস্খাণ

কামনার মতো ফুটেছে কোথাও কামিনীরা থোকা থোকা,

দু’হাতে ঠেলে নির্জন রাত মেঘও ছোটে আপ্রাণÑ

পূবের আকাশে তখন কেবল স্বপ্নের কাচপোকা।



তখন কেবল মুখোমুখি বসে স্বপ্নের কথকতা

গোলাপি চাদরে ফুটে আছে জুঁই এলোমেলো, চুপিসারে

খোলা জানালায় ভিজে হাওয়া ঢোকে সাথে নিয়ে ঝরাপাতা

টুংটাং বাজে সোনার কাঁকন শেষরাত্রির পাড়ে।



স্বপ্নেরা যেন হারিয়েছে পথ পিচ্ছিল সেই পথে

ঘুরে মরে তাই আঁচলের ভাঁজে নীল নক্ষত্রমালা,

লজ্জার সাথে ঝরে ঝরে পড়ে আলো কোন্ দ্বৈরথে

জলমত্ত মন্থনে ভাসে রাধার অধরা জ্বালা।



একা হয়ে যায় হাওয়ায় হাওয়ায় ব্রীড়াময়ী অপ্সরী!

কেউ মেলে ধরে আস্থা এবং অভয়দানের হাত!

মধুবনে কোনো নিশাচর খোঁজে পথহারা জলপরী

পরিত্রাণের সাথে সাথে ফেরে নিস্ফলা সংঘাত।



আরো রাত আসে, আসে আরো দিন প্রকৃতির ভেজা খামে

হাসির আড়ালে শুকিয়ে যে যায় বেদনার সাদা নুন

অভয়মন্ত্র পরিণতি পায় অপভ্রংশের নামে

বাঁশরিয়াদের আড়বাঁশিতেও নীরবে জমেছে ঘুণ।









ব্যাকুলতা সব মুছে গেছে কবে সময়ের ধুলো জমে

নদীরাও তাই ঘুরিয়েছে মুখ নিয়মের কথা মেনে,

অবসাদ আর ক্লান্তি ছূঁয়েছে অুল বালুকার ওমে

বৃষ্টিও তাই আসে না এপথে বিষময় হবে জেনে।



কামিনী অথবা বেলীরাও ফোটে মুখরিত সকরুণ

সোনার শিকলে বাঁধা পড়ে থাকে একাকী ৫ই জুন।

































বিপ্রতীপ বাসনার ফুল



এ রকম গল্প তো অনেকই হয়।

তারুণ্যের অভিমান অতিক্রান্ত হওয়ার পর

এভাবে নিজেদের খুঁড়ে খুঁড়ে বেহদ্দ হবার বাসনা

কখনো কখনো প্রবল হয় বটে

তবে ঘুমন্ত কুহকী পাখিদের পুনরায়

ঘুমিয়ে রাখাই ভালো।

পূর্বস্মৃতির সুখে বেশি আক্রান্ত হলে

ধ্বসে যেতে পারে সাম্রাজ্যের নড়বড়ে ভিত।



সুখের ক্লান্তিতে আড়ষ্ঠ হয়ে থাকা

তোমার চোখের ভাষাতত্ত্ব

বোঝার সাধ্য নেই আজ আরÑ

সিঁথির মতোই ক্রমশ চওড়া হয়ে গেছে

দূরত্বের ধূসরিত পথ। পরিশ্রান্ত পরিজনদের জন্য

রেখেছ তুলে শুশ্রƒষার আলো,

এতোসব আয়োজন; মৃগয়ায় সেজে আছে

পিপাসু যোদ্ধার দল।



তুমি কেন চাঁদের কথা ভাবো, করঞ্জা

ফুলের মতো দূরবর্তী রমণীর কথা ভাবোÑ

গবই তো পাওয়া যায় ওয়েবসাইটের নেশালু শরীরে।

বোতলে ভরে নিয়ে তীব্র কটাক্ষ

নিশিথ-নারীরা বড় অধীর-ব্যাকুল

এসময় জ্যোৎøার শ্যাম্পেন চাইলে

ক্ষুব্ধ হবে চাঁদের বুড়ি।













অনভিপ্রেত



হাসি আর হর্ষদের সাথে বাস করতে করতে

ওরা কি রকম ন্যাওটা হয়ে উঠেছে;

পোষা সাপের মতো সেই যে জড়িয়ে ধরেছে

ভনিতার গ্রীবাÑ তারপর থেকে কেবলই

অভব্যতার কাটাকাটি খেলা।

তোমার ক্রুদ্ধ ছুরির পোঁচে যখন

খ’সে পড়ে আমার খণ্ডিত আঙুল,

জলের ফিনকিতে ছিটকে প’ড়ে

চোখের দু’একটি পলকা পাপড়ি

বড় বিব্রতকরভাবে হাসি তখন কামড় দেয়

নীলচে ঠোঁটে।



যেবার সুখের পায়রাগুলো বিদায় নিল

ছটফট করে, শোচনীয় বিষাদে যখন

বিধ্বস্ত আমার ধূসর উঠোন আর আমি

মরিয়া হয়ে খুঁজছি গিরিবাজের ফেলে যাওয়া পালকÑ

তখন অসম্ভব যন্ত্রণা গিলে হর্ষরা হেসে ওঠে

মেঘমন্দ্রা নারীর মতো।



Ñসেই থেকে মাটি আর জলধারা হ’য়ে

আমার সাথে তারা শূন্যতা ভাগাভাগি করে।















দ্বীপের মানুষ, মানুষের দ্বীপ





প্রতিটি আজব দ্বীপে মানুষের ঘর

সেই ঘরে লুকোচুরি, অযাচিত স্বর।

প্রতিটি মানুষ যেন জলে-ডোবা দ্বীপ,

বাঁধি ঘর, ঘরে ঘরে মানস-প্রদীপ।

খুলে যায়, ভেঙে যায় বোধের বিভাব

দ্বীপের মানুষ ভাবে খেয়ালের পাপ!



একাকী দাঁড়ানো দ্বীপে, নীরব অধীর

নিজেকে হারিয়ে ফেলি ব্যগ্র-বধির।

তারপর সরে যায়, সরে যায় ঢেউ...

একাকী দাঁড়ানো দ্বীপে আর নেই কেউ!

সময় বুঝিয়ে দেয় একেলা সবাই

নিজে ছাড়া আর কোনো বান্ধব নাই।

ভিড়ের প্রাকারে মানুষ একাকীই থাকে,

একলা দ্বীপের মতো বসতিকে ডাকে।































ছায়া

শাহানা আকতার মহুয়া



সে যেন তীব্র রাতের মতো ছুঁয়েছে বুকের পাশ

গ্রীবার ভাঁজে টের পাই তার সুগভীর নিঃশ্বাস।

টের পাই তার ঠোঁটের মুদ্রা লোনা সাগরের জলে

তুড়ি দিয়ে নাচি শঙ্খবালিকা জালিবোনা ছায়াতলে।



শুকনো বকুল মুখ টিপে ঠিক তারই মতো ধুম হাসে,

মুদ্রা-ময়ূরী ঝমঝম নাচে অকারণ উচ্ছ্বাসে।

সখ্যতা তার রাত্রির সাথে, বিদিশার সাথে আরÑ

কবিতার মতো নারীদের সাথে ঢলাঢলি বেশুমার।



হ্যাঁচকা টানে খুলে দিয়ে সেই ডাকিনীর থোকা চুল

ঘ্রাণ টেনে নিত প্রকৃতির মতোÑ শিহরিত সঙ্কুল।

চোখের তারায় সুনিবিড় কোনো বেদনা ঘনিয়ে এলে

বন্ধুর মতো মেঘেরা তখন রেশমের ছায়া মেলে।



বেদনার বালি সরিয়ে যখন তুলে আনি সেই মুখ

ভরা কোটালের স্রোতে ভেসে যায় বেলাভূমি উৎসুক।





বাঁধ এবং বধিরতা

শাহানা আকতার মহুয়া



শেষরাত্রির অপলক চোখে ছায়া ছায়া ভোর কাঁপে

ফুটে ওঠে চোখে ধ্র“ব-লহরা উদয়-তারার ফুল,

দায় ও দেনার দিশাহীন ক্রোধ জ্বলে ওঠে অপলাপেÑ

দীর্ঘরাতের দীর্ঘকথিকা ছিঁড়ে আনে বোধিমূল।



এখনও তোমার হাতের বাঁধনে রক্তিম সাদা হাত

নীল শিরাগুলো ফুলে ফুলে ওঠে জলছায়াভেজা ঘামেÑ

এখনও চোখের পাপড়িতে বাঁধা জলোচ্ছ্বাসের বাঁধ

তুমি কেন কাটো অদ্ভূত বোধ ব্যবচ্ছেদের নামে?



একলব্যের দুরাশা চোঁয়ানো সোমরস করে পান

চন্দনবনে কেঁপে কেঁপে ওঠা হতাশার নীল সুরে,

কিভাবে বাঁধো মধুবতী সুর, অবিনাশী সেই গানÑ

সে সুরে পোড়ে রাতের কাব্য আঁধার রাজ্য জুড়ে।



শেষ হ’য়ে আসে পুরনো অধ্যায় মৃত আবেগে-শোকে,

পরাপ্রকৃতির বেদনা-বান্ধব ঝ’রে নশ্বরলোকে।



















ধুমপর্ব



যদি বলি, এভাবে নিজেকে আড়াল তোমার অভিপ্রেত নয়?

এই যে এতোসব আয়োজন, ঘাটে ঘাটে কুমারীরা ধরে আছে

মঙ্গলঘট, ব্যাকুল শঙ্খ।

এমন নিস্তরঙ্গ জলের মতো অধীর হয়ে আছ

ভেতরে প্রবল পতনের ঝুঁকি নিয়ে।

লোকালয় নেই বলে গাঁয়ের একলা ভিটেয় দাঁড়ানো ঘরখানা

রোদে-জলে আরো বেশি জবুথবু হয়ে ওঠে,

খ’সে পড়ে কড়ি-বর্গা উই আর ঘুনপোকার একনিষ্ঠ উৎসবে।

একফালি প্রিয়তোষ ভূমি চলে যায় অন্যের দখলে।



যোগাযোগহীনতায় মরিচা জমে ওঠে বন্ধুত্বের অভিমানী শিকলে।

এইভাবে জমতে জমতে নাগরিক ধুলো, একসময় খেয়ে নেবে

বুকের খাঁচায় পোষা স্বেচ্ছাসেবী পাখিটাকে, খেয়ে নেবে

টলটলে জলাধারা, পুষ্পারতির পরমায়ু। ধোঁয়াশার কল্কিতে টান দিয়ে

আরো বেশি বুঝিয়ে দেবে দিশাহীন দারিদ্র।

অকারণে পিছু ফিরে দেখা

হতাশ্বাসের দিঘিতে ঢিল ছুঁড়ে অযথাই জাগিয়ে তোলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ

সেই ঢেউ নড়ে উঠবে পেটের খোঁড়লে বেড়ে ওঠা শিশুটির মতো।



তারপর! চিত্রার্পিত কোমলগান্ধার।

তারপর নিথর নিঝুম দোজখের ঘুম!





চাঁদবেনে



খুব তো গমক দেখাও!

ক্ষুব্ধ ঢেউয়ের মতো

ছুটে যাও সাগরের বুকে।

ভরা গাঙে ছুটে যায় ভরা সম্পানÑ



বণিক তুমি শুধু বাণিজ্যই জানো!



চাঁদবেনে তুমি জানো রাজ্যপাট

কতদূরে কোন্ বাঁকে মুদ্রাদেবীর হাট!

কড়ির সুনাম জানো, আরো জানো

কড়ি কীর্তনÑ

চাঁদবেনে তুমি তো জানোনি কখনো

তৃষাতুর হৃদয় কতো একরোখা হয়!

উপেক্ষার আগুনে জ্বলে মনসারা কতো

আলোড়িত হয়।

বণিক তুমি শুধু পণ্যের বেসাতিই জানো

জানো না কো দুর্লভ তাঁতের বয়ন

বোঝোনি তো পদ্মার বিষের ওজন



একরোখা চাঁদবেনে, মনসাও জেদী



গাঙুরে ভেসে যায় লখাইয়ের শব

বেহুলা বসনে ভাসে দেব-কলরব।





বালিকা



শাহানা আকতার মহুয়া



বালিকা তোমার কাচের চুড়িতে বেলোয়ারি-বন্ধন

ঘরকন্নার সাথীরা সবাই বেঁধেছে আপন ঘর,

স্মৃতির উনুনে এখনো তোমার ধুলোবালি রন্ধন

তোমার উঠোনে সজীবতাহীন কেন এই বালুচর?



কন্যা, তোমার শৈশব কেন টেনে রাখে হুতাশনে

বিছানায় খোঁজো চেনা গন্ধের জুঁই-যুথিকার মালা,

নিজেকে পুড়িয়ে সৌধের ভিত গড়ে তোলো আনমনে

তবু কেন খোলো প্রতিদিনই সেই স্মৃতিদের পাঠশালা?



বালিকা, তোমার জলময় চোখে হারানো দিনের ছবি

কেঁপে কেঁপে ওঠে চেনা কোনো মুখ বন্ধ কপাট খুলে

সেই বেদনায় ম্লান হয়ে যায় নিশ্চলা জল-রবি;

লতাদের মতো নুয়ে আসে মন সকল আড়াল ভুলে।



কত যুগ গেল বালিকা তবুও করছো হৃদয়ে বাস

যতদিন যায় ততই যেন বা ব্যাকুলতা বাড়ে ক্রমেÑ

বেপথু দিনেরা পায়রার মতো খুঁটে আনে ফুল-ঘাস

কত যুগ গেল স্বপ্নের খোঁজে; মায়া-মৃগয়ার ভ্রমে!















চাঁদবেনে

শাহানা আকতার মহুয়া





খুব তো গমক দেখাও!

ক্ষুব্ধ ঢেউয়ের মতো

ছুটে যাও সাগরের বুকে।

ভরা গাঙে ছুটে যায় ভরা সম্পানÑ



বণিক তুমি শুধু বাণিজ্যই জানো!



চাঁদবেনে তুমি জানো রাজ্যপাট

কতদূরে কোন্ বাঁকে মুদ্রাদেবীর হাট!

কড়ির সুনাম জানো, আরো জানো

কড়ি কীর্তনÑ

চাঁদবেনে তুমি তো জানোনি কখনো

তৃষাতুর হৃদয় কতো একরোখা হয়!

উপেক্ষার আগুনে জ্বলে মনসারা কতো

আলোড়িত হয়।

বণিক তুমি শুধু পণ্যের বেসাতিই জানো

জানো না কো দুর্লভ তাঁতের বয়ন

বোঝোনি তো পদ্মার বিষের ওজন



একরোখা চাঁদবেনে, মনসাও জেদী



গাঙুরে ভেসে যায় লখাইয়ের শব

বেহুলা বসনে ভাসে দেব-কলরব।





উৎসমুখ



খুব প্রিয় হয়ে ওঠা মানুষদের বেশি কাছে যেতে নেই

কেননা তাতে জ্বলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকেÑ

ক্লিশে হয়ে যাওয়া এই সরল সত্যটা বারবার আবিষ্কার করি

নিজেরই আড়ষ্ঠ হয়ে ওঠা আত্মক্লেশ থেকে।

চান্দ্রেয়ী সকল বাসনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে

ক্ষমাহীন নিয়তির মাঝি

হাতে তুলে দিয়েছে এক অদ্ভূত বৈঠার বোঝা।

আঁধার ঘন হলে সবাই ডুবে যায়

ঘনঘোর স্বপ্নের স্রোতে, থিকথিকে লাভাস্রোতেও

খুঁজে পায় আগুনের মমতাÑ

আর এই মায়াবী নদীর স্রোতে আমি বৈতরণী কিনার খুঁজি।

নিরাপদ কোনো নদীকূল খুঁজি।

সারি সারি পাথরের মুখ ঝলসে ওঠে উৎসমুখে; অগ্নিমুখে,

বরফশীতল চোখে দুলে ওঠে কুচি কুচি করুণ ছায়া।



প্রকৃত সত্তা কবেই তো হারিয়েছে তারা

লোভের সোনালি আপেল খুঁজতে গিয়ে।

কখনো কখনো আসে আগুনের বার্তাবাহক

পৃথক কিছু অভিবাসী।



বৈঠাটা পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে তাদের

আগুনের দাহে। ইচ্ছে করে ফিরে যাই আগুনের মমতায়।

অথচ সে আগুনে বিশ্বস্ততা নেই!

পৃথিবীর মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসে

তারা প্রলুব্ধকের হাতছানিতেÑ

অথবা এমনো তো হতে পারে প্রিয় হয়ে ওঠা এইসব

মানুষগুলো নিজেরাই জ্বলে যায় উল্কার মতো।











রাই-রজনী







রাই, চলো যাই কৃষ্ণসখার কৃষ্ণনদী তটে

বিনোদিনী-জ্যোৎøা দেখো ঝরছে নিরন্তর

কৃষ্ণ ও মুখ দেখছ বসে ভরা-জলের ঘটে

তোমায় টেনে রাখছে কেন মনপোড়ানো ঘর!



মোহনবাঁশি খুঁজছে তোমায় পদ্মনীলা রাতে

কুঞ্জতলে কৃষ্ণ দেখো খুঁজছে একা ওইÑ

গোপনারীরা ডাকছে আকুল জ্যোৎøাধারার সাথে

রাই চলো যাইÑ যাই গো চলো বকুলবোনের সই।



আয়ান ঘোষের মস্ত ঘরে পুড়ছে রাধা বিষে

অযুত চোখের দৃষ্টিতে সব ছুরির বাঁকা হাসি;

জলজোছনায় রাধার চোখের ব্যাকুল ছোঁয়া মিশে

তমালবনের মাতাল বাতাস ঢালছে বিষাদ-রাশি।



রাধার চোখে রাত্রিশেষের আঁধার নেমে আসে



কৃষ্ণ একা কুঞ্জতলে সাজায় তাসের ঘর

আয় রাধিকাÑ বিষ-নিয়তির অগ্নিদেবী হাসে;

সেই আগুনে জ্বলছে রাধা, পুড়ছে নিরন্তর।



















বিভ্রম





চোখের পাতায় সপ্ত-সাগর, গ্রীবায় শালুক ফোটে

সারা শরীর ঝমঝমিয়ে রোদন বেজে ওঠে।

সবাই যখন মোহর খোঁজে মোহন গীতিকায়

আমি তখন দু’চোখ মুছি তোমার অবজ্ঞায়।

প্রসাধনের ছায়ায় বসে পাটরানীরা হাসে

শূন্য-রেখায় তখন আমার দিনরাত্রি ভাসে।

সবার ভেতর একলা হয়ে নিজেকে খুঁড়ে আর

উজান স্রোতের পলকা-ঝিনুক ভাসি বারংবার।

পেঁচক-রাতে বাতাস যেন গমকে ওঠে ভ্রমে

আমার শিথিল-শিকলটাতে লাল মরিচা জমে।



আমি তোমার রোদসী নই, কাক্সিক্ষত নই মোটে

সংশুদ্ধির পদ্ম তবু নিলাজ-জলে ফোটে।

































বালিকা





বালিকা তোমার কাচের চুড়িতে বেলোয়ারি-বন্ধন

ঘরকন্নার সাথীরা সবাই বেঁধেছে আপন ঘর,

স্মৃতির উনুনে এখনো তোমার ধুলোবালি রন্ধন

তোমার উঠোনে সজীবতাহীন কেন এই বালুচর?



কন্যা, তোমার শৈশব কেন টেনে রাখে হুতাশনে

বিছানায় খোঁজো চেনা গন্ধের জুঁই-যুথিকার মালা,

নিজেকে পুড়িয়ে সৌধের ভিত গড়ে তোলো আনমনে

তবু কেন খোলো প্রতিদিনই সেই স্মৃতিদের পাঠশালা?



বালিকা, তোমার জলময় চোখে হারানো দিনের ছবি

কেঁপে কেঁপে ওঠে চেনা কোনো মুখ বন্ধ কপাট খুলে

সেই বেদনায় ম্লান হয়ে যায় নিশ্চলা জল-রবি;

লতাদের মতো নুয়ে আসে মন সকল আড়াল ভুলে।



কত যুগ গেল বালিকা তবুও করছো হৃদয়ে বাস

যতদিন যায় ততই যেন বা ব্যাকুলতা বাড়ে ক্রমেÑ

বেপথু দিনেরা পায়রার মতো খুঁটে আনে ফুল-ঘাস

কত যুগ গেল স্বপ্নের খোঁজে; মায়া-মৃগয়ার ভ্রমে!







ছায়া



সে যেন তীব্র রাতের মতো ছুঁয়েছে বুকের পাশ

গ্রীবার ভাঁজে টের পাই তার সুগভীর নিঃশ্বাস।

টের পাই তার ঠোঁটের মুদ্রা লোনা সাগরের জলে

তুড়ি দিয়ে নাচি শঙ্খবালিকা জালিবোনা ছায়াতলে।



শুকনো বকুল মুখ টিপে ঠিক তারই মতো ধুম হাসে,

মুদ্রা-ময়ূরী ঝমঝম নাচে অকারণ উচ্ছ্বাসে।

সখ্যতা তার রাত্রির সাথে, বিদিশার সাথে আরÑ

কবিতার মতো নারীদের সাথে ঢলাঢলি বেশুমার।



হ্যাঁচকা টানে খুলে দিয়ে সেই ডাকিনীর থোকা চুল

ঘ্রাণ টেনে নিত প্রকৃতির মতোÑ শিহরিত সঙ্কুল।

চোখের তারায় সুনিবিড় কোনো বেদনা ঘনিয়ে এলে

বন্ধুর মতো মেঘেরা তখন রেশমের ছায়া মেলে।



বেদনার বালি সরিয়ে যখন তুলে আনি সেই মুখ

ভরা কোটালের স্রোতে ভেসে যায় বেলাভূমি উৎসুক।







অনভিপ্রেত



হাসি আর হর্ষদের সাথে বাস করতে করতে

ওরা কি রকম ন্যাওটা হয়ে উঠেছে;

পোষা সাপের মতো সেই যে জড়িয়ে ধরেছে

ভনিতার গ্রীবাÑ তারপর থেকে কেবলই

অভব্যতার কাটাকাটি খেলা।

তোমার ক্রুদ্ধ ছুরির পোঁচে যখন

খ’সে পড়ে আমার খণ্ডিত আঙুল,

জলের ফিনকিতে ছিটকে প’ড়ে

চোখের দু’একটি পলকা পাপড়ি

বড় বিব্রতকরভাবে হাসি তখন কামড় দেয়

নীলচে ঠোঁটে।



যেবার সুখের পায়রাগুলো বিদায় নিল

ছটফট করে, শোচনীয় বিষাদে যখন

বিধ্বস্ত আমার ধূসর উঠোন আর আমি

মরিয়া হয়ে খুঁজছি গিরিবাজের ফেলে যাওয়া পালকÑ

তখন অসম্ভব যন্ত্রণা গিলে হর্ষরা হেসে ওঠে

মেঘমন্দ্রা নারীর মতো।



Ñসেই থেকে মাটি আর জলধারা হ’য়ে

আমার সাথে তারা শূন্যতা ভাগাভাগি করে।











বৃষ্টির কাল





সে রাতে বৃষ্টি ছিল খুব!

কখনো মুষলধারে

কখনো বা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দ

আর সব কি রকম চুপ!



কেবল কোলাহল যত আমার ভেতর

বালুকাবেলায় কাঁপা ঘনতরুবিথীÑ

কেবল পাঁজর জুড়ে বৈশাখী ঝড়

বয়ে যাওয়া উন্মনা প্রণয়ের তিথি।



তখন বৃষ্টির কোনো ছিল না ঠিকানাÑ

তোমার বিদ্যুত-চোখ

আর আমার লুপ্ত চেতনায়

ঝ’রে ঝ’রে পড়েছিল বৃষ্টির দানা।

























অসুখ





আপাত: সাবলীল আর সুখময়

মানুষের ভেতর অসুস্থ এক মানুষ

অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাতরায়।

রাবারের ঠোঁটভরা বিম্বিত হাসি

ডালিম ফুলের মতোই প্রজ্জ্বোল খুব।

চোখে থাক অলীক যন্ত্রণায় মেঘ

মেঘ নিয়ে অতশত খোঁচাখুঁচি নেই!



মাথার ভেতরে ঢুকে যায় প্রমত্ত আকাশ;

মাথার ভেতরে পাক খায়

শকুনের ছায়া,

গভীর নিঃশ্বাসের মতো

পবিত্র স্তবের মতো উঠে আসা

নিঃস্ব ভালবাসা আর আজন্ম তৃষ্ণায়

বিক্ষত মানুষের শরীর আর শরীর থাকে না।

আত্মায় অসুখ পুষে

হেসে হেসে ঘুরে বেড়ায় অসুস্থ মানুষ।









রাই-রজনী

শাহানা আকতার মহুয়া





রাই, চলো যাই কৃষ্ণসখার কৃষ্ণনদী তটে

বিনোদিনী-জ্যোৎøা দেখো ঝরছে নিরন্তর

কৃষ্ণ ও মুখ দেখছ বসে ভরা-জলের ঘটে

তোমায় টেনে রাখছে কেন মনপোড়ানো ঘর!



মোহনবাঁশি খুঁজছে তোমায় পদ্মনীলা রাতে

কুঞ্জতলে কৃষ্ণ দেখো খুঁজছে একা ওইÑ

গোপনারীরা ডাকছে আকুল জ্যোৎøাধারার সাথে

রাই চলো যাইÑ যাই গো চলো বকুলবোনের সই।



আয়ান ঘোষের মস্ত ঘরে পুড়ছে রাধা বিষে

অযুত চোখের দৃষ্টিতে সব ছুরির বাঁকা হাসি;

জলজোছনায় রাধার চোখের ব্যাকুল ছোঁয়া মিশে

তমালবনের মাতাল বাতাস ঢালছে বিষাদ-রাশি।



রাধার চোখে রাত্রিশেষের আঁধার নেমে আসে

কৃষ্ণ একা কুঞ্জতলে সাজায় তাসের ঘর

আয় রাধিকাÑ বিষ-নিয়তির অগ্নিদেবী হাসে;

সেই আগুনে জ্বলছে রাধা, পুড়ছে নিরন্তর।

















বালিকা

শাহানা আকতার মহুয়া





বালিকা তোমার কাচের চুড়িতে বেলোয়ারি-বন্ধন

ঘরকন্নার সাথীরা সবাই বেঁধেছে আপন ঘর,

স্মৃতির উনুনে এখনো তোমার ধুলোবালি রন্ধন

তোমার উঠোনে সজীবতাহীন কেন এই বালুচর?



কন্যা, তোমার শৈশব কেন টেনে রাখে হুতাশনে

বিছানায় খোঁজো চেনা গন্ধের জুঁই-যুথিকার মালা,

নিজেকে পুড়িয়ে সৌধের ভিত গড়ে তোলো আনমনে

তবু কেন খোলো প্রতিদিনই সেই স্মৃতিদের পাঠশালা?



বালিকা, তোমার জলময় চোখে হারানো দিনের ছবি

কেঁপে কেঁপে ওঠে চেনা কোনো মুখ বন্ধ কপাট খুলে

সেই বেদনায় ম্লান হয়ে যায় নিশ্চলা জল-রবি;

লতাদের মতো নুয়ে আসে মন সকল আড়াল ভুলে।



কত যুগ গেল বালিকা তবুও করছো হৃদয়ে বাস

যতদিন যায় ততই যেন বা ব্যাকুলতা বাড়ে ক্রমেÑ

বেপথু দিনেরা পায়রার মতো খুঁটে আনে ফুল-ঘাস

কত যুগ গেল স্বপ্নের খোঁজে; মায়া-মৃগয়ার ভ্রমে!



ডযধঃ পধহ ুড়ঁ ফড় রিঃয ঃযব হবি ডরহফড়ংি খরাব? ঋরহফ ড়ঁঃ

1 টি মন্তব্য:

  1. সুখ পাখি


    সুখে আছে যারা সুখে থাক তারা
    সুখ পাখি রে সুখকে ভুলে যেও না।

    আমি যে সুখের লাগিয়া কাঁদি ফিরি
    সুখ পাখি রে কেবা চিনি সুখের তরি।

    অন্ধ হয়েছে আমার অন্তরখানা অন্তরা
    আঁধারের জ্বালা অবুঝ হৃদয় বুঝে না।

    অন্যালোকে চক্ষু খোলে এখনও চাহনিতে অশ্রু ঝড়ে
    আঁধারের আলো আঁধারে করে আরো কালো।

    সুখে আছ সুখে থাক বার মাস
    সুখের লাগিয়া কাঁন্দা কিবা লাভ।

    ও মায়া ও মায়া ও যে মায়া মমতার খেলা
    কায়া বিবিকে হার মানায় তুমি যে জয়া।

    উত্তরমুছুন